অপরাহ্ন পর্ব ১

0
487

অপরাহ্ন

(সতর্কতা : পরিণত পাঠকের জন্য)

পর্ ১

যে কোন ক্রাইম, থ্রিলার, হরর বা সাসপেন্স এ ভরা সিনেমা যারা দেখেছেন, তারা জানেন, অন্ততঃ ষাট শতাংশ সিনেমায় কবর খোঁড়ার একটা না একটা দৃশ্য থাকবেই।

হ্যাঁ, হতে পারে ইচ্ছাকৃত খুন অথবা হতে পারে দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু, কিন্তু মৃতদেহটা লুকানোর জন্য মাটি খুঁড়ে চাপা দেয়াটা খুব সাধারণ একটা দৃশ্য এসব সিনেমায়। অথচ পুরো ব্যাপারটা কিন্তু তারা কখনো দেখাননা। সুন্দরমত দেহটা একটা বিশাল ব্যাগে ভরে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে ফেলল ( ব্যাগ টা পায় কোথায়??), পরের দৃশ্যে দেখা যায়, মাটি চাপা দিয়ে ফেরৎ আসছে খুনি। মাঝখানের সময়টা আর জটিলতাগুলি সন্তর্পনে এড়িয়ে যান তারা।

গত চার ঘন্টা ধরে আমি মাটি খুঁড়ছি। সত্যি কথা বলতে এতো কষ্টের কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা। চার ঘন্টায় যতটুকু গর্ত আমি করতে পেরেছি, তাতে আমার উচ্চতার একজন মানুষের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকবে কিনা সন্দেহ ।

তার উপর আমারো কপাল সেরকম, বহুদিন বৃষ্টি হয়নি, মাটি শুকনো খটখটে হয়ে আছে। আর গরম। উফ। প্রচন্ড দাবদাহে আমার শরীরের সব পানি ঘাম হয়ে ঝরে গেছে। পানিশূন্যতা আমাকে আরো ক্লান্ত করে ফেলেছে। তবু থামতে পারবোনা। সম্ভব নয়। তাই মনের জোরে হাত চালিয়ে যাচ্ছি।

হাতের পেশী পুরোপুরি শক্ত হয়ে যাবার পর আমাকে অনিচ্ছায় থামতে হল। এগুলিকে বিশ্রাম না দিলে আর কাজ করবেনা। না হলে দেখা গেল একটা সময় হাতগুলি সরাসরি অস্বীকৃতি জানাল আমাকে সাহায্য করতে। তার চেয়ে কিছুটা সময় ওদের কথা শোনা ভালো।

বিরতি পেয়ে চার ঘন্টা পরে আমি সানজিদার দিকে তাকালাম। এইরকম চেহারা দেখেই হয়ত মানুষ কবরের উপর এপিটাফ লিখে, ” প্ৰিয় সানজিদা, মৃত্যুতেও যে সুন্দরতম “। সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। মৃত্যু ওর স্নিগ্ধতাকে একটুও কেড়ে নিতে পারেনি। অদ্ভূতভাবে আমার কবিতার চরণ মনে পরছে।

অবনী শুয়ে আছে,
জানিনা সে ঘুমাচ্ছে কিনা…

লাইনটা মনে হয় ঠিক হয়নি। স্ত্রীকে খুন করে কবর খুঁড়ছি, একটু আকটু ভুলের জন্য ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি তো আশা করতেই পারি।

পরশু রাতেও বরাবরের মত শোবার ঘরে আমার জায়গা হলোনা। বসার ঘরে সোফার উপর শুয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। একটা সময় আমি উঠে গিয়েছিলাম।

সানজিদা দরজা বন্ধ করেনি, পেছন থেকে দেখলাম কি যত্নে সে প্রসাধনী মাখছে মুখে, চোখের কোলে সে মাখে আন্ডার আই সেরাম না কি যেন। শেষ করে সে পায়ের পাতা নিয়ে পরল। বিরামহীন লোশন ঘষা দেখে আমার নিজের চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো আরামে ।

তখন আমি ভুলে একটু শব্দ করে ফেললাম। আর সে তাকাতেই চোখাচোখি হল। আমি ভাবলাম ও হয়ত ডাকবে আমাকে। নাহ। বরং ওর দৃষ্টি এতো শীতল ছিল যে আমার মনে হয়েছিল ও মানুষ না, অন্যকিছু। আর ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি, হাসি এতো নিষ্ঠুর হতে পারে ওকে না দেখলে বোঝা হতোনা আমার।

তাই বলে ওকে খুন করার পরিকল্পনা কাল রাতে করিনি। কাল রাতে শুধু দেখতে গিয়েছিলাম ক্ষমা করা যায় কিনা। ও সেই সুযোগ হেলায় হারালো। খুনের কথা প্রথম আমার মাথায় আসে আরো আট মাস আগে, আমাদের বিয়ের রাতে।

***

পারিবারিক ভাবে, রীতিমতো ঘটক দিয়ে পাত্রী দেখে আমাদের বিয়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখার পর যথারীতি আমাকে আর সানজিদাকে পাঠানো হল একা কথা বলার জন্য। বলতে নেই, কয়েক মিনিট মাত্র ওর সামনে চুপ করে বসে থাকার পরেই ও আমার ভীষণ আরাধ্য হয়ে উঠল। আমি বললাম, বিয়ে করব।

সরকারি চাকরির সুবাদে বিয়ের বাজারে আমার কদর থাকলেও প্রেমের বাজারে কেন জানিনা আমি ছিলাম অচল মুদ্রা। বয়েজ স্কুল আর কলেজের কথা তো বাদই দিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় বছর ও আমি প্রেম করতে পারিনি। ওদিকে প্রেমের আগ্রহ কিন্তু ষোলো আনা ছিল।

তাই বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিয়েই আমি সানজিদাকে নিয়ে দিন নেই রাত নেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আর বিয়ের পর যেহেতু অবৈধ বলে আর কিছু থাকেনা, আমার স্বপ্নগুলিও বন্ধণহীন হত, আর এজন্য আমার কোন অনুশোচনা ছিলোনা। আর সেকারণেই হয়ত আশাভঙ্গের ব্যাথাটা বড় তীব্র হয়ে বুকে বেজেছিল।

খালাতো চাচাত মামাতো ভাই বোনদের অবরোধ কাটিয়ে আমি যখন বাসর ঘরে প্রবেশ করি তখন রাত একটা। পরীর মত সজ্জায় আমার সুন্দরী বধূ অপেক্ষামান। আমি দৃশ্যতই ধৈর্য ধারণে অক্ষম ছিলাম।

একটু কাছাকাছি হবার পরে খেয়াল করলাম, সানজিদা নাক কুঁচকে আছে, বললো, গন্ধ টা কিসের?

বিছানায় ফুল ছড়ানো, তার ওপর আমার প্রিয়তমা মানবী জগতের সব রহস্য নিয়ে বসে, মাদকতা ছাড়া আমি আর কোন গন্ধ পেলাম না।

সে আবারো বলল, উফ। কি জঘন্য। বমি আসছে আমার।

আমি তোতলাতে শুরু করলাম, আমিতো গন্ধ পাচ্ছিনা।

সে মুখে হাত দিল, ঘামের গন্ধ। এতো বৌয়ের কাছে আসার শখ, আরেকটু ফ্রেশ হয়ে আসবেন না?

আমি মরমে মরে গেলাম, তবু জোর করে বললাম, স্বামীর ঘামের গন্ধ তো স্ত্রীদের প্ৰিয় হয় শুনেছি।

এই বলে হাসিতে সব উড়িয়ে দিয়ে আবারো দূরত্ব ঘোচাতে চাইলাম।

” উফ ” সে লাফ দিয়ে উঠল, ” কি খান বলেন তো? এ সহ্য করা যায়? ”

বলে সে দৌড়ে চলে গেল বাথরুমে, আমি বাইরে থেকে শব্দ শুনে বুঝলাম, প্রকৃতই সে বমি করে ফেলেছে। আর ওই মুহূর্তে আমার সব আকাঙ্খা আমাকে সাথে নিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।

তবু আমি চাইনি রাতটা এভাবে কাটুক। ওর কথামতো ফ্রেশ হয়েও এসেছিলাম। কিন্তু আমার নিচু হয়ে যাওয়া অহংকার ওই রাতে আর জাগলোনা, অপমানের বোঝায় আর মাথা তুললোনা।

সেসময় সানজিদা তার বিখ্যাত শীতল, অপমানজনক হাসিটা হাসল। আর হঠাৎ নিজের অজান্তেই আমার ইচ্ছে হল ওকে খুন করে ফেলি।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here