অন্তর্ধান,পর্ব – এক

0
501

গল্প
“অন্তর্ধান”
পর্ব – এক

আমার ওয়াইফ মেহরিনকে আজ দুপুর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
লাঞ্চ ব্রেকের একটু আগে একটা প্রজেক্টের ফাইল নিয়ে বসেছি,কাজ প্রায় শেষের দিকে, ঠিক তখন মায়ের নাম্বার থেকে কল এলো। একটু অবাকই হলাম। এসময়ে মা সাধারণত কল দেন না। কিছু দরকার হলে মেহরিনকে দিয়ে বলান। এই যেমন হয়তো মায়ের পান সুপারি ফুরিয়ে গেছে। মা মেহরিনকে বলেন,

-বৌমা, বাবুকে কল দিলে বলিওতো আসার সময় যেন পান সুপারি নিয়ে আসে। আর সুপারি যেন কাঁচাটা নেয়। গতবার যেই সুপারি আনছিলো খাইতে পারি নাই। কেমন একটা গন্ধ করে।

মেহরিন মায়ের কথাগুলো হুবহু রিপিট করে।

-শোনো, আসার সময় মায়ের পান সুপারি আনবা। আর সুপারি কাঁচাটা নিও। গতবার যেই সুপারি আনছিলা মা খেতে পারে নাই। কেমন একটা গন্ধ করে।

হাতের কাজ রেখে মায়ের ফোনটা ধরলাম,

-হ্যালো আম্মা, আসসালামুয়ালাইকুম।

-ওয়ালাইকুমুস সালাম। বাবু, কোথায় তুই?

-আমিতো অফিসে।

-লাঞ্চ করেছিস?

-এইতো মা এখন করব।

-বৌমার সাথে তোর কি কথা হয়েছে?

-নাতো,কেনো কি হয়েছে?

-বৌমাতো বাসায় নাই। কোথায় গেছে তোকে কি বলে গেছে?

-বাসায় নাই মানে ? কখন গেছে? আমাকে তো কিছু বলেনি। তোমাকে বলে যায়নি?

– নাতো,আমি নামাজ পড়ে একটু বিছানায় হেলান দিয়েছি। কোন ফাঁকে চোখ লেগে এসেছিল। রাহির কান্না শুনে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি রাহি ঘরে একা কাঁদছে । আর মেইন গেইট বাহিরে থেকে আটকানো।

রাহি আমার আড়াই বছরের ছেলে।

– আমাকেতো কিছু বলেনি। দেখো হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে।

-আশেপাশে কোথায় যাবে? কখনো তো কোথাও যায় না। আমি পাশের বাসার নীলুকে কল দিয়ে দরজা খুলে নিলাম। এভাবে বাইরে থেকে গেইট আটকে যাবার মতো মেয়েতো ও না। তুই একটু দেখতো বৌমার বোনের ওখানে ফোন দিয়ে। হয়তো ঐ বাসায় গেছে।

মেহরিনের ফুপাতো বোন নওশীন আপা। ওনার বাসা মিরপুরে। এতোদূর গেলে মাকে না জানিয়ে বাইরে থেকে গেইট লাগিয়ে তো যাবার কথা না।

-আচ্ছা মা, আমি দেখছি।

-আর শোন,রাহিতো খুব কান্না করছে। মা মা করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। আমিতো সামলাতে পারছিনা ওকে।

– তুমি ওকে মোবাইলে একটা কার্টুন চালু করে দাও। হয়তো কান্না থামবে ওর।

ফোন রেখে মেহরিন এর ফোনে কল দিলাম। মোবাইল সুইচড অফ দেখাচ্ছে। আমাদের ঝগড়া হলে ও এমন মোবাইল অফ করে রাখে।

মনে করার চেষ্টা করলাম আজ সকালে বা গতকাল রাতে ওর সাথে কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া হয়েছে কিনা। সাধারণত ওর সাথে আমার ঝগড়া তেমন একটা হয় না। এর কারণ হলো ও যখন কোনো কিছু নিয়ে রেগে যায় আমি তখন চুপচাপ থাকি। কারণ আমিই কোনো না কোনো ভুল করে ফেলি।‌

চিনি আনতে বললে লবণ আনি, বিছানায় ময়লা কাপড় ছুঁড়ে ফেলে দেই, বাথরুমের স্যান্ডেল পরেই রুমে চলে আসি, বিবাহবার্ষিকী ভুলে যাই, বাসায় এসেও অফিসের কাজ নিয়ে বসি আরও এমন অনেক ভুল আমার। মেহরিন দেখতে দেখতে একসময় রেগে যায় আর তারপর এক নাগাড়ে বকবক করতেই থাকে। আর আমি এক ফাঁকে টুক করে বলে ফেলি,

-আমার ভুল হয়ে গেছে হরিণ, আর এমন হবে না।

মাঝেই মাঝেই ওকে আমি হরিণ বলে ডাকি। মেহরিন এর মে বাদ দিয়ে হরিণ। আবার কখনও কখনও মেহু বলি।

এই কথার পরে রাগে বলগ আসা মানুষেরও রাগ পড়ে যেতে বাধ্য।
মেহুও একটু নরম হয়।

-এই কথা তুমি আগেও অনেকবার বলছ কিন্তু বারবার তোমার ভুল হয়।

আমি তখন কানে ধরে বলি ,

-এবার এর মতো দেখো।‌ সত্যি এমন আর করবো না। যদি বলো কানে ধরে ওঠবস করি?

মেহরিন হেসে ফেলে।

এই হলো আমার আর মেহরিন এর ঝগড়ার পান্ডুলিপি।
তবে গতকাল রাতে বা আজ সকালে এমন কিছুতো হয়নি। সকালে মেহু হাসিমুখে আমাকে বিদায় দিয়েছে। রোজকার মতো বেরুনোর সময় বলে দিয়েছে,

-দুপুরে সময় মতো খেয়ে নিও কিন্তু।

তারপর আমি চোখের আড়াল না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত রাস্তার দিকের বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আমার অফিস যাওয়ার সময় রোজ এভাবেই ও দাঁড়িয়ে থাকে। আর আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাই। এমন সময়ে আমার মনে হয় জীবন অনেক বেশি সুন্দর।

মেহরিন হয়তো আশেপাশে কোনো বাসায় গিয়েছে। কিন্তু মাকে না বলেতো যাবার কথাও না।
আবারো ওর নাম্বারে কল দিলাম। ফোন এখনো বন্ধ।

আমার কেনো জানি অস্থির লাগতে শুরু করেছে।
যদিও অস্থির হবার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। হয়তো মেহুর ফোনে চার্জ নেই। হয়তো কোনো ইমার্জেন্সি এসে পড়েছিলো তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়েছে।

দ্রুত মেহুর ফুফাতো বোনকে কল দিলাম। হয়তো জরুরি কোনো কাজে ঐ বাসায় যেতেও পারে।

-হ্যালো,নওশীন আপু, আসসালামুয়ালাইকুম।

-ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি খবর আদনান? কেমন আছো?

-এইতো আপু। আপনারা কেমন আছেন?

-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছেন। কত দিন হয়ে গেলো তোমরা আসোনা বলোতো, একদম ভুলেই গেছো। এমন করলে হয়? আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়।

-ইচ্ছেতো করে, কিন্তু সময় হয়ে ওঠে না।

-এটা বললে হবে? সময় করে নিতে হয়। তা মেহরিন কেমন আছে? ওতো আসতে পারে মাঝে মাঝে।

আপু মেহরিন কেমন আছে জানতে চাইছে তার মানে ঐ বাসাতে যায়নি।

-হুম আপু,ও ভালো আছে। রাহিকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। আচ্ছা আপু আপনারা আসুন না একদিন।

-আচ্ছা দেখি। আগে তোমরা এসে ঘুরে যাও।

ঠিক আছে আপু,যাবো। দুলাভাইকে আমার সালাম দিবেন। এখন রাখছি আপু। আসসালামুয়ালাইকুম।

এবার সত্যিই টেনশন হচ্ছে। মেয়েটা কোথায় গেলো হঠাৎ করে। কোনো বিপদ আপদ হয়নি তো আবার। আজকাল কতরকম ঘটনাই তো ঘটছে। এইতো সেদিনই একটা নিউজ দেখলাম,
হিংসার বশবর্তী হয়ে প্রতিবেশি এক নারীকে খুন করেছে এক দম্পতি।

ধূর কিসব ভাবছি আমি! এমন কিছুই হয়নি। সব ঠিক আছে। মেহরিন সুস্থ সবল আছে।

মা আবার কল করেছেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

-কিরে বৌমার কোনো খবর পেলি?

-না মা। এখনো পাইনি। নওশীন আপার বাসাতে যায়নি। রাহি কি এখনও কান্না করছে?

-ওকে দোকান থেকে চিপস আর বেলুন আনিয়ে দিয়েছি। এখন একটু থেমেছে।

-আচ্ছা। আমি আসছি বাসায়।

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় এলাম। রাহি আমাকে দেখে আবার কান্না শুরু করল।

-বাবাই,মাম্মাম নাই,মাম্মাম আমাতে এতা রেথে তলে দেথে।

ওকে কোলে নিলাম,

-না বাবাই মাম্মাম কোথাও যায়নি। এখুনি চলে আসবে। কেঁদো না বাবাই। তুমি না আমার ব্রেভ বাবাইটা।

সন্ধ্যার মধ্যে সম্ভাব্য সব পরিচিত জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়ে গেলো। নাহ, কোথাও যায়নি মেহু। ফোনটাও এখনও অফ।
আতিক বলল, এবার থানায় জানাতে হবে। হাসপাতাল গুলোতেও খুঁজে দেখতে হবে। আতিক আমার খুব কাছের বন্ধু। একা একা কেমন অসহায় লাগছিলো। কি করব, কি করা উচিত কিছু বুঝতে পারছিনা। এমনকি কোথাও কল দিয়ে ঠিকমতো কথা বলারও শক্তি পাচ্ছি না। আতিককে ফোন দিলাম।

-দোস্ত, তোকে এখনি একবার আসতে হবে।

আমার কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যে আতিক আর কিছু জানতে চায়নি। দ্রুত চলে এসেছে। এসে ঠান্ডা মাথায় সব জায়গায় কল দিয়েছে নাম্বার ধরে ধরে।

রাহি ঘুমিয়ে গেছে। ওকে বলেছি,

-তোমার মাম্মাম তোমার জন্য খেলনা আনতে গেছে।
একটু পরেই চলে আসবে। তুমি ঘুমাও। উঠেই দেখবে মাম্মাম তোমার কাছে বসে আছে।

এভাবে মিথ্যা বলতে অনেক খারাপ লাগছে কিন্তু আমার মনে হয়েছে সত্যিইতো মেহরিন কোথাও গেছে।‌ যেকোনো‌ সময় হাজির হয়ে বলবে,

-কি হলো? আমিতো একটু শপিং মলে গিয়েছিলাম। আর তোমরা সবাইকে কল দিয়ে অস্থির করে ফেলছো। এতো অস্থির হতে হয়!

আমার বিশ্বাস মেহরিন এর কোনো বিপদ হয়নি।

থানায় যাবার জন্য আতিকসহ বের হয়েছি। এমন সময় টুক করে ফোনে একটা মেসেজ এলো । আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি মেহরিন এর নাম্বার থেকে এসেছে। মেসেজ পড়ার আগেই আমি কল দিলাম। আবার সেই এক কথা,

এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না,,,,

মেসেজ পাঠিয়েই নাম্বার বন্ধ করে ফেলেছে।

দ্রুত মেসেজ ওপেন করলাম। মেহু লিখেছে,

-আমি চলে গেলাম। আমাকে খুঁজে কোনো লাভ নেই। আমি সজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে অনেক ভেবে তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছি।

অল্প সময়ের জন্য কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম, মেহু সুস্থ আছে। ওর কোনো বিপদ হয়নি। কিন্তু তারপরেই সব কেমন অর্থহীন আর শূন্য লাগতে লাগল। হাজারটা প্রশ্ন যেন আমাকে চেপে ধরল,

মেহরিন কেনো এমনটা করবে!
কোথায় গেছে ও?
রাহিকে রেখে কিভাবে এতটা সময় আছে !
এটা কি সত্যিই মেহু নাকি অন্য কেউ ওর ফোন নিয়ে লিখেছে।

আমি তখনও জানি না এর থেকেও বড় বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here