অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা,০৯,১০

0
855

#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা,০৯,১০
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৯
গাড়িতে গুটিশুটি হয়ে থম মেরে বসে আছে মাধুর্য। অনুভবের চোখমুখ দেখে এখনো একটা টু শব্দ অবধি বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল গাড়ি চলছে। বেশ স্পীডেই চলছে গাড়িটি। কিন্তু কোন ঠিকানা বা কোন দিশায় চলছে জানা নেই মাধুর্যের। তার তো আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোথায় যাবে সে?
রাগে ফোঁস ফোঁস করছে অনুভব। এক ধ্যানে গাড়ির গ্লাসের বাইরে তাকিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে সে। এই দুনিয়ার মানুষ বড্ড স্বার্থপর। মানুষ যেমন এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব তেমনই মানুষই এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বার্থপর উপাধি টাও পেয়ে থাকে। কিন্তু এতো কেন রাগ হচ্ছে ওর? ব্যাপারটা ভেবে নিজেই বিস্ময়ের স্বীকার হয় অনুভব। ঠিক কোন সম্পর্ক বা কোন মায়ার টানে মাধুর্যকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়েছে জানে না অনুভব। ও শুধু এতোটুকু জানে, ও মাধুর্যের একবিন্দু অপমান সহ্য করতে পারবে না। গায়ে সুঁচের মতো বিঁধবে তার।

এই ব্যাপারে বেশিক্ষণ নিজের মাথায় চাপ দিলো না অনুভব। বড় শ্বাস নিয়ে বাঁকা দৃষ্টিতে মাধুর্যের দিকে তাকালো। মাধুর্য বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জানালার কাঁচ খোলা থাকায় শীতল হাওয়াতে মাধুর্যের লম্বা লাল ও কালো রঙের মিশালো চুলগুলো একধারে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। যেন সমুদ্র হওয়ার শখ জেগেছে তাদের। নিজের এক হাত অন্য হাত দিয়ে কচলিয়ে চলেছে মাধুর্য। ব্যাপারটা বুঝে অনুভব নিজেই বলে ওঠে…..
–“কিছু বলবে?”
অনুভবের ভূতের মতো কন্ঠ শুনে আঁতকে তাকায় মাধুর্য। তারপর আটকা আটকা গলায় বলে….
–“আ…..আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমার মতো আর যাওয়ার জায়গা নেই। আমাকে বরণ মামি মায়ের কাছেই রেখে আসুন। আমি মামি মাকে ম্যা…ম্যানেজ করে নেব।”
–“কিভাবে ম্যানেজ করবে? হাতেপায়ে ধরে? কি করে সহ্য করো এসব? সম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখতে হয় মাধুর্য। সবসময় সবকিছু সহ্য করতে হয় না।”

চুপ করে যায় মাধুর্য। চোখে পানি ভরে ওঠে। শুধু বেয়ে পড়ার অপেক্ষা। তখনই অনুভব কপট গলায় বলতে শুরু করে….
–“আমি আগেই বলেছি চোখের পানির দাম সস্তা নয়। নিজের চোখের পানি এতো সস্তা বানিয়ো না। আমার সস্তা জিনিস পছন্দ নয়।”
নাক টেনে হাত দিয়ে চোখ থেকে পানি মুছে ফেলে মাধুর্য। কিছুক্ষণ পরেই অনুভব গাড়ি থামায়। আশপাশটা অন্ধকার। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে বাইরের চারিপাশ। আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে চাঁদের আলোয় আশেপাশে ঘেরাও করা গাছপালা। দরজা খুলে নামে মাধুর্য। অনুভব নেমে আবার মাধুর্যের হাত চেপে ধরে।
–“জায়গাটা নতুন। কোথায় কি আছে জানো না। পড়ে যেতে পারো। ফলো মি।”
মাধুর্যেট উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে হাঁটতে শুরু করে অনুভব। মাধুর্য ঠিক কোনটাকে দেখবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনুভবকে দেখবে নাকি আশপাশটার পরিবেশ?

অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকে অনুভবের দিকেই। তাকে দেখে এমন মনে হচ্ছে এই আবছা আলোতেও ও দিব্যি পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে। তার চলাফেরার গতি দেখে মনে হচ্ছে ওর আশপাশটা দিনের মতো ঝকঝকে। কিন্তু মাধুর্য মনোযোগ দিয়েও ভালোভাবে দেখতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছুদূর হাঁটতেই অনুভব এবং মাধুর্য গিয়ে দাঁড়ায় একটা বাড়ির সামনে। একতলা বাড়ি। মাঝারি আকারের। অন্ধকার হওয়ায় গা ছমছম করছে। বাড়িতে লতাপাতা ঝুলে পড়েছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চাবি দিয়ে বাড়ির দরজা খোলে অনুভব। ভেতরটা আরো অন্ধকার। অনুভব বলে ওঠে….
–“এখানে দাঁড়াও। আমি আলো জ্বালায় আগে।”
–“ঠিক আছে।”
ভেতরে ঢুকে যায় অনুভব। কয়েক সেকেন্ডেই আলোতে ঝলমল করে ওঠে ভেতরটা। অনুভব মানুষটিও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সে মাধুর্যকে ভেতরে আসতে ইশারা করে।

একপা দুইপা করে ভেতরে ঢোকে মাধুর্য। মাথা তুলে আশপাশ তাকাতেই নজরে পড়ে বড় লিভিং রুম। কয়েকটা জায়গায় ধুলোময়লা পড়া দেখে সে বুঝতে পারে বাড়িতে কেউ থাকে না। এখানে কি করতে এনেছে লোকটি?
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় মাধুর্য। বামপাশে একটা বড় খোলা বারান্দা। তার এক পাশে একটা রুম। যেটার দরজা লাগানো। একটা কোণায় সিঁড়ি দেওয়া ওপরে ওঠার জন্য। তার পাশে বাইরের ওয়াশরুম। রুমের অন্যপাশে রয়েছে ছোট রান্নাঘর। অনুভব গিয়ে রুমের দরজা খোলে। ভেতরের রুমটাও দৃশ্যমান হয়। লাইট জ্বালাতেই দেখতে পায় মাঝারি আকারের বেডরুম। বেশ পরিপাটি করে সাজানো এবং মনোরমও বটে। অনুভব রুমের ভেতর থেকে জোর গলায় বলে ওঠে….
–“কাম হেয়ার।”

গুটি গুটি পায়ে রুমে ঢুকে পড়ে মাধুর্য। অনুভব বুকে দুই হাত রেখে ওপরে তাকিয়ে বলে ওঠে….
–“এইটা আমার ফার্মহাউস। মাঝে মাঝেই মাইন্ড ফ্রেশ করতে আসা হয়। তবে কেউ থাকে না। তাই ধুলোবালি পড়েছে। আমি তো এসব পরিস্কার করতে পারি না। আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে।”
চকিতে তাকায় মাধুর্য। মুখটা আপনা-আপনি হা হয়ে যায়। এই বাড়িতে ও কি করে থাকবে? এটা তো ওর বাড়ি নয়। তাহলে কি অনুভব তাকে দয়া করছে? মাধুর্য সব সহ্য করতে পারে কিন্তু দয়া জিনিসটি তার আত্মসম্মানে আঘাত করে। নির্বিকার সুরে বলে ওঠে….
–“এখানে আমি কি করে থাকব? সরি। আমি থাকতে পারব না। এটা আমার বাড়ি নয়। আমি এভাবে থাকতে পারব না।”
অনুভব কড়া নজরে তাকায় মাধুর্যের দিকে। তবে তার বুঝতে বেশি সময় লাগে না যে, মাধুর্যের আত্মসম্মানে আঘাত লাগছে।

এগিয়ে আসে অনুভব। একটু নিচু হয়ে শান্ত সুরে বলে ওঠে….
–“ওহ হ্যালো মিস মাধুর্য! তোমাকে এখানে থাকতেই হবে। আমি যখন বলেছি এখানেই থাকতে হবে। আমি আমার গাড়ির পেট্রোল খরচ করে এতোদূর নিয়ে এলাম আর তুমি বলছো থাকবে না। হেই ওয়েট, তুমি কি বাই এনি চান্স আমার এই বাড়িতে থাকতে দেওয়াকে দয়া বলে ভাবছো?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাধুর্য। তৎক্ষনাৎ অনুভব আবারও বলতে শুরু করে…..
–“তাহলে তো তুমি বড়ই ভুল করছো। আমি তোমাকে দয়া করছি না। এখানে আমারও স্বার্থ আছে বলেই নিয়ে এসেছি। তোমার মামি মাকে যতদূর চিনেছি তোমাকে উনি বিন্দুমাত্র শান্তি দেন না। আর তুমি আমার ড্যাডের অফিসে কাজ পেয়েছো তাও আমার জন্য। কাল থেকে তোমার পড়াশোনা, তোমার কাজের চাপ থাকবে। বাড়ি গিয়ে মামি মায়ের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তুমি। অতঃপর অফিসের কাজ করতে হিমশিম খাবে। হয়ত কখনো কখনো কমপ্লিট করতে পারবে না কাজ। তখন তো প্রবলেম হয়ে যাবে না? আমার আর ড্যাডের কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে। এখন বুঝতে পারছো? আমার স্বার্থ ঠিক কোথায়? তুমি যাতে শান্তিতে আমার কাজ কমপ্লিট করতে পারো সেকারণেই তোমাকে এখানে নিয়ে আসা।”

এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না মাধুর্য। অনুভবের এমন লজিকের সামনে মিইয়ে গেছে সে। একটা মানুষের মধ্যে এতো প্যাঁচ কি করে থাকতে পারে? ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে সে। সেটা দেখে হালকা কাশি দেয় অনুভব। তারপর আলমারির কাছে গিয়ে আলমারি খুলে নিজের প্যান্ট শার্ট বের করতে থাকে অনুভব। একটু বাঁকা হেসে বলে…
–“এভাবে তাকিয়ো না। প্রেমে পড়ে যাওয়ার চান্স ১০০%।”
কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে মাধুর্যের। মুখ ফুলিয়ে বলে….
–“০%। আপনার প্রেমে পড়তে আমি মরে যাইনি।”
হাসিটা প্রগাঢ় হতেই মরে যাওয়ার কথা শুনে থেমে যায় তার পুরো শরীর। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বিরবির করে বলে…..
–“একজন তো মরেছিল। আমাকে ভুল বুঝে প্রাণ ত্যাগ করেছিল। সঠিক টা বোঝাবার সময়টুকুই পায়নি।”

অনুভবের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে ঠেকে মাধুর্যের কাছে। শুকনো গলায় বলে ওঠে….
–“কি বললেন?”
হুঁশ ফেরে অনুভবের। দ্রুত আলমারি লাগিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে….
–“কিছু না। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
চলে যায় অনুভব। থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মাধুর্য। কয়েক সেকেন্ড পর সেও ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে।

নিজের হাতে ফুলের ইয়া বড় বুকে নিয়ে বসে আছে সামিহা। ফুলের বুকে টা অনুভবের দেওয়া। যখন অনুভব মাধুর্যকে নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার ফুলের বুকে দিতে আসে। দিয়েই শুষ্ক গলায় উইশ করে শুধু বলে….
–“আজ থেকে মাধুর্য কখনো এই বাড়ি আসবে না। আপনার যদি ওর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হয় তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এসব রেডিকিউলেস পিপলস দের সঙ্গে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে সে।”
এতেটুকু বলেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে অনুভব। তখন থেকেই একমনে বসে আছে সামিহা। বিভোর রেগেমেগে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। আজ তার মা অতিরিক্ত করে ফেলেছে। সে মাধুর্যকে নিজের বোনই ভেবেছে। অন্যদিকে সানিয়া ফেসপ্যাক লাগিয়ে মোবাইল ঘাঁটতে ব্যস্ত। তার মুখে কোনো রিয়েকশন নেই। মাধুর্যকে নিয়ে চিন্তিত নয় সে। বরণ তার জন্য মাধুর্য গিয়েছে ভালো হয়েছে। ও থাকলে পাড়ার কেন? কোনো ছেলেই যেন ওর দিকে ফিরেও তাকাতো না। এইজন্য বড্ড হিংসে হতো তার মাধুর্যের প্রতি। একারণে মনে মনে খুশি সে।

সামিহার পাশে গিয়ে বসেন রেনুকা। চিন্তিত সুরে বলেন….
–“সামিহা রে, তোর ভাই দরজা খুলছে না। খেতে ডেকেছি। তাও খুলছে না। তুই একটু ওকে বল।”
–“কেন মা? আমি বলব কেন? তোমার ওপর রাগ দেখানো কি ভাইয়ের যৌক্তিক নয়? আজ তুমি এমন কান্ড বাঁধালে ভাবলেও নিজেরই খারাপ লাগছে। মেয়েটার সাথে এতো নিষ্ঠুর কি করে হতে পারো তুমি? ওর বয়স তো সানিয়ার মতো। আর তুমি ওর মনে এতোটা আঘাত দিতে পারলে?”
রেনুকার দিকে তাকিয়ে এক নাগারে কথাগুলো শুনিয়ে দিল সামিহা। ও আজ সত্যিই এমনটা আশা করেনি। রেনুকা আশ্চর্যজনক ভাবে তাকিয়ে জোরে বলে ওঠেন….
–“আজ ওই পর মেয়েটার জন্য আমার বিরুদ্ধে কথা বলছিস সামিহা? আজ ও তোর কাছে বেশি দামি হয়ে গেল? ওর গুরুত্ব বেশি তোর কাছে? আমি তোদের কেউ না?”

বিরক্তিতে চোখ বুজে আবারও খোলে সামিহা। সে কি বলেছে আর তার মা কোথায় বিষয়টা টেনে নিয়ে যাচ্ছে! নিজের চোখমুখ জড়িয়ে বলে…..
–“আমি সেটা বলিনি। তুমি বিষয় অন্যদিকে ঘোরাচ্ছো। মাধুর্যের তো কেউ নেই মা। আমরাই তো ওর কাছে সব ছিলাম। তুমি তাকে পারতে না কাছে টেনে নিয়ে আমাদের মতোই বড় করতে?”
–“শোন, আমার এতো জন দরদী হবার ইচ্ছে নেই। পরের মেয়ের জন্য এতো টান দেখাতে পারব না আমি।”
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় সামিহার। উঠে দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে বলে ওঠে….
–“তাহলে মাধুর্য গেছে ভালো হয়েছে। ও যেন কোনোদিনো এখানে ফিরে না আসে। নিজেকে বদলাও মা। নয়ত পরে পস্তাতে হবে।”
গটগট করে নিজের রুমের দিকে চলে যায় সামিহা। গিয়েই সজোরে দরজা লাগিয়ে দেয়। ওর ভালো লাগছে না। মাধুর্যকে ও আর কাছে পাবে না। ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে উঠছে আর সব হয়েছে তারই মায়ের জন্য।

ফ্রেশ হয়ে গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে মাধুর্যের ঘরের দরজায় উঁকি দেয় অনুভব। মেয়েটা বসে আছে বিষন্ন হয়ে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। দরজায় টোকা দিতেই ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। অনুভব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে….
–“এখনো বুঝি এডজাস্টমেন্ট করতে সমস্যা হচ্ছে?”
আমতা আমতা করতে থাকে মাধুর্য। অনুভবের এক গাল হাসিতে মূহুর্তেই চুপ হয়ে গিয়ে তাকায় এই বিমোহিত লোকটির দিকে। হাসি থামিয়ে লোকটি বলে….
–“নিজের সমস্যার কথা বলতে শেখো স্ট্রেটলি। আস্তে আস্তে থাকো ঠিক হয়ে যাবে। আমি মাঝে আসব এখানে। আর তোমার ভয় করলে আমি এখানে কোনো মেয়ে সহকর্মীকে পাঠিয়ে দেব।”
–“আচ্ছা, আপনি কি আজ রাতে এখানেই ঘুমোবেন?”
মাধুর্যের কথাগুলোতে একটু ভয় মিশে আছে। তাকে আরো ভয় পাওয়াতে ইচ্ছে করছে অনুভবের। তাই সে মাথা নাড়িয়ে বলে….
–“হ্যাঁ। আমি আজ এখানেই থাকব।”

ঢোক গিলে মাধুর্য। কন্ঠস্বর আরো মিনমিনে হয়ে আসে।
–“কোথায় থাকবেন?”
–“কেন এই ঘরে। তোমার সাথে।”
–“কিহ?”
হু হা করে হেসে ওঠে অনুভব। মাধুর্যের ভয়ে মাখা চেহারা বেশ ইনজয় করছে সে। মাধুর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। এই মজাটা তার মোটেও ভালো লাগেনি। হাসতে হাসতেই অনুভব বলে….
–“এই বাড়িতে দুটো বেডরুম আছে। ওইযে খোলা বারান্দা দেখেছো সেখানে আরেকটা বেডরুম আছে। যেটা খেয়াল কর নি। আমি সেখানেই থাকব। একটু ভরসা করতে শেখো। অনুভবকে অনুভব করতে শেখো।”
শেষ কথাটা কম্পন খেলে এসে পৌঁছায় মাধুর্যের কানে। বার বার একই কথা তার কানে বাজতে থাকে। এই কথাটা যেন আগেও কোথাও শুনেছে সে। এই কথাটা ইতিমধ্যে তার কাছে হয়ে উঠেছে মধুর।

অনুভব নিজের মাথার চুল এপাশ ওপাশ করে। হাতের দুটো আঙ্গুল নাড়িয়ে বলে ওঠে….
–“গুড নাইট।”
চলে যেতে নেয় অনুভব। দরজার দিয়ে বের হতেই পিছু ডাকে মাধুর্য।
–“অনুভব শুনুন।”
মাধুর্যের মুখে অনুভব নামটি অনুভবের কানে নয় হৃদয়ে এসে আঘাত করে। তার হৃদয় মূহুর্তেই বুলেটের ন্যায় ফুটো করে দিয়ে চলে যায়। এই ডাক তো তাকে আগেও থামিয়েছে। হাজার বার থামিয়েছে। কিন্তু অনুভব যা ভাবছে সত্যি কি তাই? নাকি এটা শুধু ওর কল্পনা? সিউর না হয়ে মাধুর্যকে নিজের মনে জায়গা দিতে চায় না সে। তার কারণ ওর হৃদয়ে শুধু ভাবনারই বসবাস।
পিছু ফিরে তাকায় অনুভব। ইশারা করতেই মাধুর্য অস্বস্তি নিয়ে বলে ওঠে….
–“আমি কি এই কাপড়েই ঘুমাবো? মানে এমন ড্রেস পড়ে তো ঘুম আসবে না।”

সত্যি তো! মাধুর্যের পরনে যেমন ড্রেস তা পড়ে ঘুমানো সম্ভব নয়। অনুভব গিয়ে আবারও আলমারিতে হাত দেয়।
–“তোমরা মেয়েরাও না! কিসব ড্রেস পরিধান করো। যা পড়ে তোমরা বেশিক্ষণ থাকতেই পারো না তা কেন পড়ো কে জানে।”
অনুভবের কথায় হাসি আসে মাধুর্যের। মুখ টিপে হাসে সে। হাতে একটা গেঞ্জি বের করে মাধুর্যের সামনে ধরে সে। গেঞ্জি দেখে থতমত খায় মাধুর্য। অসহায় চোখমুখ করে বলে….
–“এটা?”
–“আমি তো মেয়ে নই। আমার আলমারিতে কয়েকটা গেঞ্জি আর শার্ট ছিল তাই দিলাম। এখন ভেবে দেখো পড়বে কি না। তাছাড়া অন্য কোনো অপশন নেই।”
ঠোঁট উল্টে গেঞ্জি হাতে নেয় মাধুর্য।
–“ওকে বাই।”
তাড়াহুড়ো করে চলে যায় অনুভব। যেন ওর কোনো তাড়া আছে। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে লাইট ওফ করে দেয় মাধুর্য।

অনুভবের গেঞ্জি পড়ে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে। তার সামিহার কথা খুব মনে পড়ছে। সামিহা তো তার কাছেই থাকতো। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে ফেলে সে। নাকে একটা গন্ধ এসে ঠেকতেই আধো আধো চোখ খোলে। চাদরে নাক লাগিয়ে দেয় মাধুর্য। এই পারফিউম এবং স্মেল অনুভবের। যেটা মাধুর্যকে বেশ টানে। শুধু চাদরেই নয়, অনুভবের গেঞ্জি, বালিশ সব খানেই এই স্মেইল রয়েছে। তার যেন মনে হচ্ছে অনুভব তার আশেপাশেই আছে। বেশ খানিকক্ষণ ঘুম না এলেও একসময় ঘুমে তলিয়ে যায় সে।
গভীর রাতে কোনো প্রাণীর হুংকার কানে আসে মাধুর্যের। তবে চোখ খুলতে পারে না সে। অন্যপাশ ফিরে আবারও ঘুমের রাজ্যে ডুবে যায়।

চলবে…..??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১০
সকালবেলা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বসে আছে মাধুর্য। খাটের পাশেই জানালা। জানালায় ফোঁটা ফোঁটা পানির আভাস বলে দিচ্ছে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘলা সকালে ঘুমটা একটু দেরিতেই ভাঙে। জানালার থাইয়ের লক খুলে জানালা টেনে খোলে মাধুর্য। সঙ্গে সঙ্গে এক শীতল হাওয়ার রেশ এসে মাধুর্যের সারা শরীর বয়ে যায়। ঠান্ডায় কুকিয়ে চাদর খামচে ধরে সে। গতকালই কত গরম ছিল আর আজ বৃষ্টির ঠান্ডা। মিষ্টি হাসি দিয়ে নিজের দুইহাতের বাহু কচলাতে থাকে মাধুর্য। সে কাল অনুভবকে অনুভব করেছে। আসলেই তাকে অনুভব করাটা অন্যরকম আনন্দের। কিছুক্ষণ পর নেমে পরে বিছানা থেকে। দরজা খুলে লিভিং রুমে প্রবেশ করে সে। বেশি সময় নেই তার হাতে। ক্লাস শুরু হবে। অনুভবকে দেখতে না পেয়ে আস্তেধীরে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় খোলা বান্দায়। সেখানে আরো বাতাস। খোলা বারান্দাতেই উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব।

মাধুর্য কিছু বলার আগেই অনুভব মাধুর্যের উপস্থিতি টের পায়। বুঝতে পারে সেই ভয়ানক অনুভূতি তার হৃদয়কে আঁকড়ে ধরছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে অনুভব বলে…..
–“গুড মর্নিং মিস মাধুর্য!!”
বলে মাধুর্যের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখজোড়া আটকে যায় মাধুর্যতে। মুখের জবান বন্ধ হয়ে যায়। ঠোঁটজোড়া অজান্তেই খুলে যায়। মাধুর্যের এলোমেলো চুল! একদিকে উঁচু আবার একদিকে নিচু হয়ে আছে। ফোলা ফোলা তার অস্বাভাবিক বড় চোখজোড়া। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে হালকা কাঁপছে। ঠোঁটে আটকে গেছে দুই-তিনটে চুল আর পরনে অনুভবের গেঞ্জি। এই মেয়েটা যেখানে থাকে সেখানেই কি পাগল করে ছাড়ে সবাইকে? নাকি এটা শুধু অনুভবের সাথেই হচ্ছে? বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে সে।

অনুভবের দৃষ্টি দেখে নিজের দিকে তাকায় মাধুর্য। সঙ্গে সঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে সে। ফর্সা চকচকে গালে ফুটে ওঠে লাল আভা। চোখজোড়া লজ্জায় ছোট হয়ে যায়। কিছু বলার চেষ্টা করতেই না পেরে ঝড়ের গতিতে স্থান ত্যাগ করে সে। তার কীর্তিকলাপ দেখে না হেসে পারে না অনুভব। হালকা হেসে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় সে। আকাশের দিকে তাকাতেই শক্ত হয় ওর চোখমুখ। চোখ একবার খিঁচে বন্ধ করে পা দিয়ে রেলিংয়ে একনার আঘাত করে চোখ খোলে সে। চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে….
–“দিশেহারা হয়ে পড়ছি আমি। বার বার সেই অদ্ভুত অনুভূতি দোলা দিয়ে উঠছে আমার মনে। তাও ওই কয়েকদিনের চেনা মেয়ের জন্য। এর অর্থ কি? তাহলে কি আমি যা ভাবছি তাই? আমি বুঝব কি করে? চিনব কি করে?কেন আমাকে এতোবড় শাস্তি দেওয়া হলো? নিজের প্রেয়সীকে চিনতে বেগ পেতে হচ্ছে আমার। নো প্রবলেম। আমি চিনতে চিনতে যেন সে আগের মতো হারিয়ে না যায় তাই তো এই ব্যবস্থা করেছি আমি। নজরবন্দি করে রেখে দিয়েছি। আমার পারমিশন ছাড়া কেউ তাকে দেখতে পাবে না। ব্যাস….শুধু একবারের জন্য কোনো প্রমাণ পেয়ে যাই।”

শ্বাস-প্রশ্বাস বার বার ওঠানামা করছে মাধুর্যের। কান থেকে যেন ক্রমাগত ধোঁয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। এই পোশাকে কি করে দাঁড়াল সে অনুভবের সামনে? একবারো খেয়াল হলো না সে কি পড়ে আছে? নিজের গালেই দুটো আলতো চাপড় মেরে চোখ বন্ধ করে বলে…..
–“মাধুর্য, তুই সত্যিই একটা মাথামোটা। পাগল তুই। এখন তো আর উনার সামনে যেতে পারবি না। বসে বসে কপাল চাপড়া।”
মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে গতকালকের লং জামা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে।দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে মাথা নিচু করে শুকনো মুখে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে বেরিয়ে আসতেই টুংটাং শব্দে কিচেনের দিকে তাকায় সে। অনুভব এখন কিচেনে কিছু একটা করছে। এখন অন্তত অনুভবের সামনে দাঁড়ালে লজ্জায় মরেই যেতে হবে ভেবে বারান্দায় চলে যায় মাধুর্য।

বারান্দায় বেতের চেয়ার-টেবিল রাখা। টেবিলের ওপর বেতের ঝুড়ি। তাছাড়া ছোট ছোট ফুলের টবে বেশ কয়েকটা পাতাবাহার গাছ লাগানো রয়েছে। যা ঝুলানো রয়েছে ওপরে। নীল অপরাজিতা ফুলের গাছ লেপ্টে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপর থেকে নিচের রেলিং পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। কি মনোরম জায়গাটি। মিষ্টি হেসে বাইরের দিকটা তাকাতেই হতচকিত চোখে তাকায় সে। বাইরের পরিবেশটা কি ভয়ানক! বাইরে জঙ্গলের আচ্ছাদনে পরিপূর্ণ। সেই জঙ্গল দিয়েই গিয়েছে একটা রাস্তা। সেই রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানো। ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাধুর্য। এই জায়গায়টা তার চেনা। আগেও এসেছিল সে। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করতেই আরেক ধাপ চমকে ওঠে সে। আতঙ্কিত সুরে বলে….
–“এটা তো সেই জায়গা। কিছু দূরেই তো ওই রহস্যজনক কুয়ো আছে। আমি সেদিন এমনটা অনুভব করেছিলাম যে, আমি ওই কুয়োর ভেতরে পড়ে গিয়ে এক রহস্যময় জগতে প্রবেশ করেছিলাম।”

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বারান্দা ছেড়ে কিচেনে ঢুকে পড়ে সে। অনুভব তখন কোনো কিছু ছুরি দিয়ে কাটছে। মাধুর্যের এমন প্রবেশে চোখ তুলে তাকায় সে।
–“এখানে আমি থাকব না। আমি থাকতে পারব না। প্লিজ!”
মাধুর্যের অসহায় গলা এবং আতঙ্কিত চোখমুখ দেখে কপাল কুঁচকে যায় অনুভবের। কি কারণে ভয় পেল মেয়েটা? ছুরি ছেড়ে এগিয়ে আসে অনুভব। মাধুর্যের কাঁধে হাত দিয়ে একটু নিচু হয়ে বলে….
–“এনিথিং রং মাধুর্য? কেন থাকবে না এখানে? কি হয়েছে?”
মাধুর্যের চোখে বার বার ভেসে উঠছে ওর কুয়োতে পড়ে যাওয়া, সেই কফিনটা খুলে আলোকিত হয়ে ছোট ছোট সাপ কিলবিল করা, ওই রহস্যময় রাজমহল! হু হু শব্দ করে অনুভবের পিঠে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাধুর্য। অনবরত কাঁপতে থাকে সে।

হঠাৎ এই ঘটনায় কি প্রতিক্রিয়া করবে তা ভেবে পাচ্ছে না অনুভব। দুই ধাপ পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয় সে। মাধুর্য মনে হচ্ছে অনুভবের শার্ট ছিঁড়ে বুকের ভেতর ঢুকে যাবে! অনুভবের বুকের ভেতরটা ধুকধুক করছে। শীতল হয়ে যাচ্ছে তার প্রত্যেকটা অঙ্গে। নেশায় বুদ হয়ে বুঁজে আসছে তার চোখজোড়া। মাথার প্রত্যেকটা স্নায়ু বলছে মেয়েটা বড্ড চেনা, তার স্পর্শ চেনা, তাকে জড়িয়ে ধরতে কোনো বাঁধা নেই। অনুভবের গরম নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে মাধুর্যের চোখে ও গালে। মেয়েটির চোখের পাতা নড়ছে। এই মূহুর্ত এখানেই থেমে যাক! সময়টা থেমে যাক। সারাজীবন থাকুক তাদের এই কাছে আসা। অনুভব হাতটা তুলে মাধুর্যকে স্পর্শ করতেই এক ঝটকায় সরে যায় মাধুর্য। নিজের মুখচোখ হাত দিয়ে একবার মুছে নিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেল সে। মিনমিনিয়ে বলে উঠল….
–“সরি।”

ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকায় অনুভব। সে প্রশ্ন করে….
–“ওকে, একটা কথা বলো। তুমি কি কোনোকিছু দেখে ভয় পেয়েছো?”
ভাবতে থাকে মাধুর্য। নিজেকে শান্তনা দেয় যে, সেদিন যা হয়েছিল সবই ওর ভ্রম। এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই। সাহস নিয়ে অনুভবের দিকে তাকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয় সে। যার অর্থ, সে ভয় পায়নি। তৎক্ষনাৎ অনুভব বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল….
–“তুমি আমার কিছু লুকাচ্ছো। যাই হোক, তোমার এখানে থাকতে ভয় লাগলে আমি আমার একটা মেয়ে বন্ধুকে পাঠিয়ে দেব। ও তোমার সঙ্গে থাকবে। ঠিক আছে?”
–“হুমম।”
মাধুর্যের বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে অনুভব। ও এখনো কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত যেটা ও অনুভবকে বলতে চাইছে না। তাকে এখন স্বাভাবিক করা প্রয়োজন।

তাই অনুভব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে….
–“আচ্ছা সকালের ব্রেকফাস্টে কি খাও তুমি? তোমার তো ক্লাস আছে না? তাড়াতাড়ি ইউনিভার্সিটি যাবে তো তুমি।”
এবার স্বাভাবিক হয়ে তাকায় মাধুর্য। চোখমুখ থেকে মুছতে শুরু করে ভয়।
–“যেকোনো একটা হলেই হলো ব্রেকফাস্টে। আর আপনি কি খাবেন?”
–“রক্ত।”
অনুভবের উদ্ভট কথা শুনে আরেক দফা চমকে যায় মাধুর্য। অনুভব কি রক্তই বলল? নাকি তার কান রক্ত শুনল? কোনটা? অতিরিক্ত বিস্মিত হয়ে বলে উঠল….
–“হ্যাঁ???”
–“ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি। আই ওয়াজ কিডিং।”
কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসে অনুভব। মাধুর্যও অনুভবের হাসির প্রতিত্তোরে হাসি দিয়ে বলে ওঠে….
–“আপনি এসব করছেন কেন? আপনি রান্না করবেন?”

–“ইয়াহ। আমি আজকে রান্না করছি।”
–“আপনি রান্না পারেন?”
–“অভিয়েসলি! অনুভব সিনহা সব পারে। নাথিং ইজ ডিফিকাল্ট ফর হিম।”
–“রিয়েলি!” (সন্দেহি দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
অনুভবও মাধুর্যের নকল করে তার মতো করেই তাকায়। মাধুর্যের হাতে পানির বোতল ধরে দিয়ে বলে….
–“ইয়েস। এখন পানি এই ময়দার ওপর ঢেলে আমার হেল্প করো।”
মাধুর্য মাথা দুলিয়ে পানি ঢালতে থাকে। অনুভব ময়দা মাখতে শুরু করে মনোযোগ দিয়ে। পানি ঢালতে ঢালতে হঠাৎ মাধুর্যের মনে একটা প্রশ্ন জাগে।
–“আচ্ছা, কাল রাতে আপনি কোনো প্রাণীর চিৎকারের আওয়াজ শুনেছিলেন?”

ময়দা মাখানো থামিয়ে দেয় অনুভব। কিছুক্ষণ ময়দার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবারও নিজের কাজে মন দেয়। আর বলে….
–“না তো। কেন?”
–“আমি শুনেছিলাম ঘুমের মাঝে। একটু উদ্ভুত ছিল হুংকার। যেন সে তৃষ্ণার্ত বা কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। শেয়াল বা কুকুর তো এমন চিৎকার করে না। তাই বলছিলাম।”
–“এটা তো জঙ্গল। অনেক ধরনের জঙ্গলি প্রাণীর বসবাস হয়। তারাই রাতে গর্জন করে।”
অনুভবের কথা বিশ্বাস হয় মাধুর্যের। তাই সে অনুভবের কথার সঙ্গে তাল মেলায়।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে গাড়িতে করে প্রথমে ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অনুভব এবং মাধুর্য। সেখান থেকেই অফিসে যাবে অনুভব। আর মাধুর্যের অফিস টাইম দুপুর ২ টা থেকে। তাই সে ক্লাস শেষ করে যাবে।
ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে এসে মাধুর্যকে নামিয়ে দেয় অনুভব। অনুভবও নামে গাড়ি থেকে কিছুক্ষণের জন্য। সামিহার আসার কথা আজকে বইপত্র নিয়ে। গেটের এক কোণে সামিহাকে দেখে হাসি ফুটে ওঠে মাধুর্যের। যেন কতবছর সামিহাকে দেখেনি সে। সামিহা এগিয়ে আসে ওদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তাকে মাধুর্য। সামিহা হেসে মাধুর্যের মাথা বুলিয়ে দিয়ে বলে….
–“নতুন জায়গাতে মানিয়ে নিতে পারছিস তো?”
–“মোটামুটি পেরেছি। কিন্তু তোমাদের ছাড়া আমার এক বিন্দুও ভালো লাগছে না সামিহা আপু।”
–“পাগলি, কয়েকদিন পর তো তোর বিয়ে হতোই। তখন তোর বরের সঙ্গে থাকতিস। আমাদের কি নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি থাকতি?”

লজ্জামিশ্রিত হাসি দেয় মাধুর্য। ওর হাতে দুটো তুলে দেয় সামিহা।
–“এখানে তোর জামাকাপড় আর তোর বইখাতা এবং তোর দরকারি সব জিনিস আছে। তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না।”
–“একেবারে পর করে দিচ্ছো?”
ভারাক্রান্ত গলায় শুনে ব্যথিত হয় সামিহা। মাধুর্যের গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে….
–“তোকে পর করে দেবার ক্ষমতা আমার আছে? আমার মায়ের জন্য তোকে আসতে বারণ করছি। আমি চাই না তুই আবার অপমানিত হ। তাই বলছি।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মাধুর্য। শেষমেশ তাকে তার প্রিয়জনদেরও ছাড়তে হলো।
গেটের ভেতর গার্ডেনের একটা সিটে বসে আড্ডায় মেতে ছিল অরুণের সাঙ্গপাঙ্গরা। সেই সঙ্গে অরুণও বসে ছিল সেই সিটের ধারে। সে করছে মাধুর্যের অপেক্ষা। আর পাঁচ মিনিটে ক্লাস শুরু হবে। কবিতাও এসে গেছে অথচ মাধুর্যের কোনো খবর না পেয়ে চিন্তিত সে। কবিতাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছে, কালকে মাধুর্যের সঙ্গে বেশ বাজে ঘটনা ঘটেছে। সেই নিয়ে আরো বিষন্ন সে।

এসব চিন্তায় যখন সে মগ্ন তখনই তার একজন বন্ধু তাকে আলতো ধাক্কা দিতেই বিরক্ত আর রাগ নিয়ে তাকায় অরুণ। তখনই তার বন্ধুটি বলে ওঠে….
–“তোর ভালোর জন্য ধাক্কা মারছি। গেটের ওইপাশে চেয়ে দেখ। তোর পেয়ারা মাধু থুক্কু ভাবি এসেছে। তাও সঙ্গে একটা পোলা আছে দেখি। এক রাতে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেনি তো!”
চোখ লাল করে তাকায় অরুণ। সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ে তার বন্ধুরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। ঘাড় ঘুড়িয়ে গেটের ওপাশে তাকায় সে। মাধুর্যকে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে একটা মেয়ে আর ছেলে। ছেলেটাকে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় অরুণের। একচোখ ছোট আরেক চোখ বড় করে নজরটি হিংস্র প্রাণীর মতো তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। উত্তেজনায় পাশে থাকা বন্ধুর হাত জোরে চেপে ধরে সে। কয়েক সেকেন্ড পর বন্ধুটির চাপা আর্তনাদে ধ্যান ভেঙে তাকায় অরুণ। দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

অরুণের বন্ধুটির হাতে অরুণের নখ বসে গিয়ে গভীর ভাবে কেটে গিয়েছে। তা দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অরুণ। হাত মুঠো করে ফেলে সে। থমথমে সুরে বলে….
–“শিট! আমি খেয়াল করিনি সরি।”
–“আরে ইয়ার, জেলাসি হলে এমন হয় মাঝেসাঝে। আমরা বুঝি তো। কিন্তু তোর এতো বড় বড় নখ কোথা থেকে এলো? আজকাল মেয়ে হওয়ার ট্রাই করছিস নাকি?
কথাটা বলে দুষ্টুমির হাসি দেয় তার বন্ধুরা। অরুণ মাথা গরম করে সেখান থেকে উঠে চলে আসে।
বইয়ের ব্যাগ নিয়ে গেট দিয়ে প্রবেশ করে মাধুর্য। পিছু ফিরে একবার তাকায় অদ্ভুত লোকটির দিকে। যেন সে যত দেখে তবুও দেখার শেষ নেই। মাধুর্যের জামাকাপড়ের ব্যাগ জোর করে নিজের সাথে নিয়ে গাড়িতে বসে অনুভব। গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।

ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে ক্যাম্পাসে আসে কবিতা ও মাধুর্য।
–“কবিতা, জেদ করিস না। আমাকে অফিস যেতে হবে। আজকে আমার ফার্স্ট দিন। আজ গল্প না করলেই নয়?”
ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে তাকায় কবিতা। মাধুর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে ভেংচি কেটে বলে….
–“ওকে যাহ! বেশি টাইম নেব না। শুধু বল এখন কোথায় আছিস তুই? আমার ক্রাশের কাছে নাকি?”
খানিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মাধুর্য।
–“তোর ক্রাশ?”
–“হ্যাঁ আমার ক্রাশ। ওই নাম কি যেন! হ্যাঁ অনুভব সিনহা। আহা! যেমন তার লুক, তেমন তার স্টাইল। দিলমে তো ওয়ো জাগা কার লিয়া।”
মাধুর্য বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে। হাত ঝেড়ে বলে….
–“এ আর নতুন কি? প্রতিদিন তোর ক্রাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে।”

মাধুর্যের হাত চিপকে ধরে কবিতা। খুশি খুশি মুখ করে বলে….
–“একদমই না। এটা একদম সিরিয়াস ক্রাশ। পারলে এখনই বিয়ে করে নিতাম।”
বাঁকা চোখে তাকায় মাধুর্য। তখনই কবিতা চিল্লিয়ে বলে ওঠে….
–“এই মাধু, দেখ দেখ।”
–“কি দেখব?”
–“আরে আমার ফোনে দেখ। একটা লাশের ছবি বেরিয়েছে। রক্তশূণ্য লাশ। তাও আবার আমরা যেই কুয়োর রাস্তা দিয়ে গেছিলাম তার আশেপাশের কোনো রাস্তায়।”
থম মেরে কিছুক্ষণ থেকে দ্রুত ফোনের দিকে তাকায় মাধুর্য। একটা ফ্যাকাশে লাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঢক গিলে মাধুর্য। নিচে লিখা আছে, এটা কোনো মানুষ নয়। প্রাণীর আক্রমনে মারা গিয়েছে। আর মৃত লোকটি চোর ছিল। সম্ভবত রাতে চুরি করতে গিয়েই কোনো অজ্ঞাত প্রাণীর হাতে মৃত্যু হয়েছে তার।

এটা দেখার পরেও কোনো ভয় কাজ করে না মাধুর্যের ভেতরে। দৃষ্টি সরাতেই অরুণের দিকে নজর যায় তার। অরুণ তার দিকেই আসছে। এতোক্ষণ যেন শান্তি ছিল তার আশেপাশে। এই ছেলেটা আসার পরেই মনের মধ্যে খচখচ শুরু হয় তার। তবে অরুণের মুখটা আজ হাসোজ্জল নয়। বেশ শুকনো। এসেই সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে…..
–“আজ তোমার সঙ্গে ওই ছেলেটি কে ছিল মাধুর্য? যে তোমাকে এখান পর্যন্ত এগিয়ে দিল?”
মাধুর্যের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে। সেখানে বিব্রতর ছাপ স্পষ্ট।
–“কেন বলুন তো? উনার ব্যাপারে জেনে আপনি কি করবেন?”
–“কথা ঘুরিয়ো না। আমি যা বলছি তার উত্তর দাও।”
অরুণের কন্ঠে রয়েছে অদ্ভুত একটা ভয়ানক সুর। সেই সঙ্গে রাগ। তবুও দমে না মাধুর্য।
–“আমি কথা ঘুরাতে যাব কেন? আমি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করেছি তার মানে এই নয় যে আমার সব ব্যাপারে আপনি নাক গলাবেন। এই অধিকার তো আমি আপনাকে দিইনি।”
–“যাকে তাকে বিশ্বাস করো না। ক্ষতি তোমার হবে। যাকে তাকে নিজের কাছে টেনো না। তোমার সবটা শূন্য করে দিয়ে কখন চলে যাবে তা টেরও পাবে না।”

চলবে…..??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here