#অপরিচিতা_ভালোবাসা
(পর্ব-২)
#ফাবিহা_নওশীন
গভীর রাত বর্ণা কফির মগ নিয়ে ছাদে এসে দাড়িয়েছে।
চাদের আলোয় একতলা বাড়ির ছাদ থেকে নিচটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।চারদিক নিস্তব্ধ গাছগুলো কেমন একটু পর পর দোলে উঠছে।
কফিতে চুমুক দিয়ে বর্ণা ২বছর আগের ঘটনা স্মরণ করছে।
ঢাকার কোয়ার্টার হাউজে সেইদিন।কিচেন পরিস্কার করে বের হয়েই মা ওকে এক বালতি জামাকাপড় পরিস্কার করতে বলে।বর্ণার খুব রাগ হচ্ছিলো কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলোনা।কি বলবে কে শুনবে।নিজের মা তো আর নয় যে ওর মনের ব্যথা বুঝবে।
ছোটবেলায় বর্ণার মা মারা যায় তারপর বর্ণার বাবা কুমিল্লার কোনো এক আত্মীয়র মেয়েকে বিয়ে করেন।সে বিধবা ছিলো সাথে বর্ণার চেয়ে এক বছরের বড় মেয়ে রুপা ছিলো।মেয়েসহ বিয়ে করে ওনাকে ঢাকায় নিজের আবাসস্থলে নিয়ে আসেন।সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে।বর্ণার দিকে তাকালোর সময় কারো হয়না।একা একা বড় হয়েছে।তবে রুপা ছিলো বর্ণার একমাত্র সংগী।রুপার মা বর্ণার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও রুপা কখনো বর্ণার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি।বর্ণার মনে হতো এই একজন মানুষের জন্যই বর্ণা বেচে আছে।
বর্ণা কাপড় ধোয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়।
তারপর ফোনের ডাটা অন করতেই একটা মেসেজ আসে মেসেঞ্জারে।
তুমি কি আমার বন্ধু হবে?
ডাটা অন করতেই মেসেঞ্জারে ভেসে উঠলো মেসেজ টি অপরিচিত আইডি থেকে।আইডি নাম রাফি আহমেদ।বর্ণা মেসেজ সিন করে কিছুক্ষণ ভাবল তারপর আর রিপ্লে করলো না।১০ মিনিট পর আবার মেসেজ আসলো- কি হবেন না বন্ধু?বর্ণা মেসেজ সিন করে এবার উত্তর দিলো,,
–কে আপনি?আপনাকে তো চিনলাম না।
–আমিও আপনাকে চিনি না।
–তবে?
–তবে কি?
–আমার বন্ধু হতে কেনো চাইছেন?আমাকে তো চিনেন ই না।
–আমি অপরিচিত কাউকে বন্ধু করতে চাই।যার সাথে আমি আমার সবটা নির্দ্বিধায় শেয়ার করতে পারি।ভালোলাগা মন্দলাগা,সুখ দুখ সব কিছু।হবেন বন্ধু আমার?
বর্ণা কিছুক্ষন ভাবলো।
–ওকে। হবো বন্ধু।
–ধন্যবাদ।
–কেনো?
–বন্ধু হওয়ার জন্য।
–স্বাগতম।
–চলুন পরিচিত হই।তার আগে তুমি করে বলি।বন্ধুত্বে নো আপনি।ওকে।
–ওকে।আমি বর্ণালী অনার্স ২য় বর্ষে ইকোনমিক ডিপার্টমেন্ট।আপনি?
–আমি রাফি আহমেদ।মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি।চাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছি।
–বাহ।বেশ ভালো।
–কি করো?
–পড়ি।
–কি পড়?
–কবিতা।
–কবিতা তোমার ভালো লাগে?
–খুব।আর আপনার?
–গান ভালো লাগে।অবসরে গান করি।গিটার বাজাই।
–বাহ বেশ।
–তোমাকে শুনাবো একদিন।
–এখন রাখছি।বাই।
–ওকে বন্ধু।
বর্ণা রাফির প্রফাইল চেক করলো।প্রফাইল পিকে হাসিখুশি একটা ছেলে গিটার হাতে দাড়িয়ে আছে।উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং,খোচা খোচা দাড়ি।স্মার্ট,কিউট একটা ছেলে।
বর্ণা মুচকি হেসে ডাটা অফ করে দিলো।
এভাবেই চলছে বর্ণালী আর রাফির বন্ধুত্ব।একে অপরের সাথে একদিন কথা না বলে থাকতেই পারেনা।
–এই বানু(রাফি বানু বলে) কবিতা শুনাও না।
— আমি কি কবি?
–কবিতা শুনাতে কবি হতে হয়।
–হ্যা হয়।
–বলেছে তোমাকে।তুমি একটা অকর্মা।তোমাকে নিয়ে টেনশনে আছি।
–কেনো?
–বিয়ে দিবো কিভাবে?তোমার জন্য তো ছেলেই পাওয়া যাবে না।আজিবন তোমার বোঝা বইতে হবে।
–রাফি!!!
–আচ্ছা বাবা,ভয় পাইছি।দিবো না তোমাকে বিয়ে কেদো না।
–কে কাদছে?বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে।তোমাকে একটা দর্জাল মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো।তখন বুঝবে মজা।
–আহা,,,এতে যদি আমার মিষ্টি বন্ধুটা খুশী থাকে তাতেই খুশি।
–দেখবো নে বিয়ের সময়।এখন রাখছি।ভার্সিটি যাচ্ছি।
–আচ্ছা।বাই।
বর্ণা ভার্সিটির জন্য বের হচ্ছে আর ভাবছে এই একটা মানুষ যাকে পৃথিবীতে সব চেয়ে কাছের মনে হয়।যার সাথে কথা বলে মনটা ভালো হয়ে যায়।সব কস্ট নিমিষেই ভুলে যায়।রাফি খুবই ভালো ছেলে।ওর মতো ছেলে হয় না।বন্ধু এমনই হওয়া উচিৎ।
সন্ধ্যায় চা নাস্তা বানিয়ে সবাইকে সার্ভ করে এসে বর্ণা পড়তে বসেছে তখনই রাফির ফোন।(নাম্বার দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছে)
–হ্যালো
–বর্ণ এটা কি হলো? সারাদিন তুমি আমার কোন খোজ নেওনি?কেনো বল তো,,আমি কি এতো টাই খারাপ,,
–আই এম ভেরি সরি। আমি অনেক বিজি ছিলাম।তাই তোমার খোজ নিতে পারি নি,,আমার লক্ষি বন্ধু রাগ করে না।আর কে বলেছে তুমি খারাপ,তুমি অসাধারণ একটা মানুষ।তোমার মতো মানুষ হয় না।তোমার সাথে কথা বলে যে কারো মন অনায়েসে ভালো হয়ে যাবে।তুমি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ একটা মানুষ।আচ্ছা তুমি কখনো আমাকে ভুলে যাবে নাতো? একদিন তোমার বিয়ে হবে, বউকে পেয়ে তো আমাকে ভুলেই যাবে।
–বর্ণ,এভাবে বলো না,তোমাকে ভুলার কথা আমি ভাবতেই পারি না,,তুমি জানোনা তুমি আমার কাছে কি,কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
–আচ্ছা তাই?(হালকা হেসে)
–তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
–মানে?
–মানে তুমি এমনিতেই সুন্দর। তুমি যখন হাসো আরো সুন্দর লাগে।
–হাও ফানি তুমি তো আমাকে দেখোই নি আজ পর্যন্ত তাহলে?
–মনে মনে দেখেছি।আর তোমার হাসিও কল্পনা করেছি।
–হুহ।আচ্ছা তোমার বাসা কই?
–কুমিল্লা।
—তাই?আমার দাদা বাড়ি কুমিল্লা।
রাফি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, কিহ?কুমিল্লার কোথায়?
–আমি জানিনা।কারণ শুনেই এসেছি আমার দাদা বাড়ি কুমিল্লা কিন্তু ছোট থেকে আব্বুর চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হয়েছি।কখনো যাওয়া হয়নি।আমার আব্বুর ভাই বোন নেই তাই সেখানে কোনো আত্মীয় স্বজন নেই।আমার নানা বাসা ঢাকায় তাই সব আত্মীয় স্বজন ঢাকায়।তাই সেখানে যাওয়া হয়না।
–সো স্যাড।ভেবেছিলাম দেখা হবে।
–আমি যদি কখনো কুমিল্লা যাই তবে তোমাকে বলবো।
–আচ্ছা।
রুপার ডাকে বর্ণার ধ্যান ভাংলো।
–কিরে চাদ তারা দেখে রাত পার করবি?ঘুমাবি না।
–হুম।
পরের দিন রাফির ফ্যামিলি এসে এংগেজমেন্টের দিন তারিখ পাকা করে গেলো।
রাফির এই বিয়েতে মত নেই কেননা তার মনের গভীরে অন্য কারো বসবাস যাকে ৬মাস আগে হারিয়ে ফেলেছে।কিন্তু কি করবে বাবার অসুস্থতার জন্য বিয়েটা করতে হচ্ছে।সবকিছু মেনে নিচ্ছে।কি করবে তাকে তো কম খোজার চেষ্টা করেনি।যে ধরা দিতে না চায় তাকে খোজে পাওয়া যায়না।
রাফির অনেক বার অভিমান হয়েছিলো আর খোজবে না ভেবেছে বারবার কিন্তু মনকে মানাতে পারেনি কেননা ভালোবাসে খুব।
আজ রাফি আর রুপা একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে যাবে।রুপা বর্ণাকে টানাটানি করছে যাওয়ার জন্য।একা যাবেনা।বর্ণা বারবার মানা করেছে কিন্তু রুপা নাছোড়বান্দা।
রাফি রেস্টুরেন্টে গম্ভীরমুখে বসে আছে।রুপা ধাপ করে বসে পড়ল রাফি চোখ তুলে তাকালো।ওর নজর রুপার দিকে নয় বর্ণার দিকে।বর্ণা পিংক কালার একটা ড্রেস পড়েছে।সাথে সাজগোজ করেছে,চুল ছাড়া।কাধে লেডিস ব্যাগ।বর্ণা চেয়ার ধরে দাড়িয়ে আছে।রাফি ওর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছেনা।রাফি বর্ণার মাঝে বারবার তার অপরিচিতা বর্ণালীকে খোজে।
তারপর মনে মনে বলছে,
—আমি কিসব ভাবছি।এক নামের অনেক মানুষ আছে এই পৃথিবীতে।বর্ণা এখানে আসবে কি করে?ও তো ঢাকায় থাকে।
বর্ণা রুপার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আপু তোমরা কথা বলো আমি একটু ঘুরে আসি।
রুপা কিছুটা জোরে বললো,
—পাগল তুই?তুই এখানকার কিছুই চিনিস না হারিয়ে যাবি।
বর্ণা রাফির দিকে তাকিয়ে দেখে রাফি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে।
–আপু আমি বাচ্চা না হারাবো না।
–বর্ণা কয়দিন হয়েছে আমরা এখানে এসেছি।তোর সমস্যা হলে পাশের টেবিলে বস কিন্তু কোথাও যাবি না।
–আচ্ছা।
বর্ণা পাশের টেবিলে ফোন বের করে ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলো।রাফি বারবার বিস্ময় নিয়ে বর্ণাকে আড়চোখে দেখছে।বিভিন্ন প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু রুপাকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।কেননা পাত্রীর ব্যাপারে না জিজ্ঞেস করে তার ছোটবোনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা অনুচিত।
চলবে….