অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব – ৬

0
962

দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে অর্ক।
আগে আকাশের বন্ধুদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ওরা যেকোন সময় রিখিয়ার জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে।

———–
আকাশের বন্ধুরা কলেজের মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। সবাই আকাশকে নিয়ে খুব চিন্তিত। আকাশ কলেজেও আসেনি, তারউপর ওরা বারবার কল করেও আকাশকে পাচ্ছেনা। অন্যান্য দিন আকাশই সবার আগে ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকে।

বেশ কিছুটা সময় পর আকাশের ফোন থেকে ওর বন্ধু পলাশের ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।
ম্যাসেজটা ছিলো এরকম,
” পলাশ তুই সবাইকে নিয়ে …… ঠিকানায় চলে আয়। কালকের প্লানটা নিয়ে জরুরি কিছু কথা আছে। ”

তারপর বাইক নিয়ে ওরা সব বন্ধুরা মিলে আকাশের দেওয়া ঠিকানায় চলে যায়। জায়গাটা হচ্ছে একটা খোলা মাঠের মতো। অনেকটা পরিত্যক্ত বলা যায়। প্রায় আধাঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তাও আকাশের আসার কোন নাম নেই। ওরা তিন বন্ধু যেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হবে তখনই ওরা ওদের পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখে ওদের প্রত্যেকের পেছনেই দুজন করে মোট ছয়জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাও প্রত্যেকের মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। পরনেই কালো রঙের পোশাক। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই ওদের পেছনে দাঁড়ানো লোকগুলো হকিস্টিক দিয়ে ওদেরকে বেধরকভাবে মারতে থাকে। হাত পায়ের জয়েন্টে বেশি আঘাত হানছে ওরা। জায়গাটা নিরিবিলি হওয়ায় ওদের আর্তচিৎকার মাঠের বাইরে যাচ্ছেনা।
ওদেরকে এমনভাবে মেরেছে যে একমাস আগে বিছানা ছেড়েই উঠতে পারবেনা। তারপর ঐ লোকগুলি আবার ওদেরকে নিজেদের গাড়ি করে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে আসে। সেই সাথে তাদের হসপিটালের সমস্ত বিলও অগ্রিম পেমেন্ট করে দেয়।

অর্ক নাঈমের কাছ থেকে সবটা জেনে তারপর খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়। আর মনে মনে বলে, ” আমি তোর উপর কোন আঁচ আসতে দেবোনা বুচি। কেউ তোর কোন ক্ষতি করতে চাইলে তার এমন হাল করবো যে দুদিনপর নিজেকেই নিজে চিনতে পারবেনা। তোকে ছোঁয়া তো দূর তোকে ছোঁয়ার কথা যে মাথাতেও আনবে তার হাল আমি বেহাল করে ছেড়ে দেবো। ”

আকাশকে তিনদিন আটকে রেখে তারপর ছেড়ে দেয় অর্ক। এ তিনদিনে ওকে খাওয়ার জলটাও কেউ দেয়নি।

আকাশের অবস্থা অনেকটাই খারাপ। হাত পায়ের বাধনের জায়গাগুলোতে কালশিটে পড়ে গেছে। এর মাঝে দ্বিতীয়দিন সেই মাস্ক পড়া লোকটা এসে ওকে একটা মোটা লাঠি দিয়ে হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালিতে বেধরক পিটিয়েছে। ব্লেড দিয়ে শরীরের অনেক জায়গায় আচড় দিয়েছে। তারপর আবার সেই কাটা জায়গায় লবণ দিয়ে দিয়েছে। আকাশ গলা কাটা মুরগির মত ছটফট করেছে। তাও সামনের মানুষটার মনে কোন দয়া হয়নি।

————–
রিখিয়া আর অর্ণা মাত্রই ক্লাশ শেষে বের হলো। এখনো ক্যাম্পাসেই আছে ওরা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন বন্ধুরা মিলে ক্লাসের কিছু নোটস নিয়ে আলোচনা করছিলো। হঠাৎ রিখিয়ার চোখ যায় সামনে। সামনের মানুষটাকে দেখে ওর চক্ষু চড়কগাছ। এ সময়ে ওর দাভাই এখানে কেন এসেছে সেটাই ওর মাথাতে ঢুকছেনা। রিখিয়ার ভাবনাচিন্তার মাঝেই রায়ান এসে ওদের পাশে দাঁড়ায়। রিখিয়ার মাথায় একটা চাটা মেরে বলে, ” কিরে ছুটকি কেমন আছিস? ”

রিখিয়া রায়ানের দিকে গরমচাহনি নিক্ষেপ করে বলে, ” ভালো। কিন্তু তুমি এসময়ে এখানে কেন? ”

রায়ান আমতাআমতা করে বলে, ” এমনি। তোকে দেখতে ইচ্ছে হলো আর চলে এলাম। ”

রিখিয়া কিছুক্ষণ সন্ধিহান ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে, ” আচ্ছা ঠিক আছে। চলো মোড়ালে গিয়ে বসে আড্ডা দেওয়া যাবে। ”

রিখিয়া অর্ণা আর ওর বাকি বন্ধুদের নিয়ে মোড়ালের দিকে অগ্রসর হয়। পেছন পেছন রায়ানও আসে। বঙ্গবন্ধু মোড়ালে শহীদ মিনার থাকায় সম্মান প্রদর্শনার্থে সবাই পায়ের জুতোগুলো খুলে একটা সাইডে রেখে দেয়। কিছুটা ছায়াযুক্ত স্থান দেখে একে একে সবাই বসে পড়ে। রায়ান, রিখিয়া আর অর্ণা পাশাপাশিই বসেছে। সবাই মিলে টুকটাক নানা ধরনের কথা বলে আসরটালে জমিয়ে দিচ্ছে। রিখিয়ার বন্ধুদের মাঝে একজন আছে টাইগার যে খুব ভালো কৌতুক বলতে পারে। ওর সত্যিকারের নাম টাইগার নয় ভালো নামও একটা আছে বাপ্পি। তবে বন্ধুমহলে ও টাইগার নামেই পরিচিত। ওকে টাইগার ডাকতে ডাকতে ওর সত্যিকারের নামটাও মনে হয় ওর বন্ধুরা ভুলে গেছে। ও একটু পরপর একেকটা কৌতুক বলছে আর বাকিরা সবাই হেসে একে অপরের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঠিক মিরাক্কেলে যেমনটা দেখে থাকে ঠিক তেমনই ধরন ওর কৌতুক বলার। হাসিঠাট্টা শেষে ওরা সবাই আবার আড্ডায় মেতে উঠে।

রিখিয়া কথা বলতে বলতে রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে রায়ান অর্ণার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তা দেখে ও খানিকটা মুখ টিপে হাসে। অন্যদিকে অর্ণার দিকে তাকালে দেখতে পায় অর্ণা লজ্জাবতী লতিকার মতো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আবার একটু পরপর আড়চোখে ও নিজেও রায়ানকে দেখছে। এক পলক দেখেই আবার চোখ নামিয়ে ফেলছে।।
রিখিয়া দুষ্টুমি করে রায়ানকে কাঁধ দিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বলে, ” কিরে দাভাই? কোথায় হারিয়ে গেলি তুই? মনে তো হয়না তোর মনোযোগ এখানে আছে? তা মনটা কোথায় বন্ধক রেখে এসেছিস বলতো? ”

রায়ান রিখিয়ার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে,
” খুব পেকে গেছিস দেখছি আজকাল। দাঁড়া মাকে বলে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ”

” এ্যাহ! বললেই পারো যে নিজে বিয়ে করতে চাও। সেটা বলতে লজ্জা পাচ্ছো তাই আমাকে দিয়ে বুঝাচ্ছো। আমিতো সুজি, একটু হলেও বুঝি। ”

রিখিয়ার এমন কথা শুনে রায়ান খুকখুক করে কেশে উঠে। ঠিক কি বলবে এখন সেটাই বুঝতে পারছেনা। তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করলো।

————
অর্ক ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে। কিভাবে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায়না। খুব তাড়াতাড়ি তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর জানতে হবে কেন এমনটা করলো সে ওদের সাথে? ওরা তো কেউই তার কোন ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন? এই কেন এর উত্তর খুব তাড়াতাড়ি ওকে খুঁজে বের করতে হবে। ঐ কালপ্রিট টার মুখ থেকেই সব উগড়াতে হবে। অতীতের সব হিসেব মিলিয়ে তারপরই ওকে সকলের সামনে আসতে হবে। এখন চাইলেও কারো সামনে যেতে পারবেনা। ওর আর ওর মায়ের বেঁচে থাকার কথাটা একমাত্র রায়ানই জানে। বাকিদের জানালে সেও জেনে যেতে পারে, পরে হয়তো আবার অ্যাটাক করে বসতে পারে। সেবার ভাগ্যের জোরে বেচে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন আর কোন রিস্ক নিতে চায়না। এ পৃথিবীতে এখন আপন বলতে একমাত্র ওর মা’ই আছে।

———–
রিখিয়া ওর ঘোড়াটা নাড়াচাড়া করছে। পাশেই অর্ণা বসে বসে এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করছে। রিখিয়ারটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। হঠাৎ অর্ণার ফোনটা বেজে উঠলে রিখিয়া উঠে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসে। অর্ণার বাবা ফোন করেছে। অর্ণা তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করে। উপাশ থেকে অর্ণার বাবা কি বললো বুঝা গেলোনা। তবে অর্ণার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে আনন্দের কোন সংবাদ। অর্ণা ফোনটা রেখেই খুশিতে রিখিয়াকে ঝাপটে ধরে। আচমকা এমন আক্রমণে রিখিয়া প্রায় পরেই যাচ্ছিলো পরে পাশের চেয়ারটা ধরে কোনরকম নিজেকে সামলে নেয়।

রিখিয়ার প্রশ্নবোধক চাহনি বুঝতে পেরে অর্ণা বলে, ” রাহিপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে রিখি। পরশু গায়ে হলুদ তার পরদিন বিয়ে। আমাদেরকে কালকেই চলে যেতে বলেছে। ”

” আমাদেরকে মানে। ”

” আমাদেরকে মানেটা আবার কি? আমার বোনের বিয়ে আর তুই যাবিনা? তুইও যাচ্ছিস কালকে আমার সাথে। আর এটাই ফাইনাল। ”

রিখিয়া অর্ণার গাল টেনে বলে, ” ওকে, ওকে আমার গোলুমলু বান্ধবীটা। ”

তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।
তবে সামনে যে ওদের জন্য নতুন এক ঝড় অপেক্ষা করছে।

(চলবে)————

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here