অন্ধকারের_হাতছানি,(পর্ব-১)

0
1257

গল্পঃ #অন্ধকারের_হাতছানি।(পর্ব-১)
লেখাঃ #নাজিফা_তাবাসসুম

অফিসে বসে তিয়াশের সবসময়ই কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিসি টিভির দিকে নজর রাখে। তিয়াশের বাসায় প্রায় সর্বত্রই আনাচে কানাচে তিয়াশ সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে মূলত তার স্ত্রী রেহানার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। বিকেলে ঠিক কিছুক্ষণ আগে রেহানার কল আসে। তিয়াশ ফোন রিসিভ করে সিসি টিভির দিকে তাকায়। সিসি টিভিতে তিয়াশ দেখলো রেহানা বারান্দায় ইজি চেয়ারে ফোন কানে দিয়ে বসে আছে।

ফোনে ওপাশ থেকে রেহানার মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসলো।
– তুমি বলেছিলে আজ দুপুরে বাসায় খেতে আসবে। কেন আসলে না? আমি তোমার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি!
– দেখ রেহানা আজকের অফিসে ভয়াবহ কাজের চাপ আমার পক্ষে সেজন্য আসা সম্ভব হয়নি।মন খারাপ করো না প্লিজ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। সমস্যা নেই।
– আমি আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো কথা দিলাম।
– বেশি রাত করবেনা কিন্তু…
– আচ্ছা । তোমার কি কিছু লাগবে? কিছু কেনা লাগবে?
– আপাতত লাগছে না। তুমি এক বোতল টমেটো কেচাপ আনতে পারো।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে তিয়াশ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল। বারান্দার চেয়ারে রেহানা চুপচাপ উদাস হয়ে বসে আছে। তিয়াশ গত এক সপ্তাহ আগে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। কিন্তু রেহানার আচরণের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পায়নি। বরং রেহানার মন খারাপ চুপচাপ চেহারাই সবসময় তার চোখে পড়ে। রেহানার কি কোনো সমস্যা হয়েছে? সবসময় এমন মন খারাপ করে বসে থাকে কেন সে?

পাশের বাসার আন্টি একবার তিয়াশকে বলেছিল.. তোমার ওয়াইফ এর মানসিক সমস্যা আছে। ওকে ডাক্তার দেখিও। কেন তিনি এমন কথা বলেছিল তিয়াশ জানে না ।
রেহানার মাঝে অস্বাভাবিক কিছু ব্যাপার আছে সেটা তিয়াশ বিয়ের প্রথম রাতেই বুঝতে পেরেছিল তবে ব্যাপারটা কি ছিল সেটা তিয়াশ এখনো বুঝতে পারছে না।

রেহানার বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিল। সেটা সে তিয়াশকে বিয়ের পরের দিনই বলেছিল।

তিয়াশ রেহানাকে ভয়াবহ ভালোবাসে । যতটা তার ভালোবাসার প্রয়োজন তার চেয়ে হয়তোবা একটু বেশিই ভালোবাসে।

তবে ইদানিং সে রেহানাকে সন্দেহ করছে রেহানা আবার তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েনি তো ! তবে এমন কোন ব্যাপার তিয়াশ রেহানার মধ্যে দেখেনি যেটা দিয়ে তিয়াশ রেহানাকে সন্দেহ করতে পারে।

এসব ভাবতে ভাবতে তিয়াশ বাসায় সামনে চলে আসলো। কলিং বেল চাপতেই রেহানার দরজা খুলে দিলো।
তিয়াশ রেহানাকে বলল – দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলে নাকি? সাথে সাথে দরজা খুললে!!
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রেহানা মৃদু হাসলো।

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে তিয়াশ কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। এমন সময় রেহানা তিয়াশের কাছে এসে আবদারের সুরে বলল- তিয়াশ কালকে প্লিজ ছুটি নাও না।
রেহানার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াশ বেশ চমকে উঠলো এই প্রথম রেহানা তার কাছে এমন করে কিছু চাইলো।

রেহানা বলল- কি হলো কি এত ভাবছো?
– নাহ তেমন কিছু না।
– ছুটি নিতে পারবে না?
– আচ্ছা নিব।

তিয়াশ তার ছুটি কনফার্ম করার পর রাতে ঘুমুতে যাবার আগে নিজের ভেতরে বেশ অপরাধবোধ অনুভব করলো।
তার কাছে মনে হলো রেহানা তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিয়াশ খামোখাই তাকে সন্দেহ করছে।

মাঝরাতে তিয়াশের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই সে লক্ষ্যে করলো রেহানার তার পাশে নেই । তিয়াশের একবার ঘুম ভাঙ্গলে সহজে ঘুম আসতে চায় না তাই সে বিছানায় কি শুয়ে থাকলো। অনেক সময় পার হয়ে যাবার পর ও রেহানাকে না দেখে বেশ অবাক হলো

তিয়াশ বিছানা থেকে উঠে পড়লো। রেহানাকে তন্ন তন্ন করে সারা বাসা খুঁজে পেলো না। এত রাতে কোথায় গেল মেয়েটা??
হঠাৎই তার মনে হলো বাসায় সিসি ক্যামেরা আছে তাই তিয়াশ দ্রুত তার ল্যাপটপে ফুটেজ চেক করে দেখতে যা দেখতে পেলো তা দেখে বেশ প্রচন্ড অবাক হলো রেহানা এত রাতে বাসা থেকে খালি হাতে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।
এত রাতে কোথায় গেল রেহানার? এত রাতে রেহানার কি এমন কাজ থাকতে পারে?
রেহানা কি তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছে?

রেহানার তো তার কাছে বলেছিলো তার প্রেমিক তার ছেড়ে পাঁচ বছর আগে বিদেশ চলে গিয়েছে। এর পর তাদের সম্পর্কটি সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে।

তবে কি সে ফিরে এসেছে?

এরকম হাজারো প্রশ্নের ঘিরে ধরছে তিয়াশকে । প্রচন্ড চিন্তায় যখন তিয়াশ কোন কূলকিনারা করতে পারছেনা ; তখন সদর দরজায় খুট করে শব্দ হলো। তিয়াশ দেখলো রেহানা বাসায় ঢুকছে।
রেহানা ঘরে ঢুকে তিয়াশে জাগ্রত অবস্থায় দেখে মনে হয় চমকে গেল।
রেহানা কাঁপা গলায় বলে উঠলো- তিয়াশ তুমি ঘুম থেকে উঠে পড়লে কখন?

– তুমি কোথায় গিয়েছিলে রেহানা?
– আমি ইয়ে ….মনে ছাদে গিয়েছিলাম।
– এত রাতে ছাদে কি করছিলে?
– আমার ঘুম আসছিল না । তাই হাঁটতে গিয়েছিলাম।
রেহানার এহেন অদ্ভুত জবাবে তিয়াশ প্রচন্ড রেগে উঠলো।
চেঁচিয়ে রেহানা কে বলল – তোমাকে আমি এর আগে ও হাজার বার ছাদে যেতে নিষেধ করেছি তুমি জানো না ছাদে কার্নিশ ভেঙ্গে গিয়েছে কিছু দিন আগে ছাদে যাওয়াটা নিরাপদ না। তারপর ও তুমি কেন গিয়েছো ?
কেন?
বিয়ের পর থেকে তিয়াশ কখনো রেহানার উপরে চেঁচামেচি করা তো দূরে থাক কখনো গলা উঁচু করে কথা পর্যন্ত বলেনি আজকে তিয়াশ তার ওপর চেঁচাচ্ছে!!

রেহানা বুঝতে পারলো তিয়াশ তার ওপরে ভয়াবহ রেগে উঠেছে।
তিয়াশ অনেক রাগের সাথে বলল – তুমি জানো তোমাকে না দেখে আমার কত চিন্তা হয়েছিল।
যখন দেখলাম তুমি বাসা থেকে বের হচ্ছো আমি তখন কত চিন্তায় মধ্যে পড়েছিলাম জানো?

তিয়াশের শেষের কথাটা শুনে রেহানা মনে হলো বেশ অবাক হলো ।
রেহানা বলল – আচ্ছা আমি যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তুমি কিভাবে দেখলে?
তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে …..।
রেহানার হঠাৎ এমন প্রশ্নে তিয়াশ কিছুটা ধাক্কা খায়। আরে তাইতো রেহানা বাসা থেকে বের হবার সময় তার তো দেখার কথা নয় ।

রেহানা আবার কিছু ধরে ফেলল না তো!! রাগের মাথায় এসব কি বলল সে?
রেহানার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্য , তিয়াশ এবার কন্ঠ নরম করে বলল – দেখ আমি আসলে অনেক দুঃখিত । আমার এমনভাবে তোমার সাথে কথা বলা উচিত হয়নি। আসলে আমি রাগের মাথায় কি বলতে কি বলেছি আমি নিজেও জানি না।
রেহানা এবার তিয়াশের হাত দুটো বলল – আমি সত্যিই অনেক সরি। আমার তোমার কথা শোনা উচিত ছিল। আমি তোমাকে প্রমিস করছি আর কখনো আমি এভাবে তোমাকে না জানিয়ে বাইরে যাব না।
তিয়াশের রাগ কমে যায়। সে বলল – আচ্ছা ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। চলো আমরা ঘুমুতে যাই।

পরদিন যেহেতু তিয়াশের ছুটি ছিল তাই সে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম ওঠার পর তিয়াশ দেখল প্রায় একটা বাজে। মধ্যদুপুর হয়ে গেছে।
রেহানার দুপুরের রান্না শেষ। সে বারান্দায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।

রেহানা একজন ফ্রিল্যান্সার। সে বাসায় থেকেই অফিসের কাজ করে। তার স্যালরি ও বেশ ভালোই। আজকে অনেকক্ষণ ধরে একটানা কাজ করে যাচ্ছে রেহানা । অনেক কাজ জমে আছে সেগুলো শেষ করতে হবে।
রেহানা একটানা বিরতিহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছিলো…. এমন সময় তিয়াশ পেছন থেকে ওকে চমকে দিলো। রেহানাকে চমকে উঠতে দেখেই তিয়াশ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
– এত অল্পতেই ভয় পেয়ে গেলে?
-উফ। তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না। এত ভয় কেউ কাউকে পাওয়ায়?
– কেন ? আমাকে ছুটি নিতে বলে তুমি কাজ করছো কেন?
– তো কি করব?
-আমার সাথে…….
তিয়াশের কথা শেষ হওয়ার আগেই বাসায় টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাসার টেলিফোনে সচরাচর কেউ ফোন করে না। এমন সময় কে ফোন করতে পারে?
তিয়াশ টেলিফোনটি ধরলো। অপরপাশ থেকে একটা উদ্বিগ্ন গলার স্বর শুনা গেল।
– তিয়াশ ভাই বলেছেন?
-জ্বি বলছি। আপনি কে বলছেন?
– আমি আপনার কলিগ বাশার বলছি।ভাই আপনার ফোন কতবার ফোন দিছি জানেন? আপনার ফোন বন্ধ কেন? শেষে আপনার টিএন্ডটি নাম্বারে কল দিলাম।
– কেন ভাই কি হয়েছে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
– ভাই আমাদের অফিসে বস খুন হয়েছেন।
-কিহহহ!! কি বলছেন এসব?
– হ্যাঁ ভাই সত্যি। পুলিশ এসেছে এখন ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। ভাই খুব ভয়ে আছি। পুলিশ অফিসের ভেতর থেকে কাউকে অফিসের বাইরে বের হতে দিচ্ছে না।

তিয়াশ তার কলিগ বাশার সাহেবের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিতেই রেহানাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ।
– জানো রেহানা!! আমাদের বস খুন হয়েছেন!!
– ওহ্ আচ্ছা।

তিয়াশ বিস্মিত হয়ে দেখল রেহানা স্বাভাবিক ভাবেই তার কথা শুনলো। যেন সে খুবই সাধারণ কথা শুনছে।

তার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি মেখে আছে। এই মুহূর্তে তিয়াশের কাছে রেহানা নামের ব্যাক্তিটি যেন অচেনা থেকে অচেনা হয়ে উঠছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here