অন্তর্দহন (সিজন-২) পর্ব- ১

0
3664

অন্তর্দহন (সিজন-২)
পর্ব- ১
লেখিকা-অলিন্দ্রিয়া_রুহি

“আমি আমার স্বামীকে প্রায়ই দেখতে পাই। না স্বপ্নে না, সরাসরিই… সে আমাকে দেখা দেয়, কিন্তু আমার কাছে আসে না, কথাও বলে না। দূর থেকে আমাকে দেখে চলে যায়.. সবাই বলে সে মৃত। ও নাকি মারা গেছে!! কিন্তু আমি জানি ও মরে যায়নি, ও বেঁচে আছে। আমার জন্য ফিরেও এসেছে। শুধু অভিমানের কারণে আমার সামনে ও আসে না… কারণ কথা ছিল, আমরা একে অপরের জন্য অপেক্ষা করব, সেখানে আমি ওর মৃত ঘোষণা শোনার পর পরিবারের চাপে পড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি! ওর অভিমান করাটা স্বাভাবিকই… আচ্ছা আংকেল, আপনি কী ওকে একটু বলবেন যেন আমার সঙ্গে অন্তত কথাটা বলে.. আমি ওকে বুঝিয়ে বলব সবকিছু। ওকে আমি বলতে চাই, আমি এখনো ওকেই ভালোবাসি। ও যে মিশে আছে আমার আত্মায়.. কী করে ভুলে যাই আমি?”
বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলল পড়ন্ত। ডক্টর শফিক বিব্রতবোধ করলেন। মেয়েটার কান্না তার অন্তরে দাগ কাটছে। কত রোগী দেখেছে এতদিনের পেশায়,কিন্তু কেউই এভাবে আবেগজনিত কারণে কাঁদেনি। পড়ন্ত ক্ষণিকের ভেতরই নিজেকে সামলে নাক টেনে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-“আর আপনি তন্ময় কে বলে দিন, উনি যেন আমাকে আর বিয়ে করতে না আসে। উনার কারণে আজ আমার অভ্র ফিরে এসেও আমার সাথে কথা বলছে না! উনার প্রতি আমার অনেক রাগ.. পৃথিবীতে কী মেয়ের অভাব? আমাকেই বিয়ে করতে হবে?” পড়ন্তর কণ্ঠ বেয়ে রাগ ঝরে পড়ল। ডক্টর শফিক আবারও বিব্রতবোধ করলেন। মেয়েটি কত অবলীলায় সব বলে যাচ্ছে! সে একজন ডক্টর হয়েও তার ভেতরের জড়তা এখনো কাটেনি। তার উপর সম্পর্কে এই মেয়ে ওর ভাবী হয়। তন্ময় আর শফিক অনেক আগে থেকেই একে অপরের বন্ধু…

শফিক বলল,
-“মানসিক রোগে ভোগা সবারই এরকম মনে হয় ভাবী। আপনি একটু দু-চোখ মেলে বাস্তবতা দেখুন। একদিন, দুদিন নয়, চারটা বছর হয়ে গেল, মিস্টার অভ্রর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিমেল শিউরলি ইনফর্ম করেছে, অভ্র মৃত। পানিতে ডুবে মরে গিয়েছে। তার লাশটাও ডুবুরিরা খুঁজে পায়নি। স্রোতে কোথায় ভেসে গিয়েছে কে জানে! আর আপনি আজ চার বছর পর এসে বলছেন, মিস্টার অভ্র জীবিত? এবং সে এসেছে… আপনাকে দেখা দিচ্ছে! বিষয়টি কেউই বিশ্বাস করবে না। আচ্ছা মিস্টার অভ্র যদি সত্যিই এসে থাকে তাহলে শুধু আপনাকে কেন দেখা দিচ্ছে? উনার বাবা-মা কে কেন দেখা দিচ্ছে না? আর কেনই বা সে পরিবারে একজন সুস্থ ব্যক্তির ন্যায় ফিরে আসছে না? এর কোনো জবাব আছে আপনার কাছে? বলুন।”
পড়ন্ত চুপ করে রইলো। কথাগুলো তাকেও ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। শফিক ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে বলল,
-“আমি বলছি এর উত্তরটা.. এর একটাই যুক্তিযুক্ত উত্তর, আপনার ভ্রম সবটা। অভ্র বলতে এই পৃথিবীতে আপনার চেনা – জানা আর কেউ নেই। যে ছিল, সে মারা গিয়েছে এবং এটা আপনি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। তাই আপনার অবচেতন মন একটা গল্প বানিয়ে নিয়েছে নিজে নিজে। আপনার নিজস্ব ধারণা অভ্র ফিরে এসেছে এবং আপনি তাকে মনের চোখ দিয়ে দেখছেনও! শুনুন, এটা ভালোবাসার টান বৈ আর কিছুই না। তন্ময় আমার বন্ধু বলে বলছি না, একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, আপনার নিজস্ব দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসুন। বাস্তব দেখুন আর জীবনকে আরও একটি সুযোগ দিন। তন্ময় খুবই ভালো ছেলে। আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মান এবং মর্যাদা দেবে। আপনার যত সময় লাগে ওর কাছে চেয়ে নিন, তবুও লাইফটাকে এভাবে নষ্ট করবেন না প্লিজ।”
হঠাৎ পড়ন্ত রেগে গেল। তার চোখমুখ শক্ত আকার ধারণ করল। এখানে তন্ময়ই তাকে নিয়ে এসেছে। তার সমস্যাগুলো শফিকে খুলে বলতে বিনীত ভাবে অনুরোধ করায় পড়ন্ত সবকিছু বলেছে। আর এই ছেলে তাকে সমাধান দেওয়ার বদলে উল্টো উপদেশ কপচাচ্ছে! পড়ন্ত ধরাম করে উঠে দাঁড়াল।
-“আমি বাসায় যাবো।”
শফিক মৃদু শ্বাস ফেলে টেবিলের উপর থাকা একটা ডোর বেলের বাটন টিপতেই চিন্তিত মুখের তন্ময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।
-“ভাবী বাসায় যেতে চাইছে।”
-“তোমার সব কথা শেষ পড়ু?” প্রশ্ন করল তন্ময়।
পড়ন্ত রাগে ফুঁসে উঠে বলল,
-“খবরদার…এই নামে আমাকে শুধু অভ্রই ডাকে এবং ডাকবে। আর কেউ ডাকবে না। আপনি তো ভুলেও না। আপনি আমার জীবনে কাল হয়ে এসেছেন। আমার পরিবারকে পটিয়েছেন। আমাকেও পটাতে চাইছেন। আমি তো একমুহূর্তে আপনার জালে পা ফেলতেই যাচ্ছিলাম! ভাগ্যিস আমার অভ্র সঠিক সময়ে চলে এসেছে… আমার অন্ধ চোখ খুলে দিয়েছে।”
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে পড়ন্ত। তার যাওয়ার পানে নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে রইলো তন্ময়। শফিক বলে উঠল,
-“সময় দে দোস্ত। মানসিক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে ভাবী। তাকে সময় দে, নিজেকেও সময় দে। যেহেতু মানসিক ভাবে আনস্টেবেল একজন মেয়েকে ভালোবেসেছিস, সেহেতু ধৈর্য এবং অপেক্ষা তো করতেই হবে!”
তন্ময় কথার প্রত্যুত্তরে একটা হালকা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে হাত ইশারায় বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো। পড়ন্ত নিকষ কালো আকাশের তলে দাঁড়িয়ে…
ঠান্ডা বাতাস বইছে। কেমন একটা বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ! পড়ন্ত নাক টেনে খানিকটা সোঁদা গন্ধ নিজের ভেতর টেনে নিতেই একটা চিরপরিচিত স্মেল পেল সেই সাথে। ঝট করে চোখ খুলে তাকাল পড়ন্ত। বিচলিত হয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। এই স্মেল, এই গন্ধ, তার বড্ড চেনা.. অভ্র! অভ্র তার আশেপাশেই আছে। কিন্তু কোথায়? পড়ন্ত উন্মাদের ন্যায় এদিক ওদিক তাকিয়ে অভ্রকে খুঁজতে লাগল। এরই ভেতর তন্ময় বাইরে এসে পড়ন্তকে অস্থির চিত্তে কিছু খুঁজতে দেখে নিজেও উদগ্রীব হয়ে উঠল।
-“কী খুঁজছো তুমি? কী হয়েছে পড়ন্ত?”
ছলছল চোখে পড়ন্ত তাকাল।
-“অভ্র..আমার অভ্র আছে। এখানেই আছে। আমি ওকে অনুভব করতে পারছি। কিন্তু ও আসছে না আমার সামনে। ও রাগ করেছে। আর সেটা আপনার জন্য..” মুহূর্তেই পড়ন্তর চোখমুখ পাল্টে ভয়ংকর রাগী হয়ে উঠল। যেন সুযোগ পেলেই তন্ময়কে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে! বিচলিত বোধ করল তন্ময়। এগিয়ে গিয়ে পড়ন্তকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
-“ঠিক আছে। আমরা খুঁজে দেখবো, আসো খুঁজি..” এই এক কথায় শান্ত হয়ে গেল পড়ন্ত। লাল চোখজোড়ায় পানি চিলিক দিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। তন্ময়ের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার প্রিয়তমার চোখ আজ অন্য কাউকে খোঁজে! যার চোখে সে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিল, সেই চোখে ভালোবাসাটা আছে ঠিকই, শুধু সেটা অন্যের জন্য! তার জন্য ছিঁটেফোঁটাও না!
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে পড়ন্তকে এদিক ওদিক খুঁজে দেখালো তন্ময়। কিছুই না পাওয়ার পর পড়ন্ত হতাশ, তন্ময়ের মুখে হাসি। একদিন না একদিন নিজের ভ্রমের কাছে নিজেই হেরে যাবে পড়ন্ত। সেদিন বুঝবে অভ্র বলে আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে….

-“কেউ নেই, বলেছিলাম!”

পড়ন্ত জবাব দিলো না। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। সে সত্যি ঘ্রাণ পেয়েছিল অভ্রের। অভ্রর বুকে কত রাত মিশে ঘুমানো হয়েছে! সেই স্মৃতি আজও চোখের সামনে তরতাজা… আর সে কী-না ভুলে যাবে অভ্রর শরীরের মাতাল করা গন্ধ? এ কী আদৌও সম্ভব?

-“কথা বলছো না কেন?”

পড়ন্তকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে তন্ময়। পড়ন্ত সে কথার জবাব না দিয়ে বলল,
-“বাসায় যাবো। রিকশা ডাকুন।”
-“আচ্ছা।”

মিনিটের মাথায় রিকশায় উঠে বাড়ির দিকে রওনা হয় তারা। যাওয়ার আগে আর একটিবার পেছন ফিরে তাকায় পড়ন্ত। গেটের পেছনে যে ঝোপটা অবহেলায়, অযত্নে বেড়ে উঠেছে, অন্ধকারে সেদিকে চোখ যায় না। গেলে দেখতে পেতো, কেউ একজন সবুজ চেক শার্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে…

নাসরিন কপালে হাত রেখে উদাসীন ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। তার ভেতরটা জুড়ে শুধু হাহাকার। মেয়েটার কপালে বুঝি আর শান্তি হলো না! কত কিছুর বিনিময়ে একত্র হয়েছিল অভ্রর সঙ্গে। সেই অভ্র বিদেশ যাওয়ার দুই মাসের মাথায় পানিতে ডুবে মারা গেল! তার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার বন্ধু দেখেছিল ভাগ্যিস! নইলে কেউ কোনোদিন বলতে পারতো না অভ্র কোথায়! কেউ কোনোদিন খুঁজেও পেতো না হয়তো! মেয়েটা তারপর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে! মনমরা, চুপচাপ, একাকীত্ব তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। শোকে শোকে পেটের বাচ্চাটাও হারালো! মৃত সন্তান প্রসব করেছিল আট মাসের মাথায়! সব হারিয়ে নিঃস্ব পড়ন্ত আজও অভ্রকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। আফসোস, তার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। মা হয়েও নাসরিন কিছু করতে পারছেন না। কত বুঝিয়েছেন পড়ন্তকে… যা হয়েছে ভুলে গিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু না! পড়ন্ত যেন ওই এক সুতোয়ই আঁটকা পড়েছে। কোনো ক্রমেই বেরোতে পারছে না। তন্ময় ছেলেটা ভালো। কবে কোথায় পড়ন্তকে দেখেছিল কে জানে, নিজে থেকে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। পড়ন্তর আগের বিয়ে,মৃত সন্তান প্রসব, সব সম্পর্কে জেনেও পিছপা হয়নি। এই ছেলেটা চাইলে পড়ন্তকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু পড়ন্তটা তো রাজীই হচ্ছে না। যাও একটু নিমরাজি ছিল, তাও ইদানীং কীসব ছায়া-টায়া দেখার ফলে ভেস্তে গেছে। অভ্রকে নাকি দেখে পড়ন্ত! কীভাবে দেখবে?আর তো কেউ দেখে না! সব মনের সৃষ্টি কল্পনা… পড়ন্ত টা বুঝতেই চায় না।

উল্লাসী এসে নাসরিনকে ডাক দিতেই নাসরিনের ধ্যান ভেঙে গেল। গোলগাল মুখের গর্ভবতী উল্লাসীকে দেখলে কিছুটা প্রাণ জুড়োয় তার। মেয়েটা তাকে কী এক মায়ার বাঁধনে আঁটকে দিয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। উল্লাসীর ছয় মাস চলছে। যখন দুই মাস হয়েছিল, তখনই একদিন হঠাৎ করে পাপনের ফোন আসে। মিথুন উদ্দিন ছেলের কণ্ঠ শুনেই অস্থির হয়ে পড়েন। যখন জানলেন পুত্রবধূ গর্ভবতী, এবং সেই খবর জানানোর জন্যেই আজ এত বছর পর পাপন ফোন দিয়েছে, তখন তিনি এক প্রকার বগলদাবা করেই পাপন আর উল্লাসীকে ঘরে নিয়ে এলেন। পাপন অবশ্য আসতে চায়নি, ওখানে ভালো ব্যবসা জমিয়ে নিয়েছিল ততদিনে। পাপনকে অনেক বছর বাদে দেখার পর মিথুন উদ্দিন অবাক। মুখ ভর্তি ঘন দাঁড়ি, বিনম্র কণ্ঠস্বর, আদব কায়দা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভরপুর…মেয়েটা তার ছেলেকে কী সুন্দর পরিবর্তনে রূপান্তরিত করেছে! এরপর থেকেই উল্লাসীর প্রতি আলাদা স্নেহ কাজ করে মিথুন উদ্দিনের। যখন ভরা পেট নিয়ে তাকে চা বানিয়ে দেয় নিজ হাতে, তখন আনন্দে তার চোখে পানি চলে আসে। শুধু পড়ন্তকে দেখলে সেই আনন্দটুকু দপ করে নিভে যায়। শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। বাসী মুখ, কতদিন চুলে চিরুনি চালায় না। খায় তো খায় না… গোসলের ঠিক নেই। এক কথায় ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছিল পড়ন্ত। ঠিক তখনি তন্ময় এসে পড়ন্তকে চাইলে বাড়ির কেউই না করেনি। শুধু বড় চাচী ঘরের ভেতর মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছিলেন। তিনিও একপ্রকার মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছেন। ছেলে হারানোর শোক কম কীসে?!

হাসিতে ভরপুর পরিবারটি আজ কী থেকে কী হয়ে গেল! মিথুন উদ্দিন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এসব ভেবে ভেবে। তার কোনোকিছুই ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে যেদিকে দু-চোখ যায়…

-“আম্মা,খাবেন না?”
প্রশ্ন করে উল্লাসী।

নাসরিন প্রত্যুত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
-“পড়ন্ত এসেছে?”
-“না আম্মা। এখনো পৌঁছায়নি। আমি ফোন দিয়েছিলাম। আপা বলল,আসতেছে।”
-“ও আসুক আগে। তারপর খাই..”
-“আপনার ওষুধ..?”
-“ওষুধ দিয়ে আর কী হবে রে মা! যেদিন আমার মেয়েটার কপালে সুখ এসে ধরা দিবে, সেদিন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠব। এসব ওষুধে কিচ্ছু হবে না।”
নাসরিনের কথায় উল্লাসীর মন ভার হয়ে আসে। সে আসার আগেই অভ্র ভাই মারা গিয়েছিল। পড়ন্তকে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় পেয়েছিল এসে। সেই থেকে দেখে যাচ্ছে… কষ্টই লাগে তার। কীভাবে কী হয়ে গেল, আজও কেউ হিসেব করে বুঝে উঠতে পারে না। পাপনটা প্রায় রাতে তাহাজ্জুদে কাঁদে নিরবে। পরিবারের এমন কষ্ট তার ছোট্ট প্রাণে সহ্য হয় না যে। উল্লাসী ভরসা দেয়, আশ্বাস দিয়ে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও সে জানে না কতটুকু ঠিক হবে বা কীভাবে ঠিক হবে!
মৃদু শ্বাস বেরিয়ে আসে উল্লাসীর বুক ফুঁড়ে। কিছু না বলেই রুম ত্যাগ করল সে।

-“আমার মতো কচি মেয়ে যে পাইছো, এটা তোমার সাত কপালের ভাগ্য! তারপরও তুমি অন্য মেয়েদের দিকে কীভাবে নজর দাও হুঁ? তোমার চোখ আমি গেলে ফেলবো জাওয়াদ..”
নিতু ফোঁসফোঁস করছে। সে ভার্সিটি থেকে বেরোনোর সময় স্পষ্ট দেখেছে, জাওয়াদ একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। জাওয়াদ যদিও তা সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করেছে। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না নিতুর। সে তো দেখেছে, আর তার চোখ কখনোই ভুল দেখতে পারে না। অতএব জাওয়াদের শাস্তি হবে এবং শাস্তিস্বরূপ তার সঙ্গে তিনদিন কথা বলা বন্ধ রাখবে নিতু। তাহলেই আক্কেল ফিরে আসবে। আর কখনো এরকম ভুল করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। হুহ!
নিতু জাওয়াদকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাঁটা দিলো। একদম রাস্তার মাঝখান বরাবর। পেছন থেকে বেশ কয়েকবার জাওয়াদ উচ্চ শব্দে ডেকে উঠল। নিতু শুনেও দাঁড়াল না। তার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে এই পাঠাটা.. চার বছর হতে চললো সম্পর্কের! অথচ এখনো বাড়িতে অবধি বলতে পারল না। ওদিকে তার বয়স হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। আর ক’দিন দেড়ি হলেই, বাচ্চাকাচ্চা না হয়ে নাতি-নাতনি দেখার বয়স হয়ে যাবে। তবুও মুখে কুলুপ এঁটে থাকে সবসময়। নিতুর এইবার টার্মটা শেষ হোক, নিজেই যাবে জাওয়াদের বাড়ি। বলবে তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা। মানবে না মানে কী? মানতেই হবে। নিতু ওত সহজ মেয়ে না। প্রেম করল, বিয়ে করবে না, আর কেঁদেকেটে বুক ভাসাবে? নো, নেভার!! দরকার পড়লে গলাটা নামিয়ে দেবে জাওয়াদের। তবুও জাওয়াদকে তার চাই-ই চাই…

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here