অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-১৭ ও ১৮

0
1625

অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-১৭ ও ১৮
সাদিয়া_সৃষ্টি

রাতে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দেয় সবাই। সবাই জাহিনের দাদু ভাই এর বাড়িতেই এসেছে। কাব্য ও অন্যদের মত ঘুমাতে যায়। তবে নিজের রমে এসে শুতে না শুতেই ফোনে কারো কল আসে। আর ফোনের স্ক্রিনে তার নাম দেখে কাব্যর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু কানে নিতেই তার মুখে চিন্তারা ভর করে।
.
কলটা কেয়ার ছিল। হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে কেয়ার নাম দেখে অবাক হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এর থেকে বেশি খুশি হয়েছিল। অভিমানে পাহাড় জমেছিল তার মনে। কেয়ার কাছে তার কোন গুরুতে নেই এমন কথা মাথায় আসতেই রাগ নামক অনুভূতির উদয় হয়। তাই এই কয়দিন ইজ থেকেই কেয়ার সাথে কোন কথা বলে নি। দেখাও করে নি। সামনে কোনোভাবে কেয়া চলে আসলেও পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছে। তবে রোজ মনে করেছে তার কথা। কিন্তু কেয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা ও করে নি। কেন করবে চেষ্টা? যদি অপর ব্যক্তির কাছে নিজের কোন মূল্যই না থাকে। তবে হঠাৎ কেন কল করল সেটা জানতে আর বিলম্ব না করে ফোনটা রিসিভ করে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে ২ পক্ষই। কারো মুখে কোন কথা নেই। কিন্তু হঠাৎ ফোনের ওপারের ব্যক্তির ফুঁপিয়ে কান্না করার আওয়াজ পায় কাব্য। বিচলিত হয়ে ওঠে। অস্থির হয়ে প্রশ্নের ঝুড়ি মেলে ধরে ফোনে।
.
–কেয়া কি হয়েছে? কাদছ কেন? কেউ কিছু বলেছে? বল আমাকে। আমি সব ঠিক করে দিব। প্লিজ চুপ করে থেক না। আমাকে বল কি হয়েছে। আর ইউ আপসেট এনিহাউ? বল আমাকে কান্না কর না প্লিজ। ওয়েট, তুমি কিছু বলবে না তো? আমি আসছি।
.
বলেই কল কেটে দিল কাব্য। গ্রামে রাত ৮-৯ টা মানে গভীর রাত। কিন্তু তখন সময়টা ৯.৩০ টা। সেই রাতে সবাই কোন আড্ডা না দিয়েই আগে আগে শুয়ে পড়েছিল ক্লান্ত হওয়ায়। কাব্য নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দ্রুত পদে এগিয়ে চলে যায় জাহিনের এক চাচাতো ভসি এর রুমে। দরজায় আওয়াজ করতেই সে খুলে দেয়। কাব্য তার কাছ থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকায় যাবে বলে। সে জিজ্ঞেস করলে বলে
.
–একটু জরুরি কাজ আছে, কাল সকালের মধ্যেই ফিরে আসবে।
.
বলেই আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ে কাব্য। ভালোবাসা গুলো কি এমনই হয়? বিশেষ করে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা গুলো। কাউকে কখনো না বললেও বোঝা যায় হয়তো। কেউ বুঝতে পারে। আর কেউ নিজে থেকেই এড়িয়ে যায়। তবু সেই মানুষের চিন্তা হয়। একটু চোখের পানি দেখলেও বিচলিত হয়ে পড়ে তার জন্য। তার জন্য সব সুখ এনে হাজির করতে ইচ্ছা হয়। তার হাসির জন্য সব করতে পারে আবার কান্না দেখলে অস্থির হয়ে ওঠে। অনেকে গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারে অপর ব্যক্তি কেমন অনুভব করছে। চাইলেও লুকানো যায় না তার থেকে। লুকানোর চেষ্টা গুলো অনেক সময় বিফলে যায়। কারণ অন্তরালে তো শেষমেশ তারই বসবাস। তার সম্পর্কে ভালো বুঝবে না তো কার সম্পর্কে বুঝবে?
.
কেয়া রোহিত এর কাছ থেকে অমন উত্তর পাওয়ার পর অবাক হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বেশি কষ্ট পায় নি। এর তুলনা সে কাব্যর সাথে করেছে। রোহিতের থেকে ওর ওয়াইফের কথা শোনার পর নিজের মাথা থেকে রোহিতের কথা ঝেড়ে ফেলে দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় তার কষ্ট। একজনের অনুপস্থিতি তাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে। নিজের ক্রাশ সম্পর্কিত অনুভূতিকে সে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিল সে যে অন্য অনুভূতির দিকে খেয়াল ছিল না। দিন শেষে কাব্যর সাথে করা ঝগড়া গুলো মনে পড়লেও সে আনদেখা করে গিয়েছে নিজ থেকেই। মনে মনে এটাই ভেবেছে- ”তার কথা আমি ভাবতে চাই না। ইরিটেটিং।” আজ এই ইরিটেটিং অনুভূতি না পেয়েই তার কাছে কিছু একটা অসম্পূর্ণ লাগছে। সে বুঝতে পারে, সে কাব্যকেই মিস করছে। খুব করে মিস করছে। কিন্তু তার কি করা উচিত, বুঝতে পারছিল না। গলায় কথা আটকে আসছিল। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল তার। সে বেশ বুঝতে পারছে যে নিজের অজান্তেই সে কাব্যর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এই কয়দিনের অবহেলা তাকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। সে পর্যন্ত আটকে না রাখতে পেরে কল করেই বসে কাব্যকে। শুধু ওই পাশের ব্যক্তির আওয়াজ একবার শোনার জন্য। নিজের কান্নাকেও আটকে রেখেছিল। কিন্তু তার চিন্তা ভুল করে কাব্য চুপ করে ছিল। কোন কথা বলে নি। তাই সে আর নিজের কান্নাকে থামাতে পারে না। তবে কাব্যর বলা শেষ কথা শুনে তার কান্না আপনাআপনি থেমে যায়। মাথায় বার বার ঘুরতে থাকে – ”আমি আসছি” কেয়া জানে যে এটা সম্ভব নয়। কারণ জাহিন পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামে গিয়েছে। এখন বললেই কাব্য আর আসতে পারবে না। তার আবার কাঁদতে মন চাইছে। কিন্তু চোখ থেকে পানি পড়ছে না। কাব্যর বলা কথাটা বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে। হয়তো কাব্য সত্যিই আসবে।
.
কেয়ার বাড়ি শ্রুতির বাড়ি থেকে দূরে ছিল না। তাই কাব্যর চিনতে অসুবিধা হয় নি। সেও আগেও এই বাড়িতে এসেছে। তবে একবার। রাতের ঘণ্টা খানিকের রাস্তা পেরিয়ে মাঝরাতেই সে কেয়াদের বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ির নিচে এসে বাইক থামিয়ে কেয়াকে ফোন দেয়। কেয়া ও সাথে সাথেই কল রিসিভ করে। কারণ সে নিজেও এই কলের অপেক্ষায় ছিল। কল ধরে কেয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই কাব্য তাকে থামিয়ে বলে,
.
–নিচে চলে আসো।
.
কেয়া কিছুক্ষণের জন্য তব্দা খেয়ে যায়। কাব্য কি পাগল হয়ে গিয়েছে না কি তার শোনাতে কোন ভুল হয়েছে। তবে সে দেরি না করে গায়ে ওড়না জড়িয়ে ঘর থেকে বারান্দায় চলে আসে। নিচে কেউ বসে আছে বাইকে। মাথায় হেলমেট। দেখতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে কেয়ার। দেরি না করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লিফটে করে নিচে নেমে আসে। কাব্য কেয়াকে দেখে নিজের হেলমেট খুলে ফেলে। নিচে রাস্তায় থাকা লাইতের আলোতে ভালোভাবেই দুজন দুজনকে দেখতে পারছে। কেয়া কিছুক্ষণের জন্য থেমে দাঁড়িয়ে থেকে আবার কাব্যর দিকে এগিয়ে যায়। কাব্যর কাছে এসে দাঁড়িয়ে আচমকাই ওকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। কাব্য এতে বড়সড় এক শক খায়। তবে নিজেকে সামলে নেয়। কেয়া আনমনে বলে ওঠে,
.
–আই ওয়াজ মিসিং ইউ, অনেক মিস করছিলাম আপনাকে। আপনি কেন এতদিন আমাকে ইগনোর করেছেন? আমাকে রেখে চলে গিয়েছিলেন?
.
–কারণ তুমিই আমাকে যেতে বলতে বারবার কেয়া।
.
–আমি বললেই চলে যেতে হবে? থাকা যায় না?
.
–সত্যিই কি তুমি চাও আমি থাকি?
.
–হুম নাহলে মাই ঝগড়া করব কার সাথে?
.
কাব্য কিছু বলল না। লাইতের আলোতে আবার কেয়াকে দেখতে থাকল। মুখে লেগে থাকা পানি শুকিয়ে এসেছে তখন। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ কান্না করেছে সে। নিজের দুই হাত দিয়ে পরম যত্নে কেয়ার মুখ মুছে দিল সে। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে কাব্য নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠল,
.
–যাও ব্যাগে নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আসো। আমরা এখনই গ্রামের উদ্দেশ্যে যাবো।
.
কেয়ার মুচকি হাসি উপহার দিয়ে মাথা উপর নীচ নাড়িয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাগ নিয়ে হাজির হল। কাব্যর বাইকে উঠতেই কাব্য বাইক স্টার্ট দিল। কেয়া বাড়িতে নিজের রুমের দরজার উপর একটা কাগজ লাগিয়ে রেখে এসেছে যাতে লেখা,
.
”আব্বু আম্মু আমি শ্রুতি আপুকে খুব মিস করছিলাম। তাই আপুকে বললাম, আপু আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি একেবারে জিজুর গ্রামে গিয়ে তোমাদের কল করব। রাগ করো না। ”
.
কাব্য কেয়ার সাথে কথা বলা শুরু করল বাইক চালাতে চালাতেই।
.
–তো আপনার রোহিতের কি হল ম্যাডাম?
.
–আপনি আবার আমাকে ওসব জিজ্ঞেস করছেন? আপনি আমাকে কেন বলেন নি আগে?
.
–আমি তো বলতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু ‘রোহিত ইজ ম্যা…’ শুনতে না শুনতেই আপনি চলে গিয়েছিলেন।
.
এবার উত্তরে কেয়া আর কিছু বলল না। শুধু কাব্যর পিঠে একবার বাড়ি মেরে আবার ওকে শক্ত করে ২ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসল। কাব্য নানা কথা বলতে থাকল রাস্তায় যাতে কেয়া ঘুমিয়ে না পড়ে। এমনিই ওরা বাইকে। ঘুমের ঘোরে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
.
.
ওরা সকালের মধ্যেই পৌঁছে যায়। কেয়া একা একাই চলে আসে ভেতরে আর কাব্য ওর পিছন পিছন। সবাই ওদের একসাথে দেখে অবাক হয়। জাহিন প্রশ্ন করে,
.
–কেয়া তুমি এখানে?
.
কেয়া কিছু বলবে তার আগেই কাব্য বলে,
.
–রাতে ও ফোন করে কান্না করল যে শ্রুতি আপুর কাছে যাবে তাই নিয়ে আসলাম।
.
সবাই মিটমিটিয়ে হাসতে থাকল।
.
সকালে সবাই বাড়ির সবার সাথে আড্ডা দিয়ে বিকালে ঠিক করল গ্রামের আশেপাশে ঘুরে দেখবে। সেই অনুযায়ী জাহিনের কাজিনরা সবাই আর শ্রুতি কেয়া মিলে গ্রামের আশেপাশে ঘোরার জন্য বের হল। পাশের জঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও শ্রুতিকে যেতে দিতে রাজি হল না জাহিন।অর এক কথা,
.
–যেখানে ঘোরার ঘুরুক, জঙ্গলে যাওয়া যাবে না।
.
জাহিন যেহেতু এখানে বয়সে সবার থেকে বড় তাই ওর কথা মানতে সকলেই বাধ্য। কেউ না বলতে পারল না। শ্রুতি বলতে যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু জাহিনের চোখে আগুনের ফোয়ারা দেখে পেটের কথা গলায় চেপে ধরল। আর বের হতে দিল না।
.
.
শুভ অন্যদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের নদীর কাছে পৌঁছে গেল। সবাই নানা কথা বলছে তবে সেদিকে খেয়াল নেই তার। সবচেয়ে বেশি অবাক হল সে নদীর পাড়ে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস মজুমদারের দিকে। নিজেকে আবার নানা পোশাকে একেবারে আবৃত করে রেখেছেন প্রতিবারের মত। তবে তার দৃষ্টি দুরের দৃশ্যে আটকে আছে। হয়তো কিছু ভাবছেন। ভাবতে ভাবতেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আর ডেকে উঠল,
.
–মিসেস মজুমদার, আপনি কি সত্যিই এখানে।
.
আওয়াজ পেয়ে মিসেস মজুমদার ঘুরে তাকান। শুভ কে দেখেই চিনতে পারে সে।
.
–ওহ মিঃ শুভ আপনি!
.
–আমাকে মনে রেখেছেন এখনো?
.
–হুম। কয়েকদিন আগেই তো দেখা হল।
.
–আপনাকে দেখলেই একটা কথা বেশ ভাবায় আমাকে।
.
–কি? আমার গেট আপ? এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন করবেন না।
.
শুভ মুচকি হাসি উপহার দিয়েই বলল,
.
–ঠিক আছে। তবে আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি প্রতি মুহূর্তে কিছু একটা লুকান।
.
–কারণ সেটা কাউকে বলতে পারব না।
.
–আমাকে বলে দেখতেই পারেন আমি অতটাও অনির্ভর যোগ্য না।
.
–নাহ থাক, যেটা লুকাতে চাইছি সেটা বলে দিলে লুকানো হবে কি করে?
.
–আচ্ছা, আর জোর করছি না। তবে কোন দিন চাইলে বলতে পারেন , আমি শুনতে রাজি আছি।
.
–ঠিক আছে। ভেবে দেখব। আপনি এখানে কেন?
.
–আমার কাজিনের গ্রামের বাড়ি এখানে তাই ঘুরতে এসেছি জাস্ট। আর আপনি?
.
–আমিও এমনিই ঘুরতে এসেছি। ভাবলাম এই দেশে যখন আসলাম তখন একটু ঘোরাঘুরি করেই যাই।
.
–ভালোই তো তাহলে আমাদের সাথে ঘুরুন।
.
–নাহ থাক। আমি ঠিক আছি। এমনিতেও আমার এখন যেতে হবে। কাল ফ্লাইট আছে।
.
–তাহলে আপনার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই?
.
–সিওর। চলুন।
.
–থ্যাঙ্কস, আমাকে অনুমতি দেওয়ার জন্য। আই হোপ ইন্ডিয়ায় আবার দেখা হবে আমাদের।
.
–ওকে। আমি যাই এখন।
.
–বাই।
.
বলে শুভ গাড়ির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণ যে ভালো লাগার এক অনুভূতি কাজ করছিল টা নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। সে আবার জাহিনদের সাথে ঘোরা শুরু করল।
.
.
.
জাহিন শ্রুতির সাথে আগে আগেই হাঁটছিল। হঠাৎ জাহিন থেমে যায়। শ্রুতি জাহিনের থামার কারণ বুঝতে পারে না। জাহিনের কাঁধে হালকা ধাক্কা দিতেই জাহিন একবার পাশে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। কিন্তু ততক্ষনে সে চলে গিয়েছিল। শ্রুতি জিজ্ঞেস করল,
.
–কি হল? আপনি থেমে গেলেন কেন?
.
–শ্রুতি শ্রুতি আমি শ্রাবণীকে দেখেছি। হ্যাঁ হ্যাঁ আম…আমি শ্রাবণীকে দে…দেখেছি। ও এখানেই ছি…ছিল কি…কিছুক্ষন আগে। ওকে আমি দেখেছি। ও চলে গেল। কোথায় গেল? কেন গেল?
.
শ্রুতি ততক্ষনে বুঝতে পারল যে আসলে কি হয়েছে। কিন্তু শ্রুতি সেখানে দাঁড়িয়ে এই কথা গুলো শুনতে পারল না। ও কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে গেল দৌড়ে। কেয়া , রাদিয়া, ইউসরা, লামিয়া আর বাকি মেয়ে কাজিনরা ওর পিছনে চলে গেল। বাকিরা জাহিনকে ঘিরে ধরল।
.
–ভাই, কি বলছিস তুই? শ্রাবণী কে? আর তাকে দেখে তুই এমন ই বা করছিস কেন?
.
–শ্রাবণী আমার ফার্স্ট ওয়াইফ।
.
এটা শুনতেই সবাই অবাক হয়ে গেল। শুভ জিজ্ঞেস করল,
.
–আর ইউ কিডিং ভাই? এটা মজা করার সময় নয়।
.
–আমি সত্যি বলছি, শ্রাবণীর সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল, ও শ্রুতির বড় বোন।
.
–তুমি প্লিজ আমাদের খুলে বল সব।
.
জাহিন সব বলা শুরু করল।
_______________________________________
শ্রাবণীর সাথে জাহিনের দেখা হয়েছিল শ্রুতির মাধ্যমেই। শ্রুতি একদিন নিজের সাথে নিজের বড় বোনকে অফিসে আনে। শ্রাবণী শ্রুতির পাশেই ছিল। জাহিন শ্রাবণীকে দেখে চমকে যায়। হঠাৎ থেমে গিয়ে তার হার্ট বিট আবার জোরে চলা শুরু করে। এই কথাটা সঠিক যে শ্রাবণী শ্রুতির থেকে দেখতে বেশি সুন্দর ছিল। আর জাহিন প্রথম দেখায় শ্রাবণীকে অনেক পছন্দ করে ফেলে। যাকে জাহিন ভেবেছিল লাভ এট ফার্স্ট সাইট। শ্রুতি জাহিনের সাথে শ্রাবণীর পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর শ্রাবণীকে নিয়ে নিজের কেবিনে চলে যায়। জাহিনের পাশের কেবিন টা শ্রুতির হওয়ায় আর কেবিন দুটি কাঁচের দেওয়াল দ্বারা পৃথক থাকায় জাহিন শ্রাবণীকে ভালোভাবেই দেখতে পারছিল। সারাদিন জাহিন কোন না কোন ভাবে শ্রাবণীকে দেখেছে, সেটা কাঁচের দেওয়ালের এপিঠ থেকে ওপিঠ হোক কিংবা আড়চোখে। কারণ দেওয়ালের ওপিঠ থেকে শ্রাবণী দেখতে না পারলেও জাহিনের মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরা খেয়ে গেল। তবুও অনেক সাহস সঞ্চয় করে শ্রাবণীর সাথে আরও কথা বলেছিল সেদিন।
.
এর পরের দেখাটা হয়েছিল শ্রুতির বাড়িতে। শ্রুতি সে সময় অসুস্থ ছিল বলে বাড়িতেই ছিল। অফিসে যায় নি কয়েকদিন। বৃষ্টির মৌসুম। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে জ্বর বেড়ে গিয়েছিল শ্রুতির। তবু শ্রুতি কথা শোনার মেয়ে না। প্রথমে কয়েকদিনের কি কি কাজ আছে সেগুলো একবার চেক করে নিল কারণ আগের দিন আবহাওয়ার খবরে বলেছে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হবে এলাকায়। তারপর যখন দেখল যে এর পরের কয়েকদিন ও অফিসে না আসলেও কিছু হবে না। তখন খুশি মনে সবাইকে সব কাজ বলে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল। জাহিনের বাড়ির কাজগুলো বারিএ সারভেন্ট দের বুঝিয়ে দিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরে আসে। তারপর শুরু হয় তার বৃষ্টিতে ভেজার মিশ্ন। এটাকে একটা মিশন ই বলা চলে। কারণ বৃষ্টিতে বেশি ভিজলে তার ঠাণ্ডা লেগে যায়, জ্বর আসে। তারপর আম্মুর কড়া কথা আর বকা শুনতে হয় । তবু শ্রুতি বৃষ্টিতে ভিজবেই। আর এবার তো টানা কয়েক দিন আম্মুর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভিজতে হবে। তাই এটা কোন মিশনের থেকে কম না। আর যেই ভাবনা সেই কাজ। একবার জ্বর হয়ে হালকা কমলে শ্রুতি আবার পরের দিন বৃষ্টিতে ভিজেছে। যার দরুন তাকে ডাক্তারের ওষুধের উপর থাকতে হয়েছে। জাহিন অন্যদিকে বেশ কয়েকদিন ধরে খেয়াল করেছে শ্রুতির অনুপস্থিতি। কোন সারভেন্ট কে জিজ্ঞেস করলেই বলে শ্রুতি ম্যাম এই কাজ করতে বলেছে। অফিসে বলে যে শ্রুতি আগেই জানিয়ে দিয়েছে সে আসতে পারবে না। তাই জাহিন কয়েকদিন কিছুই বলে নি। কিন্তু পরে একদিন না পেরে ফোন করেই বসে আর ফোনটা শ্রুতির মা ধরে। তিনি জানান শ্রুতির অসুস্থতার কারণ। জাহিন সেদিনই শ্রুতির বাসায় যায় শ্রুতিকে দেখতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঝটকা খায়। ”কাদারানি” । হ্যাঁ যে কাদারানিকে দেখে সেখানে। সেই একই পোশাক। সেই পোশাকই। জাহিন ভেবে বসে যে এটাই তার কাদারানী, শ্রাবণী ই তার কাদা রানী যাকে প্রথম দেখায় মন দিয়ে বসেছিল। সেই একই পোশাকের পাশাপাশি একই কানের দুল, হাতের চুরি আর সাথে খোলা চুল। সব মিলে যায়। তবু এক জায়গায় একটু খটকা লাগে। কিন্তু কাদারানী কে খুঁজে পাওয়ার খুশিতে সেসব চিন্তারা বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি জাহিনের মনে। সে শ্রাবণীর সাথে কথা বলতে থাকে। শ্রুতির কথা মাথা থেকে বের হয়ে যায় এমন নয়, শ্রুতির বিষয়ে কথা দিয়ে শ্রাবণীর সাথে কথা বলা শুরু করে, তারপর অন্য কথা বলতে থাকে। শ্রুতি যেই না জানতে পেরেছে যে জাহিন ওদের বাড়িতে এসেছে শ্রুতিকে দেখতে সেই শ্রুতি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দেয়। জাহিনের প্রতি শ্রুতি অনুভূতি গুলো তখন ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছিল। সে নিজের অনুভুতিগুলকে বুঝতে শিখেছিল। আর সেই অনুভূতি জাহিন কে কয়েকদিন না দেখার ফলে আরও গাড়ো হয়েছিল। কিন্তু বলা হয় নি। কিন্তু পরক্ষনে মনে পড়ে যে সে ওড়না ভুলে চলে এসেছে। আবার কয়েক বড় ধাপ ফেলে রুমে ঢুকে ওড়না নিয়ে দৌড় দেয় শ্রুতি। কিন্তু থমকে যায় জাহিন আর শ্রাবণীকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে। অনেকক্ষণ কথা বলার পর জাহিনের নজর যায় শ্রাবণীর থিক পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রুতির দিকে। শ্রুতির অসুস্থতা তার শরীরে বেশ ভালোভাবে দাগ ফেলেছে। চোখ মুখের অবস্থা দেখেই জাহিনের হাসি থেমে যায়। সে শ্রাবণীকে বাই বলে শ্রুতির কাছে যায়। প্রথমেই কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে যে কি হয়েছিল। কেন সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। নানা প্রশ্ন। কিন্তু শ্রুতি কোন উত্তর না দিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদিকে জাহিনের কথা শুনে রান্নাঘরে থাকা শ্রুতির না মিসেস রাহমান বকা শুরু করে দিয়েছেন। জাহিন কে বলছেন যাতে শ্রুতিকে বোঝায় এই বৃষ্টিতে না ভিজতে। কিন্তু শ্রুতি ততক্ষনে নিজের শরীরের সঞ্চিত শক্তি ব্যয় করে ফেলেছিল। তাই পড়ে যায় মাটিতে। জাহিন ওকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অনেকক্ষণ ওর সাথে থেকে ওকে অনেক বুঝিয়ে চলে যায় আর বলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন অফিসে না আসে। এবার যেই না জাহিন চলে যেতে নিবে তখন ওর হাত ধরে থামায় শ্রুতি। এবার ও কথা বলা শুরু করে। এই কয়দিন বাড়িতে সারভেন্টরা ঠিকমতো কাজ করেছে কিনা, অফিস এ সব ঠিক আছে কিনা, ওর আবার যাওয়া লাগবে কি না। এই অসুস্থতায় নিজের অবস্থার কথা বাদ দিয়ে কাজের কথা শুনে জাহিন শ্রুতিকে বকা দিয়ে চলে যায়। এটা দেখে শ্রুতির মা চোখের ইশারায় বলেন ”ঠিক হয়েছে” আর শ্রুতি ভেংচি কাটে।
.
শ্রাবণীর সাথে জাহিনের মেলামেশা বাড়তে থাকে। জাহিনের সাথে কথা বলা, বেড়াতে যাওয়া কিংবা একসাথে সময় কাটানো। এক্ষেত্রে শ্রুতির কোন জ্ঞান ছিল না। শ্রুতির অগোচরেই সব হয়। তাই দিন এর পর দিন জাহিনের প্রতি শ্রুতির অনভুতি বাড়তে থাকে যেমন। তেমন জাহিন তার কাদারানিকে সময় দেয় অনেক। কিন্তু জাহিনের একটা পদক্ষেপ সবাইকে চমকে দেয়।
.
জাহিন সেদিন হঠাৎ করে শ্রুতির বাড়িতে আসে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে। আর শ্রুতির বাবা মিঃ রাহমান রাজি হয়ে যান। প্রপোজাল টা ছিল জাহিন আর শ্রাবণীর বিয়ে নিয়ে। এটা শোনার পর অনেক কষ্টে নিজেকে থামিয়ে রেখেছিল শ্রুতি। জাহিনের চলে যাওয়ার পর শ্রুতি নিজের ঘরে দরজা আটকে দেয় আর কাঁদতে থাকে। সেদিন শ্রুতির কান্না বাঁধ মানতে চায় নি। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। শ্রুতির মা কে সব কথাই বলত তাই মিসেস রাহমান বুঝতে পারেন শ্রুতি অবস্থা। তবে শ্রুতি ই তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলেছে। যার জন্য তিনি চুপ করে ছিলেন। তারপর কিছু কাজের জন্য মিঃ রাহমান আর শ্রাবণী বাড়ির বাইরে ছিল। অনেকক্ষণ পরও শ্রুতি যখন বের হল না তখন তিনি ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখে শ্রুতি অজ্ঞান। তাই তার জ্ঞান ফেরানর ব্যবস্থা করতে থাকেন। শ্রুতির জ্ঞান ফিরতেই সে বিচলিত হয়ে মিসেস রাহমানকে প্রশ্ন করে যে কাউকে এই সম্পর্কে জানিয়েছেন কি না। তারপর সবার কাছ থেকে এই বিষয়টা গোপন রাখতে বলে সে। ওয়াদা করার কারণে মিসেস রাহমান আর কিছি বলতে পারেন নি কাউকে।
.
শ্রাবণীর সাথে শ্রুতির বিয়েটা হয়ে যায়। শ্রুতি নিজ হাতেই সব ব্যবস্থা করেছিল। সেদিন মিঃ রাহমানের খুশি দেখে সবাই সব মেনে নেয়। ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে হয় যেখান সবাই ছিল না। আর শ্রাবণীর কথা অনুসারে সবার থেকে গোপন রাখা হয়। শ্রুতি জাহিনের সাথে কথা বলা, দেখা করা বন্ধ করে দেয় আর অন্য অফিসে চাকরি নেয়। এরপর ৫ মাস কেটে যাওয়ার পর শ্রাবণীর জাহিনকে দিভস লেটার সাইন করে পাঠায় আর শ্রাবণী জাহিনকে ছেড়ে চলে যায়। এই ৫ মাসে যে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল তেমন না। শ্রাবণী যাওয়ার আগে শ্রুতিকে দিয়ে ওয়াদা করিয়ে নেয় যেন সে জাহিনের খেয়াল রাখে।
_______________________________________
ওয়াদার কথা মনে পড়তেই শ্রুতি মেঝে থেকে উঠে পড়ে। সে তার বুবুকে কথা দিয়েছিল যে সে জাহিনের খেয়াল রাখবে। কিন্তু আজ জাহিনের এমন পরিস্থিতিতে সে জাহিন কে একা রেখে চলে এসেছে।কি করে পারল সে এটা করতে? তাই এতক্ষণ যে দরজা সব বোনেরা মিলে নক করে করে খুলতে পারে নি, সেই দরজা শ্রুতি খুলে দেয় আর সবাইকে দেখায় যে সে স্বাভাবিক আছে। তার কিছুই হয় নি। সে জাহিনের কাছে যায়। এতক্ষণ দুজনেই অতীত মনে করছিল । জাহিন ভাইদের বলছিল আর শ্রুতি নিজেই মনে করছিল। জাহিন অস্থির হয়ে যায় আবার। কিন্তু শ্রুতি তাকে সামলে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসে আর ওকে কথা দেয় যে পরের দিন ওরা শ্রাবণীকে খুঁজতে বের হবে। এটা শুনে জাহিন শান্ত হয়।
.
.
.
পরেরদিন যথারীতি জাহিন আর শ্রুতি শ্রাবণীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। সাথে কেয়াকেও নেয় আর কাব্যও আসে। যেহেতু শ্রুতিকে কেউ চিনত না তাই কেয়াই খোঁজাতে সাহায্য করতে পারতো। আর কেয়া গ্রাম চিনে না বলে কাব্য ওর সাথে যায়। শ্রুতি আর জাহিন আলাদা ভাবে খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে শুভ ঢাকায় গিয়েছিল কাজে। এটা একান্তই ওর ব্যক্তিগত কাজ বলা চলে। হঠাৎ ফোনে কল আসে একটা নাম্বার থেকে। ওপাশ থেকে কোন মহিলাকে মারার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। খেয়াল করতেই বিঝতে পারল সে যে এটা মিসেস মজুমদার এর আওয়াজ। সে আর দেরি না করে লোকেশন ট্রেস করে সেখানে চলে যায়।
.
জাহিন খুঁজতে খুঁজতে একসময় শ্রাবণীর দেখা পায় আর ওকে আটকায়। শ্রাবণী জাহিনকে দেখে চমকে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এক দিন তো দেখা হতই তাই নিজেকে শান্ত করল । ফোনে কারো অনুমতি নিয়ে জাহিনের সাথে একটা হোটেলে গিয়ে বসল সে।
.
–তুমি এতদিন কথা ছিলে শ্রাবণী আর না বলেই চলে গেলে কেন?
.
–আমি জানি তোমার অনেক প্রশ্ন আছে। তার উত্তর আমিই দিচ্ছি আজ। তখন দেই নি কারণ তখন আমি সিউর ছিলাম না। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত। আমি সাদিককে ভালোবাসি। প্রথম থেকেই। তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগ থেকেই। তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া কথা বলা আর সব কিছু আমি বন্ধু ভেবেই করেছি। কিন্তু এটা তুমি আমার সাথে শেয়ার না করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও যেটায় বাবা হ্যাঁ বলে দেয়। আমিও তখন কিছু বলতে পারি নি কারণ বাবা তখন অসুস্থ ছিল। তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুযোগ পাই নি। তোমরা এতো জলদি বিয়ে করলে যে আমি আর চান্স পেলাম না। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আমি আলাদা থাকি তাই। এক রুমে থাকি নি কারণ আমি তো তোমাকে বন্ধুর নজরে দেখতাম। সেটা সম্ভব ছিল না। সাদিক সেই সময় ও আমার পাশে ছিল। তাই ৫ মাস পর আমি তোমাকে ছেড়ে চলে আসি।
.
–কিন্তু আমার ভালোবাসা?
.
–সেটা তোমার ভুল ধারণা জাহিন। তুমি আমাকে না, শ্রুতিকে ভালোবাসো। প্রথম থেকেই শ্রুতির প্রতি তোমার অনুভূতি ছিল, সেটা আমি দেখেছি। শ্রুতির সাথে তোমার ব্যবহার, তার প্রতি কেয়ার সব কিছুতেই শ্রুতির প্রতি তোমার ভালোবাসা প্রকাশ পায়। কিন্তু তুমি সেটাকে ভুল ভাবো। তুমি আমাকে দেখে হয়তো ক্ষণিকের ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল তোমার। কিন্তু সেটাকে তুমি ভালোবাসা বলে ভুল কর। তুমি আমাকে সবসময় বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে, কি পরবো কিভাবে সাজবে, তাই না? কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখেছ, সেগুলো তুমি শ্রুতিকে ভেবেই বলতে, আমাকে শ্রুতির মত সাজতে বলতে, কারণ তুমি আমার মধ্যে শ্রুতিকে দেখতে চাইতে। শ্রুতির অফিস ছেড়ে দেওয়ার পর তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছ, কিন্তু শ্রুতি করে নি বলে তোমার খারাপ লাগা , শ্রুতির প্রতি অভিমান ছিল। বন্ধু হিসেবে সবই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু সিউর হচ্ছিলাম না। একটা কথা থেকে আমি বুঝতে পারি সব। মাঝেমাঝেই তুমি বলতে আমাকে ”কাদারানী” আর এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে আমাকে প্রথম কাদায় মাখামাখি অবস্থায় দেখেছিলে। কিন্তু আমি কাদা থেকে সব সময় দূরে থাকি। সেদিন তুমি নিজ থেকেই বললে, ওই সালোয়ার কামিজ পরে আমাকে কাদা নিয়ে খেলতে দেখেছিলে। আমি সেদিন সিওর হয়ে গেলাম। কারণ আমি প্রম সেই কামিজ পরেছিলাম সেদিন যেদিন শ্রুতির জ্বর ছিল টানা কয়েকদিন আর তুমি ওকে দেখতে এসেছিলে। তার আগে একদিন শ্রুতি আমার কাছ থেকে ওই ড্রেস ধার নিয়েছিল আর সেদিন ও সে বৃষ্টিতে ভিজেছিল তোমার বলা কাদা মাখিয়ে। যেদিন তোমাকে ছেড়ে চলে আসলাম, সেদিন এসব বুঝতে পারি নি। তবে তোমাকে ধোঁকা দিতে চাইছিলাম না। তাই লুকিয়েই চলে এসেছিলাম। কিন্তু এই কয়েক মাসে আমি সব উত্তর পেয়েছি। তবে তোমাকে বলব কি করে বুঝতে পারি নি। সাহস করে উঠি নি। তাই শুধু ডিভোর্স পেপার এ সাইন করতে বলেছিলাম চিরকুটে। আর বলা হয় নি কথা।
.
–আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি। (শ্রাবণীর টেবিলে রাখা হাতের উপর হাত রেখে) ধন্যবাদ, আমাকে বোঝানোর জন্য।
.
.
শ্রুতি এই সময় সেই হোটেলে ঢুকেছিল। তারপর এই দৃশ্য দেখে আর সেখানে থাকতে পারল না। এবার সত্যিই আর সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। জাহিনকে শ্রাবণীর হাত ধরে থাকতে দেখে ওর মনে হল ওদের মধ্যে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই সে সেখান থেকে চলে যায় বাড়িতে। দাদুভাই, নানু সবাইকে লুকিয়ে ঘরে চলে যায়। একটা কাগজে কিছু লিখে ব্যাগ নিয়ে চলে যায় সবার থেকে লুকিয়ে।
.
.
একটি ছেলে এসে শ্রাবণীর কাঁধে হাত রেখে বলে ,
.
–ওই কি জাহিন?
.
শ্রাবণী মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে।সাদিক হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করতে। জাহিন ও হাত মিলায়। কিছুক্ষণ একে অপরের সাথে কথা বলে চলে যায় যে যার মত। জাহিন এই কোথাও দেয় যে সে শ্রাবণীর কথাগুলো সবাইকে বোঝাবে। আর এও ঠিক করে যে আজ শ্রুতিকে মনের কথা বলে দিবে। এতদিন যে দোমনা ভাব ছিল সেটা পরিষ্কার তার কাছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে একটা চিরকুট আবার তার জীবন বদলে দেয়।
.
.
জাহিন স্যার,
আমি জানি আপনি বুবুকে অনেক ভালোবাসেন। তার প্রমাণ ও আমি পেয়েছি। আপনার বুবুর জন্য কষ্ট পেয়ে ড্রিংক করা থেকে শুরু করে সব। আর আজ আপনি বুবুকে পেয়ে গেলেন। আমি চলে যাচ্ছি। আপনাদের মাঝে আর আসবো না। বুবুর সাথে ভালো থাকবেন। আমি আর বেশি কিছু বললাম না। আমার খোঁজ করবেন না তবে। প্লিজ, আমাকে আর খুজবেন না। আমি কোথায় থাকব সে সম্পর্কে কারো কাছে জানতে চাইবেন না প্লিজ।
ইতি,
শ্রুতি ।
.
.
জাহিন সেই মুহূর্তে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে চিৎকার করে। সবাই কে জিজ্ঞেস করার পরও কেউ কিছু বলতে পারে না। তাই সে ঢাকায় চলে যায়। সোজা শ্রুতির বাসায়। মিঃ আর মিসেস রাহমান কে জিজ্ঞেস করে সে। কিন্তু তারা কিছু বলেন নি। জাহিন জানত শ্রুতি তার মা কে সব কথা বলে তাই মিসেস রাহমানকে যখন চেপে ধরে সে তখন তিনি বলেন, তিনি শ্রুতিকে কথা দিয়েছেন যে কাউকে ওর সম্পর্কে বলবেন না। এতে সবার চিন্তা কিছুটা হলেও কমে কিন্তু কষ্ট টা থেকেই যায়।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here