ভার্সিটিতে আসার পর সব বন্ধুরা মিলে ক্যান্টিনে বসেছে। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ কফি, কেউবা হালকা নাশতা করছে। খেতে খেতেই সবাই আড্ডা দিচ্ছে।
রিখিয়া অনেকক্ষণ যাবৎ খেয়াল করছে অর্ণা অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছে। তবে এতো মনোযোগ দিয়ে ও কি এমন ভাবছে সেটাই কিছুতে বুঝতে পারছিনা।
এদিকে অর্ণার মাথায় বারবার শুধু রায়ানের কালকের বলা কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। রায়ানকে যতটুকু চিনেছে এতে ওর কাছে ভালোই লেগেছে। তবে ওদের মতো মিডেলক্লাস ফ্যামিলির মেয়েদের যে বড় কোন স্বপ্ন দেখতে হয়না। পরে শুধু কষ্টই পেতে হয়। এখন কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা। রায়ান যদি এসে ওর কাছে জবাব চায় কি বলবে তখন? এসব চিন্তায় ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে। আর তাছাড়া রায়ানের পরিবার কি কখনো মেনে নেবে ওকে? কি দরকার এতসব ঝামেলায় জড়ানোর তারচেয়ে এমনিতেই তো বেশ আছে।
সব ভাবনাচিন্তা সাইডে রেখে সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিলো। সবাই মিলে ঠিক করলো আজ স্টার ক্যাফেতে গিয়ে ছোট করে রিখিয়ার জন্মদিন সেলিব্রেট করবে ওরা। রিখিয়াও আজ আর কাউকে বাধা দিলোনা।
যথারীতি ওরা ক্লাস করতে চলে গেলো।
ক্লাস শেষে বেরুতে গেলেই আকাশ এসে রিখিয়ার পথ আটকায়। আকাশকে দেখেই বিরক্তিতে রিখিয়া চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই এই আকাশ নামক অসভ্য সিনিয়র ওর পেছনে পড়ে আছে। বারবার রিজেক্ট করার পরেও আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিখিয়ার পেছনেই বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। সিনিয়র বলে কেউ আকাশকে কিছু বলার সাহসই পাচ্ছেনা তারউপর আবার রাজনীতেও যুক্ত আছে।
আজকের দিনে রিখিয়া কোন ঝামেলা করতে চায়না। তাই আকাশকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। তবে কথায় আছেনা কুকুরের লেজ বারোমাস চুঙার ভেতর ঢুকিয়ে রাখলেও তার লেজ কখনো সোজা হয়না। আকাশের স্বভাবটাও সেই কুকুরের মতোই।
আকাশ ঝট করেই রিখিয়ার বা হাতটা টেনে ধরে ওকে আটকে ফেলে। অর্ণার তো ভয়ে কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে। রিখিয়া এবার কি করবে সেটা অর্ণা খুব ভালো করেই জানে।
আকাশ হাত ধরার রাগে রিখিয়ার সমস্ত শরীর রি রি করছে। এক ঝটকায় আকাশের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে ডান হাত দিয়ে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেয় আকাশের গালে।
” ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ মি এগেইন! ” কথাটা বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না সেখানে।
রিখিয়া হনহন করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। ওর পিছুপিছু বাকিরাও চলে আসে।
অন্যদিকে রাগে আকাশের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। হাতের আঙ্গুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে বলে, ” কাজটা তুমি ভালো করলেনা রিখিয়া। এর শাস্তিতো তোমাকে ভোগ করতেই হবে। ”
————-
ক্যাফেটেরিয়া তে আগে থেকেই কেক অর্ডার দেওয়া ছিলো। কেক কেটে সবাইকে রিখিয়া খাইয়ে দেয়। বাকিরাও ওকে খাইয়ে দেয়। তবে খাওয়ার চেয়ে একে অন্যের গালে কেক মাখামাখি টাই বেশি করেছে ওরা। নিজের জন্মদিনে রিখিয়াকে এতোটা হাসিখুশি এবারই প্রথম দেখছে অর্ণা। আনন্দে অর্ণার চোখের কার্নিশে অশ্রুকণারা এসে জমাট বাধে।
তারপর সবাই মিলে পিৎজা আর ফালুদা অর্ডার করে। স্টার ক্যাফের ফালুদা আর পিৎজা দুটোই অসাধারণ স্বাদের। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট করে। তারপর কুমিল্লার ময়নামতিতে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে। এটা ছিলো রিখিয়ার পক্ষ থেকে সবার জন্য ট্রিট।সত্যি বলতে আজ অনেক দিন পর রিখিয়া প্রাণ খুলে একটু আনন্দ করলো। ঘুরাঘুরি শেষে ওরা যে যার বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
—————
অর্কের একমাত্র দুর্বলতা ওর মা আর রিখিয়া। মাতো ওর সাথেই আছে। কিন্তু ওর শত্রুরা যাতে রিখিয়ার কোন ক্ষতি করতে না পারে তাই সর্বক্ষণ রিখিয়াকে নজরে রাখার জন্য নাঈম নামের ছেলেটাকে ঠিক করেছে। নাঈম ওর খুবই বিশ্বস্ত তাই এই কাজে নাঈমকেই নিযুক্ত করেছে। রিখিয়া নিজেও জানেনা যে ওর উপর চব্বিশ ঘণ্টা কেউ নজর রাখছে।
নাঈমের কাছ থেকে আজকের দুপুরের ঘটনার বিবরণ শুনে রাগে ওর চোখ দুটি রক্তলাল হয়ে উঠে। মনে হচ্ছে যেন এখনই ঐ আকাশকে নিজের সামনে ফেলে চোখের আগুনেই ওকে ভস্ম করে দেবে।
————
আকাশ ওর বন্ধুবান্ধবদের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হতে চলেছে। তাই আর দেরি না করে বাইক নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
সুযোগ বুঝে নিরিবিলি রাস্তা থেকে অর্কের লোকেরা আকাশকে তুলে নিয়ে আসে।
আকাশ কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা। হুট করে কোত্থেকে কিছু কালো মুখোশদারি লোক এসে ওকে কেন তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই ও বুঝতে পারছেনা।
ওর তো কারো সাথে কোনপ্রকার শত্রুতা নেই তাহলে এরা কার লোক? এসবই ভেবে চলেছে আকাশ। অন্ধকার রুমে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা চেয়ারের সাথে বেধে রাখা হয়েছে ওকে।
ওকে ক্লোরোফরম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছিলো এখনো তার রেশ রয়ে গেছে। হালকা ঝিমুনি ভাবটা রয়ে গেছে। ওর সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সেটা বুঝতে পেরেও মুখ তুলে তাকায়না। হঠাৎ এক বালতি ঠাণ্ডা পানি কেউ ওর মুখে ছুড়ে মারে।
ঠাণ্ডায় আকাশের কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে কারণ পানিটা ছিলো একেবারে বরফগলা ঠাণ্ডা পানি।
অর্ক আকাশের চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে বলে, “তোর সাহস হলো কি করে ওকে টাচ করার? তাও আবার ওর অনুমতি ছাড়া। ”
আকাশের মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। কে এই লোক? নিজের চেহারাও মুখোশের ভেতর আড়াল করে রেখেছে। কণ্ঠটাও কখনো শুনেছে বলে মনে হয়না। আর লোকটা কার কথা বলছে সেটাও ও বুঝতে পারছেনা। কোনরকম কাঁপাকাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
” আপনি কার কথা বলছেন? ”
সামনে দাঁড়ানো লোকটা একটা গগনবিহারী হাসি হাসে। তার হাসিতে সারা রুমে মনে হয় একটা কম্পন বয়ে গেলো। আর ভয়ে আকাশের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।
” এর মাঝেই ভুলে গেলি? আচ্ছা কোন ব্যাপার না। আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি। রিখিয়াকে মনে আছে? ”
এবার আকাশ ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে। লোকটা রিখিয়াকে চেনে কেমন করে? তাহলে কি ওরা বন্ধুরা মিলে রিখিয়াকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্লানটা করেছে সেটাও লোকটা জানে? অজানা ভয়ে আকাশের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে।
অর্ক এসে আকাশের ডান হাতের বাঁধনটা খুলে দেয়, এই হাত দিয়েই ও আজ ওর রিখিয়ার হাত ধরেছিলো। অর্ক আর যাইহোক ওর রিখিয়াকে কেউ স্পর্শ করবে সেটা ও সহ্য করতে পারবেনা। অর্ক আকাশের ডানহাতটা মোচড় দিয়ে ধরে। আকাশ একটা গগনবিদারী চিৎকার দেয়। আকাশের মনে হচ্ছে ওর হাতটা বুঝি ভেঙ্গেই গেছে। বেশ অনেকটা সময় পর অর্ক আকাশের হাতটা ছেড়ে দেয়।
আবার আকাশকে আগের মতো বেধে রেখে আসে। কয়েকদিন খাবার দাবার না দিয়ে এভাবেই আটকে রাখবে ওকে।
আর আকাশের বন্ধুদেরও একটা শিক্ষা দিতে হবে। ওদের প্লানের সবটাই অর্কের কানে এসেছে। রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
(চলবে)———
জাহানারা রিমা