#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ৯,১০
লিখা- Sidratul Muntaz
০৯
জিসান বাড়িতে ফোন করে মা আর বোনকে জানিয়ে দিল এইবার ঈদে সে বাড়ি ফিরতে পারবে না৷ অফিসের বসের সাথে ট্যুরে যেতে হবে। কিন্তু সত্যিটা হলো বস নয়, ট্যুরে যেতে হবে বসের মেয়ের সাথে। এই কথা মাকে জানাতে সংকোচ লাগল। জেসমিনও বলে দিলেন,” তোকে আমাদের কি প্রয়োজন? তুই এলেও যা না এলেও তা। এই কোরবানী আমরা মা-মেয়েতে আরামে পার করে দিতে পারবো৷ তুই অফিস বসের সাথে ট্যুরেই যা। আমাদের কথা তোর না ভাবলেও চলবে।”
মা নিশ্চয়ই অভিমান করে বলেছিলেন। কিন্তু জিসান আর কি করবে? তার হাত-পা বাঁধা। রাইসার সাথে যেতেই সে বাধ্য। মেয়েটা ব্লেকমেইল শুরু করলে আর মান-সম্মান বাঁচানোর উপায় থাকবে না। জীবন থেকে একটা দিন বাতিল করার যদি কোনো সুযোগ থাকতো তাহলে জিসান নিজের জীবন থেকে সেই দিনটিই সবার আগে বাতিল করতো যেই দিনে রাইসার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল! জিসান অসহায় স্বরে মাকে বলল,” তোমাদের জন্য অনেক কেনাকাটা করেছি। আমার এক ছোটভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো।”
জেসমিন কঠিন স্বরে বললেন,” তোর পাঠানো কিছু আমাদের দরকার নেই।”
জিসানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঈদ তো বছরে দুইবারই আসে। ঈদ ছাড়া এতো লম্বা ছুটি পাওয়াও যায় না। প্রত্যকবছর এই সময়ের অপেক্ষা করে কাটে। আর এইবার জিসান বাড়িই যেতে পারছে না। কপালে জুটেছে বডিগার্ডের ডিউটি। সবাই নিয়তি। মা ফোন রাখার পর জেসিও ফোন করল। অভিমানী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” ভাইয়া, তুমি কি সত্যি আসবে না?”
” নারে পাগলি। তোদের জন্য অনেক কিছু কিনেছি। চিন্তা করিস না, পাঠিয়ে দিবো।”
” লাগবে না অনেক কিছু। তুমি হলেই চলতো।”
জিসানের মনটা ক্রমশ বিষণ্ণ হতে লাগল। মা আর বোনকে বোঝাতেই পারল না সে কতবড় ফ্যাসাদে ফেঁসে গেছে!
রাইসা ট্যুরে যাওয়ার আয়োজন করল ঈদের দিন ঠিক রাতে। নয়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। রাতের বাস। ছাড়বে এগারোটায়। জিসান ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। রাইসা একটা ক্যাব নিয়ে এসেছে। জিসান মনে মনে ভাবল, এইটুকু রাস্তা যেতে ক্যাবের কি দরকার? সে হলে রিকশাই নিয়ে নিতো। অবশ্য বড় বড় মানুষের বড় বড় ব্যাপার। রাইসা গম্ভীর স্বরে বলল,” দাঁড়িয়ে থাকবেন না। ভেতরে আসুন।”
জিসান ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার জন্য দরজা খুলতে চাইল। রাইসা বাঁধ সেধে বলল,” সমস্যা কি? পেছনে জায়গা থাকতে সামনে বসছেন কেন?”
জিসান কাঁচুমাচু মুখে বলল,” আপনার ফ্রেন্ডরা যদি আসে?”
” যখন আসবে তখন দেখা যাবে। আপনি পেছনে আসুন।”
জিসান পেছনে এসে রাইসার পাশেই বসল। রাইসা সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,” চলুন মামা। টাঙ্গাইলের মধুপুর।”
জিসান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” টাঙ্গাইল কেন? আমাদের না বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার কথা?”
” ডেস্টিনেশন চেঞ্জ হয়েছে। আপনাকে বলা হয়নি।”
” আঙ্কেল মানে স্যার এই খবর জানেন তো?”
” না। জানেন না। আপনার ফোনটা দিন। জানিয়ে দিচ্ছি।”
জিসান সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আমার ফোন কেন?”
” আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই তাই। এবার দিন।”
জিসান মোবাইল বের করে দিল। রাইসা মোবাইলটা সুইচড অফ করে নিজের ব্যাগে ভরে রাখল। জিসান থতমত খেয়ে বলল,” এটা কি করলেন? আমার ফোন!”
” আপনার ফোন আমি খেয়ে ফেলবো না। আমার ব্যাগেই থাকবে। আপনি সারা রাস্তা আমার পাশে বসে ফোন টিপবেন আর আমি বোর হবো সেটা হচ্ছে না।”
” কিন্তু আমি তো ফোন টিপছি না।”
” তবুও আমার কাছেই ফোন থাকবে।”
জিসান কিছু বুঝতে পারছে না। তার অদ্ভুত দমবন্ধকর একটা অনুভূতি হচ্ছে। রাইসা প্রশ্ন করল,” আচ্ছা আপনার পরিবারে কে কে আছে?”
” মা আর বোন।”
” বাবা নেই?”
” উহুম।”
” আমারও মা নেই।”
” জানি।”
রাইসা চোখ খুলে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল,” আপনি আমার ব্যাপারে আর কি কি জানেন?”
” অনেক কিছুই জানি। আসাদ আঙ্কেলের থেকে শুনেছি।”
” বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করেন তাই না?”
” জ্বী করেন।”
” আপনিও কি বাবাকে ততটাই পছন্দ করেন?”
” জ্বী অবশ্যই করি।”
” বাবার কথায় কি আপনি যেকোনো কাজ করতে পারবেন?”
” নিঃসন্দেহে।”
“বাহ, বাবার প্রতি আপনার এতো ভক্তি?”
” ভক্তি কেন থাকবে না? আমার মতো সামান্য একটি ছেলেকে তিনি অনেক গুরুত্ব দেন। আমার জন্য অনেক করেছেন। আচ্ছা আপনার বন্ধুরা কখন আসবে?”
রাইসা রাগী গলায় বলল,” কেউ আসবে না।”
” আসবে না কেন?”
” এমনি…”
” তাহলে আমি কেন এলাম?”
” আশ্চর্য! আপনি কি আমার বন্ধুদের জন্য এসেছেন?”
” না৷ আমি তো আপনার জন্যই এসেছি। কিন্তু ট্যুরে কি যাওয়া হচ্ছে না তাহলে?”
” এটাই ট্যুর। দু’জন মানুষ মিলে কি ট্যুর হতে পারে না?”
জিসান দশ নম্বর বিপদ সংকেত শুনতে পাচ্ছে। তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস। এই মুহুর্তে আসাদ আঙ্কেলকে ব্যাপারটা জানাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু জিসানের ফোন সিস্ট করে রাখা হয়েছে। সে কিভাবে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করবে? ভয়ংকর অবস্থা!
শেষপথে গাড়ি থামানো হলো। সামনে সরু গলি। আর আগানোর উপায় নেই। রাইসা ড্রাইভারকে বলল,” সমস্যা নেই মামা। আমরা এখানেই নেমে যাবো।”
জিসান কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নামল। রাইসা নামতে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেল। জিসান দ্রুত এসে রাইসাকে ধরে বলল” ঠিকাছেন ম্যাডাম?”
” একদম ঠিক নেই। আমার জুতো ছিঁড়ে গেছে। পায়ে ব্যথা হচ্ছে।”
” কই দেখি।”
” আপনি কি ডাক্তার? আমার পা দেখে আপনার কাজ নেই। হাঁটবো কিভাবে সেটা বলুন।”
” আমিও তো বুঝতে পারছি না। একটা রিকশা পেলে ভালো হতো। কিন্তু রিকশাও নেই। এই মাঝরাতে কিছুই পাওয়া যাবে না মনে হয়।”
” আমি কি তাহলে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো?”
জিসান পায়চারী করতে করতে বলল,” বুঝতে পারছি না।”
রাইসা রাগী রাগী চেহারায় তাঁকাল,” কেন বুঝতে পারছেন না?”
জিসানের বিপন্ন দৃষ্টি। কি করবে সে? রাইসা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে হাঁটতে লাগল। জিসান পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করছে। হঠাৎ বুকে সাহস যুগিয়ে বলল,” ম্যাডাম, আপনার মনে হয় হাঁটতে বেশি কষ্ট হচ্ছে। কিছু মনে না করলে আমি কি আপনাকে নিয়ে তুলে নিয়ে যেতে পারি?”
” তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তাই করুন প্লিজ।”
জিসান নিজের ব্যাগটা ভালো করে কাঁধে নিল। রাইসার হ্যান্ডব্যাগটাও নিল। এই অবস্থাতে রাইসাকে কোলেও নিল। রাইসা পথের নির্দেশনা দেখিয়ে দিল। সেই অনুযায়ী তারা একটা গেস্ট হাউজে পৌঁছালো। রাইসা বলল,” এটা হচ্ছে আমাদের বহু পুরনো গেস্ট হাউজ। মা যখন ছিল, আমরা প্রত্যেক ছুটিতে এখানে বেড়াতে আসতাম। খুব মজা হতো জানেন? কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আর কখনোই এখানে আসেননি। তবে আমি আসি। একা একা। এই প্রথম কাউকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। দুইদিন আমরা এখানেই থাকবো। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। সকালে আমরা ঘুরতে বের হবো। আপনার ভালো লাগবে।”
জিসানের ভয় লাগছে। গা কেঁপে ওঠার মতো ভয়। সম্পূর্ণ একা একটা বাড়িতে সে আর মিস রাইসা থাকবে তাও দুইদিন। এটা কি ঠিক? আসাদ আঙ্কেলকে ব্যাপারটা জানাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু জিসানের মোবাইল তো রাইসার কাছে। আশ্চর্য! গেস্ট হাউজে ঢোকার সাথে সাথে রাইসার পা ঠিক হয়ে গেছে। সে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। জিসান জিজ্ঞেস করল,” এখানে আর কেউ থাকে না?”
” অবশ্যই থাকে। কেউ না থাকলে ঘর-বাড়ি, ঝোপঝাড় পরিষ্কার থাকতো কি করে বলুন? তবে আমি সবাইকে তাড়িয়ে দিয়েছি৷ এই দুইদিন এইখানে কেউ আসবে না।”
জিসান কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কেউ আসবে না কেন?”
রাইসা জবাব না দিয়ে অন্য প্রশ্ন করল,” আপনার কি ক্ষিদে পেয়েছে?”
” না।”
” বলেন কি? আমার তো মারাত্মক ক্ষিদে পেয়েছে। শুনুন আমি এখন ফ্রেশ হয়ে খেতে বসবো। আপনি না খেলেও আমার সামনে বসে থাকবেন। আমি খেতে খেতে আপনাকে কাল সারাদিনের শিডিউল বলবো।”
রাইসা এসব বলতে বলতে ওয়াশরুমে চলে গেল। জিসান অন্য একটা রুমে ঢুকল। জায়গাটা বেশিই নির্জন। একদম গ্রামের পরিবেশ। নিশুতি রাতে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মনে হলো, আশেপাশে কোথাও তক্ষকও ডাকছে। ব্যাঙের আওয়াজও পাওয়া গেল। বৃষ্টি হয়েছিল নাকি? পরিবেশ শীতল লাগছে। জিসান মনে মনে ভাবছে, সে কোথায় ফেঁসে গেল? রাইসা নামের মেয়েটা তার সাথে এই উদ্ভট আচরণ কেন করছে? মেয়েটা কি চায়! হঠাৎ পেছন থেকে রাইসা ডাকল,” শুনুন, আমাকে কেমন লাগছে?”
জিসান পেছনে ঘুরে হতভম্ব হয়ে গেল।
চলবে
#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ১০
লিখা- Sidratul Muntaz
রাইসার গায়ে কালো শাড়ি, কপালে কালো টিপ, হাত ভর্তি কালো চুড়ি আর খোলা চুল। সবকিছু মিলিয়ে তাকে চূড়ান্ত আবেদনময়ী লাগছে। ভোর সাড়ে তিনটা বাজে ক্লান্ত শরীর নিয়ে জার্ণিং করে এসে কোনো মেয়ে বুঝি এইভাবে সাজগোজ করে? জিসানকে বিমূঢ় বনে যেতে দেখে রাইসা তার প্রশ্নটা পুনরায় করল,” কি হলো বলছেন না কেন? আমাকে কেমন লাগছে? শুধু কি তাকিয়ে থাকবেন নাকি কথাও বলবেন?”
জিসানের রীতিমতো মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। পরীর চেয়েও দশগুণ সুন্দরী একটা মেয়ে যদি সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে প্রশ্ন করে তাহলে যে কারো মাথা ঝিমঝিম করা উচিৎ। জিসান কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” আপনি এতো সেজেছেন কেন?”
এই প্রশ্নে রাইসা যথেষ্ট বিরক্ত হলো। হাত ভাজ করে জিসানের সামনে দাঁড়ালো। ভ্রু কুচকে বলল,” আচ্ছা, আপনি এতো বোকা কেন?”
জিসান পানির তৃষ্ণা অনুভব করছে। গলা শুকিয়ে খা খা অবস্থা। খুব কষ্টে জীভ নেড়ে জিজ্ঞেস করল,” জ্বী, মানে?”
” আপনি কি কিছুই বোঝেন না? আমি যে আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করি এটা কি আপনি এখনও বুঝতে পারেননি? সব কি স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে?”
জিসান ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে রইল। একটু পর বলল,” আমি পানি খাবো।”
রাইসা সর্বোচ্চ বিরক্তি নিয়ে পানি আনতে গেল। এক গ্লাস পানি জিসানের হাতে ধরিয়ে বলল,” নিন,খান।”
জিসান ঢকঢক করে পানি খেল। ও আল্লাহ, এতো ভয় সে জীবনেও পায়নি। এর চেয়ে যদি মেয়েটা বলতো, আমি আপনাকে খু’ন করতে চাই তাহলে বোধহয় সে কম ভয় পেতো। জিসান পানি শেষ করতেই দেখল রাইসা তার বিছানায় বসে আছে। পায়ের উপর পা তুলে রেখেছে। তার বাঁকানো কোমড় থেকে শাড়ি আস্তরণ সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে মেদহীন, সুন্দর পেট। জিসানের হাত থেকে গ্লাস পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। রাইসা শীতল কণ্ঠে বলল,” অনেক আঁতলামি হয়েছে। এখন আমার পাশে এসে বসুন।”
জিসান গেল না। সে তড়িৎ চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলল। চশমা ছাড়া দূরের জিনিস সে স্পষ্ট দেখতে পায় না। আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আপাতত নেই। জিসান থমথমে স্বরে বলল,” ম্যাডাম, আপনি প্লিজ এখান থেকে চলে যান।”
রাইসা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল,” হোয়াট? একটা মেয়ে নিজে থেকে আপনাকে প্রপোজ করছে আর আপনি তাকে চলে যেতে বলছেন? হাউ রুড!”
জিসান মাথা নিচু করে বলল,” আপনি না গেলে আমিই চলে যাবো।”
” কোথায় যাবেন?”
জিসান কাটা কাটা স্বরে বলল,
” জানি না। কিন্তু চলে যাবো এটা শিউর। আমি যা বলি তাই করি। ”
রাইসা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে৷ জিসান একটু কঠিনভাবেই বলল,” আমি যদি আগে আপনার মনের খবর বুঝতে পারতাম তাহলে আমি কখনোই আপনার সাথে আসতাম না।”
রাইসা চুপ করে বসে রইল কয়েক সেকেন্ডস। তারপর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। জিসান বলল,” আমার ফোনটা আপনার কাছে আছে। পারলে দিয়ে যাবেন।”
রাইসা একটু পরেই এসে ফোন দিয়ে গেল। সারারাত আর জিসানের ঘুম হলো না। একবার ভাবল আসাদ আঙ্কেলকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাবে৷ তারপর চিন্তা করল, কি দরকার? মেয়ের প্রতি বাবার বিশ্বাস নষ্ট হবে। তার চেয়ে ভালো জিসান রাইসাকেই বোঝাবে। সে যেটা করতে যাচ্ছিল সেটা জীবনের চূড়ান্ত ভুল কাজ। রাইসার বয়স তো কম নয়। কমপক্ষে উনিশ কি বিশ হবেই। পনেরো কিংবা ষোল হলেও একটা কথা ছিল। ওই বয়সে মানুষ ভুল করে। কিন্তু রাইসার বয়সী মেয়ের তো এতোবড় ভুল করা সমীচীন নয়। পরদিন সকাল হলো। জিসান সূর্যোদয়ের পর একটু ঘুমিয়েছিল। তার ঘুম ভাঙল এক বয়স্ক লোকের কর্কশ ডাকে। ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে জিসান প্রশ্ন করল,” কে?”
” আমি জামাল মিয়া। এই গেস্টহাউজের কেয়ার টেকার। উঠে পড়েন। আম্মাজান আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে বসে আছেন।”
” আপনার আম্মাজান আমার জন্য নাস্তা নিয়ে বসে থাকবেন কেন?”
এই সামান্য কথায় তিনি এতো হাসতে লাগলেন! জিসান কোনো ক্ষিদে অনুভব করল না। মাথা ভরা দুশ্চিন্তা নিয়ে খাওয়া যায় না৷ তার এই মুহূর্তে ঢাকা ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। চাকরিটা মনে হয় আর করা হবে না। জিসান বলল,” আমার ক্ষিদে নেই। আপনি যান।”
জামাল চলে গেলেন। একটু পর রাইসা উঠে এলো। বিষণ্ণচিত্তে বলল,” আমার উপর রাগ করে আপনি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন এটা ঠিক না।”
জিসান চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিল,” আপনার সাথে রাগ করে আমি খাওয়া বন্ধ করবো কেন? আপনি কে?”
” ঠিক। আমি কেউ না। তাহলে আপনি খেতে আসুন।”
” শর্ত আছে।”
” কি?”
” খাওয়া শেষ করেই আমরা ঢাকায় রওনা হবো। দুইদিন যে থাকার প্ল্যান ছিল সেটা ক্যান্সেল।”
” ঠিকাছে।”
গাড়িতে উঠেও জিসান উপলব্ধি করল রাইসার মনখারাপ। চোখমুখ ফুলে আছে। ফরসা চেহারায় লালচে আভা। হয়তো সারারাত কেঁদেছে। জিসানের শক্ত প্রত্যাখ্যান সে আশা করেনি৷ সেজন্যই হয়তো এই অবস্থা। আচ্ছা, একটা মেয়ে যদি একটা ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে ছেলেটা পারে বার-বার মেয়েটার পেছনে ঘুরতে। এই একই কাজ মেয়েরা কখনও পারে না। তারা সারাজীবন কেঁদে ভাসাবে। তাও কখনও আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ছেলেটির পেছন পেছন ঘুরবে না।
গাড়ি থামল ঠিক রাইসাদের বাড়ির গেইটে। জিসানও সেখানেই নামল। তার আসাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। তিনি ফোন করে জিসানকে বলেছেন সরাসরি দেখা করতে। টাঙ্গাইলের যে অঞ্চলে তারা ছিল সেখানে নেটওয়ার্কের অনেক সমস্যা। তাই যোগাযোগও করা যায়নি। আসাদ সাহেব চিন্তিত। গাড়ি থেকে নামার সময় রাইসা বলেছিল,” আপনার হোয়াটসঅ্যাপটা একবার চেক করবেন প্লিজ।”
কথাটা বলেই রাইসা ভেতরে চলে গেছে। জিসান সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করল। রাইসার ম্যাসেজ-
” সবসময় যেটা চেয়েছি সেটাই পেয়ে এসেছি তো, তাই না পাওয়ার দুঃখ কেমন সেটা জানতাম না। আজ আপনি আমাকে সেই না পাওয়ার দুঃখের সাথে পরিচয় করিয়েছেন৷ এতোটা তীব্র কষ্ট আমি আগে কখনও পাইনি। আসলে আমারই ভুল। আপনাকে আমি আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতোই ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি আমার ভুল ধারণাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। গতরাতে আপনার আচরণে আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছি তার চেয়েও বেশি আফসোস করেছি। কারণ আপনার মতো একজন মানুষকে আমি কখনও পাবো না। হয়তো এটাই আমার নিয়তি। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব বাজে মেয়ে ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার ভালোবাসায় কোনো কলুষতা ছিল না। হয়তো প্রকাশের পদ্ধতিটা ভুল ছিল। কিন্তু এই ভুল না হলে তো আমি আপনাকে চিনতেও পারতাম না। আপনার প্রতি আমার ভালোলাগার পারদ এতো গাঢ়ও হতো না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। যদি জানতাম আপনি এতোটা বিরক্ত হবেন তাহলে আমি কখনোই এই কাজটি করতাম না। আবারও বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু আফসোস একটাই যে আমি আপনাকে কোনোদিন পাবো না।”
লেখাগুলো পড়েও জিসানের মনে কোনো অনুভূতির সঞ্চার হলো না। সে এগিয়ে গেল আসাদ সাহেবের রুমের দিকে। আসাদ জিসানের অপেক্ষাতেই ছিলেন। জিসান ভেতরে ঢুকে সালাম দিল। আসাদ সালামের জবাব নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,” তোমরা সারারাত কোথায় ছিলে?”
জিসান কোনোকিছু গোপন করল না। সত্যিটাই বলে দিল। একটা মিথ্যে বললে আরও হাজারটা মিথ্যে বেরিয়ে আসে। এর চেয়ে সত্যি বলাই সহজ। সবকিছু শোনার পর আসাদ ঘাড় নেড়ে বললেন,” রাইসা যখন তোমাকে সাথে নিতে আমার অফিসে এসেছিল তখনই আমি ব্যাপার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তবুও আমি তোমাকে ওর সাথে পাঠিয়েছি। কেন বলতে পারবে?”
” কেন আঙ্কেল?”
” কারণ আমি জানতাম তুমি আমাকে সত্যি কথাই বলবে। তোমার উপর ভরসা ছিল। এখন মনে হচ্ছে, ভরসা করে আমি ভুল করিনি।”
জিসানের ওই মুহূর্তে মনে হলো, ভাগ্যিস সে সত্যিটা বলেছিল। ভাগ্যিস! আসাদ একটু ভাবুক স্বরে বললেন,” মা মরে যাওয়ার পর থেকে আমার রাইসা একেবারেই ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গেছে। যে মেয়ে সারাক্ষণ একা একা থাকতে চায় সে হঠাৎ বন্ধুদের নিয়ে হৈহৈ করে ট্যুরে যাবে এই কথা আমিও বিশ্বাস করিনি। তবে এই প্রথমবার রাইসা কাউকে পছন্দ করেছে। এটা দেখে আমার সত্যি ভালো লাগছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, রাইসার পছন্দের মানুষটা সঠিক। সে আমার নিজেরও খুব পছন্দের।”
জিসানের লজ্জা লাগছে। আসাদ আঙ্কেল তার প্রশংসা করছেন। আসাদ বললেন,” আমার মাথায় এমন কিছু পরিকল্পনা আগেই ছিল। এই নিয়ে তোমার সাথে আমি কথা বলবো ভেবেছিলাম। যদি আমি না থাকি, আমার মেয়েটা পৃথিবীতে একা হয়ে যাবে। তখন ওকে দেখে রাখার জন্য ভরসাযোগ্য কাউকে তো দরকার। আমার মনে হয় তোমার চেয়ে ভরসাযোগ্য আমি কাউকে পাবো না। জিসান, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো?”
জিসান বিব্রত কণ্ঠে বলল,” জ্বী।”
আসাদ নিঃসংকোচে প্রশ্ন করলেন,” তুমি কি রাজি?”
জিসানের মনে হলো কাজী সাহেব তার সামনেই বসে আছেন। তাকে এখনি কবুল বলতে হবে। আর কবুল বলা মানেই বিয়েটা হয়ে যাওয়া। কি অদ্ভুত ব্যাপার! মা-বোন ছাড়া তার বিয়ে হবে এটা সে জীবনে ভাবেওনি।
জিসান চলে যাওয়ার সময় রাইসা একটা মেয়েকে পাঠালো। সম্ভবত বাড়ির কাজের মেয়ে। কারণ মেয়েটির চেহারার সাথে আসাদ সাহেব অথবা রাইসার কোনো মিল নেই। মেয়েটি জিসানকে বলল,” ভাইজান, লাঞ্চ করে যান। রাইসা আপা আপনাকে লাঞ্চ করে যেতে বলেছে।”
জিসানের লাঞ্চ করার কোনো ইচ্ছে নেই। তবুও সে বলল,” তোমার রাইসা আপাকে ডাকো।”
রাইসা আড়াল থেকে ওদের আলাপ শুনছিল। জিসান এই কথা বলা মাত্রই সে দেয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। রাইসা বের হওয়ার সাথে সাথেই মেয়েটা চলে গেল। জিসান তখনও জানে না, এই মেয়েটিই আসাদ সাহেবের দত্তক নেওয়া মেয়ে রত্না। রাইসার চেহারায় মনখারাপ স্পষ্ট। জিসান একবার ভাবল বলে দিবে যে রাইসার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। রাইসা স্নাতক পাশ করার পর পরই বিয়েটা হবে৷ কিন্তু বলতে পারল না। মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। আরও কিছুদিন কষ্ট পাক। কষ্ট পেলে তো তার কোনো ক্ষতি হবে না। যে কোনোদিন কষ্ট পায়নি তার একটু কষ্ট পাওয়া শেখা উচিৎ। রাইসা মাথা নিচু করে জিসানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জিসান কি বলতে চায় সেটা শোনার জন্য তাকে খুব উদগ্রীব দেখাচ্ছে। জিসান বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলল না৷ শুধু বলল,” ভালো থাকবেন।”
এইটুকু বলেই জিসান চলে গেল। রাইসার বামচোখ থেকে দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।
চলবে