অন্তর্দহন_১১,১২ (ধামাকা পর্ব)
অলিন্দ্রিয়া_রুহি
১১
হঠাৎ কোথা থেকে যেন কালো মেঘের ভারী দল এসে আকাশটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে প্রকৃতি গুমোট করে তুলল। উল্লাসী পাতলা নেকাবের তল দিয়ে গোমড়া মুখের আকাশটাকে একনজর দেখেই পাপনকে বলে উঠল,
-“বাকি কেনা কাটা কাল করবোনি? এখন বাসায় যাই চলো। আকাশের অবস্থা দেখো!”
পাপন রিকশার খোঁজে মনোযোগী ছিল, উল্লাসীর কথায় নিজেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-“হুম, বাসায় যাওয়ার আগে তোমার নাকফুলটা কিনে নিয়ে যাই চলো। ওই গলির পরের রাস্তাতেই একটা স্বর্ণকারের দোকান আছে। আমি কালকে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম না? তখন দেখছি।”
উল্লাসী মৃদু হাসে।
-“আচ্ছা।”
ওরা দু’জন বেরিয়েছে নতুন সংসারের জন্য টুকটাক কিছু কেনাকাটা করতে। সেদিন মোল্লা সাহেবের ঘরে যাওয়ার পর উল্লাসীই তাদের জীবন বৃত্তান্ত আদি থেকে অন্ত অবধি সবকিছুই খুলে বলে৷ এও বলে তারা বিবাহ করে একটি পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়৷ কিন্তু দু’জনেরই বয়স কম, আর বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তারা কোনো কাজীর কাছ থেকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। এই শুনে মোল্লা সাহেব মৃদু হেসে বলেছিলেন,
-“এগুলো সব বর্তমানের প্রচলিত সিস্টেমরে বাবা! কম বয়সে বিয়ে করা যাবে না, কোনো বিবধা বা তালাক প্রাপ্ত নারী কোনো অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না! এসব আজকালকার বিরক্তিকর নিয়ম৷ অথচ ইসলামে এমন কোনো নিয়ম নেই। যদি ছেলে-মেয়ে সাবালক হয়, আর তাদের দু’জনেরই মত থাকে তবে পরিবার তাদের বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে অতিদ্রুত। এতে করে তারা কোনো জেনায় লিপ্ত হবে না। বরং আল্লাহর রহমত বরকতে ভরা একটা সুন্দর জীবন যাপন করবে। তোমরা চিন্তা করো না। আমি কালাম মোতাবেক তোমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিবো। কিন্তু তোমাদের বাবা-মা কেউই নেই, এটা একটু কষ্টের আসলে। এতবড় একটা মুহূর্তে তারা কেউ থাকবে না এটা কেমন করে হয়?”
উল্লাসী তৎক্ষনাৎ বলেছিল,
-“আপনিও তো আমার বাবারই বয়সী চাচা। আমার তো বাবা নেই, আপনিই নাহয় আমাকে পাত্রস্থ করুন।”
মোল্লা সাহেব এরপর আর বাঁধ সাধেননি। ওদের দু’জনকে মাগরিবের আগে আগে বিবাহ পড়িয়ে দিলে উল্লাসী পাপনকে নিয়ে মাগরিবের নামায পড়ে। কাবিন নামা করা হয় না, দেনমোহর ধার্য্য করা হয় মাত্র পনেরোশো টাকা… যেটা পাপনের কাছে ছিল। তার সাধ্যের ভেতরই দেনমোহর ধরেন মোল্লা সাহেব, আর এটাই প্রকৃত নিয়ম! সেই পনেরোশো টাকা নগদই উল্লাসীর হাতে তুলে নিয়ে তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে ছোঁয়ার অনুমতি নিয়ে নেয় সে। সেদিন রাতটা মোল্লা সাহেবের বাসাতেই থাকে ওরা। কিন্তু পরদিনই উল্লাসীর চাপাচাপিতে পাপন আশেপাশে বাসা খুঁজতে বের হয়। মোল্লা সাহেবের বাসা থেকে একটু ভেতরে, যেতে দু’মিনিট লাগে- সেখানে একটি একরুমের ভালো মানের ফ্ল্যাট পেয়ে যায় তারা। তিনতলায় বাসা, তবে সাবলেট। একসঙ্গে তিনটি ফ্যামিলি থাকে। সকলেই স্বামী-স্ত্রী। একজনের একটি বাচ্চা আছে, নিশাত করে নাম। রুম খালি ছিল বলে সেদিনই ওরা উঠে যায় ওই বাসায়। বাড়িওয়ালা মহিলা খুবই আন্তরিক। প্রথমে ওরা বিবাহিত কীনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও মোল্লা সাহেব যখন স্বয়ং ওদের বিবাহ দিয়েছেন, শুনেছেন, তারপর আর কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেননি তিনি। সেদিন বিকেলেই হাজার তিনেকের ভেতর একটা স্টিলের খাট, দু’হাজারের ভেতর একটা র্যাক, আর ছোট ছোট দুইটা আসবাবদানী কিনে নিয়ে আসে পাপন আর মোল্লা সাহেব মিলে। আজ বেরিয়েছে হাড়ি-পাতিল কেনার জন্যে। টুকটাক অনেক কিছু কিনেছে ইতিমধ্যে। বাকিটা কাল বা পরশু কিনলেই চলবে।
বৃষ্টি আসবে আসবে করেও এলো না। বাতাসের তোড়ে কালো মেঘেদের দল দূরে উড়ে গেল। পাপন একটা সুন্দর স্বর্ণের নাকফুল কিনে সেটা উল্লাসীকে পড়িয়ে দিলে উল্লাসীকে একদম বউ বউ মনে হলো তার কাছে। গোলগাল মুখে ছোট্ট এই নাকফুলটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা নিয়ে এলো যেন। পাপন বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল,
-“সুন্দর!”
উল্লাসী লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে ফেলল৷ দু’জনে বেরোতেই পাপন বলল,
-“চলো, আজকের লাঞ্চটা কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে করি। একটা সেলিব্রেশন আর কী।”
উল্লাসী কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলল,
-“কোনো সেলিব্রেশনের দরকার নেই মিস্টার। বাসায় চলো, আমার হাতের রান্না কম নাকি?”
-“না তা না… তবুও…”
-“উঁহু, অযথা টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই হাজার খানেক শেষ! সামনে তোমাকে চাকরি করতে হবে। অথবা নিজে কিছু হলেও করতে তো হবে! তখন টাকা লাগবে অনেক। এই জন্যে এখন এসব বাদ… টাকা যতটা সেভ করা যায় অতই ভালো।”
পাপন অবাক হয়। উল্লাসীর বয়স তারচেয়েও কম। ষোলো বোধহয়! অথচ এত ম্যাচুরিটি! উল্লাসী পাপনের চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
পাপন ধ্যান ভেঙে অল্প হাসে।
-“উঁহু.. কিছু না। চলো বাসায় যাই। পা ভেঙে আসতেছে।”
উল্লাসীর কালো মোজায় ঢাকা আঙুল গুলোর ফাঁকে আঙুল গুঁজে পাপন। তারপর হাঁটা ধরে। মরা রোদ, গায়ে লাগে না। বাতাস সুন্দর, ঝরঝরে… উল্লাসীর দারুণ লাগছে। এভাবে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেও সে রাজী।
★
অভ্র বিছানার চাদর খামচে খামচে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। তার মাথায় আগুন চেপেছে যেন। পারছে না আশেপাশের সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে… জাওয়াদরা খানিক আগে চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয়েছে, পড়ন্তকে তারা পছন্দ করেছে। এখন কী হবে? পড়ন্তও কী রাজী হয়ে যাবে? তাহলে তো শেষ…! সব শেষ। অভ্র শেষ, এই দুনিয়া শেষ, তার জীবনই শেষ। ঘরে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অভ্র লাল বর্ণের চোখজোড়া মেলে শায়লাকে দেখতে পেল। এই মেয়েটার জন্যেই আজ তার পাগল হবার দশা! এই মেয়েটা.. হ্যাঁ, এই মেয়েটা তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। পড়ন্তকে, তার কলিজাকে তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অভ্রর সহ্য হলো না। শায়লা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হিংস্র বাঘের ন্যায় তার দিকে তেড়ে আসলো অভ্র। শায়লা সরে যাবে, তার আগেই তার গলা চেপে ধরল সে। শায়লা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। অভ্র হিসহিসিয়ে বলল,
-“তু..তুই.. তুই আমার জীবনটা শেষ করে দিলি শায়লা। একমাত্র তোর কারণে আজ আমি নিঃশ্বাসটা নিতে পারি না। আমার পড়ন্ত আমারই চোখের সামনে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে অন্য এক পড়ন্ত! তুই… তুই আমার জন্য অভিশাপ। তুই মরিস না কেন রে? মরে যা.. আমাকে বাঁচা! আমি আর পারছি না বুঝলি!? হয় আমাকে একেবারে মেরে ফেল নইলে তুই মরে যা। এই যন্ত্রণা আমার আর সহ্য হচ্ছে না রে.. একদম সহ্য হচ্ছে না।”
অভ্রর চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ল। শায়লা এই প্রথম অভ্রকে কাঁদতে দেখছে তাও পড়ন্তর জন্য! শায়লার মনে হলো, তার ব্রক্ষ্মতালুতে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অভ্র সরে গেল। দ্রুত হাতে চোখের পানি গুলো মুছে নিতে গিয়েও পারল না। তার বুক জ্বলছে। এবার সে বুঝতে পারছে পড়ন্ত কতটুকু অন্তর্দহনে জ্বলেছে এতদিন! অভ্র ফিসফিস করে স্বগতোক্তি করল,
-“তুই বড় শক্ত রে পড়ন্ত। আমি যে এই ব্যথা সইতে পারছি না!”
শায়লা হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। তার বুক হাপড়ের মতো উঠছে নামছে। মেজাজ খিঁচিয়ে তেজী গলায় বলল,
-“কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করলে না।”
অভ্র ঝট করে শায়লার দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার তেড়ে আসলো।
-“কাকে ভয় দেখাস তুই? হ্যাঁ? তোকে আমি তুলোধুনো করে ছাড়বো যদি আমার পড়ন্তকে এতটুকুও কষ্ট দিস তো।”
-“পড়ন্ত, পড়ন্ত, পড়ন্ত!!” চিৎকার করে উঠে শায়লা।
-“এই পড়ন্তই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাঁটা। ওকে আমি মেরেই ফেলবো। একদম সরিয়ে দিবো।”
শায়লা রাগ নিয়ে ঘর ছাড়তে নিলে পেছন থেকে টান অনুভব করে। অভ্র ওর হাতের বাহু টান দিয়ে ধরেছে।
-“তোর কলিজা ছিঁড়ে ছাদে শুকাতে দিবো। চিনিস তুই আমাকে?”
শায়লা ঝামটা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেলে অভ্র হাতের কাছে থাকা একটা ফুলদানী ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। কাঁচের জারটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটিয়ে পড়ল ঘরের মেঝেতে।
পড়ন্ত হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ তার। জাওয়াদরা নাকি যাওয়ার আগে তাকে পছন্দ হয়েছে, এমনটাই মিথুন উদ্দিনের কাছে মন্তব্য করে গেছেন। এখন শুধু তাদের পক্ষ থেকে পজিটিভ সাইন পাওয়ার অপেক্ষা। বাড়ির সবাই রাজী হলেও পড়ন্ত কিছুতেই রাজী হয়নি। এই নিয়ে নাসরিন হাজারটা কথা শুনিয়ে গেছেন। মিথুন উদ্দিন কতক্ষণ রাগে গজগজ করেছেন। পড়ন্তর কী যে অসহায় লাগছে নিজেকে! ইচ্ছে করছে কোথাও একটা চলে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে! আর জাওয়াদকে এত বুঝিয়ে বলার পরেও কেন এই বিয়েতে মত দিলো? পড়ন্ত শত ভেবেও কূল কিনারা পায় না।
নাসরিন বিছানা ঝাড়ছিলেন, এমন সময়ে হন্য পায়ে শায়লা এসে ঘরের ভেতর ঢুকলো।
-“পড়ন্ত কই চাচী?”
-“ওর রুমে৷ একটু বুঝা তো ওকে। এত ভালো পরিবার, এত সুন্দর পাত্র আর ওই গর্দভটা কোনো মতেই রাজী হচ্ছে না।”
শায়লা মৃদু শ্বাস ফেলল।
-“আমি বোঝাচ্ছি।” বলে পড়ন্তর ঘরের দিকে পা বাড়ালো। পড়ন্ত শায়লা কে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। শায়লার নাকের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকা নাকফুলটা জানান দেয়, তার বিয়ের অস্তিত্ব, অভ্রর স্ত্রীর পরিচয়, যা সহ্য হয় না পড়ন্তর।
শায়লা গমগমে কণ্ঠে বলল,
-“বাহিরে আয়। কথা আছে।”
পড়ন্ত ঠান্ডা কণ্ঠেই বলল,
-“কী কথা?এখানেই বলো।”
-“চাচীর কাছে তোকে ছোট করতে চাচ্ছি না বলেই বাইরে আসতে বলছি। এখন আসবি নাকি অভ্রর ব্যাপারে এখানেই কথা সাড়বো?”
অগত্যা পড়ন্তকে উঠে বাহিরে বেরোতে হলো। আকাশে চাঁদের অস্তিত্বও নেই। পড়ন্তর মনে হলো, তাদের জীবন থেকে শায়লার অস্তিত্ব এভাবেই মিশে যেত যদি!
শায়লা পড়ন্তকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
-“তোর সমস্যা কী? বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন? বিয়ে করে আমার আর অভ্রর জীবন থেকে বেরিয়ে যা না… তোর কারণে অভ্র আমাকে এক্সেপ্ট করতে পারছে না। অথচ ও… ও আমার উপর দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
পড়ন্ত যেন ঠিক বুঝলো না। কপাল কুঁচকে ফেলল সে।
-“কী বললে? দুর্বল হয়ে পড়েছে? তাও অভ্র তোমার উপর!” পড়ন্তর ঠোঁটে বিদ্রুপ মাখানো হাসি। শায়লা নাকের পাঠা ফুলিয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ।
-“হুম, আমার উপর। তুই প্রমাণ দেখতে চাস?”
পড়ন্তর বুকটা ঢিপঢিপ করছে। কী এমন দেখাবে শায়লা! সেটা সে সহ্য করতে পারবে তো?
তবুও জোরালো কণ্ঠে কৌতূহল দমন করতে পড়ন্ত জবাব দিলো,
-“হ্যাঁ,চাই। দেখাও।”
শায়লা দুর্বোধ্য হাসল। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের জামার গলাটা খানিকটা নামিয়ে ধরতেই গলার অনেকটা নিচে দুটো লাল দাগ দেখা গেল। কেউ নখ দিয়ে আঁচড় দিয়েছে যেন। পড়ন্তর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। সেই সাথে চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল পানি।
শায়লা জামা ঠিকঠাক করে বলল,
-“আর কিছু বলতে হবে? নাকি এখনো তেড়ামি করে বলবি, অভ্র তোকে ভালোবাসে, কোনটা?”
পড়ন্ত কোনো কথা বলল না। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তারপর একপ্রকার ছুটে শায়লার সামনে থেকে চলে গেল। শায়লা হাসল,পৈশাচিক হাসি। পড়ন্তকে তার প্রাপ্য জবাব দিতে পেরে খুশি সে।
চলবে…
#অন্তর্দহন_১২ (ধামাকা পর্ব)
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
মোল্লা সাহেবকে আজ বাসায় ডেকেছে পাপন। উল্লাসী ডাকতে বলেছে বিধায় ডেকে আনা হয়েছে তাকে। পাপন নিজেও জানে না এর পেছনের কারণটা কী। উল্লাসী একটি অদ্ভুত মেয়ে। আগেভাগে পাপনকে কিছু বলবে না, একেবারে করে দেখাবে। পাপনও তাই উল্লাসী তেমন একটা ঘাটায় না।
দুপুরে বেশ ভালো একটা ভোজন করল তারা তিনজন মিলে। মোল্লা সাহেবের জন্য পানের ব্যবস্থাও করে রেখেছিল উল্লাসী। কয়েক পদের জর্দা দেওয়া মিষ্টি পান। মোল্লা সাহেব বেশ আরাম করেই পান চিবুতে লাগলেন।
-“আপনার সাথে কিছু বিষয়ে আলাপ করতে চাই চাচা।”
উল্লাসী সুযোগ বুঝে আসল কথাটা তুললো। মোল্লা সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,
-“কও মা।”
-“এই শহরে আপনি ছাড়া আমাদের পরিচিত কেউই নেই চাচা। তাই আমাদের সব ব্যাপারে আপনার সাহায্যই কাম্য। ওর বয়স তো অনেক কম, এই বয়সে চাকরি পাওয়া কঠিন। চারদিন শুয়ে বসে কাটালেও আর শুয়েবসে থাকা যায় না চাচা। তাই আমি চাচ্ছিলাম, ও যেন কিছু একটা করে।”
-“হুমম.. সেটা তো খুবই ভালো পরিকল্পনা। শুয়ে বসে কতদিন?”
-“হ্যাঁ, এটাই চাচা। তো আমি ভাবছিলাম, যদি পাইকারী মূল্যে ছেলেদের শার্ট বা মেয়েদের ড্রেসাপ এনে ফুটপাতের উপর একটা জায়গা নিয়ে দোকান দিয়ে বসত, তাও প্রতিদিন কিছু তো আয় হতো। পাশাপাশি আমি অনলাইনেও বিক্রির চেষ্টা করতাম। এটা কেমন বুদ্ধি চাচা?”
পাপন কপাল কুঁচকে ফেলল উল্লাসীর কথা শুনে। সে ফুটপাতে জামাকাপড় বিক্রি করবে! ইয়া আল্লাহ… পাপন অসহায়বোধ করল। এছাড়া আর উপায়ই বা কী! তাও তো উল্লাসী কিছু একটা ভেবে বের করেছে! পাপন গোপনে মৃদু শ্বাস ফেলে।
মোল্লা সাহেব বেশ খানিকক্ষণ ভাবলেন। ভাবার পর বললেন,
-“বুদ্ধি ভালোই। আচ্ছা চেষ্টা করা যাক। কবে যাবা বলো। আমিই নিয়ে যাবো তোমাকে পাইকারি বাজারে।” পাপনকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললে পাপন উল্লাসীর দিকে তাকায়। উল্লাসী চোখ রাঙিয়ে মোল্লা সাহেবকে জবাব দিলো,
-“আগে জায়গা ঠিক করুন চাচা। রোড খরচের ব্যাপার আছে তো। চাইলেই তো আর রাস্তায় দোকান বসানো যায় না। আর চাচা, ভালো প্লেস বাছবেন, যেন বিক্রি ভালো হয় মোটামুটি।”
-“আগামীকাল থেকেই খোঁজা শুরু করি?” মিনমিনিয়ে বলল পাপন। উল্লাসী জোরালো কণ্ঠে বলল,
-“নাহ, আজ থেকেই। সন্ধ্যের পরই বের হবে।”
অগত্যা পাপনকে রাজী হতে হলো। এই মেয়ে একে পুরোদস্তুর সংসারী বানিয়ে তবে ছাড়বে!
মোল্লা সাহেব মাগরিবের নামাযের পর পাপনকে নিতে আসবেন, এই বলে চলে গেলে বিছানায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিলো পাপন। উল্লাসী এঁটো থালাবাসন গুলো গুছিয়ে এক পাশে সাইড করে রেখে দিয়ে নিজেও পাপনের পাশে এসে বসল।
-“তুমি কী ভাবছো, বলো তো।” প্রশ্ন করে উল্লাসী।
পাপন না বোধক মাথা নাড়ে।
-“উঁহু.. কিছু না।”
-“আমি জানি তুমি কী ভাবছো।” বলেই ভ্রু নাচায় উল্লাসী। রহস্য করে হাসে। পাপন এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-“তাই? তো বলো.. কী ভাবছি।”
-“উমম.. তুমি ভাবছো, এ আমি কাকে বিয়ে করলাম! যে কীনা আমাকে রাস্তায় বিক্রি করার জন্য ঠেলে দিচ্ছে।”
পাপন চমকিত বোধ করল। নাহ, এই মেয়েটা তার মনের গোপন কুঠুরিতে বেশ ভালোভাবেই নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ এত কিছু বুঝে যায় কী করে! কীভাবে! পাপন উত্তর দিচ্ছে না দেখে উল্লাসী জয়ের হাসি হেসে উঠে বলল,
-“দেখলে.. আমি ঠিকই ধরছি।”
পাপন উদাসীন গলায় জবাব দেয়,
-“হুম।”
উল্লাসী নিচু হয়ে পাপনের বুকের উপর মাথাটা রাখলো। ধীর কণ্ঠে বিজ্ঞের ন্যায় বলল,
-“দেখো, কাজ কোনোটাই ছোট বড় না পাপন। আল্লাহ যে আমাদের একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন, এই-ই বা কম কীসে! তুমি যদি প্রতিদিন বেচাকেনা শেষে ২০০-৩০০ টাকাও লাভ ঘরে নিয়ে আসো, তা দিয়েও আমি সংসার চালাতে পারব পাপন। আর আমিও তো বসে থাকব না। একটা কিছু অবশ্যই করব। তোমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। আমরা পারব পাপন, শুধু জোর হারিয়ো না। সামনে না জানি কত কঠিন পরিস্থিতি আসবে! তখন যদি দিশেহারা হয়ে পড়ো, তাহলে আমি কী করব বলো তো? আমার জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রেখো৷ আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। উনি নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন পাপন!”
পাপন দু’হাতে উল্লাসীকে শক্ত করে চেপে ধরল নিজের বুকের ভেতর। উল্লাসীও মিশে গেল নির্দ্বিধায়। পাপনের বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তবুও নিজেকে বুঝ দিলো সে। এরচেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে কত মানুষ আছে! তবুও সে ভাগ্যবান, নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেয়েছে। কত মানুষ আছে, যারা ভালোবাসার মানুষকে শত চেষ্টা করেও বেঁধে রাখতে পারে না!
টাকাপয়সা হাতের ময়লা। এই আছে, এই নেই। এই নেই, এই আছে! পাপন মনে মনে স্বগতোক্তি করল,
-“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব। বাকিটা ওই উপরে বসে যিনি আমার ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, তিনিই জানেন।”
-“এই.. কী হলো? কী ভাবছো?” উল্লাসীর কথায় পাপন সহাস্যে জবাব দিলো,
-“না, কিছু না।”
উল্লাসী মাথা তুলে তাকাল। চোখ পাকিয়ে সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো,
-“আমাকে ফেলে ভেগে যাওয়ার কথা ভাবছো না তো?”
পাপনের হাসি পেয়ে গেল৷ কী চিন্তাভাবনা! যার জন্য আজ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গাছ তলায় বলতে গেলে, তাকে ছেড়ে আবার কোথায় যাবে সে! পাপন হাসিটা চেপে রেখে খুন সন্তর্পণে বলে উঠল,
-“চলে গেলেই বা কী?”
-“মেরে ফেলব।” সঙ্গে সঙ্গে হুমকি দিলো উল্লাসী। পাপন সশব্দে হেসে উল্লাসীকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরল।
-“ওরে পাগলি! কোত্থাও যাব না। চিন্তা নিও না।” আহ্লাদী কণ্ঠে কথাটি বলতেই উল্লাসী শান্তি অনুভব করল। নিজের নাক পাপনের বুকের উপর ঘঁষতে লাগল মৃদু ভাবে…
পাপনের মনে হলো, এর চাইতেও কষ্ট আর পরিশ্রম করতে হলে করবে সে… তবুও উল্লাসীকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই জীবন তার, এই সংসার তার, আর এই ছোট্ট মেয়েটিও তার.. তাদের জীবনে অভাব থাকলেও, সুখপাখি তবুও ধরা দিয়েছে।
★
পড়ন্ত বড় চাচার ঘরের দিকেই যাচ্ছিল, বারান্দায় তার পথরোধ করে দাঁড়াল অভ্র। পড়ন্ত থমকে গিয়েও গেল না। সে যেন দেখেইনি, এমন ভঙ্গি করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে অভ্র পড়ন্তর এক হাত পেছন থেকে টান দিয়ে ধরল। পড়ন্ত গরম চোখে তাকাল। চাপা চিৎকারে বলে উঠল,
-“সমস্যা কী?”
অভ্রও সমান তেজ নিয়েই জবাব দিলো,
-“কথা বলতে চাই। তোর সমস্যা কী?”
-“আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি কথা বলতে চাই না।” মুখ বাঁকাল পড়ন্ত। হাত মোচড়ামুচড়ি লাগিয়ে দিলো, অভ্র এবার আরও শক্ত করে চেপে ধরল।
-“হাত ভেঙেই ফেলব একদম, এত তেজ তোর আসে কোথা থেকে?”
-“যেখান থেকে আসুক, সেটা তোমার দেখার বিষয় না অভ্র ভাই.. তুমি ছাড়ো আমার হাত। অন্যথায় আমি তোমার বউকে ডাকবো।”
অভ্র টিটকারির সুরে বলল,
-“বউ! আমার বউ! নিজেই নিজেকে ডাকবি? আচ্ছা, ডাক। আমিও দেখি একটু।”
পড়ন্তর গলার কাছে একটা কান্নার রোল উঠে এসে দলা পাঁকিয়ে রইলো। পড়ন্ত নিজেকে শক্ত এবং স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে চোখ পাঁকিয়ে বলল,
-“আমি তোমার বউ না। তোমার বউ শায়লা।”
অভ্র সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো,
-“শায়লা আমার বউ না। আমার বউ তুই..”
-“আচ্ছা, শায়লা তোমার বউ না!” পড়ন্তর ঠোঁটে আচানক একরত্তি তাচ্ছিল্য খেলা করে উঠল।
-“সে তোমার বউ না, অথচ তার বুকে তোমার দাগ থাকে! বাহ… ভাবা যায়? হাস্যকর ব্যাপার স্যাপার!”
অভ্র এইবার যারপরনাই অবাক হলো। সেই সঙ্গে হাতের টান ঢিল হয়ে এলে পড়ন্ত ঝট করে টান মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ওই হাত ডলতে শুরু করল। অভ্র বেয়াদবটা বেশ ভালো ভাবেই চেপে ধরেছিল হাতখানা৷ ইশ! লাল হয়ে গেছে।
পড়ন্ত রক্তচক্ষু করে অভ্রর দিকে একটা চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে অভ্র ডেকে উঠল,
-“এই পড়ন্ত, দাঁড়া, তুই কী বললি? আমি বুঝলাম না।”
পড়ন্ত দাঁড়াল, অভ্রর দিকে দাঁট কটমটিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“ওহ এখন বুঝো না? সাধু বাবা? হুঁ? তোমার বউ…. তোমার বউয়ের বুকের উপর নখের আঁচড়। আমি নিজে দেখেছি। আর তুমি এখন নাটক করো? নাটক?”
অভ্র চোখজোড়া পিটপিট করে বলল,
-“শায়লার বুকের ভেতর আমার নখের আঁচড়? সিরিয়াসলি! ছি…! আমি ওকে টাচ করব? ওমন ফিলিংস নিয়ে? ইয়াক থু.. ” বলে সত্যি সত্যি একদলা থুতু পড়ন্তকে দেখিয়ে দেখিয়ে বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে ছুঁড়ে মারলো অভ্র। পড়ন্তর রাগ এবার মাথায় চড়ে বসল।
-“একদম নাটক দেখাবে না বললাম.. একদম না… নাটক হচ্ছে আমার সাথে! সিনেমা? তুমি যদি না-ই ছোও, তাহলে ওই আঁচড় এলো কোথাথেকে? আমি দিয়েছি?”
-“তুই দিবি কেন? ও নিজেই দিয়েছি কী-না দেখ গিয়ে… আমি যে বলতাম তোর মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি বলতে কিছু নেই। কথাটা আসলেই সত্য।” অভ্র পড়ন্তর গাল বরাবর একটা চড় মারতে গিয়েও থমকে গেল। রাগে ভেতরটা তেতো হয়ে উঠছে। যতটা না শায়লার জন্য লাগছে, তার থেকেও বেশি লাগছে পড়ন্তর উপর। এই বিশ্বাস তার! শায়লা এসে কী না কী দেখিয়েছে, আর তার জন্য বিয়েতে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছে সে? এত বড় সাহস!
পড়ন্ত ফের কিছু বলতে নেওয়ার আগেই অভ্র বলল,
-“কী ছুঁয়ে বললি বিশ্বাস করবি বল তো? আমি সত্যি বলছি, ওর সঙ্গে ওসব তো দূর.. এক ছাদের তলায় থাকতেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। যাকে ভালোবাসা যায় না, যার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান বা মর্যাদা আমার নেই, তার সঙ্গে একত্রে থাকার মতো কষ্ট আর কীসে আছে! তুই-ই বল। ওর আর আমার সম্পর্ক এখন সাপে নেউলের মতো। ওকে দেখলেই তো মেরে ফেলতে মন চায় আমার। কখন না ছাদ থেকে ধাক্কা মেরেই ফেলে দেই ওটাকে.. আর তুই বলছিস আমি ওর সাথে..! শোন পড়ু, আগে গিয়ে ভালোমতো যাচাই করে দেখ, আসলেই আমি সত্যি বলছি নাকি ও সত্য বলছে। তবে এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুই যদি এই বিয়েতে মত প্রকাশ করিস, তাহলে আমার আর কিছু বলার নাই। আমি তোকে যথেষ্ট বুঝিয়েছি। আমি মানছি, আমার ভুল ছিল। আমি সময়মতো স্ট্যান্ড নিতে পারিনি৷ কিন্তু এখন তো চাইছি কিছু একটা করতে তাই না? যার প্রতি আমার চোখ ফিরিয়েও দেখতে ইচ্ছা করে না, তার সঙ্গে কীভাবে জোর করে হলেও সম্পর্ক আগাবো বল? তুই যদি আমার না হস, তবুও আমি শায়লাকে ডিভোর্স দিবোই দিবো। ওর সঙ্গে এক ঘরে থাকা জাস্ট অসম্ভব!! আর ওর সাথে শুধু বিয়েটাই হয়েছে। এর বাইরে এমন কিছুই ঘটেনি যে আমি ওকে ফেলে তোকে বিয়ে করতে পারব না.. দ্বিতীয় বিয়ে আমাদের সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না,এটা ঠিক। বাট দ্বিতীয় বিয়ে করে যদি কেউ সুখী হতে পারে, তাহলে দোষটা কোথায়? যার প্রতি ভালোবাসা তো দূর, সম্মানটাই থাকে না, তার সঙ্গে টেনেটুনে কতদূর আগানো যায় জীবনে? বল পড়ু..”
অভ্রর চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। গতকাল রাতেই সে শুনেছে, পড়ন্ত নাকি মত দিয়ে দিয়েছে জাওয়াদদের প্রস্তাবে। তারপর থেকেই পাগলের মতো পড়ন্তর সঙ্গে একদণ্ড কথা বলার জন্য সময় ও সুযোগ খুঁজছিল অভ্র। কোনোমতেই পায়নি দেখে বারান্দায় সকাল থেকে এই পর্যন্ত ঘাপটি মেরে বসে ছিল সে। অবশেষে শেষ বিকেলে ম্যাডামের দেখা মিললো। ঘর ছেড়েও বের হতে কষ্ট বোধহয়!
অভ্রর এত অসহায় লাগল নিজেকে নিজের কাছেই… ভুল তো মানুষ মাত্রই করে। যদি মানুষ ভুল না করত, তাহলে ফেরেশতার সঙ্গে তার কী পার্থক্য থাকত? সেই ভুল শুধরে আজ যখন সবকিছু ঠিকঠাক করতে চাইছে তখন কেন পড়ন্ত শুনছে না? মানছে না? সংসার ভাঙা ঠিক না, এটা ঠিক। কিন্তু যেই সংসারের শুরুটাই অভিশপ্ত, সেই সংসারে আদৌও কী সুখ ধরা দেবে? পাগলেও নিজের ভালো বোঝে! নিজের সুখ বোঝে! তাহলে অভ্র কেন বুঝবে না? তার সুখ যে একজনের মাঝেই নিহিত.. আর সেটা পড়ন্ত। পড়ন্তকে ছাড়া অন্য কাউকেই ভাবতে চায় না সে। অন্তর্দহনে সারাজীবনের জন্য পুড়তে চায় না…
পড়ন্ত প্রত্যুত্তর করার জন্য যুতসই কিছু পেল না। তার শব্দভান্ডারে শব্দ মজুদ নেই। তার বুক চিঁড়ে ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, আজও ঠিক ভেবে পায় না সে। সবকিছু আগের মতোই আছে, তবুও কোথাও কী যেন একটা নেই! চারপাশে তাকালে শুধু ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একরাশ শূন্যতা তার মনবাড়ির ভেতর। সত্যি বলতে, শায়লার সংসার সে ভাঙতে চায় না, কিন্তু শায়লা অভ্রর সঙ্গে কোনোদিনও সুখী হবে না। সে না চাইলেও শায়লার সংসার ভাঙবে, এমনটা অভ্রই বলল মাত্র! আর ওটা সংসারের ক্যাটাগরিতেই পড়ে না! ওখানে সামান্য সমঝোতাটুকু নেই…
পড়ন্ত শায়লার কথা শুনে আর বুকে ওই আঁচড়ের দাগ দেখেই দিকদিশা হারিয়ে ফেলে জাওয়াদদের প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিল। আর দু’দিন বাদে শুক্রবার। সেদিন জাওয়াদদের পরিবার আসবে তাকে আংটি পড়াতে। তাই নিয়ে মোটামুটি একটা তোরজোর শুরু হয়েছে বাড়িতে। পড়ন্ত বড় চাচীর কাছ থেকে উপহার স্বরুপ কী চায়, সেটা জানার জন্যেই বড় চাচার ঘরে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
পড়ন্ত এতক্ষণ যাবত ভেবে রেখেছিল, সে বলবে, আমার কিছুই চাই না। শুধু তোমরা দোয়া দিও। কিন্তু এখন তার মত পাল্টেছে। সে চাইবে… কিছু একটা চাইবে। যেটা তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আত্মসম্মানবোধ মাঝে মাঝে ভালোবাসার কাছে হেরে যায়। মরণব্যাধি ‘ভালোবাসা’ যার একবার গভীর ভাবে হয়েছে,সেই জানে এর জ্বালা কতটুকু! কখনো সুখের আতিশয্যে পৌঁছে দেয়, আবার মাঝে মাঝে দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে মারে। তবুও মানুষ ভালোবাসে, ভালোবাসাকে ভালোবাসে, প্রতিমুহূর্তে বাসতে থাকে.. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাসতে চায়। কী অদ্ভুত সাইকোলজি! তাই না?
অভ্র নিজেকে সামলে নিলো। হাত দিয়ে পুরো মুখ ডলে চোখের পানিগুলো কার্নিশ টপকানোর আগেই মুছে নিলো।তার ভেতরটা কাঁদছে.. চিৎকার করে কাঁদছে। শুধু চাইছে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাক। একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে নিয়ে সংসার করা যায় না! গেলেও সেই সংসারে কেউ সুখী হয় না! আর আজীবন অসুখী থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে কেউ আসেনি… সবাই সুখী হতে চায়। যার কিচ্ছু নেই, একদম নিঃস্ব, সেই মানুষটাও গভীর রাতে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে সুখচিত্র দেখে…
অভ্র ভাঙা গলায় বলল,
-“পড়ু, তোর যদি মনে হয় এই বিয়েটা করে সুখে থাকবি, তাহলে কর। আমি বাঁধা দিবো না। কিন্তু প্লিজ, আমি তোকে ঠকিয়েছি, সময়মতো স্ট্যান্ড নেইনি, এর জন্যে এমন কোনো ডিসিশন নিস না, যাতে আজীবন দীর্ঘশ্বাসের ভীড়ে চাপা পড়ে যেতে হয়। আমি জানিরে পড়ু, ঘুম থেকে উঠে যাকে দেখার জন্য চোখজোড়া উদ্ভ্রান্ত হয়ে ওঠে, তাকে বাদে অন্য কাউকে দেখলে কতটা ক্ষতবিক্ষত হয় ভেতরটা। তুই শুধু একঘরে আমাকে আর শায়লাকেই থাকতে দেখলি। অথচ দেখলি না,শায়লার পাগলপানা দেখেও নিজেকে কীভাবে আমি শক্ত করে রেখেছি। নিজেকে কোনো মতেই পুরুষত্বের কাছে মাথা নোয়াতে দেইনি। শায়লাকে আমি ছুঁয়েছি, তবে সেটা জিদে, রাগে, ক্ষোভে। ওকে মারতে গিয়ে ছুঁয়েছি। ভালোবেসে না… তুই বলবি, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। শায়লাকে একসময় না একসময় আমি মেনে নেবো! আসলে এটা তখন হতো, যখন আমার জীবনে তুই থাকতি না। তখন জোরজার করে হলেও একজনের প্রতি মন আঁটাতাম। আজ আমার আত্মা ‘তুই,তুই’ করে কাঁদে। তাহলে কীভাবে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসার স্পর্শ করবো? বল? শারীরিক সুখ ইজ নাথিং পড়ু… মনস্তত্ত্ব শান্তিটাই সব… সেই শান্তি আমি শায়লার থেকে কোনোদিনই পাবো না। আর পেলেও ওকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারব না। আমার সব চিন্তাভাবনা তোর কাছে গিয়েই থামে। যদি পারিস, আমাকে একটা সুযোগ দিস পড়ু। আমি এবার পরিবার, সমাজ, কারো কথাই ভাববো না। ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে, পাপনকে দেখেই বুঝলাম। কত ছোট আমার চেয়ে! অথচ কত বড় একটা স্টেপ নিলো! আমার ভেতরে সাহস ছিল না পড়ু, পাপন সেই সাহস জাগিয়ে তুলেছে। এবার আমি সত্যি সত্যি তোকে যেভাবেই হোক, নিজের করে পেতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দিস পড়ু… জাস্ট একটা।”
হাতজোড় করে ফেলে কথাগুলো বলতে বলতে। পড়ন্ত আর সহ্য করতে পারে না। দ্রুত পায়ে অভ্রর সামনে থেকে সরে গেলে অভ্র হাঁটু ভেঙে ওখানেই বসে পড়ে। সবটাই শেষ… পড়ন্ত আর কোনোদিনও তার দিকে ফিরে তাকাবে না! পড়ন্তর জীবন থেকে অভ্র নামটাই মুছে ফেলবে হয়তো একসময়… আর অভ্র ‘পড়ু, পড়ু’ করেই শেষ শ্বাসটা ছাড়বে।
হাঁটুতে হাত রেখে মাথাটা নিচু করে ফেলে অভ্র। চোখ দিয়ে কখন যে পানি বেরিয়ে আসলো,সেটা সে টের পেল না। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শ পাওয়ায় অভ্র চকিতে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে পেছন ঘুরতেই দেখল, নিতু দাঁড়িয়ে…
নিতুর চোখজোড়ায় প্রশ্নরা খেলা করছে। অভ্র আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলার চেষ্টা করল,
-“ইয়ে মানে..”
তার আগেই নিতু বলে উঠল,
-“আমি সব জানি ভাইয়া।”
অভ্র চুপসে গেল। নিশ্চয়ই পড়ন্তর থেকে শুনেছে। পড়ন্ত আর নিতুর তো গলায় গলায় ভাব! অভ্র কথা বাড়ালো না। এগিয়ে চলে যেতে চাইলে নিতু বলে উঠল,
-“আপা এত সহজে মানবে বলে মনে হয়। মাঝে আছে একদিন মাত্র। তারপরই আপার এনগেজমেন্ট। এর আগেই যা করার করে ফেলো ভাইয়া। নইলে আজীবন পস্তাতে হবে তোমাদের দু’জনকে। ভালোবাসার মাঝখানে ইগোকে আসতে দিও না ভাইয়া। আমি ছোট মানুষ, তোমাকে আর কীইবা জ্ঞান দিব! তাও বলব, যা ভালো মনে করো,তাই করে ফেলো। আমাদের পরিবার কখনোই তোমাদের অনুভূতির মর্যাদা দিবে না। তার উপর এখন তুমি বিবাহিত।”
অভ্র নিতুর দিকে তাকালে নিতু আশ্বস্ত ভঙ্গিতে হাসল।
-“আমি দোয়া করি, তোমরা যেন এক হতে পারো, আর সুখী হও। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা ছাড়া আর কীইবা আছে বলো!”
অভ্র জবাব দিলো না। চুপচাপ প্রস্থান করলো।
★
নিজের ঘরে বসে গভীর ভাবনায় ডুবে রয়েছে অভ্র। কী করবে তার মাথায় আসছে না। একটা উপায় অবশ্য পেয়েছে। কিন্তু পড়ন্ত… ও কী রাজী হবে? পড়ন্ত তো তাকে সুযোগই দিতে চায় না! তার উপর এই শায়লা তো গোদের উপর বিষফোঁড়া! অভ্রর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনি ঘরের ভেতর আবির্ভাব হলো শায়লার। অভ্র চোয়াল শক্ত করে ফেলল। মনে মনে বলল,
-“শয়তানের নাম নিছি, আর শয়তান হাজির হয়ে গেছে!!”
শায়লা গুনগুন করে গান গাইছে। তার মনে আনন্দ যেন আর ধরে না। এত আনন্দের কারণ পড়ন্তর বিয়েতে রাজী হয়ে যাওয়া…আরও একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে শায়লা। পড়ন্তর বিয়ের পর পরই যেভাবেই হোক, অভ্রর সাথে ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করবে সে। দরকার পড়লে উল্টাপাল্টা জিনিস খাইয়ে অভ্রকে বেকায়দায় ফেলে হলেও করবে। তবুও একটা বাচ্চা তার চাই.. বাচ্চা হয়ে গেলে অভ্র আর কখনোই তাকে ফেলতে পারবে না। তাকে মানতে বাধ্য হবে এবং এই পরিবারেও তার গুরুত্ব বাড়বে। নিজের তারিফ নিজেকে করতে হয় না কখনোই, তবুও শায়লা মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রশংসনীয় মন্তব্য করল। কীভাবে নিজের বুকে নিজে নখের আঁচড় টেনে পড়ন্তকে ঘোল খাইয়ে বিয়েতে রাজী করালো- ভাবতেই শায়লা উত্তেজিত হয়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে খুশির সাগরে ঢেউ খেতে লাগল সে। আলমারির পাল্লা খুলে একটার পর একটা শাড়ি সরিয়ে পছন্দনীয় কোনো রংই চুজ করতে না পেরে এবার পেছন ঘুরে তাকাল। টিটকারির সুরে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“কোন শাড়িটা পড়ব? একটু বেছে দাও তো..”
অভ্র কিছুই বলল না। সে চুপচাপ শায়লার আনন্দ দেখছে। তার ভেতরটা যে রাগে ফুঁসে উঠছে জলামুখীর মতো, তা চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে না।
শায়লা একা একাই স্বগতোক্তি করল,
-“পড়ন্তটার এনগেজমেন্ট, আমাকে সুন্দর করে রেডি হতে হবে তো সেদিন৷ বাট একটা শাড়িও পছন্দ হচ্ছে না। এই, আমাকে নিয়ে একটু শপিংয়ে যাবে? একটা নতুন শাড়ি কিনতাম.. তুমি কী পরবে? পাঞ্জাবি? নাকি শার্ট?”
বলতে বলতে ঠোঁট চিঁড়ে ফিচেল হাসি খেলা করতে শুরু করল। অভ্র নির্নিমেষ চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে শায়লা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। যদিও অভ্রকে এভাবে জ্বালাতে তার ভালো লাগছে না, তবুও এমনটা করছে তাকে চড় মারার অপরাধে। যতক্ষণ অবধি পড়ন্তর বিয়েটা না হচ্ছে, অভ্রকে তার চূড়ান্ত শাস্তি স্বরুপ টিটকারিগুলো শুনে যেতে হবে। তারপর শায়লা অভ্রকে একদম আপন করে নিবে। অভ্রকে নিজের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে বলবে মন খুলে…
বড় চাচীর সঙ্গে পড়ন্তর কী কথা হলো, কে জানে! রাতের সময় তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। তার চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে রইলেও চেহারায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি। অভ্র বারান্দার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে তারই অপেক্ষা করছিল। পড়ন্ত অভ্রকে দেখতে পেয়ে এবার আর উপেক্ষা করল না বরং নিজেই আগ্রহ করে তার দিকে এগিয়ে গেল। হাত ইশারায় ডেকে বলল,
-“একটু এদিকে আসবে? কথা আছে।”
অভ্র বলল,
-“আমারও কথা আছে। নিচে আয়। ওখানে কথা বলব। এখানে কেউ না কেউ দেখতে পারে।”
পড়ন্ত রাজী হয়ে গেল। অভ্র চলে গেল আগে আগে, পড়ন্ত পেছন পেছন গেল। মেইন গেট খুলে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলল অভ্র। পড়ন্ত অবাক হলেও থামল না। তাকে অনুসরণ করে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর অভ্র থামল। তারা বড় রাস্তায় চলে এসেছে। পুরো রাস্তা নির্জন। একটা মাইক্রো অবহেলায় রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর কোথাও কেউ নেই। পড়ন্ত ডাকল,
-“এই.. এখানে নিয়ে এলে কেন?”
অভ্র পেছন ফিরে তাকাল। পড়ন্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই তার খুব কাছাকাছি চলে এসে একটা রুমাল নাকের সামনে তুলে ধরল।
-“ঘ্রাণটা জোস না?” বলতে বলতে পড়ন্তর নাকের ভেতর পারে না রুমালটা গুঁজে দেয় সে। পড়ন্ত একটা তীব্র গন্ধ পেল। সেই সঙ্গে তার ব্রেইন ক্রমশ ভোঁতা হয়ে আসতে লাগল। চোখজোড়া এত ভারী হয়ে গেল, খুলে রাখা দায়। পড়ন্ত চেতনা হারানোর আগে শুনতে পেল, অভ্র বলছে,
-“আই এম সরি পড়ু। এছাড়া আর কোনো উপায় আমার জানা ছিল না। তোকে আমি খুব আদরে রাখব, প্রমিস…”
পড়ন্ত প্রত্যুত্তর করতে পারল না। অভ্রর গায়ের উপর নেতিয়ে পড়ল।
চলবে..