অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-০৮,০৯
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৮
এক পর্যায়ে শ্রুতির পিঠ দেওয়ালে থেকে গেল। লোকটার থেকে তার দুরুত্ব ও অনেক কমে এসেছে।
.
জাহিনের হঠাৎ খেয়াল হল যে শ্রুতি অনেকক্ষণ ধরে ওর চোখের সামনে নেই। থাকলেও তো দেখতে পারার কথা। কারণ জাহিন হেঁটে হেঁটে সবার সাথে কথা বলছিল। ও কি শ্রুতির উপর বেশি বেশি কিছু করে ফেলল? চিন্তায় পড়ে গেল জাহিন। সে ভাবল যে শ্রুতিকে দেখলে ক্ষমা চেয়ে নিবে। তাই শ্রুতিকে খোঁজা শুরু করে দিল।
.
.
–হেই ব্লেন্ডার বেবি, কি করো? এখানে এসেছ কেন?
–আপুর সাথে এসেছি। আর আমি ? আপাতত আপনাকে কোণ মশলার সাথে ব্লেন্ড করা যায়, তাই ভাবছি। আপনি কেন এসেছেন?
–তো কিছু পেলে? আর আমিও ভাইয়ার সাথে এসেছি।
–নাহ এখনো পাই নি, তবে গেস করেছি একটা।
–ওহ ওয়াও কি গেস করলে কেয়া?
–লাল মরিচ, আপনাকে ওটার সাথে ব্লেন্ড করলে খুব ভালো লাগবে।
–ওয়াও। গ্রেইট। তো কবে করবে এই মহান কাজ?
–আপনি পারলে আপনার সাইজের একটা বড় ব্লেন্ডার কিনে আনেন বা বানিয়ে আনেন, আমি এক্ষুনি ব্লেন্ড করে দিচ্ছি।
–কিন্তু সেরকম ব্লেন্ডার তো এখনো বানায় নি কেউ।
–ওহ তাহলে পুরনো যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে।
–হোয়াট? শিল পাটা?
–ওলে লে লে লে , আপনি কত্ত বুদ্ধিমান ! আমি শিহরিত।
কাব্য নিজের হাত চুলে বুলিয়ে বলল,
–বুঝতে হবে, আমি ব্রিলিয়ান্ট, কিন্তু তুমি বড্ড বোকা। আমাকে ব্লেন্ড করা, কিংবা বাটার কথা এখনো ভাবছ কেন? সেদিন তো জাস্ট তুমি যখন হলুদ বাটছিলে, আমি একটু হলুদই তোমার মুখে লাগিয়েছিলাম। সে ঝগড়াকে এখনো টেনে টেনে এত বড় করছ। তার বদলে চল, আমরা প্রেম করি।
–হাতুড়ি চিনেন?
–হ্যাঁ, চিনি।
–ছুরি চিনেন?
–হ্যাঁ চিনি।
–ড্রিল ম্যাশিন চিনেন?
–হুম, ওটাও চিনি। কিন্তু কেন?
–আমি প্রথমে আপনাকে ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে করে নকশা বানাব, তারপর সেটাকে চাকু দিয়ে কেটে সাইজ করব, তারপর সেগুলো হাতুড়ি দিয়ে পিষে আপনাকে দিব।
–ওয়াও, এক্সট্রাওরডিনারি ।
–আআআআ
হঠাৎ মেয়েলি আওয়াজে দুজনই পিছনে তাকায়। লামিয়াকে দেখে কাব্য বুঝে যায় যে ও এতক্ষণ ওদের সব কথাই শুনেছে।
–কি হয়েছে রে?
–আপু, আপনার কথা শুনে প্রথমে যা ভয় পেয়েছিলাম, কাব্য ভাইয়ার ‘এক্সট্রাওরডিনারি’ শুনে সেটা আরও বেড়ে গিয়েছে। তুই কি মানুষ ভাইয়া? আর তোমরা এতো সুন্দর ভাবে হাসতে হাসতে ঝগড়া কি করে পরিচালনা কর?
–তুই যাবি লামিয়া?
–ওকে ওকে তোমরা কন্টিনিউ করো, আমি যাচ্ছি, এমনিও দুটো পাগল একসাথে হলে যা যা করে ! আরেক্টুর জন্য হার্ট এট্যাক করি নি।
–যাহ্, বলছি এখান থেকে।
এদের ঝগড়া চলতেই থাকবে।
.
.
জাহিন ওর নানুর কাছে যায়। কিন্তু নানু বলেন যে শ্রুতি উনার সাথে দেখা করেন নি। নানু যাতে চিন্তিত না হয়ে পড়েন, তাই জাহিন উনাকে আশ্বাস দেয় যে শ্রুতি আশেপাশেই আছে। মামা আর মামিরাও একই কথা বলেন। তারা যাতে চিন্তা না করেন , সেজন্য জাহিন তাদের বলে যে শ্রুতি হয়তো আশেপাশেই আছে। শুভ, কাব্য, রাদিয়া, ইউসরা আর লামিয়া কেউই শ্রুতিকে দেখে নি। তাহলে শ্রুতি গেল কোথায়? জাহিনের চিন্তা বাড়ছে সময়ের সাথে সাথে। কিন্তু সে পার্টি টা নষ্ট করতেও পারবে না।
.
.
লোকটা শ্রুতির অনেক কাছে চলে এসেছে, শ্রুতির সাথে তার দূরত্ব অনেক কম। লোক নিজের মুখকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শ্রুতির কাছে আনে। অনেক বাজে তার দৃষ্টি। শ্রুতি নিজের মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এতে করে লোকটার হাসি যেন আরও এক ধাপ বেড়ে যায়। শ্রুতির নড়তে পারছে না। তার মনে হচ্ছে হয়তো এই লোকটাই কিছু মিশিয়েছিল ওর ড্রিংকের সাথে। লোকটা শ্রুতির মুখ ধরে জোর করে সামনে আনে আর সেই বিশ্রী হাসি দিয়ে ওর ব্লাউজের হাতায় টান দেয়। যার ফলে ওর ব্লাউজের হাত ছিঁড়ে যায়। শ্রুতির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু তার সামনের মানুষের সে দিকে কোন নজর নেই। সে নিজের মুখ সেদিকে নিজে গিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় সেখানে। শ্রুতি অবশ হয়ে নিজের অবস্থা দেখছে। মনের মধ্যে সে চিৎকার করে কাদলেও এখন যেন ওর গলাও অবশ হয়ে আছে। চতকার করার শক্তি পাচ্ছে না সে।
.
লোকটা যেই শ্রুতির আঁচল সরাতে যাবে, তখনই দরজায় আওয়াজ পায়। অনেকক্ষণ আওয়াজ হওয়ার পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে শ্রুতির যে আশা টুকু জেগেছিল, তাও নিভে যায়। লোকটা আবার শ্রুতির আঁচলের দিকে হাত বাঁড়ায়। কিন্তু তার আগেই দরজা ভাঙার আওয়াজ পায়। জাহিন দরজা সরতেই শ্রুতিকে ওই অবস্থায় দেখে নিজের উপরই এত রাগ উঠে যে লোকটাকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে দেখে শ্রুতি কান্নায় ভেজা চোখ। জাহিন লোকটাকে মারা বন্ধ করে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে অন্য এক রুমে আটকে রাখে আর শ্রুতির গায়ে নিজের কালো কোটটা মুড়ে দেয়। তারপর শ্রুতিকে কোলে তুলে সেখান থেকে বের হয়। জাহিন আর শ্রুতিকে এই অবস্থায় দেখে মিঃ রায় এগিয়ে আসেন। জাহিন উনাকে বলে উঠে,
–রুম নাম্বার ৪০৭ এ দরজা আটকানো আছে, ওটা খুলবেন না, আমি যতক্ষণ না বলব। আর ওখানে যে আছে তার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিবেন। হ্যাঁ অবশ্য চাইলে খুলতে পারেন। তবে ওকে ওখানেই রেখে দিবেন।
তারপর নিজের বডিগার্ড দেড় বলে,
–ওকে জাস্ট ফিনিশ করে দাও।
মিঃ রায় বলে উঠেন,
–কিন্তু…
জাহিন তার আগেই বলে,
–শ্রুতি কে দেখে বুঝতে পারেন নি?
জাহিনের আওয়াজ এত জোরে শোনা গেল যে সবাই তার দিকে তাকাল আর ভয়ে কাঁপতে থাকল। মিঃ রায় শ্রুতির দিকে তাকান নি আর। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন তিনি শ্রুতিকে। তিনি তার পি এ কে বলে সব একশন নেওয়া শুরু করেন। জাহিন ওদের সবাইকে উপেক্ষা করে শ্রুতিকে বলতে থাকে,
–শ্রুতি তোমার কিছু হবে না, আমি আছি তো, ডোন্ট ওয়ারী, আমি লেট করে ফেলেছিলাম। সরি শ্রুতি। কিছু মনে করে না। আমি আছি তো কিচ্ছু হবে না তোমার।
.
জাহিন বলতে বলতে ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকে। আর গাড়িতে নিয়ে সামনের সিটে বসিয়ে দেয়। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিট এ বসে শ্রুতিকে নিজের বুকে টেনে নেয়। আর গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
.
জাহিনের পরিবারের সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যায়। কেয়াও নিজে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল তাই কাব্য ওকে নিয়ে যায়। আর বারবার বোঝাতে থাকে যে ওর কিছু হয় নি। রাদিয়া রাস্তায় থাকা অবস্থায় একজন ডাক্তার কে ডাকিয়ে নেয়।
.
বাড়ি ফিরে ডাক্তার শ্রুতির চেক আপ করে ওষুধ দিয়ে চলে যান। আর যাওয়ার আগে জাহিনের সাথে কিছু কথা বলেন। বাড়ির বাকিরা শ্রুতির সাথেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু জাহিন জোর করে সবাইকে পাঠিয়ে দেয়। শুধু মামিকে শ্রুতির জামা পাল্টাতে সাহায্য করতে বলে। শ্রুতিকে অনেক কষ্টে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেয় জাহিন।
.
.
.
রাতে শ্রুতি ঘুমের মাঝেই কেঁদে উঠে। আর জাহিন পাশেই জেগে ছিল বলে সাথে সাথে শ্রুতিকে ধরে আর শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। এক সময় শ্রুতি শান্ত না হয়ে আরও অশান্ত হয়ে ওঠে। ঘুমএর ভেতরেই কান্না করতে থাকে চিৎকার দিয়ে ওঠে। হয়তো স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তাতেও প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। হয়তো স্বপ্নে আরও জোরে চিৎকার করছে, কিন্তু জাহিন আসতে শুনতে পারছে। তাই শ্রুতিকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আর কানের কাছে গিয়ে সাহস জোগাতে কথা বলতে থাকে ধীরে ধীরে।
–ডোন্ট ওয়ারী শ্রুতি, আমি আছি তোমার কাছে, কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। কেউ না।
শ্রুতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে জাহিনের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে।
চলবে।
#অন্তরালে_তোমার_বসবাস
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৯
সেই রাতে শ্রুতি ভয়ে বেশ কয়েকবার চিৎকার করে উঠেছিল। হ্যাঁ, হয়তো তার সাথে খারাপ কিছুই হয় নি। কিন্তু এটা সে তখনও জানতো না। সে মনে করছে সেই বাজে মুহূর্ত আর ভয়ে কেঁপে উঠছে। ইয়াই জাহিন জোর করে ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়। প্রথমে দেওয়া হয় নি। কিন্তু পরে বাধ্য হয়েই জাহিন খাইয়েছিল। প্রথমে শ্রুতিকে ডাকার চেষ্টা না করলেও পরে জোর করে খাইয়ে দেয়।
.
টানা দুই দিন শ্রুতি সেই রুম থেকে বের হয় নি। তার মনে ভয় বাসা বেঁধেছিল। নিজেকে শান্ত করতে চাইলেও বারবার সেই দৃশ্য ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। এই দুই দিন সবসময় বাড়ির কেউ না কেউ ওর সাথে ছিল। ওকে সামলানোর জন্য। ওর শক্তি যোগানোর জন্য। এমনকি জাহিন ও ওর পাশে ছিল সবসময়। তবে জাহিন যতক্ষণ ওর পাশে ছিল, তার বেশির ভাগ সময় শ্রুতির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েই পার করেছে। কারণ এখানে জাহিন নিজেকে দোষী ভাবছে। শ্রুতি তেমন কিছু না বললেও ওর চোখ অনেক কিছু বলত। কখনো জাহিনকে নালিশ করত, কখনো অভিমান, কখনো রাগ, তো কখনো জাহিনের অবস্থা দেখে কষ্ট। কিন্তু শ্রুতি মুখে কিছু বলত না।
.
শ্রুতি যে সেদিন নিজেকে ওই লোকটার থেকে বাঁচাতে পারতো না এমন কিছু না, তবে সেদিন ও যে পানীয় পান করে ছিল, তাতেই কিছু মেশানো হয়েছিল। যার ফলে শ্রুতির শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় নিজেকে দুনিয়ার সব চেয়ে অসহায় মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। লোকটার বিশ্রী হাসি, তার কথা বার্তা তার ইঙ্গিত শ্রুতিকে ভেঙে ফেলছিল, মনে অনেক বড় আঘাত করেছিল। যখনই ওই ঘটনা মনে পড়ে, শ্রুতি নিজের হাত পানি দিয়ে ধোঁয়া শুরু করে দেয়। ওই লোকটার বাজে ছোঁয়া যেন তখনও লেগে ছিল ওখানে।
.
২ দিন পর ঠিক হয়ে গেলেও সবার সামনে শুধু দ্বাভাবিক আচরণ করত সে শুধু। আসলে তার মনে কি চলছিল, সেটা শুধু সেই জানে। কখনো দেখা গিয়েছে হাত ধুতে ধুতে রক্ত বের করার পর্যায়। তবে এগুলোর সব কিছু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে সবার কাছে। কিন্তু যে ওই পরিস্থিতির স্বীকার , একমাত্র সেই বুঝতে পারে। নিজেকে চাইলেও স্বাভাবিক করতে পারে না। তাকে হয়তো শান্ত হতে বলা হয়, নিজেকে সামলাতে বলা হয়। কিন্তু এগুলো বলা সহজ। কিন্তু ভোলা কঠিন। যেটা শ্রুতির কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে যখন একা একা থাকে শ্রুতি।
.
মানসিক ভাবে শ্রুতির উপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল ওই ঘটনা। তবে কাউকে বুঝতে দেয় না শ্রুতি। কারণ টা অবশ্যই জাহিন। জাহিন ই ওকে বুঝিয়েছে এসব ভোলার জন্য। বুঝিয়েছে বললে ভুল হবে। ধমকিয়েছে শ্রুতিকে সে।
.
শ্রুতি মনমরা হয়েই বসে থাকত। কারো সাথে কথা বলত না। হয়তো কেউ না কেউ এসে ওকে খাইয়ে দিয়ে যেত। অন্যরা কথা বলত, ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করত। কিন্তু শ্রুতি ওদের কথার কোন উত্তর দিত না। একদিন শ্রুতি কে বোঝাতে আবার জাহিন বসেছিল ওর সামনে। কিন্তু শ্রুতির কোন রিয়েকশন ছিল না। শ্রুতিকে দেখে পাথরের মূর্তি বলে মনে হচ্ছিল। জাহিন ওকে সাহস জুগাতে অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। যাতে শ্রুতি দ্রুত ঠিক হতে পারে। কিন্তু শ্রুতির হয়তো সেদিকে কোন খেয়াল ছিল না। তাই জাহিন একটু চিৎকার করেই বলেছিল,
–কি হয়েছে তোমার শ্রুতি? কথা বলছ না কেন?
জাহিনের হঠাৎ চিৎকারে শ্রুতি সহ ওই রুমে উপস্থিত সবাই কেঁপে ওঠে। জাহিন শ্রুতির দুই বাহু ওর দুই হাত দিয়ে ধরে শ্রুতিকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে উঠে,
–তোমার কি ওই স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকার খুব শখ হয়েছে? হ্যাঁ? খুব ভালো লাগছে? লাগছে না তো? তাহলে পড়ে আছো কেন? বাড়ির সবাই চাচ্ছে তুমি ঠিক হয়ে যাও। কিন্ত তুমি নিজেই ঠিক হতে চাচ্ছ না। অন্যরা তো এই সুবিধা টুকুও পায় না। অন্যদের পরিবার তো বাড়ি থেকে বের করে দিতে দু বার ভাবে না। সেখানে বড় থেকে ছোট সবার সাপোর্ট পাচ্ছ, অন্তত তাদের জন্য তুমি নিজে ঠিক হতে পারো না? আর তুমি কি জন্য এতো কষ্ট পাচ্ছ? ওই লোকটার জন্য? কিন্তু ও তো তোমার কিছুই করতে পারে নি। তার আগেই সেখান থেকে তোমাকে সরিয়ে এনে ছিলাম আমি, তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন? কিছু কি, অনেক কিছু হও অনেকের সাথে। তারাও কিন্তু এভাবে বসে থাকে না। যদি তারা সাহসি হয়, তাহলে ঘুরে দাঁড়ায়। সেখানে তুমি নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারো, কিন্তু কিছু সমস্যা কারণে তখন পারো নি, তাই বলে এমন হয়ে থাকবে। অন্যরা যেখানে ঠিক হতে পারে সেখানে তুমি কেন ঠিক হবে না, যেখানে তোমার কিছুই হয় নি। কেন ত্মি বেঁচে থেকেও মৃত মানুষের মন আচরণ করছ? জানো না, সবাই কত চিন্তা করছে?
.
সব কথা শুনানোর পর জাহিন শান্ত হয়। কিন্তু সামনে দরজার দিকে তাকাতেই তার মুখ শুকিয়ে আসে। কারণ সেখানে শ্রুতির আব্বু আর আম্মু দাঁড়িয়ে ছিল। তারাও জাহিনের এমন রাগী রপ দেখে বেশ অবাক হয়েছিল। কিন্তু কি করবেন , বুঝতে পারেন নি তখন তারা। আসলে তখন তারা জাহিনের বাড়িতে এসেছিল শ্রুতির সাথে আবার দেখা করতে। গত দিন ও দেখা করে গিয়েছিলে তারা। কিন্তু জাহিনের বকা শুনে তারা ভাবছিলেন কি করা উচিত এই সময়। তবে তারা বুঝতে পারেন যে জাহিনের এই আচরণ দরকার ছিল। যদি শ্রুতির উপর একটু প্রভাব ফেলে। তাই জাহিন যখন তাদের দিকে অসহায় ভাবে তাকাল, তারা চোখের পলক ফেলে বোঝালেন যে সে ঠিকই করেছে। এতে জাহিন শান্ত হয়। কিন্তু পিছনে কেয়া দাঁড়িয়ে ছিল, শ্রুতির আব্বুর পিছনে। জাহিনকে দেখে তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তবে খুব মোটিভেটেড হয়েছে সে।
.
আন্যদিকে শ্রুতি ও ভাবা শুরু করে যে সে এমন কেন করছে? সত্যিই তো, তার দুই পরিবার তার জন্য কত চিন্তা করছেন। কিন্তু জাহিনের সামনে কিছু বলার সাহস আর পায় না। জাহিন উঠে সেখান থেকে চলে যায়। কারণ এই রুমে থাকলে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সবার সামনে শ্রুতির দুই গালে জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে পারত। তাই সে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। আর সেই সুযোগে রাদিয়া, ইউসরা, লামিয়া তিন জনে ”ভাবি” বলে জড়িয়ে ধরে। কেয়াও এটা দেখে শ্রুতির বাবার পিছন থেকে বের হয়ে আরেক কোণ থেকে শ্রুতির গলা জড়িয়ে ধরে। শ্রুতিও মুচকি হাসে, যা দেখে সবার চিন্তা কমে যায় অনেক। যেন বুক থেকে এক বড় বোঝা নেমে গেল। এদিকে জাহিন পাশের রুমে গিয়ে নিজেকে শান্ত করায় প্রচেষ্ট। কারণ সে রাগের বসে অন্য কিছু করলে হিতের বিপরীতে কিছু হতে পারে। তাই সে চায় না নিজের রাগের জন্য শ্রুতি কে কিছু করে বসতে। নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে। সে কখনই শ্রুতিকে সামান্য বকা দেওয়ার কথা ভাবে নি পর্যন্ত। কিন্তু আজ শ্রুতিকে এতক্ষণ ঝেড়ে আসলো। একন নিজের কাছে কেমন জানি লাগছে জাহিনের। সেই বা কি করবে? সবাই বলে বলে মুখের ১২ টা বাজিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু শ্রুতি ম্যাডাম কারো কথা সুঞ্ছেই না। এর থেকে বেশি দিন গেলে এই ভয় ওর মনে বাসা বেঁধে ওকে বড় কোন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করত। সেটা যে নিজের ক্ষতি সেটা ভাবতেই জাহিনের ভয় আরও বেড়ে যায়। শ্রাবণী তো ওর জীবন থেকে চলে গিয়েছে, এতে তেমন কিছু না হলেও শ্রুতি কিছু হওয়ার কথা ভাবতে পারছে না জাহিন। কেন এই অনুভূতি?
.
সেদিন ও শ্রুতি নিজের রুমে এসে একটুর জন্য বসেছিল। কিন্তু ওই চিন্তা গুলো ওকে শান্তিতে বসতে দিচ্ছিল না। চোখ বন্ধ করলেই কানে যেন ভেসে আসছিল সেদিনের কথা। নিজের হাতের দিকে তাকাতেই মনে পড়ল সেই ঘটনা। বাথরুমে চলে গেল সে। এতদিন শাড়ির আঁচল বাম দিকে দিতে শাড়ি পড়ত সে। কিন্তু এই কয়দিন ডানদিকে দেয় সে। তাই হাতের সাথে সে কি করত, কেউ জানতে পারতো না। কিন্তু ওইদিন জাহিন দেখে ফেলে। হাত থেকে রক্ত বের হওয়ার অবস্থা ছিল যেন। জাহিন এই কয়দিন শ্রুতির আচরণ দেখে ভেবেছিল যে শ্রুতি ঠিক হয়ে গিয়েছে অনেকটা। কিন্তু সেদিন দেখার পর জাহিন শ্রুতির গায়ে প্রথমবারের মতো হাত তুলেছিল। থাপ্পড় মেরেছিল জাহিন। তারপর শ্রুতিকে রুমে এনে বসিয়ে সেখানে ওষুধ লাগাতে শুরু করে, যেন কোন ইনফেকশন না হয়ে যায়। আর ইচ্ছে মতো বকছিল শ্রুতিকে।
.
শ্রুতি প্রথম দিকে জাহিনের কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিল ঠিকই। কিন্তু তারপরের কথা গুলো আর শোনা হয় নি তার। সে এক দৃষ্টিতে জাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। জাহিন ওর কাজ শেষ হতে শ্রুতির দিকে তাকায়। তারপর শ্রুতিও নিজের নজর সরিয়ে নেয়। কিন্তু এরপরও জাহিনের বকা দেওয়া শেষ হয় নি। পরে নানু এসে জাহিনের কান ধরে টেনে নিয়ে যায়।
.
মূলত জাহিন কে বললেই সে চলে যেত। কিন্তু জাহিনের কান টেনে ধরল কারণ তিনি চাইছিলেন শ্রুতি হাসুক। আর তাই হল।
.
তবে এই ঘটনা টা শ্রুতি ঠিকই বুঝতে পারল। এর কারণ নানু কখনো জাহিন কে বকেন না। জোর গলায় কথা বলেন না। তিনি কি না আজ জাহিনের কান ধরলেন? এটা অবিশ্বাস্য কিন্তু এটাই হয়েছে। তার সাথে শ্রুতি বুকঝতে পারল কে এই পরিবার তাকে কতটা ভালোবাসে।
চলবে।