অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা,০৭,০৮

0
973

#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা,০৭,০৮
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৭
কৌতুহলে ভরে যায় মাধুর্যের চোখজোড়া। জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ২১ বছর আগের ঘটনাগুলো। কেন ওর মা-বাবা ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল হসপিটাল থেকে? কি এমন ঘটেছিল? হতে পারে এর থেকে মাধুর্য জানতে পারবে ও কেন স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়! সামিহার ডান হাত ধরে অস্থির চাহনি নিয়ে এলোমেলো ভাবে বলে ওঠে….
–“আমাকে আজ বলবে প্লিজ সামিহা আপু?”
সামিহা মানা করে না। ব্যস্ত কন্ঠে বলতে শুরু করে ওর জানা সব ঘটনাগুলো। মাধুর্য মনোযোগী হয়ে পড়ে।

২১ বছর আগে…..
ডক্টরের কেবিন থেকে সবে চেক-আপ করে ফিরছে মধুরিমা চৌধুরী এবং মুহিত চৌধুরী। মাঝে মাঝে মিষ্টি হেসে পেটে হাত রাখছে মধুরিমা। মুহিতও প্রাণোচ্ছল হাসি নিয়ে মধুরিমার হাত যত্নের সঙ্গে ধরে রেখেছে আর অন্য হাতে ড্রাইভ করছে গাড়ি। মধুরিমা প্রেগন্যান্ট। তাও ৩ মাসের। তবে ও খানিকটা চিন্তিত নিজের পেট এই ৩ মাসেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বড় হবার কারণে। মুহিত বলেছিল তাদের টুইন বেবি হবার আশঙ্কা আছে। তবে ডক্টর তাদের ভুল প্রমাণ করে। আর এটাও বলে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবুও নিজেকে মনস্থির করতে পারছে না মধুরিমা। হঠাৎ তার পেটের এক অংশে মনে হলো বেবি কিক মারল। চমকে ওঠে মধুরিমা। দ্রুত বলে ওঠে….
–“মুহিত, দেখো বেবি রেসপন্স করছে।”
–“কি যে বলো না! সবে ৩ মাস প্রেগ্ন্যাসির। এতো তাড়াতাড়ি বেবি রেসপন্স করবে কি করে মধু?”
মধুরিমা চুপ হয়ে যায়। সত্যি তো! তাহলে এটা কি মনের ভুল ধারণা ছিল?

একসময় গাড়ি থামিয়ে দেয় মুহিত। গাড়ির একটা টায়ারে প্রবলেম হয়েছে। মুহিতের সঙ্গে মধুরিমাও নামে। গাড়িতে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। বমি বমি পাচ্ছিল। সন্ধ্যার সময়। যাবার সময় এই রাস্তা যেমন দিনের বেলায় গাছপালার কারণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তেমনই সন্ধ্যা নামতেই ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মধুরিমা এদিক ওদিক হাঁটতে শুরু করে। মুহিত তাকে বেশি দূরে যেতে মানা করে।
একটু একটু করে হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালি হয়ে পড়ে মধুরিমা। বেশ খানিকটা দূরেই এসে পড়ে। তখনই ওর ঘোর কাটে। কোনদিকে যাচ্ছে ও? ও তো নিজে থেকে আসেনি। যেন ওকে কেউ বাধ্য করে নিয়ে এসেছে। ভয়ে শিউরে ওঠে মধুরিমা। আশেপাশে ভয়ে ভয়ে পর্যবেক্ষণ করে সে। জঙ্গলের ছোট ছোট গাছ নড়ে ওঠার শব্দ আসতে থাকে তার কানে। একটু একটু করে পিছাতে থাকে সে। চিল্লিয়ে ডাকে….
–“মুহিত!”
মুহিতের সাড়া পাওয়া যায় না। হঠাৎ ছোট জঙ্গলি গাছের আড়ালে কিছু চকচকে নীল চোখ দেখতে পায় সে। মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র প্রাণি তার দিকে চেয়ে আছে।

আগপাছ না ভেবে দৌড়াতে শুরু করে মধুরিমা। পেছন থেকে কিছু পায়ের ধাপের আওয়াজ আসছে। কেউ সঙ্গে কোনো অদ্ভুত প্রাণীর ডাক। বুকের ভেতরটা ভয়ে দুরুদুরু করছে। প্রাণপণে দরুদ পাঠ করছে যাতে সে বাঁচতে পারে। একসময় পেটে তীব্র আঁচড় অনুভব করে সে। পড়ে যায় রাস্তায়। পেটে বেশ আঘাত লাগে। বড়বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে তার অনুভূত হয় তার পেট থেকে গড়িয়ে কোনো তরল পদার্থ পড়ছে। পেটের দিকে তাকায় মধুরিমা। শাড়ির আঁচল আলতো সরাতেই তার পেটে বড়সড় আঁচড়ের দাগ দেখতে পায়। সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আর দেখার সাহস পায় না মধুরিমা। দৌড়াতে শুরু করে আবারও উঠে। পথেই এক বৃদ্ধকে দেখে থেমে যায় সে। থেমে যায় বলতে থেমে যেতে বাধ্য হয়। কেননা, বৃদ্ধ লোকটি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে তেমন চেহারার আন্দাজ পাচ্ছে না মধুরিমা। কিন্তু বুঝতে পারছে লোকটি তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। অন্ধকারে কি দেখছে লোকটি?

–“শুরু হয়ে গেছে তাহলে বিপদ! সবাই উম্মাদ হয়ে খুঁজে বেরাচ্ছে তাকে। খোঁজও পেয়েছে। সাবধানে থাকো। নয়ত ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলবে ওরা।”
–“এ….এসব কি আজেবাজে কথা বলছেন আপনি?”
লোকটা পাগলের মতো হাসে। তারপর বলে….
–“তোর গর্ভে সাধারণ কেউ নয়। বরণ একজন অগ্নিশিখার মতো কেউ একজন বেড়ে উঠছে। যার ওপর নির্ভর করে আছে সবাই। যে কাটাবে ৪৯ বছরের সেই ঘুমন্ত অভিশাপ। অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা…..!!”
ভড়কে যায় মধুরিমা। সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পিছু ডাকলেও তার কথা শোনে না লোকটি। কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে মধুরিমা। এ কি হচ্ছে তার সাথে? মুহিতের কন্ঠে পেছন ফিরে তাকায় মধুরিমা। যেন প্রাণ ফিরে পায় সে। দ্রুত গিয়ে ঝাপ্টে ধরে মুহিতকে। হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে।

–“কি হয়েছে মধু? আমাকে বলো। কোথায় গিয়েছিলে তুমি? জানো আমি কত ভয় পেয়েছিলাম? কি হয়েছে আমাকে বলো। শান্ত হও।”
কোনোমতে শান্ত করায় মুহিত মধুরিমাকে। মধুরিমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সবটা বলে। মুহিতের কাছে সব অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে কোমল সুরে বলে ওঠে….
–“এসব কিছুই নয়। আমার কথা শোনো, ওই বৃদ্ধ লোক যদি ওসব কিছু বলেও থাকে তাহলে সব মিছেমিছি বলেছে। আজকাল ওসব হয় না? ওইযে সাধুবাবা, জ্যোতেষী? এরা ভন্ড হয়। এদের কথা মাথায় রাখতে নেই।”
মধুরিমা তবুও মানে না।
–“তাহলে উনি কি করে জানলেন আমি প্রেগন্যান্ট? আমি তো বলিনি মুহিত।”
মুহিত আরো অনেক কিছু বুঝিয়ে মধুরিমাকে শান্ত করতে সফল হয়। তখনই মধুরিমার মনে পড়ে ওর পেটে আঘাত লেগেছিল। দ্রুত সরে গিয়ে পেটে হাত দেয় সে। সবকিছু স্বাভাবিক লাগে তার। এটা কি করে হলো? ও তো তীব্র ব্যাথা অনুভব করেছে। তাহলে? তার মনে পড়ে, বৃদ্ধ লোকটি বলেছে তার গর্ভে কোনো সাধারণ বাচ্চা নেই। এই আঘাত ঠিক হবার পেছনে কি তাহলে বাচ্চার কি হাত আছে?
সেদিন আর কিছুই বুঝতে পারে না সে। চলে আসে বাড়িতে।

কাটতে থাকে দিন। ধীরে ধীরে পেট বড় হতে থাকে। তার সঙ্গে আরো ঘটতে থাকে অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রেগন্যান্সির সময় তার রক্তের গন্ধ ভালো লাগতো। ইচ্ছে করতো একটু রক্ত খেতে। কিন্তু পারত না। আজেবাজে স্বপ্ন আসতো। রাতে ঘুম আসতো না। ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হলেও ওর কাছে মোটেই ঠিকঠাক লাগছিল না। আশ্চর্যজনক ভাবে ঠিক ৫ মাস ৫ দিনের মাথায় মধুরিমার পেইন ওঠে। চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় করে সে। দ্রুত হসপিটালের নেওয়া হয় তাকে। ডক্টর জানায় দ্রুত অপারেশন করতে হবে। মুহিত অবাক হয়। অস্থির ভঙ্গিতে বলে….
–“এটা কি করে হয় ডক্টর? আমার ওয়াইফের সবে মাত্র প্রেগন্যান্সির ৫ মাস ৫ দিন হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি বেবি পর্যাপ্ত বড় কি করে হতে পারে?”
–“এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয় মি. চৌধুরী। আমাদের মেডিক্যাল সাইন্সে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। যদিও ঘটনাটি দুষ্কর বটে। তবুও অসম্ভব নয়।”

সেদিনই অপারেশন হয় মধুরিমার। মুহিতসহ মধুরিমার ভাই আফতাব আহমেদ এবং মধুরিমার ভাবি রেনুকা থাকেন বাইরে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। চাঁদ অনেক কাছে দেখা গিয়েছিল। যেন চাঁদ নিচে নেমে এসেছে। কিছু মানুষের ধারণা এমন পূর্ণিমা ৯৯ বছরে একবার হয়। এই দিন নাকি পৃথিবী মাঝে মানুষের জগতে এক অন্য গ্রহ বা রাজ্যের জীবের আগমন ঘটে। যদিও এটা কুসংস্কার মানা হয়।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজের বদলে খিলখিল হাসির আওয়াজ পাওয়া যায় অপারেশন থিয়েটার থেকে। যেই হাসির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে পুরো হসপিটালে। মুহিত আর মধুরিমার কোল জুড়ে আসে এক কন্যা সন্তান। সে ছিল যেম জন্ম থেকেই আরেকটি চাঁদ। চাঁদের মাঝেও খুঁত থাকলেও সেই কন্যার মাঝে ছিল না কোনো খুঁত। পুরো হসপিটালের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাকে দেখার জন্য। কারণ মেয়েটি কান্নার বদলে হেসেছিল।

মুহিত আর মধুরিমার চোখ জুড়িয়ে যায় তাদের সন্তান দেখে। এ কোন রাজ্যের পরী? নিজেদের দিকে তাকাতাকি করে তারা। তারা কেউই তো এতো সৌন্দর্যের অধিকারী নয়। মুহিত নিজের মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে….
–“এ যে মাধুর্যের মেলা বসেছে! তাহলে তোমার নাম আজ থেকে মাধুর্য।”
ছোট্ট মাধুর্য তখন জানালার বাইরে চাঁদের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে ব্যস্ত। মাত্র কয়েকঘন্টা আগে জন্মগ্রহণ করা বাচ্চার এতো চঞ্চলতা দেখে হতভম্ব মধুরিমা আর মুহিত। সে চিন্তা করতে থাকে সেদিনের বলা ওই বৃদ্ধ মানুষের কথাগুলো। সবাই আড়ালে চাঁদের আলোতো তাকিয়ে থাকতে সবুজ বর্ণের হয়ে ওঠে তার মাধুর্যের বড় বড় চোখজোড়ার মনি। মূহুর্তেই তা মিলিয়ে যায়।

জন্মের পর নিয়মই হচ্ছে বাচ্চারা কাঁদবে। তাদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে। কিন্তু মাধুর্যের ক্ষেত্রে তা উল্টো হওয়ায় সবাই যেটা পজিটিভলি নেয়নি। বিশেষ করে ডক্টর মাধুর্যকে বেবি অবজারভেশনে রেখে দেওয়ার জন্য বলেছিল মুহিতকে। মুহিত রিস্ক নিতে চায় না মাধুর্যকে নিয়ে। সে রাজিও হয়ে যায়। বেশ কয়েকদিনের জন্য আলাদা হয়ে যায় তার মা-বাবার থেকে মাধুর্য। এরপর যে তার মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে না সেটা কি সে জানতো?
মাধুর্যের যখন বয়স মাত্র ৭ দিন। অদ্ভুত ও রহস্যময় ভাবে গায়েব হয়ে যায় মধুরিমা ও মুহিত। তাদের আর পাওয়া যায় না। সবাই আকাশ থেকে পড়ে। এতোটুকু ফুটফুটে বাচ্চা রেখে কোথায় গেল তারা? কেনই বা গেল? মাধুর্য আলাদা ছিল অবজারভেশনে। সেদিন থেকেই নিজের বোনের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেন আফতাব আহমেদ। নিজের ছায়ায় বড় করে তোলেন মাধুর্যকে।

বর্তমান…..
সবকিছু জেনে থ মেরে বসে আছে মাধুর্য। চোখে টলটল করছে তার পানি। তার মা-বাবা কেন তার প্রতি এই অন্যায় করল? কেন ছেড়ে গেল তাকে? মাধুর্যকে চুপচাপ দেখে সামিহা তার বাহু ধরে ঝাঁকুনি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সামিহাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় মাধুর্য। সামিহা বুঝতে পারে মাধুর্যের মনের অবস্থা। তার লাল লাল চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সামিহা।
–“মা-বাবা আ…আমার সঙ্গে এমন কেন করল? আমি কি দো…দোষ করেছিলাম বলতে পারো আমায়?”
–“এভাবে বলিস না মাধুর্য। হয়ত তাদের সঙ্গে নিশ্চয় কোনো না কোনো ঘটনা ঘটেছিল। হয়ত উনারা তোকে ইচ্ছে করে ছেড়ে যাননি।”
মাধুর্যের কান্নার বেগ বেড়ে যায়।

সামিহা তাকে চুপ করাতে অভিমানি হয়ে বলে ওঠে….
–“এটা ঠিক নয় কিন্তু। আমার বার্থডে আজকে আর তুই কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিস। আমার মন খারাপ করে দিচ্ছিস মাধুর্য?”
মাধুর্য মাথা উঠায়। চোখের পানি মুছে ফেলে। সামিহা আলতো হেসে বলে….
–“এখন স্মাইল দে।”
মাধুর্য চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর মন ভুলানো হাসি দেয়। সামিহাও হেসে দেয়। কিন্তু মাধুর্যের মনে থেকে যায় হাজারো প্রশ্ন। এর উত্তর কোথায়?

সন্ধ্যা প্রায় ৭ টা। বেশ কয়েকজন মেহমান এসেছে সামিহাদের বাড়িতে সামিহার জন্মদিন উপলক্ষে। ছোট বাড়িটা মূহুর্তেই সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছে মাধুর্য। আশেপাশে ফেইরি লাইটে ঝলমল করছে। বিভোর নিজে মেহমানকে আপ্যায়ন করতে নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। সামিহা যেহেতু বার্থডে গার্ল তাই তাকে যেন পুতুল সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সানিয়া এখনো সাজতে মগ্ন। আর মাধুর্য ছোটাছুটি করছে। রেণুকা তাকে এক মূহুর্তের জন্যও রেহাই দিচ্ছেন না। একসময় জুস অন্যসময় সফট ড্রিংকস দিয়ে বেরাচ্ছে মেহমানদের। কবিতা বার বার মাধুর্যকে ধমক দিয়ে যাচ্ছে। কেন ও এসব করছে? মাধুর্য হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। মামি মায়ের কথার ওপর কথা কি করে বলবে সে? এক বিন্দুও বসার সময় নেই তার।

সামিহার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী এসে পড়ে অনুভব। গাড়ি থেকে নামে সে। একবার ওপরে উঠে থাকা চাঁদের দিকে পর্যবেক্ষণ করে। চোখ সবুজ বর্ণ হতে নিলে চোখ বুজে ফেলে সে। তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। রক্তের তৃষ্ণা! সামলাতে হবে নিজেকে। এক ঢোক গিলে মাঝারি একটা বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। সদর দরজা খোলা থাকায় ভেতরে ঢুকে পড়ে অনুভব। ভেতরে মানুষে ভরপুর। একটু অন্ধকার অন্ধকার পরিবেশ। ফেইরি লাইট এবং আশেপাশে কিছু ভুল দিয়ে সাজানোতে ছোট ড্রয়িংরুমটাও চমৎকার হয়ে উঠেছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে অনুভব। তার আগমনে কিছু মানুষ অদ্ভুত চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। তাতে ভ্রুক্ষেপহীন অনুভব। তার চোখজোড়া খুঁজছে চেনা মানুষকে। এমন সময় তার চোখ থমকে পড়ে সেই মোহময় মেয়েটিকে দেখে। হ্যাঁ তাকেই তো খুঁজছিল অনুভব। গোল্ডেন কালার লং জামা, তার ওপর ওড়না যেটা চিকচিক করছে অন্ধকারে। এই আবছা আলোয় মেয়েটির সৌন্দর্য দিব্যি ফুটে উঠে আছে। হাতে তার গ্লাসের ট্রে। ওপরজন মেয়ের সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে কথা বলছে মেয়েটি। তার ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গিও গভীর ভাবে দাগ কাটছে অনুভবের মনে। হালকা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে যায় সে।

–“আজ ওই ছেলেটা আসবে? সত্যি বলছিস? উফফ…তাহলে দেখতে পাচ্ছি তোর সেই মোহের রাজা কে! বেশ এক্সাইটেড আমি।”
কবিতার কথায় চোখ ছোট ছোট করে ফেলে মাধুর্য। চাপা সুরে বলে….
–“আমি জাস্ট একজনের প্রশংসা করেছি কবিতা। এটা তো হতেই পারে। এতে এতো এক্সাইটেড হওয়ার কি আছে বল তো?”
–“দেখ মাধু, অন্য কেউ প্রশংসা করে সেটা নরমালি নিতাম। বাট মাধুর্য চৌধুরী একটা ছেলের প্রশংসা করছে। এটা অষ্টম আর্শ্চযের ব্যাপার! নিশ্চয় ছেলেটা কোনো প্রিন্সের মতো দেখতে।”
মাধুর্যের মনটা হঠাৎ বিষিয়ের যায় প্রিন্সের কথা শুনে। সে কিছু বলবার আগেই পেছন থেকে মাধুর্যের মনে উথাল-পাতাল ঢেউ সৃষ্টি করা কন্ঠস্বরটি ভেসে আসে।
–“আমায় নিয়ে কথা হচ্ছিল বুঝি?”

চলবে…..??

#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮
অনুভবের কন্ঠ চিনতে ভুল হয় না মাধুর্যের। এই কন্ঠ যেন কত বছরের চেনা। ফিরে তাকায় সে এবং কবিতা। ছাইরঙা শার্টের ওপর কালো রঙের ব্লেজার, কালো জিন্স, হাতে মোটা চেইনের ঘড়ি এবং পায়ে কালো কেটস। তার চুলগুলো এক সাইডে করা। কিছু চুল মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় কপালের বামপাশে ভ্রুর একটু ওপরে পড়ছে। মিটমিটে আলোতে নীল চোখের উজ্জ্বলতা বেড়েছে দ্বিগুন। ঠিক কিভাবে বা কোন শব্দ বললে লোকটার সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবে তা ঠিক জানা নেই মাধুর্যের। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে তার। সে বিরাজ করছে অন্য দুনিয়ায়। অন্যপাশে কবিতা নিখুঁত ভাবে একবার অনুভব আর একবার মাধুর্যকে দেখতে থাকে। মাধুর্যের ভাবসাব দেখে হচ্ছে এই সেই মোহময় ব্যক্তি।

চোখটা ঝলমলিয়ে ওঠে কবিতার। তার সামনে যেন মস্তবড় একটা চকলেটের বক্স রাখা আছে। অনুভব চকলেটের থেকে কম কিসে? নিজেকে সামলিয়ে মাধুর্যকে হালকা ধাক্কা দেয় কবিতা। নিজের জগত থেকে বেরিয়ে এসে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে মাধুর্য। বেহায়ায় মতো কি করে এতোক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল সে? আমতা আমতা করে বলে ওঠে….
–“ও…ওয়েলকাম স্যার।”
–“হোয়াট ডিড ইউ সে?”
ঘাড় বাঁকা করে কান এগিয়ে বলে অনুভব। মাধুর্য একটু ঘাবড়ে যায়। ও কি ভয়ে উল্টোপাল্টা কিছু বলছে? অনুভব এক পকেটে হাত দিয়ে অন্যহাতে চুটকি বাজিয়ে বলে….
–“আই এম নট ইউর স্যার মিস. মাধুর্য। আমার ড্যাড হবে তোমার স্যার। তুমি আমাকে আমার নাম ধরেই ডাকতে পারো।”
–“না….নাম ধরে?”

–“হ্যাঁ নাম ধরে। ভেবে দেখো। আমার নাম ধরে ডাকার চান্স আমি যাকে তাকে দিই না। তোমাকে দিয়েছি। আই থিংক তোমাকে সেটা সাদরে গ্রহণ করা উচিত।”
মাধুর্য এক হাতে ট্রে ধরে হঠাৎ গলায় হাত দেয়। তার তৃষ্ণা লাগতে শুরু করেছে হুট করেই। তারপর হাত সরিয়ে নিজের কানের পিঠে চুল গুঁজে দেয় সে। কানের দুলটা চিকচিক করে ওঠে। সেটা খেয়াল করে অনুভব। সে পকেট থেকে কিছু একটা বের করে এগিয়ে দেয় মাধুর্যের সামনে। অনুভবের হাতে মাধুর্যের ফোন আর পার্স। জিনিস দুটো হাতে নেয় মাধুর্য। তখনই হাজির হন রেনুকা। অনুভবের দিকে সন্দেহি দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাধুর্যকে বলে….
–“ইনি কে? কাকে ইনভাইট করেছিস?”
মাধুর্য মিনমিনিয়ে বলে…..
–“মামি মা, উনি আজ আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। অফিসের এমডির ছেলে হন। আর মি. সিনহা, উনি আমার মামি মা। আমার সামিহা আপুর মা। উনার কাছেই থাকি আমি।”

রেনুকার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। উনি যেন প্রাণপণে এমন ছেলেই চান নিজের মেয়েদের জন্য। যথেষ্ট বড়লোক। আর কি চাই? তিনি মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলেন….
–“আমি পরিচয় হয়ে নিচ্ছি। তুই এখানে কি করছিস? বাড়িতে এতো লোকজন। কার কি লাগবে সেটা কি আমি দেখব? যা কার কি লাগবে দেখ।”
মাধুর্য মাথা নাড়িয়ে থমথমে মুখ খানা নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। সেই সঙ্গে কবিতাও এক দৌড়ে চলে যায় মাধুর্যের কাছে।
রেনুকা দাঁত বের করে হেসে অনুভবের দিকে তাকান। অনুভবও ভদ্রতার খাতিরে একটু হেসে অন্যদিকে তাকায়।
–“তা তোমার পুরো নাম কি বাবা?”
–“অনুভব সিনহা।”
অনুভবের উত্তরে আরো নড়েচড়ে প্রশ্ন করে ওঠেন তিনি।
–“তা তোমার বাবার নিশ্চয় অনেক বড় ব্যবসা। সামলাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। তুমি সাহায্য করো না?”

অনুভবের বিরক্ত লাগছে। ও বুঝে গেছে মহিলাটি সুবিধার নয়। এমনিতে এভাবে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালো লাগে না তার। তবুও মুখে হাসি টেনে বলে….
–“না হেল্প আগে করতাম না। এখানে ছিলাম না। তাই হেল্প করা হয়ে ওঠেনি। কাল থেকে আমিও অফিসে যাব।”
–“নিশ্চয় এতোদিন বিদেশ ছিলে? থাকবেই তো। থাকবেই তো। তোমরা বড়লোকের ছেলে। বিদেশেই পড়াশোনা তো করবে। বয়সও হয়েছে তোমার। বিয়ে টিয়ে করবার জন্য দেশে এসেছো নিশ্চয়? সত্যি বলতে এখানকার মেয়েরা কিন্তু অনেক ভালো। আমার মেয়ে দুটোকেই দেখো না। ওরা কত ভদ্র। বড় মেয়েরই তো জন্মদিন। ওর নম্রতা দেখলে তোমার চোখ জুড়িয়ে যাবেই যাবে।”
কথাটা বলে হেসে দেন রেনুকা। অনুভব এখান থেকে মুক্তি পাবার ছুতো খুঁজছে। রেনুকার কথা শেষ হবার পরে সে বিরবির করে বলে….
–“বিদেশে না পাতালে ছিলাম এতোদিন….।”
–“কিছু বললে?”

অনুভব নিজের ফোন বের করে ব্যস্ত হয়ে বলে….
–“না মানে হ্যাঁ আমার একটা ইম্পরট্যান্ট ফোন করার আছে। সো এক্সকিউজ মি।”
তাড়াহুড়ো করে চলে আসে অনুভব। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। এই মহিলার কথা শুনে কখন যে হুটহাট করে সে উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলবে। তার ঠিক নেই। এমনিতেই রক্তের পিপাসা তার বাড়ছে। এক ফোঁটা রক্তের জন্য হাসফাস করছে সে। কোথায় পাবে সে এখানে রক্ত? একহাত দিয়ে মাথার চুল হালকা টেনে ধরে অনুভব।
অনুভব যেতেই রেনুকার কাছে আসে সামিহা। অনুভবকে দেখে জিজ্ঞেস করে….
–“উনি কে ছিল মা?”
–“ওইযে মাধুর্য নাকি অফিসে চাকরি পেয়েছে সেখানকার এমডির ছেলে। একবার যদি তোর সম্মন্ধ ওর সঙ্গে করিয়ে দিতে পারি তাহলে রানীর হালে থাকবি তুই।” (কিটকিটিয়ে হেসে)
বিব্রত হয় সামিহা। ঝাঁঝালো গলায় বলে….
–“মা, তুমি নিশ্চয় এসব বিয়ে নিয়ে উনাকে বিরক্ত করছিলে? তোমার স্বভাব কখনো বদলানো সম্ভব নয়। উনি তোমার এসব কারণেই এড়িয়ে চলে গেছেন। যাকে তাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকো। ধ্যাত…!”
সামিহা রেগেমেগে গিয়ে সোফায় বসে। মায়ের এসব আচরণ মোটেও ভালো লাগে না তার।

ক্লান্ত হয়ে এসে বড় জানালার কাছে দাঁড়ায় মাধুর্য। ওর হাতে এখনো সফট ড্রিংকস এর ট্রে। রেনুকা বারংবার তাকে ধমক দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। একটু প্রশান্তি চায় সে। তার কাছে প্রশান্তি মানে বাইরের প্রকৃতির হাওয়া এবং এই পূর্ণিমার চাঁদের আলো। আবারও গলায় হাত দেয় মাধুর্য। অলরেডি দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেলেছে সে। তবুও পিপাসা কমবার নামগন্ধ নেই। চাঁদের দিকে চোখ রাখতেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে সে। আস্তে আস্তে চোখের মনি থেকে কালো রঙটা মুছে সবুজ রঙে পরিণত হয়। তার লাল এবং সিল্কি চুল অবাধ্য হয়ে উড়তে থাকে। সম্মোহিত হয়ে পড়েছে মাধুর্য।
দূর থেকে অনুভব লক্ষ্য করে মাধুর্যকে। অন্ধকার অন্ধকার পরিবেশে কিভাবে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে মেয়েটি। তাহলে ও কি সম্মোহিত হয়ে পড়েছে? অনুভবের ধারণা কি সঠিক? এই মাধুর্যই তার প্রেয়সী ভাবনা? পা চালিয়ে মাধুর্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় অনুভব। ততক্ষণে মাধুর্যের রেশ কেটে গেছে। এতো হইচই এ জ্ঞানে ফিরেছে সে। পাশে তাকাতেই চকিতে তাকায় সে।

–“আপনি?”
অনুভব চোখ বন্ধ করে রয়েছে। নাক টেনে কোনোকিছুর গন্ধ নিচ্ছে সে। অস্বস্তিতে পড়ে নিজের ওড়না ঠিকঠাক করে দাঁড়াতেই অনুভব চোখ বন্ধ করে বলে ওঠে….
–“সেম স্মেইল।”
মাধুর্য কিছুই বুঝতে পারে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে অনুভবের দিকে। আস্তে আস্তে চোখ খোলে অনুভব। ও এই একই গন্ধ সেই সাদা ওড়নাতে পেয়েছে। যেটা পড়ে ছিল ভ্যাম্পায়ার রাজপ্রাসাদে। তাও ওর ঘরের বাইরে। আশা নিরাশাতে পরিণত হলেও মাধুর্যের প্রতি সন্দেহটা যায় না তার। কে এই সৌন্দর্যে ঘেরা মেয়ে? কি তার আসল পরিচয়?
অনুভবের ভাবনার ফোড়ন কেটে মাধুর্য অনুভবের দিকে ট্রে এগিয়ে দিয়ে বলে….
–“সফট ড্রিংকস নেবেন?”
অনুভব মাথা দুলিয়ে একটা ড্রিংকস হাতে তুলে নেয়। সেটা মাধুর্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে….
–“আমার নয়। তোমার ড্রিংকস এর প্রয়োজন।”
–“আমার প্রয়োজন হবে কেন?”
–“তোমার বারবার ঢোক গিলা সেসব বলে দিচ্ছে। তুমি তৃষ্ণার্ত। নাও খাও।”

মাধুর্য কথা না বাড়িয়ে গ্লাসে ঠোঁট লাগায়। তার চোখ এখনো অনুভবের দিকে। কয়েক ঢোক খেয়ে শেষ করে গ্লাসের ড্রিংকস। সেটা ট্রে তে রেখে একটু খানি হাসে মাধুর্য। সেই হাসি গিয়ে লাগে অনুভবের বুকের বাম পাশে। মূহুর্তেই যেন কয়েকটা হার্টবিট মিস করে ফেলে সে। একটু একটু করে তার হাত রাখে বুকের বামপাশের ওপর। মাধুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বুকের দিকে তাকিয়ে বলে…
–“কি হলো?”
–“নাথিং।”
–“বুকে ওভাবে হাত দিয়ে আছেন কেন?”
–“হার্ট অ্যাটাক হয়েছে মেবি।”
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় মাধুর্য। এ কেমন কথাবার্তা? ঠোঁটজোড়া সরু করে বলে ওঠে….
–“কি বলছেন এসব।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলেন….
–“তুমি বুঝবে না।”

.
রক্তের বড় পাত্র সামনে নিয়ে বসে আছেন প্রলয়। তার চোখেমুখে রাগের ছাপ। আজ পূর্ণিমার রাত। এই রাতে চাঁদের দিকে তাকালে আসল রুপ বেরিয়ে আসে ভ্যাম্পায়ারের। সেই বিষয় নিয়েই চিন্তিত উনি। জোরে বলে উঠলেন…..
–“রায়মা, তোমাকে বলেছিলাম অনুভবের ওপর নজর রাখতে। ও যেন কোথাও না যায়। তুমি কি করলে?”
–“আমি তো চেষ্টা করেছিলাম প্রলয় ভাই। এখন অনুভবকে তো আপনি চেনেন বলুন। ও কারো কথা মানে? আর অতিরিক্ত রাগলে যে কি হতে পারে সেটা আপনিও জানেন।”
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান প্রলয়। মেজাজ বিগরে যাচ্ছে তার। নিজের ছেলের বিষয় নিয়ে এতো চিন্তিত আগে কখনো হন নি। ছেলেটা ফোনও ধরে না। নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করেন উনি। কারণ রাগ ভালো নয়। রাগ সংযত রাখাও ধর্মের কাজ।

–“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। ও রাগলে ভয়ানক হয়ে ওঠে। কারণ ওর সত্তা ও হারিয়ে ফেলছে। শয়তান সত্তা বিরাজ করছে ওর মধ্যে। এই শয়তান সত্তা কেন বিরাজ করছে তাও জানি। আমার ছেলেকে ওই ওয়ারওল্ফ এর বংশ শয়তান বানিয়ে দিয়েছিল একসময়। যার রেশ ও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একমাত্র ভাবনা ছিল। যে ওর এই সত্তাকে বের করতে পারত। কিন্তু আমার ছেলে যে ওকেও মেরে ফেলল।”
–“ভাবনার তো আবারও ফিরে আসবার কথা বলা হয়েছে প্রলয় ভাই। আমরা তো ভাবনাকে খুঁজতে পারি। ও নিশ্চয় আশেপাশেই আছে। নয়ত আমাদের অনুভব অভিশাপ মুক্ত হতো না। ওকে যদি আবারও অনুভবের পাশে….”
কথাটা শেষ হতে দিলেন না প্রলয়। গম্ভীর মুখভঙ্গি এবং চোখে ভয় নিয়ে বললেন….
–“না। ভাবনা আমাদের জন্য যেমন ভালো। তেমনই ভয়ানক। তুমি ভুলে যাচ্ছো রায়মা। যতই হক ভাবনাকে মেরেছে অনুভব। ওর মন, ওর আত্না সব খুন করে দিয়েছে অনুভব। ও ফিরে এলে এবং সব মনে পড়লে আমার ছেলের থেকে যদি প্রতিশোধ নিতে চায়? তখন আমি কি করব? অনুভব আমার ছেলে। আমি ওর কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারি না।

–“তবে কি করবে তুমি ভাই?”
প্রনয়ের আগ্রহী মন। ওর মাথাতেও কিছু আসছে না। একদিকে যেমন প্রলয়ের কথা ঠিক। বংশধর হিসেবে অনুভবই এখনো জীবিত। প্রনয়ের দুটো ছেলে ছিল। যাদের মৃত্যু হয়েছে ওয়ারওল্ফদের হাতে। এই শোক এখনো প্রনয় এবং রায়মার মাঝে রয়ে গিয়েছে। প্রলয় চিন্তিত হয়ে পড়েন। যেকোনো বিষয় নাকি ঠান্ডা মাথায় ভাবা উচিত। কিন্তু এই মূহুর্তে উনার মাথা কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। অজস্র ভয় দখল করে নিচ্ছে উনার মস্তিষ্ক। দিশেহারা হয়ে পড়েন উনি।
———————–
গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাধুর্য। তার দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টিপাত করছেন রেনুকা। পানিতে ভরে ওঠে মাধুর্যের ভয়ানক সুন্দর বড় আঁখি জোড়া। অপমান এবং অসম্মানে কাঁপতে শুরু করে সেখানেই। রেনুকা ঘরভর্তি লোকের সামনে থাপ্পড় মেরেছেন মাধুর্যকে। তার অপরাধ সে ভুল করে বেখেয়ালি হয়ে খাবার ফেলে দিয়েছিল। খানিকটা খাবার রেনুকার শাড়িতে লেগে গিয়েছে। এতেই অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছেন উনি। সামিহা দ্রুত এসে মাধুর্যের পাশে দাঁড়ায়। মাধুর্যকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হতভম্ব সুরে বলে ওঠে….
–“মা, তুমি এটা কি করলে? ওকে থাপ্পড় মারলে কেন?”
–“হ্যাঁ মা। এতোদিন তুমি মাধুর্যের সঙ্গে যা যা ব্যবহার করেছো আমরা মেনে নিয়েছি। মাধুর্যও মেনে নিয়েছে। সবকিছুর একটা সীমা থাকে মা।”
বিভোর থমথমে গলায় কথাটা বলতেই আগুনের মতোই দপ করে জ্বলে ওঠেন রেনুকা।

–“আচ্ছা? তোরা আমাকে সীমা শিখাবি? মাধুর্য ভুল করেছে। আমি শাসন করেছি। ও বেয়াদবি করেছে। দেখছিস না? আমার শাড়ির কি অবস্থা করেছে? আমার মতো মনে হয় ও ইচ্ছে করে এসব করেছে। যাতে সামিহার জন্মদিন ঠিকঠাক করে না হয়।”
ছলছল চোখে তাকায় মাধুর্য। মা-বাবা না থাকলে বোধহয় এমনই কষ্ট অপমান সহ্য করতে হয়? বিভোরও দমে গেছে। মায়ের কথার প্রতিত্তোরে কি জবাব দেবে জানা নেই তার। মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। মাধুর্য দুর্বল গলায় বলার চেষ্টা করে….
–“মামি মা। বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে এম….”
কথাটা শেষ না হতেই গর্জে ওঠেন রেনুকা। ধেয়ে আসে মাধুর্যের দিকে। তৎক্ষনাৎ কারো ভয়ানক চিৎকারে স্তব্ধ হয়ে যায় আশপাশটা।
–“চুপ করুন। ইনাফ ইজ ইনাফ।”
পেছন থেকে অনুভব নিজের হিংস্র চাহনি নিয়ে সামনে আসে। তার চাহনির দিকে তাকানোর সাহস নেই কারোর। থতমত খেয়ে যান রেনুকা।

ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় মাধুর্য। চোখের পলক ফেলতেই গাল বেয়ে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ে। থুঁতনিতে এসে থেমে পানির ফোঁটা নিচে পড়তেই নিজের হাতে পানির ফোঁটা নেয় অনুভব। তা দেখে মাধুর্য গোলগাল দৃষ্টিতে তাকায়।
–“তোমার চোখের পানি অনেক দামি মাধুর্য। এই পানি জিনিস যার তার জন্য মাটিতে পড়তে দিও না।”
অনুভবের কথায় কেঁপে ওঠে মাধুর্য। লোকটা নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে মাধুর্যের কোমল হাত। ওর ভেতরটা জ্বলছে শুধু মাধুর্যের অপমানের কারণে। শক্ত গলায় রেনুকার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন…..
–“আসার পর থেকে দেখছি এই মেয়েটাকে একা পেয়ে কতটা পরিশ্রম করিয়ে যাচ্ছেন। কারণ কি তাও জানি। ও আপনার নিজের মেয়ে নয়। ফ্রীতে ফাইফরমাশ খাটার লোক পেয়েছিলেন না? কিন্তু আফসোস। আজ থেকে আর এই মেয়েটাকে ফাইফরমাশ খাটাতে পারবেন না। আমি দেব না।”
মাধুর্যের হাত ধরে দ্রুত বেরিয়ে আসে অনুভব।

চলবে……
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here