#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#পর্ব ৩৬ (শেষ পর্ব)
#আনিশা_সাবিহা
অনুভবের হাতে ধারালো তলোয়ার। তা দিয়ে বার বার আঘাত করছে অরুণকে। অন্যদিকে অরুণ বোধহয় অনেক আগেই প্রাণ ত্যাগ করে চলে গেছে। অরুণের গলা থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। পেট থেকেও রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অরুণের হাতে-পায়ে, সারা শরীরে তলোয়ার দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে অনুভব। অনুভবের নৃশংসতা দেখে কেঁপে ওঠে মাধুর্যের সারা শরীর। ওপরদিকে, রক্তের সেই ঘ্রাণ টানতে শুরু করে তাকে। কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে মাধুর্য ঘরে ঢুকে অনুভবের সামনে দাঁড়ায়।
–“এই আঘাত আগেরবার আমার ভাবনাকে আমার থেকে আলাদা করার জন্য, এই আঘাত সবার সামনে আমাকেই আমার ভালোবাসার খুনি বানানোর জন্য, এই আঘাত এবারেও আমার ভাবনা রূপি মাধুর্যের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য, এটা মাধুর্যের মতো নির্দোষ মেয়েকে হত্যার জন্য, আর এটা…..”
মাধুর্য কথার মাঝে থামিয়ে দেয় অনুভবকে। তার হাত থেকে তলোয়ার কেঁড়ে নিয়ে ফেলে দেয় মাধুর্য। এতোক্ষণ অনুভব ওসব কথা বলছিল আর বার বার তলোয়ার দিয়ে অরুণের মৃতদেহকে আঘাত করছিল। মাধুর্য বেশ জোর গলায় বলল….
–“কি করছো তুমি অনুভব? থেমে যাও এবার। অরুণ আর বেঁচে নেই।”
–“আমার মনের শান্তি না হওয়া অবধি আমি থামবো না। আমার ভেতরে আগুন জ্বলছে। মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে রাগে। বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?”
অনুভব চিৎকার করে এসব বলে তাকায় মাথা তুলে। তার লাল জ্বলজ্বল করা চোখজোড়া দেখে ভয়ে কুকিয়ে যায় মাধুর্য। অনুভবের অবস্থা তার ঠিক মনে হচ্ছে না। অনুভব তো এমন করে না। অবশেষে কি তাদের ভালোবাসার মিলনও অনুভবকে ঠিক করতে পারলো না?
–“কি হয়েছে তোমার, অনুভব?”
–“কি হবে আমার? আমি শান্তি পাচ্ছি না বুঝেছো? অশান্তি লাগছে। খুব অশান্তি আরো মারতে ইচ্ছে করছে।”
মাধুর্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অনুভব এতোক্ষণ ধরে রক্ত দেখে চলেছে অথচ তার কোনো প্রভাবই অনুভবের চোখে দেখতে পায়নি সে। এদিকে শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে মাধুর্য তবুও লাল তাজা রক্ত তাকে টানছে। সে অনুভবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
–“তোমার রক্তের তৃষ্ণা পাচ্ছে না?”
অনুভব কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে হাসফাস করতে থাকে। মাধুর্য তার এক হাত দিয়ে অনুভবের দুগাল চেপে ধরে নিজের দিকে তাকাতে বাধ্য করে অনুভবকে।
–“আমার দিকে তাকাও তুমি।”
অনুভব তাকায়। মাধুর্য সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখের রঙ পাল্টাতে শুরু করে। সবুজ বর্ণে পরিণত হয় তার চোখের মণি। সেটা দেখে অনুভবের চোখজোড়া শিথিল হয়। লাল বর্ণ থেকে ওর চোখের মণিও সবুজ বর্ণ হতে শুরু করে। মোমের মতো সমস্ত রাগ গলতে শুরু করে।
স্বাভাবিক হয়ে নাক শিটকাতে থাকে অনুভব। পেছন মুড়ে দেখে অরুণ রক্তমাখা দেহ পরে আছে ফ্লোরে।
–“এতোক্ষণ তো গন্ধটা পাইনি। আমার গলা শুকিয়ে আসছে মাধুর্য। বাইরে চলো।” (ক্লান্তির সাথে)
–“এতোক্ষণ রক্তের ঘ্রাণ পাওনি কারণ তুমি ভ্যাম্পায়ারের মতো আচরণই করছিলে না। তোমার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ারওল্ফের মতো আচরণ করছো তুমি। আর অরুণকে কেন মারলে? ওকে বাঁচিয়ে উচিত ছিল অন্তত কয়েকদিন। এই খবর যদি ওয়ারওল্ফের কিং এর কানে যায় সে মহাপ্রলয় আনতে পারে, অনুভব। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?”
অনুভব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর রক্তের ঘ্রাণ সহ্য করতে না পেরে মাধুর্যের হাত ধরে বাইরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। চাইলে ওর রক্তও পান করতে পারত সে। কিন্তু তার কোনো ইচ্ছেই নেই। অরুণের রক্ত পান করা মানে নিজের পাপ বাড়ানো!
মাথার চুল টানতে টানতো হাঁটতে থাকে অনুভব। পেছন পেছন চিন্তিত হয়ে হাঁটছে মাধুর্য। আর মাঝে মাঝে আঁড়চোখে অনুভবের দিকে তাকাচ্ছে। অনুভবের চোখেমুখে বেশ রক্ত লেগে আছে। সেই সঙ্গে ওফ হোয়াইট গেঞ্জি লাল রঙে রঙিন হয়ে গিয়েছে। অনুভব অস্থির হয়ে বলে ওঠে….
–“আমি বুঝতে পারছি না আমার সাথে কি হচ্ছে? আমি এমন কেন করছি? তবে একটা কথা! আমি এমন না হলেও ওর মৃত্যু আমার হাতেই হতো। শুধু থাকতো সময়ের পার্থক্য। আজ নয়ত কাল তাকে মরতে হতো।”
মাধুর্য নিজের কপালে চিন্তার রেখা টেনে বলে….
–“আচ্ছা। তোমায় ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় ঠিক পাওয়া যাবে। এখন ঘরে চলো। ফ্রেশ হয়ে নাও।”
অনুভব ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে জামা পাল্টে নেয়। তার চোখেমুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। এমন হতে চায়নি সে। ফ্রেশ হয়েই বেডে এসে ধপ করেই শুয়ে পড়ে অনুভব।
তা খেয়াল করে মাধুর্য বলে ওঠে….
–“একি, ব্রেকফাস্ট করো নি এখনো। শুয়ে পড়লে কেন? উঠে পড়ো। ব্রেকফাস্ট করো।”
–“আমার ভালো লাগছে না মাধুর্য। শরীরে অসম্ভব ব্যাথা করছে। আমি রেস্ট নিতে চাই। তুমি খেয়ে নাও।”
অনুভবের অদ্ভুত ব্যবহারে থম মেরে তাকিয়ে থাকে মাধুর্য। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অনুভবের মাথার কাছে গিয়ে বসতেই অনুভব তার হাত ধরে চোখ খুলে তাকায়। তার চোখ বলে দেয়, সে শান্তি চায়। তার ভেতরে অশান্তির ঝড় বইছে। মাধুর্য চিন্তিত হয়ে বলে ওঠে….
–“কি হয়েছে তোমার? আমায় খুলে বলো। আমারও ভালো লাগছে না তোমার এমন আচরণ।”
অনুভব বালিশ থেকে মাথা তুলে মাধুর্য কোলে মাথা রাখে। নিজের হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাধুর্যকে। বড্ড অসহায়তার সাথে বলে….
–“আমিও বুঝতে পারছি না আমার সাথে ঠিক কি হচ্ছে। শুধু ভালো লাগছে না।”
–“ঠিক আছে আমি আজ ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে অভিজ্ঞ বয়স্ক ভ্যাম্পায়ারের কাছে যাব। তুমি চিন্তা করো না।”
অনুভব নিরব থাকে। মাধুর্য কোলে নিজের মুখ গুঁজে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। হ্যাঁ, এবার তো তার শান্তিই লাগছে। বড্ড ভালোও লাগছে।
দুপুরে…..
–“মা! চুলের কি অবস্থা হয়েছে দেখো তো। এখানে এসে বসো। আমি তেল দিয়ে দিই।”
মধুরিমা হাসে তার মেয়ের কথায়। তৃপ্তির সাথে চেয়ে থাকে তার মেয়ের দিকে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে মেয়েটাকে বউ বউ লাগছে। চুলে কোনোরকমে খোঁপা করে রেখেছে। তার ডাগরডাগর চোখজোড়া ব্যস্ত বাটিতে তেল ঢালতে। আনমনে মধুরিমা বলে ওঠে…..
–“অনেক বড় হয়ে গেছিস। সংসার সামলানোও শিখে গেছিস। কিন্তু তোকে নিজ চোখে বড় হতে দেখার আফসোসটা রয়েই গেল।”
–“আমিও তো তোমার আদর ছোট থেকে পাইনি মা। বাবার আদরও মিস করেছি। যখন বুদ্ধি হয়েছে, তখন শুনেছি তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। তারপর থেকে সমুদ্রের সমান অভিমান নিয়ে বেঁচে ছিলাম। সব জানার পর এতো অভিমান অচিরেই শেষ হয়ে গেল। আমার আর কিছু চাই না। সব পেয়ে গেছি আমি। সব! এখন এসো দেখি তেল দিয়ে দিই।” (মিষ্টি হেঁসে)
মাধুর্যের সামনে গিয়ে বসে মধুরিমা। অন্যদিকে মুহিব নিজের মেয়ে আর স্ত্রীকে মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে দেখছে। তার জীবন সার্থক হয়েছে। তারও আর কিছুই চাই না।
নিজের বেলকনিতে থাকা চেয়ারে বসে আছেন প্রলয় সিনহা। আজকের দিনটা তার অফিসের ছুটি। ইচ্ছে করেই অফিসে যাননি। অনুভবও যায়নি। অনুভবের ব্যাপারে সবটাই জানিয়েছে মাধুর্য। তারপর থেকে উনি স্থির থাকতে পারছেন না। ছেলেটাকে নিয়ে কি করা উচিত তা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন উনি। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই অনুভবের দেখা মেলে। থাই দরজা ভেদ করে দেখতে পান অনুভব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। হেঁটে এসেই প্রলয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনুভব বলে ওঠে….
–“ড্যাড, ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে কিং অলক ভয়াবহ আক্রমণ করেছে। সব ভ্যাম্পায়ারদের মেরে চলেছে নিজের দলবল নিয়ে। এলিনা আমাকে এসে বলল।”
প্রলয় ধড়ফড় করে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়েন। উত্তেজিত হয়ে বলেন…..
–“ঠিক এটারই ভয় পাচ্ছিলাম। তুই অরুণকে মেরে গোটা রাজ্যের ওপর বিপদ বয়ে আনলি অনুভব। নিশ্চয় কিং অলক খবর পেয়েছে নিজের ছেলের মৃত্যুর!”
অনুভব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে প্রলয় বলেন….
–“এখন কিছু করার নেই। আমাদের সেখানে যেতে হবে। সবাইকে বল। আমাদের পৌঁছাতে হবে। আজ ওই শয়তান গুলো বাঁচবে নয়তো আমরা।”
অনুভব বিদ্যুৎ এর গতিতে স্থান ত্যাগ করে। সবাইকে বলতেই সবাই দ্রুত নেমে আসে। অনুভব শুধু মাধুর্যকে খবর দেয়নি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মাধুর্যকে নিয়ে যাবে না সে। একবার সে হারিয়েছিল তার ভালোবাসাকে। এবার তার ভালোবাসা নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেবে না।
অনুভবকে অবাক করে দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে মাধুর্য দ্রুততার সাথে। পেছন পেছন আসে এলিনা। নিচে নেমে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে….
–“তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো অনুভব? চলো। আমাদের দ্রুত যেতে হবে। নয়ত আমাদের রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।”
অনুভব থতমত খেয়ে যায়। সে তো মাধুর্যকে এই বিষয়ে কিছু জানায়নি। তবে?
–“তো…তোমাকে এই বিষয়ে কে বলল?”
–“কে আবার বলবে? এলিনা বলেছে।”
এলিনার দিকে অনুভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চুপসে যায় এলিনা। সে বুঝতে পারে, অনেক বড়ই একটা ভুল করে ফেলেছে। মাধুর্য অনুভবের ভাবভঙ্গি দেখে কিছু একটা বুঝতে পেরে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে…..
–“বাই এনি চান্স, তুমি কি আমাকে না নিয়ে যাওয়ার প্লানিং করছিলে?”
অনুভব গলা খাঁকারি দিয়ে মাধুর্য কাঁধে চেপে ধরে শান্ত কন্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করে বলে…..
–“দেখো, তুমি বাড়িতেই থাকো। তোমার মা-বাবাও তো চিন্তা করবে তুমি গেলে তাই না? আর আমি তোমাকে হারাতে চাই না মাধুর্য। সো প্লিজ….!”
–“মা-বাবা জানে আমি আপনার পরিপূরক। বিপদে একজনের পাশে অন্যজন দাঁড়ানোই স্বামী-স্ত্রীর ধর্ম অনুভব। আর রাজ্যটা আমারও। তাই আমাকেও লড়তে হবে। অনেক করে ফেলেছে ওই কিং অলক। আমার মা-বাবাকে বন্দি রেখে ঠিক করেনি। উনার শেষ আমি আজ দেখে ছাড়ব।”
অনুভব আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। অন্য সবাই আগেই বেরিয়ে পড়েছে। দুজনে একসাথে বেরিয়ে পড়ে।
এখন ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে মধ্যরাত। আশেপাশে ভয়াবহ পরিস্থিতি। যুদ্ধের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ওয়ারওল্ফদের সাথে ভ্যাম্পায়ারদের যুদ্ধ। সবার হাতে হাতে তলোয়ার। মাধুর্য খুব করে চেষ্টা করছে সবাইকে বাঁচাতে। তার হাতেও তলোয়ার। সে বাঁচিয়ে যাচ্ছে যারা যুদ্ধ করতে অক্ষম তাদের। তারও আঘাত কম লাগেনি। হাতে আর গালে আঘাতের গাঢ় দাগ! সামনে দুই পা ফেলে খুঁজে চলেছে অনুভবকে। এরই মাঝে আক্রমণ করে বসে একজন ওয়ারওল্ফ। মাধুর্য নিজের আসল রুপ ধারণ করতেই ওয়ারওল্ফটি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দিকে। মাধুর্য ভয়ানক চিৎকার দিয়ে চেপে ধরে ওয়ারওল্ফের গলা। বসিয়ে দেয় নিজের চিকন আর বড় বড় দাঁত। রক্তশূণ্য করে ছেড়ে দেয় ওয়ারওল্ফটিকে। সামনে এগিয়ে যায় সে। একটা ভ্যাম্পায়ার ছোট শিশুকে ভয়ানক ওয়ারওল্ফের কবলে দেখে মাধুর্য ঝড়ের গতিতে গিয়ে শিশুটিকে আক্রমণ করার আগেই নিজের হাতে তলোয়ার চালিয়ে দেয় ওয়ারওল্ফের গলায়। সঙ্গে সঙ্গে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ওয়ারওল্ফের গলা থেকে মাথা।
বাচ্চাটি কেঁদে দেওয়ায় আদরের সঙ্গে কোলে তুলে নেয়।
–“কাঁদে না বাবু। আমি তোমার মায়ের কাছ দিয়ে আসব। চিন্তা করো না।”
বাচ্চাটি শান্ত হয়। তাকিয়ে থাকে মাধুর্যের মনকাড়া চোখের দিকে। বাচ্চাটিকে নিয়ে পা বাড়ায় মাধুর্য।
আস্তে আস্তে ধ্বংস হচ্ছে সব ওয়ারওল্ফ। জিতে যাচ্ছে ভ্যাম্পায়ার। ভ্যাম্পায়ার কিং প্রলয় নিজের ভয়ানক রুপ নিয়ে যুদ্ধ করছেন কিং অলকের সাথে। অন্যদিকে অনুভব নিজের তলোয়ার দিয়ে যাকে পাচ্ছে মেরেই চলেছে। অলকের সঙ্গে পেরে উঠছেন না প্রলয়। একসময় সুযোগ বুঝে তলোয়ারের আঘাত দিয়ে ফেলে দেয় অলক প্রলয়কে। অতঃপর অলকের ভয়াবহ হাসিতে কেঁপে ওঠে আশপাশ।
–“আমার ছেলেকে মেরেছিস তোরা সবাই। তোদের ছাড়ব না। ছাড়ব না আমি। তোদের ধ্বংস। আমার শান্তি।”
প্রলয়ের হাত থেকে ছিটকে গেছে তলোয়ার। কি করবেন বুঝে পান না উনি। পিছাতে থাকে উপায় না পেয়ে।
একসময় নিজের তলোয়ার প্রলয়ের দিকে চালাতে নিলে দৌড়ে আসে অনুভব। কিন্তু সময়মতো পৌঁছাতে পারে না। তার আগে মাধুর্য এসে দাঁড়ায় কিং অলকের সামনে। ভয়ে অনুভব চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে। দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। হাঁটু গেঁড়ে বসে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মাধুর্য। ওর এক হাতে তলোয়ার। তলোয়ারের অন্য প্রান্ত কিং অলকের পেটে ঢোকানো। সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছে। মাধুর্য তলোয়ার তার পেট থেকে বের করে আবারও পেটে ঢুকিয়ে দেয়। আকাশের দিকে মুখ করে চিৎকার করে ওঠে কিং অলক। এটাই ছিল তার শেষ চিৎকার। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
–“একসময় আমাকেও এভাবেই তলোয়ার দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সেট করেছিল আপনার ছেলে। আপনিও সাথ দিয়েছিলেন। আরো কত অন্যায় করেছেন তার ঠিক নেই। আমার মা-বাবাকে এতো বছর কষ্ট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু কথায় আছে, প্রকৃতি সব কিছু একসময় ফিরিয়ে দেয়। সেটা আপনার কর্মের ফল হলেও ফিরিয়ে দেয়।”
কিং অলক সেখানেই মারা যায়। মাধুর্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
জয়ী হয় ভ্যাম্পায়ারদের। বিজয়ের উল্লাস পড়ে চারিদিকে। প্রলয় এগিয়ে এসে মাধুর্যের সামনে দাঁড়ান। তার মাথায় স্নেহের হাত রেখে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলে….
–“আজ আবারও প্রমাণ করে দিলে আমি ভুল ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমার ছেলের মিল হলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আমি কতবড় ভুল করতে চলেছিলাম সেটা বুঝতে পেরেছি। আমার প্রাণ বাঁচিয়ে আমার ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিলে।”
–“এভাবে বলবেন না। আপনি আমার বাবার মতোই। বলা বাহুল্য আপনি আমার আরেক বাবা।”
অনুভব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসতেই তার হাত এবং মাধুর্যের হাত ধরে দুজনের হাত একসাথে মিলিয়ে দেন প্রলয়।
–“একসময় আমি চেয়েছিলাম তোমাদের আলাদা করতে। আজ আমি নিজেই চাই তোমরা এক হও। আর একসঙ্গে বাঁচো।”
অনুভব মাধুর্যকে ফিরে পেয়ে সকলের সামনে লজ্জার মাথা খেয়ে জড়িয়ে ধরে। বিষয়টাতে মাধুর্য লজ্জায় কুকিয়ে গেলেও অনুভবের মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। তা দেখে সবাই আরো আনন্দের সাথে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। মাধুর্য বাড়িতে বসে বসে চুল শুকোনোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে মধুরিমা অস্থির হয়ে নিজের মেয়ের গালে, গলায়, হাতে মলম দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। অতঃপর শেষমেশ রেগেই বলে….
–“তুই শান্ত হয়ে বসবি? আমায় আমার কাজ করতে দিবি?”
–“ওহ মা! আমাদের ক্ষত খুব তাড়াতাড়ি সেড়ে যায়। আজকে এসব আঘাত দেখছো তো? কাল আর দেখবে না। দাগও থাকবে না।”
–“আচ্ছা দাও।”
–“হ্যাঁ মা। আপনি ওকে জোর করেই লাগিয়ে দিন। নয়ত আপনার মেয়ে বড্ড অবাধ্য। আমার কথাও শোনে না।”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটি বলল অনুভব। তার পেছন পেছন হাসতে হাসতে ঢোকে জোহান। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভালোমতো জখম হয়েছে সে। তবুও দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
–“ভাবি, তোমায় বিরক্ত করতে চলে এলাম।”
বলে হাসিটা আরো প্রসারিত করে জোহান। এরই মাঝে অনুভব তার পিঠে আলতো মেরে বলে…..
–“চুপ কর। মাধুর্য আসলে জোহানের তো কেউ নাই। ওর ক্ষতগুলো খুব গভীর। তাই ওর যত্নের দরকার তাই নিয়ে এলাম।”
–“খুব ভালো করেছো।”
মিষ্টি হাসে মাধুর্য। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জোহানকে উদ্দেশ্য করে বলে….
–“এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন জোহান ভাইয়া? চলুন আপনাকে ঘর দেখিয়ে দিই। রেস্ট নিন।”
জোহান মাথায় দুলায়। মাধুর্য ঘর থেকে বের হতে নিতেই ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে সামিহা। মাধুর্যকে দেখে দ্রুততার সাথে বলে….
–“মাধুর্য, শুনলাম ফুফা আর ফুপি এসেছে। তাই দেরি না করে চলে এলাম। তুই কি রে? আমায় খবরও দিত….”
জোহানকে দেখে থমকে যায় সে। তার চোখমুখ দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়। সেই সাথে খানিকটা দুঃখও পায়। লোকটার কত লেগেছে!!
বোন, মা আর মেয়েদের মাঝে না থাকায় ভালো ভেবে বেড়িয়ে যায় অনুভব জোহানকে নিয়ে। সামিহা তাকিয়ে থাকে জোহানের যাওয়ার পানে। জিজ্ঞেস করতে বড্ড ইচ্ছে করল, কি করে এমন হলো আপনার? কিন্তু মুখ থেকে একটা টু শব্দও বের করতে পারল না সামিহা। মাধুর্য সামিহাকে সবটা বলে। তার মায়ের সাথে পরিচয় করায়। সবটা শুনে হতভম্বতার রেশ কাটাতে পারে না সামিহা।
–“তার মানে তোরা ভ্যাম্পায়ার?”
–“হ্যাঁ। এখন কি তুমি আমায় দূরে সরিয়ে দেবে?”
মাধুর্যের কথায় রেগে তাকায় সামিহা। তার মাথায় টোকা মেরে মুখ ফুলিয়ে বলে….
–“এভাবে বলতে পারলি? তুই যেই হো না কেন! আমার কিছু যায় আসে না। আমার কাছে তুই আমার বোন।”
মাধুর্য জড়িয়ে ধরে সামিহাকে। নিজের বোনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সে। এতোটাই ভালোবাসে তাকে। এতকিছুর মাঝে হঠাৎ সামিহা প্রশ্ন করে….
–“আচ্ছা, জোহানও ভ্যাম্পায়ার?”
মাধুর্য কিছু না ভেবেই উত্তর দেয়….
–“হ্যাঁ। উনিও ভ্যাম্পায়ার।”
সামিহার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যেতে শুরু করে। এতোদিন তার মানে মিথ্যে স্বপ্ন বুনছিল জোহানকে নিয়ে? না চাইতেও মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছিল সেদিনের পর থেকে জোহানকে। তাকে নিয়ে প্রতিটা মূহুর্ত ভেবেছে সামিহা। এখন মিথ্যেই মনে হচ্ছে তার সবটা। এলোমেলো লাগছে। তবুও সে মুখে প্রকাশ করল না। বাহানা দিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে।
–“আমি ভ্যাম্পায়ার বলে বুঝি আমাকে ভালোবাসা যায় না??”
চকিতে পেছন মুড়ে তাকায় সামিহা। জোহান দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না চাইতেও সবটা শুনে নিয়েছে সে। সামিহা কাঁপতে শুরু করে। কম্পন ধরা গলায় বলল….
–“মা…মানে?”
জোহান এগিয়ে আসে। নিজের বুকে হাত রেখে বলল….
–“আমরা ভ্যাম্পায়ার। আমরা দৃষ্টি দেখে বুঝে যাই কার মনে কি চলছে। তোমার দৃষ্টিতেও অনেক পেয়েছি মিস. সামিহা!”
সামিহা চুপ করে থাকে। তা দেখে জোহান আবারও বলে….
–“আমাকে ভালোবাসা অন্যায় মনে হয় তোমার? আমি ভ্যাম্পায়ার বলে মানুষকে ভালোবাসা অপরাধ?”
পিটপিট করে তাকায় সামিহা। না বুঝে বলে….
–“মানে?”
–“মানেটা হচ্ছে তুমি যা ফিল করছো তা আমিও করছি।”
সোজাসাপটা ভাবে উত্তর দেয় জোহান। সামিহার চোখ ছলছল করে ওঠে। তার ভালো লাগছে। খুশি তাকে ঘিরে ধরেছে যেন। জোহান সামিহার হাত ধরে আলতো চুমু খায়। ভ্রু নাচিয়ে বলে…..
–“সো মিস. কিপটে! ভালোবাসার অনুমতি কি পেলাম?”
সামিহা কি রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারল না। হেসেই ফেলল সে। এখান থেকেই শুরু হয় তাদের ভালোবাসার এক অধ্যায়!
চারিদিকে জোনাকির মেলা বসেছে আজও। কিন্তু জায়গায়টা একটু ভিন্ন! এটা ভ্যাম্পায়ার রাজ্য। গাছপালার আচ্ছাদনের ভীড়ে রয়েছে একটা ব্রিজ। ব্রিজটা অদ্ভুত সুন্দর। ব্রিজের কংক্রিটে লাইট জ্বলছে। তা আরো মনোমুগ্ধকর করছে পরিবেশ। মাঝে মাঝে গাছের পাতা নড়ছে। তারা বোধহয় আড়াল করতে চাইছে আজ মাধুর্যের মাধুকরী সৌন্দর্যকে। তার সৌন্দর্য অপরুপ ভাবে ফুটে উঠেছে আজ। সে ঠিক সেদিনের মতো সেজেছে যেদিন অনুভবের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তার। তখন সে ছিল ভাবনা। একজোড়া ঠান্ডা হাত স্পর্শ করে তার গাল। সে জানে এই স্পর্শটি। তাই বন্ধ করে তার চোখ। বিরবির করে বলে….
–“অনুভব।”
অনুভব তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের মাঝে লুকিয়ে ফেলে মাধুর্যকে। আজ তাদের সুখকর মূহুর্তে কেউ বাঁধা দেবার নেই।
–“আজ মনে হচ্ছে, আমার অপেক্ষার ফল সত্যিই শেষ হয়েছে। আমার ভালোবাসার বদল হয়নি মাধুর্য। আমি চিনে নিতে পেরেছি আমার ভাবনাকে।”
মাধুর্য অনুভবের বুকে মুখ লুকিয়ে শুধু শোনে। অনুভবের বুকে বড় বড় লোমে সুড়সুড়ি লাগে তার। আবার লোকটার ঘ্রাণ তার ভালোও লাগে। সব মিলিয়ে আজ ভালোবাসায় দিশেহারা দুজনে। প্রকৃতিও তাদের আলতো মিষ্টি হাওয়ায় বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের ভালোবাসা তারাও লুকিয়ে দেখছে! মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা দেখে মাধুর্যের থুঁতনি ধরে তোলে অনুভব। মেয়েটার গালে চিকচিকে পানি দেখে বুকটা ধক করে ওঠে তার।
–“কাঁদছো কেন?”
মাধুর্য ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলে….
–“একসময় অবিশ্বাস করেছি তোমাকে। অবিশ্বাস করেছি তোমার ভালোবাসাকে। খুনি অপবাদ দিয়েছি তোমাকে। এখন নিজেকে ক্ষমা করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এতোকিছুর পরেও আমি জানতাম তুমি মিশে গেছো আমার অস্তিত্বে। তোমায় ভুলতে চেয়েছিলাম আমি। তবে এটা তো মাথাতেই ছিল না যে, তোমায় মন থেকে মুছতে হলে আমার অস্বস্তি আমায় মুছে ফেলতে হবে।”
অনুভব কিছু না ভেবে হাসে। মাধুর্যের গালে পানি নিজের গালের সাথে মিশিয়ে নিয়ে কানে কানে বলে….
–“উঁহু, কেঁদে পার করলে চলবে না মাই লাভ! এসব কিছুর শাস্তি তোমায় পেতে হবে।”
–“কি শাস্তি?”
মিনমিন করে মাধুর্য। অনুভব ঝট করেই মাধুর্যকে কোলে তুলে নেয়।
–“আমায় ভালোবাসতে হবে। অভিজ্ঞ বয়স্ক ভ্যাম্পায়ার বলেছে তোমার ভালোবাসা আমার মাঝ থেকে খারাপ শক্ত দূর করবে। তাই আমার ভালোবাসা চাই। এটা তোমার শাস্তি।”
গাল লাল করে হাসে মাধুর্য। মুখ লুকিয়ে ফেলে অনুভবের বুকে। তা দেখে আরো জোরে বলে….
–“তা রাজি তো আমায় ভালোবাসা দেওয়ার জন্য আর ভালোবাসা নেওয়ার জন্য?”
মাধুর্য অনুভবের পিঠ খামচে ধরে লজ্জায়। ইশশ…কি লজ্জা! অনুভব মাধুর্যকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। জোনাকিরাও যেন হাসছে! ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার সময় এসেছে। #অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা পূর্ণ করার পালা এসেছে।
সমাপ্ত?