অন্তর্ধান #পর্ব: তিন

0
185

#গল্প
#অন্তর্ধান
#পর্ব: তিন

পাঁচ.
ডিউটিতে এসে এক কাপ আদা দেয়া রঙ চা না খেলে মেহমিতের মাথা ঠিকঠাক কাজ করে না। থানার মোড়ের বিমলের দোকানের রঙ চায়ের স্বাদটাই আলাদা। আরো অনেক জায়গায় রঙ চা খেয়েছে কিন্তু এই দোকানের চায়ের ঘ্রাণটাই আলাদা। ঠিক শীতের শুরুতে যেই রোদ তার মতধ নরম অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে।

চা এসে পৌঁছাতে পারেনি ঠিক তখনই থানার ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল।

এতো সকালে ফোন মানেই কোনো কেসের ফোন।
মেহমিত যা ভেবেছিল তাই। কুড়িল এলাকায় এক অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ পাওয়া গেছে এক নির্মাণাধীন ভবনের সামনে।

নাকেমুখে কয়েক চুমুক দিয়ে ফোর্সকে গাড়িতে উঠতে বলে নিজেও তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ল ওসি মেহমিত।

আজকাল খুনখারাবি এতোটাই বেড়ে গেছে যে এখন মনে হয় পুলিশের চাকরিতে আসাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এতো নৃশংসতা চারপাশে,মেহমিতের ভীষণ খারাপ লাগে। যদিও এই চাকরিতে এই খারাপ লাগাটাকে পাত্তা দেবার সুযোগ নেই। খুনখারাবি,বিভৎস লাশ,আসামীকে ধরা, চার্জশিট, নানামুখী চাপ এই নিয়েই জীবন চলছে।

স্পটে পৌঁছে জটলা সরিয়ে জায়গাটা ফাঁকা করল ফোর্স। খুব ভালো করে লাশটাকে অবজার্ভ করছে মেহমিত। যদিও এই কাজে এক্সপার্ট দু’জন সাথে এসেছে। তারপরেও মেহমিত নিজেও খুব ভালো করে চারপাশে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে। সম্ভবত উঁচু থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে। মাথাটা থেতলে গেছে একেবারে। তবে এভাবে থেতলে যাওয়ার কথা না। খুনি ভারী কিছু দিয়ে মাথা থেতলে দিয়েছে। আশেপাশে তেমন কোনো ভারী কিছু পাওয়া গেলো না। লাশের শরীরে গয়না আছে। মানে গলার চেইন,আংটি । তারমানে ছিনতাইয়ের কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। আর ছিনতাই করতে হলে কোনো পথচারীকে এতো উচু বিল্ডিংয়ে নিয়ে আসবেই বা কেনো।

সেক্সুয়াল এসল্ট হয়েছে কিনা জানতে হলে পোস্ট মর্টেমের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। তারমানে নিহত নারী স্বেচ্ছায় এখানে এসেছিল। পরিচিত কারো সাথেই হয়তো এসেছিল।

সাব ইন্সপেক্টর রায়হান লাশের আর আশেপাশের ছবি তুলে নিচ্ছে। মেহমিত ওর পাশে থাকা কনস্টেবল মোজাম্মেলকে ডেকে বলল,
– লাশ প্রথম কে দেখেছে তাকে নিয়ে আসো ।

-জ্বি স্যার।

মধ্যবয়স্ক শ্রমিক শ্রেণীর এক লোক এসে দাঁড়ালো সামনে।

-এই যে স্যার ইনিই প্রথম দেখেছে।

-আপনিই তাহলে লাশটা প্রথম দেখেছেন?

-জ্বি।

-আনুমানিক ক’টার সময় দেখেছেন?

-সাড়ে পাঁচটার মতো হইবো।

-তখন কি উনি জীবিত ছিলেন?

-না,মরাইতো দেখলাম।

-এতো সকালে আপনি এখানে কি করছিলেন?

-এই বাড়ির মালিক তো থাকে বিদেশ। আমিই দেখাশোনা করি। নীচতলায় পরশুদিন মিস্ত্রী কাজ কইরা গেছে। দেয়াল গাঁথছে। ঐতে পানি দিতেই আইছিলাম।
তো আইসাই দেখি লাশ পইড়া আছে।

-ও আচ্ছা।

-আশেপাশে ভারী কিছু ছিলো কি? যেমন পাথর বা লোহাজাতীয় কিছু?

-না স্যার তেমন কিছুতো ছিলো না।

-এই এলাকার কেউ কি ওনাকে চিনেছে? আপনি কি আগে কখনো দেখেছেন এনাকে?

-না,এই এলাকার না। আগে দেখি নাই। তয় মুখটাই তো ভালো বোঝা যাইতেছে না।

-আচ্ছা।

-থানায় খবর কি আপনিই দিয়েছেন?

-না স্যার। আমিতো নাম্বার জানি না। এক ভদ্রমতন লোক আছিলো । উনিই কল দিছেন।

-আচ্ছা,আপনি আসতে পারেন।

এবার মোজাম্মেলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-নিহতের আত্মীয় কেউ এসেছে?

-ওনার হাজবেন্ডকে খবর দেয়া হয়েছে। উনি এসে লাশ সনাক্ত করবেন।

-কিছু স্নাপ নিয়ে লাশ সনাক্ত করার পর পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দাও। জায়গাটা রেস্ট্রিক্টেড করে রাখো। আর ওনার হাজবেন্ডকে থানায় আসতে বলো।

-জ্বি স্যার।

মেহমিত বিড়বিড় করল,ব্যাগে সবকিছু আছে,হাত কান, গলারটা আছে কিন্তু মোবাইল নেই।
শুধু মোবাইলটা মিসিং। কিন্তু কথা হলো এত উঁচুতে কেনো উঠবে এই মহিলা! আত্মহত্যা নয়,তাহলে চেহারা বিকৃত থাকতো না। কিছু একটা গোলমাল আছে।

পার্সে থাকা আইডি কার্ড থেকেই মেহরিনের পরিচয় জানা গেছে। তারপরেও লাশ সনাক্ত করার জন্য পরিবারের লোকজনকে ডাকা হলো। আদনান লাশ দেখে সনাক্ত করল। মেহরিন এর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলীতে একটা আঁচিল আছে। ঐটা দেখেই নিশ্চিত করল যে এটাই মেহরিন, আদনানের হরিণ, রাহির মা।

ছয়.

এই মুহূর্তে আদনান বসে আছে থানায়। ওর সামনে বসা ওসি মেহমিত আদনানকে বলল,

-আমি সত্যিই দুঃখিত এই সময়ে আপনাকে এভাবে থানায় আসতে হলো। কিন্তু আপনার ওয়াইফের বিষয়ে জানার জন্য এই মুহূর্তে আপনাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাই তদন্তের খাতিরেই অপ্রিয় কাজটা করতে হলো।

-ইটস ওকে অফিসার। আমিও চাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। কালপ্রিট ধরা পড়ুক। মেহুর সাথে যে বা যারা এমন করেছে ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

-আপনার ওয়াইফ ঠিক কবে কখন নিখোঁজ হন?

-গত পরশু দুপুরে।

-আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

-আমি অফিসে ছিলাম। আমার মা ফোন দিয়ে বলল মেহরিন বাসায় নেই। বাইরে থেকে দরজা আটকে চলে গেছে। তারপর পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ নেই। পরে ওর মোবাইল থেকে মেসেজ আসে। আমি থানায় জিডি করি।

মেসেজটা কি দেখতে পারি?

আদনান মোবাইল এগিয়ে দেয়। ওসি সাহেব মেসেজটা পড়েন।

-আপনার সাথে ওনার কি কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল?

না তেমন কিছু হয়নি।

আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো? কোনো কিছু নিয়ে সমস্যা চলছিলো কি?

নাহ,কোনো সমস্যা ছিলো না। আমরা ভালো ছিলাম।

ভালো মানে কেমন ভালো?

স্বাভাবিক যেমন থাকে।

দেখুন আদনান সাহেব, সবকিছু ঠিক নিশ্চয়ই ছিলো না। তাহলেতো আর উনি এভাবে বেরিয়ে পড়তেন না।
ওনার কি অন্য কারো সাথে ,,!

মানে!

Extremely Sorry for the question.কিন্তু তদন্তের জন্য এমন প্রশ্ন করতেই হচ্ছে।
Hope you will cooperate.

-নাহ,ওর কারো সাথে অবৈধ কোনো সম্পর্ক ছিলো না। ও সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকত। আমাদের ফুটফুটে একটা আড়াই বছরের ছেলে আছে। ওকে নিয়েই মেহরিন এর দিন কাটত।
আপনি যেটা মিন করছেন তেমন কিছু করার মতো মেয়ে ও ছিলো না।

-আচ্ছা আদনান সাহেব আপনি এখন আসুন। পোস্ট মর্টেমের ফর্মালিটি হয়ে গেলে লাশ পেয়ে যাবেন। আর আপাতত শহর ছেড়ে কোথাও যাবেননা। আবার প্রয়োজনে আপনাকে থানায় আসতে হতে পারে।

-জ্বি আচ্ছা।

চলে যাবার আগে আবার ঘুরে এলো আদনান
অফিসার একটা অনুরোধ, আমার মেহুর এমন পরিস্থিতি কেনো হলো এটার সুষ্ঠু তদন্ত চাই আমি। আমার রাহিকে কেনো মা হারা হতে হলো এর বিচার চাই।

-এটা আমাদের দায়িত্ব মিস্টার আদনান।
We will try our level best.

আদনান খেয়াল করলো ওর শশুড় আর মারুফ এসেছে থানায়। আদনান সালাম দিয়ে ওর শশুড়কে জড়িয়ে ধরল।

-আব্বা কি থেকে কি হয়ে গেলো।

-শান্ত হও বাবা। ধৈর্য ধরো।
বলতে বলতেই উনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। স্বভাবে যত কড়া হোননা কেনো নিজের একমাত্র মেয়ের এমন অপমৃত্যু ওনাকেও দূর্বল করে দিয়েছে।

মারুফ ওর বোন জামাইয়ের সাথে কথা বললো না। ওর চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট হয়ে আছে। শুধুমাত্র বাবার কারণেই আদনানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে পারেনি।

মেহরিন এর বাবা লাশ বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। যদিও আদনানের ইচ্ছা ছিলো ওকে এখানেই দাফন করতে। অতদূরে মেহরিন একা একা থাকবে এটা মেনে নেয়া কষ্টকর।
কিন্তু সন্তানহারা পিতার এই দাবীটুকুকে অস্বীকার করবার উপায় নেই।

রাজশাহী পৌঁছতে ভোর হয়ে গেলো। মেহরিন এর বাসায় ওর নিকটাত্মীয় সবাই এসেছে। লাশ নামানোর সাথে সাথে শোকাবহ পরিস্থিতি সশব্দ রুপে ছড়িয়ে পড়ল পুরো বাড়িতে।
মেহরিনের মা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালেন। আত্মীয় স্বজন যারা এসেছে তারা শোক দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে নানারকম কানাঘুষা করতে লাগল। আদনানের দিকে সবাই কেমন সন্দেহ এর চোখে তাকাতে লাগল। অনেক কাছের মানুষ যারা আগে দেখলেই কথা বলত তারা কেমন যেন এড়িয়ে গেলো। আদনানের নিজেকে নিতান্তই অযাচিত আর বেমানান মনে হতে লাগল।

আসার পথে আদনান ওর মা আর রাহিকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে। ছোট রাহি এখনো জানে না যে ওর নানুবাড়িতে যাচ্ছে ওর মাকে দেখতে। কিন্তু এই দেখাই যে শেষ দেখা সেটা ঐ অতটুকু বাচ্চাকে বোঝানোর মতো শক্তি আদনানের নেই। ওর দাদী সারাটা সময় বুকে আগলে রেখেছে ওকে। আদনানের আত্মীয়রা ওকে রাজশাহী আসতে বারণ করেছিল কিন্তু আদনান এতটাও সার্থপর হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া রাহিরতো অধিকার আছে ওর মাকে শেষ দেখা দেখবার। আদনান স্পষ্ট করে সবাইকে বলেছে,

– আমার বিপদ হবে ভেবে আমার মেহুকে শেষ বিদায়ের সময় ওর কাছে থাকবনা এতোটা বিবেকহীন আমি হইনি আজও।

সাত.

মেহমিত সদ্য আসা কেসটা নিয়ে ভাবছে।
একজনের ওয়াইফ যার কিনা সুখের সংসার, স্বামীর সাথে কোনো সমস্যা নেই সে এক দুপুরে বলা নেই কওয়া নেই বাসা থেকে চলে গেলো। তারপর একদিন পর হঠাৎ তার লাশ পাওয়া গেলো। খুনটা কে করতে পারে।

হয়তো তার স্বামী মিথ্যা বলছে। কিন্তু বাসার সিসিটিভি থেকে দেখা গেছে মহিলা নিজে ব্যাগ হাতে বাইরে গেছে। হাজব্যান্ড এর সাথে যদি কোথাও যেয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ব্যাগসহ যেতো না। আর তাছাড়া হাজব্যান্ড ঐ সময় অফিসেই ছিলো। অফিস স্টাফরা তাই বলছে। তাছাড়া ভিকটিমের বাবার বাড়ির লোকেদের আদনানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

তারমানে ভিক্টিম অন্য কারো সাথে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে একা একাই কোথাও যাচ্ছিলো। খারাপ কারো হাতে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু কেউ যদি জোর করে ভিক্টিমকে ঐ বিল্ডিংয়ে তোলেও সেক্ষেত্রে জোরজবরদস্তির কোনো চিহ্ন থাকতো।

আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। হতে পারে পরিচিত কারো সাথে ভিকটিম ওখানে গেছেন। এতো রাতে ঐ পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে কেনোই বা যাবেন! সেটা যতই পরিচিত কারো সাথেই হোক না কেনো।

দ্বিতীয় সম্ভাবনাই সঠিক হতে পারে। ভিকটিমের কারো সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিলো। যদিও ওনার হাজবেন্ড বলেছেন ওনারা দাম্পত্য জীবনে খুব সুখী ছিলেন।‌ তবে আজকাল কে যে সুখী আর কে সুখী নয় সেসব বোঝাই মুশকিল। এফবিতে হাসি হাসি চেহারার ছবি আপলোড দিচ্ছে ওদিকে বাইরে দু চারটা এফেয়ার চালাচ্ছে খাবার পরের ডেজার্ট আইটেমের মতো। এই চাকরি করতে এসে কত কি যে অভিজ্ঞতা হয়েছে মেহমিতের। মানুষের বিচিত্র মানসিকতা আর চরিত্র সব এই চাকরিতে এসেই দেখছে ও।

এসব দেখতে দেখতে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা একেবারেই মুশকিল। ওর সাথেও যে এমন কিছু ঘটবে না তাই বা কে বলবে।
সত্যিই তাই,এই চাকরিতে আসার পর ওর মাঝে থাকা কমনীয় নরম মনের মানুষটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে। সারাদিন চোর ,ডাকাত আর বিকৃত মনের সব অপরাধীদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে ও নিজেই ভীষণ রুক্ষ হয়ে গেছে।

যাই হোক,আপাতত কূল কিনারা পাওয়া না গেলেও পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট আর ভিকটিমের মোবাইল ফোনের রেকর্ড হাতে আসলে কিছু একটা সমাধান পাওয়া যাবে।

আদনান সাতদিন ছুটিতে ছিলো। এ কয়দিন ও রাহিকে সামলেছে। তিনদিনের দিন এতিমখানায় বাচ্চাদের খাইয়েছে,দোয়ার আয়োজন করেছে। ও নিজেও রোজা রেখেছে, নামাজ আদায় করেছে।
এখন রাহিও আর আগের মতো কাঁদে না। কিন্তু ঘুমের ঘোরে ঠিকই মা মা করে ফুঁপিয়ে ওঠে।
মাঝে মাঝে মায়ের ছবি নিয়ে চুমু খায় আর একা একা কথা বলে,
মাম্মাম, তোমার অথুক তবে ভালো হবে। তুমি তবে
আতবা?

আড়াল থেকে এসব দেখে ওর দাদী আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করেন। আদনানেরো চোখ ভরে যায় পানিতে। ও ঠিক করে মেহরিনের ছবিগুলো সব লুকিয়ে ফেলবে।

আজ থেকে আদনানের ছুটি শেষ। জয়েন করতে হবে। ও এমন একটা পদে আছে যে ও না থাকলে অন্যরা হয়তো চালিয়ে নিতে পারে কিন্তু আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়না। তাই ছুটি আর না বাড়িয়ে অফিস জয়েন করল আদনান।আর তাছাড়া বাসায় থাকলেই মেহরিনের স্মৃতি ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এ বাসার সবখানে মেহুর ছোঁয়া লেগে আছে। একটা মেহরিন মেহরিন ঘ্রাণ পুরো বাসা জুড়ে।

তবে একটা বিষয় সত্যি শোক সে যত তীব্র হোক না কেনো মানুষের দৈনন্দিন কাজগুলো ঠিকই চলতে থাকে। কারো জন্যই কিছু থেমে থাকে না। হয়তো কষ্ট হয়, তীব্র যাতনায় অসহ্য ঠেকে সবকিছু তারপরেও থেমে থাকেনা কিছুই।

অফিসে জয়েন করার পর সবাই ওকে সমবেদনা জানিয়েছে ঠিকই,কিন্তু ওর অগোচরে তারাই আবার দু’জন তিনজন একসাথে হলেই এই ঘটনা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চালাচ্ছে।

আদনান ভাবল,

মানুষ কি বিচিত্র জীব। সবকিছুই নিজের মতামত আর বিচার জুড়ে দেয়। উপরে উপরে যা বলে ভেতরে সেটা ধারণ করে না। অন্যের কষ্ট নিয়ে খোঁচানো মানুষ এটা বোঝে না যে তার নিজের জীবনেও কত কষ্ট কত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদনান কাজে মন দেয়।

ওদিকে আবীর গয়নাগুলো সব বিক্রি করে দিয়েছে। নগদ টাকা আর গয়না বেঁচে বেশ ভালো একটা এমাউন্ট হাতে এসেছে ওর। কিছু টাকা ব্যাংকে ফিক্সড করে রাখবে ঠিক করল ও। আর কিছু টাকা নিয়ে কক্সবাজার, রাঙামাটিতে ক’দিন ঢু মেরে আসবে। এমনিতেই মেহরিন নামের সেকেন্ড হ্যান্ড মালটাকে বাগে আনতে খুব বোর হয়ে গেছিলো দিনকাল। একটা লম্বা ট্যুর দিয়ে সেই বোরনেস কাটিয়ে তারপর নতুন কিছু ভাবা যাবে।

আট.

ঠিক চারদিন পর। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট চলে এসেছে। মৃত্যুর কারণ উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে হৃদপিন্ড ফেটে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায় নি।

তবে কাজের কাজ করেছে আইটি সেকশনের লোকজন। মেহরিন এর ফোনের রেকর্ড এসে গেছে। একটা নাম্বারে অনবরত মেসেজ আর কথা হয়েছে। যেটা আবীর নামের একজনের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা আছে।
এই ছেলেটার সাথে ভিকটিমের সম্পর্ক ছিলো। মেসেজ থেকেই দেখা যাচ্ছে ওর সাথেই চলে গিয়েছিল ভিকটিম। এখন এই আবীরকে ধরলেই সব রহস্য উন্মোচন হবে।
আবীরের ফোনের লোকেশন ট্রাক করে ওকে এরেস্ট করার জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নিলো।

দুদিনের মধ্যে আবীরকে ধরা হলো খুলনা সদর থেকে। খুলনা সদর থানা পুলিশ ওকে এরেস্ট করে হাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করল‌ ওসি মিজানুর রহমান। ঢাকা থেকে কেইসের হিস্ট্রি মেইল করা হয়েছে এই থানায়। সম্ভবত পরকীয়ার কেইস।

সামনের টেবিলে হাতের ডান্ডা রেখে প্রশ্ন করল মিজানুর রহমান,

-আপনি আবীর হোসেন?

-জ্বী হোসেন না,আহমেদ।

ও আচ্ছা। মেহরিন নামে কাউকে চেনেন?

-কোন মেহরিন?

-ওরে শালা,এতো পুরাই নাটুকে দেখতাছি।
যেই মেহরিন কে নিয়ে পালিয়ে চিটাগাং যেতে চাইছিলা।

আবীর দেখল এক প্রশ্নেই আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে সামনে থাকা রুক্ষ চেহারার ওসি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

-আমি কাউকে নিয়ে পালিয়ে যাইনি।

মিজানুর রহমান পাশে দাঁড়ানো এস আইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-স্যারের মনে হয় মেমোরি কাজ করছেনা, বাফারিং হচ্ছে। রফিক,ওনারে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার ব্যবস্থা করো।

-কি সব বলেন? এভাবে অযথা থানায় এনে আপনারা আমাকে টর্চার করতে পারেন না।

-রফিক হালার পুতেরে উলটায়া বাইরাও। তাইলেই বুঝব আমরা কি কি পারি আর পারি না।

-এক গ্লাস পানি হবে?
-উহু,পানি খাইলে তো মুইতা দিবা হালার পো।

– মেহরিনকে নিয়ে যাবার কথা ঠিকই ছিলো কিন্তু আমিতো শেষ পর্যন্ত ট্রেনে উঠিনি।

-তাতো আমরা জানি যে তুই ট্রেনে ওঠোস নাই।‌ তুইতো ওরে অন্য জায়গায় নিয়ে মেরে ফেলছিস।

-এইটা কিন্তু বাড়াবাড়ি অফিসার। আমি কেনো ওকে মারতে যাবো? কি বলেন এসব!

-মারছিস ওর টাকার জন্য।

-টাকার জন্য মারতে হবে কেনো। ওর টাকার ব্যাগতো আমার কাছেই ছিলো।

-এইতো স্বীকার করলি যে ওর টাকা তোর কাছে।

-না মানে,ও নিজে থেকেই দিয়েছে আমাকে।

-নিজ থেকে দেয়নি। তুই জোর করছিস। আর যখন কথা শোনেনি ওকে ঐ বিল্ডিং থেকে ধাক্কা দিয়ে মাইরা ফেলছিস।

-কোন বিল্ডিং থেকে?
আমিতো ঐদিন খুলনার ট্রেনে উঠে খুলনায় চলে আসি।

-জায়গামতো বাড়ি পড়লে সত্যি বলবি গানজাখোর। আর ভিতরে গরম ডিম হান্দাইলে তোর সব সত্যি পু**কি দিয়া বার অইব। শালা পরের বৌরে নিয়া রঙ তামাশা করার ক্ষমতাই থাকবনা।

মিজানুর রহমান রফিককে ইশারা করতেই আবীরকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা অন্ধকার রুমে। আধাঘণ্টা ঝুলে আর্তনাদ করার পর জ্ঞান হারালো আবীর।

ইন্সপেক্টর মেহমিত বসে আছে ওনার রুমে। সামনে এস আই রায়হান। রায়হান বলল,

-স্যার ঐ ছেলেতো এক কথায় আটকে আছে। সে ঐদিন ভিকটিমের সাথে ছিলো না, খুলনায় চলে গেছিলো। আর খোঁজ নিয়ে দেখেছি ঐ ছেলে সত্যিই ঐ দিন ট্রেনে করে খুলনায় গেছিলো।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী যেই সময়ে মৃত্যু হয়েছে তখন ঐ ছেলে ট্রেনে ছিলো?

-তাহলেতো হিসাবে মেলেনা।

-হুম,ও বলছে মেয়েটাকে ট্রেনে তুলে ও আর ওঠেনি। টাকা পয়সা আর গহনার ব্যাগ নিয়ে খুলনাগামী ট্রেনে উঠে পড়েছে। ছেলের নানাবাড়ি খুলনায়। ওখানেই গিয়ে উঠেছে।

-তাহলে মানে দাঁড়ায় মেয়েটা আবীরকে না পেয়ে নেমে পড়েছিল। তারপর বেরিয়ে ওখানে ঐ বিল্ডিংয়ে কিভাবে কার সাথে গেলো এটাই রহস্য। আর হত্যার মোটিভ টাও ক্লিয়ার না। না কিছু খোয়া গেছে,না রেপড হয়েছে,কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্নও পাওয়া যায়নি।

তাহলে হয়তো আত্মহত্যা করেছে।

-ছেড়ে দাও রায়হান।

-কি ছাড়ব স্যার? এই কেসটা ছেড়ে দেবার কথা বলছেন?

-চাকরিটা ছেড়ে দাও?

সেটাতো ছাড়তে পারলে ভালো হতো।

-হুম আর তুমি চাকরি ছাড়লে ডিপার্টমেন্টের ভালো হতো।

-মানে?

-তোমার চাকরির বয়স কত?
এতো বোকা হলে এই সেক্টরে আছো কিভাবে? ধরলাম আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মুখটা থেতলে দিলো কে?

-সরি স্যার। মাথাতেই ছিলো না।

– মাথাটায় একটু এসবও রাখো । সারাদিন তো শুধু চ্যাটিং আর গেইম থাকে মাথায়।

রায়হান মাথা চুলকে বলে,

-আর একটা বিষয় স্যার, হত্যাকাণ্ডের সময় আর ট্রেনের সময়ের মাঝে অনেকটা সময়ের ব্যবধান আছে। প্রায় ছ ঘন্টার মতো।

-হুম, তারমানে সরাসরি ওখানে যায়নি তাহলে।
দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।

-লাশের ছবি দিয়ে কোনো নিউজ কি হয়েছে?

-স্থানীয় পত্রিকার একটা ছোট আকারে নিউজ‌ হয়েছে।

-আর একটা নিউজ করান। ভিকটিমের ভালো একটা ছবি দিয়ে।

-আচ্ছা স্যার।

মেহরিন এর কেসটা কেমন যেন আটকে গেলো এক জায়গায়। কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। কার সাথে কিভাবে মেয়েটা ওখানে গেলো ,কেনোই বা গেলো এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
মেহমিত নানা দিক দিয়ে ভাবছে কিন্তু কোনো কিছুর হদিস পাচ্ছে না।

ঐদিন মেহরিন বাসায় ফিরে যায়নি। দাড়োয়ান বলেছে,

ম্যাডামকে দুপুরে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। পরে আর আসেননি।

সিসিটিভি ফুটেজেও তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। আর আদনানও দশটার পরে আর বের হয়নি। তাই ওকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাইরে রাখা হয়েছে।

আদনান বসে আছে থানায়। ও এসেছে কেসের আপডেট জানতে সেই সাথে পুলিশকে তাগাদা দিতে। এই দেশে কতশত কেস অমিমাংসিত হয়ে পড়ে আছে। অথচ পুলিশ চাইলেই কত জটিল কেসের রহস্য উদঘাটন করতে পারে।
কেসের ইনচার্জ মেহমিত বাইরে ছিলো। আধঘন্টা পরে ফিরে এলে আদনান উঠে হাত মেলালো। মেহমিত বলল,

-কি খবর আদনান সাহেব?

-খবরতো আপনার কাছে। আমার ওয়াইফের খুনির কি কোনো হদিস মিললো?

-এখনো তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বোঝেনি তো এমন নির্জন একটা এলাকায় ওনার মৃত্যু হয়েছে কারো চোখে তেমন কিছু পড়েনি। আর ঐ এলাকার রাস্তায় একটাই সিসিটিভি ছিলো তাও আবার নষ্ট।

-তাই বলে কি খুনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।

-তা কেনো! আমরা লেগে আছি। কিছু একটা ক্লু অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।

-তাই যেনো হয়। আজ উঠি তবে।

আদনানকে বললেও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারলো না মেহমিত। কেনো যেনো কেসটা এক জায়গায় স্থির হয়ে গেছে। প্রথমে একটা সরল কেইস মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে ভীষণ গোলমেলে একটা কেইস। ঐ এলাকার সব সন্ত্রাসী আর ছিনতাইকারীদের সাথে কথা হয়েছে। ওরা কেউই এই বিষয়ে জানে না। সোর্সরাও তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

এই যখন পরিস্থিতি এক দুপুরে মেহমিতের নাম্বারে একটা কল এলো। ফারিয়া নামের একজন ফোন করল,
আসসালামুয়ালাইকুম।আমি মেহরিনের বন্ধু। যেই মেহরিনের খুনের কেইস নিয়ে আপনি কাজ করছেন।

-জ্বি বলুন।

-মেহরিন আমার কলেজের বন্ধু। ঘটনার দিন নাকি মেহরিন আমার বাসার সামনে এসেছিলো। দারোয়ানকেও বলেছে ভেতরে আসার কথা। কিন্তু পরে একটা গাড়ি এসে থামে আর ও ওটাতে উঠে চলে যায়।

-গাড়ির নাম্বার আর কে ছিলো গাড়িতে এসব কিছু কি জানতে পেরেছেন?

– আমি ঠিক জানি না। দারোয়ান বলতে পারবে।

– আপনি এতো দিন পরে এটা জানালেন যে!

– দারোয়ান আমাকে গতকালকেই বলল। ওনার নাকি মনে ছিলো না।

-দারোয়ানের সাথে আমরা একটু কথা বলতে চাই। উনি যেনো কাল ওখানে থাকেন।

-জ্বি আচ্ছা।

পরদিন এস আই রাহুলসহ মেহমিত ঐ বাসায় গেলো। কিন্তু দারোয়ান নাকি ঐদিন আসেইনি। পরের দিনও যখন দারোয়ান লাপাত্তা তখন ঐ বাসার লোকজন থানায় জানালো।
একদিন পর দারোয়ানের লাশ পাওয়া গেলো শ্যাওড়াপাড়ার এক ডাস্টবিনে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here