#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ১৪(শেষ)
লিখা- Sidratul Muntaz
সেদিনের পর থেকে জিসান আরও অনেক সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর চেষ্টা করেছিল রাইসাকে। কিন্তু রাইসা প্রত্যেকবারই সকলের সামনে এমন আচরণ করে যে তাকে নিতান্তই সুস্থ মানুষ বলে মনে হয়। দিন দিন রাইসার আচরণে জিসান নিজেই উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে হয় রাইসাকে গলা টিপে মে’রে ফেলতে। আসাদ সাহেবের সাথে একদিন ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় বসল জিসান। রাইসার সমস্ত অস্বাভাবিকতার ঘটনা বিস্তারিত বলল। আসাদ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। একসময় বললেন,” রাইসার এই অবস্থা নতুন কিছু নয়। তবে আমার ধারণা ছিল ও ঠিক হয়ে যাবে। ওর এই আত্মকেন্দ্রীক আচরণ যে এতো ভয়াল রূপ ধারণ করবে এটা আমি বুঝতে পারিনি। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে বিয়ের আগেই তোমাকে আমি সতর্ক করতাম।”
জিসান শান্ত কণ্ঠে বলল,” বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে তাই এসব বলে এখন আর লাভ নেই আঙ্কেল। রাইসাকে কিভাবে স্বাভাবিক করা যায় সেটা নিয়েই আমাদের চিন্তা করা উচিৎ।”
” সেটা তো অবশ্যই। তবে তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। যে কথা আমি কোনোদিন কাউকে বলিনি সেই কথা আজ তোমাকে বলছি বাবা। কারণ আমি তোমাকে ভরসা করি। নিজের সন্তানের থেকেও বেশি।”
” আমি জানি আঙ্কেল। আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।”
আসাদ সাহেব চোখ থেকে চশমা খুলে রাখলেন। এই মুহূর্তে তারা বারান্দায় বসে আছে। নিস্তব্ধ রাত্রি। আকাশে মেঘেদের বিচরণ। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে পরিবেশে। চাঁদহীন অন্তরীক্ষে মিটিমিটি তারাগুলো প্রজ্বলিত শিখার মতো জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই আসাদ সাহেব বললেন,” আমার স্ত্রী সালেহার কথা কি কখনও বলেছি তোমাকে?”
” না আঙ্কেল। কখনও বলেননি।”
” আজ বলছি শোনো, রাইসাকে যেমন দেখছো সালেহাও ঠিক তেমনই ছিল। রাইসা হয়েছে তার মায়ের প্রতিবিম্ব। বিয়ের পর এখন পর্যন্ত তোমার সাথে রাইসা যা কিছু করেছে সালেহাও আমার সাথে ঠিক তাই করতো। রাইসার জন্মের পর কতবার যে সালেহা তাকে গলা টিপে হ’ত্যা করতে চেয়েছিল আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। ওর হাত থেকে রাইসাকে বাঁচানোর জন্য আমি আলাদা বাড়িতে গভর্নেস রেখে রাইসার দেখা-শুনা করিয়েছি। সেই বাড়িতে গিয়েও সালেহা অসংখ্যবার রাইসাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করেছে। গভর্নেস আহত হয়েছে। সালেহার কথা ছিল, ওর আর আমার পৃথিবীতে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকতে পারবে না। আমাদের মাঝে যে আসবে সালেহা তাকেই শেষ করবে। আমি সন্তান হারানোর ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতাম। রাইসার যখন বারো বছর বয়স তখন আমি এতিমখানা থেকে একটি পাঁচবছরের মেয়েকে দত্তক নেই। এই কাজটা আমি করেছিলাম ভবিষ্যতের কথা ভেবে। রাইসা যদি কোনো কারণে সত্যিই ম’রে যায় তাহলে শেষ বয়সে আমি আমার দত্তক নেওয়া মেয়েটিকে নিয়ে থাকতে পারবো। সে হবে আমার সকল সম্পদের অধিকারীনী। কিন্তু সালেহা এটা জানতে পারলে তার জীবনটাও ঝুঁকির মুখে পড়তো। তাই মেয়েটিকে আমি কখনও নিজের মেয়ের পরিচয় দেইনি৷ সবার কাছে সে স্বীকৃতি পেয়েছে কাজের মেয়ের পরিচয়ে। শুধু রাইসা সত্যিটা জানতো। আমি ভেবেছিলাম রাইসা তার মায়ের মতো হয়নি। সে আমার মতো হয়েছে। কিন্তু আমার দত্তক নেওয়া মেয়ের সাথে রাইসার রেষারেষি মনোভাব আমাকে হতাশ করল। সালেহার আচরণের নব্বই ভাগ অংশই রাইসার মধ্যে ছিল। এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে রাইসা একদম সালেহাকেই ফিরিয়ে এনেছে। জিসান, তুমি বিশ্বাস করবে কি-না জানি না। কিন্তু শেষমেষ সালেহার মৃত্যু আমার হাতেই হয়েছিল। আমি ওর ভয়ংকর অত্যাচার সহ্য করতে পারিনি। অতিরিক্ত ভালোবাসা বিতৃষ্ণার রূপ নিয়েছিল। কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসাও ভালো না।”
জিসান হতচকিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আসাদ আঙ্কেলের মতো একজন মানুষের দ্বারা খু’ন! এ তো অবিশ্বাস্য ঘটনা! জিসান কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,” সেই মেয়েটি এখন কোথায় আঙ্কেল?”
আসাদ বিব্রত কণ্ঠে বললেন,” আছে। বিদেশে আছে। রাইসার যন্ত্রণায় তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।”
জিসান তখনও জানতো না যে সেই মেয়েটিই রত্না। আর সে বিদেশ নয় কাজের মেয়ের পরিচয়ে এই বাড়িতেই আছে। আসাদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,” আমি চূড়ান্ত অতিষ্ট হয়ে সালেহাকে হ’ত্যা করেছিলাম। আমার ভালোবাসা টিকে থাকেনি। এর মানে কি নিজের স্ত্রীর প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল না? ছিল বৈকি! কিন্তু ভালোবাসা হেরে গেছে। জিতে গেছে ক্রোধ। তোমার ভালোবাসাও একসময় হেরে যাবে। তখন হয়তো আমার মতো তুমিও রাইসাকে মে’রে ফেলতে চাইবে।”
জিসান নিশ্চুপ হয়ে গেল। আসাদ আঙ্কেলের ধারণা শতভাগ সত্যি। জিসান তো এখনি রাইসাকে মে’রে ফেলার চিন্তা করছে। আসাদ যেন জিসানের মনের কথা পড়ে ফেলেছেন।
” আমি তোমাকে ভালো একটা পরামর্শ দিচ্ছি জিসান। তুমি যেকোনো বাহানায় রাইসার জীবন থেকে সরে যাও। নাহলে তোমরা কেউই সুখী হতে পারবে না। রাইসা কখনোই তোমাকে ভালো থাকতে দিবে না। আর তুমি নিজে যদি ভালো না থাকো তাহলে রাইসাকে কি করে ভালো রাখবে? আমি চাই না ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক। তাই বলছি, চলে যাও রাইসাকে ছেড়ে। দূরে কোথাও চলে যাও। তোমাদের আলাদা হওয়া ছাড়া এই সমস্যার অন্যকোনো সমাধান নেই।”
জিসান কি বলবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ পর সে আসাদ সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে এলো। এবং সেটাই ছিল জিসানের সাথে আসাদ সাহেবের শেষ কথোপকথন। এরপর আর কোনোদিন আসাদ সাহেবের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। সকালে জানা গেল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর এই হঠাৎ মৃত্যুর কারণ ধরতে জিসানের বেশি বেগ পেতে হলো না। রত্নার থেকে জিসান জেনেছিল গতরাতে তার আর আসাদ সাহেবের সকল আলাপন রাইসা আড়ি পেতে শুনেছে। সকালে রাইসা বাবার জন্য কফি বানিয়েছিল। সেই কফিতে এমন কিছু মেশানো ছিল যা খেয়ে আসাদ সাহেব মা’রা গেছেন। ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে তিনি স্ট্রোক করেছেন। কাকতালীয়ভাবে আসাদ আর জিসানের মায়ের মৃত্যু একই কারণে হয়েছে। সেদিন সকালে রাইসা জেসমিনের জন্যেও কফি বানিয়েছিল৷ সেই কফি খাওয়ার কিছুসময় পরেই জেসমিন ইহলোক ত্যাগ করেন। আসাদ সাহেবেরও একই পরিণতি। কিন্তু জিসানের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনো মেয়ে কি পারে নিজের জন্মদাতাকে হ/ত্যা করতে! যদিও আজ-কাল রাইসার কোনো আচরণেই সে তেমন অবাক হয় না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে রাইসার বানানো কফি জিসান কখনোই খায়নি। সে চাইলেই রাইসাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতো। কিন্তু রাইসা নিজের বাবাকে কেন খু’ন করবে? তার মানসিক অবস্থা পুলিশ বুঝতে চাইতো না। এতে ভয়ংজর জটিলতার সৃষ্টি হতো। তাই জিসান আইনী ব্যবস্থা না নিয়ে বেআইনী ব্যবস্থা গ্রহণে মনস্থির করে। রাইসাকে নিজের হাতেই মে’রে ফেলতে চাইছিল সে। অন্যদিকে রত্না আসাদ সাহেবের মৃত্যুর কারণ হিসেবে জিসানকে সন্দেহ করেছিল। তার ওই সন্দেহ ইচ্ছে করেই জিসান ভাঙাতে যায়নি। রত্নাকে কাজের মেয়ে ভেবে সে তখনও পাত্তা দেয়নি। তবে এখন বুঝতে পারছে, রত্নাকে পাত্তা না দেওয়া অনেক বড় ভুল ছিল।
রাইসাকে মা’রার জন্য অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল জিসান। সাইক্রিয়াটিস্ট নোভার শরণাপন্ন হওয়া এই পরিকল্পনারই একটি অংশ ছিল। যদি কোনোভাবে মিস নোভা জিসানকে মানসিক রোগী হিসেবে সনাক্ত করে ফেলে তাহলে রাইসাকে খু’ন করার পর আইনী দিক দিয়ে জিসান সাইকো হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাবে। এক্ষেত্রে তার শাস্তির পাল্লাও হালকা হবে।
জিসানের বক্তব্য শেষ হলো। মিস নোভা এতোক্ষণ ধরে তার জবানবন্দী মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কাঁচের দরজার বাহিরে থেকে অফিসার ও কন্সটেবল পুরো কাহিনী বুঝে মাথা নাড়ছে। তাদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করেই মিস নোভা বলল,” আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে মিস্টার জিসান। অবশ্য এটা গুড নিউজ নাকি স্যাড নিউজ সেটা আপনি ডিসাইড করবেন।”
জিসান বিরস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” নিউজটা কি? শুনি!”
” আমার কাছে এই মাত্র ফারিহার মেসেজ এসেছে। আপনার স্ত্রী রাইসার জ্ঞান ফিরেছে। সে হন্যি হয়ে আপনাকে খুঁজছে৷ বার-বার আপনার নাম উচ্চারণ করছে। এর থেকে প্রমাণ হয় মিসেস রাইসার এক্সিডেন্টের পেছনে আপনার হাত নেই। আপনাকে মুক্ত করা হচ্ছে। আপনি কি এখন আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান?”
জিসানের চেহারায় কোনো উৎফুল্লতা দেখা গেল না। সে আগের মতোই বিরস কণ্ঠে জবাব দিল,” নিশ্চয়ই চাই।”
রাইসা ঝাপসা দৃষ্টিতে জিসানকে দেখতে পাচ্ছে। মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগার কারণে তার দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। শ্বাস নিতেও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে৷ রাইসা ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পাচ্ছে। জিসান কাছে আসতেই রাইসা বলল,” তুমি কি আমার মাথায় একবার হাত রাখবে জিসান? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
জিসান শুধু রাইসার মাথায় হাত রাখল না। তার কপালে চু’মুও দিল। শীতল কণ্ঠে বলল,” তুমি যা চাও তাই হবে রাইসা। আমরা সবসময় একসাথে থাকবো। আমাদের মাঝে কখনও কোনো তৃতীয় ব্যক্তি আসবে না। আজকের পর থেকে তোমার সব কথা আমি মেনে চলবো। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না প্লিজ।তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।”
রাইসা খুব জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। হাত বাড়িয়ে জিসানের মুখমন্ডল স্পর্শ করে বলল,” জিসান, তুমি আমাকে যতই ঘৃণা করো কিন্তু আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি।”
কথাটা বলার পরেই রাইসার দূর্বল হাতটি পড়ে গেল নিচে। জিসান তড়িঘড়ি করে বলল,” আমিও, আমিও ভালোবাসি!”
শেষ কথাটি শুনে যাওয়ার সৌভাগ্য রাইসার হয়নি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস গ্রহণ করার পর রাইসা চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। আর কোনোদিন তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে না। জিসানের বাম চোখ থেকে দু’ফোঁটা গরম অশ্রু রাইসার গাল স্পর্শ করে গেল শুধু।
পাঁচ বছর কেটে গেছে। রত্না এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সে মিস নোভার সঙ্গেই আছে। ফারিহা বিয়ে করে বিদেশে সেটেল হওয়ার পর নোভার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে রত্নাই এখন তার সমস্ত কাজ করে। নোভা এখনও বিয়ে করেনি। সে ঠিক করেছে মনের মতো মানুষ না পেলে কোনোদিন বিয়ে করবে না। ঘৃণার সঙ্গে বসবাস করার চেয়ে ভালোবাসার অপেক্ষায় থেকে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়াও ভালো।
নোভা রোজ রত্নাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে নিজের চেম্বারে যায়। প্রায়ই রত্না মাঝপথে গাড়ি থামাতে বলে। আজকেও তাই করল। একটি অনাথ আশ্রমের সামনে গাড়ি থামানো হলো। রত্না গাড়ি থেকে নেমে মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। নোভা শীতল দৃষ্টিতে নেইমপ্লেটের দিকে তাকালো, ” রাইসা চাইল্ড হোম অরফেনেজ।”
রাইসার মৃত্যুর পর তার নামের সব সম্পদ বিক্রি করে এই এতিমখানাটি নির্মাণ করেছিল জিসান। রত্না এই এতিমখানার সামনে দাঁড়ালেই কেন যে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সেই রহস্য আজও বুঝতে পারে না নোভা। হয়তো তার শৈশবস্মৃতি মনে পড়ে যায়। একসময় সেও তো এমন একটি আশ্রমেই বড় হয়েছিল। অন্য একটি কারণ অবশ্য থাকতে পারে। সেই কারণটি ইচ্ছে করেই মানতে চায় না নোভা। এতিমখানার পাশেই ছোট্ট একটা কুটির। তার পেছনেই কবরস্থান। সেখানে রাইসার কবরটি আছে। তবে ওইটুকু জায়গা জিসান দখল করে রেখেছে পাঁচবছর ধরে। আজ পর্যন্ত সেখানে অন্যকাউকে কবর দেওয়া হয়নি। কবরের উপর কাঠগোলাপের গাছ লাগানো হয়েছে। রাইসার কাঠগোলাপ পছন্দ ছিল। নোভা গাড়ি থেকে নেমে রত্নার পাশে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,” ভেতরে যাবে?”
রত্না হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। নোভা বলল,” চলো।”
তাদের দেখেই বুড়ো একজন লোক গেইট খুলে দিলেন। নোভা রত্নাকে নিয়ে ছোট্ট কুটিরের কাছে গেল। জিসান ব্যালকনিতে বসে খাতা কাটছে৷ তার সামনের টেবিলে বিশাল বই-খাতার স্তূপ। ভেতরের রুমটিতে শুধু একটা চৌকি ছাড়া অন্যকিছু নেই। পাঁচবছর ধরে এটিই জিসানের আবাসস্থল। এখানে সে এতিমখানার বাচ্চাদের পড়াশুনা শেখায়। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত নাকি সে এই কাজই করে যাবে। রত্না কিছু বলল না। সে দূর থেকে জিসানকে দেখেই চলে যেতে চাইল। নোভা বলল,” দেখা না করলে এলে কেন?”
” আর আসবো না।”
রত্নার কণ্ঠে অভিমান। নোভা হাসল৷ সে জানে রত্না কালই আবার আসবে। নোভা রত্নার হাত ধরে বলল,” চলো ভেতরে যাই।”
একপ্রকার জোর করেই রত্নাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল নোভা। জিসানকে উদ্দেশ্যে করে গলা খাকারি দিয়ে নোভা বলল,” আসসালামু আলাইকুম মাস্টার সাহেব। কি অবস্থা? কি করছেন?”
জিসান চশমা ঠিক করে মৃদু হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে দু’টো মোড়া এনে ওদের বসতে দিল। রত্না বসল না। সে নোভার কাঁধে হাত রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নোভা বসল। জিসান হাসিমুখে জবাব দিল,” গত সপ্তাহে ওদের পরীক্ষা নিয়েছিলাম। আজ রেজাল্ট দেওয়ার কথা। তাই দেখছিলাম সব ঠিকঠাক আছে কি-না।”
নোভা বলল,” প্রতিদিনের মতো আজকেও রত্নার ইচ্ছে হলো আপনাকে না দেখে ভার্সিটি যাবে না। তাই নিয়ে এলাম।”
” ভালো করেছেন। রত্না, বসো না তুমি। দাঁড়িয়ে কেন?”
রত্না আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,” বসবো না এখন। আমার দেরি হচ্ছে। আপু তুমি আসো। আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।”
জিসানের চোখে দৃষ্টিপাত না করেই বের হয়ে গেল রত্না। নোভা হেসে বলল,” লজ্জা পাচ্ছে হয়তো। ও ভেবেছে আপনি বিরক্ত হয়েছেন।”
জিসান একহাত দিয়ে চশমা নেড়ে বলল,” বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আপনাদের যখন মন চাইবে আসবেন। আমার তো ভালোই লাগে।”
নোভা জানে জিসান এই কথা কেবল ভদ্রতার খাতিরেই বলছে। সে আসলে নিজের কুটিরে কারো উপস্থিতিই সহ্য করতে পারে না। কিছুদিন আগেও গম্ভীর গলায় বলেছিল,” এখানে আর আসবেন না। এটা শুধু আমার আর রাইসার বাড়ি।”
এরপর রত্না কিছুদিন আসা বন্ধ রেখেছিল। এখন আবার আসতে শুরু করেছে। কবে জানি জিসানের মেজাজ আবার বদলে যায়। নোভা জিজ্ঞেস করল,” মিস্টার জিসান, মাস্টার সাহেব। আপনি এখন কেমন আছেন?”
” ভালোই আছি।”
” মিসেস রাইসাকে মিস করেন?”
” না। মিস করবো কেন? সে তো আমার সাথেই আছে। তার অন্তরীক্ষ আর আমার অন্তরীক্ষ একই।”
” অন্তরীক্ষ মানে তো আকাশ। যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের সবার অন্তরীক্ষই এক।”
” না। অন্তরীক্ষ মানে শুধু আকাশ নয়। অন্তরীক্ষ মানে হৃদয়। হৃদয়ের বিশালতা। অন্তর থেকেই অন্তরীক্ষ। যার অন্তরীক্ষ যত বিশাল তার হৃদয় তত আলোকিত।”
” তাই? আপনার হৃদয়ের অন্তরীক্ষ কি আলোকিত?”
জিসান বিরস গলায় বলল,” না। আমার অন্তরীক্ষে শুধুই অন্ধকার।”
নোভার মনটা কেমন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। জিসান ঘড়ি দেখে বলল,” সকাল নয়টা বাজছে। গাছে পানি দিতে হবে। আপনি বসুন। আমি আসছি।”
জিসান পানির পাত্র হাতে উঠে চলে গেল। বাড়ির পেছনদিকের কবরে রাইসা শুয়ে আছে। সেখানে অনেক ধরণের ছোট ছোট গাছপালা লাগানো। জিসান সবগুলোতে আলাদা আলাদাভাবে পানি দিচ্ছে। রাইসার কবরের সামনে দাঁড়ালেই তীক্ষ্ণ অপরাধবোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হৃদয়। পাঁচবছর আগের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে হসপিটালের শেষ দিনটি। রাইসাকে নিজ শক্তিতে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ করে মে’রে ফেলেছিল জিসান। এই একটি কারণে নিজের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকবে সে। এই অপরাধের দায়ভার কেউ নেবে না। কেউ না!
নোভা এসব দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি আশ্চর্য! মেয়েটা ম’রে গিয়েও জিসানকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। ভালোবাসার কি অদ্ভুত ক্ষমতা। রাইসার স্বপ্নই পূরণ হয়েছে। আজ তাদের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি নেই। জিসান সবকিছু ত্যাগ করে রাইসার কবরের এক টুকরো জায়গা দখল করে কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু রাইসা জীবিত অবস্থায় তা দেখে যেতে পারল না। জেনে যেতে পারল না যে জিসান তাকে কতটা ভালোবেসেছিল! এই ভালোবাসার পরিধি বোঝার আগেই রাইসা হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি হয়তো স্বার্থপর মানুষদের এভাবেই শাস্তি দেয়।
অনাথ আশ্রম থেকে চলে আসার সময় নোভার মনে একটা প্রশ্ন দূর্বিপাকের মতো ঘুরছিল। আচ্ছা, জিসানের কি অপরাধ ছিল? সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে তার অন্তরীক্ষে আজও কেন অন্ধকার!
সমাপ্ত