অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব-২

0
1232

সবাই মিলে ওরা অনেক্ষণ ঘুরাঘুরি করে সাথে কিছু খাওয়াদাওয়া। পুরো সময়টাতেই রিখিয়ার বারবার মনে হচ্ছিলো কেউ ওদের উপর নজর রাখছে অনেকবার পেছন ফিরে খুজেছেও কিন্তু তেমন কাউকেই পায়নি। তাই পরে আর বিষয়টা নিয়ে অতোটা মাথা ঘামায়নি।

সকাল থেকেই আকাশটা বেশ স্বচ্ছ ছিলো, মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলোনা যেখানে সেখানে হুট করেই আকাশটা এখন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। যেকোন সময়ই মুষলধারে বৃষ্টি নামতে পারে।
তাই আর বেশি দেরি না করে পেছনের গেইটটা দিয়ে বেরিয়ে ওরা সবাই রিকশা নিয়ে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। খালি রিকশা পেতে অতোটা সমস্যা হয়নি তবে সমস্যা একটাই পূবালী চত্বরের ওখানে সবসময় জ্যামে পড়তে হয়। আজ ভাগ্য ভালো রাস্তায় গাড়ি কম থাকায় ওখানে অতোটা জ্যাম ছিলোনা। রেললাইন ক্রস করে কিছুদূর সামনে এগুতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।

রিকশার হুড তুলে, কোলের উপর পলিথিনের কাগজটা দিয়েও তেমন একটা লাভ হচ্ছেনা। হালকা বৃষ্টির ছাট এসে রিখিয়া আর অর্ণা দুজনকেই ভিজিয়ে দিচ্ছে।
রিকশা এসে গলির সামনে থামে। এখান থেকে একটুখানি সামনে হেটেই যেতে হবে ওদের। গলিটা সরু হওয়ায় রিকশা আর ভেতরে যেতে পারবেনা।

বৃষ্টিতে ভিজলেই রিখিয়ার জ্বর চলে আসে। তাই ও হতাশভাবে আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টি শুরু হলো তো হলোই থামার কোন নামই নেই।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে নামতে যাবে ঠিক তখনই কোথা থেকে ছাতা মাথায় পিচ্ছি একটা ছেলে ছুটে আসে। রিখিয়ার হাতে দুটো ছাতা গুঁজে দিয়ে যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই আবার ছুটে চলে যায়। রিখিয়া আর অর্ণা কিছু বুঝে উঠার আগেই ছেলেটা চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো। আর ওরা

________________

অর্ক সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নেয় অফিসে আজ জরুরি মিটিং আছে। যাওয়ার আগে মায়ের কাছে যেতে ভুলেনা। মায়ের ঘরের সামনে গিয়েই ওর চোখ থেকে কয়েকফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে। ওর চঞ্চলমতি মাকে এভাবে বিছানায় অসাড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওর ভেতরটা কষ্টে দুমড়েমুচড়ে উঠে।

সেদিনের পর থেকেই ওর মা প্যারালাইজড হয়ে গেছে, হাটাচলা করতে পারেনা। পা ছাড়া বাকি সব অঙ্গানুই সচল আছে।
অর্ক হাক পেরে ডেকে উঠে,
— “এই রিনি! মায়ের খাবারটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।

রিনি দৌড়ে রান্নাঘরে ওর মায়ের কাছ থেকে ফারজানা বেগমের নাশতার ট্রেটা নিয়ে আসে।

রিনির মা ট্রেতে করে অর্কের জন্যেও টোষ্ট আর মাল্টার জুস দিয়ে দেন। উনি খুব ভালো করেই জানেন এখন অর্ক মায়ের সামনে খাবার খাওয়া নিয়ে কিছুতেই না করতে পারবেনা। নয়তো প্রায়ই না খেয়েই অফিসে চলে যায়। সারাক্ষণ কাজের মাঝেই ডুবে থাকে ছেলেটা।

রিনি ওর মায়ের থেকে ট্রেটা নিয়েই বড় বড় পা ফেলে ফারজানা বেগমের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

নাশতার ট্রেটা টি-টেবিলে রেখেই রিনি অর্ককে বলে,
— “ভাইজান মা আপনাকে এই টোষ্ট আর মাল্টার জুসটা খেয়ে নিতে বলছে। ”

রিনির কথা শুনেই অর্ক রিনিকে ধমকে বলে উঠে,
— “এই তোকে না কতোবার বলেছি ভাইজান ডাকবিনা ভাইয়া বলে ডাকবি আমাকে।”

রিনি নিজের মাথায় নিজেই একটা চাটি মেরে বলে সরি ভাইয়া মনেই থাকেনা আমার, আর এমন ভুল হবেনা।”

অর্ক এসে রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আচ্ছা নিচে যা গিয়ে তুই আর খালা নাশতাটা করে নে।”

রিনি আচ্ছা বলেই রুমের বাইরের দিকে পা বাড়ায়।

রিনি চলে যেতে নিলেই অর্ক ওকে আবার ডেকে বলে,
” এই শোন। তুই যেন কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলি? ”

” অইতো ভাইয়া ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলাম এরপরেতো বাবা আর পড়তে দেয়নাই। অই বুইড়া খাট্টাস ব্যাটার সাথে বিয়ে ঠিক করছিলো। আপনি তখন না গেলে কি যে হতো! ”

সেদিনের কথাটা মনে পড়তেই অর্ক একটা হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে। একটা বাচ্চা মেয়ে বয়স বড়জোর পনেরো হবে। বাবা হয়ে কি করে নিজের মেয়েকে তার বাবার বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিলো সেটাই ও ভেবে পায়না।

অর্ক রিনিকে বলে, ” আচ্ছা ঠিক আছে, বাদ দে ওসব। তোর স্কুল থেকে সব কাগজপত্র আমি আনিয়ে নেবো। তারপর তোকে এখানের একটা স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দেবো। তুই আবার পড়াশোনা করবি। ”

অর্কের কথা শুনে খুশিতে রিনির চোখে পানি চলে আসে। আচ্ছা এখনকার দিনেও বুঝি এমনো মানুষ হয়। কই ওর নিজের বাবাই তো ওকে টাকার জন্য বুড়ো নেশাখোর একটা লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো। কৃতজ্ঞতায় ওর চোখ ছলছল করে উঠে।
রিনি আর কিছু না বলে নিঃশব্দে ওখান থেকে প্রস্থান করে।

অর্ক গিয়ে ওর মায়ের মাথার কাছে বসে। ওর মাকে আধশোয়া ভাবে শুইয়ে দিয়ে খাবারের ট্রে থেকে ওর মায়ের জন্য বানানো খাবারগুলো নেয়। আস্তে আস্তে মাকে নিজ হাতে সবটা খাবার খাইয়ে দেয়। খাইয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলেই ফারজানা বেগম ওর হাতটা ধরে ওকে আটকে নেয়।

চোখের ইশারায় ট্রেতে থাকা অর্কের খাবারগুলো দেখায়। অর্ক একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে আচ্ছা ঠিক আছে আমি নিচে গিয়ে খাচ্ছি।
কিন্তু অর্কের মাও নাছোড়বান্দা ছেলেকে নিজের সামনে বসিয়ে রেখেই খাওয়াবেন। অর্ক অগত্যা আর কথা না বাড়িয়ে দুইটা টোষ্ট কোনরকম খেয়ে জুসটা খেয়ে নেয়।
ফারাজানা তার শাড়ির আচলটা দিয়ে ছেলের মুখে লেগে থাকা জুসটুকু মুছে দেয়।

অর্ক মায়ের কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।

_______________

রিখিয়া আর অর্ণা কলেজের দিকেই যাচ্ছিলো তখনই ওদের সামনে এসে একটা সাদা রঙের গাড়ি এসে থামে। গাড়িটা দেখেই রিখিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
গাড়িটি থেকে ৫’৭” উচ্চতার ফরসামতন সুদর্শন একটি ছেলে নেমে আসে। ছেলেটাকে বেরুতেই রিখিয়া দৌড়ে গিয়ে তাকে ঝাপটে ধরে বলে, ‘ আই মিসড ইউ দাভাই।’

রিখিয়ার কথাটা শেষ হতেই ছেলেটা হালকা অভিমানের সুরে বলে, ‘ তাই বুঝি দাভাইকে একটাবার ফোন করার সময়টুকুও হয়না তোর। ‘

রিখিয়া নিজের এককান ধরে বলে, ‘ সরি দাভাই। এদুদিন আমার একদমই খেয়াল ছিলোনা। এই যে কান ধরে ক্ষমা চাইছি এমনটা আর কক্ষনো হবেনা। তবে তুমিওতো কল করতে পারতে, নাকি? ‘ এবার রিখিয়ার গলায়ও হালকা অভিমানের সুর শুনা গেলো।

‘ আরে আমিতো বান্দরবন ছিলাম ব্যবসার কাজে। কাজের ফাকে একফোঁটা বিশ্রামের সময়ও পায়নি। আজই ফিরলাম, আর দেখ এসেই সোজা আমি আমার ছুটকির কাছে চলে এসেছি। ‘

রিখিয়ার এতক্ষণে অর্ণার কথা মনে পড়লো। অর্ণাকে দেখিয়ে বললো, ‘ দাভাই ও হলো….. ’

রিখিয়াকে কথাটা শেষ না করতে দিয়েই রায়ান বললো, ‘ অর্ণা, রাইট? ‘

রিখিয়া সরুচোখে নিজের দাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ তুই চিনলি কি করে। ‘

রায়ান আমতাআমতা করে বললো, ‘তোর মুখে এতবার ওর বিবরণ শুনেছি যে না চিনে উপায় আছে নাকি! ‘

‘ অহ তাই বল। ‘

রায়ান অর্ণার দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে বললো, ‘ হাই! আমি রায়ান, রিখিয়ার ওয়ান অ্যান্ড অনলি দাভাই। ‘

রায়ানের হাত স্পর্শ করতেই অর্ণার শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো, এ যেন অন্য এক অনুভূতি। তবে কেন এমনটা হলো তা ওর জানা নেই।

রায়ান রিখিয়াকে বললো, ‘ তা সকালে ব্রেকফাস্ট করেছিস তো নাকি? ‘

রিখিয়া বললো, ‘ আসলে দাভাই, আজকে আমাদের দুজনেরই ঘুম থেকে উঠতে লেইট হয়ে গেছে তাই আর করা হয়নি। তবে আমরা ক্যান্টিনে গিয়েই করে নিবো। তুমিওতো বোধহয় এখনো কিছু খাওনি, চলো আজ আমরা সবাই একসাথেই নাশতাটা সেরে নেই। ‘

তারপর ওরা তিনজনে মিলে ক্যান্টিনে বসে হালকা কিছু খেয়ে নেয়।

রিখিয়া আর অর্ণা ক্লাসে চলে যায় আর রায়ানও ওদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে চলে যায়। লং জার্নি করে এসেছে এখন ফ্রেস হয়েই একটা লম্বা ঘুম দিবে।

______________

এদিকে অর্ক অফিসে পৌঁছেই কারো নাম্বারে একটা ফোন লাগায়। অপর পাশ থেকে ফোনটা ধরতেই অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করে, ‘ কোন কিছু কি জানতে পেরেছিস ওদের ব্যাপারে? ‘

‘ হ্যা ওরা বান্দরবন যেখানে ছিলো সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওরা নাকি সেখান থেকেও কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শিফট করে গেছে। আমার মনে হয়, আগেরবার ওদের উপর যে অ্যাটাকটা হয়েছিলো সেখান থেকেই ওরা সতর্ক হয়ে গেছে। আমাদেরকেও এখন যা করতে হবে ভেবেচিন্তেই করতে হবে। প্লানমাফিক সামনে এগুতে হবে। হটকারিতা করা যাবেনা। ‘

অর্ক বলে, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বরং এখন একটু বিশ্রাম কর। রাখছি, বায়। ‘

(চলবে)———-

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here