#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ১৩
লিখা- Sidratul Muntaz
রাইসা উদ্ভট শব্দে হাসতে লাগল। জিসান হতাশ কণ্ঠে বলল,” ইউ আর জাস্ট ইনসেন রাইসা। আমি তোমাকে চিনতে ভুল করেছি।”
জিসান ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিলে রাইসা হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,” কোথায় যাচ্ছো?”
জিসান ক্ষীপ্র ঝাঁকিতে হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল,” তোমাকে কৈফিয়ৎ দিবো না।”
রাইসা একেবারে দরজা দাঁড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল,” তাহলে আমিও তোমাকে যেতে দিবো না। আগে বলো, কোথায় যাচ্ছো তুমি? জয়ীর কাছে যাচ্ছো?”
” যদি আমি জয়ীর কাছে যাইও তাহলে তোমার প্রবলেম কি? তুমি আমাকে আটকাতে পারো না। জয়ীর সাথে তুমি যেটা করেছো সেটা অন্যায়। অন্তত এই অন্যায়ের খেসারত দেওয়ার জন্য হলেও ওকে আমার দেখতে যাওয়া উচিৎ। ”
” তুমি ওকে দেখতে যেতে পারবে না। আমি ম’রে গেলেও তোমাকে যেতে দিবো না।”
জিসান বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” তুমি বুঝতে পারছো না রাইসা। জয়ী মা’রা গেলে এখানে পুলিশ আসবে। তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”
রাইসা আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল,” জয়ী ম’রবে না। ও শুধু একটু ইনজ্যুরড হয়েছে। ম’রে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি।”
” তবুও আমার ওর কাছে যাওয়া উচিৎ। ”
রাইসাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে জিসান বেরিয়ে পড়ল। রাইসা পেছন থেকে গলা ফাটানো চিৎকার করেই যাচ্ছিল। জিসান শুনল না।
জয়ীকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে ওর বাড়ির লোকদেরও খবর দেওয়া হলো। হসপিটালের বিলও জিসান মিটিয়ে দিয়েছে। সে ঘণ্টাখানেক হসপিটালেই থাকল। জয়ীর অবস্থা যখন ভালোর দিকে আর ওর বাড়ির লোকেরাও চলে এসেছে তখন জিসান হসপিটাল থেকে বের হলো৷ এর মধ্যে রাইসা কম হলেও একশোটা মিসডকল দিয়েছে। ফোন সাইলেন্ট ছিল বলে জিসান টের পায়নি। এবার সে বাড়ির দিকে রওনা হলো। কিন্তু সেখানে আরও বড় দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। রাইসা আ/ত্ম/হ/ত্যা/র চেষ্টা করেছিল। হাতের শিরা কে’টে র/ক্তা/র/ক্তি অবস্থা। বাড়িতে শুধু রত্না ছিল। সেই মেয়ে র/ক্ত দেখে ভয়ে আর বিভ্রমে অস্থির। রাইসার ফোন থেকে এতোক্ষণ রত্নাই কল করছিল জিসানকে। রাইসার অবস্থা দেখে জিসান খুব ভড়কে গেল৷ রাইসাকে হসপিটালে নেওয়া হলো। কিছুসময় কাটল একদম এলোমেলো।
রাইসার জ্ঞান ফিরে আসার পর সবার আগে সে জিসানের নাম উচ্চারণ করে৷ তাই জিসানকে ভেতরে যেতে বলা হলো। জিসান রাইসার কাছে এসে দেখল রাইসা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে। এতোবড় একটা কান্ড ঘটানোর জন্য তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধ দেখা গেল না। জিসান জিজ্ঞেস করল,” তুমি এটা কেন করলে রাইসা?”
রাইসা কঠিন মুখে বলল,” তুমি আমার কথা না শুনে কেন চলে গিয়েছিলে? আর কখনও যদি এমন করো তাহলে আমি আবার সুইসাইড করবো। বুঝেছো?”
জিসান হাতের সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারল রাইসাকে। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না। সে রাইসাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। কিন্তু তার এইসব কর্মকান্ডের জন্য ধীরে ধীরে ভালোবাসাটা ফিকে হয়ে আসছে। এটা কি রাইসা বুঝতে পারছে না? চড় খেয়েও রাইসার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। চোখ-মুখ কঠিন করে চুপচাপ বসে রইল সে। কিছুদিন আগেও জিসান রাইসাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে যদি অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলে তাহলে রাইসা কি করবে? রাইসা জবাবে বলেছিল, সে জিসানকে খু’ন করবে। জিসান মজা ভেবে কথাটা আমলে নেয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রাইসা সত্যি বলেছিল। যে মেয়ে এতো ভয়ংকর কাজ করতে পারে সে সব করতে পারে। আজ সকালেও রাইসা বলছিল, পৃথিবীর যত বাদামী তিলওয়ালী মেয়ে আছে সবাইকে সে হ/ত্যা করবে। কারণ জিসানের বাদামী তিল পছন্দ! এতোটা সাংঘাতিক চিন্তা কেউ করতে পারে? আজকে জয়ীর সাথে রাইসার আচরণেই প্রমাণিত হয় রাইসার মতো মেয়ে সব করতে পারে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ নিকৃষ্ট কাজও এই মেয়ে পারবে৷
” আই হেইট ইউ রাইসা। আজকের পর থেকে তুমি আর কখনও আমাকে পাশে পাবে না৷ যেদিন তোমার এই পাগলামি স্বভাব ছাড়তে পারবে সেদিন এসো। এর আগে না। আমি ব্রেকাপ করছি।”
রাইসা হতভম্ব কণ্ঠে আওড়াল,” কি বললে? ব্রেকাপ!”
” হ্যাঁ ব্রেকাপ।”
রাইসা সাথে সাথে জিসানের হাত চেপে ধরে অনুরোধ করল,” তুমি এমন করো না জিসান। আমি ম’রে যাবো।”
” তুমি ম’রে যাও কি বেঁচে থাকো আই ডন্ট কেয়ার।”
জিসান এইটুকু বলে উঠে চলে যাচ্ছিল। রাইসাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা সে তখনও ভাবেনি। শুধু রাইসাকে একটু লাইনের আনার জন্য ভেবেছিল কিছুদিন আলাদা থাকবে। কিন্তু রাইসা ঠিক সেই মুহূর্তে এমন একটি কথা বলেছিল যে জিসানকে থামতেই হলো। রাইসা এক নিশ্বাসে বলল,” জিসান আমি কিন্তু প্রেগন্যান্ট।”
জিসান স্তব্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, রাইসা মিথ্যে বলছে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে শোনার পর আর অবিশ্বাস করে থাকা সম্ভব হলো না। আসাদ সাহেবের দেশে ফিরতে আরও দুইমাস বাকি। তার অনুপস্থিতিতেই জিসান রাইসাকে বিয়ে করল। কারণ রাইসা জেদ করছিল। আর জিসানও নিষেধ করার উপায় পেল না। বিয়ের পর রাইসার পাগলামি আরও বাড়তে লাগল। প্রত্যেকটি বিষয়ে জিসানকে সন্দেহ শুরু করল। শুধু মেয়েজনিত বিষয় না, জিসান অন্যকারো সাথে বেশিক্ষণ কথা বললেও রাইসার মাথায় র/ক্ত উঠে যেতো। একদিন এমন হলো যে রাইসার খুব পেটব্যথা হচ্ছিল। জিসান ফার্মেসীতে গেল ঔষধ আনতে। কিন্তু তখন মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত। সব ফার্মেসী বন্ধ। তাদের পাশের ফ্ল্যাটের একটা আপু ফার্মাসিস্ট। জিসান তার কাছে গেল। ওদের বাসায় সচরাচর ঔষধও থাকে। সেই আপুর নাম রিক্তা। মেয়েটি জিসানের সাথে এমন গল্প জুড়ে দিল যে জিসান উঠতেই পারছিল না। এদিকে জিসানের দেরি হচ্ছে বলে রাইসা রুম থেকে বের হলো। পাশের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে জিসানের জুতো দেখে সাথে সাথে কলিংবেল চাপল। রিক্তা দরজা খুলে হাসিমুখে বলল,” আরে রাইসা, কেমন আছো? তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। জিসানও এখানে আছে। এসো ভেতরে এসো।”
রাইসা রক্তশূন্য দৃষ্টিতে বলল,” জিসান কোথায়?”
রিক্তা রাইসাকে ভেতরে নিয়ে এলো। রাইসাকে দেখে জিসানের মুখ শুকিয়ে গেল। রাইসা নিশ্চয়ই এখন উল্টা-পাল্টা ভাববে। অথচ জিসানের কোনো দোষ নেই।
” রাইসা তুমি আবার কষ্ট করে উঠে এলে কেন?”
জিসান জিজ্ঞেস করল অপ্রতিভ স্বরে। রাইসা হাত ভাজ করে বলল,
” কি করবো? তুমি তো আসছিলে না। তাই আমাকেই উঠে আসতে হলো।”
জিসান হাসার চেষ্টা করল,” স্যরি। আপুর কাছে এসেছিলাম তোমার জন্য ঔষধ নিতে। এইযে দেখো ঔষধ।”
” ঔষধ নেওয়ার জন্য একসাথে বসে চা খেতে হয়? হেসে হেসে গল্প করতে হয়? জানতাম না তো!”
জিসান কি বলবে বুঝতে পারল না। একজন মানুষের বাড়িতে এলে তাকে বসতে বলা এবং চা-কফি অফার করা ভদ্রতা। জিসান চা খেতে চায়নি। কিন্তু রিক্তা খালি মুখে মেহমান যেতে দিবে না। তাই জোর করে চা বানিয়ে এনেছে। এখন রাইসা এই সামান্য ব্যাপারটাই অনেক বড় করে দেখছে। রিক্তা বলল,” তুমি বসো না রাইসা। এক কাপ চা তুমিও খাও।”
” আমি এখানে চা খেতে আসিনি।”
জিসান বলল,” ঠিকাছে তাহলে বাসায় চলো।”
এই কথা বলে জিসান রাইসার হাত ধরতে এলো। রাইসা গগনবিদারী চিৎকার করে উঠল,” ডন্ট টাচ মি।”
জিসানের গালে আচমকা একটা চড় ছুঁড়ে মারল রাইসা। রিক্তা বিস্মিত হয়ে গেল। শুধু এইটুকুতেই রাইসা থেমে থাকল না। বাড়িতে এসে ভাঙচুর করল। সারারাত জিসানকে ঘুমাতে দিল না। কিছুদিন পর রিক্তা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেল। কেন চলে গেল তা কেউ জানে না।
আসাদ সাহেব দুইমাসের আগেই বিদেশ থেকে ফিরে এলেন। জিসান-রাইসার বিয়ের বিষয়টা জেনে তিনি একটুও ব্যথিত হলেন না। বরং খুশি হলেন রাইসার প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে। জিসানকে নিয়ে শপিং করতেও বের হলেন। একটা বড় কাঠের দোলনা কিনে আনলেন। ছোট ছোট জামা-কাপড় কিনলেন, জুতো কিনলেন। জিসান বলল,” এখন এতো শপিং করার কি দরকার আঙ্কেল? মাত্র তিনমাস চলছে। এখনও ছেলে নাকি মেয়ে বোঝা যাচ্ছে না।”
আসাদ বললেন,” সমস্যা নেই। বাচ্চাদের মধ্যে আবার ছেলে আর মেয়ে কি! আমি এমন ডিজাইন দেখে কিনেছি যেন ছেলে-মেয়ে সবাই পরতে পারে। হাহাহা!”
আসাদ সাহেবের এতো উত্তেজনা দেখে জিসানও মনে মনে প্রফুল্লতা অনুভব করল। এতোদিন বাচ্চা নিয়ে তার মনে কোনো আনন্দ ছিল না। ইদানীং আনন্দ হচ্ছে। সে চায় তার একটা মেয়ে হোক। আর মেয়েটি যেন একদম তার মায়ের মতো দেখতে হয়। জিসান তার নাম দিবে জুঁই। জেসমিনের বাংলা অর্থ জুঁই।
কিছুদিন পর রাইসার বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে গেল। রাইসা খুব কাঁদল। জিসান কাঁদল না। সে শুধু রাইসাকে সান্ত্বনা দিল৷ কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল, এই দূর্ঘটনায় রাইসার চেয়েও হাজারগুণ বেশি কষ্ট সে নিজে পেয়েছে। কাঠের দোলনা, জামা-জুতো সব দান করে দেওয়া হলো।
রাইসার একটা সিকরেট রুম ছিল। সেখানে রাইসা কাউকে ঢুকতে দেয় না। মাঝে মাঝেই ওই সিকরেট রুমে গিয়ে সে সময় কাটায়। একদিন কৌতুহলবশত জিসান সেইরুমে ঢুকল৷ রাইসা অবশ্য তখন বাসায় ছিল না। রুমের প্রত্যেকটি দেয়ালে জিসানের ছবি লাগানো। জিসানের সাথে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ছোট-খাটো স্মৃতি রাইসা পরম যত্নে আগলে রেখেছে। জিসানের ব্যাপারটা ভালো লাগল। সে সব খুঁটিনাটি জিনিস নেড়েচেড়ে দেখছিল। কিন্তু চোখ আটকে গেল একটা ফাইলে। রাইসার এবর্শন রিপোর্ট ছিল সেটা। এক নিমেষে জিসানের দুনিয়া থমকে গেল যেন। সাথে সাথে রিপোর্ট নিয়ে সেই হসপিটালে রওনা হলো সে। গাইনোকোলোজিস্টের থেকে জানা গেল, রাইসার মিস ক্যারেজ হয়নি। সে নিজ ইচ্ছায় গর্ভপাত করেছিল। শুধু তাই নয়, একইসাথে রাইসা লাইগেশনও করিয়ে ফেলেছে যাতে সে কখনও আর মা হতে না পারে। জিসানের পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেল। রাইসার কি বড় ধরণের কোনো মানসিক সমস্যা আছে? নাহলে কোনো মা কি করে পারে নিজের বাচ্চাকে মে’রে ফেলতে? কোনো স্বাভাবিক মেয়ের পক্ষে কি করে সম্ভব মাতৃত্বকে স্বেচ্ছায় বর্জন করা! জিসান সিদ্ধান্ত নিল রাইসার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবে। সেদিন রাতেই রাইসাকে এই বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করল জিসান, ” এমন কেন করলে রাইসা? তুমি কি চাও?”
রাইসা চোয়াল শক্ত করে বলল,” কিছুই চাই না। শুধু তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। তোমার আমার মাঝখানে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে না।”
জিসান হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করল,” আমাদের বাচ্চা তোমার কাছে তৃতীয় ব্যক্তি?”
” আমার বাচ্চা -কাচ্চা পছন্দ না।”
” পছন্দ না বললেই তো হবে না৷ এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। তুমি এখন আবেগের বশে যেই ভুল করেছো সেইজন্য আজ থেকে দশবছর পর ঠিকই আফসোস করবে।”
” আমি আফসোস করবো না। আর আবেগের বশে আমি কিছুই করিনি। যা করেছি সব বুঝে-শুনেই করেছি। তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি জিসান। তুমি আমাকে ছেড়ে অন্যকাউকে ভালোবাসলে আমার খুব কষ্ট হবে। আমি সেটা মানতে পারবো না।”
” তোমার এই অভিশপ্ত ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”
জিসান রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। সারারাত আর বাড়ি ফিরল না সে। পরদিন সাইক্রিয়াটিস্টের এপোয়েন্টমেন্ট নিল৷ রাইসাকে সেই সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু রাইসা ডাক্তারের সামনে এমন ভাব করল যেন সে পুরোপুরি সুস্থ। জিসান নিজেও অবাক হয়ে গেল রাইসার আচরণ দেখে। সাইক্রিয়াটিস্ট রাইসার কোনো অসুখ সনাক্ত করতে পারলেন না।
চলবে