অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-০৬,০৭
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৬
–আরে সবাই কি খাবে না? আমি আবার অফিসের কাজ নিয়ে বসব, তাই খাবার আগে আগে দিতে বললাম।
তখন নানু বলে উঠলেন,
–আচ্ছা সবাই খেতে বস। আর শোন জাহিন, আমি চাচ্ছি আজ তোরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যা। অনেক দিন তো এলো ওরা কিন্তু এখনো বাড়ি থেকেই বের হয় নি।
–আমি পারব না নানু, আমার কাজ আছে। ওরা তো সব চিনে। তাছাড়া শুভ আছে , কাব্য আছে। ওদের কে বল ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে।
–আমি তো বলছিলাম যে …
–না নানু। আমি এ নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না। তোমরা গিয়ে ঘুরে আসো। তুমিও যাও। তোমাদের ভালো লাগবে।
–তবু একবার ঘুরে আসলে তো কিছু…
–আমি আমার কথা বলে দিয়েছি।
শ্রুতি হঠাৎ বলে উঠল,
–সমস্যা নেই নানু, আমি আছি না। উনি যাচ্ছেন না তো কি হয়েছে? আমি গিয়ে ওদের সাথে ঘুরব।
শ্রুতির কথায় ওর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জাহিন। কিন্তু এ দৃষ্টির মানে শ্রুতি বুঝল না। জাহিনের কাজ করে দিচ্ছে ও। এতে তো জাহিনের খুশি হওয়ার কথা। কোথায় ধন্যবাদ দিবে তা না করে উল্টো রেগে যাচ্ছে।
.
এ দৃষ্টি এড়ালো না নানুর। তিনি মিটমিটিয়ে হেসে চলেছেন। পরে হালকা কেশে বলে উঠলেন,
–ঠিক আছে, তোমরা যাও, আর জাহিন তুই বাসায় বসে কাজ কর। শ্রুতি আর শুভ আছে ওদের সামলানোর জন্য।
এই কথা শুনে জাহিনের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হল। তবে এর কোন কারণ খুঁজে পেল না শ্রুতি। তাহলে কি উনি খুশি হন নি? কিন্তু কেন? যাই হোক, তাতে আমার কি? ঘোরাঘুরির নাম শুনলেই আলাদা এক অনুভূতি কাজ করে শ্রুতির মধ্যে। আর সেই অনুভূতির তীব্রতা এতটাই বেশি যে শ্রুতিকে কিছুক্ষণের মধ্যে জাহিনের কথা ভুলিয়ে দিল।
.
.
.
খাওয়া দাওয়া শেষে শ্রুতি, রাদিয়া, ইউসরা, লামিয়া, শুভ আর কাব্য মিলে বেরিয়ে পড়ল, আশেপাশের কিছু এলাকা ঘুরবে বলে। জাহিনের নানু আর মামা মামিরা একসাথে বসলেন কথা বলতে। জাহিন নিজের রুমে গিয়ে কম্পিউটার নিয়ে বসল। অফিসের কাজের তেমন চাপ নেই। আর না দরকার আছে কাজ করার। অন্যান্য স্টাফ রা এতো ভালো ভাবে কাজ করে যে সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। তবুও নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখে জাহিন।
.
.
বাবা মা না থাকায় ছোট কাল থেকেই নানুর কাছে বড় হয়েছে। আর বুঝতে শেখার পর থেকেই নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছে। যার ফলস্বরূপ পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই নিজে ওদের থেকে আলাদা থাকা শুরু করে। বেঁচে থাকার জন্য অর্থ উপারজন নিজেই শুরু করেছিল। মামারা অনেকবার সাহায্য করতে চেয়েছেন কিন্তু সে নেয় নি। উল্টো কৌশলে সেটা ফেরত পাঠিয়েছে। সময় পেলেই নানুর সাথে দেখা করত আর কাজিন দের সাথে সময় কাটাত। ও পরিবারে সবচেয়ে বড় হওয়ায় নিজে ওর পরিবারের জন্য কিছু করতে চাইত। এই জিদ থেকেই কাজ করে। এক পর্যায়ে এসে বিজনেস শুরু করে আর সাফল্য লাভ করে।
.
.
ভারতেই ছিল সে। তবে নিজেকে পরিচিত করে তোলার প্রবল ইচ্ছা থেকে ভারত ছেড়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। সেখানে একের পর এক চ্যালেঞ্জ নিয়েছে এবং সেটা পূরণ করেছে। নিজের পড়াশোনা এর পাশাপাশি শেষ করে। বিজনেস জগতে ওর প্রচুর নাম ডাক। তবে বাংলাদেশের কথা শুনে থমকে গিয়েছিল। তার বাবা বাংলাদেশি ছিলেন। মাও বাংলাদেশে গিয়েছিলেন শখের বসে। সেখানে একসাথে পড়াশোনা করে ভালোবাসা থেকেই দুই পরিবারের সম্মতি নিয়ে বাবা মা বিয়ে করেন। তবে তাদের সুখের পরিবার বেশিদিন ছিল না। রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় জাহিনের বাবা মা। নানু এই খবর পেতেই তাকে নিয়ে যান সেখান থেকে। কারণ উনি ধারণা করেছিলেন যে জাহিন এই কষ্ট সেখানে থাকলে সামলাতে পারবে না। তবুও জাহিন জেদি হয়ে ওঠে। সা সিদ্ধান্ত নেয়, তাই করে ছাড়ে। কারো কথা শুনত না। শুধু মাত্র ছোট ভাইবোন দের ছাড়া।
.
.
তাই বাংলাদেশে সে এসেছিল নিজের ব্যবসার আরেকটি শাখা গড়ে তুলতে। আর পাশাপাশি কিছু রাস্তার কাজ ঠিক করতে, যেখানে এক্সিডেন্ট বেশি হয়। সে চায় না তার মতো কেউ মুহূর্তেই অনাথ হয়ে যাক। কারণ জাহিনের সে সময় তাও নানু ছিলেন। ওর পরিবার ছিলেন। কিন্তু সবার তো থাকে না। এখন যদি তারা বাবা মা এর থেকেও আলাদা হয়ে যায় তাহলে পরিনতি ভয়ানক হবে। এক, অবহেলিত হবে। দুই, বিপথে চলে যাবে।
.
অফিস তৈরি শেষ হওয়ার পরই জাহিন দেশে ফিরে ছিল। বৃষ্টির এক দিন ছিল। দেশে ফেরার পর থেকেই দেখছে, বৃষ্টি থামার নাম নেই। গাড়িতে উঠে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে গাড়ির জালানা দিয়েই বাইরের দৃশ্য দেখছিল সে।
.
হঠাৎ চোখে পড়ে কাদা রানি কে। ওকে কাদা রানি ছাড়া কি বলা যায় জানা নেই জাহিনের। বাংলাদেশে ট্রাফিক জ্যামের আলাদা পরিচিতি রয়েছে। সেই ট্রাফিক জ্যামে ই ফেঁসে গিয়েছিল বলে গাড়ি থেমে ছিল। আর বাইরের দৃশ্য দেখছিল। তাই পুরোটাই চোখে পড়ে তার। লাল সালোয়ার কামিজ পরিহিত একটি মেয়ে কয়েকটি বাচ্চার সাথে পার্কটিতে এলো। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। তবে বৃষ্টির জনে চেহারা তা ঠিক বুঝল না সে। হঠাৎ করেই একজনের দিকে দুষ্টুমির হাসি হেসে কাদা ছুঁড়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি খেলা। এক পর্যায়ে মেয়েটি মাখামাখি অবস্থা হয়ে যায়। মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে,
–কাদারানী ।
নেমে সেই মেয়েটির কাছে যাবে বলে গাড়ির দরজা খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই গাড়ি এক টানে জায়গাটি অতিক্রম করল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ চুপ রইল জাহিন। এতক্ষণ চুপ রইলেও এবার নিজেকে গালি দেওয়া শুরু করল।
–এতক্ষণ তো গাড়ি ঠিকই থেমে ছিল। আর তখনই গাড়ি একটানে সামনে এগিয়ে গেল। আর গেল তো গেল , আর থামল না? এতক্ষণ ধরে তারপর ও চুপ থাকল কি করে? জায়গাটার নাম ও দেখল না। কি করে এতোটা বেক্কল হতে পারলাম আমি?
নিজেকে গালি দেওয়ার মতো মহান কাজ সেই থেকে যে শুরু হয়েছিল। আজও চলে।
.
.
ভাবতেই হাসি চলে আসল জাহিনের। নিজেকে এ পর্যন্ত ও বহুবার গালি দিয়েছে। বোকা দিয়েছে। গুনে শেষ করা যাবে না। তবে সব মনে মনে । প্রথম দিন সেদিন হোটেলে থাকলেও পরে যেদিন দাদুভাই এর সাথে কথা হল, সেদিন থেকে আর হোটেলে থাকতে দেন নি তিনি। তার উপর সে জানতে পারল যে দাদি মারা গিয়েছেন। বহুবছর যোগাযোগ ছিল না তাদের। দাদু নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাহিনের মুখ দেখে নানুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। পরে বেশ কয়েকদিন কথা হত ঠিকই। কিন্তু এতে করে জাহিনের মন আরও বেশি খারাপ হত। তাই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সময়ের ব্যবধানে মানুষের ফোন নাম্বার পরিবর্তিত হওয়ায় আর একে অপরের কাছে সেটা না থাকায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে দেশ আলাদা হওয়ায়। দাদুর ইচ্ছায় না করতে পারে নি। গ্রামেই থেকে ছিল সে বেশ কয়েকদিন। পরে অফিসের কাছাকাছি নিজের বাড়ি বানিয়ে সেখানে থাকা শুরু করে। এমনিই গাম থেকে অফিসে কাজ করা কঠিন বলে শহরে যেতে দেন দাদু।
.
.
ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে সে। আবার নিজের কাজে মন দেয়। সামনে কম্পিউটার খোলাই ছিল। কিন্তু মন অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। কাজ করতে করতে টেবিলে হাত বাড়িয়ে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু কফি কাপ না পেয়ে হতাশ হয়। অন্যদিন হলে ঠিকই পেত কিন্তু আজ শ্রুতি বাইরে ঘুরতে গিয়েছে। আর ওর যাবতীয় কাজ শ্রুতিই করে দিত। নিজেকে কিছু করা লাগত না। তাই এসব বিষয়ে কখনো ভাবেও নি। দেখা গিয়েছে কিছু চাওয়ার আগেই তার সামনে শ্রুতি হাজির করত। যেন জাহিন কে জাহিনের থেকেও বেশি শ্রুতি চেনে। ওর বন্ধুরা বা বিজনেস পার্টনার কিংবা অন্যরা যেই আসুক না কেন, একবার হলেও ভুল করে শ্রুতিকে ভাবি বলে ডাকত। তার উপর শ্রুতি যেন জাহিন কে কড়া শাসনে রাখত। এতে ওরা পুরো ভাবি ভেবেই বসে থাকত। জতক্ষন না পর্যন্ত কেউ ওদের জানায় যে শ্রুতি ওদের ভাবি না, জাহিনের পিএ। তবুও হয়তো বিশ্বাস করত না। এর জন্য বেশির ভাগ মানুষই জাহিনের কাছে বকা খেয়েছে। তবে শ্রুতি মেয়েটা সত্যিই ওর কাজ অনেক ভালো ভাবেই করত। হয়তো ভালোর উপরে কিছু থাকলে জাহিন তাই বলত।
.
.
শ্রুতির কথা ভাবতে ভাবতেই ওর ভাবনায় চলে আসে বিয়ের পর প্রতি সকালে ঘটনা। শ্রুতির বকা, ওকে দিয়ে কাজ করানো, জোর করে খাওয়ানো সব কিছু। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ওর মনে পড়ে শ্রুতির আফটার বাথ লুক। স্নান করার পর তোয়ালে দিয়ে চুল মোছা , পানি ঝাড়া থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত।
.
.
.
হঠাৎ মোবাইলের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। আর শব্দে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। সামনে ল্যাপটপ কোলের উপর সেভাবেই পড়ে আছে। তার খেয়াল হয় যে সে এতক্ষণ কি ভাবছিল। নিজেকে বকা দিতে যাবে কিন্তু তার আগেই ম্যাসেজ টোন আবার বেজে ওঠে।
.
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে কাব্য ম্যাসেঞ্জারে ছবি পাঠিয়েছে। ছবি গুলো দেখতে গিয়ে তার মাথা আবার ওই অজানা কারণে গরম হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ ছবিতেই শ্রুতির পাশে শুভ ছিল। সে রেগে গিয়ে শ্রুতিকে ফোন করে।
–হ্যালো
–কোথায় তোমরা?
–ঘুরছি এখনো। জানেন এখানে সবাই মিলে অনেক মজা করছে। পরিবেশটাও সুন্দর…
কথা বলতে বলতে হঠাৎ শ্রুতি খেয়াল করল যে জাহিন কিছু বলছে না।
–হ্যালো আপনি শুনতে পারছেন?
–হ্যাঁ
–কি ভাবছেন এতো?
–তোমার আফটার বাথ লুক।
আনমনে বলে ওঠে জাহিন।
–কি বললেন শুনতে পাই নি।
জাহিনের খেয়াল হল যে সে কি বলেছে? সে কথা ঘুরে বলল,
–তুমি বলতে থাক , আমি শুনছি।
–জানেন শুভ কে দেখলাম, ও এখানকার সবই চিনে।
এবার জাহিনের মনে পড়ল যে সে কেন ফোন করেছিল। সে বলল,
–তোমরা এখন বাড়ি ফিরে আসো।
–কিন্তু আমরা তো কিছুই ঘুরলাম না।
–আমি তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাবো পরে। এখন বাড়ি ফরে আসো।
বলেই ফোন কেটে দিল।
.
.
শ্রুতিকে অগত্যা সেদিন না ঘুরেই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।
চলবে।
#অন্তরালে_তোমার_বসবাস
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৭
চারপাশে আলোর মেলা চলছে যেন। সময়টা রাত হলেও আলোর জন্য ঠিক রাত বলে মনে হচ্ছে না। জাঁকজমক পূর্ণ পরিবেশ। গানের শব্দ ভেসে আসছে কানে। খোলা মাঠ হলেও বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে। সবাই কারোর না কারোর সাথে কথা বলছে। কেউ কেউ ড্রিংক এর গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর পরিবেশটা উপভোগ করছে। অন্যদিকে কেউ নাচে মত্ত নিজের পার্টনারের সাথে।
.
শ্রুতি আর জাহিন এসেছে এক পার্টিতে। মূলত ব্যবসায়িক কারনেই এই নিমন্ত্রণ। তাদের বিজনেস পার্টনার মিঃ রায় এই পার্টির আয়োজন করেছেন। আর তাদেরও নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাই আর না করতে পারে নি জাহিন। আর এখন যেহেতু ঘটা করেই বিয়ে হয়েছে তাই জাহিনের স্ত্রী হেসেবেই এসেছে শ্রুতি। অবশ্য স্ত্রী হিসেবে না আসলেও পিএ হিসেবে আসতে পারতো কিন্তু ও আসতে চাইছিল না। সাধারণত এসব পার্টিতে শ্রুতি আসে না। কোন ডিল করতে হলে জাহিনের সাথে যায়। কিন্তু এখন ও জাহিনের স্ত্রী হওয়ায় না গেলে অনেক সমস্যা হতে পারে। কারণ প্রেস – মিডিয়ার লোক থাকবে। তার উপর তাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে। এখন সামান্য কারণে না গেলেও সেই তিল কে তাল বানিয়ে পুরো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াবে। তাই এতো ঝামেলা করার থেকে ভালো ওখানে গিয়ে এক জায়গায় বসে থাকবে।
.
.
জাহিন ফর্মাল ড্রেসে আছে। পুরো ব্ল্যাক ড্রেস আপ তার। তার পাশেই শ্রুতি ওর হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করল। সে নিজেকে কালো শাড়িতে মুড়িয়ে রেখেছে। অবশ্য ও এ শাড়ি পড়তে চায় নি। এসব পার্টি হলে ও সাধারণ পোশাকেই গিয়েছে সব সময়। শুধু ডিলের সময়টুকু থেকে কাগজ পত্রে সাইন করা হলে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ত। তাই এখানে থাকার অভ্যাস নেই। আগেও দেখেছে যে অনেকে অনেক সেজেগুজে আসে। কিন্তু তার ধ্যান কাজ ছাড়া অন্য দিকে ছিল না কখনো।
.
আজ যখন জাহিন ওকে যাওয়ার কথা বলল তখন ও সাফ না করে দিয়েছিল। কিন্তু পরে মিঃ রায় এর কথা বলল যে উনি অবশ্যই ওদের দুজনকে আসতে বলেছে। তাছাড়া মিঃ রায় ওদের পুরনো বিজনেস পার্টনার এর পাশাপাশি ওর বাবার সমান। উনি নিজেও শ্রুতিকে মেয়ের চোখে দেখেন। তাই আর না করতে পারে নি। নিজে তৈরি হয়ে যখন আয়নায় দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো নিজেকে দেখছিল তখন হঠাৎ কোথা থেকে এক কালো শাড়ি উড়ে এসে ওর মাথার উপর ল্যান্ড করে। শাড়িটা মাথা থেকে সরিয়ে নিজের হাতে নিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখল জাহিন দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড রাগে বলে উঠল,
–এটা আপনি কি করলেন?
–কেন কি করলাম?
তখন জাহিন ফোন চালাচ্ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে। ফোনে দু চোখ রেখেই শ্রুতির প্রশ্নের উত্তর দিল সে। শ্রুতি জাহিনের এমন উত্তরে আরও রেগে গিয়ে বলল,
–শাড়িটা আমার উপর ফেললেন কেন। আমি তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। আর আপনি নষ্ট করে দিলেন?
–কি তৈরি হয়েছিলে? শুধু সালোয়ার কামিজ ই তো পরেছিলে। আর সাজোও নি। তো?
–তো আমি এখন কি করব?
–এই শাড়িটা পড়ে হালকা সেজে নিচে চলে আসো।
–আমি সাজতে পারি না।
–রাদিয়া লামিয়া ওরা এসে সাজিয়ে দিবে। এখন কি বলবে যে শাড়িও পরতে পারি না?
–না না, আমি যাচ্ছি।
শ্রুতি শাড়ি পরে বেরিয়ে এসে দেখে জাহিন পুরো ব্ল্যাক স্যুট পরেছে আর দাঁড়িয়ে তখনও ফোন চালাচ্ছে। শ্রুতিকে দেখে রাদিয়া আর বাকিবের ডেকে বলল,
–হালকা করে সাজিয়ে দিবি, বেশি দিলে সেটা ধুইয়ে দিবে আবার সাজাতে বলব।
বলেই গটগট করে বেরিয়ে চলে গেল। আর ইউসরা আর লামিয়া রাগে ফুটছে যেন ওরা বেশি মেক আপ করিয়ে ভুত বানিয়ে দেয় বলে এমন বলল জাহিন।
.
.
সিঁড়ি থেকে শ্রুতিকে নামতে দেখে অবাক হয় নি জাহিন। তবে আক রাশ মুগ্ধতা এসে ভর করেছিল ওকে। বেশি কোথা না বলে বাই বোনদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। মামা মামি আর নানু আগেই বেরিয়ে গিয়েছে। ওরাই পরে বের হল।
.
.
শ্রুতির সাথে হাত ধরে নেমেছিল ঠিকই কিন্তু একটা জায়গায় শ্রুতিকে বসিয়ে ওর থেকে দূরে গিয়ে অন্যদের সাথে কোথা বলা শুরু করে দেয় জাহিন। শ্রুতির থেকে দূরে থাকতে চাইছে সে। কিন্তু যার সাথে কোথা বলুক না কেন, শ্রুতির থেকে বেশি দূরে যাচ্ছে না। বার বার আড়চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে।
.
শ্রুতির অনেকক্ষণ বসে থাকার পর আর ভালো লাগল না, তাই উঠে হাঁটতে শুরু করল। জাহিন ও যার সাথে কোথা বলছিল তাকে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ওর পিছনে পিছনে হাঁটা ধরেছে।
.
শ্রুতি পুল সাইদের কাছে এসে থামে। পিছনে তাকাতেই দেখে যে জাহিন একজনের সাথে কথা বলছে। শ্রুতি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আশেপাশে আরও অনেক মানুষ আছে তবে একা নয়। কারো না কারো সাথেই আছে। কিন্তু শ্রুতি একা দাঁড়িয়ে আছে। ওর সাথে কেউ নেই। বাকিরাও অন্যদের সাথে কোথা বলছেন বলে নানু বা অন্যদের কাছে যায় নি শ্রুতি। তবে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। এজন্যই আসতে চায় না সে পার্টিতে। বিশেষ করে যেখানে অচেনা মানুষের মেলা। একাই দাঁড়িয়ে ছিল সে। জাহিন ও কথার ফাকে ফাঁকে আড়চোখে শ্রুতিকে দেখে যাচ্ছিল ।
.
.
হঠাৎ শ্রুতির দিকে তাকাতেয় দেখে শ্রুতি কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে সুইমিং পুলে পড়ে যাচ্ছিল। সে সেদিকেই পা বাড়াতে যায়। কিন্ত তার আগেই কেউ এসে শ্রুতিকে ধরে ফেলে। এক হাতে শ্রুতির হাত আর অন্য হাত শ্রুতির কোমরে দিয়ে শ্রুতিকে আটকায়। শ্রুতিও ভয়ে ব্যক্তির হাত শক্ত করে ধরে ফেলে । এই দৃশ্য দেখে জাহিন থেমে যায়।
.
শ্রুতিকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলে শ্রুতি দেখে শুভ ওকে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে। শ্রুতি নিজেকে সামলে শুভকে ধন্যবাদ জানায়। আর ওর সাথে কথা বলতে থাকে সেখানে দাঁড়িয়েই। জাহিনের মাথায় আবার রাগ ভর করে। সে মিউজিক যেখানে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল সেখানে গিয়ে লোকটাকে কিচ্ছু বলে আর আবার শ্রুতির কাছে ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে শ্রুতি তখন শুভর সাথে কথা বলছে। পাশে কাব্যও এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সেদিকে খেয়াল নেই জাহিনের। সে শ্রুতিকে কিছু না বলেই শ্রুতির হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। শ্রুতি এদিকে অবাক হয়ে জাহিনের দিকে চেয়ে আছে। তার হাত জাহিন এতো শক্ত করে ধরেছে যে তার মনে হচ্ছে এখনই ভেঙে যাবে। কিন্তু এতটাই অবাক হয়েছে যে কি প্রশ্ন করবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না শ্রুতি। সে কি প্রশ্ন করবে
.
যে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? নাকি
.
কেন নিয়ে যাচ্ছে এভাবে? নাকি
.
হাত ধরেছে কেন?
.
নিজেই বুঝতে পারছে না শ্রুতি। একসময় জাহিন শ্রুতিকে নিয়ে এসে এক জায়গায় থামল। থামতেই শ্রুতি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। এখানে সব কাপল রা যে যার মতো ড্যান্স করছে। শ্রুতি কিছু বুঝে উঠবে তার আগেই ওখানে সব আলো নিভে যায় আর শুধু একটি আলো তাদের উপর পড়ে। সাথে সাথে একটা গানও শুরু হয়ে যায়। জাহিন ও সেই গানের সাথে তাল মিলিয়ে শ্রুতিকে নিয়ে নেচে যাচ্ছে।
.
.
””তুম্নে জো হ্যায় মাঙ্গা তো দিল ইয়ে হাজির হো গায়া
তুমকো মানা মাঞ্জিল ওর মুসাফির হো গায়া
লো সাফার শুরু হো গায়া , হামসাফার জো তু হো গায়া
লো সাফার শুরু হো গায়া মেরা হামসাফার তু হো গায়া
দিল কি বেহচ্যানি কো আয়া আব কাহি আরাম হ্যায়
তু না হো তো সোচতা দিল তুঝকো সুবাহ শাম হ্যায়
ইস কাদার হার ইক পাল মে মেরে শামিল হো গায়া
লো সাফার শুরু হো গায়া , হামসাফার জো তু হো গায়া
লো সাফার শুরু হো গায়া মেরা হামসাফার তু হো গায়া
.
.
জাহিন লোকটাকে কোন গানের নাম বলে আসে নি কিন্তু তাও এ গান কেন দিল সে জানে না। তবে যতক্ষণ ওরা নাচের মধ্যে ছিল জাহিন প্রতিটা স্তেপে শ্রুতির উপর নিজের রাগ ঝাড়ছিল যেন, হাত যতবার ধরেছে, শ্রুতির শুধু মনে হয়েছে যে এই ওর হাত ভেঙে গেল। আর যেখানে যেখানে জাহিনের হাত ছুয়েছে, সেখানে পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গিয়েছে যেন। গান শেষ হতেই শ্রুতি ওর থেকে দূরে সরে এসে সেখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। জাহিন এবার আর ওর পিছনে যায় নি। মুলত নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই। আর বেশিক্ষণ থাকলে ও ভয়ানক কিছু করে ফেলত।
.
.
শ্রুতি সেখান থেকে সরে সরাসরি অন্যদিকে চলে যায়। একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসে পড়ে। জাহিন যে এতো নিঃশব্দে কারো উপর রাগ ঝাড়তে পারে, জানা ছিল না শ্রুতির। প্রথম বার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বলে তার এখন কি করা উচিত জানা নেই বলে সেখান থেকে এক প্রকার পালিয়ে এসেছে। আর চেয়ারে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। জাহিনের ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আসছিল। তাই একজন ওয়েটার কে থামিয়ে হাতের কাছে যেটা পেয়েছিল সেটাই পুরো পান করে। এতে করে গলা ভিজলেও ওর কেন জানি কিছু সময়ের মধ্যে মাথা ঘোরা শুরু করে। ভাবল হয়তো টেনশনের কারনেই আবার মাথা ঘুরছে। তাই ওয়াশ রুমের দিকে পা বারায় সে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে যে তার দিকে কেউ চেয়েছিল, সেটা বুঝে নি শ্রুতি।
.
.
ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের মুখ পানি দিয়ে হালকা ধুয়ে নেয়। কিন্ত মাথা ঘোরাটা কমছে না। কি করবে বুঝতে না পেরে ভাবল মামির কাছে যাবে। কিন্তু তার আগেই ওয়াশ রুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল। পিছনে ঘুরতেই দেখল একটা লোক বিশ্রী হাসি দিয়েই যাচ্ছে। সেই লোকটি কিছু সময়ের মধ্যে তার দিকে এগিয়ে গেল। এতে করে শ্রুতি ভয় পেয়ে আরও পিছিয়ে গেল। সে কিছু করতে পারছে না কারণ তার মনে হচ্ছে সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, কিছু সময়ের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু কি করবে সে, পালাতে হলে শক্তি লাগবে, যা তার মধ্যে একটুও অবশিষ্ট নেই। সে ধপ করে নিচে পড়ে গেল। নিজেকে তোলার চেষ্টা করল। কিতু উঠতে পারল না। তাই পেছাতে শুরু করল বসেই। কিন্তু লোকটা তার দিকেই আসছে আর বাজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে। সেই কথাগুলো শ্রুতির মস্তিষ্ক পর্যন্ত না পৌঁছালেও লোকটার বলার ধরন দেখে বুঝতে পারছে যে লোকটা খারাপ কিছুই বলছে। হয়তো অনেক বেশি খারাপ।
.
এক পর্যায়ে শ্রুতির পিঠ দেওয়ালে থেকে গেল। লোকটার থেকে তার দুরুত্ব ও অনেক কমে এসেছে।
চলবে।