অন্য বসন্ত ( সপ্তম পর্ব)

0
913

অন্য বসন্ত ( সপ্তম পর্ব)
ঈপ্সিতা_মিত্র
( নতুন শুরুর অধ্যায় )
<২>
দীপ্তির মনে অনিকেতের জন্য জায়গা তৈরী হওয়াটা কি কিছু হলেও ওর ভুল না ! আলো মার্ শরীর খারাপের দিন যখন দীপ্তি ওকে বার বার করে বাড়ি ফিরতে বলেছিলো , তখন কি ওর কাজের কথা না ভেবে একবার দীপ্তির জন্য থমকে দাঁড়ানো উচিত হয়নি ! কিছু সন্ধ্যে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে দুজনের জন্য মনে রাখার মতন কিছু মুহূর্ত তৈরী করার কি দরকার ছিল না ! সারাক্ষন কাজের চিন্তা না করে নিজের লোকগুলোর জন্য ভাবাটাও কি একবার উচিত ছিল না ওর ! না কি দীপ্তিকে , আলো মাকে ও নিজের অজান্তেই টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছিল | ওরা তো ছিলই , ওরা তো থাকবেই , এইরকম একটা চিন্তা কৃষ্ণেন্দুর মধ্যে এসে ভিড় করেছিল ! তাই হয়তো মনের দূরত্বটা অনেকদিন আগে থেকেই বাড়তে শুরু করেছিল ! ফাঁক তৈরী হয়ে যাচ্ছিলো খুব ওদের মধ্যে ! আর অনিকেত সহজেই সেই ফাঁকে নিজের জায়গাটা করে নিয়েছিল এতো শক্তভাবে | কথাগুলো ভেবে আরো কষ্টগুলো যেন কৃষ্ণেন্দুর মধ্যে পাক খাচ্ছিলো রোজ কেমন ! সমস্ত রাত নির্ঘুম কাটছিলো ওর | কিন্তু তাও কিছুতেই আর সব ভুলে একটা ফোন করা হয়ে উঠলো না ওর | কৃষ্ণেন্দুকে যখন দীপ্তিরা এক রাতের মধ্যে ছেড়েই দিয়েছে , সেখানে ওর আর বলার মতন কিছু বাকি নেই | আর সেই রাতে অন্তত কৃষ্ণেন্দুর দোষ ছিল না | কৃষ্ণেন্দু এই দু মাসে আজও বিশ্বাস করে যে সেইদিন দীপ্তির মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিল মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে বুঝতে | একটা ডান্স এর জন্য জিজ্ঞেস করাটা কোনো অভদ্রতা না | কিন্তু হয়তো দীপ্তির একটা কারণ দরকার ছিল চলে যাওয়ার | তাই নিজের ভুল বোঝাটাকে স্বীকার না করে ও চলে গেলো ! অনিকেতের জন্য চলে গেলো !

এই বিশ্বাসটাকে নিয়েই দিনগুলো কাটছিল কৃষ্ণেন্দুর | অন্ধকার কিছু দিন | যেখানে জেগে , ঘুমিয়ে , কাজের ভিড়ে , একান্তে , শুধুই একটা কষ্ট , একটা খারাপ লাগার ভিড় | যেখানে আর কোনো ডিল সাইন করে সেই ফাঁক পূর্ণ হয় না | যেখানে তৃষার দেয়া নতুন নতুন বিজনেস প্রপোসাল , আইডিয়া শুনেও আর কোনো এক্সাইটমেন্ট হয় না | যেখানে অফিসের এতো লোকের ভিড়েও সারাক্ষন মনে হয় আসল যার থাকার কথা , সে ই নেই | দীপ্তি আর কোথাও নেই | হাজার হাজার আলবর্ষের মাঝে ওদের পুরোনো দিনগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও ! কার ভুল , কার দোষ জানে না | তবে সব এলোমেলো হয়ে গেছে | শেষ হয়ে গেছে হঠাৎ |
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই কৃষ্ণেন্দু গাড়ি চালাচ্ছিল কলকাতার ভিড় রাস্তায় | আজ খুব বৃষ্টি চারিদিকে | কালো মেঘ ঢেকে আছে পুরো শহরটাকে | তাই হয়তো ওরও পুরোনো কথা এতো বেশি করে মনে পড়ছে আজ | এই বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ভীষণ অগোছালো , একা লাগছে নিজেকে | এই সবের মধ্যেই একটা রেড সিগন্যাল হঠাৎ থমকে দিলো গাড়িটা | ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে তখন আবছা শহর | তার মাঝেই কৃষ্ণেন্দুর চোখ দুটো এদিক ওদিক চলে যাচ্ছিলো | কিন্তু ফুটের ওপারে রেস্টুরেন্টটায় চোখটা গিয়েই ওর অজান্তে থমকে গেলো আচমকা | কাঁচের জানলার ওপারে ওই দুজন কারা ! একজন তো অনিকেত | কিন্তু অনিকেত এটা কার হাত ধরে বসে আছে ! উল্টোদিকের মেয়েটা তো দীপ্তি না ! এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেও জল ভেজা কাঁচের আড়ালে থাকা দুটো মুখ চিনতে ওর ভুল হলো না একদম | ঠিকই দেখেছে ও | অনিকেত একটা মেয়ের সঙ্গে বসে আছে , টেবিলের ওপর হাতটা আলতো করে ধরে | কিন্তু এই অচেনা মুখের মেয়েটা কে ! দীপ্তির সঙ্গে ওর রিলেশনের কি হলো তাহলে ! না কি ছেলেটার এই ধরণেরই ক্যারেক্টার | দীপ্তির সঙ্গে আরো অনেককে নাচাচ্ছে ! ভেবেই অনিকেতের ওপর রাগটা ফিরে এলো আবার | এদিকে গ্রিন সিগন্যাল হতেই গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই হলো কিছুটা | তবে কৃষ্ণেন্দু একটু দূরে গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে সাইডে পার্ক করলো এবার | তারপর সোজা হাঁটতে শুরু করলো রেস্টুরেন্টটার দিকে | অনিকেতের ওপর রাগটা এবার বেশ গাঢ় হচ্ছে ওর | আজ ওর এইরকম একা হয়ে যাওয়ার জন্য তো এই ছেলেটাই দ্বায়ী | ওর সব শেষ করে দিয়ে আবার এখন অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম হচ্ছে ! এই ভেবেই ও রেস্টুরেন্টটাতে ঢুকলো মুখের পেশিগুলোকে শক্ত করে | আজ অনিকেতকে ছাড়বে না ! এই মেয়েটার সামনে মুখোশটা খুলে রেখে দেবে ওর | এই ভেবেই অনিকেতের সামনে গেলো | এই মুহূর্তে অনিকেতও আচমকা ওকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেছিলো যেন ! তবে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো নিজে থেকে ,
———– ” এই মেয়েটা আবার কে অনিকেত ! আর কতজনের লাইফ নিয়ে খেলবে তুমি ? দীপ্তিকে তো আমার থেকে দূরে করেই দিলে | এবার অন্তত নিজে ওর সঙ্গে লয়াল থাকো ! না কি তোমার প্রত্যেক মাসে নতুন নতুন মেয়ে লাগে ফুর্তি করার জন্য ? এই মেয়েটাকে কবে তুললে আবার ?”
কথাগুলো যেন ধাক্কা দিলো আজ অনিকেতকে | রেস্টুরেন্টের সমস্ত লোক এখন কৃষ্ণেন্দুর চিৎকারে ওদের দিকে তাকিয়ে | অনিকেতের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য হঠাৎ | তবে এই লোকটা আজ সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছে নিজের | আর চুপ থাকবে না অনিকেত | অনেক হয়েছে ! কথাটা ভেবেই ও উঠে দাঁড়িয়ে নিজের দৃঢ় গলায় বললো ,
———- ” আপনি আসলে কি জানেন স্যার , একজন অন্ধ মানুষ | যার চোখ আছে ঠিকই | কিন্তু সে দেখতে পায় না | এই মেয়েটা যে এখন আমার সঙ্গে বসে আছে , ওর নাম নিশা | আমার কলেজ লাইফ থেকে গার্লফ্রেন্ড | ঈশ্বরের কৃপায় একটা ব্যাংকে চাকরিও পেয়ে গেছি আমি এই দু মাসে | নেক্সট উইক থেকে জয়েনিং | আর তারপরই বিয়ে করবো আমরা | আর এই সমস্ত কথা দীপ্তি আমাদের আলাপের প্রথম দিন থেকে জানে | ও তো এখন থেকেই ডিসাইড করছে , কিভাবে আমাদের বিয়েতে আমাদের হেল্প করবে সব এরেঞ্জমেন্টস এ | শুরু থেকে আমার আর দীপ্তির ঠিক এরকমই সম্পর্ক ছিল | বন্ধুত্বের সম্পর্ক | কিন্তু আপনি এইসব কোনোদিনই বোঝেননি ! তবে আপনার মতন লোকের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আর আমি কিছু এক্সপেক্টও করি না ! যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে একটা ভিড় পার্টিতে ঠিকভাবে প্রটেক্ট করতে পারে না ! তার সঙ্গে ইভ টিসিং এর মতন ঘটনা ঘটলেও তাকে বিশ্বাস করে না ! উল্টে সবার সামনে তাকে ওই লোকটাকে সরি বলতে বলে ! তার মতন স্পাইনলেস মানুষের কাছ থেকে আর কি ই বা এক্সপেক্ট করা যায় ! আর হ্যাঁ , আমি জানি , এতদিন বাদেও আজ আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না আবারও | কিন্তু পারলে একবার সেইদিনের সিসিটিভি ফুটেজটা একটু চেক করে নেবেন | কে ঠিক , কে ভুল পরিষ্কার হয়ে যাবে | ”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলেছিলো সেইদিন অনিকেত কৃষ্ণেন্দুকে | তারপর নিশার হাতটা শক্ত করে ধরে বেরিয়ে যেতে যাচ্ছিলো রেস্টুরেন্টটা থেকে | তবে নিশা শেষবারের মতন ওকে থামিয়ে কৃষ্ণেন্দুকে কিছু কথা বলে উঠলো নিজে থেকেই , যেটা শোনার জন্য কৃষ্ণেন্দু ঠিক তৈরী ছিল না | সেইদিন এই অচেনা মেয়েটা কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রেখেই বলেছিলো যাওয়ার আগে ,
————- ” আপনার কথা শুনেছিলাম অনেক অনিকেতের কাছে | দীপ্তির জন্য খারাপ লাগতো তখন খুব আমার এইসব শুনে | একটা ঠিক মানুষ খুঁজে পাওয়া আসলে খুব টাফ | আর নিজের জীবনের এতগুলো বছর ও যাকে দিলো , খারাপ সময়ে যার পাশে শক্ত করে দাঁড়ালো , সে ভালো সময় আসতেই ভুলে গেলো ! এটা ভেবেই খুব বাজে লাগতো মন থেকে মেয়েটার জন্য | তবে আজ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে , ক্ষতিটা ওর হয়নি | ক্ষতিটা আসলে আপনার | একটা ঠিক মানুষকে পেয়েও নিজের কাছে রাখতে পারলেন না ! অনেক লোকসান করে ফেললেন নিজের | সারা জীবনেও এই লসটা পূরণ হবে না কখনো | এইটুকু বলে দিতে পারি | যাইহোক , জানি না এতো দামি একজনকে হারিয়েও ভালো থাকা যায় কি না ! তবে চেষ্টা করবেন |”
কথাগুলো শেষ করেই আর নিশা অপেক্ষা করলো না এক মুহূর্তও |অনিকেতের হাতটা খুব শক্ত করে ধরে বেরিয়ে গেলো রেস্টুরেন্টটা থেকে | আর বৃষ্টি ভেজা আবছা কাঁচের আড়ালে কৃষ্ণেন্দু কেমন একা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আজ | বাইরে বৃষ্টিটা এখন মনে হয় খুব বেড়েছে ! ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা মুষলধারায় ঝরে পড়ছে শহরে | আর কৃষ্ণেন্দু এই আকাশ ভাঙা বৃষ্টির মাঝে ভীষণ একা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, নির্বাকভাবে | নিজের ভুলগুলো আজ ভীষণভাবে পরিষ্কার ওর কাছে | বুঝতে পারছে না এতো ভুল বুঝে রইলো কি করে ও এই দু মাস ! কিভাবে একবারও ফোন করলো না দীপ্তিদের ! কিভাবে নিজের সব থেকে কাছের মানুষগুলোকে এতটা দূরে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে ! আর তাহলে অনিকেতকে নিয়ে যেইভাবে দীপ্তিকে ভুল বুঝেছিলো ও দিনের পর দিন , সেইরকম সেইদিন পার্টিতেও কি কৃষ্ণেন্দুরই বুঝতে ভুল হয়েছিল ! অনিকেত আজ কি বলে গেলো ওকে ! ওর কেন মনে হলো না এতদিনে সিসিটিভি ফুটেজটা একবার চেক করার ! একবার চেষ্টা করার সত্যিটা জানার ! কথাটা ভেবেই নিজের ওপরই নিজের রাগ হচ্ছিলো ভীষণ | এই মুহূর্তে ও গাড়ির স্পিডটা তাই বাড়ালো আরো | আর তারপর ভেজা শহর পেরিয়ে হাজির হলো সেইদিনের হোটেলটায় |

ম্যানেজার ওর চেনাই ছিল প্রথম থেকে | তাই কথা বলে সেই রাতের সিসিটিভি ফুটেজটা সহজেই পেয়ে গেলো নিজের কাছে , একটা মেমোরি চিপে | গাড়ির মধ্যেই ল্যাপটপটা ছিল আজ ওর | কথাটা মনে হতেই চিপটা নিয়ে ও আর একটুও অপেক্ষা করলো না ! সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির ভেতরে এসে ল্যাপটপটা খুলে বসলো সেই মুহূর্তে | তবে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দেখতে হঠাৎ থমকে গেলো কেমন ! মিস্টার ভট্টাচারিয়ার টলতে টলতে দীপ্তির কাছে এগিয়ে আসা , ওর ওপর এলিয়ে পড়া , ওকে জাপ্টে ধরে ওর শরীরটাকে ভোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা , দীপ্তির নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাঁসফাঁস করে ওঠা ! সব এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওর | কৃষ্ণেন্দুর এই মুহূর্তে মিস্টার ভট্টাচারিয়ার সঙ্গে নিজেকেও কেমন নোংরা লাগতে শুরু করলো হঠাৎ ! এতটা লোভ ! এতটা হিসাব চলে এসেছিলো ওর মনে ! সেই রাতে দীপ্তির সঙ্গে এই রকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কৃষ্ণেন্দু সেটা খেয়াল করলো না ! ওর এলোমেলো চেহারার ক্লান্ত মুখটাকে লক্ষ্য করলো না ! শুধুমাত্র নিজের ব্যবসার কথা ভেবে গেলো ! মিস্টার ভট্টাচারিয়ার ওপর অন্ধ বিশ্বাস দেখিয়ে গেলো ! একবারও দীপ্তির কথাগুলো শুনলো না ! এমন কি ওকে সবার সামনে সরি বলতে বললো এই জঘন্য লোকটাকে ! আর যেই ছেলেটা দীপ্তিকে এই রকম পরিস্থিতি থেকে বাঁচালো , তাকেও ঐভাবে সবার সামনে অপমান করলো কৃষ্ণেন্দু ! ওর চাকরি অব্দি কেড়ে নিলো ! নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছে এখন ঠিক ওর | এতটা নিচে কবে নেমে গেলো কৃষ্ণেন্দু ! সত্যি, অনিকেত ওকে আজ যা বলেছে , একদম ঠিক বলেছে | কৃষ্ণেন্দু সত্যি অন্ধ | এই সাকসেস , ব্যবসা , ওপরে ওঠার লোভ এইসবের ভিড়ে ও অন্ধ হয়ে গেছিলো কখন, নিজেও বোঝেনি ! আর আজ হঠাৎ এইভাবে নিজেকে দেখে , নিজের এই স্বার্থপর , হিসাবি মুখটা দেখে লজ্জা লাগছে ভীষণ | মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে ওর | বুঝতে পারছে না ঠিক কিভাবে এতো বড়ো ভুল করলো ! আর কিভাবেই বা এই ভুলটাকে ঠিক করবে নিজের ! কি করে দীপ্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে আবার ! কি করে ফেস করবে ওকে ! কোন মুখে ক্ষমা চাইবে !
এই বৃষ্টি ভেজা দিন কৃষ্ণেন্দুকে একটা আয়না দেখিয়ে দিয়েছে যেন | আর এতদিন বাদে হঠাৎ এই আয়নায় নিজেকে দেখে কিরকম অচেনা লাগছে ওর ! বুঝতে পারছে না ওই পুরোনো , দৃঢ় , ঠিক ছেলেটা যে কখন কবে কোথায় ওর কাছ থেকে হারিয়ে গেলো ! আর তার বদলে একটা ভুল , লোভী , অহংকারী ছেলে এসে ভর করলো ওর মধ্যে ! ঠিক মেলাতে পারছে না এই সত্যিটা | সব এলোমেলো লাগছে আজ | চারিদিকের অন্ধকারটা যেন আরো গাঢ় মনে হচ্ছে হঠাৎ | মনে হচ্ছে কৃষ্ণেন্দু হারিয়ে যাচ্ছে এই অন্ধকারের মধ্যে , এই কালো রংটার মধ্যে | আর আসে পাশে কেউ আর নেই | ওর হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখার জন্য ! ওকে এই অন্ধকার থেকে টেনে বের করে আনার জন্য ! এইভাবে নিজের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য |
সেদিন এই অন্ধকারের আড়ালে কৃষ্ণেন্দুর হঠাৎ একটা কথা মনে হলো ল্যাপটপটা বন্ধ করে | ওই লোকটা , মিস্টার ভট্টাচারিয়ার আজ একটা মিটিং আছে না তৃষার সাথে ! কাল অফিসে তৃষা কথায় কথায় বলছিলো | তৃষাদের গল্ফগ্রিনের বাড়িতেই তো হবে মিটিংটা | কৃষ্ণেন্দুর কথাটা মনে হতেই গাড়িটা স্টার্ট করলো | রাগে ওর মুখটা এখন লাল হয়ে গেছে | সিসিটিভির দৃশ্যগুলো যেন ভাসছে চোখের সামনে | আজ এই লোকটাকে ও শেষ করে দেবে | লোকটার এগেনস্টে যদি পুলিশ কেস না করেছে তো ওর নাম কৃষ্ণেন্দু না ! ওই শয়তানটাকে ইভ টিজিংয়ের কেসে জেলের হাওয়া খাওয়ালেই শান্তি হবে | আর সমস্ত প্রমাণ তো আছেই হাতের কাছে | এইসব ভেবেই কৃষ্ণেন্দু গাড়ির স্পিডটা বাড়িয়ে সোজা হাজির হলো তৃষাদের বাড়িতে | তারপর প্রায় কিছুই না ভেবে কলিংবেলটা বাজালো | ভেতরে ভেতরে রাগটা আরো বাড়ছে এখন | জানে না মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে হাতের কাছের পেলে ঠিক কি করবে ও ! হাতের মুঠোটা রাগে বন্ধ হয়ে আসছে এই মুহূর্তে | পেশিগুলো ফুলছে ওর | এই সময়েই বাড়ির একজন কাজের লোক দরজাটা খুলে দিলো | মিস্টার ভট্টাচারিয়া তৃষার সঙ্গে ওপরের ঘরে আছে | কাজের লোকের মুখে কথাটা শুনে কৃষ্ণেন্দু প্রায় দৌড়ে পা চালিয়ে ওপরের ঘরটার কাছে এসে হাজির হলো | তবে ঘরটায় ঢোকার মুখেই পা-টা হঠাৎ থমকে গেলো , ভেতরের কথাবার্তা শুনে | তৃষার গলার আওয়াজ স্পষ্ট কানে এলো ওর | তৃষা বেশ খুশি খুশি হয়েই এখন মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে একটা ড্রিংক বানিয়ে দিয়ে বলছে , ——– ” ইউ আর একচুয়ালি জিনিয়াস .. আই মিন ইট .. আমি ঠিক যেইরকম চেয়েছিলাম . আংকেল তুমি সেইরকমই করলে সেদিন পার্টিতে | মানে জাস্ট তোমার জন্য দীপ্তি এক রাতের মধ্যে অফিস , কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি , কৃষ্ণেন্দুর লাইফ , সব কিছুর থেকে হাওয়া ! ”
কথাটার উত্তরে মিস্টার ভট্টাচারিয়া বেশ হাসি মুখেই বললো এবার , ———– ” আরে , তোকে আমি সেই ছোটবেলা থেকে চিনি | তোর জন্য এই টুকু করতে পারবো না ! আর কৃষ্ণেন্দুর মতন ছেলের পাশে তোকেই শুধু মানায় | ওই দীপ্তির মতন একটা পাতি মেয়ে ! কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই ! কোনো ক্লাস নেই | আমি সেদিন কিছু না করলেও আর কদিন বাদে কৃষ্ণেন্দু এমনিই ওই মিডলক্লাস, বিলো স্ট্যান্ডার্ড মেয়েটাকে নিজের লাইফ থেকে সরিয়ে দিতো | আমি তো জাস্ট কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করে দিলাম | ”
লোকটার কথাটা শেষ হতেই কৃষ্ণেন্দু আর নিজেকে আটকাতে পারলো না যেন | দরজার আড়াল থেকে আচমকে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো মিস্টার ভট্টাচারিয়ার ওপর | কলার ধরে ওকে সোফা থেকে তুলে গালে একটা থাপ্পড় মারলো জোরে | দীপ্তি আচমকা এরকম কৃষ্ণেন্দু দর্শনে আজ অবাক | তার ওপরে এইভাবে মিস্টার ভট্টাচারিয়ার ওপর হাত তুলে দেয়ায় তো আরোই যেন আকাশ থেকে পড়েছে ! ও খুব উত্তেজিত হয়েই তাই বলে উঠলো , ———– ” কি করছো তুমি কৃষ্ণেন্দু ! মাথার ঠিক আছে তো ? ইউ নো , মিস্টার ভট্টাচারিয়া আমাদে কত ইম্পরট্যান্ট ক্লাইন্ট .. তুমি ওনার গায়ে হাত তুললে কিভাবে !”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো তৃষা | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু ওর কথাটাকে আর এগোতে না দিয়েই এবার বললো ———- ” জাস্ট শাট আপ .. একদম চুপ | আর একটাও কথা না | যা বলার এতক্ষন ধরে বলে দিয়েছো | আর আমি দরজার বাইরে থেকে সব শুনে নিয়েছি | আই কান্ট্ বিলিভ তুমি এতো নোংরা একটা মেয়ে ! একটা মেয়ে হয়ে তুমি আর একটা মেয়ের ওপর ফিজিক্যাল এসল্ট করাও , তাও প্ল্যান করে ! আমি কি লেভেল এর অন্ধ ছিলাম এতদিন ! যে তোমার মতন মেয়েকে চিনতে পারিনি | এনিওয়েজ , আজ থেকে আমাদের কোম্পানির কোনো ফিন্যান্স এর দরকার নেই তোমার বাবার কাছ থেকে | লিগ্যাল ডকুমেন্টস আমার লইয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেবে | আর এরপর আমার অফিসে আর একবারও আসার কথা ভুলেও ভাববে না ! আর রইলো মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কথা | তোমার প্রিয় আংকেল ! ওনাকে তো আমি জেল অব্দি পৌঁছেই ছাড়বো | সেদিন রাতের সমস্ত এভিডেন্স আছে আমার কাছে | এন্ড হি উইল পে ফর হিস্ এভরি সিঙ্গেল একশন অন দ্যাট ডে .. আই প্রমিস ইউ দিজ… ”
কথাগুলো বলেই কৃষ্ণেন্দু আর এক সেকেন্ডও ওই ঘরটাতে দাঁড়ালো না | ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো তৃষাদের সামনে থেকে | রাগে এখন ওর পুরো শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে | জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে নিজের অজান্তেই | ভেতরটা যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ | এতো বড়ো ভুল করলো ! তৃষার মতন মেয়েকে দিনের পর দিন বিশ্বাস করে দীপ্তিকে অদেখা করে রেখে দিলো ! এই নোংরা মেয়েটাকে সুযোগের পর সুযোগ দিয়ে গেলো দীপ্তির সঙ্গে ওর ডিস্টেন্স তৈরী করার ! দীপ্তিকে একটু একটু করে ওর লাইফ থেকে সরিয়ে দেয়ার ! শুধুমাত্র বিজনেসে হেল্প করেছে বলে কৃষ্ণেন্দু শেষে মানুষ চিনতে ভুলে গেলো !
সেদিন এই সব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই কখন বৃষ্টি ভেজা শহরে রাত নেমে এসেছে , কৃষ্ণেন্দু খেয়াল করেনি | গঙ্গার ধারের একটা বেঞ্চে ও অনেক্ষন ধরে বসেছিল নিজের ঘোরে | এইরকম একটা দিন যে কোনোদিন ওর জীবনে আসবে ,যখন সব কিছু অগোছালো , হাতটা একেবারে খালি হয়ে যাবে , কৃষ্ণেন্দু এটা কোনোদিনও ভাবেনি ! আজ নিজেকে চিনতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে আসলে ওর | হঠাৎ যেন নিজের খারাপ , অহং এ আচ্ছন্ন চেহারাটা খুব পরিষ্কারভাবে দেখে ফেলেছে ও ! তাই আরো এলোমেলো লাগছে | ছন্নছাড়া লাগছে নিজেকে | মনের জ্বালা যদি বৃষ্টিতে ভিজে মেটে , তাই ও সেই বিকেল থেকে এখানে বসে ! তবে এবার উঠতে হবে | এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছে | জানে না এই দিনগুলোর ভিড়ে নিজের মানুষরা ঠিক কতটা দূরে সরে গেছে ওর ! কিন্তু আর না | আর সময় নষ্ট করলে চলবে না আজ | কৃষ্ণেন্দুকে দীপ্তি , আলো মা , এদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে ! ফেস করতে হবে ওদের | যদিও জানে না গিয়ে কি বলবে ! কি উত্তর দেবে ওর সেদিনের ব্যবহারের জন্য ! কি উত্তর দেবে এই দু মাস একবারও ফোন না করে , কোনোরকম যোগাযোগ না করে থাকার জন্য ! কিন্তু তা ও যাবে | কৃষ্ণেন্দু জানে , ও যেই ভুলগুলো করেছে , তারপর একটা সরি কোনোদিনই যথেষ্ট হবে না , সব কিছু ঠিক করার জন্য ! কিন্তু সামনে গিয়ে তো দাঁড়াতেই হবে | চোখ মেলাতে পারুক কি না পারুক ! এই ভেবেই কৃষ্ণেন্দু সেদিন প্রায় রাত দশটার পর এসে হাজির হয়েছিল দীপ্তিদের বাড়ির সামনে | ওই পুরোনো একতলা বাড়িটা দেখে যেন ও কয়েক সেকেন্ড এর জন্য থমকে গেছিলো হঠাৎ ! মা বাবা মারা যাওয়ার পর আলো মা যদি ওকে এই বাড়িতে না নিয়ে আসতো , অতো যত্ন করে আগলে না রাখতো , তাহলে কি আজ বেঁচে থাকতো কৃষ্ণেন্দু ! অনেকদিন আগেই হয়তো হারিয়ে যেত এই পৃথিবী থেকে ! আর কৃষ্ণেন্দু তার বদলে কি ফিরিয়ে দিলো ! অপমান | এতো তীব্র অপমান , যে এক রাতের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হলো ওদের ! কথাটা ভেবেই চোখটা আবার নিচে নেমে গেলো ওর | তবে কয়েক মুহূর্তে নিজেকে সামলে কৃষ্ণেন্দু এরপর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলো | তারপর চোখটা বন্ধ করেই কলিংবেলটা বাজালো |
এতো রাতে ওদের বাড়িতে কে এলো হঠাৎ ! কথাটা কলিং বেলের আওয়াজটা পেতেই মাথায় এলো হঠাৎ | তাই নিজের ঘর থেকে একটু কৌতূহল নিয়েই বেরিয়ে এলো সেদিন দীপ্তি ড্রইং রুমে | ততক্ষনে মা দরজাটা খুলে দিয়েছে | দীপ্তি কয়েক পা এগিয়ে দরজার সামনে আসতেই থমকে গেলো কেমন ! আলোও চুপচাপ মূর্তির মতন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে | আর কৃষ্ণেন্দু থমথমে দৃষ্টিতে দীপ্তির দিকে নিঃস্পলকভাবে তাকিয়ে এখন | দীপ্তি এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আজ একদমই তৈরী ছিল না ! যেই মুখটা সময়ের আড়ালে হারিয়ে যাবে ভেবেছিলো , সে যে হঠাৎ না চাইতেই আবার সামনে এসে দাঁড়াবে , দীপ্তি এটা ভাবেনি | তাই কয়েক সেকেন্ড ও নিজেও থমকে ছিল এই মুহূর্তটায় | তবে এই মুহূর্তের ঘোরটা কাটতেই দীপ্তির ভেতরে একটা ধাক্কা লাগলো কেমন ! ও তো চায় না আর এই ছেলেটাকে নিজের সামনে দেখতে | একদমই চায় না | কথাটা ভেবেই ও নিজেকে ফিরিয়ে নিলো , ঘরে চলে যাওয়ার জন্য | তবে আরেকবার থমকে গেলো ওই পুরোনো গলার আওয়াজটা শুনে | কৃষ্ণেন্দু ওকে ডেকে উঠলো সেই মুহূর্তে | ও এখনো দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে | আলো মা দরজা খুলে ওকে দেখে একটু যেন চমকেই গেছিলো আজ ! আগের সেই হাসিটা আর ছিল না মুখে কৃষ্ণেন্দুর জন্য | কৃষ্ণেন্দুও কিছু বলতে পারেনি | এতো ভুলের পর কি বলা যায় , ও সত্যি জানে না | এই সময়েই দীপ্তি এসে ওকে দেখেই আবার ফিরে যাচ্ছিলো | কিন্তু আজকের যাওয়াটা দেখে কৃষ্ণেন্দু কিছুতেই আর নিজেকে আটকাতে পারলো না | ও যেন আপনাআপনিই দীপ্তিকে ডেকে ফেললো কিছু না ভেবেই | তবে অবাক হয়ে গেলো এতকিছুর পরও দীপ্তি আজ ওই ডাকটাকে না শুনে থাকতে পারলো না ! ঘুরে তাকালো ওর দিকে আরেকবার | তারপর কয়েক পা ফেলে ওর কাছে এগিয়ে এলো | তার মানে কি দীপ্তির মনে এখনো ওর জন্য জায়গা আছে ! কথাটা ভেবে কৃষ্ণেন্দুর মনে যেন একটু আশা জড়ো হলো হঠাৎ | ফিরে পাওয়ার আশা | আর সেই জন্যই ও বলে উঠলো এলোমেলোভাবে , ——- ” দীপ্তি ! সেদিন ভুল হয়ে গিয়েছিলো ! আমি বুঝিনি ! আমি…. ”
না, কথাটাকে আর শেষ করতে পারলো না কৃষ্ণেন্দু | ওর চোখে চোখ রেখেই আচমকা কিছু না বলে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করে দিলো মুখের ওপর | কানে এসে বাজলো যেন সেই বন্ধ দরজার আওয়াজটা | কৃষ্ণেন্দু কিছুক্ষন খুব অবাক হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো ওই দরজার সামনে | বুঝতে পারছিলো না যে এইভাবে দীপ্তি ওকে উত্তর দেবে | কিছু না বলেও , এতো কিছু বুঝিয়ে দেবে | কৃষ্ণেন্দু যে ওদের জীবনে আর কোথাও নেই ! ওর সঙ্গে কোনো কথা , কোনো শব্দই আর বাকি নেই ! এটা বুঝিয়ে দেবে | সেদিন কৃষ্ণেন্দু এরপরও যেতে পারেনি ওই বাড়িটার সামনে থেকে | আজ সব হারিয়ে নিঃস্ব লাগছে নিজেকে | শুধু মনে হচ্ছে যদি একবার ওই দরজাটা খোলে ! যদি কেউ কোনো কথা বলে ওর সঙ্গে ! যদি কোনোভাবে ওর চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা এই ভয়ঙ্কর নিঃস্তব্ধতাটা কেটে যায় আজ কোনোভাবে ! এই ভেবেই সেদিন সারা রাত ওই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে ও এক টানা দাঁড়িয়ে ছিল ওই বাড়িটার সামনে | কিন্তু আজ আর কেউ ওর কাছে আসেনি | ওকে ডেকে আর কেউ ঘরে নিয়ে যায়নি | আর এই অন্তহীন অপেক্ষার মধ্যেই কলকাতায় আর একটা সকাল এসে উঁকি দিয়েছিলো | কৃষ্ণেন্দু তখনও কিরকম নিস্প্রান ভাবে দাঁড়িয়েছিল বাড়িটার সামনে | কিসের আশায় , ও নিজেও জানে না ! সেই সময়েই দরজা খুলে হঠাৎ আলো বাইরে এলো | কৃষ্ণেন্দু ওর আলো মা কে দেখে আরেকবার যেন অল্প প্রাণ ফিরে পেলো | আবার আশাটা জাগলো বুকের মধ্যে | তাহলে কি এক রাতের অপেক্ষার পর আলো মা ওকে ডেকে নিতে এসেছে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই আলো ওর সামনে এসে বলে উঠলো ,
———– ” তুই কি সারা রাত দাঁড়িয়েছিলিস এখানে ? কেন ! ”
আলোর কথায় ও কি উত্তর দেবে আবার ঠিক বুঝতে পারলো না | কেন দাঁড়িয়েছিল সেই কারণটা বললে কি আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে ! আবার কি সেই হারানো জায়গাটা নিজের ফিরে পাবে কৃষ্ণেন্দু ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও আনমনে আলোর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো | আজ এই অগোছালো জীবনে এই হাতটার খুব দরকার ওর | কথাটা ভেবেই জল নেমে এলো চোখে হঠাৎ | মা বাবা মারা যাওয়ার পরও আলোর কাছে ও ঠিক এইভাবেই কাঁদতো | কিন্তু সেদিনের মতন আলো আজ আর ওকে সামলাতে পারলো না ! কিছু সময় বাস্তব এমনভাবে জীবনে চলে আসে , যখন কঠিন হতেই হয় | চাইলেও আর তাকে পুরোনো জায়গা ফিরিয়ে দেয়া যায় না | কথাটা আলো জানতো বলেই বলে উঠলো আলতো গলায় ,
————- ” কৃষ্ণেন্দু , এখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আর কিছু হবে না | কিছু দরজা সারা জীবনের জন্যই বন্ধ হয়ে যায় | দীপ্তি আমাকে নিজের মুখে কখনো কিছু বলেনি , যে সেদিন রাতে ঠিক কি হয়েছিল | আমি অনিকেতের কাছে শুনেছিলাম | খারাপ লেগেছিলো ভীষণ | তবে এই দু মাসে দীপ্তি কখনো আর তোর নামটাও বলেনি আমার সামনে | এটাই সত্যি | আমি চাই না , তুই শুধু শুধু নিজের সময় , নিজের শরীর নষ্ট করে এইখানে এইভাবে আসিস | কারণ আমি জানি , এসেও কোনো লাভ হবে না | আর তোর তো বিজনেস আছে | আমি জানি তুই চাইলেই ভালো কোনো মেয়ে পেয়ে যাবি | আর আমরা তোর লাইফে একটা সময় অব্দি ছিলাম | যতদিন দরকার ছিল | এই দু মাসে অন্তত এইটুকু বুঝেছি , যে এই দরকারটাও এখন নেই সেইরকম | তাই প্লিজ আর এখানে আসিস না | আর আমি চাই , তুই খুব ভালো থাক | ব্যাস |”
কথাটা বলেই আলো কৃষ্ণেন্দুর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে চলে যেতে যাচ্ছিলো | কিছু শেষ তো এইভাবেই হয় | তবে কৃষ্ণেন্দু এই সময় খুব দৃঢ় গলায় বলে উঠলো হঠাৎ ,
———— ” আমি এইভাবে পারবো না থাকতে | তোমাদের ছাড়া | আমি জানি , অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে ! হয়তো কোনোদিনই সেটা আমি ঠিক করতে পারবো না।কিন্তু তা ও আমি আসবো | রোজ আসবো এখানে | রোজ অপেক্ষা করবো | যদি তোমরা দরজাটা খোলো কখনো ! যদি দীপ্তি আরেকবার আমার সাথে কথা বলে ! পুরোনো সময়টা যদি কখনো ফিরে আসে আমার কাছে ! আমি আমার সারা জীবন দিয়ে অপেক্ষা করবো সেই সময়টার জন্য |”
কথাটা শেষ করে কৃষ্ণেন্দু আর দাঁড়ালো না | রাস্তাটাকে খালি করে দিয়ে চলে গেলো আলোর সামনে থেকে | তবে আলো স্পষ্ট বুঝতে পারলো , এই যাওয়াটা আসল যাওয়া নয় | কৃষ্ণেন্দু আবার আসবে | বার বার আসবে | চেনে ও ছেলেটাকে ! জানে ওর এই দৃঢ় গলার আওয়াজটাকে | যতক্ষণ না পুরোপুরি ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে , ততদিন অব্দি আসবে কৃষ্ণেন্দু | কিন্তু আলো তো নিজের মেয়েকেও চেনে | ওর ঠান্ডা বরফ হয়ে যাওয়া মনটাকেও চেনে | ওর ওই শব্দহীন নিঃস্তব্ধতা যে কতটা তীব্র , আলো জানে | তাই ভয় হচ্ছে একটা আজ কিরকম ! কৃষ্ণেন্দুর অপেক্ষা কোনোদিনও শেষ হবে তো ! না কি এই অপেক্ষার আড়ালেই সব কিছু শেষ হয়ে যাবে ওর ! প্রশ্নগুলো যেন ভেতর থেকে এসে ধাক্কা মারছে আলোকে | আর উত্তরহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকালটা !

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here