#অন্ধকারের_হাতছানি (পর্ব-২)
#নাজিফা_তাবাসসুম
তিয়াশের বাসায় পুলিশ এসেছে। মূলত রেজাউল করিম এর খুনের বিষয়ে তিয়াশকে জিজ্ঞেসাবাদ করার জন্যই । বসার ঘরে দুজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। তাদের সামনে এই মুহূর্তে তিয়াশ ও রেহানা বসে আছে। রেহানা খুবই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। কিন্তু তিয়াশ প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে আছে। সিনিয়র পুলিশ ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এই দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিয়াশকে দেখে তার সন্দেহ লাগছে। রায়হান আহমেদ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি তিয়াশকে প্রশ্ন করবেন।
জুনিয়র পুলিশ অফিসার রোহিত চাকমা তাকে সেই সুযোগটি না দিয়ে তিয়াশকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো। এতে করে ইন্সপেক্টর রায়হান বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললেন না। শক্ত মুখ করে বসে রইলেন।
রোহিত প্রথমে তিয়াশকে প্রশ্ন করলেন – আপনি তো ইউনাইটেড কোম্পানির সিইও? অ্যাম আই রাইট?
– ইয়ে… মানে..জ ..জ ..জ্বি।
– অদ্ভুত তো ! সিইও কথাটা বলতে এতটা তোতলাতে হয়। মূল প্রশ্ন শুরু করলে কি করবেন?
তিয়াশের প্রচন্ড ভয়ে গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না ছোটবেলা থেকে পুলিশ দেখলে সে ভীষণ ভয় পায়।
– ইয়ে মানে যে আসলে আমি একটু নার্ভাস তো, সেজন্য আরকি একটু ও তোতলানো..আর কি
– আচ্ছা ঠিক আছে , তিয়াশ সাহেব তাহলে আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি আপনি তো গত কালকে আপনার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ছিলেন। ঠিক ?
-জ্বি ।
– আচ্ছা আপনি কি কারনে ছুটিটা নিলেন ? আপনার অফিস অ্যাটেনডেন্স চেক করে দেখলাম আপনি গত এক বছরে বেশি ছুটি নেননি ।বলতে গেলে প্রায় দুই দিন ছুটি নিয়েছেন ।
আপনি হঠাৎ করে কালকে কি মনে করে ছুটি নিলেন এবং কালকেই আপনার বস মারা গেল এটার অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে?
– মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি খুন করেছি!
– অদ্ভুত তো । তিয়াস সাহেব আমিতো একবার ও উচ্চারণ করিনি যে আপনি খুন করেছেন।
আপনি নিজেই হঠাৎ এভাবে বলছেন এর মানে কি ধরবো আপনার ভিতরে কোন ঘাপলা আছে?
তিয়াশ আর কিছু বলার আগেই রেহানা বলে উঠলো-
– ওয়ান সেকেন্ড মিস্টার রোহিত চাকমা আপনি আমার হাসবেন্ড কে এভাবে করে বলতে পারেন না!
আপনার কাছে কি এমন এভিডেন্স আছে যে আমার হাজব্যান্ড এই খুনের সাথে জড়িত?
– দেখুন ম্যাম আমি কিন্তু একবারও বলিনি জড়িত। আপনারাই বারবার টেনে কথা নিয়ে বলছেন।
– আচ্ছা আপনি একবার বলুন তো আমার হাজবেন্ডের বস রেজাউল করিমের ফরেনসিক রিপোর্ট কি এসেছে? সেটা যে আদৌ খুন সেটা কি আপনারা জানেন?
রেহানার এহেন প্রশ্নে জুনিয়র অফিসার রোহিত চাকমা এবং ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন…
কারণ আসলেই তো ফরেনসিক রিপোর্টে আরো একদিন আসবে।কিন্তু তারা বিষয়টিকে খুন হিসেবে বিবেচনা করছে। কারণ লাশটা যেমন বিভৎস অবস্থায় পাওয়া গেছে সেটা খুন ব্যাতীত আত্মহত্যা হতে পারে না। সেটা অবশ্যই খুন।
ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ রোহিতকে আর কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই কথা বলা শুরু করলেন রেহানাকে বললেন – দেখুন ম্যাম আমি আমার দীর্ঘ ২১ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক খুন দেখেছি। তাই আমরা কোন লাশকে দেখলেই আইডেন্টিফাই করতে পারি সেটা খুন নাকি আত্মহত্যা।
ইন্সপেক্টর এর কথা শুনে রেহানা মৃদু হেসে বলল , আপনার এইবারের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন হতেও পারে
সব সময় আমরা যেটা ভাবি সেটা তো আর হয় না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
রায়হান আহমেদ বলে উঠলেন- আপনি এতটা কনফিডেন্ট কিভাবে?যে এটা খুন নয় ?
– আমি মোটেও কনফিডেন্ট না । আমি জাস্ট আপনাদেরকে বলছি ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে না আসতেই এতটা গভীরে না যাওয়াই ভালো।
ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ বললেন – সেটা আমাদের ব্যাপার ; আপনাকে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
রেহানা তার কথা শুনে বলে উঠলো – মাথা ঘামাতে অবশ্যই হবে কারণ আমার হাজব্যান্ড এই ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে ।
ইন্সপেক্টর রায়হান আহমেদ বললেন, আমরা কিন্তু আপনার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলতে এসেছি আপনি মাঝখান থেকে এত কথা বলছেন কেন?
রেহানা বলল ,আপনাদের কনফিউশন দূর করার জন্য আমি মূলত কথা বলছি; আমার হাজব্যান্ড যে খুনের সাথে জড়িত নয় ; সেটা আপনারা আজকে আমার বাসা থেকে বের হওয়ার পরই বুঝতে পারবেন।
রোহিত বলল , কিভাবে?
তিয়াশ বিস্মিত হয়ে রেহানার দিকে তাকিয়ে আছে। রেহানা এত যুক্তি দিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে তা দেখে সে অবাক হয়ে যাচ্ছে।
রেহানার কথা বলার ভঙ্গি তার কাছে অচেনা লাগছে। রেহানা বরাবরই চুপচাপ মেয়ে। হঠাৎ করে সে তিয়াশকে ডিফেন্ড করে এত কথা বলছে বিষয়টা তিয়াশের কাছে অনেক ভালো লাগলো।
রেহানা বলল, শুনুন তাহলে আমার হাজব্যান্ড বাসার নিরাপত্তার জন্য কিছু সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। আপনারা চাইলে সিসি টিভি ফুটেজ গুলো আমি আপনাকে দিতে পারি সেখানে আপনি দেখতে পারেন। আমার হাজব্যান্ড গত পরশু সারারাত বাসায় ছিল। সে বাসা থেকে বের হয়নি এবং সে রাতে ছুটি নেওয়ার পর সকালে অফিসে ও যায়নি।
রেহানার মুখে সিসি ক্যামেরার কথা শুনে তিয়াস ভয়ানক বিস্মিত হলো ।
রেহানা কিভাবে জানে সে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। তার মানে রেহানাকে অনেক আগে থেকেই জানতো কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি। কিন্তু কেন ?
অনেক কিছুই তিয়াশ ভাবতে যাচ্ছিল। তার আগেই রেহানা উঠে গেল।
ইন্সপেক্টর রায়হান তিয়াশের দিকে তাকিয়ে বললেন অদ্ভুত। আপনি পুলিশ দেখে ভয় পেলেও আপনার বুদ্ধি আছে মশাই। তিয়াশ বিব্রতবোধ করল।
রেহানা পাশের ঘর থেকে তার ল্যাপটপটা নিয়ে এলো এবং তার কাছে থাকা কিছু ফুটেজ ইন্সপেক্টর হাতে দিয়ে বললো, আপনি চাইলে ফুটেজ গুলো নিয়ে যেতে পারেন এমনকি এখানে বসে ও দেখতে পারেন।
ইন্সপেক্টর বললো, আচ্ছা ঠিক আছে ।তাহলে চালু করুন । রেহানা ল্যাপটপে ফুটেজগুলো চালু করতেই ইন্সপেক্টর গভীর মনোযোগে দেখতে শুরু করলেন। সিসি ক্যামেরা ফুটেজে সেদিন রাতে তিয়াশের বাসায় ঢোকার পর থেকে, তাদের রাতের খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানোর প্রস্তুতি ,এমনকি ঘুম, সব কিছুই আছে ।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় এটাই যে; সেদিন রাতে যখন রেহানা বাসার বাইরে গিয়েছিল সেই দৃশ্য গুলো ফুটেজের কোথাও নেই।
তিয়াশ ফুটেজে এত বড় ধরনের পরিবর্তন দেখে অনেক অবাক হলো। এটা কিভাবে সম্ভব? সে ভেবে পাচ্ছেনা। এক রাতের মধ্যে এতটা পরিবর্তন কিভাবে হতে পারে ফুটেজে?
ফুটেজ টা দেখার পর ইন্সপেক্টর রায়হান এবং পুলিশ অফিসার নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন যে সেদিন রাতে তিয়াশ বাসা থেকে বের হয়নি।
তারা তিয়াশের বাসা থেকে বের হবে এমন সময়
পুলিশ অফিসার রোহিত থমকে দাঁড়ালেন । সে রেহানাকে বলল, আপনার হাতের অনামিকার আংটিটা তো বেশ সুন্দর।
কথাটা শুনে ইনস্পেক্টর রায়হান বিরক্ত হলেন। তবে রেহানার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে চমকে গেছে।
পুলিশ অফিসাররা বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর তিয়াশ বিমর্ষ হয়ে বসে থাকলো।তার নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে , তার মনে হাজারো প্রশ্ন জমে থাকলে ও লজ্জায় সে রেহানার সাথে কথা বলতে পারছেনা ।
অনেক সময় ধরে তিয়াশকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রেহানা তার পাশে এসে বসলো।
তিয়াশ রেহানার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছে না। রেহানা তাকে হয়তোবা কত না অনেক খারাপ মানুষ ভাবছে।
দুজনে বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রেহানা নীরবতা ভেঙে বলল , তিয়াশ আমি তোমাকে একটা মিথ্যা কথা বলছিলাম। তিয়াশ জিজ্ঞেসাসূচক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
– আমার প্রেমিক সিয়াম পাঁচ বছর আগেই মারা গিয়েছে। খামোখা তাকে নিয়ে সন্দেহ করে কোন লাভ নেই।
– আমাকে ক্ষমা করে দাও রেহানা। আমার ভুল হয়ে গেছে।
রেহানা তিয়াশের কথার জবাব দেয় না। অপলক মায়াময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তিয়াশের কাছে মনে হলো রেহানার চোখের ভাষায় গভীর কোন কষ্ট লুকিয়ে আছে।
বাসা থেকে বের হওয়ার পর ইন্সপেক্টর রায়হান রোহিতের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি এমন ভাবে মিসেস রেহানার প্রশংসা করলে কেন?
আমি প্রথম থেকে খেয়াল করেছিলাম তুমি তার হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে।
স্যার আমি মিসেস রেহানার হাতের যে আংটিটা দেখে প্রশংসা করেছিলাম ; সেটা আর কিছু না পেন্টাকলের ডায়াগ্রাম ছিল।
– কি?
– সেটা একটা পেন্টাকলের ডায়াগ্রাম ছিল।
– পেন্টাকল?
– জি স্যার।
– এটা আবার কি?
-স্যার মিসেস রেহানা আর কেউ নয় একজন শয়তানের পূজারী।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: (পাঠকের অনেকেই হয়ত জানেন না পেন্টাকল কি? পেন্টাকল নিয়ে ছোটখাটো ভাবে কিছু যদি বলতে হয় তবে বলব এটা ইলুমিনাতি অর্থাৎ শয়তানের উপাসনা যারা করে ; তারা সব সময় একটা বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে সেটাকে পেন্টাকল বলা হয়। শয়তানের উপাসকরা এই চিহ্ন দ্বারা শয়তানের উপাসনা করে থাকে।)
এই পর্বে রেহানার আসল পর্দা ফাঁস হলেও তাকে ঘিরে থাকা রহস্যের সমাধান হয়নি । তবে এখন পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের সমাধান না হতে পারে। সেগুলো আগামী পর্বে অর্থাৎ শেষ পর্বে পেয়ে যাবেন ।