#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ৭(বাকি অংশ),০৮
লিখা- Sidratul Muntaz
০৭ বাকি অংশ
জায়গাটা মর্গের মতো। কিন্তু এখানে কোনো লাশ নেই। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের মাঝামাঝিতে কেবল একটা বাল্ব জ্বলছে; হলদে রঙের। সামনে বিশাল টেবিল। সেই টেবিলের সংযুক্ত চেয়ারেই বসে আছে জিসান। পানির তৃষ্ণায় গলা ফেটে চৌচির। এদের কাছে পানি চাইলে কি পাওয়া যাবে?
দু’জন স্বাস্থ্যবান অফিসার ও একজন কন্সটেবল ঢুকল। কন্সটেবলের হাতে বড় লাঠি। জিসানকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদের আগেই লাঠিচার্জ করা হবে! অফিসার দু’জন শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলেন। একজন ঠান্ডা পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। অন্যজন জিজ্ঞেস করলেন,” খাবেন?”
জিসান পানি খেতে আগ্রহ দেখালো। তাকে পানি দেওয়া হলো। পানি খাওয়ার পর প্রথম অফিসার জিজ্ঞেস করলেন,” আপনার স্ত্রীর সাথে বিয়ে কিভাবে হয়েছিল? লভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ?”
প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই জিসান বিষম খেল। তার নিরন্তর কাশি উঠল। অস্বস্তিকর অবস্থা। অন্য অফিসার বললেন,” সমস্যা নেই। আপনি ধীরে-সুস্থে কথা বলুন। তবে শর্ত একটাই। সত্যি বলতে হবে। মিথ্যে বললেই..”
অফিসার কন্সটেবলের দিকে ইশারা করলেন। কন্সটেবল ইশারা করল নিজের লাঠির দিকে। জিসান গলা খাকারি দিল। সে সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা এই কথা বোঝার উপায় কি? জিসান এই মুহূর্তে যা বলবে অফিসার দু’জন সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য। শুধু আসল ঘটনাটি ছাড়া। জিসান স্বীকার করুক আর না করুক, রাইসার এক্সিডেন্টের জন্য তাকেই দায়ী করা হবে।
” লভ ম্যারেজ।”
জিসান নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে উত্তর দিল। অফিসার দু’জন একবার চোখাচোখি করলেন। প্রথম জন জানতে চাইলেন,” বিয়ে কিভাবে হয়েছিল?”
এই ব্যাপারে সত্যিটা চেপে গেল জিসান। সত্যি হলো, রাইসা প্রেগন্যান্ট ছিল। তাই তাদের বিয়েটা জরুরী ছিল। তাড়াহুড়ো করে তারা গোপনে বিয়ে সারে। কিন্তু বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি। রাইসার মিস ক্যারেজ হয়ে যায়। এই বাচ্চার ব্যাপার শুধু জিসান আর রাইসা ছাড়া পৃথিবীর অন্যকেউ জানে না। জিসান মিথ্যেটাই বলল,
” আমি আর রাইসা রিলেশনে ছিলাম। সিদ্ধান্ত নেই বিয়ে করবো। কিন্তু আসাদ আঙ্কেল মানে রাইসার বাবা এই বিয়েটা মানতে চাননি। আমি অফিসের সামান্য একজন ইমপ্লয়্যি হয়ে কিভাবে বসের মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখি? এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে রাইসা তার সবকিছু ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমরা গোপনে বিয়ে করি। কিছুদিন পর এই বিয়ের কথা জানাজানি হয়। মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আসাদ সাহেবের মন নরম হয়েছিল। তিনি আমাদের একদিন ডেকে পাঠালেন। তারপর সবকিছু মেনে নিলেন। তবে মন থেকে মানতে পারেননি। বিভিন্ন উপায়ে তিনি আমাকে খু’ন করার চেষ্টা করেছেন। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন এই চেষ্টা করে গেছেন। আমি ভাগ্যের জোরে প্রত্যেকবার বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি।”
” বলতেই হয়, আপনার ভাগ্যে জোর আছে!”
প্রথম অফিসার যেন কটাক্ষ করলেন।
” তিনি মরলেন কিভাবে?” দ্বিতীয় অফিসারের প্রশ্ন। জিসান জবাব দিল সপ্রতিভ স্বরে,” হার্ট এটাক।”
দু’জন অফিসার একত্রে মাথা নাড়ছেন। একজন টেবিলের দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করলেন,” বসের মেয়ের সাথে আপনার প্রেম হয় কিভাবে? মানে রিলেশনের ব্যাপারে আগ্রহ বেশি ছিল কার? আপনার নাকি মিস রাইসার?”
জিসান অস্বস্তি কাটাতে বলল,” এগুলো তো স্যার ব্যক্তিগত বিষয়।”
প্রথম অফিসার চোয়াল শক্ত করে বললেন,
” রিমান্ডে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। যা প্রশ্ন করবো সব ঠিকঠাক উত্তর দিবেন। উইদাউট এনি ফারদার এডো! ”
জিসান এইবার সত্যি কথাটাই বলল,” আমি রাইসাকে নিয়ে এমন কল্পনা মাথাতেও আনিনি। কিন্তু রাইসার আমার প্রতি এপ্রোচ ছিল। তাই আমাকে সায় দিতে হয়েছে।”
অফিসার একজন রেগে চিৎকার করলেন,” মিথ্যা বলবেন না!”
জিসান ভ্রু কুচকালো। কি আশ্চর্য! একটু আগে সে মিথ্যা বলেছিল। সেটা সহজেই বিশ্বাস করলেন দু’জন। আর এখন জিসান সত্যি বলেছে। তাও বিশ্বাস করছে না। এখানে অবিশ্বাসের কি হলো?”
দ্বিতীয় অফিসার প্রথমজনকে শান্ত হতে বললেন। দ্বিতীয় জন একটু বয়স্ক। তাই তিনি খুব ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন করছেন। প্রথম জনের বয়স কিছুটা কম। দেখতেও রগচটা ধরণের। অল্পতেই ফুঁসে উঠছেন। দ্বিতীয় অফিসার বললেন,
” আচ্ছা জিসান সাহেব, বিয়ের পর আপনার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল?”
” প্রথম দেড়বছর ভালোই ছিল। তারপর আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যেতে থাকে।”
” প্রথম দেড়বছর মানে যতদিন আসাদ সাহেব বেঁচেছিলেন ততদিন৷ এরপর থেকেই আপনাদের সম্পর্কটা খারাপের দিকে যেতে শুরু করে। ঠিক না?”
জিসান মাথা নিচু করে বলল,” জ্বী ঠিক।”
তারপর একটু খটকা লাগল তার। অফিসার জানলেন কি করে? জিসান অবাক হয়ে তাকাতেই দ্বিতীয় অফিসার হেসে উঠলেন। বললেন,” এই একটা কথা ছাড়া আপনার সব কথাই মিথ্যে। পয়েন্ট আকারে বলছি শুনুন। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মিসেস রাইসাকে আপনি হুমকি দিয়ে বিয়ে করেছিলেন। অথবা কোনো কারণে রাইসা আপনাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই কথা আসাদ সাহেব জানতেন না। তিনি যখন জানতে পারলেন তখন আপনাদের সম্পর্কটা সহজেই মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। আপনাকে জামাতা হিসেবে পেয়ে তিনি যথেষ্ট আনন্দিতও ছিলেন। তিনি আপনাকে খু’ন করার চেষ্টা একবারও করেননি। বরং আপনিই আসাদ খানকে নানা অযূহাতে খু’ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আর শেষমেষ তিনি হার্ট এটাক করেন। হতে পারে এটাও মার্ডার। আপনি তো আবার সরাসরি খু’ন করেন না। ভিক্টিমকে এমনভাবে মা’রেন যাতে পরবর্তীতে ব্যাপারটা এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।”
জিসানের কপাল গড়িয়ে দু’ফোঁটা ঘাম টেবিলে পড়ল। হৃৎপিন্ডে দামামা বাজছে। এতো ঘটনা অফিসার জানলেন কি করে? রত্না বলেছে? সেও বা এসব কিভাবে জানলো? এর মানে কি রত্না সব জানে! জিসানের কণ্ঠ আবার শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রথম অফিসার বললেন,” আপনার হয়তো আরেক গ্লাস পানি প্রয়োজন।”
জিসানকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার কাছে সময় দুই ঘণ্টা। এর মধ্যে সব সত্যি স্বীকার করতে হবে। তা না করলে সত্যিই তার উপর লাঠিচার্জ শুরু হবে। অফিসার দু’জন বিরতিতে গিয়েছেন। দু’ঘন্টা পার হলে আবার আসবেন। হঠাৎ অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করল সাইক্রিয়াটিস্ট নোভা। সাথে একজন কন্সটেবল। জিসানের মুখোমুখি চেয়ারটিতে বসেই প্রশ্ন করল নোভা,” কেমন আছেন মিস্টার জিসান?”
জিসান অন্যদিকে তাকাল। জবাব দিতে ইচ্ছে করল না। নোভা সামান্য হেসে বলল,” আমার উপর রাগ দেখাচ্ছেন কেন? আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তবে আপনার কাছে আসার একটা কারণ আছে। আমি অযথা আলাপ করতে আসিনি। শুধু একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো। হয়তো আপনিও উপকৃত হতে পারেন।”
জিসান না তাকিয়েই জবাব দিল,” কি প্রশ্ন?”
” রত্না কি কিছু মিথ্যে বলেছে?”
জিসান এবার সরাসরি তাকাল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,” আমার কথা বিশ্বাস করবেন?”
” বিশ্বাসযোগ্য হলে অবশ্যই বিশ্বাস করবো।”
জিসান একটু থামল। আগেই বলে দিল না। ঘটনা কি হয়েছে সেটা বুঝতে হবে। জিসান বলল,” রত্নাকে হঠাৎ অবিশ্বাস করছেন কেন? একটু আগে তো তার অভিযোগের উপর ভিত্তি করেই আমাকে গ্রেফতার করিয়েছেন।”
” হ্যাঁ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু গর্ভর আছে। ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সাথে আলাপ করি। আপনার কথা যদি গ্রহণযোগ্য মনে হয় তাহলে আমি বিশ্বাস করবো। আপনাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করবো।”
” রত্নার কথা কি তাহলে গ্রহণযোগ্য না?”
” রত্না আমাকে অনেক বিষয় মিথ্যে বলেছে।”
” মিথ্যে বলেছে এটা কিভাবে বুঝলেন?”
” মাঝে মাঝে বোঝা যায়। জটিল ব্যাপারগুলোতে সত্যি আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যটা খুব সুক্ষ্ম।ওই সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলো যারা ধরতে পারে তারা বুঝতেও পারে। রত্না সেদিন আপনার বাড়িতে বন্ধ ঘরে বসে আমাকে যা কিছু বলেছিল আর আজকে যা বলেছে; এই দুই জবানবন্দীর মধ্যে তেমন মিল নেই। কিছু ব্যাপার আছে যথেষ্ট অযৌক্তিক। বোঝাই যায়, হয় রত্না সেদিন মিথ্যে বলেছিল নাহলে আজ মিথ্যে বলছে। এখন প্রশ্ন হলো, তার মুখ থেকে সত্যি বের করার উপায় কি?”
জিসান মৃদু হেসে জানাল,” উপায় আমি জানি। কিন্তু আপনি মানবেন কি-না সেটা হচ্ছে কথা।”
” আগে বলেন, তারপর দেখছি মানা যায় কি-না।”
” রত্নাকে বলবেন, সে যদি একটাও মিথ্যে কথা বলে তাহলে সেই মিথ্যের জন্য আমাকে ম’রতে হবে। দেখবেন তারপরই গড়গড় করে সব সত্যি বলতে শুরু করেছে।”
নোভা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে বলল,” ভালোই আইডিয়া দিয়েছেন। ঠিকাছে আমি চেষ্টা করে দেখি। আপনাকে আপডেট জানাবো।”
কন্সটেবলসহ সাইক্রিয়াটিস্ট নোভা বেরিয়ে যাচ্ছে। জিসান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রত্না হয়তো এবার সত্যি স্বীকার করবে। কিন্তু বিপদ তবুও কাটবে না। রাইসার এক্সিডেন্টের বিষয়ে রত্না সত্যি বললেও আসাদ সাহেবের এক্সিডেন্ট নিয়ে নিশ্চয়ই মিথ্যা বলবে না।সত্যিটাই বলবে। তখন তো জিসান আবার ফেঁসে যাবে। উফ, সবকিছু কেমন গোলকধাঁধা হয়ে যাচ্ছে। এক জাল থেকে বাঁচতে গিয়ে অন্যজালে ফাঁসতে হচ্ছে৷ জিসান রত্নাকে কাজের মেয়ে ভেবে অবহেলা করেছিল। যদি আগে জানতো যে রত্না কাজের মেয়ে নয়, আসাদ খানের দত্তক নেওয়া মেয়ে! তাহলে জিসান আসাদ খানের ব্যাপারটা নিয়ে আরও শতর্ক হয়ে যেতো। আজকে এতোদিন পর এসে এইভাবে ফাঁসতে হতো না।
জিসান যা বলেছিল তাই সত্যি হলো। নোভা রত্নার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলেছে,” তুমি মিথ্যে কথা বলো না রত্না। যদি একটাও মিথ্যে বলো তাহলে কিন্তু মিস্টার জিসানকে মে’রে ফেলা হবে।”
রত্না বিচলিত কণ্ঠে জানতে চাইল,” কেন? জিসান ভাইকে কেন মা’রা হবে? তিনি তো বেশি অন্যায় করেননি। তাকে শাস্তি দিয়ে তারপর ছেড়ে দিলেই তো হয়।”
ফারিহা বলল,” ইউ আর সো ইনোসেন্ট রত্না! মিস্টার জিসান যেটা করেছেন সেইটা মার্ডার কেইস। এতো সহজে তাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে নাকি?”
রত্না ব্যগ্র হয়ে বলল,” কেন যাবে না? আমি অনুরোধ করবো। পুলিশ আঙ্কেলদের ঘুষ দিবো৷ তাহলেও কি ছেড়ে দিবে না?”
ফারিহা কি উত্তর দিবে বুঝতে পারল না। সে হতভম্ব।নোভা কাছে এসে রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” শোনো রত্না, মিস্টার জিসান যেটা করেছেন সেটা অনেক বড় ক্রাইম। একটা মানুষকে মে’রে ফেলা কোনো সাধারণ অপরাধ না। যদি মিসেস রাইসা মা’রা যান তাহলে অবশ্যই তোমার জিসান ভাইয়ের ফাঁসি হবে। এখন তুমি সত্যিটা বলো, জিসান কি আসলেই রাইসাকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিল?”
রত্নার মুখ কাঁচুমাচু। সে সত্যি কিভাবে স্বীকার করবে? সে জানে, জিসান ভাই রাইসা আপাকে মা’রতে চায়নি। রাইসা আপার এই এক্সিডেন্টের পেছনে দায়ী হলো রত্না নিজেই। যদি রত্না এই সত্যি স্বীকার করে তাহলে তো জিসানকে ছেড়ে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে! রত্না আমতা-আমতা করে বলল,” জিসান ভাই তো ভুল কিছু করেননি। রাইসা আপা আমাদের এতো অত্যাচার করেন যে তাকে মে’রে ফেলা ছাড়া আমাদের অন্য উপায় নেই। জিসান ভাইয়ের দোষ কি বলুন? তিনি তো আমাকে বাঁচানোর জন্য আপাকে মা’রতে বাধ্য হয়েছেন।”
ফারিহা চোখ বড় করে নোভার দিকে তাকালো। নোভা কোমল কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা রত্না, তুমি এতোবার কেন স্টেটমেন্ট চেঞ্জ করছো? প্রথম দিন কিন্তু তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার রাইসা আপা স্বাভাবিক মানুষ। তার কোনো সমস্যা নেই। তোমাদের সাথে সে অনেক ভালো ব্যবহার করে। অথচ এখন বলছো সে তোমাদের অত্যাচার করতো। কোনটা সত্যি?”
রত্না নত মাথায় জবাব দিল,” এখন যেটা বলছি সেটাই সত্যি।”
নোভা রত্নার চিবুক স্পর্শ করে বলল,” তাহলে সেদিন মিথ্যে কেন বলেছিলে?”
রত্না জবাব দিল না। এর জবাব তার কাছে নেই। রাইসা কোনোভাবে সুস্থ হয়ে যাক এটা রত্না চায় না। নোভা প্রথম সাক্ষাৎ-এই রত্নাকে নিজের পরিচয় জানিয়েছিল। সে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। তখন রত্নার অবচেতন মন ভেবে নেয়, জিসান ভাই রাইসা আপার চিকিৎসা করার জন্য এই মহিলাকে বাসায় এনেছেন। কিন্তু রত্না তখন কোনাভাবেই চায়নি যে রাইসার চিকিৎসা হোক। তাই মিথ্যে করে বলেছিল, রাইসা সুস্থ মানুষ। নাহলে তো ডক্টর নোভা রাইসার চিকিৎসা করতেন। আর যদি রাইসা সুস্থ হয়ে যায় তাহলে তো জিসানের সাথে রত্নার বিয়ের স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না! শুধুমাত্র এই ভয়েই রত্না মিথ্যেটা বলেছিল। এখন সেটা ডক্টর নোভার কাছে স্বীকার করতে পারছে না সে। নোভা কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করল। তারপর বলল,” আচ্ছা থাক, বাদ দাও। কিন্তু যদি তোমার রাইসা আপা ম’রে যায় তাহলে কিন্তু জিসান ভাইয়ের ফাঁসি হবে। তাই ভেবে-চিন্তে সত্যি কথা বলো।”
রত্না হঠাৎ মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলল। নোভা উতলা কণ্ঠে বলল,” রত্না কি হয়েছে?”
রত্না কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,” জিসান ভাইয়ের দোষ নেই। আপার এক্সিডেন্টের জন্য আমি দায়ী। জিসান ভাই তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি এই ব্যাপারে কিছু জানেন না।”
চলবে
#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ৮
লিখা- Sidratul Muntaz
রাইসার এক্সিডেন্টের সম্পূর্ণ বিবরণ বিস্তারিত বলে দিল রত্না৷ তার স্বীকারোক্তি শুনে নোভা হতভম্ব। স্তব্ধ চোখে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করল,” এক্সিডেন্টটা তোমার জন্যই হয়েছে তাহলে হসপিটাল থেকে ফোন করে আমাকে মিথ্যে বলেছিলে কেন? মিস্টার জিসানকে ফাঁসিয়ে তোমার লাভটা কি হলো?”
রত্না নিশ্চুপ। দু’হাতে চোখের জল মুছল। নোভা ওর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল,” জিসান তোমার রাইসা আপাকে খু’ন করতে চেয়েছিলেন। আমরা যাতে পুলিশ এনে জিসানকে ধরিয়ে দেই এটাই তো চেয়েছিলে তুমি তাই না? এর মানে তুমি জিসানকে ফাঁসাতে চেয়েছো। কিন্তু কেন? জিসানের প্রতি কি তোমার ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ আছে?”
রত্না ভেজা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বলল,” রাগ আছে। তিনি আমার বাবাকে খু’ন করেছেন। এই কথা তো আমি আপনাকে সেদিনও বলেছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর আমি একদম একা হয়ে গেছি। যেকোনো সময় রাইসা আপা আমাকে মে’রে ফেলতে পারে। আমার এই ছোট্ট জীবনটার এখন কোনো মূল্য নেই। কারো কাছেই নেই।”
নোভা ভ্রু কুচকে ফারিহার দিকে তাকাল। ফারিহা অবাক হয়ে রত্নার কথা শুনছে। রত্না কাঁদতে কাঁদতে আরও বলল,” ছোটবেলায় আমি ছিলাম খুব অসহায় একটি মেয়ে। সেই ছোট্ট অসহায় মেয়েটিকে স্নেহ,মমতা, মর্যাদা দিয়ে এতোবড় যিনি করেছেন তার প্রতি আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার পরিমাণ প্রায় সীমাহীন। মানুষটি আমাকে জন্ম দিতে পারেননি।কিন্তু আমাকে আগলে রেখেছিলেন বাবার মতো। তাকে নিঃসন্দেহে আমি নিজের জন্মদাতার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ”
নোভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,” এর মানে তুমি তোমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এটা করেছো?”
রত্না মাথা নিচু করে হ্যাঁ বলল। মুখে কোনো জবাব দিল না। নোভা রত্নার কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল,” শোনো রত্না, মিথ্যে কথা আমাকে বলো না। আমার কাছে কিছু লুকালে তুমিই বিপদে পড়বে। তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে ক্লিয়ারলি সবকিছু বুঝিয়ে বলো। তুমি খুব ছোট্ট একটা মেয়ে। তোমার যদি ভুল থাকে তাহলে তোমাকে ক্ষমা করা হবে। জিসানের মতো এতো কঠিন শাস্তি তোমার হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে যদি আমরা বুঝতে পারি তোমার দোষ ছিল কিন্তু তুমি স্বীকার করোনি তাহলে কিন্তু অনেক বড় শাস্তি হবে তোমার।”
রত্না ভীত দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু চুপ করে রইল। নোভা বলল,” তোমার যদি মিস্টার জিসানের প্রতি এতোই রাগ থাকতো তাহলে তুমি তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে কেন? আমি যেদিন তোমাদের বাড়ি এসেছিলাম সেদিনও তুমি বলেছিলে জিসান তোমাকে ভালোবাসে। তোমাদের সম্পর্ক আছে। নিজের বাবার খু’নীর সাথে তুমি কেন সম্পর্ক রাখলে? তখন তো আমি জানতাম না যে তুমি আসাদ সাহেবের ছোট মেয়ে হও। এখন এটা জানতে পেরে আমার অবাক লাগছে। যে ছেলেটা তোমার বড় আপাকে ধোঁকা দিয়েছে, তোমার বাবাকে খু’ন করেছে তার সাথে তোমার সম্পর্ক থাকার তো প্রশ্নই আসে না।”
রত্না মুখ টিপে কেঁদে ফেলে বলল,” আমি ওইদিন মিথ্যে বলেছিলাম। জিসান ভাইয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ওইটা আমার ভুল ধারণা ছিল।”
নোভা মৃদু হাসল। রত্নার হাত দু’টো টেনে ধরে বলল,” তাহলে আমি যা ধারণা করেছি তাই ঠিক। তুমি যখন বুঝতে পারলে জিসান তোমাকে ভালোবাসে না তখন তাকে ফাঁসিয়ে দিলে। কিন্তু সে যদি তোমাকে ভালোবাসতো তাহলে তুমি কখনোই তাকে ফাঁসাতে না। নিজের বাবার খু’নীর সাথেই স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার করতে। ঠিক বলেছি না? তাহলে প্রতিশোধটা তুমি তোমার বাবার খু’নের জন্য নাওনি। প্রতিশোধ নিয়েছো কারণ জিসান তোমার ভালোবাসা রিজেক্ট করেছে।”
রত্না কি বলবে বুঝতে পারল না। তার অস্বস্তি আর লজ্জা হচ্ছে৷ নোভা বলল,” তুমি খুব ছোট্ট মেয়ে রত্না। দুনিয়ার জটিলতার কিছুই বোঝো না। যে ছেলে তোমার বাবাকে মে’রে ফেলতে পারে সে তোমাকেও মে’রে ফেলতে পারে। তাছাড়া মিসেস রাইসার এক্সিডেন্টের পেছনে জিসানের হাত না থাকলেও সে কিন্তু মনে মনে ঠিকই রাইসাকে খু’ন করতে চাইতো। এটা সে আমার কাছে স্বীকার করেছিল। যে একবার খু’ন করতে পারে সে বার-বার খু’ন করতে পারে। তুমি এমন একটা মানুষের সঙ্গে কিভাবে থাকবে? যদি সত্যিই মিস্টার জিসান তোমার বাবার হত্যাকারী হয় তাহলে তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। ”
রত্না আর্তনাদ করে বলল,” না!”
” তুমি বললেই তো নিয়ম বদলে যাবে না। যে পাপ করবে তাকে পাপের শাস্তি পেতেই হবে। আর তোমার বাবার খু’নের শাস্তি হোক এটা তুমি চাইছো না কেন?”
” কারণ জিসান ভাইয়া এই জঘন্য কাজটি করেছেন রাইসা আপার উপর ত্যক্ত হয়ে। তার খু’ন করার পেছনে কারণ ছিল।”
” অবশ্যই কারণ থাকবে। কেউ তো বিনা কারণে অথবা খুশিতে মানুষ খু’ন করে না। অতিরিক্ত রাগে, ক্রোধে আর বিরক্তিতেই করে। তবে খু’ন যে কারণেই করুক, শাস্তি তো একটাই। মৃত্যুদন্ড।”
রত্না মুখে হাত দিয়ে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। তার এখন আফসোস হচ্ছে, কেন সে খু’নের কথাটা বলে দিল? যদি সত্যি এখন জিসানের ফাঁসি হয়ে যায় তাহলে রত্না কি করবে? ফারিহা বলল,” কেঁদো না মেয়ে।তুমি আমাদের কাছে যা যা বলেছো পুলিশের কাছেও তাই বলবে। সবকিছু স্বীকার করবে৷ ভয় পাবে না একদম। আমরা তোমার পাশে আছি। জিসান তোমাকে কিছু করতে পারবে না।”
রত্না বলে উঠল বিগলিত স্বরে,” জিসান ভাইয়া আমাকে কখনোই কিছু করবেন না৷ তিনি আমাকে সবসময় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু এবার আমি নিজেই তাকে বিপদে ঠেলে দিলাম।”
নোভা সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বলল,” তুমি তো ভুল কিছু করোনি। সে তোমাকে যতই বাঁচাক আসল কথা হচ্ছে সে একটা ক্রিমিনাল।”
” জিসান ভাইয়া ক্রিমিনাল নয়। আমি আপনাদের বুঝিয়ে না বললে আপনারা বুঝবেন না। রাইসা আপার মাঝে অনেক গন্ডগোল আছে। সে মানুষকে ভয়ানক অত্যাচার করতে জানে। ছোটবেলা থেকে আমার সাথে তার রেষারেষির সম্পর্ক। আমি তার সাথে এক টেবিলে খেতে বসলেও সে টেবিলের সব খাবার ফেলে দিতো। একদিন আমরা বেড়াতে গেছিলাম। আর সাতবছর আগের কথা। রাইসা আপার সাথে একই গাড়িতে উঠেছি। কিন্তু রাইসা আপা আমাকে তার গাড়িতে বসতে দিচ্ছিল না৷ তাই বাবা তাকে একটা থাপ্পড় মারলেন। সেই রাগে রাইসা আপা ইচ্ছে করে গাড়ির ব্রেক ফেইল করে রেখেছিল। যাতে আমরা সবাই ম’রে যাই। ভাগ্য ভালো ছিল যে ড্রাইভার ব্যাপারটা আগেই বুঝতে পেরেছিল৷ তাই ওই যাত্রায় রক্ষা। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে। রাইসা আপা আমাকে বিভিন্নভাবে খু’ন করতে চেয়েছে। সে আমাকে সহ্যই করতে পারতো না।”
” এইসবের সাথে জিসানের খু’নের সম্পর্ক কি?”
” সম্পর্ক আছে। আসাদ আঙ্কেল জিসান ভাইয়ের সাথে গল্প করতে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু রাইসা আপার এটা পছন্দ ছিল না। সে সবসময় জিসান ভাইকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে রাখতে চাইতো। জিসান ভাই শুধু তার কথা শুনবে, তার সঙ্গে থাকবে এছাড়া পৃথিবীর অন্যকিছু নিয়ে চিন্তা করতে পারবে না৷ এমন একটা বিশ্রী ধ্যান- ধারণা নিয়ে চলতো সে। জিসান ভাইয়া খুব বেশি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। শেষে থাকতে না পেরে তিনি বাবাকে খু’ন করলেন। ভেবেছিলেন বাবা ম’রে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
নোভা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,” এইটা তো কোনো কথা হলো না। তোমার আপা না হয় অসুস্থ কিন্তু মিস্টার জিসান তো অসুস্থ নয়। তিনি এই কাজ কিভাবে করলেন? আমার মনে হচ্ছে তুমি ভুল জানো রত্না। জিসান অন্য কারণে আসাদ খানকে হত্যা করেছেন৷ এই কারণটা তিনি কাউকে বলছেন না। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”
” কিভাবে খুঁজে বের করবেন?”
” ওয়েট এন্ড সী।”
জিসানকে টানা তিনঘণ্টা পেটানো হলো। নাক,ঠোঁট ফেটে র’ক্ত বের হচ্ছে। তবুও সে একটা টু-শব্দ উচ্চারণ করল না। কন্সটেবল দু’জন হাঁপিয়ে উঠেছে। তারা আধঘণ্টার বিরতি নিল। আধঘণ্টা পর আবার মা’রা হবে। যতক্ষণ স্বীকার না করবে ততক্ষণ।
জিসান মেঝেতে শুয়ে আছে আধমরার মতো। দূর্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” পানি, প্লিজ পানি।”
নোভা বাহিরে থেকে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ভেতরের দৃশ্য দেখছিল। জিসানের কণ্ঠে পানির আর্তনাদ শুনে সে একগ্লাস পানি হাতে ছুটে এলো। ঝাপসা দৃষ্টিতে জিসান দেখল একটি মেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে পানির গ্লাস। জিসান মেয়েটিকে চিনতে পারছে না। মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না মেয়েটি আসলে কে? জিসান হাত বাড়ালো পানির গ্লাসটি নেওয়ার জন্য। নোভা সাথে সাথে হাত গুটিয়ে নিল। পানি ছুঁতে না দিয়ে শীতল স্বরে বলল,” আগে সত্যি বলতে হবে। তাহলেই পানি পাবেন।”
জিসানের বাড়িয়ে রাখা হাতটা মেঝেতে পড়ে গেল। তার এই মুহূর্তে মনে পড়েছে মেয়েটির পরিচয়। মিস নোভা! যিনি পেশায় একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। বড় বড় শ্বাস ছাড়তে লাগল জিসান। রুমের বাহিরে কাঁচের দেয়ালের ওইপাশে নজর রেখে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন অফিসার। তাঁরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ভেতরের দৃশ্য, শুনতে পাচ্ছেন কথাবার্তা। জিসানের নিশ্চুপতা দেখে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল নোভা,” কেন চুপ করে আছেন? কোনো লাভ নেই তো। রত্না আপনার বিরুদ্ধে সব সত্যি বলে দিয়েছে৷ আপনি আসাদ খানের খু’নী৷ এবার সেটা স্বীকার করুন। নাহলে রত্নার স্টেটমেন্টের উপর ভিত্তি করেই আমাদের স্টেপ নিতে হবে।”
জিসান ক্লান্ত স্বরে বলল,” আমরা গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। পানিটা দিন প্লিজ।”
নোভা বলল,” হা করুন।”
জিসান হা করল। নোভা উপর থেকে পানি ফেলতে লাগল। এমনভাবে ফেলল যেন শুধু গলাটুকু ভেজে। তারপর পানি ফেলা বন্ধ করেই বলল,” বাকিটা পাবেন সত্য বলার পর।”
জিসান হাঁফ ধরা কণ্ঠে বলল,” আমি.. আমার স্ত্রী রাইসাকে ভীষণ ভালোবাসতাম।
সেদিন খুব আনন্দের একটি দিন ছিল। জিসান বেতন পেয়েছে, ঈদের বোনাস পেয়েছে, বাড়ি ফেরার সময় মা-বোনের জন্য শপিং করবে। খুব শীঘ্রই তাদের সাথে দেখা করতে গ্রামের বাড়িতেও যাবে। আর কিছুদিন পর ঈদের ছুটি। জিসানের মা জেসমিন খাতুন তখন প্রায়সময় অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকেন। ফোন করলে দূর্বল কণ্ঠে কথা বলেন। আর প্রত্যেক বাক্যের শেষে অন্তত একবার হলেও বলেন, তিনি মা’রা যাবেন। এসব শুনতে শুনতে জিসান প্রায় ত্যক্তবিরক্ত। কিন্তু সেদিন সকালে মা ফোন করে আনন্দের কথা জানালেন। তাঁর নাকি আজ শরীর খুব ভালো লাগছে। তিনি জিসানের জন্য ভুনা খিচুরী আর পায়েস রান্না করবেন। জিসান যেন দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। এই কথা শুনে মুহূর্তেই মন ফুরফুরে হয়ে উঠল জিসানের। অনেক দিন পর প্রফুল্লতা অনুভব করল মনে। ভাবল হাফ ডে নিয়ে আজ দ্রুতই গ্রামে রওনা হবে। এই উদ্দেশ্যেই কড়া নাড়ল বসের অফিসরুমে। আসাদ খান তখন নিজের মেয়েকে নিয়ে লাঞ্চ করছেন৷ রাইসাকে দেখে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়ে গেল জিসান। মনে পড়ল প্রথমদিনের সেই অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা। শেষমেষ পায়ে ধরে নয়, পায়ে নেইল পলিশ লাগিয়ে মাফ চাইতে হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত রাইসা ঘটনাটি কাউকে জানায়নি। যে কারণে অবচেতন মনেই রাইসার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব হয় জিসানের। আসাদ সাহেব জিসানকে ডেকে বললেন,” এসো জিসান মাহমুদ, আমাদের সাথে লাঞ্চ করো।”
জিসান ভাবল হুট করে ঢুকে পড়ায় ভদ্রতা রক্ষার্থে তাকে ডাকা হচ্ছে৷ তাই জিসান প্রত্যাখ্যান করল,” আমি খেয়েছি আঙ্কেল। আপনারা শেষ করুন। আমি পরে আসবো।”
রাইসা ভ্রু কুচকে বলল,” বসকে কেউ আঙ্কেল ডাকে? আমার বাবা কোন সম্পর্কে আপনার আঙ্কেল হলো শুনি?”
রাইসার চটপটে প্রশ্নে জিসানের মুখ কাচুমাচু হয়ে গেল। চোখে-মুখে ইতস্ততা নিয়ে তাকাল আসাদ সাহেবের দিকে। আসাদ মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসছেন। বললেন,” আমার মেয়ে এসেছে তোমার কাছে। আমার জন্য ও কখনও অফিসে আসে না। তোমার সাথে কথা বলার জন্য এলো আর তুমিই চলে যেতে চাইছো! ভেতরে এসে বসো।”
জিসান অপ্রস্তুত গতিতে দরজা আটকে ভেতরে ঢুকল। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
” তাহলে আমাকে ডাকলেই হতো আঙ্কেল..স্যরি, স্যার!”
জিসানের ভীত দৃষ্টি রাইসার দিকে৷ রাইসা ফিক করে হেসে ফেলল। আসাদ সাহেব নিঃশব্দে হাসছেন। জিসানের বুক ধ্বক ধ্বক করতে লাগল বাপ-মেয়ের হাসি দেখে। রাইসা নামের মেয়েটার হাব-ভাব সুবিধার না। সেদিনের দূর্ঘটনাটি আবার আসাদ সাহেবকে বলে দিবে না তো? এজন্যই যদি জিসানকে ডাকা হয়! জিসানের মনে আতঙ্ক তৈরী হলো। রাইসা নামের অদ্ভুত মেয়েটিকে সে অসম্ভব ভয় পাচ্ছে। আসাদ সাহেব জিসানের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,” রাইসা এইবার ঈদে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। ভার্সিটির বন্ধুদের নিয়ে ট্যুর।”
জিসান ভীত মনে হাসার চেষ্টা করে বলল,” ভালো সংবাদ। ”
আসাদ ঘাড় নেড়ে বললেন,” অবশ্যই ভালো সংবাদ। কিন্তু আমি কখনও মেয়েকে একা ছাড়িনি। সবসময় বিশ্বস্ত একজনকে পাঠাতে হয় ওর সাথে। সেই বিশ্বস্ত একজনকে তো তুমি চেনোই। আমার ড্রাইভার। সবসময় রাইসাকে গাইড করে নিয়ে যায়। কিন্তু এবার রাইসা গাড়ি নিতে চাইছে না। তারা নাকি বাসে যাবে। ”
জিসান বাধ্য স্বরে বলল,” এটাও ভালো আঙ্কেল। সবসময় তো গাড়ি চড়তে ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে বাসে-ট্রেনেও চড়তে হয়।”
” হুম। কিন্তু আমার আদরের মেয়ে। একা যেতে দেই কিভাবে বলোতো? শুধু বন্ধুদের ভরসায় তো ছাড়া যায় না। বডিগার্ড একজন লাগে। যদি তোমার সমস্যা না থাকে, তুমি কি যাবে রাইসার সাথে?”
জিসানের বিষম উঠে গেল। আসাদ সাহেব বললেন,” পানি খাও, পানি খাও৷ আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি। সরাসরি তোমাকে যেতে বলছি না। সেই অধিকারও আমার নেই। ঈদের আনন্দ মাটি করে তোমাকে আমার মেয়ের সাথে যাওয়ার জন্য আমি জোর করতে পারি না। তবে রাইসা বলেছে তোমার সাথে একবার কথা বলতে। ওর সিক্সথ সেন্স নাকি বলছে তুমি রাজি হবে।”
আসাদ সাহেব কথাটা রসিকতা করেই বলেছেন।কিন্তু জিসানের বুঝতে বাকি নেই যে এবার কি হতে চলেছে। জিসান যেতে রাজি না হলে রাইসা তাকে ব্লেকমেইল করবে সেদিনের ঘটনা নিয়ে। না চাইতেও জিসানকে মাথা নাড়তে হলো। রাজি হতে হলো। কিন্তু আগে যদি জানতো ওই একটি ট্যুরের কারণে তার পুরো জীবন বদলে যাবে তাহলে সে কখনোই রাজি হতো না।
চলবে