অন্তরীক্ষে_অন্ধকার পর্ব ২

0
353

#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ২
লিখা- Sidratul Muntaz

“আপনি তাহলে আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করেননি মিস নোভা।”
আশাহত মনে হচ্ছে জিসানের কণ্ঠ। নোভা ভরাট গলায় বলল,” নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছি। পেশেন্টের কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। পেশেন্টরা কখনোই ডক্টরের কাছে এসে মিথ্যে বলবে না।”
” তাহলে? আমি যদি অসুস্থ হই আপনি আমার ট্রিটমেন্ট করুন। আমার স্ত্রীর সাথে কেন দেখা করতে চাইছেন?”
নোভা বোঝানোর মতো সুন্দরভাবে বলল,” দেখুন মিস্টার জিসান, এর পেছনে একটা কারণ আছে।বলতে পারেন এটাও ট্রিটমেন্টের অংশ। আপনার স্ত্রীকে আমি কিছু প্রশ্ন করবো। যার মাধ্যমে আপনার রোগটা আরও ভালোভাবে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব। আমি তো মানসিক রোগের ডাক্তার। এই পর্যন্ত যত মেন্টাল পেশেন্ট দেখেছি তারা কেউই নিজের সম্বন্ধে সঠিক ইনফোরমেশন দিতে পারেনি। অনেক সময় এমন হয় যে রোগে ভুগছে তার থেকে যে রোগীকে ফেইস করছে তার স্টেটমেন্টের উপর বেশি নির্ভর করে যে ট্রিটমেন্ট কেমন হওয়া উচিৎ! ”
জিসানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ। গভীর মনোযোগে কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” কিন্তু আমার স্ত্রীকে বুঝতে দেওয়া চলবে না যে আমি মানসিক অশান্তিতে ভুগছি। এটা ওকে কোনোভাবেই জানাতে চাই না আমি। তাই আপনার সাথে তার দেখা করানো অসম্ভব। ”
নোভা হাসার চেষ্টা করে বলল,” ওমা, জানানোর প্রশ্ন আসছে কেন? আমি তো বলিনি আপনার স্ত্রীকে কিছু জানাতে হবে।”
” তাহলে আপনি তার সঙ্গে কিভাবে দেখা করবেন?”
নোভা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সহজ গলায় বলল,” অনেক উপায় আছে। আপনি অন্য পরিচয়ে আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন৷ ধরুন, আমি হলাম আপনার ইউনিভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড!”
” আমার কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড নেই। এটা রাইসা জানে।”
” তাহলে আমি হতে পারি আপনার দূর সম্পর্কের কাজিন। যে অনেকদিন পর আমেরিকা থেকে ফিরেছে।”
জিসান জ্ঞানীর মতো মাথা নেড়ে বলল,” আই সী। মানে আপনি যেকোনো মূল্যেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। তাইতো?”
” এটা আমার চিকিৎসার খাতিরে করতেই হবে। কিছু করার নেই মিস্টার জিসান।”
জিসান একটু সময় চুপ থেকে বলল,” ওকে ডান। আমি আবার আগামীকাল আসবো। আপনি কখন ফ্রী থাকেন জানিয়ে দিবেন। আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।”
” কালই?”
জিসান অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল,” যত দ্রুত সম্ভব। এখন যদি ফ্রী থাকেন তাহলে এখনও যেতে পারেন।”
” এখন না। ঠিকাছে কালকেই যাবো। আপনি নাম্বার নিয়ে যান। ফোন করবেন।”
” নাম্বার আমার কাছেই আছে।”
” ওইটা তো রিসিপশনের নাম্বার। আপনি আমার পারসোনাল নাম্বারটা নিয়ে যান।”
জিসান কঠিন গলায় বলল,” আমি মহিলা মানুষের নাম্বার আমার ফোনে রাখি না।”
নোভা আর ফারিহা দু’জনকেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত অবস্থায় রেখে বের হয়ে যাচ্ছিল জিসান। নোভা একটু গলা উঁচু করে বলল,” আপনি কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আমার কাছে কেন এসেছিলেন? শুধুই ট্রিটমেন্টের জন্য? এর মানে কি আপনি সুস্থ হতে চান? আপনার স্ত্রীকে আর খু’ন করতে চান না?”
জিসান ঘুরে তাকাল। শক্ত চোয়ালে উচ্চারণ করল,” আমি আমার লাইফের যেকোনো অবস্থাতেই তাকে খু’ন করতে চাইবো। এজ সুন এজ পসিবল!”
জিসান ধপ করে দরজা আটকে বের হয়ে গেল। নোভা তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। একটা খু’ন-খারাবি সত্যি ঘটে যাবে না তো? নোভার উচিৎ ছিল তাৎক্ষণিক লোকটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সে লোকটিকে যেতে দিয়ে ভুল করল নাকি? ফারিহা বলল,” এখন আপনার কি মনে হচ্ছে ম্যাম? মিস্টার জিসান কিন্তু রাজি হয়ে গেছেন। অর্থাৎ আমরা ধরে নিতে পারি তিনি নিজের স্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছেন তা সবই সত্যি। অথবা তিনি নিজে সেগুলো বিশ্বাস করেন।”
নোভা শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ঘাড় নাড়ল। ভাবুক স্বরে বলল,” হুম। কিন্তু এসবের পেছনে উনার অন্য পরিকল্পনাও থাকতে পারে। বাকিটা কাল জানা যাবে। যদি এসব সত্যি হয় তাহলে উনার ট্রিটমেন্টের আগে উনার স্ত্রীর ট্রিটমেন্ট বেশি দরকার বলে আমি মনে করি।”
ফারিহা হেসে ফেলে বলল,” এটা ঠিক বলেছেন ম্যাম।”

জিসান পরদিন ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলো নোভাকে তোলার জন্য। চেম্বারের সামনে এসে রিসিপশনে কল দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনফরমাল পোশাকে বেরিয়ে এলো নোভা আর ফারিহা। তাদের দেখলে কেউ ভাববে দুই সখী আনন্দ নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। তাদের মনে ফূর্তির শেষ নেই। জিসান বিরক্তির সাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নোভা জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বলল,” মিস্টার জিসান, আপনি পেছনে চলে আসুন। ফারিহা ড্রাইভারের সাথে বসুক। আর আপনি পেছনে আমার সাথে বসবেন।”
জিসান ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চশমা ঠিক করল। নোভা একটু বিব্রত হলো। জিসানের তাকানো দেখে মনে হচ্ছে নোভা খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে। এখনি নতজানু হয়ে ক্ষমা না চাইলে তার ভয়ংকর শাস্তি হবে। জিসান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আমি আমার স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়ের পাশে বসি না মিস নোভা। আপনি পেছনে বসুন। মিস ফারিহার সাথে।”
নোভা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” ইটস ওকে। আমি জাস্ট আপনার সাথে কথা বলার সুবিধার্থে অফারটা করেছিলাম।”
জিসান সামনের আয়নাটা ঠিক করে বলল,” কথা হবে সামনে-পিছে। কিন্তু ফেইস টু ফেইস!”
গাড়িতে বসার পর নোভা পেশাগত প্রয়োজনে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করল,” আচ্ছা মিস্টার জিসান, আপনার শ্বশুর মানে মরহুম আসাদ সাহেবের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?”
জিসানের ঠোঁটে হাসি নেমে এলো। শ্বশুর সম্পর্কীয় আলোচনায় তাকে আগ্রহী মনে হচ্ছে। জিসান কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার মতো বলল,” তিনি খুবই অমায়িক মানুষ ছিলেন। আমার সব ব্যাপার বুঝতেন। আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। আমি ছিলাম তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। ”
” বাহ, দারুণ! এজন্যই বুঝি নিজের একমাত্র কন্যাকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন?”
জিসান এই প্রশ্নে উচ্চশব্দে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দ শুনে বিস্মিত হয়ে চোখাচোখি করল ফারিহা আর নোভা। জিসান থেমে থেমে হাসছে। হাসির দমকে যেন তার দম আটকে যাবে। নোভা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” হাসির কি বললাম?”
” আসাদ আঙ্কেল ছিলেন আমার আর রাইসার সম্পর্কের ঘোর বিরোধী। তিনি কখনোই আমাদের বিয়ে দিতে চাননি। আমি রাইসাকে বিয়ে করেছি নিজের ইচ্ছায়। অথবা বলতে পারেন রাইসার ইচ্ছায়। আসলে তখন আমার বোধশক্তি এতোই থার্ডক্লাস ছিল যে রাইসার ইচ্ছাকেই মনে হতো নিজের ইচ্ছা। এইটুকুও বুঝতাম না যে নিজে কি চাইছি! শুধু জানতাম রাইসা যা চায় আমাকেও তো সেটাই করতে হবে!”
নোভা বিস্মিত হয়ে বলল,” কিন্তু গতকাল তো আপনি বলেছিলেন আসাদ সাহেবই নাকি আপনাকে নিজের একমাত্র কন্যা বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন!”
জিসান পেছনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” সত্যিই এটা বলেছিলাম নাকি?”
” জ্বী অবশ্যই বলেছিলেন। আপনি এটাই বলেছিলেন।”
জিসান ঠোঁট উল্টে বলল,” আমার তো মনে পড়ছে না।”
নোভা সন্দেহী গলায় প্রশ্ন করল,” যদি আসাদ সাহেব আপনাকে এতোই পছন্দ করতেন তাহলে আপনাদের সম্পর্ক মানতে চাইবেন না কেন?”
জিসান ক্রোধান্বিত গলায় উত্তর দিল,” পছন্দ শুধু কর্মচারী হিসেবে করতেন। মেয়ের জামাতা হিসেবে না। তাই পথের কাঁটা হতে চেয়েছিলেন। আমাদের ভালোবাসাকে গলা টিপে হ’ত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাভ কি হলো? আমরা তো দিব্যি বিয়ে করেছি। অথচ তিনিই চলে গেছেন পরপারে। একেই বলে রিভেঞ্জ অফ নেচার। ”
জিসানের কথা বলার ধরণ শুনে নোভা কোনো সর্বনাশা ভয়ংকর ঘটনার ইঙ্গিত পেল। তার শরীর পুনরায় শিরশিরানি শুরু করেছে। এরপর আর একটা প্রশ্নও করতে ইচ্ছে হলো না নোভার। গাড়ি থামল বিশাল বড় এপার্টমেন্টের সামনে। সময় সন্ধ্যা। ফারিহা আর নোভা একসাথে হাত ধরে নামল। জিসান ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে ইশারায় বলল,” চলুন।”
নোভার ভেতরে যেতেই ভয় লাগছে। ভয় কা’টাতে সে ফারিহার হাত শক্ত করে ধরে আছে। উপলব্ধি করল, ফারিহার হাতটি কাঁপছে। অর্থাৎ ফারিহা নিজেও ভয়ে কাবু। লিভিংরুমে বসতে দেওয়া হলো ওদের। পুরো বাড়ি অন্ধকার ছিল। জিসান এসে লাইট জ্বালায়। ফারিহা আর নোভা চারদিকে তাকাতে তাকাতে সোফায় বসে। জিসান আওয়াজ করে ডাকল,” রাইসা, আমার কাজিন চলে এসেছে। তোমার সাথে দেখা করতে চায়। রাইসা?”
ছুটে এলো মাথায় এলোমেলো বেণী নিয়ে এক মিষ্টি কিশোরী। মাথা নিচু করে বিনীত কণ্ঠে সে বলল,” ভাইজান, আপামনি ঘুমাইতাছে।”
জিসান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” এইসময় কিসের ঘুম? আমি না বলেছিলাম বাসায় গেস্ট আসবে?”
” বলছিলেন। আপামণির মনে আছিল না। তিনি তো আবার অনেক কিছুই ভুইলা যান।”
” যাও ডেকে আনো তোমার আপামণিকে।”
মেয়েটি দাঁত বের করা হাসি দিয়ে বলল,” যাইতাছি ভাইজান।”
শরীর দুলিয়ে হেলতে-দুলতে মেয়েটি চলে গেল। নোভা জিসানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” রত্না?”
জিসান সোফায় বসতে বসতে জবাব দিল,” ঠিক ধরেছেন।”
নোভা মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” খুবই প্রাণবন্ত একটি মেয়ে।”
জিসান সামান্য হাসল। কি ভেবে যে হাসল তা বোঝা গেল না। একটু পরেই ঘুমো ঘুমো তৈলাক্ত চেহারা নিয়ে রুমে প্রবেশ করল রাইসা। মুখে অমায়িক হাসি। ফারিহা আর নোভাকে দেখেই সালাম দিল। নোভা-ফারিহা সালামের জবাব দিয়ে হাসি বিনিময় করল রাইসার সঙ্গে। তারপর রাইসা আহ্লাদী দৃষ্টিতে জিসানের দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,” আরও আগে ডাকবা না আমাকে?”
জিসান গম্ভীর গলায় বলল,” কিভাবে ডাকবো? তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে। ঘুমানোর সময় তোমাকে ডাকলেই রেগে যাও।”
রাইসা অবাক হয়ে কনুই দিয়ে ধাক্কা মারল জিসানের বাহুতে। ঠাট্টার স্বরে বলল,” কবে রাগ করেছি তোমার উপর?”
জিসান বিব্রত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। রাইসা ফারিহা আর নোভার সামনে বসল। খুবই চটপটে মেয়ে মনে হচ্ছে তাকে। নোভা অবাক হয়ে রাইসাকে দেখছে। জিসান যেমন ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছিল তার সঙ্গে রাইসার ইমেজের কোনো মিলই নেই। কি ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে। মনে হচ্ছে, তেলাপোকা দেখলে এই মেয়ে লাফিয়ে ওঠে। বৃষ্টি দেখলে পাগলের মতো ছুটোছুটি করে। বিকেলবেলা ফুচকা খেতে যাওয়া তার অভ্যাস। টকে ঝাল কম হলেও ফুচকাওয়ালার সাথে মিষ্টি কণ্ঠে ঝগড়া করে। এমন ধরণের একটি মেয়ে কখনও কারো সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে না। রাইসা একসাথে অনেকগুলো কথা বলছে। জিসানের সাথে তার কিভাবে বিয়ে হলো, তাদের প্রথম দেখা কিভাবে হয়েছিল, সবই বলছে। এই বিষয়গুলো নোভা অল্প-বিস্তর শুনেছিল জিসানের কাছে। তাই মনোযোগ দিয়ে কথা শোনার প্রয়োজন মনে করল না। সে মনোযোগ দিয়ে অবজার্ভ করছিল রাইসা নামের রূপবতী মেয়েটিকে। নোভার মনে হচ্ছে তার দেখা অন্যতম রূপবতী মেয়ে হলো রাইসা। কথা-বার্তার এক পর্যায়ে জিসান সোফা ছেড়ে উঠে যেতে নিচ্ছিল। রাইসা জিসানকে হাত দিয়ে থামিয়ে বলল,” দাঁড়াও। তুমি যাচ্ছো কোথায়? গল্প করো আমাদের সাথে!”
জিসান কোমল গলায় বলল,” হ্যাঁ। গল্প করবো। তার আগে কফি নিয়ে আসি?”
রাইসা ভ্রু কুচকে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,” কফি আনা তোমার কাজ নাকি? দাঁড়াও রত্নাকে বলে দিচ্ছি। তুমি বসো। অদ্ভুত!”
রাইসা উঠে রত্নাকে ডাকতে গেল। নোভা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে জিসানের দিকে তাকালো। জিসানকেও যথেষ্ট অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, নিজের স্ত্রীর এমন অমায়িক আচরণ সে প্রত্যাশাই করেনি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here