অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা #The_Mysterious_Love #২০,২১ #আনিশা_সাবিহা

0
976

#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#২০,২১
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০

আকাশে সূর্য আর দেখা যাচ্ছে না। আবারও প্রকৃতি নিজেকে ঢেকে ফেলছে অন্ধকারের মাধ্যমে। আশেপাশে ঘন জঙ্গল থাকায় শোনা যাচ্ছে পেঁচার ডাক। নামাজ পড়ে থুঁতনিতে হাত দিয়ে জানালার পাশে বসে আছে মাধুর্য। তার মুক্ত ঝরা হাসি নেই। তার একটি বিশেষ কারণ আছে। তা হলো অনুভব। মানুষটা তাকে কখনোই শান্তি দেয় না। আজ সারাদিনের জন্য একবারও দেখা হয়নি তার মাধুর্যের সঙ্গে। যা ফলে সব কিছুই পানসে লাগছে মাধুর্যের। নিজে নিজেই মাধুর্য অভিমানী কন্ঠে বলে ওঠে….
–“আচ্ছা! অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ বুঝলাম। অন্তত কল করলে নিশ্চয় জাত যেত না। আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সেটার খবর তো নিতে পারত!”
কথাটা শেষ হতে না হতেই টংটং করে ঘড়ির ঘন্টা বাজে। ঘড়ির ছোট কাটা সাত-এ ঠেকেছে। ঘড়ির ঘন্টার আওয়াজ ভূতূড়ে! প্রথম যেদিন আওয়াজ বেজেছিল সেদিন একপ্রকার চমকে উঠেছিল মাধুর্য।

সে যাই হোক, আজ মাধুর্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনুভবকে তার মনের কথা জানাবে। মানুষটাকে ছাড়া তার পুরো জীবন যেন রঙহীন! এই রঙহীন জীবন নিয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। জীবনে রঙ নিয়ে আসতেও তার অনুভবকে চাই। মাধুর্য এটাও ভাবল, নিজের মনের কথা জানাবার সঙ্গে অনুভবকে কয়েকটা ঝাড়িও দিয়ে দেবে মনমতো। লোকটা তাকে ভালোবাসে অথচ পুরুষ হয়েও মনের কথা জানাতে পারছে না? ভারি অদ্ভুত! বিরবির করতে করতে কোল থেকে বালিশ নামিয়ে উঠে পড়ে মাধুর্য। চোখমুখে পানির ঝাপ্টা লাগিয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখটা মুছতেই অনুভবের দেওয়া শপিং ব্যাগটা তার চোখে পড়ে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভেতর থেকে একটা বেগুনি রঙের গাউন আবিষ্কার করে মাধুর্য। হতভম্ব হয়ে যায় সে কিছুক্ষণের জন্য। ব্যাগটা উপুড় করতেই ব্যাগ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে একটা ছোট কাগজ। তা হাতে নিয়ে কাজের ভাঁজ খুলে ছোট ছোট গোছানো লিখা চোখে ভেসে ওঠে মাধুর্যের। মুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকে লিখাগুলো।
‘পছন্দের ব্যাপার স্যাপারে আমি অতি দুর্বল। তাই যা পেরেছি পছন্দ করেছি তোমার জন্য। জানি না নীল রঙের ছোঁয়াতে তোমায় কেমন লাগবে! তবে কল্পনা করে দেখলাম ইউ লুকিং গর্জিয়াস। পার্টিতে ড্রেস টা পড়লে আমার ভালো লাগবে। জীবনে বোধহয় একটা পছন্দই সবথেকে বেস্ট। তা হলো মাধুর্য চৌধুরী।’

মাধুর্যের মনে মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়। হাসিও পায় আবার শিহরণে শরীর কেঁপেও ওঠে শেষ কথা শুনে। মুখে হাত দিয়ে হেঁসে বলে….
–“নীল রঙ? আমি বোধহয় আসলেই একজন পাগলকে ভালোবেসেছি। যে কি না ঠিকঠাক রঙও চিনে না।”
অন্য হাতে বেগুনি রঙের গাউনটা নেয় সে। উল্টেপাল্টে বলে….
–“বেগুনি রঙ কে নীল রঙ বানিয়েছেন উনি। কি অদ্ভুত! শুনেছি প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রঙ চিনতে ভুল করে। আজকে প্রমাণ টুকুও পেলাম।”
আর কথা বাড়ায় না মাধুর্য। রেডি হতে শুরু করে নিজের মতো। গাউনটা গায়ে জড়িয়ে বাঁকা করে খোঁপা করে সে। খোঁপায় লাগিয়ে দেয় একটা কৃত্রিম বেগুনি রঙের ফুলের মালা। গলায় চিকন একটা স্টোনের হার পড়ে নেয়। বেগুনি রঙের ছোঁয়া বাড়িয়ে তোলে মাধুর্যের মাধুরি। রেডি হয়ে একপলক নিজেকে দেখে নেয় সে। গলায় জড়িয়ে নেয় বেগুনি স্কার্ফ। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘটে এলিনার আগমন।

–“মাধুর্য, বাইরে একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তুমি তৈরি হয়ে গিয়েছো?”
–“হ্যাঁ, আমি তৈরি।”
এলিনা আলতো হেসে মাধুর্যকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। আনমনেই বলে ফেলে….
–“প্রতিবারই সৃষ্টিকর্তা তোমাকে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দান করেন।”
প্রথমে বুঝতে না পারলেও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সংকোচ নিয়ে তাকায় মাধুর্য।
–“প্রতিবারই মানে?”
নিজের ওপরই হতভম্ব হয়ে বিষম খায় এলিনা। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবতে থাকে কোন বাহানা দেওয়া যায়। তখনই বেজে ওঠে গাড়ির হর্ন। বিষয়টা চেপে যাওয়ার জন্য এলিনা দ্রুততার সঙ্গে বলে ওঠে….
–“দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি এসো নয়ত অনুভব রাগ করবে।”
এলিনা যেন চোরের মতো পালিয়ে যায়। থম মেরে কয়েক সেকেন্ড সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে মাধুর্য। অতঃপর হাঁটা দেয় বাহিরের দিকে।

আজকের পার্টি রাখার কারণ একমাত্র কারণ হলো ভ্যাম্পায়ার রাজ্য আগের মতো ফিরে পেয়েছে সবাই। কাল থেকে শুরু হবে সব ভ্যাম্পায়ারের নিজের রাজ্যে জীবনযাপন। তবে বাকিদের কাছে পার্টির কারণ হচ্ছে, তারা কোম্পানির বড় ডিল পেয়েছে। প্রলয় সিনহা আজ বেশ খুশি। সব আগের মতো লাগছে উনার। আজকের পার্টি রাখার আরেকটি গোপন কারণ রয়েছে। যা শুধু প্রলয় সিনহা এবং তার ছোট ভাইসহ ছোট ভাইয়ের বউ জানে। কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই প্রকাশিত হবে। আশেপাশে হালকা লাইটে সবাই নিজে নিজেদের মতো ব্যস্ত। পার্টিটা সিনহা বাড়ির টেরিসে আয়োজন করা হয়েছে। একপাশ থেকে লো মিউজিক ভেসে আসছে যা পরিবেশটাকে রোমাঞ্চকর করতে বাধ্য। ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে আশেপাশে ঘুরে ঘুরে অনুভবকে খুঁজতে থাকেন প্রলয়। ঘড়িতে সময় দেখেন উনি। প্রলয়ের একটা ছেলে থাকলেও তার বয়স আন্দাজ করা বেশির ভাগ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কারণ ভ্যাম্পায়ারদের বয়সের সঙ্গে চেহারায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না সহজে। তবুও বয়স্ক দেখাতে মোটা ফেমের চশমা পড়ে ঘোরেন উনি।

–“ছেলেটা তো এতো দেরি করে না। আজকে হঠাৎ কি হলো?”
বিরবির করে বলে ওঠেন প্রলয়। সামনে রায়মা কে দেখে একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন….
–“রায়মা, অনুভবের ঘরে গিয়েছিলে? ও রেডি হয়নি?”
–“আমি তো ওর ঘরের সামনে গেছিলাম প্রলয় ভাই। ছেলেটাকে তো চেনেন। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। একবার ডেকেছিলাম। ও বলল রেডি হয়ে নিচে আসছে।”
প্রলয় ছোট্ট করে “ওহ” বলে সরে আসেন। একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মূহুর্তেই। ক্লায়েন্ট প্রশ্ন করে ওঠেন…
–“হোয়ার ইজ ইউর সন মি. সিনহা?”
প্রলয় কিছু একটা উত্তর দেওয়া আগে অনুভবকে উঠে আসতে দেখে ইশারা করে বলেন….
–“দেয়ার হি ইজ…!!”
–“ওহ হো! দিস হ্যান্ডসাম গাই। লাইক ইউ।”
প্রলয় শব্দ করে হাসেন।

মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে পার্টিতে এসে উপস্থিত হয় অনুভব। নিজের কোটের হাতা ঠিক করতে করতে তার পকেটে হাত দেয়। পকেট থেকে একটা চিকন এবং চকচকে সুন্দর রিং বের করে অনুভব। মুখে স্নিদ্ধমাখা হাসি ফুটে ওঠে ওর। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আজকে মাধুর্যকে নিজের মনের কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। সেই সঙ্গে করছে তার ভয়। এতোদিন ভয়ের মুখোমুখি না হলেও হুট করেই ভয় করছে তার। এরপর যদি একবারের জন্যও মাধুর্যের আগের কথা মনে পড়ে যায় তবে সবটা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাবে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রিং টা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসে মানুষের ভীড়ের দিকে।
দাঁড়িয়ে এক কোণায় কথা বলতে মগ্ন হয়ে পড়ে একটি মানুষের সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ হেসে হেসে কথা বলার পর ওর চোখ যায় একজোড়া পায়ের ওপর। এগিয়ে আসছে সেই পা-জোড়া। চোখ ওপরে তুলতেই হৃৎস্পন্দনের গতি দশগুণ বেড়ে যায়। চোখে আঁটকে যায় তার প্রেয়সী। কোনোরকমে বলে ওঠে….
–“এক্সকিউজ মি!”
তার সামনে থাকা ব্যক্তিটির থেকে চলে আসে অনুভব। একটু একটু করে অনুভব ও মাধুর্য দুজনেই এগিয়ে আসে। একসময় থেমে যায় মাধুর্য। অনুভব অনেকটা কাছে চলে আসে।

চোখ নামিয়ে রেখেছে মাধুর্য। অনুভব অস্ফুটস্বরে বলে….
–“বিউটিফুল।”
মাধুর্য লাজুক হাসি হাসে মাথা নিচু করে। হাসি বজায় রেখেই বলে….
–“কিন্তু, এটা নীল নয় বেগুনি রঙ। এতো বড় হয়েছেন তাও রঙ চিনতে শিখেন নি?”
–“একসময় জীবনের সব রঙ হারিয়ে গিয়েছিল তো তাই কোনটা কোন রঙ ভুলেই গিয়েছি বোধহয়। নো প্রবলেম, তুমি এসেছো তো। সব রঙ চিনতে শেখাবে।”
প্রথম কথাগুলো রহস্যময় লাগলেও শেষ কথাটুকুতে নেচে ওঠে মাধুর্যের মন। চোখ তুলে অনুভবের দিকে তাকায় সে। নীল চোখজোড়ার এই অদ্ভুত চাহনি যেন তাকেই নেশা লাগিয়ে দিচ্ছে। মূহুর্তেই নামিয়ে নেয় চোখ। বলতে সাহস পায় না নিজের মনের কথা। কতক্ষণ চাপা রাখতে পারবে তা জানা নেই মাধুর্যের। এভাবে অনুভবের সামনে থাকতে পারছে না সে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক আওয়াজটা বেরেই চলেছে। তাই আস্তে আস্তে পেছন মুড়ে এলিনাকে খুঁজতে লাগে তার দুই চোখ। আসার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটা?

এলিনাকে না দেখতে পেয়ে ধীর গতিতে হাঁটতে শুরু করে মাধুর্য দুই হাতে গাউন ধরে। ও খেয়াল করে অনুভবও তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে। ইশশ…যার থেকে সে পালাতে চাইছে সেই মানুষটাই যদি পেছনে থাকে তবে তো পালিয়ে লাভ নেই। ভ্রু কুঁচকে বলে….
–“আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন কেন?”
–“নয়ত তুমিই বিপদে পড়বে।”
–“আমি?” (ঘাড় ঘুড়িয়ে)
অনুভব মাথা নাড়িয়ে হালকা নিচু হয়ে বলে….
–“ইয়েস তুমি। জানো তো, প্রথম দিন তোমাকে ঠিকই ধরেছিলাম। তুমি প্রচন্ড খামখেয়ালি।”
চোখ ছোট ছোট করে তাকায় মাধুর্য। লোকটা তাকে আবারও অপমান করতে চাইছে। মুখ বেলুনের মতো ফুলিয়ে বলে…..
–“দেখুন আপনি কিন্তু…. ”
–“ড্রেস টা যে পড়েছেন তা ভালোভাবে পড়তে পারতেন তো। আপনার পিঠের একটু ওপরে যেই ড্রেসের ফিতা সেটা বাঁধতে ভুলে গেছেন।”
মাধুর্যের কথা থেমে যায়। রেগেমেগে বলে….
–“কি সব আজেবাজে কথা!”
গটগট করে হাঁটতে শুরু করে মাধুর্য। তবুও পিছু ছাড়ে না অনুভব। হাঁটতে হাঁটতে স্বাভাবিক হয়েই বলে….
–“আপনার পিঠের ওপরে তিলটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে মিস. মাধুর্য।”

ঢক গিলে থেমে যায় মাধুর্য। লজ্জায় কাঁপুনি দিয়ে ওঠে সে। আশেপাশে লুকানোর মতো জায়গা না দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকায় অনুভবের দিকে। অনুভব ভ্রু নাচিয়ে তাকায়। এখানে চেনাজানা বলতে এলিনা ছাড়া তেমন কেউ নেই। আর যারা আছে সবাই তাদের অফিসের। এলিনাও যে কোন ভীড়ের অতলে তলিয়ে গেছে কে জানে! এমন সময় অনুভব কানে ফিসফিস করে বলে….
–“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি তোমার হেল্প করতে পারি।”
সঙ্গে সঙ্গে মাধুর্য এমন ভাবে তাকায় যেন অনুভব বিশাল বড় অপরাধ করে ফেলেছে। অনুভব চোখ বড় বড় করে বলে….
–“এই না না। আমি ভালো ছেলে। এখন তুমি তাহলে কাকে খুঁজে নেবে নাও।”
বাঁকা হেসে সেখান থেকে চলে যেতে নেয় অনুভব। মাধুর্য তাড়াতাড়ি ওর হাত দিয়ে অনুভবের হাত ধরে। অনুভব জানতো এমনটাই হবে।
–“আমাকে হেল্প করুন না প্লিজ!”
অনুভব আশেপাশে তাকায়। তারপর আঙ্গুল দিয়ে নিজের দিকে তাক করে বলে….
–“কে আমি?”
মাধুর্য ঠোঁট উল্টে মাথা দুলায়।

অনুভব কিছুক্ষণ মাধুর্যের অসহায় চেহারা উপভোগ করতে থাকে। তারপর হো হো করে হেসে দেয়। বোকা বনে যায় মাধুর্য। কোনোমতে অনুভব হাসি থামিয়ে বলে….
–“ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমিও ওতো টাও খারাপ নই। আমি এলিনাকে ডেকে আনছি।”
অনুভবের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে মাধুর্য। সরু ঠোঁটে বলে ওঠে…..
–“আপনি যাবেন না। চুল খোলা নেই পেছনে। খোলা পিঠ…. ”
বাকিটুকু বলতে পারে না মাধুর্য। সে এলিনাকে ফোন করেও পায় না। অনুভব উপায় না পেয়ে মাধুর্যকে তার ঘরে নিয়ে আসে। তাকে থাকতে বলে অনুভব।
–“আমি এলিনাকে ডেকে নিয়ে আসছি।”
–“তাড়াতাড়ি আসবেন।”
অনুভব ঠাস করে চোখ টিপ দিয়ে বলে….
–“এই গেলাম আর এই এলাম।”
সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতিতে হাওয়া হয়ে যায় অনুভব।
মিনিট পাঁচেক পর দেখা মিলে তার। সঙ্গে এলিনাও আছে। এলিনাকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে অনুভব বলে….
–“ওর তোমাকে দরকার। যাও। ফাস্ট।”

এলিনা বাধ্যমতো মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢোকে। বাইরেই কাঁচের রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে অনুভব। ও আজ সবার সামনে মাধুর্যকে ভালোবাসার কথা বলতে চায়। সবাই জানবে সে এখনো তার প্রেয়সীকে ভালোবাসে। চিনতে পেরে গেছে তার ভাবনাকে। চেহারা বদলে তার কিছু যায় আসেনি। ভালোবাসার অনুভূতি তাকে বলে দিয়েছে, সে-ই তার ভাবনা।
কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে আসে মাধুর্য। অনুভব কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাধুর্য মিষ্টি করে ডেকে ওঠে….
–“শুনছেন?”
নড়েচড়ে উঠে তাকায় অনুভব। মাধুর্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে….
–“কিছু বলার ছিল আপনাকে।”
অনুভবের উত্তরের আগেই ওরা শুনতে পায় অনুভবের নাম ধরে ডাকছে তার বাবা। ওপরে প্রলয় সিনহা মাইক নিয়ে অনুভবকে ডেকে চলেছেন। মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে অনুভব ভরাট গলায় বলে…
–“আগে ওপরে যাই? তারপর কথা বলি?”
মাধুর্য মাথা ঝাঁকায়। তারা দুজন ওপরে উঠে আসে।

–“আজকের দিনটা বিশেষ দিন। কারণ শুধু বড় ডিল পাওয়ার জন্য নয়। আরেকটা কারণও রয়েছে। যেটা আমি এখুনি বলতে চাই। অনুভব মাই সন! কাম হেয়ার।”
বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে অনুভব। রায়মা এসে তার উদ্দেশ্যে বলে….
–“অনুভব বাবা! তোমার বাবা ডাকছে যাও।”
–“বাবা কেন হঠাৎ আমাকে ডাকছে মণিমা? কি এমন কারণ রয়েছে?”
রায়মা থতমত খায়। আসল কারণ জানতে পারলে অনুভবের রিয়েকশন কি হবে তা নিয়ে সেও চিন্তিত। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে….
–“তা তো গেলেই জানতে পারবে।”
অনুভব এক পলক মাধুর্যের হাসিমাখা চেহারার দিকে তাকিয়ে প্রলয় সিনহার কাছে যায়। প্রলয় হেসে বলেন….
–“আমার একমাত্র ছেলে। অনুভব সিনহা। যার বিয়ে দিতে চলেছি খুব তাড়াতাড়ি। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে আমরা মেয়েও ঠিক করে রেখেছি।”

সবাই খুশিতে হাত তালি দিতে শুরু করে। সেখানে উপস্থিত অনুভবের বন্ধুরা সিটি বাজাতে লাগে। আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে যেন। এই আনন্দ যেন একজনের জীবনে হয়ে আসে দুঃখ হিসেবে। মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায় মাধুর্যের। এলিনা এসে মাধুর্যের পাশে দাঁড়ায়। এলিনা নিজেও অবাক। অনুভব তাকে বলেছিল মাধুর্যের ব্যাপারে। মাধুর্যের চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। চোখে পানি টলটল করছে তার। বুকের মাঝে ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। যেই ঝড়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে মাধুর্যের মন। এলিনা তার কাঁধে হাত রাখতেই চোখের পানি লুকিয়ে ফেলে সে। হাসতে চাইছে মাধুর্য। কিন্তু হাসি আসছে না। চোখের সামনে অনুভবকে নিয়ে সাজানো স্বপ্ন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
–“মাধুর্য, ঠিক আছো?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাধুর্য থেমে থেমে বলল….
–“এজন্যই বোধহয় বলে জানো তো? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। ভেঙে গেলে খুব কষ্ট হয়।”
কষ্টে ভার হয়ে আসে মাধুর্যের নিশ্বাস। তাহলে কি ভুল ছিল অনুভবের সঙ্গে কাটানো মূহুর্তগুলো? এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলে আস্তেধীরে বেরিয়ে আসে মাধুর্য।

চলবে…..??

#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১
হঠাৎ এক বিকট শব্দে চমকে তাকায় সবাই অনুভবের দিকে। চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠো করে নিজের ডান পা ফ্লোরে রাখে অনুভব। তার পেছনে থাকা কাঁচের রেলিং বেশ এলোমেলো ভাবে ভেঙে নিচে পড়ে গেছে। পা দিয়ে রাগের চোটে কাঁচ ভেঙে ফেলেছে অনুভব। কপালের রগ দপদপ করে জ্বলছে ওর। প্রলয় সিনহা নিজেই ছেলের এতো ভয়ানক হিংস্র রুপ দেখে ভয় পেয়ে যান। মূহুর্তের মাঝেই আবারও একটা কাজ করে বসে অনুভব। তার বাবার হাত থেকে মাইক্রোফোন ছো মেরে কেঁড়ে নেয় সে। রাগে নিজের আসল রুপ ধারণ করতে চলেছে সে। চোখের মনি সবুজ হয়ে আসছে তার। বিষয়টা বেগতিক দেখে প্রলয় তার ছোট ভাই প্রনয়কে ইশারা করেন যেন প্রনয় গেস্ট দের নিয়ে গিয়ে নিচে খেতে দেয়। প্রনয় দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টা সামলান।
অনুভব নিজের সবুজ চোখজোড়া দিয়ে খুঁজতে থাকে তার মাধুর্যকে। পায় না তার চোখজোড়া। এলিনাও নেই। মাধুর্যের পেছন পেছন বেরিয়ে গেছে সে। বিতৃষ্ণায় প্রকট হয়ে তাকায় নিজের বাবার দিকে।

টেরিসে শুধুমাত্র রয়ে গেল প্রলয়, রায়মা আর অনুভব। তাৎক্ষণিক, অনুভবের হাতে থাকা মাইক্রোফোনের সঙ্গে লেগে থাকা তার দাঁত বসিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলে একপাশে ফেলে দেয় সে। বৈদ্যুতিক বিভ্রাট হয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠে নিস্তেজ হয়ে একপাশে পড়ে রইল মাইক্রোফোন।
–“আমাকে না জানিয়ে, আমার মত না নিয়ে কার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছো তোমরা?”
রাগে থেমে থেমে প্রশ্নটা তার বাবার কাছে ছুঁড়ে দেয় অনুভব। প্রলয় বিষয়টা শান্ত ভাবে মিটমাট করতে চান। একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগেন….
–“অনুভব বিষয়টা হচ্ছে…. ”
কথাটা পরিপূর্ণ হতে দেয় না অনুভব। এবার চেঁচিয়ে বলে ওঠে….
–“নো এলিগ্যেশনস ড্যাড। আমি জানতে চাই কেন তুমি এমন করলে? তুমি জানো না তোমার ছেলে একজনের জন্য কতটা ব্যকুল? তুমি জানো না সেটা? কার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছো তুমি?”
–“দেখ অনুভব, শান্ত হ। এভাবে কেউ চিৎকার করে কথা বলে না। মেয়েটা ভালো। কবিতা নাম। ওর সঙ্গে বিয়ে করলে সুখি থাকবি তুই।”
অনুভব নিজেকে শান্ত করে রাখতে পারছে না। আর না পারছে কিছু করে নিজের রাগ কমাতে। কারণ সামনের মানুষটা তার বাবা।

অনুভব কান এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে….
–“সুখি? কীসের সুখি বাবা? যদি অন্যের সাথে আমি সুখি থাকতাম তাহলে নিজের ৪৯ বছরের অভিশপ্ত জীবন বেছে নিতাম না আমি। আমার ভাবনা চলে যাওয়ার পর অন্য কাউকে নিয়ে সুখি থাকতে পারতাম। কিন্তু ওকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগে বাবা। সেকারণেই সেই অভিশাপ আর সেই শাস্তি আমি মাথা পেতে নিয়েছি। আর আজ তুমি বলছো অন্যকাউকে বিয়ে করে নিতে?”
অনুভবের কথাগুলো গম্ভীর হলেও তার কথার ভয়াবহতা বেশ। যার কন্ঠে মেখে থাকে শীতলতার মেলা আজ তার কন্ঠেই রয়েছে আঁতকে ওঠার মতো হিংস্রতা। প্রলয় নিচ দিকে তাকিয়ে ওপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে শান্ত সুরে বললেন….
–“বেশ তাহলে শোন আমি তোকে কেন ভাবনার থেকে আলাদা করতে চাইছি। ধরে নিলাম, ভাবনাকে তুই খুঁজে পেলি। তারপর ওর আগের সব কথা মনে পড়ে তখন কি করবি? ও যদি তোকে তোর ভুলের জন্য তোকে মারার চেষ্টা করে? কি করবি তুই? ভুলে যাস না ওর শক্তি কতটা হতে পারে। আমি বাবা হয়ে আমার একমাত্র ছেলেকে মৃত্যু সঙ্গে কি করে ঘর করতে দেব?”

কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায় অনুভব। তার ভালোবাসার মানুষ তাকে মারার চেষ্টা করবে এটা তার কল্পনাতীত। অথচ তার বাবা কতদূর ভেবে ফেলেছে। পেছন মুড়ে রেলিংয়ে হাত লাগায় সে। ওর ধারালো নখগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে রেলিংয়ের ধারে বাড়ি মারতে থাকে। প্রলয় ভাবেন তার ছেলে হয়ত মেনে নিয়েছে তার কথা। তবে মূহুর্তেই তা ভুল প্রমাণিত হয়।
–“ভাবনা আমার কিছু করবে না বাবা। ও কিছু করতেই পারে না। আমি বিশ্বাস আছে ওর প্রতি।”
–“শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরে তো তোকে ছেড়ে দিতে পারি না। আমার শেষ কথা, তুই কবিতাকেই বিয়ে করবি।”
আবারও চিৎকার করে ওঠে অনুভব। সামনে ফিরতেই ওর কানে বাজে ‘কবিতা’ নামটি। চিৎকারটা থেমে যায় তার। অবাক সুরে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে…..
–“কবিতা? এই নামটা আমি আগেও কোথাও শুনেছি। কোথায় যেন!”
চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে অনুভব। সেকেন্ডেই মনে পড়ে কবিতা মাধুর্যের বেস্টফ্রেন্ডের নাম। চোখ বড় বড় করে তাকায় সে। মনে মনে প্রার্থনা করে, যাতে এই কবিতা সেই কবিতা না হয়। প্রলয় এসে অনুভবের কাঁধে হাত রাখেন। ভার গলায় বলেন….
–“আমার কথা শোন। তোর খারাপ হবে না। তোর বাবা তোর খারাপ চায় না।”

রাগে কটমট করে কাঁধ থেকে হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় অনুভব। বলতে নেয়, সে তার ভাবনাকে পেয়ে গেছে। মুখ খুলতেই আবারও চুপ হয়ে যায়। ভাবতে থাকে এখন যদি সে এই বিষয় জানায় তবে মাধুর্যকে আরো দূরে করে দেবে তার থেকে। হিতে বিপরীত হতে পারে।
–“আমি এখন বিয়ে করব না মানে করব না। তুমি আমাকে জোর করতে পারো না।”
–“অনুভব!!!”
ছেলের সঙ্গে পেরে ওঠেন না উনি। রায়মাও চেষ্টা করে অনুভবকে বোঝাতে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। একসময় বাধ্য হয়ে প্রলয় জোর গলায় বলেন….
–“তোর মরা মায়ের দিব্যি অনুভব। বিয়েটা তোকে করতে হবে।”
থমকে যায় অনুভব। ছলকে ওঠে তার চোখজোড়া। শুকনো গলায় বলে ওঠে….
–“ড্যাড!”
–“তুই বাধ্য করলি আমাকে। আমি এমনটা বলতে চাইনি।”
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনুভব। তার চোখের সামনে ফুটে ওঠে মাধুর্যের হাসিমাখা চেহারা। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে তার পাশে থাকা মিউজিক বক্সটাকে পা দিয়ে লাথি মারতেই তা ছিটকে গিয়ে অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। চোখের পলকে নিচে নেমে যায় সে। যাওয়ার আগে প্রলয়কে বলে যায়….
–“ঠিক করলে না তুমি।”

ফার্মহাউসের খোলা বারান্দায় একমনে দাঁড়িয়ে আছে মাধুর্য। তার চোখে নেই ঘুম নামের কোনো বস্তু! অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আকাশের তাঁরাগুলোর দিকে। মিটমিট করে জ্বলছে তারা। কি সুন্দর না লাগছে। একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আনমনে বলে….
–“রাতের এই অন্ধকারে ঢাকা আকাশটাকে আলোকিত করবার জন্য রয়েছে তাঁরা আর একটা সুন্দর চাঁদ। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আমার এই অন্ধকার জীবনটা আলোকিত করার জন্য কেউ নেই।”
মাধুর্য খেয়াল করে তার গলা ভিজে যাচ্ছে। চোখের নিচে হাত রাখতেই বুঝতে পারে তার অশ্রু তার গলা ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। তার পরনে এখনো সেই অনুভবের দেওয়া বেগুনি গাউন। চোখের ওপর হাত রেখে নিজের ওপরেই নিজের মায়া হয় মাধুর্যের। চোখ থেকে পড়া পানির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে….
–“আর কত পড়বি তোরা? ছোট থেকে তো পানি ঝরেই যাচ্ছে চোখ থেকে। এর কি বিরতি নেই? সবেমাত্র ভালোবাসা কি জিনিস বুঝতে শিখেছিলাম। বুঝেছিলাম, ভালোবাসা কোনো রুপকথার শব্দ নয়। এর বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে। কিন্তু কি হলো? এই ভালোবাসার বিনিময়ে বাম পাশে থাকা ছোট্ট মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।”

নিজের সঙ্গে কথা বলার মাঝেই ব্যাঘাত ঘটে এলিনার ডাকে।
–“মাধুর্য!”
–“আমি তো তোমাকে বললাম আমাকে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দাও। প্লিজ এলিনা!”
এলিনা তার দিকে ফোন এগিয়ে দেয়। দম নিয়ে বলে….
–“তোমার ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছিল। থামার নাম নিচ্ছিল না। তাই নিয়ে এলাম।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নেয় মাধুর্য। কিছুক্ষণ আগে বিভোর ফোন করেছিল তাকে। বিভোর কাজের জন্য বাইরে গেছে। নয়ত আজ মাধুর্যের জন্মদিনে আসত। সামিহাকেও তার মা আসতে দেয়নি। হয়ত তাদের মাঝেই কেউ হবে। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই কবিতার নাম দেখে ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে মাধুর্য। আবারও নিজ ছন্দে বেজে ওঠে তার ফোনের রিংটোন।

গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কবিতার উচ্ছ্বসিত সুর ভেসে আসে। কবিতা পাগলের মতো গান গাইছে। যেন সে খুশিতে আত্মহারা!
–“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।”
মাধুর্যের সবকিছুতে অস্থির লাগছে। পুরো মন ভরে গেছে বিষে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়েছে আজ। দুর্বল গলায় বলে ওঠে….
–“বেশ খুশি মনে হচ্ছে। কাহিনী কি কবিতা? তোর কবি পেয়ে গেলি নাকি?”
কবিতা গান বন্ধ করে। তার মনে খেলছে উথাল-পাতাল ঢেউ। খুশি খুশি মনে বলে…..
–“তেমনই কিছু। আমার মনের মানুষ হতে চলেছে আমার ক্রাশ। এটা কি খুশির খবর নয় মাধু?”
মাধুর্য না বুঝেই আলতো হাসে। তার জীবনে না হোক তার বন্ধুর জীবনে পছন্দের কেউ তো মিলছে!
–“তোর তো ক্রাশের অভাব নেই। তা কোন ক্রাশের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে?”
–“আমার সব থেকে বড় ক্রাশ। যে আমার পুরো হৃদয় দখল করে নিয়ে বাকি ক্রাশ দের ছিটকে ফেলে দিয়েছে। দ্যা ওয়ান অ্যান্ড অনলি অনুভব সিনহা।”

ধক করে ওঠে মাধুর্যের বুকের ভেতরটা। মনের মাঝে কি বিষাক্ত ছুরি বিঁধে যাওয়ার কষ্ট কম পড়েছিল যে এবার অন্য আরেক বিষাক্ত ছুরি এসে মনে বিঁধে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল? হাতে থাকা ফোন কাঁপতে থাকে অনবরত। শুষ্ক চোখ থেকে বেয়ে পড়ে আবারও অশ্রু। যা এসে থামল মাধুর্যের চিকন ঠোঁটে কাছে।
–“হ্যালো! মাধু। কি হলো? শুনতে পাচ্ছিস?”
নিজের ফোন নাড়াতে নাড়াতে বলে কবিতা। সে কি জানে তার ছোট বেলার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর মনে কতবড় বিদ্রোহ চলছে? সে কি জানে তার বেস্টফ্রেন্ডের থেকে সে প্রিয় মানুষটাকে কেঁড়ে নিয়ে ফেলছে? জানে না কবিতা। সেকারণেই হয়ত বড়মুখ করে কলটা করেছে কবিতা। মাধুর্য নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না। কোনো বাঁধা মানছে না তার দুচোখ। ঢক গিলে সে বলে…..
–“ওহ। খুব ভালো। অ…অবশেষে বিয়ের বাজনা বাজলো তোর।”
–“হুমম জানিস আমি তো ভেবেছিলাম এই ক্রাশকেও কাছে পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না। কিন্তু জানতাম না ক্রাশের ফ্যামিলি নিজে আমাকে পছন্দ করে যাবে। আমি তো তাকে প্রথম দেখাতেই একদম ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখেছি জানিস?”

কবিতা নিজের আনন্দের চোটে খেয়ালই করেনি মাধুর্য কন্ঠে রয়েছে যন্ত্রণা। হঠাৎ মাধুর্যের মনে প্রশ্ন জাগে।
–“আচ্ছা, অনুভব কি রাজি বিয়েতে?”
–“হ্যাঁ। একটু আগেই ফোন দিয়ে বলল বিয়ে ফাইনাল। তারা নাকি যত তাড়াতাড়ি চায় এই বিয়েটা দিতে। সেকারণেই তোকে ফোন দেওয়া। শোন আমার বিয়েতে আমাকে তৈরি কিন্তু তোকেই করতে হবে মাস্ট বি!”
হাসফাস করছে মাধুর্য। একদিকে তার ভালোবাসা আরেকদিকে তার ছোট বেলার বন্ধুত্ব। এই দোটানায় এতো কষ্ট কেন? আস্তে আস্তে কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে ফেলে কল কেটে দেয় মাধুর্য কবিতার কোনো উত্তর না দিয়ে। লোহার রেলিংয়ে হাত রেখে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তবুও কষ্টের ভার কমছে না কিছুতেই। নিজের স্কার্ফের গলা হিচকি তুলে বলে…
–“কাঁদলে নাকি কষ্টের ভার কমে। আজ কেন কমছে না? এভাবে পাথরের সমান কষ্ট চেপে রাখলে তো মরে যেতে হবে। আমি তো ভেবেছিলাম অনুভব আমার জন্য এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে। যেমনটা আমি করি। সব ভাবনা সত্যি হয় না তা প্রমাণ করে দিলেন অনুভব। আপনার সঙ্গে কাটানো সব মূহুর্ত হয়ত আমার কাছে বিশেষ ছিল আপনার কাছে নয়।”

যেমনটা মাধুর্যের মনের কোণে কালো মেঘ জমেছে। তেমনই হঠাৎ করেই আকাশেও কালো মেঘ জমতে থাকে। তাঁরাগুলো ঢেকে যায়। আজ আকাশও মাধুর্যের একাকীত্বের সঙ্গ দিতে চায় যেন। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। মুখ উঠিয়ে বাড়িয়ে দেয় বাইরের দিকে মাধুর্য। বাতাসে বাঁকা হয়ে বৃষ্টি পড়ায় ভিজে যাচ্ছে মাধুর্য। এলিনা সবটাই শুনছিল দাঁড়িয়ে থেকে। মেয়েটার কষ্টে খারাপ লাগল ওর। সে যদি কিছু করতে পারত! কিন্তু আফসোস কিছু করবার মতো সুযোগও তো পাবে না। কোথায় সে সাধারণ ভ্যাম্পায়ার আর কোথায় ভ্যাম্পায়ার কিং প্রলয়। বৃষ্টি শুরু হতেই মাধুর্যকে সে ভিজতে দেখে দ্রুত কাছে এসে বলে….
–“এখানে এসো মাধুর্য। ভিজে যাচ্ছো তো। রাতদুপুরে ভিজলে জ্বর আসবে।”
–“আসুক। আমি ভিজতে চাই। তুমি যাও।”
–“অনুভব আমাকে বকবে মাধুর্য। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
মাধুর্য অদ্ভুত ভাবে হাসে।
–“আমার খেয়াল রাখতে কে বলেছে এতো? আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”
চেষ্টা করেও পারে না মাধুর্যকে ঘরে নিয়ে যেতে। না পেরে চলে আসে এলিনা।
ঘন্টা খানেক বৃষ্টিতে ভিজে নিজের বাইরের কষ্টের আবরণ ধুয়েমুছে ফেলে মাধুর্য। চুল কোনোরকমে মুছে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে।

রাত প্রায় ১ টার কাছাকাছি। রক্ত পান করে চোখ লাল করে এক ধ্যানে চেয়ে বসে আছে অনুভব। ওর কানে বার বার বাজছে তার বাবার বলা কথা।
–“তোর মরা মায়ের দিব্যি অনুভব। বিয়েটা তোকে করতে হবে।”
চোখ বন্ধ করে মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেস লাগিয়ে বসে সে। নির্বিকার হয়ে বলে ওঠে….
–“আমার এই ৪৯ বছর অপেক্ষা করা আবারও বৃথা যাবে। কাছাকাছি এসেও মিলতে পারব না আমরা। ভাগ্য সবসময় আমার সাথে নিষ্ঠুর খেলা খেলতে থাকে। আমাদের #অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা কে পূর্ণ করার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা মূহুর্তেই ড্যাডের এক সিদ্ধান্তে শেষ হয়ে গেল।”
কোটের পকেট থেকে চকচকে রিংটা বের করে অনুভব। দুটো আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একসময় আংটি টা পড়ে যায় নিচে।অনুভব সেটা তোলে না। ফেলেই রাখে নিচে। পাশে থাকা ড্রেসিংটেবিলের ওপর ফোন স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। চোখ সেদিকে দিতেই দেখতে পায় এলিনা ফোন করেছে।

ফোনটা হেলেদুলে তুলতেই শোনা যায় এলিনার অস্থির কন্ঠ।
–“প্রিন্স, মাধুর্যের জানি না কি হয়েছে! শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে আমাদের মতো। তা সহ্য না করতে পেরে অনবরত কাঁপছে। বুঝতে পারছি না কি করব। ওর কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছে।”
অনুভব কোনোরকম উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেয়। কোট ঘাড়ের কাছে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যায় দরজা খুলে।
আধঘন্টা পর অনুভবকে দেখে চিন্তার রেশ খানিকটা হলেও কাটে এলিনার। দরজা খুলে দিতেই হুরমুর করে ঢুকে পড়ে বাড়িতে। একটা শব্দও না বলে সরাসরি ঢুকে যায় মাধুর্যের ঘরে। চাদর মুড়ি দিয়ে অস্পষ্ট ভাষায় কিছু একটা বলছে মাধুর্য। মাধুর্যের পাশে বসে তার কপালে হাত রাখতেই পিটপিট করে তাকায় মাধুর্য। তার চোখ দিয়ে সবটা ঘোলাটে দেখছে সে। কিন্তু অনুভবের অস্তিত্ব চিনতে একটুও ভুল হয়নি তার। অন্যদিকে ফিরতেই অনুভব মাধুর্যকে আধশোয়া করে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। তাও যদি মেয়েটার কাঁপুনি কমে। তবে অনুভবের শরীরও বেশ ঠান্ডা। হবে না-ই বা কেন! সেও তো ভ্যাম্পায়ার। একটু একটু করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে একসময় বৃথা যায় সব। অনুভবের বুকেই ঢলে পড়ে মাধুর্য।

এলিনা মাধুর্যের হাত-পায়ে মালিশ করছিল। চিন্তিত হয়ে অনুভবকে বলে ওঠে….
–“কি হয়েছে ওর প্রিন্স কিছু বুঝতে পারলেন? ও ঘন্টাখানেক বৃষ্টিতে ভিজেছে। মানা করার পরেও শোনেনি। কিন্তু ওর তো জ্বর আসেনি। এলে শরীর গরম থাকত। এখানে তো পুরো উল্টো বিষয় হচ্ছে। শরীর আমাদের মতোই বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
অনুভব মাধুর্যের চোখের কাছের চুল সযত্নে সরিয়ে দেয়। ভবঘুরে হয়ে বলে….
–“মাধুর্যকে এই ঠান্ডা সহ্য করতে হবে এলিনা। আস্তে আস্তে ওর আসল রুপ বেরিয়ে আসছে। পরিপূর্ণ ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হচ্ছে। তাই আমাদের মতো ওর শরীর ঠান্ডা থাকবে স্বাভাবিক। ওকে সহ্য করতে হবে এই ঠান্ডা। আমার কিছু করার নেই।”

চলবে….??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here