অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-১৯ও২০(শেষ)
সাদিয়া_সৃষ্টি
কেটে গিয়েছে ৩ বছর। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেদিন শুভ ঢাকায় মিসেস মজুমদারকে ট্রেস করে পৌঁছে দেখে যে তার স্বামী তাকে মারছে। মারতে মারতে বাচার অবস্থা নেই হয়তো। সে এমন পরিস্থিতিতে পড়বে ভাবতে পারে নি। তাও টপ ২০ এর মধ্যে থাকা ভারতীয় বিজনেস ওমেন এর এই অবস্থা হওয়া আর সেটা পুরো দুনিয়া থেকে গোপন রাখা সত্যিই অবিশ্বাস্য। শুভ দেরি করে মিঃ মজুমদারকে সরিয়ে মিসেস মজুমদারকে নিয়ে গাড়ির দিকে ছুট লাগায় আর হাসাতালে গিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তারপর তাকে সুস্থ করায় মন দেয়। ইতিমধ্যে কাব্যর ফোন কলের মাধ্যমে গ্রামের সব বিষয় জানতে পারে কিন্তু ঢাকা থেকে ওখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না তখন তাই ওদেরকে ঠিক মত সামলাতে বলে। মিসেস মজুমদার সুস্থ হতে থাকে আর অন্যদিকে শুভ সেই সময় তাকে সামলানোর পাশাপাশি মিঃ মজুমদার কে গুম করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। মিঃ মজুমদার ব্যবসা সম্পর্কে কিছু জানতেন না। এই ক্ষেত্রে মিসেস মজুমদারকেকাজে লাগান। তাকে বসে রাখতে মারার পদ্ধতি সাথে মগজ ধোলাই পদ্ধতি অবলম্বন করেন যার ফলে মিসেস মজুমদার ওরফে খুশি অনেক ভয়ে থাকত। ব্রেইন অয়াশ এত ভালোভাবে করা হয়েছিল যে খুশি ভয় পেটে বাধ্য ছিল। এছাড়া খুশির বাবা মা কে মেরে ফেলার হুমকি তো ছিলই। এসব জানতে পেরে শুভ আর শুভকাজে দেরি করে নি। সবার অগোচরে গুম করে দিয়েছে মিঃ মজুমদারকে। তারপর সকলকে জানানো হলে সবাই শুভর সাথে খুশির বিয়ের কথা বলে, তবে নানু তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে বলেন। খুশিও সেটাই করে। তার বাবা মায়ের ও কোন আপত্তি ছিল না। এখন তাদের ২ বছরের ছেলে শান্ত রয়েছে। শুভ খুশির বিয়ের পরপরই কেয়া আর কাব্যর বিয়েও হয়ে যায়। তাদেরও দের বছরের মেয়ে কণিকা রয়েছে। ওরা সবাই বিয়ের পরপর ভারতে চলে যায়। সেখানে বিজনেস সামলায় শুভ আর কাব্য। এতে কেয়া আর খুশি সরাসরি যুক্ত না থাকলেও পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করে। জাহিন কে নিয়ে কাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু জাহিন কোন কথা শোনে নি। সে বাংলাদেশেই থাকবে এমন জিদ করে বসে আছে আজও। তার ধারণা সে এখানেই খুশিকে খুঁজে পাবে। তাই আর অন্য কোথাও যায় নি জাহিন। সে আগের থেকে বেশি শক্ত ও কঠোর হয়েছে। আগে শ্রুতির সামনে সে শান্ত রুপ প্রকাশ করেছিল শুধু। কিন্তু এখন সেই শান্ত রুপ পরিবারের সামনেও প্রকাশ করে না। কারণ সে শান্ত হয়ে গেলে তার পরিবার আবার তাকে ভারতে যেতে জোর করবে। অন্যদিকে সে ভারতে কোন ভাবেই যাবে না। শ্রুতি তাকে খুঁজতে মানা করেছে তো কি হয়েছে, সে তো কথা দেয় নি যে খুজবে না। এখন সারাদিন দুটো কাজ করে শ্রুতিকে খোঁজা আর নিজেকে অফিসের কাজে ডুবিয়ে রাখা। জাহিনের পাশের কেবিন এই ৩ বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে বসার মানুষ আজও ফিরে আসে নি। আর রাতেও জাহিনের দুটো কাজ, এক , ড্রিংক করা আর দুই শ্রুতি কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়া। এই চারটি কাজ করেই সে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আজ সে টপ ১ বিজনেসম্যানের স্থানে থাকলেও তার তাতে কোন পাত্তা নেই। জাহিনের ভয়ে সব কর্মচারী থাকে যতক্ষণ তারা অফিসে থাকে। সফলতার শীর্ষে অবস্থান করা জাহিনের মধ্যে আজও কোন শান্তি নেই।
.
.
.
–সায়নী সায়নী, আর কত কাজ করবে? এবার তো থামো।
–কয়টা বাজে? এখন?
–১২.৩০ পি এম। এখন দোকান বন্ধ করতে হবে।
–ওয়েট আর একটু, জাস্ট থার্টি সেকেন্ডস। এন্ড ডান। চলো এবার।
–এই যে ম্যাডাম, আমি আমার বাসায় যাচ্ছি। আপনি যদি যেতে চান তাহলে আমার সাথে আসতে পারেন আর না হলে নিজের রাস্তা মাপেন।
–হাহা ওকে বাই বাই, কাল দেখা হবে। আপাতত আমি আমার জানুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। জানো আমার জানু কত টেস্টি। ইশ্ একবার যদি ট্রাই করতে !
–তোর জানু হারাম। জানিস না? কয়বার বলতে হবে তোকে। এতো কেন ড্রিংক করিস?
–আচ্ছা ম্যাডাম, আমি যাই, আমার জানু কাল ১২.৩০ থেকে মোট ২৪ ঘণ্টা ৩ মিনিট ওয়েট করেছে। আমি যাই, মাই জানু বিয়ার, আ’ম কামিং টু ইউ, জাস্ট ওয়েট আ ফিউ মিনিটস।
–হ্যাঁ যাও যাও। আর কাল সকালে ঠিক সময় চলে এসো।
–জো হুকুম মেরে আকা।
–একেবারে মদ পাগলি !
.
বলেই নাফিসা চলে গেল। নাফিসা সায়নীর রুমমেট। ওরা একটা ফ্ল্যাটে একসাথে থাকে। গত ৩ বছর ধরে একসাথেই আছে। আর সায়নী হল মিসেস শ্রুতি রেজওয়ান সায়নী। নিজের আসল নামের সাথে একটা নকল নাম যোগ করেছে শুধু। আর সায়নী নামটা ই ও বেশি ব্যবহার করে এই ৩ বছর ধরে। তাই শ্রুতি নামে ওকে এখানকার কেউ চিনে না। নাফিসা শ্রুতির সবতাই জানে। তাই ওকে আর জোর করে নি কিছুতে। ওরা স্কুল লাইফের বান্ধবী আর এখন ওরা সিলেটে আছে। সারাদিন কাজের উপর থাকে শ্রুতি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত একটা হোটেলে ওয়েটার হিসেবে কাজ করে। বিকাল থেকে রাত ১২ টা / ১২.৩০ টা পর্যন্ত একটা গ্রোসারি স্টোরে কাজ করে। আর রাতে বারে কাজ করে। এখানে বারে কাজ করার আলাদা কারণ আছে। সে গত ৩ বছরে ড্রিংক করা রপ্ত করেছে। সেটার খরচ এরাই দেয়। এখানে কাজ করে সে যে টাকা পায় সেটার কিছু অংশ দিয়ে বিয়ার কিনে। আর এখন সে এই দুই কাজ করতেই যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে ডেলিভারির কাজটা ও তাকেই করতে হয়। বিয়ার তার জানু হয়ে গিয়েছে। এটা তার ২য় ভালোবাসা। মিসেস রাহমানের সাথে যোগাযোগ রেখেছে কারণ তার অনুপস্থিতি বাবার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সে আজও জানে না যে জাহিনের সাথে শ্রাবণীর মিল হয় নি কারণ সে মিসেস রাহমানকে দিয়ে কথা দিয়ে নিয়েছে যেন জাহিনের কোন কথা না বলে নাহলে কথা বলা টুকুও বন্ধ করে দিবে। আজ সে কাজে এসেছে কিন্তু বিয়ার খেতে পারে নি। কারণ তাকে ডেলিভারির কাজ দিয়েছে। একটা হোটেলের নির্দিষ্ট রুমে পৌঁছে দিতে হবে। যেই না মুখের কাছে বোতলটা ধরেছিল , অমনি একজন এসে এই কথা বলে । তাই সে আগে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে দেয় ব্যক্তির গালে। তারপর তার কাছ দেখে বিয়ারের কার্টুন নিয়ে তাতে আরও একটা এক্সট্রা বোতল নিয়ে নেয় আর বলে দেয় যে আজ আর কাজে আসবে না। যেই ছেলেটা চড় খেল তার কাছে এটা নতুন কিছু না, আগেও অনেক খেয়েছে শ্রুতির কাছে চড়। শ্রুতির কাজের শুরুতেই বাঁধা দেওয়ার জন্য। শ্রুতি বাইক নিয়ে চলে যায় হোটেলের উদ্দেশ্যে।
.
সেখানে পৌঁছে প্যাকেট টা হাতে নিয়ে রুমের সামনে গিয়ে বেল বাজায়। দরজা খুলতে সামনে থাকা ব্যক্তির দিকে না তাকিয়েই তার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে চলে যায়। কিছু দূর যেতেই তার মনে পড়ে নিজের বিয়ারের কথা। তাই আবার সেখানে গিয়ে বেল বাজাতে গিয়ে দেখে দরযা খোলা। তাই বলে ওঠে ,
.
–আমার জানু আপনার প্যাকেটের মধ্যে রয়ে গিয়েছে। সেটা ফেরত দিন। আই মিন জানু, সরি, বিয়ারের বোতল।
.
হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বত্ত্বেও কোন রেসপন্স না পেয়ে সামনে তাকাতেই চমকে ওঠে সে। সামনে জাহিন দাঁড়িয়ে ছিল। জাহিন সিলেটে এসেছিল ব্যবসার কিছু কাজে। কিন্তু এখানে এসে যে শ্রুতিকে পেয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারে নি। আর দেরি না করে শ্রুতি হাত ধরে টেনে ভিতরে ঢোকায় আর দরজা লাগিয়ে দেয়। তার দেওয়ালের সাথে শ্রুতিকে চেপে ধরে।
.
শ্রুতির বুঝতে বেশ কিছু সময় লেগে যায় যে কি হয়েছে। যখন বুঝতে পারে তখন মুখ খুলে কিছু বলার জন্য। কিন্তু তার আগেই জাহিন বলে উঠে,
–ওহ, ফাইনালি তোমাকে পেলাম! শেষ পর্যন্ত তোমার দেখা মিলল। ইশ আগে জানলে আরও আগে সিলেটে আসতাম। সো মিসেস রেজওয়ান আপনি ড্রিংক করা ধরেছেন?
–হুম তাতে আপনার কি? আর আপনিই বা কে? কে এই মিসেস রেজওয়ান? আমি সায়নী ওকে? আর হ্যাঁ, আমি ড্রিংক করি। এই বিয়ার হল আমার জানু। আমি দেলিভারি করা সময় ভুল করে আপনার প্যাকেটে আমার জানুকে রেখে এসেছি। জাস্ট একটা জানু আছে ওতে, আই মিন একটা বোতল। সেটা আমাকে দিয়ে দিন। আমি চলে যাবো।
–কোথায় যাবে? আবার পালাতে?
–ওয়েট? পালাচ্ছে কে? এই সায়নী কারো থেকে পালায় না। বুঝছেন?
–দেন এই বোতলের বিয়ার শেষ করে দেখাও।
–আমি কেন আপনাকে দেখাতে যাব?
–তার মানে তুমি পালাচ্ছ।
–নাহ, আমি পালাই না, বাট আপনার কথা কেন শুনব আমি?
–কারণ তুমি সত্যি বলছ না মিথ্যা সেটা আমার জানতে হবে।
–আমি কি মিথ্যা বললাম?
–এই যে বললে তুমি পালাও না। সেটা আমি বিশ্বাস করি না। তাই প্রমাণ কর।
–ওহ হ্যালো মিস্টার হোয়াটএভার। আমি পালাই না। আমি রোজ রাতে আমার ৪ – ৫ টা করে জানুকে শেষ করি।
–ওয়েট আগে এই জানু বলা বন্ধ কর, আ’ম জেলাস। ওয়েট আচ্ছা, জানু বলা বন্ধ করতে হবে না। তুমি বিয়ারকে জানু বল বাট আমাকে সোনা কলিজা ডার্লিং বলে ডেক। এখন নাও জলদি প্রমাণ কর।
–আমি কেন প্রমাণ করব?
–তার মানে তুমি পালাচ্ছ।
–আরে মিয়া, আমি পালামু ক্যান? ওকে দেখুন মিঃ হোয়াটএভার।
.
বলেই শ্রুতি পুরো এক বোতল এক ঢোকে শেষ করল। আর এতেই কাজ হল। শ্রুতির নেশা ধরে গেল। জাহিন অনেক কম বয়স থেকেই ড্রিংক করে। তাই ওর এই সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে। যে কার কতটুকুতে নেশা ধরবে শ্রুতি যদিও ৩ বছর ধরে ড্রিংক করে থাকে, তবুও ও নিজের সীমার থেকে কমিয়েই করবে হয়তো। আর যেমন ধারণা করল তেমনি হল। শ্রুতির এক বোতলেই নেশা ধরে গেল। আর শ্রুতিকে রাগানো জাহিনের জন্য সহজ ব্যাপার। নিজের কথার ফাঁদে শ্রুতিকে ভালোই ফেলতে পারে। এই সুযোগটা শ্রুতিই ওকে দেয়। শ্রুতি অনেক স্মার্ট হলেও জাহিনের কাছে আসলে নার্ভাস ফিল করে যার জন্য জাহিনের সামনে ও কিছুটা বোকা বোকা হয়ে যায়। এতে জাহিনের ই লাভ হয়। অল্প কথা বলেই ওকে প্যাঁচে ফেলা সম্ভব হয় তখন। এক্ষেত্রেও তাই হল। শ্রুতিকে অনেকদিন পর রাগতে দেখল জাহিন। একসাথে শ্রুতির রাগ বোকা হওয়া মুখ দেখা হয়ে গেল। সাথে এক নতুন চেহারাও দেখল সে। মাতাল চেহারা। এবার সে শ্রুতিকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল। জাহিনের ইচ্ছা ছিল তখনই সব বলে দেওয়ার আর আবার আগের মতো হওয়ার। কিন্তু শ্রুতিকে তখন বললে ও সকালের মধ্যে সব ভুলে যাবে এটা জাহিনের জানা। তাই সেই রাতটা একসাথে গল্প করে আর ড্রিংক করে কাটিয়ে দিল দুজন। সকালে জাহিনের ঘুম শ্রুতির আগেই ভাঙল। তাই সে নিজের জামা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
.
শ্রুতি ঘুম ভাঙতেই নিজেকে অচেনা জায়গায় পেয়ে অবাক হল বেশ। ভয় ও পেয়েছে মনে মনে তবে সেটা প্রকাশ করছে না। রাতের কথা মনে পড়তেই বুঝল যে এটা অন্য কারো নয়, বরং জাহিনের ফ্ল্যাট। ভাবতেই সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল সে। কিছু ক্ষণ আগে যখন একটু জন্য মনে হল যে অন্য একটা লোকের সাথে থেকেছে, তখনই ভয়ে ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। জাহিনের কথা মাথায় আসতেই নিজেকে শান্ত করল। তারর সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য উঠে পড়ল। দরজার কাছে গেল দরজা খুলতে কিন্তু দরজা খুলছে না। লক করে রেখেছে জাহিন – কথাটা মাথায় আসতেই তার রাগে নাচতে ইচ্ছে হল। কেন সে আবার জাহিনের কথার প্যাঁচে পড়ে মাতব্বরি করে পুরো বোতল শেষ করতে গিয়েছিল ভাবতেই মুখে হাসি চলে এলো। নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। যার কাছ থেকে এতো দিন পালালাম শেষে তার কোথায় কি না বিয়ার খেয়ে ফেললাম। শেম অন ইউ বুদ্ধু সায়নী। ততক্ষনে জাহিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। আর দেখল শ্রুতি দজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবছে। বুঝল, গালি দিচ্ছে বোধ হয়, তাই সে নিজেই বলল,
–আমাকে আর কষ্ট করে গালি দিতে হবে না। ওই কাজ টা আমি নিজেই করি। রোজ নিজেকে গালি দিই। তাই এই মহান কাজ আপাতত স্থগিত রেখে ফ্রেস হয়ে নাও , আর দরজা এখন খুলবে না শ্রুতি।
–হেই ওয়েট। আই টোল্ড ইউ না, আমি শ্রুতি না, আমি সায়নী।
–ওকে সায়নী বেবি, যাও ফ্রেস হয়ে নাও।
–আমি বে…
–জানি তুমি বেবি না, তুমি তো বুড়ি তাই না, তবু আমি বেবি বলেই ডাকব। যাও যাও ফ্রেস হয়ে আসো, আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।
.
শ্রুতি আর ঝগড়া না করে চলে গেল। বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে নিজে নিজে হেসে ফেলল। জাহিনের এই ব্যবহার গুলো শ্রুতির ভালোই লাগছে। বেশি ভালো লাগছ এ এই ভেবে যে ৩ বছর পর দেখা হয়েছে বলে মনেই হচ্ছে না। ওদের খুনসুটি ঝগড়া শুরু থেকেই চলছে। শ্রুতি ফ্রেস হয়ে এসে দেখে জাহিন টেবিলে খাবার নিয়ে বসে পড়েছে। শ্রুতির অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। শ্রুতি দেখল যে ও যেহেতু ওর বাচ্চা বাচ্চা শরীর নিয়ে দরজা ভাঙতে পারবে না, তাই চুপচাপ বসে পড়ল কোন কথা না বলে। জাহিন নিজের চেয়ারের কাছে শ্রুতির চেয়ার টেনে আনল। তারপর মুখের সামনে চামচে খাবার নিয়ে তুলে ধরল। জাহিনের সাথে শ্রুতির এখন মোটেই ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছিল না। তাই সে ভদ্র বাচ্চার মতো কেয়ে নিল। জাহিন শ্রুতিকে খাওয়াতে থাকল, নিজেও খেল আর এর মাঝে ওকে শুভ কাব্যর বিয়ে, ওদের বেবি সবার কথা বলতে থাকল যেগুলো শ্রুতি এই ৩ বছরে মিস করেছে। জাহিন এতো সুন্দর করে গুছিয়ে বলছিল যে শ্রুতি মনে হচ্ছিল ও চোখের সামনে সব দেখতে পারছে। আর জাহিন এর ফাঁকে ফোনে ছবি বের করে শ্রুতির হাতে ধরিয়ে দিল। শ্রুতি সেগুলো দেখতে দেখতে আর জাহিনের কথা শুনতে শুনতে খাওয়া শেষ করল। তারপর জাহিন দরজা খুলে দিল আর শ্রুতি নিজের মতো চলে গেল। জাহিন ওর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনে কাউকে শ্রুতির সব ডিটেইলস বের করতে বলল।
.
যাকে জাহিন সায়নীর সব ডিটেইল বের করতে বলেছিল, সে সিলেটে থাকা সব ‘সায়নী’ নামের মেয়েদের ডিটেইল নিয়ে আসলো। জাহিন এতো বোঝা দেখে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। যদিও আসতে দিয়েছে। জোরেই মারত কিন্তু নিজের রাগের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে। আজ সে সব ঠিক করতে চাইছে। যদি কোন কারণে জাহিন রেগে গিয়ে শ্রুতির সাথে ঝগড়া করে বসে। তাই । কথায় বলে Practice makes a man perfect. সেটার প্রয়োগ করছে সে আপাতত। কোন ভুলের কারণে সে আর শ্রুতিকে হারাতে চায় না। মেয়েটাও তো কম কষ্ট করে নি। শ্রাবণীর কাছ থেকে যখন শ্রুতির অনুভূতি গুলো সম্পর্কে জানল তখন সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। শ্রাবণী সাদিকের সাথে যাওয়ার আগে আবার থেমে শ্রুতির পাগলামি র কথা বলতেই জাহিন নিজেকে বোকা দিতে শুরু করেছিল সেদিন। শ্রুতি নিজের অনুভূতি কাউকে না বললেও শ্রাবণী ওর চেহারা দেখে হালকা হলেও বুঝে নিতে পারতো। তাই যখন নিজের বোনকে সারা দিন কারো চিন্তায় হারিয়ে থাকতে দেখল, তখনই শ্রাবণী ধরে নিয়েছিল যে শ্রুতি কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর এসব শোনার পর জাহিন দুইয়ে দুইয়ে চার করে নীল। শ্রুতির এতদিনের কথা বার্তা, কেয়ার, জাহিনের খেয়াল রাখা সব যে শুধু দায়িত্ববোধ থেকে ছিল না সেটা বুঝতে আর বেশি সময় লাগে নি জাহিনের সেদিন। শুধু বাড়ি পৌঁছাতেই দেরি করে ফেলেছিল। যার জন্য তাদের জীবন থেকে ৩ টা বছর হারিয়ে।
.
লোকটা আবার হোটেলের সিসি টিভি ফুটেজ দেখে সায়নীর নাম ঠিকানা বের করে দিল। জাহিন কাগজ টা দেখেই অবাক হয়ে গেল। মিসেস শ্রুতি রেজওয়ান সায়নী। নামটা মনে মনে কয়বার আওড়ে নিল। এতেই মুখে হাসি চলে আসলো তার। শ্রুতির আগের থেকে তেমন পরিবর্তন হয় নি। শুধু চুল গুলো কেটে পিঠের মাঝ বরাবর রেখেছে আর ড্রিংক করে। আর আগের থেকে কঠোর হয়েছে/ এর বেশি কিছু জাহিনের নজরে পড়ল না। জাহিন বিকালে শ্রুতিদের ফ্ল্যাটে গেল যেখানে শ্রুতি আর নাফিসা একসাথে থাকে। রাতে যদি যেত তাহলে শুধু নাফিসা কে পাওয়া যেত কারণ শ্রুতি রাতে সরাসরি বারে চলে যায়। তাই জাহিন বিকেলেই সেখানে গেল। বেল বাজাতেই নাফিসা দরজা খুলে দিল। আর একবারেই চিনে ফেলল। জাহিন রেজওয়ান । তাদের বাড়িতে। সে বেশি কথা না বলে ভেতরে এনে বসাল আর শ্রুতিকে ডাকতে গেল। কিন্তু তার আগেই ও বলল নাফিসার সাথে কথা বলবে। নাফিসা অবাক হয়ে গেল – জাহিন তার সাথে কেন কথা বলবে? জাহিন হেয়ালি না করে তাদের পাস্ট নাফিসার সামনে খুলে রাখল। সব শোনার পর নাফিসা ইমোশনাল হয়ে বলল,
.
–আপনি এসব আমাকে বললেন কেন?
–যাতে শ্রুতি যদি রাগ করে তাহলে আপনি ওকে বুঝাতে সাহায্য করেন আমার টিমে থেকে।
–এই জন্য ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলতে নেই। শুধু নিজের লাভ টা দেখে।
–ডোন্ট ওয়ারী শালিসাহেবা। শ্রুতি ঠিক রাজি হয়ে যাবে। আপনাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না।
–ওকে জিজু ডান।
.
জাহিন এসেই যখন নাফিসা কে দেখল তখন ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল যে জাহিন কে ও চিনে। কিন্তু কোন এক কারণে পছন্দ করে না। তাই ওর সামনে সবটা খুলে বলল সে। যাতে ভুল বোঝাবুঝি না। সবটা শোনার পর নাফিসাও বুঝতে পারল যে জাহিন এর কোন দোষ নেই। দুজনেই পরিস্থিতির শিকার/ তাই ওদের দুজনের মিল যাতে হয় সেই চেষ্টাই করবে। আর এছাড়াও জাহিন জানত যে ও এতদিন শ্রুতিকে সামলিয়েছে। তাই ওকে সব বলে ফেলল জাহিন।
.
শ্রুতি সবে মাত্র স্নান থেকে ফিরছিল। জাহিন আর নাফিসাকে হেসে হেসে গল্প করতে দেখে ও ভ্রূ কোঁচকাল।
.
–ওহ সায়নী তুই এসেছিস। যাহ্ জিজুকে রুমে নিয়ে গিয়ে কথা বল আর সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নে।
–তার মানে তুই সব বলে দিয়েছিস?
.
এর উত্তরে নাফিসা জোর করে একটা বড় হাসি উপহার দিল । আর সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেল। কিন্তু আবার বের হয়ে এসে শ্রুতিকে ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দিল আর জাহিনকেও পাঠিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিল। সব এত হঠাৎ করেই হল যে শ্রুতির বুঝতে সময় লেগে গেল কি কি হল এতক্ষণ। নাফিসা জানে যে শ্রুতি আবার পালানোর চেষ্টা করবে পুরো সত্যি না শুনেই। তাই এই দরজা আটকানোর ব্যবস্থা। তারপর ওর নজরে পড়ল ওদের ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক প্রাণীর দিকে। সে রোহিতের ভাই রনিত। রোহিত কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। তাই রনিত ওর হয়ে কাজ করছে এই সময়। দেখেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
.
–আপনি কে?
–জাহিন স্যার এর ম্যানেজার, রনিত।
–বিবাহিত? (চোখ দুটি ছোট ছোট করে)
–নাহ।
–রিলেশনে আছেন?
–না।
.
বেচারা রিলেশনে থাকবে কি করে। জাহিন নিজে যেমন বেশি কাজ করে তেমন রনিত কেও তার সমান কাজ করতে হয়, হয়তো তার থেকে বেশি। রিলেশনের জন্য সময় কোথায়? এই প্রশ্ন সুনলে আজও তার কান্না পায়। কিন্তু কি করবে? জাহিনের সামনে কান্না করা মানে শুধু চড় খাওয়া। কাল ও শ্রুতির সম্পর্কে খোঁজ করতে গিয়ে চড় খেল। ওর বড় ভাই এর অবস্থা তাও ভালো ছিল। শুধু ইডিয়ট বলে ছেড়ে দিত। আর এখন রনিত কে ইডিয়ট বললেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু জাহিন শুরুই করেছিল চড় দিয়ে যেটা আজও চলছে।
.
–ওকে, তাহলে তোমার জাহিন স্যার কে বল যে আমাকে বিয়ে করবে।
–মানে কি?
–দেখ, এখন তোমার যেই বয়স চলছে তাতে রিলেশনে যাওয়ার সুযোগ পাবা কি না সন্দেহ। আর জিজুর অফিসে কাজের চাপে তোমার হবু বউ বিয়ের আগে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। কিন্তু আমি আলাদা। তাই সুযোগ দিলাম। বুত রিলেশন ফিলেশন করতে পারব বা। সোজা বিয়ে। তাই রাজি থাকলে… আর না থাকলে …
–ও…ওকে। আমি রাজি।
.
হ্যাঁ শুনতেই নাফিসা রনিতকে জড়িয়ে ধরল। রনিত ও হালকা হেসে দুই হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।
.
.
.
শ্রুতি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে জাহিনের দিকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। যখন কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই জাহিন নিজের হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল আর বলল,
.
–আর কিছু বল না এখন, শুধু আমার কথা শোনো।
.
এইটুকু বলে সেদিনের শ্রাবণীর বলা সব কথা বলল। সব শুনে শ্রুতি চোখে পানি চলে এলো। সত্যিই সেদিন সে সেখান থেকে পালিয়ে এসে কত ভুল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে জীবনের ৩ টা বছর হারাল। সবার থেকে দূরে থেকে আর তার বাড়ির মানুষদেরও কষ্ট দিল। তাই নিজেকে আটকে না রাখতে পেরে জাহিনকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
.
.
.
আজ আবার ৩ বছর পর পুরো পরিবার জাহিন দের দাদুভাই এর বাড়িতে একত্র হয়েছে। নানু, ২ মামা, ২ মামি, শুভ খুশি, শান্ত, কেয়া কাব্য কণিকা, রাদিয়া, ইউসরা, লামিয়া, রোহিত ওর ওয়াইফ আর ওর বেবি, রনিত আর নফিসাও আছে। মিঃ আর মিসেস রাহমান ও এসেছেন। পুরবারি ভোরে গিয়েছে মানুষে। জাহিনের অন্য কাজিন রা ও আছে। বাচ্চা রা দৌড়ে দৌড়ে খেলে বেরাচ্ছা। সবাই হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। এখন কার মূল বিষয় হল রনিত আর নাফিসার বিয়ে। ওরা গ্রামেই বিয়ে দিবে ওদের। রনিত ও এখনো ভয় ভয়ে আছে। বিয়ের দিন না যখন কবুল বলতে যাবে তখন জাহিন আবার রেগে গিয়ে ওর গালে চড় বসিয়ে দেয়।
.
জাহিন আর শ্রুতি পাশাপাশি বসে আছে সেখানে রাখা একটা বাঁশের বেঞ্চের উপর। শ্রুতি অন্যদের সাথে কথায় মেতে উঠেছিল। জাহিন ওকে পাশ থেকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। এতে শ্রুতি আড়চোখে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
.
–কি করছ?
.
জাহিন ও কম না। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল,
.
–এই টুকুতে থেমে আছি, তাই তোমার লাক ভালো। আর আপত্তি করলে সবার সামনে কিস করে বসব। সামলাতে পারবে তো?
.
শ্রুতি আর কিছু বলল না।
.
.
.
জাহিন আর শ্রুতি ফাইনালি এক হল। অনুভূতি গুলো বড়ই অদ্ভুত। বুঝতে পারলে সেটা ভালো আর ভুল বুঝলে সেটা ভালো না। কিছু ভুল বোঝাবুঝি অনেক কছুর কারণ হতে পারে। তবু ভালোবাসা কি কমে। অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি থেকে অনেক ভুল কাজ করে বসে। যেমন জাহিন শ্রাবণীকে কাদারানী ভেবে কারো সাথে ডিসকাস না করে বিয়ে করে ফেলল। কিন্তু তবু তো খটকা লাগত। দেরি করেই হোক। তাও তো বুঝল আসলে অন্তরালে কার বাস? তবে সব ক্ষেত্রে এমন হয় না। কিছু কিছু দেরি অনেক দেরি হয়ে যায়। যে ক্ষেত্রে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। তবে জাহিনের ভাগ্য এদিক থেকে ভালো। দেরি করলেও বেশি দেরি তো করে নি।
.
আজ সে বিনা দ্বিধায় বলতে পারবে সবার কাছে।
.
অন্তরালে_তোমার_বসবাস । শুধুই তোমার।
সমাপ্ত