অন্তর্দহন (সিজন-২) পর্ব- ৫

0
2295

অন্তর্দহন (সিজন-২)
পর্ব- ৫
লেখিকা- অলিন্দ্রিয়া_রুহি

রাত স্তব্ধ, নিঝুম। চারিদিকে নির্জনতা বিরাজমান। অবয়বটা এখনো আছে। পড়ন্ত হাত ইশারায় কয়েকবার মিনতি করল। তাকে এত কষ্ট না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। পাশেই বিছানার মধ্যে শায়লা ঘুমুচ্ছে। পড়ন্ত যে তাকে একবার ডাক দিয়ে উঠাবে, সেই বোধটুকুও তার ভেতর নেই। পড়ন্তর মস্তিষ্ক অভ্র অভ্র করে অচেতন হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। সে কী করে, কী ভাবে, মাঝে মাঝে অনেক কিছুই মনে করতে পারে না। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, বেঁচে থাকতে হয় বলেই বেঁচে থাকা। শুধু দেহটাই আছে। রুহ কবেই ছেড়ে চলে গিয়েছে!
আজকে একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটলো। পড়ন্ত দেখলো, অবয়বটি নড়েচড়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। পড়ন্ত কান্না থামালো। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। অভ্রর রাগ অবশেষে ভাঙতে চলেছে কী তবে? কাছে এসে বিল্ডিং এর একদম কাছাকাছি দাঁড়াল অবয়বটি। বিল্ডিং এর সামনে হালকা পাওয়ারের হলুদ ডিমলাইট, তাতে অবয়বের চেহারা না দেখা গেলেও হাত-পা অনেক কিছুই স্পষ্ট হলো। অবয়বটি এক হাত উঁচু করে পড়ন্ত কে তার কাছে ডাকলো। ইশারায় চলে আসতে বলল। পড়ন্ত বুঝলো, আজকেই সব লুকোচুরির শেষ হতে চলেছে। অভ্রর রাগ ভেঙেছে। তাকে নিয়ে চলে যাবে বহুদূরে। যেখানে তারা দু’জন ব্যতীত তৃতীয় কেউ থাকবে না। কেউ তাদের সংসারে বাঁধা দিতে পারবে না। পড়ন্ত ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করল, ‘আসছি।’
তারপর ধীরস্থির ভাবে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। একবারও ভাবল না, সে কোথায় যাচ্ছে। কার সঙ্গে যাচ্ছে। আর ওই অভ্র বেশী লোকটা কে! যদি ও অভ্রই হয়, তবে কেন তার পরিবারের সামনে আসছে না? কী কারণ?
অসুস্থ মস্তিষ্কের পড়ন্তর কাছে এসব কিছুই বোধগম্য নয়। অভ্রতে এমনভাবে মজে গিয়েছে সে যে বাস্তবতাকে জীবন থেকে আলাদা করে ফেলেছে পুরোপুরি। অভ্রর সঙ্গে একটি সুন্দর সংসার গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর পড়ন্ত ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেনি কত বড় বিপদের ভেতর পড়তে চলেছে কিছু সময়ের মধ্যেই…

শায়লা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঘুমে ঝিমিয়েছে এতক্ষণ, তবুও চোখজোড়া বহু কষ্টে খুলে রেখেছে শুধুমাত্র পড়ন্তর জন্য। পড়ন্তর হাবভাব কী, কী করে সে একা জেগে জেগে, তার সবকিছু অবলোকন করেছে শায়লা। এই যে একটু আগে পড়ন্ত চোরের ন্যায় চুপি চুপি বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে, এটাও শায়লা খেয়াল করেছে। কিন্তু পড়ন্তকে আঁটকায়নি। পড়ন্ত কোথায় গেছে, কার সঙ্গে গেছে তার সবটাই শায়লা জানে এবং এটা শায়লার হুকুমেই ঘটছে। সুতরাং পড়ন্তকে আঁটকানোর কোনোই মানে হয় না। এবার শায়লা ঘুমুবে। শান্তির ঘুম ঘুমাবে। পথের মাঝখানের কাঁটা চলে যাচ্ছে। খুব দ্রুতই অভ্র দেশে ফিরে আসবে। তারপর অভ্রকে নিজের করে পেতে আর কোনো বাঁধা থাকবে না। শায়লা আনমনেই মৃদু হাসল। নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ঘুমানোর আগে আগন্তুক কে একটা ফোন করে পড়ন্তর খবরাখবর নিলো শায়লা। আগন্তুক জানালো, ভোর হতেই পড়ন্তর লাশ ভেসে উঠবে মাঠের সামনের ছোট্ট পুকুরটায়। সবাই ভাববে, মাথাপাগল পড়ন্ত অভ্রর শোকে নিজের জীবনটা দিয়ে দিয়েছে। কেউ জানবে না, অভ্রর রূপে অন্য একটি ছেলে এতদিন শায়লার আদেশে পড়ন্তকে দেখা দিতো। ধীরে ধীরে পড়ন্তকে আরও অসুস্থ বানিয়ে আজ ইশারায় ডেকে নিয়ে চলে গেল তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে! শায়লা হাই তুললো। তার বড্ড মাথা ধরেছে। এখন একটা শান্তির ঘুম দেওয়াই যায়। সকালে উঠে না হয় মরাকান্না কাঁদা যাবে!

শায়লার ঘুম ভাঙলো শিখার ডাকাডাকিতে। শায়লা হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে ঘুম থেকে জেগে উঠল। শিখা নাকমুখ কুঁচকে রয়েছেন। নিজের ঘর থাকতে পড়ন্তর ঘরে এসে ঘুমানোর মানে হয় কোনো! ঘরটা কী পরিমাণ নোংরা হয়ে রয়েছে। একটা আঁশটে গন্ধ বিরাজমান। আবার পড়ন্তকে সুস্থ করে তোলার যে ভূত শায়লার মাথায় চেপেছে, সেটা নিয়েও ততটা খুশি নন তিনি। পড়ন্তকে পড়ন্তর মতো থাকতে দিলেই তো চলে। তিনি চান না শায়লা আর একটুও সময় অপচয় করুক। একটা ভালো পাত্র পাওয়া মাত্রই শায়লার বিয়ে নিয়ে ভাববেন তিনি। পাত্রর খোঁজ ও লাগিয়ে দিয়েছেন শিখা।

শায়লা বিরক্তি ধরা গলায় বলল, ‘কী মা? এভাবে ডাকাডাকি কেন? কী হয়েছে?’ শায়লা মনে মনে ভাবল, হয়তো পড়ন্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা পড়ন্তর লাশ পাওয়া গেছে তাই শিখা এভাবে চিল্লাচিল্লি করে উঠালেন তাকে। এই ভেবে শায়লা মনে মনে একটু স্বস্তি ও পেল। বিদেশে অনেক ছেলের সঙ্গে মিশেছে সে। অনেক ক্লোজ হয়েছে। কিন্তু সবাইকে সাময়িক ভাবে ভালো লাগলেও জীবনসঙ্গী করার মতো আকর্ষণ কারো জন্যেই খুঁজে পাইনি যতটা অভ্রর কথা ভাবলেই তার অনুভূতি হয়। শেষ পর্যন্ত নিজের অন্তর্দহনের কাছে হেরে গিয়ে শায়লা বুদ্ধি করে কীভাবে অভ্রকে নিজের করে পাওয়া যায়। সময় এবং পরিবেশ তারই অনুকূলে ছিল সে সময়টায়। অভ্রর ব্যাপারে তার বন্ধুর থেকে সবসময় আপডেট নিতো শায়লা, যেটা শুধুমাত্র সেই বন্ধু আর শায়লার ভেতরেই ছিল। অভ্র জানতো না। ওই দেশে একটা ভুল বোঝাবুঝির রেশ ধরে অভ্রকে আচানক জেলে যেতে হলো। তার বন্ধু প্রথম প্রথম তাকে উদ্ধার করার জন্য অনেক চেষ্টা করলেও পারে না। যখন সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলাদেশে অভ্রর পরিবারে জানাবে সবকিছু, তখন কোর্ট রায় দিলো পাঁচ বছরের কারাদন্ডের। অভ্র যে তার পরিবারকে একটু জানাবে, সেই সুযোগটাও তাকে দেওয়া হলো না। তবুও অভ্র এইটুকু নিশ্চিন্ত ছিল যে, তার বন্ধু ঠিকই বাংলাদেশে জানিয়ে দিবে এবং তার পরিবার কোনো না কোনো উপায় বের করে তাকে মুক্ত করবেই করবে। কে জানতো, এই বন্ধুই তাকে এভাবে ডোবাবে! শায়লার থেকে বেশ কিছু অর্থের বিনিময়ে অভ্রর জেলে যাওয়ার খবরটা সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে ছড়িয়ে দিলো অভ্র মরে গিয়েছে। সে নিজের চোখে নাকি অভ্রকে পানিতে ডুবে যেতে দেখেছে। লাশ খুঁজিয়েছে, পাওয়া যায়নি। সবাই বিশ্বাস করে নিলো। আর তারপর থেকেই অভ্র-পড়ন্তর সোনার সংসারে ধ্বস নেমে এলো। ওদিকে অভ্র, যে কীনা বেঁচে রয়েছে, যার দিব্যস্বপ্নে পড়ন্তর প্রতিচ্ছবি, এদিকে পড়ন্ত- যে অভ্রর বিরহে পাগল প্রায়…মাঝখান দিয়ে শায়লা, সে সব জেনেও কোনো স্টেপ নেয়নি। ইচ্ছে করে ওই দেশে থেকেছে এতদিন যাতে তার উপর কেউ কোনো সন্দেহ না করে। তারপর ধীরে ধীরে পড়ন্তকে পাগল বানিয়েছে। আর এখন পড়ন্তকে বাড়ি ছাড়াই করল। না জানে কোথায় আছে পড়ন্ত। আদৌও কী সে মারা গিয়েছে? তার লাশ পাওয়া যাবে মাঠের সামনের ছোট্ট পুকুরটায়?

শায়লা ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইলো, ‘বাসায় কিছু হয়েছে মা?’
শিখা ভ্রু কুঁচকালেন।
‘বাসায় কী হবে?’
‘না মানে, তুমি যেভাবে ঘুম থেকে ডেকে তুললে তাই আমি আর কী ভাবলাম কিছু হলো কীনা।’
‘বাসায় কিছুই হয়নি। কিন্তু তোর কান্ডকারখানা আমার ভালো লাগছে না। কোথায় এসেছিস, এখন শান্ত হয়ে বসবি, দু’দিন বাদে তোর বিয়ে দিবো তাই নিয়ে চিন্তা টিন্তা করবি। তা না, এসেই পড়ন্তকে নিয়ে পড়েছিস! আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না এসব শায়লা। ওকে ওর মতোই থাকতে দে না। পাগল মেয়ে, দু’দিন পর বেঁধে রাখতে হবে দেখিস।’
শায়লা মুচকি হেসে বলল, ‘এসব কথা বলো না তো মা। ও আমার ছোটো বোন না? ওর ভালো টা আমি চাইবো না তো কে চাইবে বলো?’
‘তোকে এত ভালো চাইতে হবে না। উঠ, নিচে আয়। নাশতা টা করে তারপর যা করার কর। আর শোন, এই ঘরে ভুলেও আসবি না আর। তোর ঘর নেই? এই ঘরে মানুষ থাকে? ইশ, কেমন গন্ধ!’ শিখা দ্রুত পায়ে চলে গেলেন। শায়লা ঠোঁটের কোণায় ফিচেল হাসি এঁকে বলল, ‘এই ঘরে আর আসার প্রয়োজন হবে না আম্মু।’

ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই শায়লার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পড়ন্ত ডাইনিং টেবিলে বসে রয়েছে। একদম সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মতো। হাসিমুখে নাশতা করছে। তার পাতে নাসরিন এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। সবার মুখে হাসি। পড়ন্তর এই স্বাভাবিকতা সবাইকে আনন্দ দিচ্ছে। শায়লা ফাঁকা ঢোক গিললো। তার চেহারায় মেদুর রঙের ছায়া। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। পড়ন্তর তো লাশ হয়ে যাবার কথা এতক্ষণে। তাহলে সে এখানে কী করছে? তবে কী আসিফ তার কাজ পরিপূর্ণ ভাবে করতে পারেনি? হ্যাঁ, সেই আগন্তুকের নাম আসিফ। যে কীনা শায়লার ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ড। শায়লাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে বিধায় এত জঘন্য পাপ করার ক্ষেত্রেও পিছপা হয়নি। শায়লার এক কথায় পড়ন্তর জীবন নিয়ে খেলতে দুইবার ভাবেনি। শায়লার ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে গেল রাগে। আসিফকে সামান্য একটা কাজ দিয়েছিল, তাও করতে পারল না! এবার কী হবে? কী আর হবে! আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই অভ্রর ছায়া সাজার নাটক চালিয়ে যেতে হবে। পড়ন্তকে আরও দুর্বল করে তুলতে হবে। তবেই তার কার্যসিদ্ধি হবে।

শায়লা খেয়াল করল, পড়ন্ত তার দিকে চেয়ে আছে। শায়লা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। পড়ন্ত বলল, ‘শুভ সকাল আপা।’
‘শুভ সকাল।’ পাংশুটে মুখে জবাব দিলো শায়লা। তারপর পড়ন্তর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে রুটির প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিলো। একটা রুটি সবেমাত্র ছিঁড়ে মুখের কাছে ধরেছে, ওমনি একটা চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর শায়লার হাত আঁটকে দিলো। থমকে গেল শায়লা। পেছন ঘুরে তাকিয়ে অভ্রকে নিজের চোখের তারায় আবিষ্কার করতেই হকচকিয়ে গেল সে। অথচ বাড়ির সকলেই চুপচাপ, শান্ত। যেন তারা জানতো অভ্র এভাবেই একদিন হুট করে চলে আসবে। তবে কী রহস্য লুকিয়ে আছে এসবের পেছনে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here