অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-১৬
সাদিয়া_সৃষ্টি
মাঝরাতে কানে গানের আওয়াজ ভেসে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় শ্রুতির। এক অদ্ভুত সুর। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় নিজেকে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। খুব করে তাকে টানছে গান টা। ভালোই লাগছে শুনতে। খারাপ না। কে গান গাইছে সেই চিন্তা কিছু ক্ষণের জন্য তার মাথায় ই আসে নি। কিন্তু যখন মনে হল তখন নিজেই ধীরে ধীরে শব্দ না করে উঠে বারান্দার দিকে আ বাড়াল। অন্ধকারে যদিও ভয় করছিল।রাত বিরাতে কে গান গায়? এই সময় যেই চিন্তা প্রথমে মাথায় আসে সেটা হল – ভুত। তবু এই মাথায় আসার পরও যে শ্রুতি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে নি তার জন্য তাকে পুরষ্কার দেওয়া উচিত। এর কারণ অবশ্য বেশি কিছু নয়। তার ঘুম ভাঙে এক গানের আওয়াজে। তারপর এক নজর জাহিনের বিছানার দিকে তাকাতেই দেখে সেটা ফাঁকা। ঘরে আলো না জ্বললেও চাঁদের ওই হালকা আলোতে বোঝা যাচ্ছে যে সেখানে কেউ নেই। তাই অনিয়ন্ত্রিত চিৎকারের হাত থেকে সেই যাত্রায় বাড়ির মানুষদের কান বেঁচে যায়। শ্রুতির খুব ইচ্ছা ছিল জাহিনের মুখ চাঁদের আলোতে দেখার। এই ইচ্ছাও তার অনেক আগের। তবে ভুলে গিয়েছিল সময়ের ব্যবধানে। সূর্যের আলো যখন জাহিনের মুখে পড়ত তখন ক্রাশ খাওয়ার মত কাজ করত সে। তাও এক বার নয়, বারবার। সূর্যের আলো বিভিন্ন সময় একেক রঙের আলো হিসে জাহিনের মুখের উপর পড়লে তখন অনেক টা আলাদা অনুভূতি কাজ করত শ্রুতি। এক অজানা অনুভূতি যা শান্ত থাকতে দিত তাকে। তাই বাঁচতে জাহিনের পিছন পিছন ছাতা নিয়ে ঘুরেও বেড়িয়েছে। কাজের জন্য সারা দিন থাকলেও রাতে জাহিনের সাথে থাকা হয় নি তার, কাজ করা হয় নি তেমন। তাই চাঁদের আলোয় জাহিনকে কেমন লাগে সেটা দেখার ইচ্ছা ছিল শ্রুতি। বিছানায় জাহিনকে না পেয়ে নিজের মনকে শান্ত করে প্রথমে। শ্রুতি যতক্ষণ জাহিনের বিছানার দিকে মুখ ঘরাচ্ছিল ততক্ষণ মুখ থেকে চিৎকার বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর হালকা করেও বসেছিল তবে সেটা সে নিজে ছাড়া আর কেউ শুনতে পারে নি। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যেতেই দেখে আরেক দৃশ্য। জাহিন একেবারে মেঝেতে বসে আছে। পাশে চেয়ারে গিটার রাখা। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে এতক্ষণ গানটা জাহিন ই গায়ছিল। কোন ভুত না। তবে চাঁদের আলোয় জাহিনকে সত্যিই অপূর্ব লাগছিল। শ্রুতির কাছে কেন যেন জাহিনকে দেখতে চাঁদের থেকে বেশি ভালো লাগছিল। নিজের মনে হাজার কথার জাল বুনে চলেছিল শ্রুতি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুতে ছিল জাহিনের প্রশংসা , কিছুতে ছিল জাহিনের সাথে চাঁদের তুলনা, তো কিছুতে ছিল নিজের পূর্ব অনুভূতির জাগরন। যাকে নিজেই মাটি চাপা দিয়েছিল বেশ সময় আগে। কারণ এই অনুভূতি তার জন্য নয়। এই অনুভূতি অন্য কারো। এতে তার অধিকার নেই। কিন্তু আজ সেই অনুভূতি আবার অনুভব করতে ইচ্ছা করেছে তার। সত্যিই কি খুব ক্ষতি হত এই অনুভূতি একান্ত তার সম্পদ হলে? এই চিন্তার অন্ত নেই।
.
তবে গানের কথা ভাবতে ভাবতে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
.
–আপনি এতো সুন্দর গাইতে পারেন স্যার, আগে তো কখনো শোনান নি।
.
শ্রুতির আনমনে বলা কথায় জাহিনের ধ্যান ভেঙে যায়। সে এতক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক ভাবে। চাঁদের সাথে কারো তুলনা করার প্রচেষ্টায় ছিল। কিন্তু যার তুলনা করছিল তার আওয়াজ পেয়েই চমকে পিছনে ফেরে সে। ঘুমন্ত চেহারায় চাঁদের হালকা আলো পড়ে আরও মোহ ময় করে তোলে পরিবেশ। কিন্তু জাহিনের সেই অনুভূতির চেয়ে অবাক হওয়ার পরিমাণ বেশি। সেটাই আপাতত বেশি প্রকাশ পাচ্ছে তার চেহারায়। শ্রুতির ততক্ষনে খেয়াল হল যে সে কি বলে তাই সেটাকে এড়িয়ে যেতেই বলে উঠল,
.
–আসলে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আর গানের আওয়াজ এলো কানে। তাই উঠে পড়লাম। আপনি তো ভালোই গান গাইতে পারেন।
.
–তাই না কি?
.
মজার চলে বলে উঠল জাহিন। শ্রুতি জাহিনকে এই প্রথম এমন আচরণ করতে দেখল। একদম দুলাভাই শালিকা পারফেক্ট জুটি। আচ্ছা মজা না করি। প্রথম বার না রেগে, না সিরিইয়াস হয়ে, না বকে কথা বলল জাহিন শ্রুতির সাথে। হাসির চলে বলা কথাটা একেবারে বুকে বাম পাশে আঘাত করলেও প্রকাশ করাটা ঠিক হবে না। তাই এর উত্তরে চুপ করেই থাকল। তবে কিছুক্ষণের এই নিস্তব্ধতা ভেঙে জাহিন নিজেই বলতে শুরু করল,
.
–যাও ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। সকালে আবার গ্রামের জন্য বের হতে হবে। এখন রেস্ট না নিলে পরে খারাপ লাগবে যেতে।
.
–অবশ্য এবার আপনার কোন কথা শুনবেন না নানু, তাই আপনি মানা করার আসা ছেড়ে দেন। আর আমার জার্নি করার অভিজ্ঞতা আছে অনেক। আমার কিছু হয় না। আপনার কত মিটিং ফাইল আমাকে দৌড় ঝাপ করে আনিয়েছেন বাসায় , ভুলে গিয়েছেন না কি?
.
–আম্র সন্দেহ আছে তোমার উপর। কারণ তুমি মিটিং এর ফাইল আনো ঠিকই। কিন্তু তারপর আর তোমার দেখা পাওয়া যায় না। পরে খুঁজে দেখলে দেখি যে সোফায় আরামে শুয়ে ঘুমাচ্ছ।
.
–ওটা তো একবার … ক্লান্ত হয়ে…
.
–হয়েছে আর বলতে হবে না। ক্লান্ত প্রতিবার হও, আর প্রতিবার ঘুমিয়ে পড় তুমি। তা ম্যাডামের কি ঘুম আসছে না? এখনো জেগে আছেন?
.
শ্রুতি ইচ্ছা করল আরও কিছু সময় কাটাতে। কিছু না হোক, বন্ধু হিসেবে কিছু সময় তো গল্প করাই যায়। যদিও ওর চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। তবু বলল,
.
–না, আসলে ঘুম ভেঙে গেল তো। তাই আর কি…
.
–এখানে বসে পড়।
.
জাহিন নিজের পাশে থাকা চেয়ারটা দেখিয়ে বলল। যদিও সে নিজে মেঝেতে বসে আছে, তবু শ্রুতিকে নিচে বসতে বলল না। শ্রুতির ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। তবে শ্রুতি নিজে জাহিনের পাশে গিয়ে বসল। জাহিন প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শ্রুতি বিলম্ব না করে উত্তর দিল ,
.
–আপনি নিচে বসেছেন, আমি উপরে কি করে বসি? তাছাড়া আমার কিছু হবে না এখানে বসলে।
.
জাহিনকে আশ্বস্ত করতেই জাহিন আর না করতে পারল না। কিছুটা সময় গল্প করল ওরা। এই ক্তহা বলার সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। তবে তার কারণ ও শ্রুতি নিজেই। জাহিনের কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। জাহিন সেখানে না থেকে শ্রুতিকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়াল তারপর নিজেও ঘুমাতে গেল। নিজের বিছানায় গিয়ে যেই না চোখ বন্ধ করেছে ততক্ষনে শ্রুতির গোঙানির আওয়াজ শুনে নিজের বিছানা থেকে উঠে শ্রুতির বিছানায় গিয়ে অকে বুকে জড়িয়ে নিল। আর এই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল যে মেয়েটা আজও বুঝল না প্রতি রাতে কি হয়?
.
.
.
কেয়া আজ এসেছিল হাসিমুখে ঠিকই। কিন্তু যেতে হয়েছে তাকে ভাঙ্গা মন নিয়ে। অফিসে এসে শ্রুতিকে খুজছিল সে। যদিও জানত যে আজ শ্রুতিকে পাওয়া যাবে না। তবু এসেছিল। কারণ একটাই ক্রাশ কে দেখা। তার সাথে কথা বলা। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে যে এমন কিছু জানবে, বুঝতে পারে নি সে। আজ তারা কথা বলছিল। মাঝে হঠাৎ দাওয়াত দেওয়ার কথা উঠে।
.
–সো আপনি কি আমাকে দাওয়াত দিবেন বলছেন?
.
–হুম সমস্যা নেই। যদি যেতে চান তাহলে আমার আগে থেকে জেনে রাখতে হবে। আপনিই তো প্রথমে বলেছিলেন।
.
–আগে থেকে জেনে কি করবেন? হঠাৎ করে গিয়ে চমকে দিয়ে আসব।
.
–আসলে আমার ওয়াইফকে বলে রাখা ভালো। ও সবসময় আমার ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে তো। তাই আর কি…
.
–আ…আপনার ওয়াইফ?
.
–হুম।
.
–আ…আচ্ছা, আমি তাহলে পরে একদিন জানিয়ে দে…দেব।
.
বলেই সেখান থেকে চলে গেল। আর কিছু শুনতে চায় না সে। প্রথমবার কারো উপর কিছুটা সিরিয়াস ভাবেই ক্রাশ খেয়েছিল সে। হিরো দের ছাড়া বাস্তব জীবনে। কে জানত সে আরেক বাচ্চার বাবা হবে?
.
.
.
শ্রুতিদের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। এর মূল কারণ জ্যাম। ফেরি ঘাটে জ্যামে পড়া এক বিশাল ব্যাপার। যে পড়ে, সেই বুঝে যে ফেরিঘাটের জ্যাম কেমন জ্যাম। এতো মানুষকে টানা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ও আটকে রাখতে সক্ষন। জাহিন দের নিজস্ব গাড়ি থাকলে নদী তো আর গাড়ি দিয়ে পার হওয়া যাবে না। সেখান থেকে পার হয়ে জলযান লাগবে। আর তার জন্যই এতো দেরি হয়ে যায়। এই জ্যামের মধ্যে হাজারো কাহিনী ঘটে। যখন সেগুলো প্রকাশ পায়, মানুষ তখন হয় লজ্জার শিকার হয়, ময়ত ফেমাস হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া এমন এক জিনিস।
.
রাতে নিজেক বিছানায় এলিয়ে দেয় সবাই। সবাই জাহিনের দাদু ভাই এর বাড়িতেই এসেছে। কাব্য ও অন্যদের মত ঘুমাতে যায়। তবে নিজের রমে এসে শুতে না শুতেই ফোনে কারো কল আসে। আর ফোনের স্ক্রিনে তার নাম দেখে কাব্যর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু কানে নিতেই তার মুখে চিন্তারা ভর করে।
চলবে।