অপরাহ্ন পর্ব ৫ (শেষ)

0
389

অপরাহ্ন

পর্ব ৫ (শেষ)

(সতর্কতা : বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়া নিষিদ্ধ)

প্রতিবার ফেরার পথে আমি গাড়িটিকে আমার পরিচিত এক দোকানে নিয়ে ওর ক্ষুন্নিবৃত্তি করি। ওরা বড় ভালো লোক, মাত্র পাঁচশো টাকার বিনিময়ে পানি ঢেলে ঢেলে যানটিকে স্নান করিয়ে দেয়, আরো দু’শ দিলে ভেতরটাও মুছে দেয়। ওরা বলে ওয়াক্সিং, অর্থাৎ কিনা মোমের প্রলেপ দেয়া। ঝকঝকে নতুনরূপে ওটাকে যখন অফিসে ফিরিয়ে দেই, যাত্রাপথের কোন চিহ্নমাত্র ওর গায়ে আর থাকেনা।

স্যার বললেন, ” তুমি আবার সবসময় এসব করতে যাও কেন? এটা তোমার দায়িত্বে পরেনা কিন্তু ”

আমি হেসেছিলাম শুধু, উনি জানেন না এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে শুধু পরেনা, এটা আমার গুরুদায়িত্ব।

” আগামী মাসে ” আমি বললাম, ” দ্বিতীয় সপ্তাহে যদি যাই স্যার? মাসের প্রথম উইক টা, একটু পারিবারিক কাজ ছিল। ”

আসলে ইংরেজি মাসের ছয় তারিখে পূর্ণিমার রাত, আর আমাকে ওই সময়টাতেই যেতে হবে। আমাকে কাজ করতে হবে রাতে আর সেসময় আমার জন্য কেউ ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল হয়ে আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকবেনা।

” সমস্যা হবার কথা না ” উনি বললেন।

***

এরপরের দিনগুলি কেটেছিল খুব দ্রুত। সানজিদার প্রতি আমার আসক্তি এতো বেড়ে গিয়েছিল যে আমি রাতে না ঘুমিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম। ওকে মনে হত এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপন জন, কারণ আমার গোপন কথা একমাত্র ও ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানেনা।

আরো একটা অদ্ভূত কারণে ওকে আমি আরো ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। কারণটা এরকম, আমি জানতাম এই ধরায় ওর দিন হাতে গোনা, তার ওপর ওর কারণে আমি একটা বড় পরিকল্পনা করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছি, আমার দিন কাটছে উত্তেজনার আনন্দে। বোঝাতে পারলাম? আমি নিজেও কি বুঝি নাকি এতো? শুধু জানি, এসব ভেবে ওকে আমার বড় ভালো লাগতো, ইচ্ছে করত বুঁকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখি চব্বিশ ঘন্টা।

এক সন্ধ্যায় আমি ওর অন্য এক রূপ ও দেখেছিলাম। ভেজা চোখ, উদভ্রান্ত ভঙ্গি, দ্রুত নিঃশ্বাস, শোবার ঘরে বিছানায় বসে মুঠোফোনে ব্যাস্ত থাকার চেষ্টা। ওর মুখের রেখা আমার চেনা হয়ে গেছে ততদিনে, কাজেই অস্থিরতাটুকু আমার না বোঝার কোন কারণ ছিলোনা।

আমিও তৎসম অস্থির হয়ে হাহাকার করে উঠলাম, ” কি হয়েছে? কাঁদছিলে তুমি? ”

পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে তাকানো কাকে বলে সেদিন বুঝেছিলাম, চোখ তুলে বললো, ” আমাকে তোমার খুব পছন্দ তাই না? ”

আমার ইচ্ছে করল অনেক কিছুই, কিন্তু সবে অফিস থেকে ফেরা ঘর্মাক্ত কাপড়ে ওকে ছোঁয়া যাবেনা, দূরত্ব বজায় রেখে বললাম, ” হ্যাঁ। খুব। খুব। কেন জানতে চাইছ? ”

ঠোঁট উল্টে হাসল, ” এমনি। আমি তো পছন্দ করবার মতোই মানুষ। অথচ আমি ভিক্ষে চাইলেও ভিক্ষে দেয়না এমন মানুষ ও পৃথিবীতে আছে, ভাবতেই পারিনা…

সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। রাতে সে নিজে থেকেই একটু কাছে আসবার চেষ্টা করেছিল, আমি তবুও ব্যর্থ হয়েছিলাম। ও ঘুমিয়ে গেলে ওর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। এতদিন যে তীব্র অবজ্ঞার জ্বালা আমাকে তাড়িয়ে ফিরত, আজ সেটা দ্বিগুন হয়ে গেল। আঃ। কি ভীষণ কষ্ট। কি অপমান!

***

গতকাল বিকেল চারটায় আমি সানজিদাকে ফোন করলাম। আগের রাতটা, আগেই বলেছি, বসার ঘরে সোফায় কাটিয়েছিলাম আমি। আর্থিক বিষয়ে এতো তাড়াতাড়ি আমাদের মনোমালিন্য হবে, আমি ভাবিনি, কিন্তু হয়েছিল। সুদূর ভবিষ্যতে কি হবে, কেন আমি যথেষ্ট পরিমান অর্থ নিরাপদে জমিয়ে রাখছিনা আলাদা করে, সেই নিয়ে তর্কের ফলস্বরূপ এটা ঘটেছিলো।

” আমি তো আজ সাইটে যাচ্ছি ” বলেছিলাম।

” হ্যাঁ তো? জানি তো? ”

” না বলছিলাম, আজকের রাতটা বাসায় থেকো তুমি। মার শরীর বেশি ভালো না। আগামীকাল অফিস করে তোমাদের বাসায় যেও। ”

” শরীর খারাপ? আমাকে তো কিছু বলেননি? ”

এই কথায় দম বন্ধ হয়ে গেল আমার, আজ রাতে ও বাসায় না ফিরলে সব ওলোটপালোট হয়ে যাবে, ওর পরের কথায় শ্বাস ফিরে এল আবার।

” আচ্ছা যাব। আমি গেলেও ওনার যে খুব লাভ হবে তা নয়। তবু যাব ”

” ধন্যবাদ ”

***

আমি বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছিলাম কিন্তু পরিকল্পনা মোতাবেক ওটাকে বাসস্ট্যান্ড এর কাছাকাছি এক জায়গায় থামিয়ে দিলাম। এই জায়গাটাও গত দুইমাসের নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলনের কারণে আমার খুব চেনা, দু চারটি গাড়ি এখানে সবসময় বসে থাকে। আমারটিকে আলাদা করে লক্ষ করবার কোন ব্যাপার নেই।

রিসোর্ট এসে পৌঁছেছিলাম সাড়ে সাতটায়, প্রতিবারের মত কাল রাতেও রিসিপশনিস্ট ছেলেটার সাথে সময় নিয়ে গল্প করলাম। তার বাড়ির খবর, তার মনের কথা না জানা প্রেমিকার খবর নিলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। একটা পর্যায় গলার স্বর কাঁদো কাঁদো করে বললাম, ” ভাই, মেয়ে মানুষ যতদিন দূরে আছে ভালো আছ। ”

সৌভাগ্যবশত মোক্ষম দিনে সে টোপটা গিলে নিয়ে বললো, ” ভাইয়া সবসময়েই দেখি আপনি কেমন উদাস। মনটন খারাপ করে রাখেন। ভাবী কি তাহলে অন্য কোথাও…? ”

আমি যারপরনাই খুশি হয়ে (ভাঙা গলায় ) তাকে নিজের স্ত্রীর কাল্পনিক পরকীয়া প্রেমের গল্প শুনালাম, অতঃপর পকেট থেকে ডায়াজিপাম এর একটা পাতা বের করে বললাম, ” আজ রাতে একটু শান্তি মত ঘুমাবো ছোট ভাই। দেইখো সকাল সকাল কেউ বিরক্ত না করে ”

ছেলেটা মুখ ছোট করে ফেলল, ” ভাইয়া বেশি খাবেন না তো আবার? ”

” আরে না পাগল। সেই বয়স আছে নাকি? ”

রুমে এসে আমি প্রচন্ড অস্থির বোধ করতে শুরু করেছিলাম। সাড়ে নয়টায় বের হব, দশটায় বাস সব পরিকল্পনা কেমন হাস্যকর মনে হতে শুরু করল একসময়। কেন আমাকে এতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে? কে আছে এখানে যে আমাকে খুঁজতে আসবে?

অস্থিরতা অসহ্য বোধ হলে আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মোবাইল ফোন নাকি শুনেছি ট্রাক করা যায়, অন্ততঃ সিনেমা নাটকে তো তাই দেখায়। খুব যত্নে ওটাকে তাই সারারাতের জন্য ইলেকট্রিসিটি খেতে ব্যাস্ত করে দিলাম। কেউ যদি, কোনোদিন, খুঁজে বের করতে চায়, তারা জানবে, জন্মদুখী এক স্বামী একাকী হোটেলে ঘুমের ওষুধ নিয়ে ঘুমাচ্ছিল সারারাত। বেচারা স্বামী।

আমি আটটার পর পরই বের হয়ে যাওয়া মনস্থির করলাম। এখানে বসে থাকলে নিজের হৃৎপিণ্ডই হাতুড়ি পেটার শব্দ করে করে মেরে ফেলবে আমাকে। কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে বের হতেই আমার বুক কেঁপে উঠল সহসা। পাশের রুম থেকে কে একজন বের হয়ে ধূমপান করছে! সে কি দেখে ফেলল আমাকে? আমি অন্ধকারে অনড় দাঁড়িয়ে রইলাম, নিঃশব্দে। নিঃশ্বাস ও ফেলছি সাবধানে, যেন অনন্তকাল অপেক্ষার পর লোকটার সিগারেট শেষ হল।

আমি বলেছিলাম আমি তাড়াহুড়ো করে কোথাও যেতে চাইনা, কিন্তু রাস্তায় নেমেই জীবনানন্দের অমোঘ বাণী পুরোপুরি ভুলে গিয়ে আমি দৌঁড়াতে শুরু করলাম, বাসস্ট্যান্ডে না পৌঁছে আমার সে দৌড় থামলনা।

বাস যথারীতি লোকে লোকারণ্য, আমি তাতে অখুশি হলাম না। বরং একটু বসে অশান্ত মনটাকে শান্ত করার সুযোগ পেয়ে বেশ ভালোই লাগল। লোকের ভিড়ে একাকিত্ব একটা চরম সুখকর ব্যাপার, যে না অনুভব করেছে সে বুঝবেনা।

গাড়িটি যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম সেইভাবে আছে, আবার একবার জনবহুল বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে। কারো এখানে মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখার অবকাশ নেই, সবাই কি ভীষণ ব্যাস্ত নিজেদের নিয়ে!

হঠাৎ আমার মনে হল, আমি হয়ত গাড়ির চাবিটা ফেলে এসেছি আমার হোটেলের রুমে, কল্পনায় স্পষ্ট দেখতেও পেলাম টেবিলের উপর হেলায় পরে আছে সেটা। কিন্তু না, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হবার আগেই ওটাকে আবিষ্কার করলাম প্যান্টের পকেটে। হেসে ফেললাম নিজের অজান্তেই।

***

কিছুদিন আগে সস্তার একটা মোবাইল কিনে নিয়েছিলাম, সিম নিবন্ধন করেছিলাম এক যুগেরও আগে হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর নামে। ওর নাম স্বাতন, এমনিতেই নামটা নিয়ে আমার একটু ঈর্ষার মত ছিল, আমার বাবা মা এতো কাব্যিক নাম ভাবতে পারেননি আমার জন্মের সময়, তাই । তাও ভালো, এই সিম কার্ডটার সুবাদে কিছু সময়ের জন্য আমার নাম স্বাতন হল!

আমার বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের দুরুত্ব বজায় রেখে এবং অন্ধকার জায়গা বেঁছে নিয়ে গাড়িটি রেখেছি আমি। এই মুহূর্তে আমার আর কোন অস্থিরতা নেই, কোন চিত্ত চাঞ্চল্য নেই। আমি ঢেউহীন সমুদ্রের পানির মত স্থির। এমনকি একবার গান গাইতেও ইচ্ছে করল, কবিগুরুর গানটা। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে….

” হ্যালো? ”

সানজিদার কণ্ঠ শুনে অবশ্য একটা দুর্বল মুহূর্তের জন্য একটু খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিলাম। কি সুন্দর করে হ্যালো বলে সে! আবার হ্যালো বলার শেষে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে দেয় সবসময়। আচ্ছা কি হবে যদি সব বাদ দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করি….

” সানজিদা? ”

” ও তুমি! কার নম্বর থেকে ফোন দিলে? তোমার মোবাইল কোথায়? ”

” সানজিদা আমার মনটা খুব খারাপ। একটু বাইরে আসবে? ”

” বাইরে মানে? কোথায় তুমি? গাজীপুর যাওনি? ”

” নাহ। এতো সুন্দর চাঁদের আলো দেখে আর যেতে পারিনি। জানো আজ পূর্ণিমা? ”

সানজিদা কি একটু হাসল? সত্যিই আমার ছেলেমানুষি কথায় ও কি কখনো হাসতে পারে?

” বাসায় আসো। আমি এখন বের হতে পারবোনা। এই বয়সে এ আবার কেমন পাগলামি? ”

আমি ধাতস্থ হলাম, নাহ, ও হয়ত হাসেনি, আমারই মনের ভুল।

” না। আর কখনো বলবো না। শুধু আজকে রাতে। দুজনে মিলে জোছনা দেখবো। প্লিজ? ”

” উফ। আচ্ছা মাকে কি বলবো এখন? ”

” বলতে হবেনা। ঘুমিয়ে গেছেন তো? নাহারের ও নিশ্চই ঘরের দরজা বন্ধ? চুপিচুপি চলে আসো। এই একটাবার ”

গাড়ির ভেতরে বসে আমি সত্যি সত্যিই কবিতায় লেখার মত রাস্তায় চোখ বিছিয়ে রাখলাম। ওইতো সে হেঁটে আসছে, সেই রাজরানীর মত মাথা উচু করে, চাঁদের আলোয় ওর নীল রঙের চুমকি খচিত ওড়নাটাকে মনে হচ্ছে তারা ভরা আকাশের একাংশ। কি সুন্দর! কি মায়াবী! এতো সুন্দর কি প্রকৃতি নিজেই সহ্য করতে পারবে?

” আর কাজ পাওনা, না? ” সে বসে বললো, ” কোথায় ছিলে এতক্ষন? ”

আমি হাসলাম, ” আমিতো তোমার আশে পাশেই থাকি সবসময়। তুমিই দেখোনা “।

ও ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে, ” আজকে কি কোন বিশেষ দিন? তোমার জন্মদিন বা আর কিছু? আমার কিন্তু জানা নেই, পরে আবার দোষ দিওনা “।

” না। জন্মদিন না। তবে তোমার জন্য উপহার এনেছি ঠিকই ”

” তোমাকে তো বলেছি অযথা আমার জন্য কিনে টাকার শ্রাদ্ধ করবেনা। আমার পছন্দ খুবই নিদিষ্ট, সবার সাথে মেলেনা ”

আমি চালকের আসন থেকে নেমে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম আবার, এই পেছনের চেয়ারের নিচে ওর উপহার অপেক্ষা করে আছে। হ্যাঁ, ঠিক বিষধর সাপের মত কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে নাইলনের শক্ত দড়ি। রক্তপাত আমার খুব পছন্দ নয়।

সে ইতিমধ্যে মুঠোফোনটি হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে দেখছিল কিছু একটা, আমি দড়িটা সন্তর্পনে ওর গলায় পরিয়ে দিলাম তখন, গাড়ির চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলেছি ওর অহংকারী চেহারাটা। ও অবাক হয়ে মাথা তুলেছে, আমি জানি সেই দৃষ্টি দেখলে আমি আবার দুর্বল হয়ে যাব। তাই চোখ বন্ধ করে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে বাঁধনটা আরও… আরও… আরও… মজবুত করতে থাকলাম… যতখন পর্যন্ত না ও আশাহত হয়ে প্রতিবাদ করা ছেড়ে দিল।

***

পূর্ণিমার দিগন্ত ভাসানো শুভ্র আলোয় সেই এগারোটা থেকে মাটি খুঁড়ছি, এখন চারটা বাজে। আমি বারবার পূর্বাকাশের দিকে তাকাচ্ছি, সূর্য ওঠার খুব বেশি দেরি নেই। সেই পর্যন্ত আমাকে ধৈর্য রাখতেই হবে। নিজেকেই নিজে বারবার বলে যাচ্ছি, আর একটু… আর একটু….

ভোর পাঁচটায় আমার কাজ শেষ হল। আমি পরম যত্নে সানজিদাকে কোলে তুলে নিলাম। পাখির পালকের মত নরম ওর শরীর, হালকা। আমি হাত দিয়ে ওর মুখ স্পর্শ করলাম শেষবারের মত। আমার মনে হল, ঠোঁটের কোনে ঝুলে থাকা বিদ্রুপের হাসিটা আজ আর নেই। বরং অসম্ভব কোমল মনে হচ্ছে ওকে। আগেই বলেছিলাম একবার, মৃত্যুতেও সুন্দরীতমা।

কিন্তু না, আর সময় নেই। আমি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দ্রুত পোশাক পাল্টে নিলাম। এখন পরেছি ঘুমাবার পোশাক। সাধারণত রাতে পরার মত আলাদা কিছু নেই আমার, একটা লুঙ্গি আর ছেড়া টি শার্ট পরে ঘুমিয়ে থাকি। কিন্তু আজকের দিনটা আলাদা।

গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তায় ওঠার আগে একবার পিছনে তাকালাম, ভাঙা টেবিল ফ্যানটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ছোট একটা ভয়জাতীয় শিহরণ অনুভব করলাম, ও আমার সব কাজের সাক্ষী, দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছি তারপর।

ততক্ষনে সূর্য উঁকি মারা শেষ করে ভালোমতোই নিজের উপস্থিতি জানান দেয়া শুরু করেছে। এবারে সত্যিই আমার ভয় লাগছে। ভীষণ, তীব্র, প্রচন্ড, আকাশ বাতাস এক করা ভয়। মাটির বুকে গর্ত খুঁড়তে ছয় ঘন্টা লাগবে আমি ভাবিনি, আমার পরিকল্পনায় বড়জোড় দুই তিন ঘন্টা ধরে রেখেছিলাম।

আচ্ছা পরিকল্পনাটা বলি। ভেবেছিলাম সানজিদাকে এখানে চিরদিনের মত শুইয়ে রেখে আমি গাড়ি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড যাব, গতকাল যেখানে গাড়িটা ছিল, ঠিক সেখানে রেখে বাসে করে সাইটে যাব, সেখান থেকে পনের মিনিট হেটে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে শুয়ে থাকবো কেউ জেগে ওঠার আগে। এখন তা আর সম্ভব নয়।

রাস্তায় যানবাহন চলতে শুরু করেছে, ধীরে ধীরে ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে নগরী। রাতের মত নীরব ফাঁকা রাস্তা আর নেই। সুতরাং আমি এখন ফেরত গেলে কিছুতেই সময়ের আগে ফিরতে পারবোনা।

চিন্তাভাবনা করবার সময় কোথায় আমার হাতে, নিজের উপর প্রচন্ড রাগে ইচ্ছে করছে নিজেই গাড়িটাকে নিয়ে একটা বিশাল ট্রাকের সাথে ধাক্কা খাই, সব শেষ হয়ে যাক। কিন্তু আমি তা করলাম না। আমি বরং আর পিছনে না গিয়ে রিসোর্ট এর দিকেই গাড়ি ছোটালাম।

ছোটালাম ভাষাটা ব্যবহার করলাম শুধু বলার সুবিধার্থে, এক ঘন্টার পথ আমার ঠিক আড়াই ঘন্টা লাগল। আর এই আড়াই ঘন্টা, একা গাড়িতে, আমি কিভাবে কাটালাম, সেটা আমি ছাড়া পৃথিবীর কোন মানুষ কোনোদিন জেনেছে কিনা জানিনা, জানবে বলেও আমি মনে করিনা।

আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু আমার মাথায় ছিল, আমি খুব জানি আয়নার দিকে তাকালে দেখতাম আমার কালো চেহারাটা টকটকে লাল হয়ে আছে , কিন্তু আমি আয়নার দিকে তাকালাম না। না আমার অপরাধবোধ হচ্ছিলোনা, যে মানুষ অপরাধবোধে ভুগতে পারে, সে দীর্ঘ তিনমাস ধরে কারো প্রাণনাশের পরিকল্পনা করতে পারেনা। আমার হচ্ছিলো ভয়, সীমাহীন অন্তহীন ভয়, ধরা পরে যাবার ভয়। আমি নিজেকে প্রকাশ করতে তৈরী নই, এখনো নই।

গাড়িটা থামানোর পরে ঘড়ির দিকে তাকালাম, সাড়ে আটটা। ততক্ষনে আমার সব নিঃশেষ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে ভেজা কাপড়ের মত আমাকে মুচড়ে কেউ বের করে নিয়েছে আমার সবটুকু প্রানশক্তি। স্টিয়ারিং হুইলের উপর রাখা আমার হাত থরথর করে কাঁপছে।

হঠাৎ জানালায় শব্দ পেয়ে আমি তাকালাম, সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিজেকে টেনে হিচড়ে বের করলাম গাড়ি থেকে।

” এতো সকালে গাড়ি নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন? ” সে বললো, ” রাতে এতো মন খারাপ করছিলেন, আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম “।

” গাড়ি নিয়ে ” কথাটা খট করে আমার কানে লাগল। সত্যিই কি সে এটা বললো? সত্যিই? মানে কি দাঁড়াচ্ছে সে খেয়ালই করেনি গাড়িটা এখানে রাতে ছিলোনা? শুধু প্রতিবারের মত ধরেই নিয়েছে গাড়িটা ছিল? এখন বুঝলাম, ফরচুন ফেভার্স দ্যা ব্রেভ কথাটা কতখানি সত্যি। আমার মত এতো সৌভাগ্য করেও কেউ আসে পৃথিবীতে?

এতক্ষণের জমানো সব আবেগ এবার বন্ধন ছিঁড়ে বের হয়ে এল আমার। মুক্তি, পরিত্রান, শান্তি, সব একসাথে বন্যার মত ভাসিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। কাল রাত থেকে এই পর্যন্ত একবারও কাঁদিনি, এবার অপরিচিত একটা ছেলের সামনে নির্লজ্জের মত ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম, পরমতম শান্তির কান্না।

” সকালে উঠে মন এতো খারাপ হলো ” আমি বললাম, ” ভাবলাম একটু ঘুরে আসি “।

” কাঁদবেন না ” শুনলাম ছেলেটা বলছে, হয়ত সে অপ্রস্তুত, বিশালদেহী ত্রিশোর্ধ একজন পুরুষ মানুষের কান্না অবশ্যই সুখকর কোন দৃশ্য না, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলোনা। আমি থামার চেষ্টাও করলাম না।

নিজের কামরায় ঢোকার পরেও বেশ অনেকক্ষন ধরে কাঁদলাম আমি। বিছানার উপর মোবাইলটা পরে আছে, হাতে নিয়ে সানজিদার মেসেজ দেখলাম, যেটা আমি গতরাতে নিজ হাতে লিখেছিলাম,

” আমাদের বনিবনা হবেনা, চেষ্টা করে লাভ নেই, আমি জানি। তাই চলে যাচ্ছি। হ্যাঁ, যা ভাবছ তাই, আমার পূর্বপরিচিত একজনের কাছেই যাচ্ছি। পারলে ক্ষমা করো আর আমাকে খোঁজার চেষ্টা করোনা।”

আমি গোসল করলাম দীর্ঘ সময় নিয়ে। সেখানেও ট্যাপের পানি আর আমার চোখের পানি এক হয়ে যাচ্ছিল। আমি কাঁদছিলাম ক্লান্তিতে আর শান্তিতে।

আমার ছোটবেলার খেলার সঙ্গী আসমা, সাঁতার জানা থাকা সত্বেও কি করে সেই সাঁকোর নিচে পানিতে পরে ডুবে মারা গিয়েছিল, গত বিশ বছরে ভুলেও কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেনি। অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী সুরভী, কি ঝামেলাই না হল সেবার, শাহবাগ অবরোধ এই সেই কত কি। বাস চালককে ছাত্ররা পারলে পিটিয়ে মারে। কেউ জানেনি আমাকে তাচ্ছিল্য করার অপরাধে সে পা পিছলে (!) বাসের নিচে চলে গিয়েছিল, বাস চালকের খুব বেশি ত্রুটি ছিলোনা।

প্রকৃতি চাইলে এ যাত্রাও বেঁচে যাবো হয়ত, সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম সেটা।

পরিশিষ্ট

শরীর ভেঙে আসছে ঘুমে, তবু মনের জোরে কাজ করে গেলাম সারাটাদিন। মাঝে মাঝে, বিরতি দিয়ে দিয়ে ফোন করছি সানজিদাকে, আগেই বলেছি, যদি কেউ মুঠোফোনের রেকর্ড কখনো খতিয়ে দেখে, তাদের জন্য এটা আমার উপহার। অবশ্য প্রতিবারই একটু ভয় ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিলো, হয়ত সে ফোনটা ধরবে। তখন কি করতাম আমি? ভাগ্য ভালো, জীবন কোন ভুতের সিনেমা নয়, সানজিদাও তাই ফোন ধরেনি।

ভালো কথা, ওর ফোন থেকে একই সাথে আমার স্বাশুড়ি আম্মাকেও বার্তা পাঠিয়ে রেখেছিলাম কাল রাতে, তিনি দুপুরের দিকে আমাকে ফোন করে খুব কাঁদলেন। তাদের মেয়ে এমন কোন কাজ করতে পারে, তাদের কল্পনাতেও ছিলোনা কোনোদিন। আমিই বরং বললাম, ফোনটা বন্ধ , একটু খোঁজ নেয়া দরকার, উনি বললেন, এমন মেয়ের খবর উনি আর চান না!

আমার মা আর বোনকে খবরটা জানালাম আমি নিজেই। ওরা খুব অবাক হয়েছে বোঝা গেল, তাদের ধারণা ছিল আমিই কাল রাতে ডেকে নিয়ে গেছি সানজিদাকে!! আমি ভীষণ আশ্চর্য হলাম এই কথায়, আমিতো সেই সন্ধ্যা সাতটা থেকে গাজীপুরে! আমি কি করে ডাকবো!কেউ একজন তো অবশ্যই ডেকে নিয়েছিল তাকে, খুব সম্ভবত সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিটির সাথেই সে চলে গিয়েছে কোথাও!!

তবে হ্যাঁ, আমি জানি সানজিদার মোবাইল ফোনের রেকর্ড ঘেটে দেখলে দেখা যাবে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ওকে ফোন করেছিল কে যেন গতরাতে, তার অনতিবিলম্ব পরেই ওর নিজের এবং ওই অপরিচিত নম্বরটি, দুটিই বন্ধ হয়ে যায়। আর আমার মোবাইলের খোঁজ পাওয়া যাবে রিসোর্টের কামরায়, সারারাত।

এরপরে আসে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ব্যাপারটা। যারা ইদানিং কালের গোয়েন্দা সিনেমা আর নাটক দেখে নিজেদেরকে পাক্কা ঝানু গোয়েন্দা মনে করছেন, তাদের মুখে ছাই। কোন রাস্তায় কোন সময়ে কোন গাড়ি গেল আসল, এটা দেখার মত সি সি টিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা অন্ততঃ বাংলাদেশে এখনো হয়নি, অন্ততঃ আমি যে পথের কথা বলছি সেখানে তো নয়ই।

আচ্ছা তারপরেও ধরে নিচ্ছি, আছে, ক্যামেরার ব্যবস্থা আছে। এইসব ক্যামেরার রেকর্ড গুলি সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়, একটা সময় পর পর নিজেই মুছে ফেলে নিজেকে। সানজিদার মৃত্যু রহস্য নিয়ে কথা শুরু হবে তার দেহাবশেষ খুঁজে পাবার পর, আমার মনে হয়না আমার প্ৰিয় টেবিল ফ্যানটি আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমার সাথে এধরণের কোন বিশ্বাস ঘাতকতা করবে।

আমি আর পাঁচদিন সেখানে থাকতে পারলাম না, যে পুরুষের স্ত্রী পরের হাত ধরে পালিয়ে যায়, তাকে স্বভাবতোই ভগ্ন হৃদয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসা উচিৎ। সুতরাং পরের দিন সকালে কিছু কাজ গুছিয়ে আমি ফেরত আসলাম। আর হ্যাঁ, বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই আমি গাড়িটিকে প্রতিবারের মত ধুয়ে মুছে আনলাম। কোন এক পূর্ণিমার রাতে এই গাড়ি অচেনা জঙ্গলে জোছনাবিলাসে গিয়েছিল, গায়ে ধুলো মেখেছিল, তার শেষ চিহ্নটাকে দেখলাম পানির সাথে ভেসে নর্দমায় চলে যেতে।

কাউকে নিখোঁজ হিসেবে গণ্য করতে গেলে নাকি অন্ততঃ আটচল্লিশ ঘন্টা বা দুই দিন পার হতে হয়। আমি সেই দুইদিন অপেক্ষা করে তৃতীয় দিন নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি নিখোঁজ রিপোর্ট লিখিয়ে রাখলাম।

শেষ

আগের পর্ব

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1658183174696703/?mibextid=Nif5oz

( ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে। আনন্দের বৃষ্টি নামুক , তপ্ত দেশ শীতল হোক, এই কামনায় )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here