অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব ১০

0
1030

” মা! তুমি যদি অর্ণাকে ঢুকতে না দাও তাহলে কিন্তু দাভাই, আমি আর অর্ণা তিনজনেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। ”

মিসেস শাহিদা রিখিয়ার কান টেনে ধরে বলেন,
” অর্ণা কিরে? ভাবী বল ওকে। এখন কিন্তু ও তোর একমাত্র ভাইয়ের বৌ হয়, কথাটা মাথায় রাখিস। ”
উনার কথা শুনে উপস্থিত আর সবার চোখগুলো রসগোল্লার মত বড় হয়ে যায়। সকলের অবস্থা দেখে মিসেস শাহিদা আর নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলেন না। তার হাসি দেখে সকলের চক্ষু ছানাবড়া। কারোরই আর বুঝতে বাকী নেই যে এতক্ষণ উনি মজা করছিলেন।

অর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ” কিরে ভয় পেয়ে গেছিলিস বুঝি? রিখিয়ার মতো তুইওতো আমার আরেকটা মেয়ে। তোকে মানতে আমার সমস্যা কেন হবে? ”

অর্ণাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসানো হয়। রিখিয়ার দাদী অর্ণার সাথে গল্পে মেতে উঠেন। এ মেয়েটাকে উনার শুরু থেকেই বেশ পছন্দ। কেমন শান্তশিষ্ট আর মিষ্টভাষী একটা মেয়ে।

মিসেস শাহিদা রাহেলাকে পাঠান ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসতে। এমন সময় ওদের বাড়ির কেয়ারটেকার সেলিম দুই হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে ভেতরে আসে। দুটো ব্যাগ ভর্তি তাজা ফুল। শাহিদা ভ্রু কুঁচকে বলেন, ” তুই কি করে জানলি যে এখন আমি তোকে ফুল আনতে পাঠাতাম? ”

” খালাম্মা এগুলাতো আমি আনি নাই। রায়ান ভাইয়ের সাথে উনার যে বন্ধু আইছিলো উনি দিয়া গেছেন। ”

রায়ান বিস্মিতভাব নিয়ে বললো, ” অর্ক! ”

রায়ানের কথা কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাতেই রিখিয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করে, ” কি নাম বললে তুমি? ”

” আবব… অ অ অ অয়ন ”

” কিন্তু ”
” কি কিন্তু কিন্তু করছিস বলতো? ওর কাণ্ডটা দেখ একবার। ”

মিসেস শাহিদা সেলিমকে বলেন রায়ানের ঘরটা গিয়ে সাজিয়ে দিতে।

রিখিয়া সেলিমকে আটকে দিয়ে বলে, ” আমি সাজাবো। তুমি শুধু আমাকে হেল্প করবে। ”

রায়ানের দাদী উনার বৌমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ” বিয়েটা তো কাউকে না জানিয়ে যেনতেন ভাবে হয়ে গেলো। তবে সবাইকে তো জানাতে হবে। কি করা যায় বলোতো? ”

” মা, আমি ভাবছিলাম কি রায়ানের বাবার সাথে কথা বলে কালকে সন্ধ্যায় একটা রিসেপশনের ব্যবস্থা করবো। আপনি কি বলেন? ”

” কিন্তু একদিনে সব ব্যবস্থা করবে কি করে? ”

” মা, এখনকার দিনে এসব নিয়ে কোন সমস্যা হয়না। ওয়েডিং প্ল্যানাররাই সব করে ফেলবে। আমাদেরকে শুধু আজকে সবাইকে ইনভাইট করার কাজটা সেরে ফেলতে হবে।

————–
রিখিয়া ফুলগুলো দিয়ে খুব সুন্দর করে রায়ানের ঘরটা সাজিয়েছে। ফুলগুলোর সাথে কিছু রঙ্গিন মোমবাতিও ছিলো সেগুলোও খুব সুন্দরভাবে ঘরের সব কর্ণারে জ্বালিয়ে দিয়েছে। মোমবাতিগুলোর পাশে কিছু গোলাপের পাপড়িও ছিটিয়ে দিলো।
সাজানো শেষ হলে পুরো ঘরটাকে একবার ভালোভাবে পরখ করে নিলো। না বেশ ভালোই লাগছে দেখতে।

অর্ণাকে গেস্টরুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে নেয়। অর্ণাকে নিয়ে রিখিয়া গেস্টরুমেই ডিনার সেরে নিয়েছে।
ডিনার শেষে অর্ণার পরনের বিয়ের শাড়িটা পালটে একটা খুব সুন্দর মেরুন রঙের হাফ সিল্ক শাড়ি ওকে পড়িয়ে দেয়। এ কাজটা রিখিয়া খুব ভালোই পারে। শাড়িটাতে অর্ণাকে বেশ মানিয়েছে। রিখিয়া এটা ওর মায়ের কাছ থেকে এনেছে। সাথে কিছু অর্নামেন্টসও নিয়ে এসেছে। শাড়ি পড়ানো হয়ে গেলেই ও অর্ণাকে হাল্কা সাজে সাজিয়ে দেয়। কারণ অর্ণা বরাবরই হাল্কা সাজ পছন্দ করে। তারপর একে একে সবগুলো অর্নামেন্টস ওকে পড়িয়ে দেয়।
সব সাজ কমপ্লিট হলেই অর্ণাকে লজ্জা দেওয়ার জন্যে বলে, ” কিরে আজ তো মনে হয় আমার ভাইটাকে মেরেই ফেলবি। যা লাগছে না তোকে! আমিই তো ফিদা হয়ে গেলাম। দাভাইয়ের যে কি হবেনা আমি শুধু সেটাই ভাবছি। হার্ট এটাক না করে বসে আবার। ”

তখন পেছন থেকে দাদীর গলা শোনা যায়, ” এই বুচি একদম আমার নাতবৌয়ের পেছনে লাগবিনা বলে দিলাম। ”

বুচি নামটা শুনতেই রিখিয়ার হাসিহাসি মুখে অন্ধকার নেমে আসে।
এ নামে ওকে আরো একজন ডাকতো। তার কথা মনে পড়তেই ওর চোখগুলো ভিজে আসতে চাইলো।

দাদী হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললেন, ” আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র নাতির একটা মাত্র বউ। একদম আমার নাতবৌকে লেগফুল করবিনা। তুইতো বিয়ে করে পরের বাড়ি চলে যাবি। অবশ্য তোর মত বাচাল মেয়েকে কে বিয়ে করবে? ”

দাদীর কথায় রিখিয়া রেগেমেগে বলে, ” বুড়ি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি একদম আমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা। আমি বাচাল তুমি কি হ্যা? যে একটা চেহারা আমার দাদা বলে তোমাকে বিয়ে করেছে বুঝেছো নয়তো সারাজীবন আইবুড়োই রয়ে যেতে। ”

রিখিয়ার কথা শুনে ওর দাদী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। এভাবে না বললে মেয়েটা মনমরা হয়েই থাকতো।
” কি এতো বড় কথা। তোকেতো আমি….. ”

এর মাঝেই মিসেস শাহিদা ওখানে চলে আসেন।

” কিরে রিখি তোদের শেষ হয়নি এখনো? কটা বাজে দেখেছিস। ”

” না, মা। আমাদের তো সেই কখনই হয়ে গেছে। মাঝখান থেকে এই বুড়িটাই এসে পেঁচাল পাড়ছে। ”

” কি এতো বড় কথা আমি বুড়ি? ”

রিখিয়া মুখ ভেঙছে বলে, ” বুড়ি নওতো কি ছুড়ি? নিজেকে কি ছুড়ি ভাবছো নাকি তুমি? হুম! ”
ওদের দাদী নাতনির তর্ক বিতর্ক চলছেই থামার নামই নেই। অর্ণা আর মিসেস শাহিদা নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে শুধু সবটা।

মিসেস শাহিদা আর না পেরে দুজনকেই ধমকে চুপ করে দেয়। শাশুড়ি কে নিজের সাথে নিয়ে যায়। আর রিখিয়াকে বলে, অর্ণাকে রায়ানের ঘরে দিয়ে আসতে।

—————–
রায়ান আর অর্ক ফোনে কথা বলছে।
” অর্ক আ’ম শিউর কালকে ও এখানে আসবেই। বাবা আর মা আমাদের বিয়ে উপলক্ষে কালকে একটা গ্র‍্যান্ড রিসেপশনের আয়োজন করেছে। আর সেখানে সে আসবেনা তা তো হতে পারেনা। এটা আমাদের কাছে অনেক বড় একটা চাঞ্চ। যেভাবেই হোক কাজে লাগাতেই হবে। ”

” হুম তুই ঠিকই বলেছিস। তবে এখন এসব কথা বাদ দে। নতুন জীবন শুরু করতে চলেছিস আজ বরং শুধু সেটা নিয়েই ভাব। অল দ্য বেষ্ট। রাখছি। বায়। ”

রায়ান এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। রুম থেকে আওয়াজ আসতেই দেখে রিখিয়া অর্ণাকে নিয়ে এসেছে। অর্ণাকে খাটের উপর বসিয়ে দিয়েই রিখিয়া চলে যায়।

অর্ণার দিকে রায়ান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে।

রায়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ণা বেশ লজ্জাবোধ করে। অর্ণা যদিও রায়ানকে পছন্দ করে তাও কেমন ভয় ভয় করছে ওর।
তবে রায়ান ওর মনের ভাষা এভাবে বুঝে ফেলবে সেটা ও ভাবতে পারেনি।
রায়ান বলে,
” বি নরমাল অর্ণা। আমার সাথে এতোটা অস্বস্তি নিয়ে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ আমাদের। শুয়ে পড়ো। ”

অর্ণা কিছুক্ষণ কৃতজ্ঞসূচক নয়নে তাকিয়ে থাকে রায়ানের দিকে। এ মানুষটা কি করে যেন ওর না বলা কথাগুলোও বুঝে ফেলে।
ও আর তেমন কিছু না ভেবে খাটের একপাশে শুয়ে পড়ে। রায়ানও লাইট অফ করে অপর পাশে শুয়ে পড়ে। এখন ঘরে শুধু একটা ড্রিমলাইট জ্বলছে।

বেশ কিছুটা সময় পার হওয়ার পর দুজনের কারোরই চোখে ঘুম আসছেনা। অর্ণা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলে, ” আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে পারি? ”

অর্ণার কথা শুনে রায়ানের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। ও নিজেই অর্ণাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। একটা সময় পর দুজনেই ঘুমিয়ে যায়।

(চলবে)———–

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here