অন্য বসন্ত ( দশম পর্ব )
ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
কৃষ্ণেন্দু কিছুটা দূরে নিজের চেয়ারে বসেছিল এখন | এই মুহূর্তে আবার দীপ্তি যেন খেয়াল করলো , কৃষ্ণেন্দুকে ভীষণ উইক লাগছে আজ | অন্য দিনের থেকেও বেশি ফ্যাকাসে অন্ধকার লাগছে মুখটা | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও এগিয়ে গেলো | তারপর কৃষ্ণেন্দুর কাছে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললো , —————– ” আমার রিজাইনটা | এন্ড কংগ্রাচুলেসন্স | আজকের অর্ডারটা কমপ্লিট হওয়ার জন্য | আমি যেখানেই থাকি , সব সময় এটাই চাইবো , তোমার ব্যবসা , তোমার কেরিয়ার যেন আরো এগিয়ে যায় | অল দ্যা বেস্ট … আসলাম |”
কথাটা শেষ হতেই কৃষ্ণেন্দু এবার একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো হঠাৎ , ————– ” তুই যেখানেই থাকিস মানে ! কোথাও যাচ্ছিস ? ”
দীপ্তি কথাটা শুনে দু সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলো , ———– ” ব্যাঙ্গালোর | চাকরি নিয়ে | কিন্তু এর বেশি কিছু জিজ্ঞেস কোরো না | এড্রেস আমি দিতে পারবো না | যাইহোক আসলাম |”
কথাগুলো বলেই দীপ্তি এবার দরজার দিকে ফিরে তাকালো , এগিয়ে যাওয়ার জন্য | কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর একটা কথায় হঠাৎ থমকে গেলো | কৃষ্ণেন্দু যেন কিরকম ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলো আজ ,
————- ” আমার জন্য এই শহরটা ছাড়ছিস ! যাতে কোনোদিনও আর দেখা না করতে পারি ! চিন্তা করিস না | আমি আর যাবো না দীপ্তি | আর কোনোদিনও দেখা হবে না আমাদের | ডিস্টার্ব করবো না তোকে , প্রমিস |”
কথাগুলো যেন কানে এসে লাগলো এখন দীপ্তির | কৃষ্ণেন্দুর গলার আওয়াজের মধ্যে আজ কিরকম একটা ক্লান্তি ছিল | শুনে মনে হচ্ছিলো কিছু একটা শেষ হয়ে যাচ্ছে | আর কৃষ্ণেন্দু যেন সেই শেষটা জানিয়ে দিলো ওকে | কথাগুলো মনে হতেই দীপ্তি একবার ফিরে তাকালো কৃষ্ণেন্দুর দিকে | ওই ফ্যাকাসে মুখটাকে এক পলক দেখে মনে হলো আর বেশিক্ষন থাকলে ও জরিয়ে পরবে আবার | এই ছেলেটার জন্য টান তৈরী হয়ে যাবে আগের মতন | যেটা দীপ্তি আর কখনোই হতে দেবে না | পুরোনো ভুলটা আর করবে না ও | কথাটা ভেবেই মনটাকে শক্ত করলো যেন আজ| তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে জোরে পা চালালো , ঘরটা থেকে আর কৃষ্ণেন্দুর জীবন থেকে সারা জীবনের মতন বেরিয়ে আসার জন্য |
কিছু শেষ হয়ত এইভাবেই লেখা থাকে । একটা অসমাপ্ত বইয়ের গল্পের মতন । দীপ্তি আর কৃষ্ণেন্দু র গল্পটাও তাই । একটা অসমাপ্ত পরিণতি হীন গল্প । যার শেষের কাছে ফিরে যাওয়া যায় না । মাঝ পথেই বইটাকে বন্ধ করে দিতে হয় । সেইদিন রাতে দীপ্তি একলা ঘরে বসে বসে এই কথাগুলোই ভাবছিল । আর মাঝে মাঝে না চাইতেও যেন শুনতে পাচ্ছিল ওই ক্লান্ত গলার স্বরটা । ওই ফ্যাকাসে থমকে থাকা মুখটা যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও বলে মনে হচ্ছিল হঠাৎ । কিন্তু দীপ্তির যে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই আর । একবার এই ছেলেটাকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট দিয়েছে নিজেকে । কিন্তু একই ভুল তো বার বার করতে পারে না । তাই চোখটা ভিজে এলেও দীপ্তি স্থির ছিল মনে । বোঝানোর চেষ্টা করছিল নিজেকে , যে নতুন শহরে গেলে সব ভুলে যাবে ও । নতুন অনেক অচেনা মুখের ভিরে আর মনে পড়বে সেই চেনা মুখটাকে । কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন আলতো করে চোখের পাতায় ঘুম এসে জড়ো হয়ে ছিল ওর । কিন্তু স্বপ্নেও ওই কৃষ্ণেন্দু ই ভেসে এলো আজ । ছেলেটা যেন খুব কাছে ওর এসে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ । দীপ্তি স্পষ্ট শুনতে পেল কৃষ্ণেন্দু র নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর আওয়াজ । তারপর কিছু না জানিয়েই ভীষণ অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিকে । দীপ্তি বুঝতে পারলো না ছেলেটা কোথাও হারিয়ে গেল আচমকা । দীপ্তি ওই অন্ধকারের মধ্যে অনেক হাত্রালো , অনেক খোঁজার চেষ্টা করলো । কিন্তু তা ও কৃষ্ণেন্দু কে দেখতে পেলো না কোথাও ! এই মুহুর্তেই হঠাৎ চোখে একটা আলোর রেশ এসে পরলো । দীপ্তি যেন দম বন্ধ করা অন্ধকার পেরিয়ে চোখ মেলে তাকালো হঠাৎ । কি দেখছিল এতক্ষণ ও ! স্বপ্ন ! কথাটা ভেবেই মাথায় হাত দিল । বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমেছে কপালে ! কি অদ্ভুত স্বপ্নটা ছিল ! সত্যি । কথাটা ভাবতে ভাবতেই আবারও না চাইতেই কৃষ্ণেন্দু র কথা মনে এলো কেমন । ও ঠিক আছে তো ! ভাবনা টা কিরকম এসে ধাক্কা দিলো মনে । দীপ্তি আবার এই মুহূর্তে নিজের মনকে শাসন করলো । না , বেশি ভাবছে ও । ঠিক কেন থাকবে না কৃষ্ণেন্দু । আজ থেকে তো ওর আবার ভালো থাকার দিন শুরু । ওর জীবনের সব থেকে কাছের ব্যবসাটা বেঁচে গেল ! আবার আস্তে আস্তে সাকসেস , টাকা পয়সা , নাম সব ফিরে আসবে ওর । আজ তো খুশির দিন । আজকের দিনে কৃষ্ণেন্দু র মনে পুরনো কারোর জন্য ভাবনা আসতেই পারে না ! সেই সময়ই পাবে না হয়ত । কথাটা যেন জোর করেই ভাবার চেষ্টা করলো দীপ্তি । তারপর নিজের চোখটা বন্ধ করে আরেকবার নতুন করে ঘুমনোর চেষ্টা করলো ও ।
যাইহোক , সেদিন এরপর বেলার দিকে দীপ্তি গিয়েছিল একটু ব্যাঙ্কে । ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার আগে কিছু টাকা তোলার ছিল ওর। কিন্তু সেদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে থমকে গেল হঠাৎ ! পরিতোষ জেঠুকে সামনে দেখে !ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরোচ্ছে এখন | হঠাৎ এই সময় ব্যাংকে ! অফিস টাইমে ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি এগিয়ে গেলো সামনে | পরিতোষ জেঠু যেন একটু ইতঃস্তত হয়ে গেলো দীপ্তিকে দেখে এই মুহূর্তে | দীপ্তি ব্যাপারটা খেয়াল করেই জিজ্ঞেস করে উঠলো , ——– ” কি হলো পরিতোষ জেঠু ? তুমি ব্যাঙ্কে ? আজ অফিস যাওনি ?”
কথাটা শুনে উনি যেন একটু কথা সাজিয়ে বলে উঠলো , ———- ” হ্যাঁ , আসলে কাজ ছিল কিছু , তাই |”
কি হলো হঠাৎ ! পরিতোষ জেঠু এইরকম এলোমেলো ব্যবহার করছে কেন হঠাৎ ! আর হাতে ঐসব কিসের ফাইল ! কথাটা দীপ্তি ভাবতেই ব্যাংকের ভিড়ে একটা লোক পরিতোষ জেঠুকে একটু যেন ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেলো ভেতরে , আর আচমকা ওর হাতে ধরা ফাইল দুটো পরে গেলো মাটিতে | কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চারিদিকে | দীপ্তি সেই মুহূর্তেই মাটিতে কাগজগুলো তোলার জন্য এগিয়ে গেলো | কিন্তু একটা পেপারের ওপর চোখ যেতেই কিরকম অবাক হয়ে গেলো ও ! কৃষ্ণেন্দুর বাড়ির দলিলের কপি ! এটা পরিতোষ জেঠুর কাছে কি করছে ! কথাটা ভেবেই ও অনেক প্রশ্ন নিয়ে তাকালো লোকটার দিকে | পরিতোষ জেঠুও যেন এই মুহূর্তে কিছুক্ষনের জন্য উত্তরহীন হয়ে রইলো দীপ্তির কাছে | তারপর নিজেই বলে উঠলো আস্তে গলায় ,
————– ” আসলে কৃষ্ণেন্দু কাউকে জানাতে বারণ করেছিল বলে বলিনি | ও এক মাস আগে বাড়িটা মর্গেজ রেখে লোন নিয়েছিল কোম্পানির জন্য | নইলে এতজনের স্যালারি ,র মেটেরিয়ালস এর জন্য এডভান্সের টাকা , সব জোগাড় করতে পারতো না ! তাই | আমি কিন্তু তখন বারণ করেছিলাম ওকে জানিস | কিন্তু শোনেনি | কি বলি বল !”
কথাটা শুনে দীপ্তি এই সময়ে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | কৃষ্ণেন্দু বাড়িটাকে বন্দক রেখে লোন নিয়েছিল ! আর এই ব্যাপারটা কাউকে জানতে দেয়নি ! ওই বাড়িটা ওর কাছে কতটা দামি ছিল দীপ্তি অন্তত সেটা জানতো প্রথম দিন থেকে | তাও এতো বড়ো একটা রিস্ক নিলো ! যদি প্রজেক্টা ঠিক মতন কমপ্লিট না হতো , তাহলে তো মাথার থেকে ছাদটাই চলে যেত ওর | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দীপ্তির যেন খুব অদ্ভুত লাগছিলো এবার | কৃষ্ণেন্দু তাহলে এতটাই বদলে গেছে এই ক মাসে ! যেই ছেলেটা আগে নিজের লাভ ক্ষতি ছাড়া এক পার্সেন্টও বেশি কিছু ভাবতে পারতো না , সে অন্যদের যাতে এক মাসও মাইনে বন্ধ না হয় , এডভান্সের টাকা আটকে না যায় , তার জন্য নিজের বাড়িটা অব্দি ব্যাংকের কাছে জমা রেখে দিলো ! কথাটা ভেবেই ওর সেই থমকে থাকা ফ্যাকাসে মুখটা যেন আরেকবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো , আর আজ সত্যি কষ্ট হলো ওর , মন থেকে ছেলেটার জন্য | তার মানে কৃষ্ণেন্দু এই এক মাস কতটা মেন্টাল স্ট্রেসের মধ্যে ছিল | কতটা চাপ ছিল ওর ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই পরিতোষ জেঠু এবার বলে উঠলো , ———— ” কি জানি কি হয়েছে ! আজ কৃষ্ণেন্দু অফিসে আসেনি জানিস | ফোনটাও সুইচ অফ | সেই জন্যই তো ওকে ছাড়াই ব্যাংক এ আসতে হলো | তবে ওর সাইন ছাড়া তো কাজ কিছুই হবে না | ছেলেটা সত্যি কিরকম অদ্ভুত হয়ে গেছে অনেকদিন ধরে ! যেদিন থেকে আরেকবার অফিসে জয়েন করেছি , খেয়াল করছি | কৃষ্ণেন্দু কিরকম যন্ত্রের মতন কাজ করে যায় যেন | কোনো হাসি নেই , কোনো কথা নেই ! আর লাস্ট কদিন তো ওকে দেখে আমার ভীষণ উইক লাগছিলো ! জানি না শরীর টোরির ঠিক আছে কি না ! দেখি , এরপর একবার যাবো ওর বাড়ি দেখা করতে | ”
কথাগুলো বলেই পরিতোষ জেঠু আর দাঁড়ালো না বেশিক্ষণ দীপ্তির সামনে | তবে দীপ্তি ভেতরে ভেতরে কিরকম থমকে গেলো হঠাৎ ! মনে পরে গেলো এই এক মাসে দিপ্তিও তো কৃষ্ণেন্দুর সাথে কোনো কথা বলেনি | একই অফিসে কাজ করে সারাক্ষন অচেনা থেকেছে ! ওর কি উচিত ছিল কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলার ! তাহলে কি কৃষ্ণেন্দু একটু হালকা হতো মন থেকে ! একটু ভালো থাকতো ও ! সেদিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই এরপর দীপ্তি বাড়ি ফিরেছিল | তবে বাড়ি আসার দু মিনিটের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো , যেটা সব কিছু এলোমেলো করে দিলো ওর | সেদিন বাড়ি ফেরার পর একটা পোস্ট এসেছিলো দীপ্তির নামে | দীপ্তি সাইন করে খামটা খোলার আগের মুহূর্ত অব্দি জানতো না যে এটা শেষ চিঠি | সেদিন আনমনে খামটা খুলে কাগজগুলো বার করেই ও স্তব্ধ হয়ে গেছিলো হঠাৎ | এইসব কি ! দানপত্র ! কৃষ্ণেন্দুর বিজনেসের পেপার ! কৃষ্ণেন্দু নিজের সমস্ত ব্যবসা , সেন টেক্সটাইল সব কিছু দীপ্তির নামে করে দিয়েছে ! আর সঙ্গে একটা চিঠি পাঠিয়েছে ওকে | দীপ্তি কিছু বুঝতে না পেরে খুলে দেখলো তখনই চিঠিটা | কতগুলো শব্দ হয়ে সেই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো হঠাৎ ,
———– ” আমার ব্যবসাটা আমি তোকে দিলাম দীপ্তি | কারণ আমি জানি , তুই আমার থেকে অনেক বেশি ভালো করে , সবার কথা ভেবে এই ব্যবসাটা চালাতে পারবি | এছাড়া আর কোনোভাবে দূরে যেতে পারতাম না | তাই নিজেকে সরিয়ে নিলাম | আর তুই নিশ্চিন্তে কলকাতাতে থাকতে পারিস | কোনো চিন্তা করিস না | দেখা হবে না আর আমার সঙ্গে | যাইহোক , ভালো থাকিস | ”
কথাগুলো যেন ধাক্কা দিলো দীপ্তিকে এখন | কি লিখেছে কৃষ্ণেন্দু এইসব ! আর সরিয়ে নিলাম মানেটা কি ! কথাটা মনে হতেই আলো এসে হাজির হলো ড্রইং রুমে | দীপ্তিকে ঐভাবে কতগুলো কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলোও অবাক | কি হলো হঠাৎ ! কথাটা ভেবে আলো সেই মুহূর্তে এগিয়ে গেলো দীপ্তির কাছে | তারপর জিজ্ঞেস করে উঠলো ওকে ,
———– ” কি হয়েছে তোর ? এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? আর এইগুলো কিসের কাগজ তোর হাতে ?”
দীপ্তি এতগুলো প্রশ্নের যেন কোনো উত্তর দিতে পারলো না এখন | কোনো কথা সাজিয়ে উঠতে পারলো না মনে | শুধু কাগজগুলো ওর মার্ হাতে ধরিয়ে দিলো | আলো কিছু বুঝতে না পেরেই কাগজের লেখাগুলোতে চোখ মেলালো | তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে ও নিজেও থমকে গেলো যেন | কৃষ্ণেন্দু নিজের পুরো ব্যবসাটা দীপ্তির নামে লিখে দিয়ে চলে গেছে ! শেষে এইভাবে শেষ করলো ছেলেটা ! আলোর কথাগুলো ভেবে চোখ দুটো ভিজে এলো হঠাৎ | দীপ্তির তবে এই সময়ের মধ্যে যেন সম্ভিত ফিরেছে | ও তাড়াতাড়ি নিজের মোবাইল থেকে কৃষ্ণেন্দুর নাম্বারটা ডায়েল করলো | এখন ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে দীপ্তিকে | কিন্তু এই মুহূর্তে কল করতেই উল্টো দিক থেকে শুধু নিঃস্তব্ধতাই ভেসে এলো আজ দীপ্তির কাছে | কৃষ্ণেন্দুর মোবাইলটা সুইচ অফ | দীপ্তি কি করবে এবার বুঝতে না পেরে পরিতোষ জেঠুর নাম্বারটা ডায়েল করলো | ব্যাংক এ বলছিলো না উনি , যে কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি যাবে এরপর দেখা করতে ! পরিতোষ জেঠু ঠিক তাহলে কৃষ্ণেন্দুর খবর দিতে পারবে | কথাটা মনে হতেই কয়েকটা রিং বেজে পরিতোষ জেঠু ফোনটা তুলল ও নিজের | দীপ্তি এই সময় একটু এলোমেলো হয়েই জিজ্ঞেস করলো ,
————– ” হ্যালো , পরিতোষ জেঠু ,তুমি গেছিলে কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি ? দেখা হলো ওর সাথে ? ঠিক আছে তো ও ?”
দীপ্তির এতগুলো প্রশ্নের কোনো মানে খুঁজে না পেয়ে উনি অবাক হয়েই উত্তর দিলো যেন , ———– ” না রে | কৃষ্ণেন্দু তো কাল রাত থেকেই বাড়ি ফেরেনি শুনলাম | ওর বাড়ির সব স্টাফরা বললো আমাকে | কিন্তু তোর গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন ? সব ঠিক আছে তো?”
দীপ্তি এর উত্তরে কিরকম স্তব্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ | ফোনটা কান থেকে সরিয়ে দিলো নিজের | শরীরটা যেন কিরকম হালকা মনে হতে শুরু করেছে এই মুহূর্তে | পাশের চেয়ারটা ধরে কোনো রকমে সামলালো নিজেকে | তার মানে কৃষ্ণেন্দু ওর বাড়িতেও যায়নি ! ফোনটা সুইচ অফ | অফিসে আসেনি ! তাহলে কি সত্যি চলে গেলো ছেলেটা ! সব ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো ! কালকে কি তাহলে সেই জন্যই ওকে বলেছিলো , আর দেখা হবে না ! দীপ্তি যেন আর কিছু ভাবতে পারলো না এখন | কি করবে ও এরপর ! কোথায় খুঁজবে কৃষ্ণেন্দুকে ! আর কাল তো সত্যি দেখে মনে হচ্ছিলো কৃষ্ণেন্দুর শরীর ঠিক নেই | শুধু দীপ্তি কেন , পরিতোষ জেঠু অব্দি খেয়াল করেছে ব্যাপারটা |
এই রকম শরীর নিয়ে কোথায় গেলো ছেলেটা ! এরপর যদি কিছু হয়ে যায় ওর ! না , আর যেন ঠিক ভাবতে পারলো না দীপ্তি | কৃষ্ণেন্দু ঠিক আছে | কিছু হয়নি ওর | কথাগুলো যেন নিজের মনে বলেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো এখন | এরপর প্রায় দু ঘন্টায় ওর কল লিস্টে যতজন চেনা বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন ছিল কৃষ্ণেন্দুর , প্রত্যেকের নাম্বার ট্রাই করে দেখলো দীপ্তি | কিন্তু সবার কাছ থেকে উত্তরে একটা ‘না’ ই শুনতে হলো ওকে | কৃষ্ণেন্দু চেনা পরিচিত কারোর বাড়িই যায়নি ! দীপ্তি কথাগুলো শুনে যেন কিছু বুঝতে পারছে না এখন | কাল রাত থেকে তাহলে কোথায় আছে কৃষ্ণেন্দু ! আচ্ছা , ও কলকাতার বাইরে কোথাও যায়নি তো ? না কি দেশের বাইরে ! তাহলে নিশ্চই কোনো ট্রেন টিকিট , অথবা এয়ার টিকিট কাটবে নিজের ! এর উত্তর তো ওর পার্সোনাল এসিস্টেন্টই দিতে পারে | কথাটা মনে হতেই দীপ্তি এবার কৃষ্ণেন্দুর নতুন এসিস্টেন্ট বিমলদাকে কল করলো | ওর একাউন্ট ডিটেলসও বিমলদা হ্যান্ডেল করে | খুব সহজে খোঁজ নিয়ে বলে দিতে পারবে কৃষ্ণেন্দু কোনো টিকিট কেটেছে কি না ! এইসব ভেবে একটু যেন আশা জেগেছিলো মনে ওর | ছেলেটার একটা খোঁজ পাওয়ার আশা | তবে কিছুক্ষনের মধ্যে সেটাও শেষ হয়ে গেলো | বিমলদা খোঁজ নিয়ে ফোনে জানালো যে কৃষ্ণেন্দুর নামে কোনো ট্রেনের টিকিট , কোনো এয়ারটিকিট , কিছুই বুক হয়নি ! ব্যাংকের একাউন্টগুলোতেও চেক করেছেন উনি | কৃষ্ণেন্দু একটা টাকাও কোনো ব্যাংক একাউন্ট থেকে উইড্র করেনি | আর সব থেকে বড়ো কথা , যেটা শুনে দীপ্তির আরোও সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো , কৃষ্ণেন্দুর গাড়িটা কাল রাত থেকেই অফিসের পার্কিং এ রাখা | ও নিজের গাড়িও নিয়ে যায়নি সঙ্গে | দীপ্তি এতো কিছু জানার পর সত্যি কিরকম নিশ্চুপ হয়ে গেলো | তার মানে কৃষ্ণেন্দু ইচ্ছে করেই ওর কোনো হদিশ না রাখার জন্য গাড়িটা পর্যন্ত নিয়ে যায়নি | দীপ্তি এরপর আর ঠিক কিছু ভাবতে পারলো না এই মুহূর্তে ! যে নিজেই নিজের খোঁজ দিতে চায় না , তাকে কি করে ফিরিয়ে আনবে দীপ্তি ! কথাটা মনে আসতেই এই প্রথম আলো ওর কাছে এসে নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো হঠাৎ , ———- ” আমি জানতাম , এইরকমই কিছু একটা হবে | অনেকদিন আগে থেকে জানতাম | কৃষ্ণেন্দু বদলে গিয়েছিলো দীপ্তি | নইলে রোজ রাতে এসে ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও দিনের পর দিন এই বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো না ছেলেটা ! কিন্তু তুই সেইসব কিছুই দেখেও দেখিসনি কখনো | তুই তো না চিনেই থাকতে চেয়েছিলিস | তাহলে আজ কেন খুঁজছিস ? আজ তো আর এইসবের দরকার নেই | ”
দীপ্তি এই সময়ে মায়ের কথাগুলো শুনে যেন থমকে গেলো | চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো কিরকম ওর | প্রচন্ড জল এসে ভিড় করলো সেখানে | দিনের পর দিন দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুকে এভয়েড করেছে | ওর সাথে কথা বলেনি | ওকে বাড়ির বাইরে দেখে কত সময় নিজের ঘরের জানলার পর্দাটা টেনে দিয়েছে মুখের ওপর ! কোনোদিনও আর ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি | এমন কি কালকেও , যখন কৃষ্ণেন্দু শেষবার ওকে বললো , আর কখনো দেখা না হওয়ার কথা ! তখনও দীপ্তি বুঝলো না কিছু ! একবার ফিরে দেখলো না ওকে ! কালও যদি দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলতো , তাহলে হয়তো আজ এইসব কিছুই হতো না ! ছেলেটা ওদের সঙ্গে থাকতো | ঠিক থাকতো | কথাগুলো ভেবে কিরকম দিশাহারা লাগছে যেন ওর | না , এইভাবে চুপচাপ বসে থাকলে হবে না | দীপ্তিকে কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে বার করতেই হবে | এইভাবে ওর জন্য কেউ চলে যেতে পারে না ! এমনিতেই অনেকটা টাইম পার হয়ে গেছে ! এখন দুপুর একটা বাজে | দীপ্তি পুলিশ স্টেশন যাবে এখন | মিসিং রিপর্ট লেখাতে | পুলিশ খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবে ছেলেটাকে | কথাগুলো ভেবেই ও চোখের জলটা মুছে কিছুটা শক্ত করলো নিজেকে | তারপর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ,
————— ” আমি এইভাবে কাউকে হারিয়ে যেতে দেব না ! আমি পুলিশ স্টেশন যাচ্ছি | যে করেই হোক , আমি কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে বার করবো | এইভাবে কোনো কিছু শেষ হয় না !”
কথাগুলো বলেই দীপ্তি আর অপেক্ষা করলো না | বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে | কিন্তু আলোর যেন এই মুহূর্তে কিরকম শেষ লাগছে ভেতর থেকে | মনে পরে যাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুর সেই থমকে থাকা চেহারা , ওর স্থির দুটো চোখকে | এবার কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে পাওয়া এতো সহজ হবে না আর ! দীপ্তি না এরপর কৃষ্ণেন্দুর নিথর শরীরটা পায় কোথাও থেকে ! কথাটা ভেবেই ভয়ে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চারিদিকটা আজ আলোর |
চলবে