অন্য বসন্ত ( অষ্টম পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<৩>
দূরত্ব এমন একটা জিনিস , যেটা সব সময় রাস্তা দিয়ে মাপা যায় না | রাস্তা কম হলেও মনের দূরত্ব যখন বাড়ে , তখন সেই কাছের মানুষটার কাছে পৌঁছনোটা অসম্ভব হয়ে যায় | কৃষ্ণেন্দুর আজকাল এই কথাটা ভীষণভাবে মনে হয় | যখন ও রোজ রাতে গিয়ে দীপ্তিদের বাড়ির সামনেটায় দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষন ! নিস্পলক দৃষ্টিতে দীপ্তির ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে , একবার ওর দেখা পাওয়ার আশায় ! তখন খুব মনে হয় | দীপ্তি সেই সময় আনমনে যদি কখনো জানলার কাছে চলেও আসে , কৃষ্ণেন্দুকে দেখেই সরে যায় ভেতরে , অথবা পর্দাটা টেনে দেয় নিজে থেকে | কথা বলা তো দূরে থাক , কৃষ্ণেন্দুকে আজকাল দীপ্তি দেখেও অদেখা করে দেয় | কোনো অচেনা মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যেরকম কারোর কিছু আসে যায় না , দীপ্তিরও যেন ঠিক কৃষ্ণেন্দুকে ওদের বাড়ির বাইরে দেখলে ওরকমই মনে হয় ! এইভাবে নিঃস্তব্ধতার ভিড়ে আস্তে আস্তে দুটো মাস কেটে গেছে শহর থেকে | কৃষ্ণেন্দু এই সময়ের ভিড়ে কিরকম একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে | যার জীবনে শুধু একটা অফিস আছে | সে সেখানে রোজ যায় , কাজের মধ্যে হারিয়ে ফেলে নিজেকে ইচ্ছে করেই | তারপর ধীরে ধীরে রাত নাম শহরে | রাস্তাঘাট ক্লান্ত হয়ে যায় | কৃষ্ণেন্দু সেই ক্লান্ত রাস্তা পেরিয়ে অফিস থেকে ওই পুরোনো ঠিকানাটার সামনে এসে দাঁড়ায় | জানে , এই বাড়িতে ওর আর ঢোকা হবে না ! কিন্তু তা ও এই বাড়িটাকে দেখলে মনে হয় , নিজের কিছু একটা আছে | হয়তো তারা এখন রেগে | অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে | কিন্তু একদিন ঠিক সেই অভিমান গলবে | একদিন ঠিক আবার ওর জীবনে সব কিছু আগের মতন হয়ে যাবে | ওই নিজের মানুষগুলো ফিরে আসবে ! এই ভাবনার ভিড়েই এক দু ঘন্টা অদ্ভুতভাবে কেটে যায় কৃষ্ণেন্দুর | একা নিঃস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে | কখনো পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় , তো কখনো কালো মেঘ ভরা আকাশে , বৃষ্টি মাথায় নিয়ে | তারপর হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগে যেন | ভেতর থেকে শেষ বলে মনে হয় নিজেকে | তখন কৃষ্ণেন্দু ওর বাংলোতে ফেরে | ঘর ভর্তি ফার্ণিচারেরা যেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করে শুধু | নিজেকেও সেই লোকহীন , শব্দহীন বাড়িটায় ওই ফার্নিচারগুলোর মতনই লাগে ওর , প্রাণহীন | তারপর কোনোদিন ইচ্ছে হলে খায় , কোনোদিন খায় না | বদলে অনেক সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেয় অনেকগুলো একসঙ্গে | একটা ওষুধেও আজকাল কাজ হয় না | কিছুতেই চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে না এমনিতে | নেশা , বা ওষুধ , কিছু একটা লাগেই চোখ বন্ধ করার জন্য | তখন মাঝে মাঝে মনে হয় , যদি এই চোখটা আর না খোলে ! রাতটা আর শেষ না হয় ! তাহলে কি দীপ্তি আর আলো মা ফিরবে ! ওকে শেষ দেখা দেখতে ! তখন কি রাগ ভাঙবে ওদের ! পৃথিবীতে না হলেও ওদের মনে নিজের জায়গাটা করে নিতে পারবে কৃষ্ণেন্দু আরেকবার ! এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই ঘুমের ওষুধের পাতা অথবা এলকোহলের নেশা কাজ করে দেয় ওর অজান্তে এরপর | কিরকম নিস্তেজ হয়ে যায় কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষনের জন্য | সম্পর্ক থাকে না তখন আর ওই যন্ত্রনাগুলোর সঙ্গে ওর | কিন্তু একটা সময় আবার ওষুধ এলকোহলগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয় | না চাইতেও চোখ খুলতে হয় তখন ওকে | এমন একটা দিন দেখতে হয় , যেখানে শুধু একাকিত্ব আর বিষন্নতা ছাড়া আর কিছু বাকি নেই ! তারপর আবার কাজ খুঁজতে শুরু করে কৃষ্ণেন্দু | কাজের ভিড়ে নিজের মনটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে শুরু করে আরেকবার |
এইসবের মাঝেই সেদিন একটা ঘটনা ঘটেছিলো | বেস্ট ইয়ুথ আইকন এর একটা অ্যাওয়ার্ড কৃষ্ণেন্দুকে এবার দেয়া হয়েছে একটা নিউজ চ্যানেল থেকে | এতো কম বয়সে এইরকম একটা সাকসেসফুল বিজনেস রান করাচ্ছে ও ! মিডিয়ার নজর তো থাকবেই ওর ওপর | তবে সেদিন আনমনে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে সেই অ্যাওয়ার্ড শো এর লাইভ টেলিকাস্ট দেখে আলো যেন থমকে গেলো হঠাৎ | স্ক্রিনের ওপারে কৃষ্ণেন্দু স্টেজে উঠে এওয়ার্ড নিচ্ছে , সেই দৃশ্যটা দেখে ! আপনাআপনিই মুখে একটা হাসি চলে এলো ওর | সেই সময়েই আবার ওই এওয়ার্ড শো এর এঙ্কর কৃষ্ণেন্দুকে বলে উঠলো নিজে থেকে , যেন ও কিছু লাইন বলে অডিয়েন্সের জন্য | কৃষ্ণেন্দু তো একটা ইন্সপিরেশন আমাদের নিউ জেনারেশনের কাছে | এতো কম বয়সে এতটা সাকসেস কি করে পেতে পারে লোকজন , সেই নিয়ে যদি কৃষ্ণেন্দু কিছু বলে ! আলো এবার টিভির ওপারে আরোই স্তব্ধ হয়ে গেলো | ছেলেটাকে তো নিজে আগলে রেখেই মানুষ করেছিল একটা সময়ে | সে আজ এতো বড়ো একটা অনুষ্ঠানে সম্মানিত হচ্ছে ! ভেবেই আনন্দ হচ্ছিলো ভীষণ | আর কৃষ্ণেন্দু এই এই আনন্দের ভিড়েই মাইকটা হাতে নিয়ে বলে উঠলো সেদিন , কিছু অন্য কথা | ও এই সম্মানটা পেয়েও থমথমে মুখে উত্তর দিলো , ————— ” সরি , কিন্তু আমি কারোর ইন্সপিরেশন হতে পারি না | আমি সেইরকম মানুষ নোই | হ্যাঁ, শুধু সাকসেস দিয়ে বিচার করলে হয়তো আমি ভীষণ ভালো একজন বিজনেসম্যান , কিন্তু জীবন দিয়ে বিচার করলে আমি একেবারে নিঃস্ব একটা মানুষ | আমি ঠিক সময়ে আমার নিজের লোকেদের ইম্পর্টেন্সটা বুঝিনি | তাদের এত কষ্ট দিয়েছি , এতো ভুল করেছি, যে আজ ওই নিজের মানুষগুলো আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে | আসলে ভীষণ বেশি কেরিয়ার , ব্যবসা , লাভ ক্ষতির হিসাব নিয়ে ভাবতাম একটা সময়ে , যে নিজের লোকগুলোর কথা ভাবতেই ভুলে গেছিলাম | মনে হতো ,এরা তো আছেই ! এরা তো থাকবেই ! টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছিলাম এই সম্পর্কগুলোকে কেমন | আর সেই জন্য একদিন সব শেষ হয়ে গেলো | খালি হয়ে গেলো একদম হাতটা | শুধু টাকা , ব্যবসা , আর সাকসেস ছাড়া , একটাও নিজের লোক পরে রইলো না আমার কাছে | তাই সবাইকে বলবো , ডোন্ট বি লাইক মি .. আমি হয়ে কোনো লাভ নেই | বরং নিজের মতন হও | কেরিয়ারের সঙ্গে নিজের লোকগুলোকেও সময় দাও | তাহলে জীবনে আসল সাকসেসটা পাবে |”
কথাগুলো শেষ করেই ও ধীরে ধীরে নেমে গেলো স্টেজটা থেকে | শো এর এঙ্কর থেকে অডিয়েন্স , সবাই কিরকম চুপ হয়ে গেলো ওর উত্তরটা শুনে ! কেউই বুঝতে পারছিলো না এই কথাগুলো শুনে ঠিক কিভাবে রিয়্যাক্ট করা যায় ! আর এদিকে আলোর মুখের হাসিটাও কিরকম হঠাৎ মিলিয়ে গেলো টিভির এপারে | কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো যেন ভেতরে গিয়ে লাগলো ! বুঝতে পারলো সেই মুহূর্তে , যে ছেলেটা ভালো নেই | ওর অন্ধকার মুখ , ওর থমকে থাকা দুটো চোখ যেন সব বলে দিলো আলোকে | সেই সময়েই হঠাৎ খেয়াল করলো ড্রইং রুমের দরজায় দীপ্তি দাঁড়িয়ে | ও কি তাহলে টিভিতে কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো শুনছিলো এতক্ষন ! প্রশ্নটা আলোর মনে আসতেই দীপ্তি দরজাটা খালি করে নিজের ঘরে চলে গেলো কিছু না বলে | তবে সেই মুহূর্তে আলোও আর চুপ করে থাকতে পারলো না যেন | ও আজ প্রথম দীপ্তিকে কৃষ্ণেন্দুর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য ওর ঘরে এলো |
সেদিন ওই মুহূর্তে সন্ধ্যে নেমে এসেছিলো কলকাতায় | দীপ্তি জানলার কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল একা একা | মা যে ঘরে এসেছে , প্রথমে খেয়ালই করেনি ! গলার আওয়াজটা শুনে খেয়াল হলো | আলো এই মুহূর্তে এসে সোজাসুজিই দীপ্তিকে জিজ্ঞাসা করে উঠলো আস্তে গলায় , ——— ” কৃষ্ণেন্দুর ইন্টারভিউটা দেখছিলিস তুই টিভি তে ? ”
দীপ্তি প্রশ্নটা শুনেও চুপ রইলো | কিছু সময় উত্তর দেয়ার মতন কোনো কথা থাকে না আসলে | আলো এই নিঃস্তব্ধতার ভিড়েই বলে উঠলো এবার ,
———– ” মানুষ বদলায় দীপ্তি | পরিস্থিতি অনেক সময় ভুলগুলোকে বুঝিয়ে দেয় | কৃষ্ণেন্দু দু মাস ধরে রোজ আমাদের বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে ! ঝড় জল বৃষ্টি সব কিছুর মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে কতদিন ! শুধু একটু কথা বলতে চায় তোর সঙ্গে, ব্যাস | আর আজ যেইভাবে এতগুলোর লোকের সামনে নিজের ভুলটা স্বীকার করলো ছেলেটা , তারপরও কি এটা বুঝতে পারছিস না , যে ও সত্যি বদলে গেছে | ও বুঝতে পেরেছে নিজের ভুলগুলো | ”
দীপ্তি সেদিন মায়ের কথাগুলো শুনেও কয়েক সেকেন্ড চুপ ছিল | তবে এইসবের পর তো আর নিরুত্তর হয়ে থাকা যায় না ! তাই ও দৃঢ় গলায়ই এবার বলে উঠলো আলোকে ,
———- ” কিন্তু এই নিয়ে আমার তো কিছু করার নেই মা | আমিও নিজের ভুলটা বুঝে গিয়েছি | দিনের পর দিন আমার থেকে পুরোপুরি আলাদা , একটা স্বার্থপর হিসাবি মানুষকে ভালোবেসে , সঙ্গে থেকে যেই ভুলটা করেছিলাম , সেটাকে বুঝে গিয়েছি | আর কোনোদিন আমার পক্ষে ওই ভুলটা রিপিট করা সম্ভব হবে না | আর কৃষ্ণেন্দুর ভালো খারাপ থাকাতে আমার কোনো হাত নেই | আমি কাউকে বলিনি আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে ! তাই প্লিজ আমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বোলো না | ”
কথাগুলো শেষ করেই দীপ্তি এবার ল্যাপটপটা খুলে বসলো খাটে | হয়তো মায়ের আরো কোনো প্রশ্ন থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যই এই মিথ্যে ব্যাস্ততাকে আঁকড়ে ধরলো ও | আলো নিজেও বুঝতে পারলো দীপ্তির এই আড়ালটা | তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেলো ও | তবে দীপ্তির এই মুহূর্তে না চাইতেও কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো কানে বেজে উঠলো হঠাৎ ! ও কি সত্যিই নিজের ভুলগুলোকে বুঝেছে ! কথাটা যেন একবার আনমনে মনে এসেই মিলিয়ে গেলো কেমন | বুঝলেই বা কি ! যেটাকে একটা সময় নিজের হাতে দিনের পর দিন ধরে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে , সেই কাঁচগুলোকে আর জুড়বে কি ভাবে ! চাইলেও আর এটা সম্ভব নয় |
দীপ্তির এইসব ভাবনার ভিড়ে এরপর তিনটে সপ্তাহ কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে | আজ বুধবার | এখন প্রায় রাত দশটা | দীপ্তি আজ নিজের ঘরে বসে বসে কিছু কোম্পানিকে মেল্ করছে নিজের সিভি | সব কটা কোম্পানিই ব্যাঙ্গালোর , পুনা , হায়দ্রাবাদ , জামশেদপুর , এইসব জায়গার | আসলে আজকাল আর এই শহরটা ভালো লাগে না ঠিক ! মনে হয় এই রাস্তাগুলো , এই ভিড় , ট্রাম বাস , জ্যাম , ধুলো বালি সব কিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে | আগে যখন বাবা বেঁচে ছিল , দীপ্তিরা তখন থাকতো দার্জিলিং এ | তারপর যখন ওর ক্লাস সিক্স , তখন হঠাৎই বাবা মারা গেলো | একটা হার্ট এটার্ক এ সব শেষ | আলো তারপর আর একা একা কি করেই বা মেয়েকে নিয়ে ওই পাহাড়ি শহরে থাকে ! কলকাতায় তাও কিছু আত্মীয় স্বজন , চেনা লোকজন আছে ওদের | সেই জন্যই পাকাপাকি ভাবে ওরা কলকাতায় চলে এলো সেই বছর | তবে দীপ্তির মন যদিও ওই মেঘ কুয়াশার দেশেই পরে ছিল অনেকদিন | সেই সময় এই শহরটাকে কিরকম ভিড়ে ঠাসা , ঘামে জর্জরিত মন খারাপের শহর বলে মনে হতো ওর | তখনও মনে হতো এই কলকাতা ছেড়ে যদি ও কোথাও পালিয়ে যেতে পারতো ! তবে সেই সময় ভাবনাটা হঠাৎ থমকে গেছিলো দীপ্তির | যখন ওই শান্ত চোখের ছেলেটা এসেছিলো ওদের বাড়িতে, সেই সময়ে ওর ক্লাস নাইন | তারপর কখন ঠিক বুঝতে পারেনি , এই ভিড়ে ঠাসা গুমোট কলকাতায় হঠাৎ যেন বসন্ত নেমে এসেছিলো , একদম বিনা নোটিশে ! এই শহরের অলিগলি , বাস ট্রাম , চুপচাপ নিজের স্রোতে বয়ে চলা গঙ্গা , সব কিছুকেই দীপ্তি ভালোবাসতে শুরু করেছিল যেন | কথাটা ভেবে হঠাৎ আবার কেমন মন খারাপটা ফিরে এলো ওর | ল্যাপটপের সামনে স্থির চোখে বসে পুরোনো দিনগুলো যে কেন আচমকা ভেসে উঠলো ! দীপ্তির এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সেদিন মায়ের গলার আওয়াজ কানে এলো | বেশ জোরেই চিৎকার করে ডাকছে আলো এখন ওকে ! কি হলো আবার ! এইভাবে ডাকছে কেন মা ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি ড্রইং রুমে গেলো | তবে এই ঘরে এসেই পা-টা থমকে গেলো যেন | টিভি স্ক্রিনে কৃষ্ণেন্দুদের ফ্যাক্টরিটা দেখাচ্ছে | আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে সেটা এখন ! দীপ্তি স্থির হয়ে গেলো যেন এই দৃশ্যটা দেখে ! আলো সেদিন নিউজটা আনমনেই চালিয়েছিল রান্না করতে করতে | ভাবতে পারেনি যে এইরকম একটা খবর হঠাৎ ভেসে উঠবে চোখের সামনে | কিভাবে আগুন লেগেছে কেউ বলতে পারছে না ঠিকভাবে ! হয়তো শর্ট সার্কিট থেকে ! তবে লাখ টাকার জিনিস পুড়ে গেছে ভেতরে এই দু তিন ঘন্টায়ই | কিরকম অদ্ভুত লাগছে এই মুহূর্তে দীপ্তির | অফিস থেকে তো মাঝে মাঝেই এই ফ্যাক্টরির ভিসিটে যেত দীপ্তি | এইভাবে আগুন লেগে গেলো সেখানে ! মেলাতে পারছে না যেন | সেই সময়েই আলো হঠাৎ ফোনটা তুলে কৃষ্ণেন্দুর নাম্বারটা ডায়েল করলো নিজে থেকে | না , দীপ্তি আর কিছুতেই না বলতে পারলো না মা কে | ও জানে কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা না হয় অব্দি ওর মা শান্তি পাবে না | তাই কোনো বারণ করলো না আজ |
আলো সেই সময় শুধু কৃষ্ণেন্দুর কথাই ভাবছিলো আসলে | ছেলেটা ঠিক আছে তো ! নিউজে বলছে কৃষ্ণেন্দু না কি প্রথমে ওই আগুনের মধ্যে ঢুকেওছিলো , যদি কোনোভাবে কিছু বাঁচানো যায় ! তবে যারা কাজ করছিলো তারাই আর এগোতে দেয়নি | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রিংটা বন্ধ হয়ে ফোনটা ধরলো কৃষ্ণেন্দু | তবে কিছু ঠিক বলতে পারলো না আজ | ফোনটা ধরেও কিরকম নিঃস্তব্ধই রয়ে গেলো | আলো সেই মুহূর্তে বেশ জোরেই বলে উঠলো ওকে , ———— ” হ্যালো কৃষ্ণেন্দু ! কিছু বলছিস না কেন ? ঠিক আছিস তো তুই ? ”
কথাগুলো শুনে কৃষ্ণেন্দু কিরকম ভাঙা , শান্ত গলায় উত্তর দিলো , ———— ” আছি ! তুমি কেমন আছো আলো মা ? কতদিন বাদে শুনলাম তোমার গলাটা !”
আলো এর উত্তরে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | এই গলার আওয়াজে যেন নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কান্না ছিল একটা ! আলো বুঝতে পারছিলো , ওই আগের কৃষ্ণেন্দুর প্রাণখোলা কথাগুলো কিরকম শেষ হয়ে গেছে | আজকের ঘটনাটা যে ছেলেটাকে খুব বড়ো একটা ধাক্কা দিয়েছে , সেটা যেন ওর এই ভাঙা গলাটাই বুঝিয়ে দিলো | আলো সেই মুহূর্তে আর কোনো কথা না ভেবেই বলে উঠলো , ———– ” তুই এক্ষুনি বাড়ি আয় | আমি কিছু জানি না | তুই বাড়ি আয় | ”
কথাটা শুনে কৃষ্ণেন্দু যেন ভেজা গলায়ই বলে উঠলো হঠাৎ , ———- ” যাবো আলো মা ? সত্যি !”
আলো এর উত্তর দীপ্তির দিকে তাকিয়ে দিলো , ——— ” হ্যাঁ , তুই এক্ষুনি আয় | আমি তোকে দেখতে চাই এখন |”
না , দীপ্তিও সেই মুহূর্তে কোনো আপত্তি করতে পারেনি এই কথাটায় | এতটা পাথর ও আজও হয়ে যায়নি | আর মায়ের এমনিই হাই প্রেসারের প্রব্লেম আছে | এই সময়ে কৃষ্ণেন্দুকে না দেখতে পারলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে আলোর | দীপ্তি সেইসব জানে বলেই চুপ ছিল | তবে সেই রাতে কৃষ্ণেন্দু যখন ওদের বাড়ি এসেছিলো , তখন ঘড়িতে একটা | সেদিন দীপ্তিই দরজাটা খুলেছিলো ওকে | আলোর প্রেসারের জন্য মাথা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে বলে সোফাটায় বসেছিল | কিন্তু কৃষ্ণেন্দুকে দেখে এই মুহূর্তে আলোর সঙ্গে সঙ্গে দীপ্তিও কিরকম স্তব্ধ হয়ে গেলো যেন | এলোমেলো চুল , ছন্নছাড়া চেহারা , সাদা জামাটায় এদিক ওদিক কালো কার্বন জমা , আর হাত দুটো ! আঙুলের ওপর থেকে সারা হাতের পাতা , পুড়ে ঝলসে আছে অনেকটা | রক্ত বেরোচ্ছে সেখান দিয়ে | দীপ্তি ঠিক কিছুতেই এই মুহূর্তে পুরোনো কথা ভেবে দূরে সরে থাকতে পারলো না আর | এই অবস্থায় ও সত্যি কখনো কৃষ্ণেন্দুকে দেখতে চায়নি | নিজে থেকেই তাই ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে এসেছিলো ওর জন্য | আলোর শরীর তো কৃষ্ণেন্দুর এই চেহারা দেখে আরোই যেন খারাপ হয়ে গেছিলো কিরকম | ওর ওই আগুনে পুড়ে যাওয়া হাত দুটোর দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছিলো না ঠিক ! কষ্ট হচ্ছিলো ভীষণ বুকে | দীপ্তিই তাই ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো কৃষ্ণেন্দুকে | আলো এরপর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছিল | কিন্তু কোনোভাবেই কোনো উত্তর দেয়নি ছেলেটা ওকে | যেন একটা অদ্ভুত ট্রমার মধ্যে ছিল ও | ওই আগুনের দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে সব ছাই করে দেয়ার দৃশ্যটা ভাসছিলো ওর সামনে | খোলা চোখেই যেন দেখতে পাচ্ছিলো ওই আগুনটাকে ও | তাই কোনো কথা বলার মতন অবস্থায় ছিল না ঠিক | এরপর আলোর কথায় দীপ্তি ওকে ওর পুরোনো ঘরটায় নিয়ে গিয়েছিলো | অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল কৃষ্ণেন্দু এরপর | দীপ্তি বুঝতে পারেনি ও ঘুমিয়েছে কি না ! মনে হচ্ছিলো যেন ওই অন্ধকারের আড়ালে ঢাকতে চাইছে কৃষ্ণেন্দু নিজেকে | দীপ্তি বুঝতে পারছিলো , একটা বড়ো ধাক্কা লেগেছে ওর | সামলাতে সময় লাগবে | তবে আজ অনেকদিন বাদে কৃষ্ণেন্দুর জন্য কষ্ট হচ্ছিলো একটা | ওর মা বাবার এক্সিডেন্টের পর আলো যখন ওকে প্রথম এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো , তখনও কৃষ্ণেন্দু ঠিক এইভাবেই ছিল | স্তব্ধ , চুপচাপ , থমকে যাওয়া একটা ছেলের মতন | আজ যেন সেই পুরোনো কৃষ্ণেন্দুটাই ফিরে এসেছে আবার ওদের বাড়িতে | কথাগুলো আনমনে মনে আসতেই দীপ্তি আবার সামলালো নিজেকে এখন | না , এইভাবে কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে ভাবলে চলবে না ওর | এখন ওরা দুজন দুটো আলাদা পৃথিবীর মানুষ | কৃষ্ণেন্দু খারাপ থাকুক , এটা দীপ্তি চায় না ঠিকই | তবে কৃষ্ণেন্দুর জীবনে খারাপ কিছু হলে সেটা ঠিক করার দ্বায়ও আর দীপ্তির না | কথাটা ভেবেই নরম মনটাকে শক্ত করলো ও আরেকবার | আর এই ভাবনার মাঝেই রাতটা আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো শহরে | নতুন একটা ভোর তৈরী করার জন্য |
<৪>
পরের দিনের সকালে দীপ্তি একটু আনমনাভাবেই ড্রইংরুমে এলো | কৃষ্ণেন্দু ডাইনিং টেবিলের সামনে চুপচাপ বসে | দীপ্তি এটা দূর থেকে খেয়াল করলেও আজ মুখ ঘুরিয়ে নিজের ঘরে চলে যেতে পারলো না ! ব্রেকফাস্ট করে ওকে বেরোতে হবে একটা পোস্ট করার জন্য | তাই ডাইনিং টেবিলটার সামনে যেতেই হলো | কৃষ্ণেন্দু হঠাৎ ওকে এতো কাছ থেকে দেখে কয়েক সেকেন্ড যেন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল | দীপ্তি ব্যাপারটা দেখেও অদেখা করে ব্রেড টোস্ট তিনটে নিজের প্লেটে তুলে নিলো | না , ও এখানে খাবে না এখন | ব্রেকফাস্টটা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েই খাবে | এইসবই ভাবছিলো , তখন কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো একটু আস্তে গলায় হঠাৎ , ———– ” কেমন আছিস তুই ?”
দীপ্তি অন্যদিন হলে হয়তো উত্তর দিতো না | কিন্তু আজ কৃষ্ণেন্দুর ওই ফ্যাকাসে মুখটা এক পলক দেখে চুপ থাকতে পারলো না | অল্প কথায় বলে উঠলো , ——– ” ঠিক আছি |”
এই মুহূর্তে আলো ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে অবাক | কৃষ্ণেন্দুর প্লেটটা আধ ঘন্টা আগে যেইরকম দিয়ে গিয়েছিলো , সেইরকমই সাজানো আছে | মানে ছেলেটা কিছুই খায়নি ! কালকে রাতেও তো কিছু খায়নি | এই রকম করলে কি করে হবে ! এইসবই ভাবছিলো , তখনই কৃষ্ণেন্দু ওর সামনে দীপ্তিকে বলে উঠলো , ———- ” তোর হেল্প দরকার আমার দীপ্তি | নইলে পারবো না আর এই কোম্পানিটাকে সামলাতে | কাল আমাদের সব অর্ডার , যা কিছু রেডি ছিল, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে | মেশিনগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে | ইন্সুরেন্সের টাকা পেলেও , সেটা তো ক্লাইন্টদের এডভান্স ফেরত দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাবে ! আমার যেই ফিন্যান্সিয়াল এডভাইসর এর টিমটা ছিল , তাকেও আর আমি এফোর্ড করতে পারবো না | হাতে শুধু আর একটাই প্রজেক্ট আছে আমাদের | যদি ওটা কোনরকমভাবে কমপ্লিট করতে পারি , তাহলে এই সেন টেক্সটাইলটা বেঁচে যাবে | কিন্তু এই প্রজেক্টের জন্য প্রোডাকশন কন্ট্রোল , মেটেরিয়াল সাপ্লাই , বাজেট করা , এইসব আমি একা করতে পারবো না | আর খুব বড়ো টিম নিয়ে কাজ করাও আর পসিবল না | কারণ আমি অতজনকে স্যালারি দিয়ে রাখতে পারবো না | তুই যদি আরেকবার আগের মতন আমার সঙ্গে না থাকিস , আমি পারবো না আর সব কিছু সামলাতে | আর এই কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে গেলে এতগুলো ওয়ার্কার্স ! প্রায় তিনশো লোক কাজ হারিয়ে ফেলবে ! প্লিজ , আমার জন্য না , ওদের জন্য আমাকে হেল্প কর | প্লিজ .. ”
কৃষ্ণেন্দু প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো সেদিন দীপ্তিকে | দীপ্তি হঠাৎ করে এইসব কথা এক্সপেক্ট করেনি একেবারে ! আসলে যে ওর সঙ্গে এতো মাস ধরে কোনো কথা বললো না , চিনলো না ওকে , কৃষ্ণেন্দু তার কাছ থেকে কিভাবে হেল্প চাইছে নিজের মুখে এটাই বুঝতে পারছিলো না ! তবে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে দীপ্তির যা ই হয়ে থাক , শেষ কথাটা তো ওর ঠিক | এই কোম্পানিটা বন্ধ হলে শুধু একা কৃষ্ণেন্দু শেষ হবে না | সঙ্গে ওই তিনশো ওয়ার্কার্সদেরও শেষ হয়ে যেতে হবে ! এই বাজারে চাকরি চলে যাওয়ার মানে অনেক বড়ো ধাক্কা | কিন্তু আবার সেই ছেলেটার সাথে দিনের পর দিন একই অফিসে কাজ করাটাও তো দীপ্তির পক্ষে অসম্ভব , যার সঙ্গে সারা জীবনের মতন অচেনা হয়ে যাওয়ারই কথা ছিল ! এই সব ভাবনার ভিড়েই দীপ্তি একটু সময় নিয়ে এবার উত্তর দিলো কৃষ্ণেন্দুকে , ———- ” ঠিক আছে , আমি এই প্রজেক্টটা কমপ্লিট হওয়া অব্দি তোমার সঙ্গে কাজ করবো | কিন্তু একটা শর্তে | যদি তুমি এই প্রজেক্টটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সাথে আর কোনো রকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা না করো , কখনো আর আমাদের বাড়ির সামনে এসে না দাঁড়াও তাহলেই | এই প্রজেক্টের পর , না আমরা তোমাকে চিনবো , না তুমি আমাদের চেনার চেষ্টা করবে | তাহলেই আমি কাজ করবো | নইলে না |”
কথাটা শুনে কৃষ্ণেন্দু যেন এই মুহূর্তে থমকে গেলো কেমন ! দীপ্তি মন থেকে তার মানে এতটাই দূরে সরে গেছে , যে এরকম একটা শর্ত দিয়ে দিলো ওকে ! কথাটা ভাবতেই আলো এবার জোর দিয়েই বলে উঠলো দীপ্তিকে , ———- ” তুই এইসব কি বলছিস ! এই পরিস্থিতিতে এইভাবে ওর সঙ্গে কেন কথা বলছিস ?”
দীপ্তি কথাটা শুনে বেশ দৃঢ় গলায়ই ওর মা কে উত্তর দিলো এবার , ———- ” কারণ আমি আর কখনো ওই পুরোনো পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে চাই না ,তাই | আর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা তো শুরু থেকে দরকারেরই ছিল | মনের সম্পর্ক তো না | তাহলে পুরোনো ঘটনাগুলো ঘটতো না কখনো | সেই জন্য দরকার যেদিন শেষ হয়ে যাবে , সেদিন থেকে তো আর যোগাযোগ রাখার কোনো মানে হয় না ! আর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে কাজটাও আমি শুধুমাত্র ওই অতগুলো ওয়ার্কার্সের কথা ভেবেই করতে রাজি হয়েছি | আমি চাই না ওই মানুষগুলোর কাছ থেকে ওদের কাজটা চলে যাক | যাইহোক , এই শর্তটা মানতে যদি কৃষ্ণেন্দু রাজি হয় , তাহলেই এই প্রজেক্টে আমি কাজ করবো | ”
কথাগুলো শেষ করে এবার দীপ্তি থামলো | কৃষ্ণেন্দুর উত্তরের অপেক্ষায় | তবে কৃষ্ণেন্দু কয়েক সেকেন্ড নিঃস্তব্ধ থেকে হঠাৎ ওকে বলে উঠলো , ———– ” তুই সত্যি আর আমার সঙ্গে কোনো কন্ট্যাক্ট রাখতে চাস না ? তুই সত্যি আমাকে এই শর্তটা দিলি ?”
দীপ্তি এর উত্তরে ওর চোখে চোখ রেখেই বললো , ———-” আমি এমনি এমনি কোনো কথা বলি না কৃষ্ণেন্দু | না ভেবে | তোমার সঙ্গে এই ঘটনাটা না ঘটলে , আজও আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতাম না এইভাবে ! জানো নিশ্চয়ই |”
দীপ্তির এই উত্তরে আলো আবার উত্তেজিত হয় বলে উঠলো , ———— ” তুই এইসব এই পরিস্থিতে বলিস না ওকে | প্লিজ | থাম |”
কিন্তু আলোর কথাটা শেষ হতেই কৃষ্ণেন্দু এবার অন্য কথা বলে উঠলো , ও দীপ্তির দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো , ——— ” ঠিকই | আমার জায়গাটা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ | আমি ভুলবো না এটা কখনো | আর তুই চিন্তা করিস না | এই প্রজেক্টটা কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পর আর কখনো তোর আর আলো মার্ সামনে আসবো না আমি | আই প্রমিস |”
কথাটা বলে কৃষ্ণেন্দুর আলোর দিকে তাকিয়ে শুধু একটা শব্দই বললো এবার , ——– ” আসি |”
তারপর ঘরটা খালি করে দিয়ে বেরিয়ে এলো রাস্তায় | এই বাড়িতে যে আর ওর জন্য কোনো জায়গা নেই , এই বাড়ির মানুষগুলোর মনে যে কৃষ্ণেন্দু আর নেই , এটা এতদিন জানলেও এতো সত্যি মানতে পারতো না কিছুতেই | তবে আজ মানতে বাধ্য হলো | এই খোলা আকাশ , এই ফাঁকা রাস্তা , আর একটা নিঃস্ব জীবন ওকে বাস্তবটা বুঝিয়ে দিলো ভীষণ কঠিনভাবে ! এই মুহূর্তে হঠাৎ অনেক পুরোনো দুটো মুখ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো কেমন | মা বাবা | কতদিন আগে দেখেছিলো ওদের ! আবছা হয়ে গেছে ছবিটা | তা ও কিরকম মনে পড়ছে মুখগুলো ! অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে ওদের ! যেন দূরে দাঁড়িয়ে আছে ! কিছুর একটা অপেক্ষা করছে | কথাটা ভেবেই চোখটা ভিজে এলো ওর | সেদিন যদি গাড়িতে কৃষ্ণেন্দু নিজেও যেত মা বাবার সঙ্গে ! বিয়ে বাড়ির ইনভিটেশনটা তো ওরও ছিল | শুধু সামনে পরীক্ষা বলে মা যেতে বারণ করলো | এখন মনে হচ্ছে , কেন বারণ করলো ! কেন নিলো না ওকে নিজেদের সঙ্গে ! তাহলে এইভাবে একা হয়ে যেতে হতো না আজ ! সেদিন শেষ হয়ে গেলে এইভাবে রোজ রোজ শেষ হতে হতো না আর ! নিজের ভুলগুলোর সঙ্গে এইভাবে বাঁচতে হতো না ওকে ! কথাটা আনমনে এসে ধাক্কা দিলো যেন ভেতরে | মনে মনে খুব ক্লান্ত লাগলো ওর | কিছুতেই আর লড়তে ইচ্ছে করছে না এখন | ওই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মা বাবার আবছা লাল রঙের গাড়িটা ওকে ডাকছে যেন ! মনে হচ্ছে দৌড়ে যদি একবার ওই গাড়িটায় উঠে যেতে পারতো ! তাহলে মুক্তি পেতো | এই ক্লান্ত , ভুলে ভরা জীবনটা থেকে মুক্তি |
চলবে