অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-১০,১১
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-১০
জাহিনের নানু জাহিনের পিছনে উঠে পড়ে লেগেছেন যেন জাহিন গামের বাড়ি যেতে রাজি হয়। কিন্তু তিনি তখনও তাকে রাজি করাতে পারেন নি। জাহিন গ্রামের জীবনের সাথে অভ্যস্ত নয়। সেখানে থাকতে পারলেও রোজকার অভ্যাসের সাথে সেটার মিল নেই। তাই গ্রামে যেতে চায় না। এছাড়া সেখানে গেলে দাদু আর সেখান থেকে আসতে দিবেন না। আর নানু তো আছেন ই , সেখানে একবার ঢুকাতে পারলে আর জীবনে শহরে আসার অনুমতি দিবেন না। নানু বাড়ি ভারতে হলেও বাংলাদেশে এসে সবাই জাহিনের দাদু ভাইয়ের বাড়িতেই থাকে। সেখানে সবাই ভালভাবেই থাকতে পারে। জমিদার পরিবার হওয়ায় বাড়িটা অন্যান্য সকল বাড়ি থেকে আলাদা আর একসাথে অনেক মানুষ থাকতে পারে, তাই থাকার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু জাহিন রাজি হলে তো?
–জাহিন, তোকে কতবার বলতে হবে যে রাজি হয়ে যা।
–তোমরা চাইলে ঘুরে আসতে পারো, আমি মানা করি নি। আমার এখানে অনেক কাজ আছে। সেগুলো ছেড়ে আমি তোমাদের সাথে যেতে পারব না। তোমরা ঘুরে আসো। সরকার হলে সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।
–কিন্তু তোকেও আমাদের সবার সাথে যেতে হবে।
–আমি বলে দিয়েছি, আমি যেতে পারব না। তোমরা যাও।
–জাহিন বেশি বাড়াবাড়ি করিস না, রাজি হয়ে যা। এমনিই আমরা চলে গেলে তুই ঘোরে একা থেকে কি করবি?
–আমি একা থাকব কেন? আমার সাথে শ্রুতিও থাকবে।
তখনই শ্রুতি বলে উঠল,
–আমি আপনার সাথে থাকব কেন? আমিও ওদের সাথে থাকব। আমি শুনেছি শুভ গ্রাম খুব…
–আমি বলে দিয়েছি শ্রুতি এখানে থাকবে মানে থাকবে। আমাকে ও কাজে সাহায্য করবে। কাজ আছে অনেক।
তখন জাহিনের নানু আবার বলে উঠেন,
–শ্রুতি কেন থাকবে এখানে? তুই একা থাকবি। তুই কাজ করবি, কর কিন্তু শ্রুতিকে দিয়েও কেন কাজ করাবি তুই? শ্রুতি আমাদের সাথেই যাবে। আর তুই ও যাবি। আমি কোন না শুনতে চাই না।
–সব কাজ তোমাদের জোর করে না করালে হয় না? আগের বার তো তাই করিয়েছ। আমাকে কেন এমন করাও ?
রেগে বলে উঠল জাহিন। বলেই সেখান থেকে উঠে চলে গেল। সে সবে মাত্র অফিস থেকে শ্রুতিকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু নানুর কথায় নিজের রাগ সামলাতে পারে নি। আগের বার নানু জোর করে শ্রুতির সাথে বিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এমন না যে উনি চাপিয়ে দিয়েছেন সব জাহিনের উপর। হয়তো বোঝা হিসেবেই গণ্য করছে জাহিন। এখনো ভালবাসতে পারে নি সে শ্রুতিকে। তাহলে কি কোন ভুল করলেন মিসেস রেজওয়ান? নাহ, উনি তো জাহিনের ভালোর জন্যই এমন করেছেন। এমনিই জাহিনের কম বয়স হয় নি যে তখনও অবিবাহিত ছিল। তাছাড়া জাহিন এখানে একা থাকত, দাদু বাড়ি থাকা স্বত্তেও সে দাদু ভাইয়ের সাথে থাকত না। তাদের দেখাও হয় খুব কম। কিন্তু কেন জানি খারাপ লাগা কাজ করছে নানুর। তিনি কি সত্যিই বেশি জোর করেছেন জাহিনের উপর? কারণ যাওয়ার আগে তিনি জাহিনের চোখে স্পষ্ট অভিমান দেখেছেন।
.
.
.
অন্যদিকে শ্রুতি আজকাল এই বুঝে আরে না যে সে কেন বেশ কয়েক দিন ধরে ঘুমের ওষুধ না খেয়েও ভালোমতো ঘুমাতে পারছে? বেশ কয়েক দিন ধরেই সে খেয়াল করেছে যে সে শোয়ার আগে ঘুমের ওষুধ খায় নি। তার আগেই জাহিন কোনোভাবে ওকে ঘুমাতে নির্দেশ দিয়েছে। আর ঘুমের ওষুধ ও ছিল না ওর কাছে। অন্য কাউকে বলে নি কারণ ও চায় না ওর জন্য কেউ আবার চিন্তিত হোক। তাই কাউকে বলা হয় নি, আবার কাজের চাপে ওষুধ কেনাও হয় নি। সুতরাং ওষুধ নেওয়াও হয় নি শ্রুতির। কিন্তু গত কয়েক রাত ধরে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে না। বরং সে শান্তিতেই ঘুমাচ্ছে। বেশ ভাবায় তাকে ব্যাপার টা।
.
জাহিন নিজের রুমে ঢুকে শ্রুতিকে এক দৃষ্টিতে এক দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতে দেখে হালকা কেশে ওঠে। এতে করে শ্রুতি ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। সে দেখে যে তখন জাহিনের কফির সময় হয়ে গিয়েছে। তাই সেখান থেকে সোজা রান্না ঘরে চলে যায় কফি বানাতে।
.
জাহিনের কফি বানানোর সময় প্রতি বার শ্রুতি এক চুমুক নিয়ে দেখে আসলেই সে অতটা তেঁতো কফি পান করতে পারবে না কি? এটা শ্রুতির পুরনো অভ্যাস। জাহিন যে কড়া কফি খায় এটা অন্যদের কাছ থেকে শুনেছিল সে আর কি করে বানাতে হয় তাও শিখেছিল। কিন্তু কফি বানানোর পদ্ধতি দেখে তার মনে হয়েছে জাহিন কফির উপর অত্যাচার করে। নিতান্ত চিনি না দিয়ে আর কম পানিতে এতো কফি দিয়ে নিজের মুখের উপর অত্যাচার করে কি পায় জাহিন, সেটা ভেবে পায় না শ্রুতি। কিন্তু সেও জানতে চায়।
.
.
অফিসে থাকাকালীন সময়ে জাহিনের কফির দায়িত্ব শ্রুতির উপরই ছিল। তাই কফি বানাত শ্রুতি নিজেই। অন্য স্টাফ দেরও অনেক কাজ থাকে অফিসে। তাই আর অন্যদের জ্বালাতে চায় নি সে। একবার এক স্টাফ থেকেই শিখে নিয়েছিল। প্রথম দিকে তার কাছে খটকা লাগে, যে এই কফি কি করে জাহিন পান করে। কিন্তু নিজেকে সান্ত্বনা দিত তখন শুধু। যে এই কফি সে এক চুমুক নিলেও সোজা উপরের টিকিট বিনা পয়সায় কাটতে পারে, এমনটা শ্রুতির ধারণা। কিন্তু মানব মন কৌতূহল প্রবণ। সে অজানাকে জানতে চায়, অদেখাকে দেখতে চায়। আর জীবনে এক বারের জন্য হলেও অজানা খাবার টেস্ট করতে চায় হয়তো। টিভি তে কত মানুষ কত কিছু খায়, আর শ্রুতি এই সামান্য কফি পান করতে পারবে না? এটা ভেবেই এক দিন সাহস করে কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে দেয়। অবশ্য এই চুমুক দেওয়া আর পাথর নিজের হাত দিয়ে ভাঙার চেষ্টা শ্রুতির কাছে সমান লাগছিল। ইচ্ছে করছিল যে কফি পান করতে, আবার সাহস মুহূর্তেই নিভে যাচ্ছিল। তবু অনেক বার মুখ এর সামনে থেকে কফি কাপ উঠা নামা করে শেষমেশ এক চুমুক নিয়ে নেয়। নেয়ার পর তার বাজে অবস্থা ছিল। অফিসের যেখানে কফি বানানোর সরঞ্জাম ছিল, সেখান থেকে চিনির কৌটা বের করে খাওয়া শুরু করে সে। পুরো কৌটা খালি করে নি তবে বেশ পরিমাণে নিজের মুখে চালান করেছিল শ্রুতি। তারপর আবার কফি জাহিনের জন্য নিয়ে গিয়ে ওর টেবিলে রেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। জাহিন কাজে ডুবে ছিল, তাই সামনে কেই আদৌ আছে কি না, সেদিকে খেয়াল ছিল না তার। সে বিনা দ্বিধায় সেই কফি নিয়ে পান ক্রা শুরু করে। তার চোখে মুখে কোন কষ্টের ছাপ ছিল না। কিন্তু ছিল এক আনন্দের ছাপ। যেই রিয়েকশন শ্রুতি ডেইরী মিল্ক চকোলেট খাওয়ার সময় দেয়। এটা দেখে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা ছিল। কিন্তু তাও নিজেকে সামলে বলে যে জাহিন নিশ্চয়ই কাজে ব্যস্ত ছিল তাই বুঝতে পারে নি। তাই নিজে থেকেই জাহিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে যে কফি কেমন হয়েছে । জাহিন ওর সামনেই আরেক চুমুক নিয়ে বলে যে ভালোই। এর পর শ্রুতি আরও কড়া করে কফি বানিয়ে পান করিয়েছে জাহিন কে দিয়ে। কিন্তু এতেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি জাহিন। তাই প্রতিবার জাহিনকে দেওয়ার আগে নিজে একবার করে টেস্ট করে নেয় যে সেও কোন দিন জাহিনের এই কফি পুরো শেষ করতে পারবে কি না। কিন্তু আজও সেই একই কাজ করে। রান্নাঘর থেকে চিনির কৌটা নিয়ে মাটিতেই বসে পড়ে আর সেটা খাওয়া শুরু করে। এই কাজের জন্য শ্রুতি নির্দিষ্ট সময়ের ৫ মিনিট আগে থেকেই কফি বানাতে যায়। জাহিন এই কথা জানত। তাই সে প্রতি বারের মতো এই বারও ছবি তুলে নেয় লুকিয়ে। পরে শ্রুতিকে ব্ল্যাকমেইল করার কাজে দেবে তাই।
.
.
.
–আদিয়াত রায়হান।
চলবে।
#অন্তরালে_তোমার_বসবাস
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-১১
–আদিয়াত রায়হান।
–ওহ, ঠিক আছে। ওয়েট, কে?
–আদিয়াত রায়হান , স্যার।
–তুমি কি ওকে কাজটা দিয়ে দিয়েছ?
–জ্বি স্যার। উনিই লাস্ট কয়েকদিন ধরে শ্রুতি ম্যাম এর কাজ দেখছেন। উনিই শ্রুতি ম্যামের অ্যাসিস্টেন্ট।
–তুমি ওকে কেন কাজ দিয়েছ? অন্য কাউকে নিয়োগ দিতে পারো নি? দুনিয়াতে অভাব পড়ছিল কাজটার জন্য। ওকে বাদ দিয়ে দাও। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। ওকে অন্য অফিসে কাজ দিয়ে দাও।
–কিন্তু সেটা সম্ভব নয় স্যার। ওকে আমরা ২ মাসের জন্য কাজে নিয়ে নিয়েছি। আর আপনিই তো বলেছিলেন সাইন করিয়ে নিতে।
–নিয়োগ দেওয়ার আগে আমাকে জানাবে না? রোহিত এটা কি করলে তুমি?
–স্যার আমি তো আপ…আপনাকে জানিয়েছিলাম। আপনিই হ্যাঁ বলেছিলেন।
–তাই বলে তুমি ওকে… ইডিয়ট।
.
বলেই ফোন কেটে দিল। এতক্ষণ জাহিন রোহিত এর সাথে কথা বলছিল যিনি ওই অফিসের ম্যানেজার। শ্রুতি অসুস্থ হওয়ায় ওর উপর যেন চাপ না পড়ে সেজন্য ই শ্রুতির জন্য অ্যাসিস্টেন্ট এর ব্যবস্থা করতে বলেছিল জাহিন। কিন্তু অ্যাসিস্টেন্ট এর জন্য যে মেয়েদের খুঁজতে বলবে, সেটা বলতে ভুলে গিয়েছিল। যার জন্য এখন রোহিত বকা খাচ্ছিল। তবে সে-ই বা কি করত? তাকে তো তখন জাহিন বলে নি যে অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে ছেলেদের নেওয়া মানা। তাই সে চুপচাপ বকা খেয়ে নিল। জাহিন কল কাটতেই নিজের চেয়ার এ বসে পড়ল। সারাদিনের কাজ করে বেশ ক্লান্ত ছিল রোহিত। কিন্তু হঠাৎ ফোনের রিং বেজে ওঠায় নিজের হাতে ফোন ধরে। ধরতেই জাহিন এর আওয়াজ শুনে চেয়ার ছেড়ে ঠাস করে উঠে দাঁড়ায়, এতক্ষণ সে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। কিন্তু ফোন কাঁটার সাথে সাথে নিজেকে আবার সেই চেয়ারে ফেলে দেয় রোহিত। তার এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জাহিনের শেষের কথা মনে পড়তেই নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারে। এতদিন সে তার স্যার এর কাছে গাধা ছিল। এখন সেখান থেকে প্রমোশন পেয়ে ইডিয়ট হয়েছে। তাহলে স্যার কি শ্রুতি ম্যাম কে ইডিয়ট বলা ছেড়ে দিয়েছেন।
.
.
এর পিছনের কাহিনী টা কিছুটা এরকম। শ্রুতি একটা সহজ ফাইল এর উপর কাজ করছিল সেদিন। তখন সে নতুন নতুন অফিসে এসেছিল। তাই যাতে কোন ভুল না হয়, সেজন্য সবাইকে প্রচণ্ড জ্বালাত, প্রতিটা লাইন ঠিক করার আগে জিজ্ঞেস করে নিত। এতে রোহিত বেশি ভুগত কারণ, রোহিত এর উপর দায়িত্ব ছিল শ্রুতির কাজ দেখা। সেদিন ফাইল এর একটা লাইন এ শুধু একটা বানান ভুল বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেটা কি ঠিক লিখেছে কি না সেটা বুঝতে পারছিল না। পরে যখন শেষ বারের মতো জাহিনকে দেখাতে পাঠাল, জাহিন দেখে সব বলল ঠিক আছে। তাও শ্রুতি বলল,
–স্যার ১৪৭ পেইজের ১৩ নং লাইনের এই বানান টা কি ঠিক?
–হ্যাঁ ঠিক আছে।’
–কিন্তু আমার ভুল মনে হচ্ছে।
–আমি বলছি তো ঠিক আছে।
–আপনি আর এক বার দেখে নেন তো ঠিক আছে কি না?
জাহিন বারবার বলছিল যে সব ঠিক আছে কিন্তু শ্রুতি মানতে চাইছিল না। তাই শ্রুতি সেই ওয়ার্ডের আরও নিত্য নতুন বানান বলছিল যেগুলো সবগুলোই ভুল। তাই জাহিন ওকে ইডিয়ট বলে ফেলে। কিন্তু তাও শ্রুতি মানতে নারাজ যে ফাইলের বানান টা ঠিক আছে।
.
সেই সময় রোহিত রুমে ঢুকছিল এক স্টাফের সম্পর্কে কথা বলতে। জাহিন শ্রুতিকে বিশ্বাস করানোর জন্য রোহিত কে ওই ওয়ার্ডের বানান জিজ্ঞেস করে। রোহিত এবার কিছুক্ষণ মাথা চুলকে আরও ভুল একটা বানান বলে দেয়। এটা দেখে শ্রুতি বলে,
–বলছিলাম না স্যার, এই বানান টা ভুল।
–স্যার?
–জাহিন, শ্রুতি ইউ আর এন ইডিয়ট আর রোহিত, তুমি একটা গাধা। একটা সামান্য স্পেলিং এর কত কিছু করে ফেলছ?
বলে জাহিন গুগল সার্চ করে শ্রুতিকে বিশ্বাস করায় আর রোহিত গাধা উপাধি পেয়ে যায়। সেদিন।
.
.
অফিসে গিয়ে জাহিন এক আলাদা দৃশ্য দেখে আজকাল। আজকাল শ্রুতি বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জাহিন বুঝতে পারে না শ্রুতির এই ব্যস্ততার কারণ। সকালে ঘুম থেকে তোলার সময় সেই যে ঝগড়া হয়, তারপর আর শ্রুতির দেখা পাওয়া যায় না। তবে এর মধ্যে কাজের কাজ একটাই হয়েছে যে শ্রুতি র সাথে ঝগড়া যাতে কম হয় সেজন্য জাহিন বিছানা গোছানোর কাজ টা নিজেই করে। যে কি না কখনো কোন কাজ করতে চাইত না। বলতে গেলে নিজের জিদের বশেই কোন কাজ করতে চাইত না। ছোট থাকতে একবার এই নিয়ে একটা ছেলের সাথে ঝগড়া হয়েছিল এই নিয়ে। সেই থেকে সে ঘরের কাজ আর কোন দিন করে নি। কিন্তু শ্রুতির চিৎকার শুনে সকালে হার্ট এট্যাক না করতে চাওয়ায় কাজে লেগে পড়ে। এতে অবশ্য এক্সারসাইজ হয়ে যায় তার। তাই অন্তত নিজের মেদের উপর নিয়ন্ত্রণের উপায় ভেবেই নিজেকে শান্ত রেখেছে। তবে আজকাল শ্রুতির সাথে অন্যান্য কাজেও সাহায্য করে।
.
তবে শ্রুতির এই গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ ভাবাচ্ছে জাহিনকে। শ্রুতি কাজ যাতে কম হয় সেজন্যই তো আদিয়াত কে রাখা হয়েছে। কিন্তু আদিয়াত কাজ না করে শ্রুতি কাজ করছে এটা দেখে বেশ রাগ লাগে জাহিনের। আরও বেশি রাগ লাগে যে শ্রুতি অন্তত কোন ফাইল নিয়ে কথা বা কফি এসব ঠিক করতে জাহিনের কেবিনে আসতো, কিন্তু এখন সে না কফি দিতে আসে আর না ফাইল। কফি অন্য কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় আর ফাইল রোহিত এর মাধ্যমে দেখায়। শ্রুতি কাজের প্রতি দায়িত্ব বান ঠিক আছে, কিন্তু টি বলে জাহিনকে ভুলে যাবে?
.
.
নিজের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে জাহিন। কাজের চাপ বেশি থাকায় শ্রুতির সাথে ঠিকমতো কথা হয় না জাহিনের। তাছাড়া শ্রুতি ওই পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়েছে, বেশিদিন হয় নি। তাই জাহিন চাচ্ছে না কোন প্রকার চাপ যাতে শ্রুতির মস্তিষ্কে পড়ে। শুধু কারণ কি এটাই? না, এটা নয় । জাহিন শ্রুতিকে ঠিক মতো সারাদিন না দেখতে পেয়ে অস্থর হয়ে উঠছে। কিন্তু নিজের মনকে মানাতে পারছে না যে শ্রুতির জন্য অস্থির হচ্ছে। তবে এই অস্থিরতার পরিমাণ এতো গভীর কেন? কেন এই অস্থিরতা পুরনো অস্থিরতার সাথে মিলে যাচ্ছে? সেই যে কাদা পরীকে দেখেছিল। তারপর ১ মাস যে অস্থিরতায় ভুগেছিল জাহিন, সেটা ই কি এই অস্থিরতার সাথে মিলে যায়? যায় হয়তো। কিন্তু কাদা পরী তো শ্রুতি নয়। ওটা তো শ্রাবণী। তাহলে কি শুধু শ্রাবণীর বোন হওয়ায় ওর প্রতি এমন টান অনুভব করছে জাহিন। কি করে সম্ভব? জাহিন না চাইলেও শ্রাবণীকে ভালোবাসে। তাহলে জাহিনের ভালোবাসায় কি ঘাটতি রয়েছে। না কি ওর ভালোবাসা বদলে গিয়েছে? এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় আসলেও তেমন পাত্তা দেয় না জাহিন। ওর কাছে এসব চিন্তার কোন গুরুত্ব নেই। ও শ্রাবণীকে ভালবাসত আর এটাই ফাইনাল। যে এখন ওর কাছে নেই, ওর সাথে নেই, পরিবারের চাপে পড়েই সে শ্রাবণীর বোন শ্রুতিকে বিয়ে করেছে। এর বেশি কিছুই নয়। প্রতিবার মনে যখন প্রশ্ন জড়ো হয়, তখন এসব কথা বলেই নিজেকে সেই প্রশ্ন থেকে সরিয়ে নেয় জাহিন। সেটা ক্ষণিকের জন্য সফল হলেও আবার জাহিনকে তাড়া করে। কিন্তু সেটাকে পাত্তা দেয় না সে। বরং নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখে। যাতে তার সঙ্গী হয় ল্যাপটপ টা।
.
.
কেবিন থেকে বের হয়ে সোজা শ্রুতির কেবিনে চলে যায়। জাহিনের পাশেই শ্রুতির কেবিন। সে নিজের কেবিনে বসেই শ্রুতিকে দেখতে পারে। তবে শ্রুতি নিজের কেবিন হেকে জাহিনকে দেখতে পায় না। এর কারণ ওদের কেবিন আলাদা করা হয়েছে কাঁচ দ্বারা। আগে সাধারণ ইট পাথরের দেওয়াল ই ছিল। কিন্তু সে এই কাঁচের দেওয়াল করিয়েছে পরে। এর কারণ তাও শ্রুতি। সে একদমই নিজের খেয়াল রাখে না। কাজ করলে সেই কাজে ডুবে যায়। যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ হয়, সেই কাজ থেকে বের হয় না। এর কারণে টানা তিন দিন্ন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে কাজ করেছিল ও। যার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে জাহিন আশ্চর্য হয়েছিল এই জন্য যে, এই তিন দিন শ্রুতিকে দেখে মনেই হয় নি যে সে দুর্বল। জাহিন নিজে হেঁটে হেঁটে সকলের কাজ দেখছিল। তখন শ্রুতির কেবিন সামনে পরায় সেখানে ঢুকে দেখে যে শ্রুতি তার কম্পিউটারে কোন ফাইল সেভ করে সেটা বন্ধ করল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পড়ে যেতে নিল। কিন্তু তার আগেই শ্রুতি কে জাহিন ধরে ফেলেছিল। যার কারণে জাহিনের উপর ই সে পড়ে আর অজ্ঞান হয়ে যায়। জাহিন হতভম্ব হয়ে ১ মিনিট আগের শ্রুতি আর তখন ওর কাটে পড়ে থাকা শ্রুতির তুলনা করছিল। কিছুক্ষণ আগে মনেই হয় নি ওকে দেখে যে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কারণ শ্রুতি যেভাবে ছুটোছুটি করে কাজ করছিল, দূর থেকে কেউ মনে করতেই পারবে না যে শ্রুতি কাজ করার অবস্থায় নেই। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে ও কতটা দুর্বল আর চিন্তিত কাজ টা নিয়ে। পরে ডাক্তারের কাছ থেকে সব জানতে পারে জাহিন। তাই দেরি না করে সেই দেওয়াল ভেঙে কাঁচ লাগানোর ব্যবস্থা করে জাহিন। শ্রুতি আজও জানে না যে তার কেবিনের কাঁচ কি জন্য লাগানো হয়েছে। আর জাহিন খুব ভালোভাবেই শ্রুতির কাছ থেকে এই বিষয় টা গোপন রেখেছে। জাহিনের কেবিনে এই কাঁচের দেওয়ালে পরধা টাঙানো। তাই সেটা না সরানো পর্যন্তও বোঝা যাবে না যে ওই কাঁচ দিয়ে অপর রুমের দৃশ্য দেখা যায়। শ্রুতি কখনো সেই পর্দা সরায় ও নি। তাই জানে না কিছু।
.
.
তবে এখন জাহিন সেই কেবিন দেখতে পারছে না। কারণ শ্রুতির কেবিনে কিছু কাজ চলছে। কিছুদিন আগেই ইলেকট্রিক্যাল কিছু সমস্যা হওয়ায় শ্রুতির কেবিন বদলানো হয়েছে। তাই নিজ কেবিন থেকে বের হয়ে শ্রুতির কেবিনে গিয়ে উকি মারে। দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল।
.
.
–তোমার নাম তো আদিয়াত রায়হান, তাই না?
–ইয়েস ম্যাম।
–কিন্তু এত বড় নামে আমি ডাকছি না। এর বদলে আমি তোমাকে আদি বলে ডাকব, ঠিক আছে?
.
বলেই শ্রুতি আদির মাথায় হাত রাখল। এতে জাহিন তেলে বেগুনে- পেয়াজে – মরিচে সব ভাবেই জ্বলে উঠল।
.
”আমাকে তো জীবনে আপনি ছাড়া, কিংবা স্যার ছাড়া ডাকেন নি ম্যাডাম, আর আজ অন্য একটা ছেলের নিক নেইম দিচ্ছেন, কি সুন্দর ! তুমি করে ডাকছেন? হাউ বিউটিফুল ! এর সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন, আর আমার কফি পর্যন্ত নিজের হাতে পাঠাচ্ছেন না ম্যাম। ”
.
ভাবতেই জ্বলার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। শ্রুতি আদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল ছোট ভাই এর মতন ভেবেই। কিন্তু জাহিন তো সেটা জানে না।
.
–ওকে ম্যাম।
–তাহলে কাজের কথায় আসি।
তবে ওর আর কাজের কথায় আশা হল না শ্রুতির ।
চলবে।