#গল্প
#অন্তর্ধান
পর্ব: দুই
দুই.
মেহরিনের মেসেজ পাবার পর আর থানায় যাব কিনা বুঝতে পারছি না । আতিক বলল,
-ভাবির মেসেজ আসছে ,এখন থানায় গিয়ে কি বলবি। নানারকম উলটা পালটা কথা বলবে পুলিশ। চল বাসায় ফিরে যাই।
-কিন্তু যদি কোনো বিপদ হয় ওর।
-সেটাও ঠিক। তবে আমার মনে হয়না তেমন কিছু হয়েছে। ভাবি হয়তো ওনার কোনো পরিচিত কারো বাসায় গিয়েছে তোর ওপর অভিমান করে।
-কিন্তু আমার ওপর কি নিয়ে অভিমান করবে। সকালেওতো সব ঠিকঠাক ছিলো।
-বন্ধু,এইটাইতো ভুল। নারীর মন কে কবে বুঝতে পেরেছে। এরা যে কি নিয়ে কখন অভিমান করে রাগ করে সেটাই তো বোঝা যায় না। তুই আজকাল দেখ। দেখবি ঠিক যোগাযোগ করেছে।
আতিকের কথা ঠিক মনে হলেও মনের খচখচিটা রয়েই গেলো। শেষ পর্যন্ত থানায় গিয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি করলাম।
বাসায় ফিরে এলাম। রাহি ঘুমিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে ঘুম ভেঙ্গে ওর মাকে দেখতে পাবে। সকালে বাচ্চাটাকে কি বলব। সব চিন্তা করতে করতে মাথাটা দপদপ করতে থাকল।
সারারাত জেগে কাটল। বেশ ক’বার মেহুর নাম্বারে কল করলাম। বন্ধ দেখালো।
আমার শশুর বাড়ী রাজশাহীতে। ওখানে গিয়েছে কিনা জানতে শশুড়ের নাম্বারে কল দিলাম। রিসিভ করল মেহরিন এর ছোট ভাই মারুফ।
মেহরিন কে পাওয়া যাচ্ছে না শুনেই আমার ওপর চড়াও হলো।
-পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি! ইয়ার্কী হচ্ছে নাকি। কোথায় গুম করেছেন আমার বোনকে?
-কি বলছো এসব? আমি কেনো ওকে গুম করতে যাবো?
-পুলিশ যখন ডিম থেরাপি দিবে তখন বুঝবা কেনো গুম করতে যাবা। ফাউল একটা। বাবা কি দেখে যে এর সাথে আমার বোনটাকে বিয়ে দিলো। শালা কু,, বাচ্চা, কালকের মধ্যে আমার বোনের খোঁজ চাই। নাইলে তোর গুষ্টিশুদ্ধ বারো শিকের ভাত খাইতে হবে।
মারুফ মুখ খারাপ করতে শুরু করলে আমি ফোন কেটে দিলাম। মারুফ কেনো জানি না আমাকে প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারে না। কেনো সেই কারণটাও বুঝতে পারিনি কখনো। এখন সুযোগ পেয়ে ঝাল ঝাড়ল।
বেলকনিতে বসে সামনে থাকা অসীম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার জীবনটা এখন ঠিক এই রাতের মতো। মেহরিন নিজ হাতে এক অসীম আঁধারের চাদর বিছিয়ে দিলো আমার জীবনে। মনে মনে শুধু এটুকুই বলছি,
মেহু তুমি ফিরে এসো। আর কখনো তোমার কোনো অবহেলা অযত্ন হতে দেবো না। একবার শুধু ফিরে এসো।
তুমিতো সরাসরি বলতে পারতে কি আমার ভুল,কেনো অভিমান করেছো। কিন্তু এমন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমাকে এ কোন শাস্তি দিচ্ছো।
পরেরদিন দেখা গেলো আমার আলমারির লকারে থাকা নগদ দুই লাখ টাকা, মেহরিন এর নামের চেক বই আর ওর গয়না একটাও নেই। তারমানে মেহু নিজে থেকেই চলে গেছে। ওর কিছু কাপড় চোপড়ও সরানো। কাল এসব দেখার কথা মাথায় আসেনি। আজ আলমারিতে হাত দিয়ে বোঝা গেলো মেহরিন বেশ গুছিয়ে এ বাসা,এ সংসার ছেড়ে গেছে।
ওর ফোনটাও আর খোলা পাইনি।
তিন.
তুর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস তিন ঘন্টা লেটে চলছে। তার মানে দীর্ঘ সময় প্লাটফর্মে বসে থাকতে হবে। খুব অস্থির লাগছে মেহরিনের । শুধু মনে হচ্ছে পরিচিত কেউ দেখে ফেলবে। তারপর তাকে জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। যদিও এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত কেউ কিছু জানে না। মাথা মুখ সব ওড়না দিয়ে ঢেকে বসে আছে ও। ওর বুকের ভেতরটা খুব জোরে ধুকধুক করছে।
আবীর এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে আর একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই পুরোপুরি শেষ করছে না। ও খুব টেনশনে আছে বোঝা যাচ্ছে।
এতক্ষণে বাড়িতে সবার জেনে যাবার কথা যে মেহরিন সব ছেড়ে চলে এসেছে। রাহির দাদি ওকে না পেয়ে প্রথমে ভাববে হয়তো বাইরে আশেপাশে খুঁজবে। তারপর দেরি দেখে আদনানকে ফোন করে যখন বলবেন আদনান কি ভাববে?
ও কি খুব কষ্ট পাবে? অবশ্য ওর কষ্ট হবার কথাও না। পুরোপুরি মেশিন টাইপের একটা মানুষ। মাঝে মাঝে সরি বলা ছাড়া আর কোনো ভালোবাসা নেই লোকটার মাঝে।
আদনান কি পুলিশের কাছে গেছে? পুলিশ যদি তাকে ধরে ফেলে।
ধূর,এটা কি সিনেমা নাকি যে এতো জলদি তার নিখোঁজ হবার খবর ছড়িয়ে পড়বে আর পুলিশ ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়বে ওকে খুঁজতে। আদনান হয়তো প্রথমে পরিচিত সবার কাছে কল দেবে। তারপর থানায় যাবে। তার আগেই ও মেসেজ পাঠিয়ে দেবে যে ও স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছে।
সামনের একটা লোক ঘুরঘুর করছে আর বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। আচ্ছা লোকটা কি আদনানের পরিচিত কেউ। এভাবে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখছে কেনো। আবার একটু পরপর কাকে যেন ফোন দিচ্ছে লোকটা। ভয়ে আবার গলা শুকিয়ে এলো ওর। নির্ঘাত লোকটা আদনান বা ওর পরিচিত কেউ। এখানে দেখে আদনান কে কল করেছে।
ওড়নাটা টেনে আরো একটু নামিয়ে দিলো মেহরিন। আবীর কাছে এসে দাঁড়াল।
-কিছু খাবে?
-নাহ,ট্রেন কখন আসবে?
-এইতো আধঘন্টা লাগবে আর।
-আরো আধঘন্টা!
-হুম,আগে জানলে বাসে টিকিট করতাম।
-আমিতো বাসে জার্নি করতে পারি না।
-এজন্যই তো ট্রেনে করলাম। কিন্তু এতো জঘন্য টাইমটেবল কে জানত।
-তোমার ক্ষিদে পেয়েছে?
-উহু,তুমি সাথে আছো এখন ক্ষুধা তৃষ্ণা সব মিটে গেছে। খুব বেশি ক্ষুধা পেলে তুমিতো আছোই।
-ধ্যাত, ফাজলামো ভালো লাগছে না।
-কিন্তু আমিতো ফাজিলের খালু শশুড়।
-তাই না? আমার খুব ভয় করছে আবীর।
-কিসের ভয়,আমি আছিতো।
-হুম।
-তুমি বসো,আমি একটু আসছি।
-আবীর চলে গেলে পাশে বসা মহিলাটা একটু কাছে সরে এলো।
-আপনের সোয়ামী লাগে?
মেহরিন চমকে ওঠে। সত্যিই তো,আবীর তার কি হয়? কোন ভরসায় সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে।
-আপনেগো মানাইছে খুব। যেমন বর তেমন তার বৌ। তয় আপনের সোয়ামী অনেক বেশি সোন্দর আফা।
এই কথা শুনে মেহরিন এর ভালো লাগে। সত্যি ওকে আবীরের সাথে খুব মানায়। এতো সুন্দর দেখতে আবীর আর ও নিজেই বা কম কিসে। তারপরেও আবীর একটু বেশিই ভালো। ওর মতো ছেলে যে মেহরিনকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছে এটাই ওর জন্য অনেক সৌভাগ্যের। আবীর না এলে ওর জীবনটা একঘেয়ে চাকায় ঘুরতে ঘুরতে ফুরিয়ে যেত।
আর এখন সব ছেড়ে এসে কি সব ভেবে মন খারাপ করছে ও। আবীরতো বলেছে ওরা চিটাগাং গিয়েই বিয়ে করবে। ওর এক বন্ধুর বাসায় উঠবে। ঐ বন্ধু সব এরেঞ্জ করে রেখেছে।
এমনিতেই আবীর ফাজলামো করে,তবে কখনো কোনো অসভ্যতা করেনি ওর সাথে। একটু আধটু হাত ধরা ছাড়া বেশি কিছু চায়নি কখনো। সরাসরি বিয়ে করতে চেয়েছে। খারাপ কিছু মনে থাকলে নিশ্চয়ই সুযোগ নিতো। আর সেও হয়তো বাঁধা দিতে পারতো না।
আদনানের সাথে সত্যিই হাপিয়ে উঠেছিল ও। একটা দায়িত্ব পালনের মেশিন হয়ে গেছিলো যেন। আর তাছাড়া আদনানের সাথে কি ওর যায়? কি দেখে যে এখানে বিয়ে দিয়েছিলেন মা বাবা।
বাবাকে বরাবরই ভয় পায় মেহরিন। এতো যে বড় হয়েছে এখনও বাবার মুখের ওপর একটা কথাও বলতে পারে না। আদনানের বাসা থেকে যখন প্রস্তাব এলো ওর বাবা ওকে ডেকে বলল,
-ছেলেটা ভালো। খুব ভালো ফ্যামিলি। তোমাকে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে।
মা একবার বলেছিল,
-কিন্তু বয়স তো বেশি মনে হয়।
-তুমি বেশি বুঝতে যেওনা। এস্টাবলিশড ছেলে নিলে তো বয়স বেশি হবেই। কম বয়স নিতে চাইলে ভার্সিটি পড়ুয়া কোনো বেকারের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তোমার মেয়েতো পড়াশোনাতেও লবডঙ্গা। এর চেয়ে ভালো ছেলে কোথায় পাবে। আমি চাই এই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে। এটাই শেষ কথা।
এর ওপর আর কোনো কথা চলে না মেহরিনদের পরিবারে।
আদনানের সাথে বিয়েটা হয়ে গেলো। আর তারপর নিত্যদিনের একঘেয়ে সংসার যাপন। কিভাবে কিভাবে যেন রাহিও পৃথিবীতে এলো। ও নিজেও মানিয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু আবীর এসে ওকে জানান দিলো কতকিছু পাবার আছে ওর। কতটা ভালোবাসা ওর প্রাপ্য।
রাহির জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু ও জানে আদনান এর কাছে অনেক ভালো থাকবে রাহি। বাবা হিসেবে আদনান পৃথিবী সেরা।
আচ্ছা রাহি জেগে উঠে মাকে না পেয়ে কি করবে, নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করবে । মনটা আবার খারাপ হতে শুরু করল।
ট্রেন চলে এসেছে। আবীর এসে বলল,
-জলদি ওঠো। ‘ঞ’ বগি। তুমি এগোও আমি লাগেজ নিয়ে আসছি।
দৌড়াতে দৌড়াতে ‘ঞ’ বগিতে উঠলো মেহরিন। টিকিট দেখে সিটে গিয়ে বসল। যাক শেষ পর্যন্ত ট্রেনে ওঠা হলো। ওর জীবনের সঠিক ট্রেন। এখন শুধু উদ্যাম ছুটবে ও,জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করবে।
জানালার পাশেই সিট পড়েছে। জানালা দিয়ে বাইরেটা একটু দেখে নিলো। হুইসেল বাজছে।
আবীর এখনও আসলো না।
টেনশন লাগছে আবার। ও কি দরজার কাছে আছে?
গার্ড সবুজ পতাকা নাড়ছে। আবার হুইসেল বাজিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করেছে।
চার.
মেহরিন যাবার পুরো আটচল্লিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। পুলিশ এখনও ওর কোনো ট্রেস পায়নি। অবশ্য ওরা কতটুকু কি চেষ্টা করেছে সেটাই সন্দেহ।
মারুফ আমাকে ক্রমাগত হুমকি ধামকি দিচ্ছে। ও আমার নামে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার শশুড়ের জন্য এখনও চুপ আছে।
এই যখন পরিস্থিতি দুপুরে একটা আননোন নাম্বার থেকে আমার নাম্বারে কল এলো,
-হ্যালো আপনি কে বলছেন?
-আপনি কে বলছেন প্লিজ।
-আমাকে চিনবেন না। এখানে কুড়িল,সেক্টর তিনে একটা অজ্ঞাতনামা মহিলার লাশ পাওয়া গেছে। তার হাতব্যাগে থাকা নোট বুক থেকে রাহির আব্বু লেখা এই নাম্বার পাওয়া গেছে। আপনিই কি রাহির আব্বু?
আমার ভেতরটা স্থির হয়ে গেলো। বুকের ভেতর হুহু করছে।
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনোরকমে বললাম,
-জ্বি আমিই রাহির আব্বু।
চলবে।