অন্তর্দহন_১৬ শেষ
অলিন্দ্রিয়া_রুহি
বিয়ের আনন্দ, হৈচৈ সরে গিয়ে একধরনের গম্ভীর নিস্তব্ধতা বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে গ্রাস করে নিয়েছে। পড়ন্ত হেচকি তুলে কতক্ষণ কেঁদেকেটে এখন শান্ত হয়ে রয়েছে। অভ্র কোথায় যেন বেরিয়েছে, কেউ জানে না। প্রতিবেশীরা যার যার মতোন খেয়েদেয়েই বিদায়। কেউ এক মিনিট স্বান্তনা দেওয়ার জন্যেও এগিয়ে আসেনি। খাওয়া শেষ, থেকে কী হবে? জাওয়াদের বড় মামা তুমুল হৈচৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি, সবাইকে উদ্দেশ্য করে চিটার-বাটপার ইত্যাদি বলে গিয়েছেন। পড়ন্তকে তো সোজাসাপটা চরিত্রহীন বলেছেন। আর অভ্রকে খিস্তি দিয়েছেন। জাওয়াদও এসেছিল।তবে সে কারো উপর রাগ বা আক্রোশ প্রকাশ করেনি। সে এসেছিল তার মামাকে থামাতে। পারেনি। পড়ন্তর দিকে অসহায় চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিদায় নিয়েছে। তারপর থেকেই পড়ন্তর কান্না থামছে না। তার জন্য আজ পরিবারে কতকিছু ঘটে গেল! এরা জানলোই বা কার থেকে যে পড়ন্তর বিয়ে হয়ে গেছে অভ্রর সঙ্গে? পরে শুনলো, বিকেলে যেই প্রতিবেশীকে তার মেয়ে নিয়ে খোঁটা দিয়েছিল পড়ন্ত, সেই নাকি কথাগুলো লাগিয়েছে। এও বলেছে, পড়ন্তর পেটে ভুলক্রমে অভ্রর বাচ্চা চলে আসায় দ্রুত বিয়ে দিয়ে মিটমাট করছে। পড়ন্ত অবাক হয়। মানুষের মন-মানসিকতা তাকে বারংবার বিস্ময়ের উঁচুতে পৌঁছে দেয়।
নিতু হন্তদন্ত পায়ে ঘরে ঢুকলো।
-“আপা..” ডাকলো পড়ন্তকে। পড়ন্ত সাড়া না দিয়ে নিতুর দিকে তাকালে নিতু দাঁত কটমট করে বলল, “তোমার চরিত্র নিয়ে নাকি কথা বলেছে? আমি বাথরুমে ছিলাম, তাই তখন শুনতে পারিনি।”
পড়ন্ত বিষন্ন কণ্ঠে মাথা দোলালো।
-“কত্তবড় সাহস! তুমিও এমনি এমনি ছেড়ে দিলে? খালি বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়েছে তাতেই কী মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? ভালোই হয়েছে, ওরকম একটা পরিবারে তোমার বিয়ে না হওয়ায়। বিয়ে হলে তো পুরো জীবনটাই তাদের আয়ত্তে নিয়ে নিতো। আর ওই জাওয়াদ ব্যাটা কিছু বলতে পারে নাই? সেই বা কেমন পুরুষ মানুষ?”
-“আমার মনে হয় কী, উনি আসলে উনার মামাকে থামাতে আসছিল। আমার উপর কোনো রাগ বা অভিমান তো দেখলাম না।”
-“হইছে, যে থামানটা থামাইছে। তোমার কাছে ওই ব্যাটার নাম্বার আছে?”
পড়ন্ত ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“কেন?”
-“লাগবে। কিছু উপহার আছে উনার জন্য।”
-“আমার কাছে কোনো নাম্বার নেই।”
-“থাকলেও তুমি দিবে না। মানুষকে ছেড়ে দিয়ে মহান সাজতে চাও সবসময়। আর এভাবেই ছাড়তে ছাড়তে একদিন নিজের আত্মসম্মান খুঁইয়ে বসবা। হুহ!”
নিতু যেভাবে হুড়মুড় করে এসেছিল, সেভাবেই হুড়মুড়িয়ে চলে গেল। রেখে গেল পড়ন্তর হতভম্ব মুখ, নিতুর এই অযাচিত রাগের কারণ সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
রাত বারোটার দিকে মা,চাচীরা মিলে অভ্রর ঘরে বসিয়ে দিলো পড়ন্তকে। শায়লাকে তখন আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। পড়ন্ত তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস ও করল না। মা তাকে কিছু পরামর্শ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় পড়ন্ত বলল,
-“কেমন মা তুমি! আমার বিয়ে হয়ে গেল আর তুমি একটুও কাঁদলে না!”
নাসরিন মুখ ঝামটা মারলেন।
-“হ্যাঁ, তোর বিয়ে তো আমি বাংলাদেশের বাহিরে দিয়েছি। আর কোনোদিন দেখতে পারবো না, তাই শোকে কাঁদবো। ন্যাকামো যত্তসব।”
নাসরিন চলে গেলে পড়ন্ত একা একাই হাসলো। পুরো ঘরটা চোখ বুলিয়ে দেখল সে। সবকিছু চেনা, তবুও আজ কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। অন্যরকম একটা অনুভূতি বুকের ভেতর হুটোপুটি খেলছে। অভ্র এখনো আসেনি। পড়ন্ত নেমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা ফটো স্ট্যান্ড, সেটায় অভ্রর চার বছর আগের পুরোনো একটা ছবি। তখন কত বাচ্চা বাচ্চা দেখাতো অভ্রকে! আর এই চার বছরে হুট করে যেন পুরুষ হয়ে উঠেছে! পড়ন্ত আনমনেই হাসল। ছবিটার উপর হাত বুলিয়ে নিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
-“অনেক কষ্টে তোমায় পেয়েছি। আর কক্ষনো তোমার হাত ছাড়বো না। তাতে যাই হয়ে যাক না কেন..”
-“ওয়াদা করছো তো?” হঠাৎ অভ্রর কণ্ঠ কানে বাজলে পড়ন্ত দ্রুত হাতে ছবির স্ট্যান্ডটি ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে পেছন ঘুরে তাকাল। স্বস্তির দম ফেলতে ফেলতে বলল,
-“এভাবে হুটহাট কথা বলে আমাকে ভয় দেখানোর স্বভাব টা গেল না আর!”
অভ্র মুচকি হেসে দরজা আঁটকে দিলে পড়ন্তর বুকের ভেতর কেমন যেন খচখচ করে উঠল। যেদিন কাজী অফিসে বিয়ে করেছে তারা, সেদিন রাতেই অভ্রর এক বন্ধুর বাড়িতে বাসর হয়েছিল তাদের। তখনো এতোটা লজ্জা লাগেনি পড়ন্তর। তখন একটা ঘোরের ভেতর ছিল সে। আজ পারিবারিক ভাবে একত্র হতে পেরে, আবার ঘরের ডেকোরেশন দেখে পড়ন্তর মনে হচ্ছে, আজকেই বাসর রাত। আজকেই অভ্রর সঙ্গে প্রথম মিলনের রাত। অভ্র আর সে দু’জনে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে…
পড়ন্তর লজ্জায় দম গাঢ় হয়ে আসে। সে হাত-পায়ে কোনোপ্রকার শক্ত অনুভব করল না। অসাড় হয়ে এসেছে যেন সবকিছু। বুকের পাজরে পাজরে কাঁপন, রক্তের ছলকানি খানিক পর পর, তাকে কাঁপিয়ে তুলছে। এ কেমন মরণ অনুভূতি গো!
অভ্র এগিয়ে আসলে পড়ন্ত চোখ নামিয়ে নিলো সলজ্জে… অভ্রর ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। আচমকাই পড়ন্তকে নিজের বাহুডোরে আঁটকে নিলে সারা শরীরে একধরনের শিহরণ অনুভব করল পড়ন্ত। জমে গেল সেখানেই…
অভ্র বলে চলেছে,
-“আমি অনেক কষ্টে তোকে পেয়েছি। তুই আমাকে ওয়াদা করিস বা না করিস, আমি তোকে কোথাও হারাতে দিবো না। তোর সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া করবো না। আমাদের বিবাহিত জীবন পানসে হতে দিবো না। তোর জন্য আমার ভালোবাসা আজ যেমন, আগামী বিশ বছর পরেও তেমন থাকবে, যদি বেঁচে থাকি। আর যদি মরেও যাই..” পড়ন্ত অভ্রর মুখ চেপে ধরল। চোখ পাঁকিয়ে বলল,
-“হইছে! ডায়লগ.. খুব তো জাওয়াদের পরিবার দেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছো। একা ফেলে গেছো আমাকে।”
অভ্র দাঁত কেলিয়ে হাসল।
-“আবার ফিরে আসছি না?”
-“গেছিলে কই?”
-“মাঠে ছিলাম। খুব আপসেট লাগছিল বুঝলে। আমার জন্য আমরা কতকিছু ফেস করলাম! আব্বু-আম্মু, অন্যরা কতকিছু সহ্য করল! আব্বুকে সুদ্ধ অপমান করে গেছে। নিতে পারছিলাম না। এখানে থাকলে একটা মারামারি লেগে যেতো, তাই চলে গিয়েছিলাম।”
পড়ন্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
-“আমিও এমনটাই ভাবছিলাম জানো না। নিজের জন্য যত না, তার চাইতেও বেশি খারাপ লাগছিল বাবা-মাকে অপমান করেছে বিধায়। আমাদের কারণে আজ..”
পড়ন্তর চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। আজকের রাতটির মতো সুন্দর রাত আর আসবে না জীবনে। তাই বাজে স্মৃতিচারণ করে দুঃখ পাওয়ার চেয়ে সব ভুলে জীবনে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। অভ্র দ্রুত প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,
-“থাক, থাক। আচ্ছা, আমাকে আজ কেমন লাগছিল? বললে না তো।”
পড়ন্ত অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়েই মৃদু হাসল।
-“ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি কী?”
-“তাই? তাহলে এখন দেখে নাও। মন প্রাণ ভরে দেখো। এই যে…” অভ্র পড়ন্তর থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। পড়ন্ত ঠোঁট কামড়ে আপাদমস্তক পরখ করে নিয়ে থাম্পস আপ সাইন দেখালো আঙুল দিয়ে৷ মুখে বলল,
-“দারুণ.. খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
-“আর তোমাকে চমৎকার।”
পড়ন্ত ভ্রু নাচালো।
-“কার বউ দেখতে হবে না?”
-“হুম। শায়লাকে লেহেঙ্গা আর ভারী সাজেও এতটা সুন্দর লাগেনি, যতটা তোমাকে লাগছে।”
-“ইশশিরে.. এর ভেতর আবার শায়লা কোথথেকে আসলো?”
পড়ন্ত গাল ফুলায়।
-“তোমার মুখে এখনো শায়লা শায়লা.. ব্যাপার কী?অজান্তেই মন দিয়ে বসেছো নাকি?”
এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর জিদ নিয়ে বসলে অভ্র দু’হাতে কান চেপে ধরল।
-“সরি সরি.. ভেরি সরি জানপাখি। আর বলব না। আর কী যে বলো না তুমি! মন কী এতই সস্তা? যখন তখন একে ওকে দিয়ে দিলাম? তবে আমার খারাপ লাগে ওর জন্য।”
-“কেন?” ক্রুর দৃষ্টিতে চাইলো পড়ন্ত।
-“তুমি যা ভাবছ তা না আসলে। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, ও যদি পাগলামিটা না করতো, তাহলে আজ অকালে গায়ে তালাকের ট্যাগটা লাগতো না ওর। ভালো জায়গায় বিয়ে করে সুখী হতো। আমরাও হতাম। ওর কারণেই কতকিছু ঘটে গেল! যাক গে.. যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ধাক্কা না খেলে মাথার বুদ্ধি খোলে না।”
পড়ন্ত একমত হলো।
-“ওর জীবনটাও একদিন সুন্দর ভাবে সেজে উঠবে। দেইখো। আমরা দোয়া করবো ওর জন্য। আর কোনো কূটবুদ্ধিতে না গেলেই হয়।”
-“মনে হয় না। দারুণ শিক্ষা পেয়ে গেছে।”
-“হুম।”
অভ্র শরীর থেকে পাঞ্জাবি খুলে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল। পড়ন্ত তখনো বসে, আঁড়চোখে অভ্রকে দেখছে।
অভ্র বলল,
-“বাতি জ্বলবে?”
-“তাহলে ঘুম আসবে না।”
-“তাহলে নেভাও।”
-“আমি পারব না।”
বলে পড়ন্ত নিজের নখ খুঁটতে লাগল। অভ্র মুচকি হেসে এক টানে পড়ন্তকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলে পড়ন্ত কপট রাগে বলে উঠল,
-“এভাবে টান দাও কেন? হাত খুলে ছুটে আসলে?”
-“এভাবে লজ্জা পাও কেন?”
-“জানি না।” বলে চোখ নামিয়ে অভ্রর বুক থেকে সরে পাশে শুয়ে পড়ল সে।
-“আমার ঘুম পাচ্ছে।”
-“দুই ঘন্টা পর।” চোখ পাঁকালো অভ্র।
পড়ন্ত মুখ ভেংচি কেটে অন্যপাশে ঘুরলো। অভ্র উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে দিয়ে পড়ন্তর গা ঘেঁষে শুয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর ধীর হাতে পড়ন্তর গায়ের উপর হাত রাখতেই চমকে উঠল সে। পড়ন্ত কাঁপছে, কাঁদছে কেন ও? ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল অভ্র।
-“পড়ু.. এই পড়ু, কাঁদিস কেন? কী হইছে?”
পড়ন্ত বলল না কিছু। কেঁদে যাচ্ছে নিরবে। অভ্র তাকে সোজা করে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিলে পড়ন্তর কান্নার বেগ বাড়লো। অভ্রর বুকটা ঢিপঢিপ করছে। কী এমন হলো যে এভাবে কাঁদছে মেয়েটা!
-“আহা না বলে ভেউভেউ করলে বুঝবো কী করে?”
-“আমার কান্না ভেউভেউ?” নাক টেনে বলল পড়ন্ত।
-“তার চেয়েও জঘন্য।” হালকা দুষ্টুমির স্বরে কথাটি বলতেই পড়ন্ত কান্না থামিয়ে অভ্রর পিঠে চটাস করে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
-“যার জন্য চুরি করি, সেই বলে চোর। যার জন্য কাঁদলাম, তার কাছে আমার কান্না ভেউভেউয়ের চেয়েও জঘন্য! বাহ.. কী কপাল গো আমার। এই সরো.. শোবোই না তোমার বুকে।”
অভ্র ফিক করে হেসে উঠল।
-“মারবো এবার। কাঁদছিলি কেন? বল আমাকে।”
-“বলব না।”
-“ওবাবা! অভিমান?”
-“কচু..”
-“রাগ?”
-“তোমার মাথা।”
-“আর তোর মন্ডু।” বলে পড়ন্তর নাকে নাক ঘঁষে দিলো অভ্র।পড়ন্ত চুপসে গেল৷ তার ভীষণ ভালো লাগছে।
-“আমি জানি তুই কেন কাঁদছিলি।”
-“কেন?” গাঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল পড়ন্ত।
-“আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে..”
পড়ন্ত আবারও মিইয়ে গেল। অভ্রটা সব বুঝে যায়। খাটাশটার বসবাস তার মনের গভীরে…
★
ওদিকে যখন রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, এদিকে তখন ঝাড়াঝাড়ির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ছোট চাচার ফোন থেকে আলগোছে জাওয়াদের নাম্বারটি টুকে সোজা ছাদে চলে আসে নিতু। ঘরে শায়লা বর্তমান, তার সামনে কথা বলা যাবে না। তাই হাওয়া খাওয়ার নাম করে ছাদে আসা নিতু জাওয়াদের চৌদ্দগুষ্টি ধুঁয়ে দিচ্ছে। আধঘন্টা যাবত চেঁচামেচি শেষে আর কোনো গালি মনে করতে না পেরে ঝগড়া থামাতে বাধ্যই হলো সে। ওদিকে জাওয়াদ তখন চুপচাপ, যেন এত গরম গরম কথাও তার কানে ঢোকেনি।
নিতু গমগম স্বরে বলল,
-“কারো চরিত্র নিয়ে কথা বলতে আপনার লজ্জা লাগল না?”
জাওয়াদ ইনোসেন্ট কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-“আমি তো বলিনাই, মামা বলছে।”
-“আর আপনি চুপ থেকে তাতে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।”
-“তো কী করা উচিত ছিল আমার?”
-“আপনার মামা’কে ধমক দিয়ে চুপ করাতে পারলেন না?”
জাওয়াদ মৃদু হেসে বলল,
-“আমার তো তোমার মতো এত চিল্লাচিল্লি করার অভ্যেস নেই নিতু।”
আগুনে ঘি ঢাললো জাওয়াদ। চিৎকার করে বলে উঠল নিতু,
-“আমাকে আপনার ঝগড়াইটা মনে হয়?”
জাওয়াদ দ্রুত উত্তর দিলো,
-“না, না, তা কখন বললাম?”
-“আপনার কথাবার্তা কিন্তু সেটাই বোঝা গেছে। শুনুন, আমরাও না আপনার ওই মামার মতো না। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে বিশাল হাঙ্গামা করার অভ্যাস নাই। আপনাকে ফোন দিয়েছি এই কারণে যে…”
বাকি কথা শেষ করল জাওয়াদ।
-“আমার বংশর পিন্ডি চটকাতে।”
হুংকার ছাড়ল নিতু।
-“রাগ বাড়াচ্ছেন কিন্তু। ওরকম পরিবারের পিন্ডি কেন, ধরে সদস্যগুলোকেও চটকাতে পারলে খুশি হতাম। ইশশিরে, বিয়ে হয় নাই কিছু না, তাতেই একদম মাথা কিনে ফেলেছে যেন! আর বিয়ে হলে না জানো কী কী হতো! ভাগ্য ভালো, পড়ন্ত আপুর বিয়েটা আপনার সাথে হয়নি। আপনাদের মতো ফ্যামিলির থেকে বেঁচে গেছে। হুফ..”
-“হুম, আসলেই, বিয়েটা না হয়ে ভালোই হয়েছে।”
এই কথাটির মধ্যে কেন যেন অন্যরকম কিছুর আভাস পেল নিতু। একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। ওদিকে জাওয়াদ হেসে বলল,
-“থেমে গেলে কেন? যুতসই গালি পাচ্ছো না? কুকুর থেকে শুরু করে টিকটিকি পর্যন্ত সবগুলো প্রাণীর উপাধি তো আমাকে দিয়ে দিয়েছো। আর কী কিছু খুঁজে পাচ্ছো না? আমি সাহায্য করব? জলহস্তী কিন্তু বলোনি!”
নিতুর গলার আওয়াজ এবার আরও চড়লো।
-“আপনি কী মজা করছেন আমার সাথে?”
-“না নিতু। তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। কোনোটা মিস যেন না যায়।”
-“শুনুন, আপনার বাজে প্যাঁচাল শোনার জন্য ফোন দেইনি। আমার আপাকে আপনি সরি বলবেন। তার ক্যারেক্টার নিয়ে কথা বলার আপনারা কেউ না।”
-“আচ্ছা। বলব। তার জন্য তো তোমাদের বাসায় আসতে হবে আমাকে।”
-“দরকার পড়লে আসবেন।” বলেই আবার তড়িঘড়ি করে নিতু বলল,
-“কেন,কেন? ফোনে বলবেন। বাসায় আসার দরকার নেই। আপনাকে একা পেলে আমার চাচারা ভর্তা বানাবে।”
-“বানালে বানাবে। তাতে তোমার কী? নাকি আমাকে মারলে সেটা তোমার সহ্য হবে না? হুঁ?”
নিতু থতমত খেয়ে গেল। ইতর ব্যাটা। বারবার কথার জ্বালে ফাঁসিয়ে দেয়।
নিতু দ্রুত বলল,
-“রাখছি।”
-“কথা বললে ফেঁসে যাবে ভাবছো?”
নিতু জবাব না দিয়ে খুট করে কল কেটে দিয়ে আনমনে হেসে উঠল। লোকটা বদের হাড্ডি, তবুও কেমন মায়ার জালে টানে… গলার স্বর ভরাট, পুরুষালি.. নিতুর পুনরায় তার সঙ্গে কথা বলতে মন চাইলো। সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধিক্কার জানালো। আবেগী মন কখন কী চায়, বোঝা যায় না। নিতু দ্রুত ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো।
★
আজ অভ্রর বিদায়ের দিন। মাঝে তিন মাস কেটে গেছে। পড়ন্তর শরীরটা দুর্বল আগের চাইতে। ইদানীং কিছুই খেতে পারে না। খাবার দেখলেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। মনে হয় নাড়িভুঁড়ি সুদ্ধ বেরিয়ে আসবে। অভ্র ধমক ধামক দিয়ে এতদিন খাওয়ালেও এখন একটু চিন্তিত সে। কে খেয়াল রাখবে পড়ন্তর? অনেক অপেক্ষার পর প্রতিক্ষিত ইউনিভার্সিটিতে পড়ার চান্স পেয়েছে সে। ফুল ফ্রি স্কলারশিপ। একবার ওখান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে পারলে তার লাইফ সেটেল্ড। তমিজ উদ্দিন ও অনেক বুঝিয়েছেন, বুঝিয়েছে পড়ন্তও। দুটো মাত্র বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয়। এটাই নিয়ম! এতদিন অভ্রকে নিজে বুঝিয়ে আসলেও আজ ভীষণ খারাপ লাগছে পড়ন্তর। ভেতরটা ভেঙেচুরে আসতে চাইছে। নিজের কাছ ছাড়া করতে মন সায় দেয় না। তার উপর সে গর্ভবতী। এই সময়ে প্রতিটি মেয়ে তার স্বামীর সোহাগ চায়, তার স্বামীকে পাশে চায়। পড়ন্তও এর ব্যতিক্রম নয়। অভ্রকে অবশ্য তিন চাচীই আশ্বস্ত করেছে, পড়ন্তর এতটুকু ত্রুটি তারা হতে দেবেন না। আর ইন্টারনেটের যুগে কথা,দেখা, সারাক্ষণই হবে। বিদেশ গিয়ে নিজের জীবন টা সেটেল্ড করলে তার এবং তার ফিউচার সন্তানের জন্যই বেশি ভালো। অবশেষে অভ্র রাজী হয়েছে।
রাত একটায় কানাডার ফ্লাইট। সন্ধ্যের পর পরই বেরিয়ে যাবে তারা। পড়ন্তও যেতে চেয়েছিল, অভ্র মানা করল। প্রথমত, এই শরীর নিয়ে জার্নি না করাটাই ভালো। দ্বিতীয়ত, পড়ন্তকে চোখের সামনে রেখে কোনোমতেই পা আগাতে পারবে না অভ্র। নিজের স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এতবড় স্টেপ নিয়েছে সে। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। সে ভেঙে পড়লে পড়ন্তও ভেঙে পড়বে। মাগরিবের আযান পড়ে গেছে, তবুও খোলা চুলে ছাদে একাকী বসে আছে পড়ন্ত। তার দু-চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝড়ছে। বুকটা দুমড়েমুচড়ে আসছে কষ্টে.. অভ্রকে দুই মিনিট চোখের সামনে না দেখলে খারাপ লাগে যার, সে কী করে দুইটা বছর তাকে ছাড়া থাকবে? ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে পরিবেশ ভারী করে তুলছে।
অভ্র রাগ রাগ ভাব নিয়ে ছাদে এলো। যদিও ভেতর থেকে রাগ আসছে না তার, একরাশ যন্ত্রণারা হৈচৈ করছে। তবুও পড়ন্তকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।
-“তোর সাহস তো কম না..”
পড়ন্ত চমকে উঠল। অভ্র এখনো তাকে ‘তুই’ ‘তুমি’ দুটো মিলিয়ে ঝিলিয়ে ডাকে।
পড়ন্ত চোরা হাসলে পড়ন্ত চড় দেওয়ার ভঙ্গিমা করল।
-“এখনি এই অবস্থা? আমি গেলে তো নিজের প্রতি খেয়াল রাখাই ছেড়ে দিবি। এই ভরা সন্ধ্যায় এই শরীর নিয়ে ছাদে কী তোর? তার উপর চুল খোলা। মাথা ঢাক..” ধমক লাগাল অভ্র। তারপর নিজেই ওড়না টেনে মাথায় পরিয়ে দিলো। গলার স্বর খানিকটা নরম করে বলল,
-“নিজেই তো বুঝিয়েছিস এতদিন, আমার যাওয়া উচিত। আর আজকে নিজেই এমন লাগিয়েছিস। তাহলে আমি যাই কী করে বল? ক্যান্সেল করে দেই?”
পড়ন্ত দ্রুত এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো।
-“এই না.. আমি কী ক্যান্সেল করতে বলছি?”
-“তাহলে কথা দে, নিজের যত্ন করবি।”
-“কথা দিলাম।”
-“আমায় ছুঁয়ে বল।”
পড়ন্ত অভ্রকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। খামচে ধরল পিঠের চামড়া, অভ্রর ব্যথা লাগলে টু-শব্দটি করল না। নিজের চোখজোড়াও ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।
-“তোমাকে খুব মনে পড়বে…” কান্নারত কণ্ঠে বলল পড়ন্ত।
-“মরে যাচ্ছি নাকি?” ভ্রু বাঁকিয়ে কথাটি বলতেই পড়ন্ত অভ্রকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল।
-“ধরবোই না তোমাকে। যাও মরো..”
অভ্র জল চোখে হাসল।
-“যাওয়ার সময় তোর রাগ মুখ দেখে যাব?”
পড়ন্ত নিভলো একটু। মুখ গুমোট করে বলল,
-“তাহলে মরার কথা কেন বলো?”
অভ্র কান ধরল,
-“আর বলব না। একটু এদিকে আয় না। জড়িয়ে ধর। আমার না খুব কান্না কান্না পাচ্ছে রে..”
বলতে বলতে অভ্র কেঁদে উঠল। পড়ন্ত হতবাক! অভ্র কাঁদছে? তার জন্য? তাকে এত ভালোবাসে? সামলে রাখতে পারল না নিজেকে আর.. অভ্রকে শক্ত বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে কেঁদে গেল দু’জনে…
কতক্ষণ কাঁদল জানে না কেউ। একসময় বড় চাচী অভ্রর খোঁজে ছাদে এসে দু’জনকেই এভাবে কাঁদতে দেখে নিজেও শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। তার বুকটা এখনি খালি খালি লাগছে।
-“তোর যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বাবা।”
অভ্র সোজা হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। পড়ন্তর চোখ মুছিয়ে দিয়ে মায়ের হাতে পড়ন্তকে তুলে দিয়ে বলল,
-“আমার সবচে মূল্যবান সম্পদটা আমি তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম মা। দেখে রাইখো।”
-“রাখবো বাবা, রাখবো।”
বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে কান্নারত চোখে অভ্রর চলে যাওয়া দেখলো পড়ন্ত। অভ্রদের গাড়ি যখন রাস্তার মোড় ক্রস করে চলে গেছে, পড়ন্ত ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
-“তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না প্রিয়। জলদি ফিরে এসো। অপেক্ষায় থাকবো..”
পড়ন্তর কান ঘেঁষে একটা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল। মনে হলো, অভ্র বলছে,
-“আসবো প্রিয়তমা, আসবো আমি…”
(সমাপ্ত)