অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-১২ ,১৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-১২
তবে ওর আর কাজের কথায় আসা হল না শ্রুতির । তার আগেই জাহিন ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আদির সামনেই ওকে কিছু না বলে শ্রুতির হাত টেনে ওই রুম থেকে প্রথমে বের হল তারপর নিজের রুমে নিয়ে যেতে লাগল। এদিকে আদি বুঝতে পারল না যে কি হল কিছু সময় আগে। ওর ম্যাম কাজের কথা বলতে শুরু করতেন, কিন্তু তার আগেই স্যার এসে ম্যাম কে নিয়ে গেলেন। তাও ডেকে না, হাত টেনে সরাসরি। ওর সামনে কি কেউ ওর ম্যাডামের অপহরণ করল? এখন যদি আদির চেহারা দেখানো যেত তাহলে দেখা যেত যে আদির মাথার উপর একটি লাল রং এর ‘প্রশ্নবোধক চিহ্ন’ গোল গোল ঘুরছে। সে বুঝতেই অনেক খানি সময় নিল যে এতক্ষণ কি হল।
.
জাহিন শ্রুতি র কোন কথা না শুনে ওকে টানতে টানতে নিজের কেবিনে নিয়ে গেল। শ্রুতি নিজেও মাঝে কোন কথা বলে নি অবশ্য। সে চায় নি যে অফিসে কোন প্রকার সিনক্রিয়েট হোক। তাই চুপচাপ জাহিনের হাতে হেঁটে চলল। জাহিন ওকে নিজের কেবিনে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল আর শ্রুতিকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দরজার সাথে লাগিয়ে দাঁড় করালো। তারপর নিজের ডান হাত দেয়ালে জোরে শব্দ করে রেখে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শ্রুতির দিকে। নিজেও বলল ও,
–কি হচ্ছিল এতক্ষণ?
–আমি আদিকে ওর কাজ বুঝিএ দিচ্ছিলাম।
শ্রুতির সোজা উত্তর। কিন্তু এতে জাহিন আরও রেগে গেল। নিজের রাগ সামলাতে নিজের বাম হাত মুঠ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বলল,
–কি করছিলে এতদিন তুমি?
–আমি কি করলাম, আমি তো কাজ করছিলাম। এই সময় অফিসে কাজের চাপ বেশি হয়ে গিয়েছিল। তাই সেটাই কমানোর চেষ্টা করছিলাম।
–আর আমার কেবিনে আসা বন্ধ করে দিয়েছ কেন? এমনকি কফি পর্যন্ত অন্য স্টাফ কে দিয়ে পাঠাও?
–আমি ব্যস্ত ছিলাম।
–ওহ এত ব্যস্ত যে নিজে বানাতে পারো, কিন্তু রুমে এসে দিয়ে যেতে পারো না? তাই না?
–আ আমি সত্যিই বস্ত ছিলাম। আর আপনি জানলেন কি করে যে আপনার কফি আমি বানাই ? আমি তো…
–তোমার কফির টেস্ট আমি জানি, আর এটা ভেব না যে কফির কাপে লিপস্টিকের দাগ এতদিন আমি দেখি নি? লাস্ট কয়েকদিন ধরেই ছিল না।
–এসব কি বলছেন আপনি? আমি কি জানি যে কে লি লি লি… যাই হোক প্রমাণ কি?
–সিসি টিভি ফুটেজ দেখানো লাগবে?
–না , ন না, আমি ঠিক আছি , আর ওসব মিথ্যা কথা, আমি তো কফি পান করি না।
–”ঠাকুর ঘরে কে? আমি কলা খাই নি।”
–আপনি আবার ঠাকুর ঘর কোথা থেকে আনছেন ? বাই এনি আমি ধর্ম বদলান নি তো?
–আমি জানি শ্রুতি যে তুমি সবটা বুঝেছ। কিন্তু এই কয়দিন ধরে আমাকে ইগ্নোর করছ কেন?
–আমি তো কাজে…
–ব্যাস শ্রুতি। আর মিথ্যা নয়। ওই দিন পার্টির ঘটনা নিয়ে এখনো পড়ে আছো তুমি? তোমার কাজের চাপ কমানোর জন্যই আমি অ্যাসিস্টেন্ট এর ব্যবস্থা করেছি। প্রথম দুই দিন সেই সব কাজ করেছে। তাই ক কাজ বোঝানোর, কিংবা মাথায় হাত দেওয়ার কোন দরকার নেই। তবু তুমি ওকে কাজ করতে না দিয়ে নিজে সব কাজ করছ? কেন শ্রুতি। আমি তো তোমাকে কিছু বলি নি ওই দিন সম্পর্কে, কত বার বুঝিয়েছি যে ওই দিন কিছুই হয় নি। তাও তুমি ওই একটা রাত কে এতো সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছ?
–আমি ওসব ভুলে গিয়েছি স্যার।
–তাহলে শাড়ি পরার এই নতুন ধরণ কেন শ্রুতি? কেন তোমার হাতে রোজ দাগ পাওয়া যায়? কেন আমাকে রোজ তোমার হাত চেক করতে হয় যে তুমি আবার নিজের কোন ক্ষতি করেছ কি না? কেন আমি প্রতি দিন নতুন ক্ষতে মলম লাগিয়ে দিই? ওই রাত টা কে কেন ভুলতে পারছ না?
.
শ্রুতি এবার সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ল। সবার সামনে শক্ত থাকলেও জাহিনের সামনে থাকতে পারছে না। হয়তো এই মানুষটাকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে দেখে তাই। তাই নিজেই জাহিনের বুকে ঢলে পড়ে বলল,
–কারণ ওই দিন ও আমাকে এখানে ছুয়েছিল। ওই ওই বাজে ছোঁয়া আমার কাছে সহ্য হয় না। আমি পারি না ভুলতে, ওই ঠোঁটের ছোঁয়াটা…
.
আর কিছু বলার আগেই জাহিন ওর মুখে হাত দিয়ে থামাল। শ্রুতি এতক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে বলায় ওর কথা কোনটাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু জাহিন ঠিকই বুঝে নেয় সব। ও বুঝতে পারে, শ্রুতি যেই কথাগুলো বলছে, সেগুলো বলতে গিয়েও প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। শ্রুতি মনের দিক দিয়ে শক্ত হলেও এমন পরিস্থিতিতে প্রথমবার পড়েছিল। তার উপর যেই কথাগুলো শুনেছিল, সেই সময় নিজেকে অসহায় মনে করা, কোন কাজ করার ক্ষমতা তার মধ্যে সেই পরিস্থিতিতে অবশিষ্ট না থাকা, এসব ঘটনা আরও বাজে ভাবে প্রভাব ফেলে শ্রুতির মস্তিষ্কে। কিন্তু এবার জাহিন শ্রুতিকে সেই অনুভূতি ভোলাতে যে কাজ করে বসল, সেটা শ্রুতি ভাবতেও পারে নি।
.
শ্রুতির কান্না থেমে গেল মুহূর্তেই। হঠাৎ তার চেহারায় অবাক হওয়ার ছাপ পড়ল প্রচণ্ড ভাবে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে জাহিন এমন কিছু করবে। সত্যিই কি জাহিন কিছু করেছিল কিছু সময় আগে। না কি ওর ভুল? নাহ, সে ভুল কিছু দেখে নি। জাহিন সত্যিই ওর কাঁধে আঁচল ছেড়ে দেওয়া আঁচল সম্পূর্ণ উঠিয়ে হাতেই ওই জায়গায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিল গভীর ভাবে। শ্রুতির মাথা থেকে সেই রাতের সম্পূর্ণ ঘটনা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। সে আগে অবাক হবে, না কি আগে জাহিন কে প্রশ্ন করবে সেটাই বুঝে পাচ্ছিল না। তারপর জাইন শ্রুতিকে আবার আগের মতো জড়িয়ে ধরে ওকে আশ্বাস দিয়ে বলে উঠল,
–আর ওই রাতের কথা ভাববে না। একদম মাথা থেকে বের করে দাও সব চিন্তা। মনে রাখবে সবসময় আমি আছি তোমার সাথে। আই উইল প্রটেক্ট ইউ অলওয়েজ।
শ্রুতির ভালো লাগতে শুরু করল। একটা সমত তো ও নিজেও এই লোক টা কেই ভালবাসত। নিজেকে খুব সুরক্ষিত মনে হচ্ছিল এভাবে। কিন্তু হঠাৎ বুবুর কথা মাথায় আসতেই সে চটজলদি উঠে যেতে লাগল। কিন্তু জাহিন ওকে আবার সেই একইভাবে চেপে ধরে রইল। কিছুক্ষণ অভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর শ্রুতিকে বলল,
–ওসব নিয়ে আর ভেব না, কাজে মন দেও। কিন্তু নিজের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করবে না একদম।
শ্রুতি কোন কথা না বলে মাথা উপর নিচ নাড়ল কয়েকবার।
.
জাহিন আবার বলল,
–তোমার উপর আমার একদম বিশ্বাস নেই। তাই আজ সারাদিন তুমি আমার কেবিনে বসেই সব কাজ করবে। আর এর অন্যথা যেন না হয়। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
.
তারপর মনে মনে বলল,
”নাহলে আবার ওই আদিয়াতের মাথায় হাত চলে যাবে তোমার। কে জানে বেশিন থাকলে মাথার পরপর মুখেও হাত দেওয়া শুরু করে ফেলবে। তোমার উপর এক দম ই বিশ্বাস নেই আপাতত আমার। আমার সাথে তো পারো শুধু ঝগড়া করতে। হুহ…”
কিন্তু আবার মুখেই বলে উঠল,
–আর আমার কফি নিজে বানিয়ে এনে আমার হাতেই নিজেয় দিবে। আজ তোমাকে এখানে রাখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিব যে তুমি ওই নতুন কেবিনে কাজ করবে না কি আমার কেবিনেই, সো বি কেয়ারফুল। আর চাইলে কফি নিজেই টেস্ট করতে পার, আমি মাইন্ড করব না।
.
এতক্ষণ শ্রুতি জাহিনে বুকের সাথে লেগেই দাঁড়িয়েছিল আর জাহিনের সব কথা শুনছিল। কিন্তু শেষ কথা শুনে তখন সেখান থেকে সরে দাঁড়াল, ওর কান লাল হতে শুরু হয়েছে। জাহিনের নজর এড়ালো না সেই দৃশ্য। শ্রুতি বলে উঠল,
–আমি যাই কাজ আছে পড়ে অনেক। আদিকে সব বোঝাতে হবে।
বলেই এক দৌড় দিল শ্রুতি। জাহিন এতক্ষণ শ্রুতির লাল কান দেখে মুচকি হাস্লেও শেষে আদিয়াতের নাম শুনে সেই পরিমাণে রেগে গেল। বিশেষ করে আদিয়াতের নাম যখন শ্রুতি ছোট করে ”আদি” বলে ডাকল, তখন তার মনে হল শ্রুতি টেনে টেনে এক বালতি ভালোবাসা যোগ করে আদিয়াতের নাম বলছিল। তখনই মাথা এলো রোহিতের নাম। সোজা গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল আর টেবিল থেকে ফোন নিয়ে রোহিতকে কল করল।
.
.
জাহিনের বলতে দেরি, কিন্তু রোহিত মুহূর্তেই এসে হাজির। যে কেউ বলবে যে সে দরজার বাইরেই বোধ হয় দাঁড়িয়ে ছিল। যে জাহিন কল করল আর একবার রিং হতেই রোহিতের পা জাহিনের কেবিনে পড়ল। সাধারণত জাহিন কোন কাজ ছাড়া রোহিতকে কল করে না। কিংবা একবার রিং হওয়ার পর ২য় রিং বাজার অপেক্ষা করে না। তার আগেই কেটে দেয়। রোহিত ও কলের এই ১ম আর ২য় রিং হওয়ার পার্থক্য ভালোই বুঝত। কিন্তু সে কি জানত যে তাকে বকে খেতে হবে এবার।
.
রোহিত ঢুকতেই জাহিন ওকে বকা দেওয়া শুরু করল। কেন সে আদিয়াতকে কাজে রেখেছে? কেন কোন মেয়েকে রাখল না শ্রুতির অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে এই সব। আর রোহিত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল যে এর পর থেকে কাউকে নিয়েগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ভুল আর সে করবে না। বিশেষ করে দরকার পড়লে আরও অপশন রাখবে প্রশ্নে আর সব জাহিনের কাছ থেকেই জেনে নিবে। তবে রোহিত এখনো ভেবে চলেছে যে সে আজ কার মুখ দেখে সকালে ঘুম থেকে উঠেছে? মানে, সকালে উঠে প্রথমে কার মুখ দেখেছে? মনে পড়তেই নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারল। সে তো নিজের মুখই দেখেছিল। বেডের সামনে আয়না হওয়ায় তার চেহারাই আগে দেখতে হয়। সে আরও একটা প্রতিজ্ঞা করল যে বাড়ি গিয়ে আজই বেডের সামনে থেকে আয়না সরাতে হবে। সরিয়ে পাশের দেওয়ালে লাগাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল সে যদি ঘুম থেকে উঠে এবার সামনে না তাকিয়ে পাশে তাকায়?
.
জাহিন রোহিতকে নিজের মাথায় হাত দিয়ে মারতে দেখে দেখে উঠল জোরে,
–কোথায় হারিয়ে গেলে আবার।
–না, স্যার। আপনি কন্টিনিউ করেন।
চলবে।
#অন্তরালে_তোমার_বসবাস
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-১৩
বারে বসে জাহিন ড্রিংক করছে। আজ তার খুব করে এই কাজ টা ই করতে ইচ্ছা করছে। খুব করে। সে বেশ কয়েক দিন ধরে শ্রুতির সাথে আদিয়াত কে দেখছে। কিন্তু সেটা সহ্য করতে পারছে না। মনের মধ্যে এই অনুভূতি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে নিজের অনুভূতির উপর তার বেশ সন্দেহ হয়। সে কি সত্যিই ভালোবেসে ফেলল শ্রুতিকে? কিন্তু এটা সম্ভব নয়। সে শ্রাবণীকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, সে শ্রাবণীকেই ভালোবাসে। জোর গলায় বলে উঠল সে। ওর আওয়াজ শুনে সবাই ওর দিকে তাকাল। বারে যে ডিজে গান বাজছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। জাহিন বলতে থাকল,
–আমি শ্রাবণীকেই ভালো বাসি। অনেক ভালোবাসি। কিন্তু শ্রাবণী আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। খুব নিষ্ঠুর তুমি শ্রাবণী। দেখ, শ্রুতি কত ভালো, তুমি আসার আগে থেকেই আমার সাথে আছে। আমার কত খেয়াল রাখে। কিন্তু ও তো শুধু আমার অ্যাসিস্টেন্ট। ও তো আজও আমাকে ছাড়ে নি। তাহলে তুমি তো আমাকে ভালবাসতে। কেন আমাকে ছেড়ে গেলে শ্রাবণী? আমিও তো তোমাকেই ভালবাসতাম। আচ্ছা শ্রাবণী বলতে পারবে আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে? তোমার কথা আমার কেন মনে পড়ছে না। আমি কেন শ্রুতির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। কেন ওর সাথে অন্যকে দেখে আমার রাগ লাগছে? এমন কি নিজের ভাই এর সাথে কথা বলাও আমি দেখতে পারি না কেন? হোয়াই?
প্রথম ৩ লাইন জোরে বলায় সবাই ওর দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু আবার নিজের মতো আনন্দ করতে শুরু করে, এদিকে জাহিন বিড়বিড় করে বাকি কথাগুলো বলে। শেষের দিকে ”হোয়াই” কথাটা হালকা জোরে বললেও এবার আর তেমন শুনতে পায় নি। সে গ্লাস ছেড়ে সামনে থাকা ওয়েটার এর কাছ থেকে বোতল টা কিছুটা ছিনিয়ে নিয়ে নেয়। একসাথে ৫ টা । অন্য টেবিলের জন্যই নিয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু অন্য কাস্টমারের এমন ব্যবহার দেখে রেগে গেলেও কিছু বলতে পারল না। কারণ ইনি হলেন মিস্টার জাহিন রেজওয়ান। একে রাগ দেখানো মানে হল সেই রাতের মধ্যেই গুম হয়ে যাওয়া। তাই কিছু বলল না সে। তবে জাহিন এখানে আসা অনেকদিন আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই এতদিন পর আবার জাহিনকে দেখে বেশ অবাক হল ওয়েটার।
.
ততক্ষনে জাহিন এক বোতল শেষ ও করে ফেলেছে। আর শেষ হতেও সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলল। এটা পুরনো একটা কাজ ওর। আগে যখন এখানে ড্রিংক করতে আসতো তখন রোজ এই কাজ করত। কিছু পুরনো কাস্টমার কাঁচ এভাবে জোরে ভাঙার শব্দ শুনে বুঝতে পারল কে এই কাজ করেছে। মূলত জাহিন এর চেহারা না দেখলেও এই কাজ দিয়ে ওরা চিনত। যারা নতুন তারা আবার জাহিনের দিকে তাকাল। তবে অন্ধকার হওয়ায় ভালো করে জাহিনের চেহারা দেখতে পারে নি। এতে করে জাহিনকে পাগলের উপাধি দিয়েই আবার কেউ নাচে তো কেউ মদ্যপানে মত্ত হয়ে গেল। আসলে কেউ ঠিক ভাবে জানেই না যে এখানে জাহিন রেজওয়ান উপস্থিত আছেন। তাই এত শান্ত হয়ে আছে। নাহলে মেয়েরা লাইন লাগিয়ে দিত। সবাই জানে যে জাহিন বিবাহিত কিন্তু তাই বলে ক্রাশ খাওয়াই যায়। কয়েকজন তো এই প্রার্থনাও করত যেন জাহিন আর শ্রুতি বিয়ে ভেঙে যায় আর ওর সাথে কোন মিরাক্কেল এর মাধ্যমে জাহিনের মিল হয়ে যায়। খুন বেশি ফ্যান হওয়ায় এই হাল সম্পর্কে বেশ অবগত জাহিন। বাইরের দুনিয়ায় জাহিনের আসল চেহারা সম্পর্কে জানলেও নিজের দেশে কোন দিন সে সেই রুপে আসে নি জাহিন। হুম, জনসম্মুখে আসে নি, তবে গোপনে যে আসে না টা নয়। কিছুদিন আগেই তো শ্রুতির সাথে যে বাজে ব্যবহার করেছিল তাকেই দেখালো সেই রুপ। হ্যাঁ, কাজটা গোপনেই হয়েছে। তবে লোকটাকে আর ওই ওয়াশরুমের বাইরে দেখা যায় নি। মিঃ রায় ও খুব বাজে ভাবে শেষ করেছিল লোকটাকে। অপমানিত হয়েছিল অনেক লোকটা। বেশ কিছুদিন মিডিয়ায় অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এই খবর। তবে সে সম্পর্কে শ্রুতি আজও অবগত নয়। এর মূল কারণ ও জাহিন, সেই সবাই কে মানা করেছে এ সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে। আর সাওবাই যাই করিক না কেন, জাহিনের রাগ কে প্রচুর ভয় পায়।
.
জাহিন আবার আরেকটা বোতল ভাঙতে গিয়েও ভাঙল না। কারণ তার খেয়াল হল বোতল টা শেষ হয় নি। অনেক খানি বাকি। তাই আবার সেটা শেষ করার কাজে লেগে পড়ল ঠিকই। কিন্তু তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল পুরনো কিছু স্মৃতি। শ্রুতির সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিকের সব স্মৃতি। যেন তার চোখের সামনেই সব ভাসছে। হাত বারালেই ছুঁতে পারবে সেই ঘটনা গুলো কে।
.
.
.
শ্রুতির সাথে জাহিনের দেখায় কোন জাঁকজমক পরিবেশ ছিল না। আর না ওদের মধ্যে তেমন কিছু হয়েছিল। প্রথম দিন শ্রুতি ইন্টারভিউ এর জন্য এসেছিল। জাহিন সেদিন শ্রুতি সহ বাকিদের ইন্টারভিউ নিয়েছিল। অন্যান্য দেড় তুলনায় শ্রুতির অবস্থা বেশ ভালো ছিল। ওর আত্মবিশ্বাস আর কাজ ওকে চাকরি পাইয়ে দেয়। তাছাড়া কিছু কিছু জায়গায় ওর বুদ্ধিমত্তা দেখে জাহিন শ্রুতিকেই ওর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নির্বাচন করে ফেলে। শ্রুতির পরিবারের অবস্থা অতোও খারাপ না যে শ্রুতিকে চাকরি করা লাগত। কিন্তু নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ কারা তার স্বপ্ন। তাই রেজওয়ান ইন্ডাস্ট্রি তে আসা তার। পরের দিন থেকে যথারীতি কাজে চলে আসে। বেশ কয়েক মাস ধরে কাজ করার পর জাহিনের প্রতিটা বিষয় ওর মুখস্ত হয়ে যায়। জাহিনের সব কাজ শ্রুতিই করত। নিজে থেকেই। তবে জাহিন এতে দ্বিমত করে নি কখনো। আবার উৎসাহ ও দেয় নি। সকালে জাহিন কে ঘুম থেকে তোলা, ওকে খাইয়ে সময়ের মধ্যে রেডি হতে বাধ্য করা সবই শ্রুতি করত। এতে জাহিন রাগ দেখালেও লাভ টা ওরই হত। জাহিন কাজের প্রতি বেশ সিরিয়াস থাকলেও সকালে ঘুম থেকে ওঠা কিংবা নিজের খেয়াল রাখার ক্ষেত্রে একদমই নজর দিত না। কাজ করতে করতে দুনিয়ার খবর ভুলে যেত যেন। শ্রুতির ব্যাপারটাও কিছুটা এরকম ছিল। তাই শ্রুতির কাজে বেশ খুশি ছিল জাহিন।
.
জাহিনের বাড়ি প্রথম গিয়েছিল শ্রুতি ফাইল দিতেই। জাহিন প্রতি বারের মতো ওই দিনও সকাল সকাল ঘুমে মগ্ন ছিল। কিন্তু ফাইলে সাইন করা দরকার ছিল। আর না হলে ক্ষতি হত কোম্পানির। তাই শ্রুতি বাধ্য হয়ে রোহিতকে বলে। আর প্রথমেই রোহিত সাফ সাফ মানা করে দেয়।
–মিস শ্রুতি, আমাদের স্যার সকালের এই ঘুম কে এই ফাইলের থেকেও বেশি পছন্দ করেন। তাই আপনি উনাকে দিয়ে সাইন করাতে পারবেন না। আর স্যার প্রচণ্ড বকবেন। তাই আপনি স্যার এর বাসায় যাওয়ার কথা ভুলেই যান।
তবু শ্রুতি মানার পাত্রী নয়। সে জাহিনের ঠিকানা অফিসের ফাইল থেকে নিয়ে নেয়। রোহিত এই কাজ টা করতে পারতো, যদি মানুষটা জাহিন না হত তাহলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত এটা জাহিন। একবার এই চেষ্টা করেছিল রোহিত। আর সেটাই প্রথম আর শেষ চেষ্টা ছিল তার। আর সকালে বিশেষ করে ঘুমের মধ্যে জাহিনকে জ্বালায় নি। সেদিন জাহিন ওকে ১ ঘণ্টা ধরে কথা শুনেছিল। অবশ্য সেদিনও রোহিতের কাজের জন্য তাকে অগনিত বার ইডিয়ট বলেছিল।
.
শ্রুতি জাহিনে বাড়ি গিয়ে জাহিন কে ডাকার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন সারা পায় নি। কয়েকবার হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে শ্রুতিকে। প্রথমে অন্যদের পাঠাতে চেয়েছিল জাহিনকে ডাকতে কিন্তু সব সারভেন্ট মানা করে দেয়। তাই শ্রুতি বাধ্য হয়েই নিজেই জাহিনের রুমে ঢুকে। কিন্তু জাহিন ঘুমাচ্ছিল তখন। এক বালতি পানি জাহিনের উপর ঢেলে দেওয়ার ইচ্ছে করলেও সেটাকে দমিয়ে রাখে নিজের মধ্যে। তারপর জাহিনের কানের কাছে যায়। আর সাবধানে বলতে থাকে,
–স্যার, আমাদের ক্লায়েন্ট মিঃ স্টিভ এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে।
বলেই সেখান থেকে দূরে সরে যায়। আর জাহিন হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে। স্রুই এই কয় দিনে বেশ বুঝতে পেরেছিল যে জাহিন নিজের খেয়াল না রাখুক, কিন্তু কাজের প্রতি সে বেশ সচেতন। তার ফলাফল সামনেই। শ্রুতি হালকা চিৎকার করে নিজের ডান হাত মুঠ করে উপরে তুলে হাক্লা লাফিয়ে বলে উঠে,
–মিশন সাকসেসফুল। ইয়েয়ে…
জাহিন রাগী দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকায়। যার অর্থ সে প্রশ্ন করছে যে , ”কোথায় মিঃ স্টিভ?”
.
শ্রুতি এক শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠে,
–আসে নি, কিন্তু আপনি ফাইল চেক করে সাইন না করলে আজকের মধ্যেই এসে যাবে।
কাজের কথা শুনে জাহিন শান্ত হয়ে যায়। আর শ্রুতিকে শান্ত ভাবে বলে ফাইল দিতে , ও চেক করে দিবে। জাহিনের এমন হঠাৎ পরিবর্তনে শ্রুতি অবাক হয়েই জাহিনের হাতে ফাইল দিয়ে দিল।
.
শ্রুতি এবার এসে জাহিনকে জাগিয়েই কাজের কথা বলেছিল। যার কারণে জাহিনের মুড সাথে সাথে বদলে যায়। অন্যদিকে সেদিন রোহিত ভয়ে আর কাজের কথা বলতেই পারে নি। তাই তাকে বকা শুনতে হয়েছিল। হাহ।
.
.
এর পরের বারও কিছুটা এমন কারণেই জাহিনের বাড়ি আবার যেতে হয়েছিল শ্রুতিকে। সেদিন মিটিং সকালে ছিল আর জাহিন ঘুমিয়ে ছিল। তাই শ্রুতি ওর রুমে গিয়ে কোন কথা না বলে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। এসি বন্ধ করে দেয়। ফ্যান বন্ধ করে দেয়। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই জাহিন চোখ কুঁচকে ফেলে। আর তার রুমে হঠাৎ সাইবেরিয়ার ঠাণ্ডা পরিবেশ থেকে মরুভুমির উষ্ণ পরিবেশের আভাস পাওয়ায় এক লাফে উঠে পড়ে। ঘম হালকা নিয়ন্ত্রণে আসতেই সে দেখতে পারে যে শ্রুতি ওকে স্যার স্যার বলে ডেকেই চলেছে। শ্রুতিকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে, কিন্তু শ্রুতি তার আগেই কাজের কথা বলে জাহিন কে থামিয়ে দেয়। এতে করে জাহিন বাধ্য ছেলের মত ফ্রেশ হতে চলে যায়।
.
.
শ্রুতি আশেপাশে তাকিয়ে দেখল রুমটা খুব অগোছালো। তাই সে সেসব ঠিক করে ফেলল। ঘরের বাইরেও এর থেকে ভালো অবস্থা ছিল না। জাহিনের বড় ডুপ্লেক্স বাড়িতে জাহিন একাই থাকত। তাও এতো অগোছালো বারও দেখে তার সহ্য হচ্ছিল না। তাই নিজেই সব ঠিক করতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখে যে জাহিন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। একদম পরিপাটি ভাবেই। তবে ঘড়ি পরা বাকি ছিল। সেটাই ঠিক করছিল সে। শ্রুতি জাহিন কে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর পরে জাহিনের পিছু পিছু অফিসে চলে যায়। এরপর থেকে শ্রুতি অফিসের পাশাপাশি জাহিনের ঘরও সামলাত। ওর চিন্তা এই যে জাহিন কে যদি রোজ ঠিক সময় ডেকে তোলার অভ্যাস করিয়ে দিতে পারে তাহলে পরে আর কোন সমস্যা হবে না। জাহিন একা একাই উঠতে পারবে। তাই রোজ সে জাহিন কে সকালে ঘুম থেকে উঠাতো আর সকালে খাইয়ে দাইয়েই তারপর অফিসে নিজে যেত। মাঝে মধ্যে জাহিন বকতে গেলে উল্টা নিজে বকেই জাহিন কে চুপ করিয়ে দিত। এতে করেই এক সময় জাহিনের সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস হয়ে যায়। তবে সে সেটা কখনো প্রকাশ করে নি। শ্রুতি নিজেই রোজ জাহিন কে জাগাত। নিজের প্ল্যানিং এ কেন সফল হচ্ছে না এতদিন ধরে জাহিন কে জাগানোর পরও, সেই কথা একসময় ভুলে যায় শ্রুতি। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এটা না করলে সকালে কি একটা কাজ বাকি বাকি লাগে তার কাছে। তাই সে রোজ জাহিনকে জাগায়। ঘরের বাকি সব স্টাফ দেরও ও নিজেই বলে দিত কি করে ঘর সাজিয়ে রাখবে, কখন কি করতে হবে সব। যেন জাহিন এর পর কি করতে চলেছে সে সম্পর্কে শ্রুতি বেশ ভালো ভাবেই জানত। কিন্তু জানতে পারে নি শুধু শ্রাবণীর বিষয় টা।
চলবে।