#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#২২,২৩
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২
চারিদিকে আযান পড়ছে। ভোরের আলো এখনো ফোটেনি। একটু নড়েচড়ে ওঠে মাধুর্য। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় চোখমুখ কুঁচকে যায় তার। কেউ তাকে জোরে চেপে ধরে আছে সেটা বুঝতে পারে সে। তাকে জড়িয়ে থাকা মানুষটির বুকে হাত রেখে সরে আসতে চায় মাধুর্য। কিন্তু মানুষটি বোধহয় তাকে ছাড়তে চায় না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করে মাধুর্য। নিজের ফোলা ফোলা চোখে তাকাতে সক্ষম হয় সে। মাথা উঠিয়ে অনুভবকে দেখে চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায় তার। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেও পারে না। অনুভব তার হাতের দুটো বাঁধন দিয়ে সুন্দর করে ধরে দেয়ালে ঠেস লাগিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত চেহারা দেখে বড্ড মায়া হলো মাধুর্যের। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল অনুভবের কপাল। হাতটা বাড়িয়ে নিয়ে যায় মাধুর্য অনুভবের গালের দিকে। গালে যখন হাত রাখতে যাবে তখনই মনে পড়ে গতকাল রাতের কথা। নামিয়ে নেয় নিজের হাত। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে ছাড়াতে।
মাধুর্যের নড়াচড়াতে ঘুমে বিঘ্ন ঘটে অনুভবের। ঘাড় এপাশ-ওপাশ ঘুড়িয়ে খানিকটা চমকে চোখ খোলে সে। ওর হাতের বাঁধন আলগা করার শত চেষ্টা করে চলেছে মাধুর্য। তাকে কষ্ট করতে না দিয়ে অনুভব নিজেই খুলে দেয় হাতটি। মাধুর্য দুই হাত দূরে গিয়ে হাত দিয়ে ভর রেখে বসে অনুভবের দিকে তাকায়। চোখজোড়া গাঢ় লাল হয়ে গিয়েছে লোকটির। মুখটা লাগছে শুকনো শুকনো। গোলাপি আভায় আবৃত ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নেয় মাধুর্য। তার আর কোনো অধিকার নেই মানুষটাকে এতো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার। গলা খাঁকারি দিয়ে সে বলে ওঠে….
–“আপনি এখানে এইসময়?”
অনুভব নিজের শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ায়। ঘুম জড়ানো গলায় বলে ওঠে…..
–“কাল রাতে এলিনা আমাকে ফোন করেছিল। তুমি রাতে ভীষণ কাঁপছিলে। তাই এসেছি।”
–“কিন্তু এভাবে আমাকে জড়িয়ে রাত কাটিয়ে দেওয়া বিষয়টা বেশ আপত্তিকর অনুভব। আপনি পারতেন সামিহা আপুকে ফোন করতে।”
মাধুর্যের কন্ঠে গম্ভীরতা। তার উদ্ভট ব্যবহারে বিস্মিত চোখে তাকায় অনুভব।
–“এমন করছো যেন আগে আমরা একসঙ্গে সময় কাটাই নি।”
আবারও মাধুর্য পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেয়….
–“আগের কথা আর এখনকার কথায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমার বেস্টফ্রেন্ড কবিতার সাথে। আমি চাই না ও কোনোরকম ভাবে আমাকে ভুল বুঝুক। তাই জন্যই বলছি আগের কথা আর এখনকার কথা অনেক আলাদা।”
চোখ বড় বড় করে তাকায় অনুভব। ও যা ভেবেছিল অবশেষে তাই হলো। কবিতায় সে যার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তবে মাধুর্যের অদ্ভুত ব্যবহার মানতে পারছে না সে। তার বলা প্রত্যেকটা কথা অনুভবের মস্তিকে আঘাত হানে। কিন্তু কি করবে সে? কিছু কি করার আছে? ও পারবে না অন্য কাউকে বিয়ে করতে। অনুভবের বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার মনের কথাগুলো। তার সামনে থাকা প্রেয়সীকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে….
–“কি করব আমি? আমাকে কোনো পথ দেখাও মাধুর্য। এভাবে আমি বাঁচতে পারব না। শুনেছি, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সবটা কেন ব্যতিক্রম হচ্ছে? কি দোষ করেছি আমি?”
হাহাকারে ভরে আসে অনুভবের ভেতরটা। ধীর গলায় বলে…..
–“আমি আসছি।”
নিজের গতিতে বেরিয়ে যায় অনুভব। মাধুর্য স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। সবটা হাতে বাইরে চলে গেছে। কিছু করার নেই। শান্ত হয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে সে।
নামাজ সেরে বাইরে আসতেই মাধুর্য খেয়াল করে ওর হাত-পা হার হিম করা ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। নিজের গলা মুখে হাত রাখে মাধুর্য। তার পুরো শরীর একইরকম ঠান্ডা। যেন সে কোনো সাধারণ মানুষ নয়। কোনো আস্ত বরফ। বেশ খানিকটা চিন্তিত হয়ে বাইরে লিভিং রুমে আসে মাধুর্য। এলিনা সবে মাত্র নামাজ পড়ে সোফায় বসেছে। মাধুর্যকে দেখে প্রশ্ন করে ওঠে….
–“এখন কেমন লাগছে তোমার?”
–“হুমম ভালো। কালকে কেন অনুভবকে ডেকেছিলে এলিনা? ডাকার দরকার ছিল না।”
মাধুর্য বিক্ষিপ্তভাবে কথাটা বলতেই আমতা আমতা করতে শুরু করে এলিনা।
–“একা কি করব বুঝতে পারিনি। তাই….”
–“যদি বুঝতে না পারতে তাহলে আমাকে সেভাবেই রেখে দিতে। আমি তো ঠিক হয়েই গেছি। এমনিই ঠিক হয়ে যেতাম।”
মাধুর্যের কন্ঠে এক পাহাড় সমান অভিমান এবং কষ্ট বুঝতে দেরি হলো না এলিনার। কোনো জবাব না দিয়ে মাধুর্যের মুখের দিকে নির্বিকার ভাবে চেয়ে রইল সে।
অফিসের কেবিনে ফোন নিয়ে পায়চারি করেই চলেছে অনুভব। তার চোখেমুখে অস্থির ভাবটি ফুটে উঠেছে। ফোন অন করে অনেক ভাবনাচিন্তা করে কল করে কবিতার নম্বরে। গতকাল কবিতা নিজে থেকে তাকে ফোন করেছিল মাধুর্য কোথায় থাকে তা জানতে। অনেক খুঁজে খুঁজে সে পেয়েছে কবিতার নম্বর। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে অনুভবের। ওপাশ থেকে কল রিসিভড হয়। তড়িঘড়ি করে অনুভব বলে ওঠে….
–“হ্যালো? কবিতা বলছো?”
ওপাশে কবিতার হাত কাঁপছে। যতই হোক মানুষটি এখন ওর হবু বরে পরিণত হয়েছে। লজ্জা পাওয়া স্বাভাবিক। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে….
–“জ্বি!”
–“শুনলাম তুমি বিয়েতে রাজি। তুমি মন থেকে রাজি?”
–“জ্বি। আমার বাবা নেই। অনেক আগেই আমার মাকে ছেড়ে চলে গেছেন অন্য কারো হাত ধরে। মা-ই আমার সব। মা আপনাকে যথেষ্ট পছন্দ করেছেন। আমিও রাজি।”
অনুভব বিরক্তির শ্বাস ছাড়ে। কবিতা নামক মেয়েটির ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। নিজে রাজি বললেই হলো। অন্যদিকে ছেলে মন থেকে রাজি কি না তা জানতে চাওয়ার কোনো হেলদোল নেই। চাপা গলায় অনুভব বলতে নেয়….
–“ওকে। তুমি রাজি কিন্তু আমি রাজি কি না তা জানার চেষ্টা করছো কখনো?”
–“আপনি রাজি। সেটা তো কাল জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল না? চেষ্টা করতে যাব কেন?”
অবাক সুরে বলে ওঠে কবিতা। তখনই অনুভবের কেবিনে প্রবেশ করেন প্রণয়। অনুভবের কথাবার্তা শুনে মনে হলো সে কবিতাকে বেফাঁস কিছু বলতে চলেছে। দ্রুত গিয়ে আচমকা ফোনটা অনুভবের থেকে কেঁড়ে নিয়ে কল কেটে দেন প্রণয়। রাগে কটমট করে পেছন ফিরে তাকায় অনুভব। নিজের চাচ্চুকে দেখে জোরে বলে ওঠে….
–“চাচ্চু! ফোনটা কেঁড়ে নিলে কেন? আর কেবিনে ঢোকার সময় নক করে আসোনি কেন?”
–“কেন নক করে এলে ফোনটা কেটে দিতি আর আমি জানতে পারতাম না তুই কবিতাকে ফোন করেছিস। এটাই তো?”
বিষাদ মাখা মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে অনুভব। প্রণয় শান্ত কন্ঠে বলেন….
–“অনুভব, তোকে এই বিয়ে করতে হবে। তোর বাবা বলেছিল তো? তোর ভালোর জন্য বিয়েটা করতে হবে।”
–“তাহলে শুধু কবিতাকেই কেন চাচ্চু? তোমরা বোধহয় ভুলে যাচ্ছো কবিতা একজন মানুষ।”
–“মানুষ জন্যই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ ভাবনা কে তা আমরা আদোও জানি না। আর মানুষের ভালোবাসা পেলে তোর মাঝে যে শয়তান সত্তা রয়েছে তা বিলীন হতে পারে অনুভব।”
অনুভব চেঁচিয়ে বলল….
–“দরকার নাই শয়তান সত্তা বিলীন হবার। আমি চাই না কারো ভালোবাসা চাচ্চু। আমি শুধু একজনেরই ভালোবাসার কাঙাল ছিল আর আছি সে আমার ভাবনা। তার থেকে আমাকে দূরে করে দিচ্ছো। আই হেট ওল ওফ ইউ। প্লিজ গো!”
প্রণয় কিছু বলতে গিয়েও বলে না। এই ছেলে এখন কিছুই মানবে না নিজের কথা ছাড়া। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে আসেন উনি।
সময় জিনিসটা নদীর স্রোতের মতো। স্রোত যেমন সারাজীবন বহমান থাকে তেমনই সময়ের ক্ষেত্রেও তাই। সময় একবার পেরিয়ে গেলে তা হাজার সাধনা করেও ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। চোখের পলকেই কেটে গেছে আট দিন। রাত পেরোলেই বিয়ের বাজনা বাজবে মাধুর্যের ভালোবাসার মানুষটির এবং তার প্রিয় বান্ধবীর। নিজের ভাগ্যকে খুব সহজেই মেনে নিয়েছে মাধুর্য। সে বুঝে গিয়েছে ‘অনুভব সিনহা নামক মানুষটি তার ভাগ্যেই নেই।’
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছোট ছোট ধাপ ফেলে হাঁটছে মাধুর্য। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। আজ পূর্ণিমা। অফিস থেকে ফিরছে সে। কাল অনুভবের বিয়েতে ইনভাইটেশন পেয়েছে তার স্যার প্রলয়ের থেকে। তবে মাধুর্য ঠিক করেছে সে যাবে না। কারণ সে মেয়েপক্ষ। কবিতা ওর কাছে বায়না ধরেছে তাকে বউ সাজিয়ে অনুভবের সামনে মাধুর্যকেই নিয়ে যেতে হবে। মাধুর্যও মানা করতে পারেনি। চারিপাশে গাছের কারণে চাঁদ ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। যেই গাছপালার পর্ব শেষ হয় তৎক্ষনাৎ তার ওপর চাঁদের আলো পড়ে। এক অন্যরকম অস্বস্তি হতে শুরু করে মাধুর্যের। মাথা ঘুরে ওঠে তার। আজ সন্ধ্যা থেকেই ওর কেমন জানি লাগছে। এক অন্যরকম অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে। চাঁদের দিকে তাকায় সে। তার চোখ সবুজ বর্ণের হয়ে আসে। আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে তার হাত পায়ের রগ। হুট করেই বড় হয়ে যায় তার হাতের নখগুলো। ঠোঁটের দুদিকে বেরিয়ে আসে দুটো সরু ও চিকন দাঁত। হা করে মাধুর্য। কাঁধ থেকে পড়ে যায় ব্যাগ। অবাক করা বিষয় হচ্ছে আজ সবকিছুই ওর সঙ্গে সজ্ঞানে হচ্ছে। ও সব দেখতে পাচ্ছে। ভয়াতুর দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকায় মাধুর্য।
–“এ…এ কি হচ্ছে আমার সা…সাথে?”
নিজের গালে হাত বুলায় মাধুর্য। প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত অনুভব করে সে। গলায় হাত দেয়। নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে মাধুর্য। টলতে টলতে ঝোপের ভেতরে ঢুকে আসে সে। অস্পষ্ট চোখের সবকিছু ঝকঝকে এবং স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাত হওয়া সত্ত্বেও সবটা দেখতে পায় মাধুর্য। তার থেকে কিছু দূরে দেখতে পায় সেই রহস্যময় কুয়ো টা। যেই এগুতে নেবে তখনই পায়ের কাছে ভাঙা আয়নার টুকরো পায় মাধুর্য। নিজের চেহারা দেখতে হালকা ঝুঁকে পড়ে সে। নিজের এমন ভয়ঙ্করী রুপ দেখে আঁতকে ওঠে। কানে হাত রেখে বলে….
–“এটা আমি না। আমি এমন নয়। হতে পারি না এমন।”
চিৎকার দিয়েও সব সত্যিটা পাল্টায় না। সে আজ সজ্ঞানে আসল রুপে এসেছে। আজ থেকেই তাকে মেনে নিতে হবে সে একজন ভ্যাম্পায়ার। একটা সময় ভয়ানকভাবে হুংকার দিয়ে ওঠে মাধুর্য। তার হুংকারে কেঁপে ওঠে আশেপাশের পরিবেশ। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য কোনো কিছু না পেয়ে সেখানই ক্লান্ত হয়ে পড়ে মাধুর্য। একসময় গা এলিয়ে ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে।
এলিনা কোনোরকমে এনে মাধুর্যকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ে মাধুর্য। এলিনা বাইরে এসে অনুভবকে ইশারা করে। অনুভব মাথা নাড়িয়ে গাড়ি করে চলে যায়। নিজের রাজ্য থেকে কুয়োর মাধ্যমে বের হতেই অনুভবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গিয়েছিল অবচেতন মাধুর্যের দিকে। একপ্রকার ভয় পেয়ে দৌড়ে মাধুর্যের কাছে আসে অনুভব। দেখে ওর শ্বাস এখনো চলছে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় সে। তবে আন্দাজ করতে পারে মাধুর্য হয়ত নিজের রুপে আবারও এসেছিল। তাই ওকে সাবধানে ঘরে পৌঁছে দেয় অনুভব। তবে নিজে মাধুর্যের সামনাসামনি হবে না বলে আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করেনি সে। কারণ মাধুর্য তাকে এড়িয়ে চলে। সামনাসামনি হলেই বার বার চলে যেতে চায়। অনুভব ভেতর থেকে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে মাধুর্যের এই ব্যবহারে। মাঝে মাঝে তার ভালোবাসার মানুষের কোলে মাথা রেখে মন খুলে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই অধিকার যেন ছেলেদের দেওয়া হয়নি। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। অন্তরে সবরকম যন্ত্রণা, কষ্ট চেপে রাখতে হয়। অনুভবও সবটা চেপেই রাখছে ভেতরে। তবে এখনো একটা ক্ষীণ আশায় বেঁচে আছে সে। বিশ্বাস করছে তার নিষ্ঠুর ভাগ্যের ওপর। ভাগ্য তাকে ফেরাবে না।
আধো আধো ভাবে চোখ মেলে মাধুর্য। নিজের ভয়ঙ্কর রুপ মনে পড়তেই মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠে বসে সে। সেই চিৎকারে হন্তদন্ত হয়ে হাতে একটা গ্লাস নিয়ে ঘরে আসে এলিনা।
–“তোমার জ্ঞান ফিরেছে? কেমন আছো এখন?”
এলিনাকে দেখে গুটিশুটি হয়ে বসে পড়ে মাধুর্য। তার মস্তিষ্কে একটা কথায় ঘুরতে থাকে, সে সাধারণ মানুষ নয়। সে ভয়ানক কোনো প্রাণী। এলিনার থেকে তার দূরে থাকতে হবে। এলিনা ভ্রু কুঁচকায়। ক্ষীণ গলায় বলে….
–“কি হয়েছে? এমন করছ কেন? ঠিক আছো তো?”
–“হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।”
থেমে থেমে জবাব দেয় মাধুর্য। এলিনা তার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে….
–“এই নাও এটা খেয়ে নাও। ভালো লাগবে। এটা তোমার দরকার।”
দ্রুত গ্লাস নিয়ে মাধুর্য এলিনাকে ইশারা করে।
–“হুহ। খেয়ে নেব। যাও।”
এলিনার বিষয়টা অদ্ভুত লাগে। তবে প্রকাশ করে না। গ্লাসে অনুভব কিছুটা রক্ত মেশাতে বলেছিল শরবতের সঙ্গে। যার কারণে শরবতের রঙ লাল হয়েছে। অনুভবের ধারণা মাধুর্য অতিরিক্ত রক্তের পিপাসার কারণে নিজের আসল রুপে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তাই এলিনাকে সেই কাজটা করতে বলেছে সে।
শরবত হাতে নিয়ে প্রথমে নাক শিটকায় মাধুর্য। এক মূহুর্তেই শরবতের মধ্যে থেকে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ আসতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। এক ঢকে খেয়ে ফেলে সমস্ত রক্ত মেশানো শরবত। মিটে যায় তার তৃষ্ণা। অনুভব করে এক তৃপ্তি। উঠে দাঁড়ায় সে। মনে হয় অনুভবের কথা। কাল ওর বিয়ে। সবটা কেমন জানি শুরুতেই ভেঙে গেল। আয়নায় সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নিজের চোখমুখে হাত বুলিয়ে আপনমনে বলে….
–“কি আমি? কি আমার আসল পরিচয়?”
চলবে…..??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩
মেসেজের টোন বেজে উঠতেই আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বেডের ওপর পড়ে থাকা ফোনের দিকে। ফোনের লাইট একবার জ্বলে উঠছে একবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। না চাওয়া সত্ত্বেও একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে ফোনটা হাতে তোলে মাধুর্য। ‘অনুভব’ নামটি দেখে হৃদয়টা এক মূহুর্তে শীতল হয়ে যায় মাধুর্যের। হার্টবিট ফাস্ট চলতে শুরু করে। মানুষটিকে সে যতই ইগনর করতে চাইছে যেন ততই তার সমস্ত জুড়ে জায়গা দখল করছে। কিছুক্ষণ স্থির থেকে মেসেজ ওপেন করে মাধুর্য।
–“আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। এখন এবং এই মূহুর্তে। যদি তোমার ইচ্ছে হয় তবে সেই নদীর ধারে চলে এসো। যেখানে আমাদের অনুভূতি প্রগাঢ় হয়েছিল।”
মেসেজটা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মাধুর্য। মাথায় আসে হাজারো চিন্তাভাবনা। মাধুর্যের ধারণামতে তো অনুভব মানুষ। সে একটা প্রাণী। যতদূর তার মনে হয়েছে সে একজন ভ্যাম্পায়ার। যার সঙ্গে মানুষের কখনোই মিল হওয়া সম্ভব নয় হয়ত।
সব ভাবনা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলল মাধুর্য। মাথা চেপে ধরো ভাবতে থাকল শুধুমাত্র অনুভবের কথা। সে অনুভবকে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে। আজকে যখন লোকটা তাকে ডেকেছে তখন তার যাওয়া উচিত। হয়ত এটাই তার সঙ্গে শেষ দেখা। নিজেকে শান্তনা দিয়ে মাধুর্য বেরিয়ে পড়ে অনুভবের সঙ্গে দেখা করতে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, তার জীবনে রয়েছে শুধুই তিক্ততা! নেই কোনো মিষ্টত্ব। এমন জীবনও কারো হয়? যেখানে এক চিলতে সুখ থাকলে পরবর্তীতে হাজারো কষ্ট এসে ভীড় জমায়….!
আনমনে চলতে চলতে কখন যে মাধুর্য নদীর পাড়ে পৌঁছায় সে নিজেই জানে না। তবুও কাটে না তার চিন্তার রেশ।
নদীর পাড়েই গাছে ভর দিয়ে এক পা গাছে ভাঁজ করে রেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল অনুভব। তার কানে আসে কারো পায়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ। অর্ধেক ভেঙে যাওয়া মনটা জানান দেয়, যার অপেক্ষায় সে প্রহর গুনছিল সেই মানুষটা এসেছে। চোখ খুলে পাড়ের ওপরে তাকায় সে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক চাঁদপানা মুখ। মাধুর্যকে অনবরত হাঁটতে দেখে ভরাট গলায় তাকে ডাক দেয়।
–“মাধুর্য!”
ভাবনার রেশ কেটে যায় মাধুর্যের। ওপরে থাকা চাঁদটাও প্রভার ফেলছে তার ওপর। সে বুঝতে পারছে তার চোখ বার বার রঙ পাল্টাচ্ছে। নিজের মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকায় মাধুর্য। চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পায় তার প্রিয় মানুষটিকে। মনে অনেক দ্বন্দ্ব নিয়ে পাড়ের নিচে নামে মাধুর্য। অনুভব তার সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাধুর্যের ভেতরটা কেঁপে ওঠে অনুভবকে দেখে। মনে একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, লোকটা কি ঘুমোয় না?
অনুভবের চোখদুটো অসম্ভব লাল হয়ে রয়েছে। মাথার চুল নেই পরিপাটি। সবসময় খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রাখার অভ্যেস তার। তবে দাঁড়ি আগের থেকে বেশ বড়সড় হয়ে গিয়েছে। এতোদিন অনুভবের দিকে ঠিকমত তাকায়নি মাধুর্য তাই এসব পরিবর্তন তার খেয়ালেও আসেনি। আজ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। শুকনো কেশে মাধুর্য প্রশ্ন করে….
–“কেন ডেকেছেন? কোনো কাজ ছিল?”
–“কাজ তো অনেক রয়ে গেছে মাধুর্য। সেসব কাজ শেষ করার সুযোগ টুকুও তো পেলাম না।”
ঘন চোখের পাপড়ি বার বার নড়তে থাকে মাধুর্যের। অনুভবের এসব প্যাঁচানো কথাবার্তার আগামাথা খুঁজতে থাকে সে। দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে যায় তাদের দুজনকে। দুজন শুনতে পায় দুজনেরই নিঃশ্বাসের শব্দ। দুজনের নিঃশ্বাস প্রচন্ড ভারি। প্রতিটা নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে যেন কষ্টগুলো উপচে পড়ছে। মাধুর্য এবার স্পষ্ট ভাষায় বলে….
–“কি বলতে চাইছেন? কাল আপনার বিয়ে। আপনার এভাবে দেখা করতে আসা ঠিক হয়নি। আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। অনেক রাত হয়েছে। বাড়ি ফিরতে হবে।”
–“আমার বিয়েতে কি তুমি খুব খুশি??”
–“আমার খুশি বা অখুশি বিয়েতে কি কোনো প্রভাব ফেলে?”
অনুভব আচমকা মাধুর্যের হাতজোড়া ধরে নিজের বুকের ওপর রাখে। থতমত খেয়ে তাকায় মাধুর্য। মানুষটা তাকে যেকোনো মূল্যে দুর্বল করতে চায়।
–“আমি আর পারছিনা। চলো আমরা পালিয়ে যায়! যেখানে কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের।”
অনুভবের কথায় একটা বাচ্চাদের মতো জেদ খুঁজে পেল মাধুর্য। তবে মাধুর্যের তো তার এই বাচ্চামিতে সাথ দিলে চলবে না। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে নেয় সে।
–“আপনার বোঝার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে অনুভব। আপনাকে এসব মানায় না। আপনিও জানেন আপনাকে কবিতাকে বিয়ে করতে হবে। আমিও জানি।”
অনুভব দেখে তার নিষ্ঠুর মাধুর্যকে। হ্যাঁ, মেয়েটা আগের থেকে অবশ্যই নিষ্ঠুর হয়েছে। নয়ত তাকে অবজ্ঞা কি করে করতে পারে? অনুভব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে….
–“কিন্তু আমি তো কবিতাকে কখনোই সুখি রাখতে পারব না। আমি তোমাকে….”
কথায় মাঝেই থামিয়ে দেয় মাধুর্য অনুভবকে। সে শুনতে চায় না সেই কথা। সে দ্রুত গতিতে অনুভবের দিকে ফিরে বলে ওঠে….
–“বলবেন না এই কথা। প্লিজ! আমি আর সেই কথা শুনতে চাই না যেই কথা আপনি বলতে চাইছেন। আপনার মনের কথা আমার লোমকূপে অবধি শিহরণ জাগাতে পারে। আর এর ফল হতে পারে, নিজের পুরোনো বন্ধুকে ধোঁকা দেওয়া। যেটা আমি চাই না।”
–“কবিতা বলেই কি তুমি স্যাক্রিফাইজ করছো?”
–“জানি না। আমি কিছু জানি না। আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না দোহায় লাগে!”
বিদ্যুতের গতিতে উধাও হয়ে যায় মাধুর্য। অনুভব তাকে আটকাতে গিয়েও পারে না। চোখ বন্ধ করে গাছে হাত দিয়ে আঘাত করে সে। সবটা হয়ে গেল এলোমেলো!
পরেরদিন….
সামিহা এসেছে আজ মাধুর্যের কাছে। সেই সঙ্গে বিভোরও এসেছে। আজকে কবিতার বিয়েতে তারাও ইনভাইটেশন পেয়েছে। তবে প্রথমে এসেছে মাধুর্যের কাছে। সামিহা যখন থেকে এসেছে মাধুর্যকে দেখেই যাচ্ছে সে। তার শুকনো চোখমুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করেই ফেলে সামিহা।মাধুর্য রান্নাঘরে সামিহার জন্য কোল্ড কফি আর বিভোরের জন্য ব্ল্যাক কফি বানাচ্ছে। এই বাহানায় সামিহাকে এড়িয়ে যাচ্ছে ও। কারণ সে জানে ওর আপু কিছু একটা ধরেই ফেলবে। আজ বাড়িতে এলিনা নেই। অনুভবের বিয়েতে না চাইতেও তাকে সেখানে থাকতে হচ্ছে।
কফি বানিয়ে ট্রে তে নিয়ে বেরিয়ে এসে বেতের সোফার সামনের টেবিলে রাখে মাধুর্য। সামিহা মাধুর্যকে উদ্দেশ্য করে বলে….
–“আর কিছু লাগবে না। তুই এখানে এসে বস আমার পাশে।”
জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে সামিহার পাশে গিয়ে বসে মাধুর্য। সামিহা ভ্রু কুঁচকে দেখতে থাকে তাকে।
কফিতে এক চুমুক দিয়ে বলে….
–“মুখে একটা প্লাস্টিক হাসি ফুটিয়ে রেখে কি বোঝাতে চাচ্ছিস আমাকে বল!”
মাধুর্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তোতলানো গলায় বলে…
–“কি বলছো আপু? আ…আমি কি বোঝাতে যাব?”
–“ঠিকই তো। কি বলছিস এসব সামিহা?”
বিভোর কফি হাতে নিয়ে কথাটি বলে ওঠে। সামিহা নিশ্চিত হয়ে বলে….
–“আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। মাধুর্য কি হয়েছে তোর? এই বাড়িতে থাকতে সমস্যা হচ্ছে? নাকি হাত খরচের সমস্যা? আমাদের বল।”
নিজের কঠোরতা টিকিয়ে রাখতে পারে না মাধুর্য। হুট করেই সামিহার কোলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে সে। সামিহা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। মাধুর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে…
–“কি হয়েছে তোর?”
মাধুর্য সবটা বলে। সামিহা আর বিভোর কিছুটা হতবাক হয় বটে। যেই মেয়েটা ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিল না, যেই মেয়েটা বড়লোক ছেলে দেখলে কয়েক হাত দূরত্ব রেখে চলতো! সেই মেয়েটাই কি না এমন একজনকে ভালোবাসল যাকে নিজের করে পাওয়া বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
সামিহা ও বিভোর ঠিক কি বলে শান্তনা দেওয়া যায় তাদের মাথাতেই আসছে না। সামিহা অনেক ভাবনাচিন্তা করে বলে ওঠে….
–“প্রত্যেকটা মানুষের জীবনসঙ্গী আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তোর ভাগ্যে যদি অনুভব লিখা থাকে তবে কবিতার সঙ্গে বিয়ে হবার আগ মূহুর্তেই তোদের মিলন ঘটবে। আর যদি না থাকে তাহলে হাজার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যাবে না। তুই নিজেকে আগে শান্ত কর।”
মাধুর্য আস্তে আস্তে নিজের কান্না থামায়। বিভোর তাকে প্রশ্ন করে….
–“এরপর কি করবি ভেবে রেখেছিস?”
–“না এখনো ভাবিনি। আগে কবিতার বিয়েতে তো যেতে হবে। তারপর ভেবে দেখব।” (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে)
–“তুই যেতে পারবি সেখানে?”
–“যেতে তো হবেই বন্ধুত্বের কারণে।”
মলিন হাসে মাধুর্য। বিভোর ও সামিহা অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে মাধুর্যের পানে।
চারিদিকে বিয়ের আমেজ! ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন না করা হলেও বিয়ে বিয়ে ভাব ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে। সিনহা বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের সকল ভ্যাম্পায়ার ভীড় করেছে তাদের প্রিন্সের বিয়ের দেখবার জন্য। সকলে বিয়ের কাজে তাড়াহুড়ো করছে। প্রলয় সিনহা চান দ্রুত বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে। অনুভব কখন বেঁকে বসবে তার ঠিক নেই।
–“রায়মা! অনুভব তৈরি হয়েছে? হাতে আর বেশি সময় নেই। বিয়ের জন্য বের হতে হবে।”
প্রণয়ের কন্ঠে রায়মা তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে। ওপরে ইশারা করে বলে…
–“অনুভব তৈরি হচ্ছে। আর একটু সময় লাগবে।”
–“সেই সময়টাই তো নেই। নেই বললে ভুল হবে প্রলয় ভাই দ্রুত যা করবার করতে বলেছে।”
–“ছেলেটাকে জোর করা কি ঠিক হচ্ছে প্রণয়?”
চিন্তিত সুর রায়মার। সে গত কয়েকদিন ধরে অনুভবকে খেয়াল করছে। অনুভব আগের মতো নেই। কেমন জানি হয়ে গেছে। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়াও করে না। তাই তাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে রায়মার। প্রণয় যান্ত্রিক আওয়াজে বলে….
–“প্রলয় ভাইয়ের কথায় শেষ কথা। আর আমার মনে হয় এতে ভালোই হবে।”
ড্রেসিং রুমে বড় আয়নার সামনে টুলে শিরদাঁড়া সোজা করে দুই হাঁটুতে দুই হাত রেখে বসে আছে অনুভব। তার দৃষ্টি স্থির আয়নায় নিজের দিকে। মনে মনে অসংখ্য বার নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে সে। তার মনটা বার বার বলে উঠছে….
–“ছি প্রিন্স অনুভব! ছি! যার জন্য তুই এতগুলো বছর অপেক্ষা করলি। যার জন্য তুই নিজের জীবনের সময় থামিয়ে রাখলি আজ তাকে পেয়েও ধরে রাখতে পারলি না? এই নাকি ওর ভালোবাসা? তুই আদোও ভাবনাকে ভালোবেসেছিলি তো?”
তার মস্তিষ্ক তীব্র প্রতিবাদ জানায় তার মনের কথায়।
–“কেন? এতো সন্দেহ কেন? ভালোবাসা আর বাবার কসমের মধ্যে কি দোটানায় রয়েছি জানিস না? কাকে বেছে নেব?”
মন এবার তাচ্ছিল্য হাসে।
–“তাই বলে একবার চেষ্টাও করে দেখবি না?”
–“চেষ্টা কি কম করেছি? যা করেছি তার ওপর বিশ্বাস আছে। আমার অপেক্ষা বিফলে যাবে না। কিছুতেই না। আমি শেষ পর্যন্ত আশা রেখে যাব মাধুর্য আমার হবে।”
মন আর মস্তিষ্কের এই তীব্র লড়াইয়ে কেউ জেতার আগেই দরজা খুলে প্রবেশ করে এলিনা। মাথা নত হয়ে রয়েছে তার এবং হাতে গোল বড় বাটির মতো কিছু একটা। যার ওপর রয়েছে খয়েরী রঙের রাজকীয় পাগড়ি।
–“প্রিন্স, এটা পড়ে নিন। আমাদের বের হতে হবে। কিং এর কড়া আদেশ। দ্রুত বের হতে হবে।”
পাগড়িটা রাখে এলিনা আয়নার সামনে। চোখেমুখে গম্ভীরতা রেখে পাগড়িটা মাথায় পড়ে অনুভব। সে বরাবরই সুন্দর দেখতে। তার চেহারার সঙ্গে প্রিন্স ভাবটা রয়েছে। তবে আজ নেই তার চেহারার আলাদা উজ্জ্বলতা। তার পরনে বিয়ের পোশাক। গোল্ডেন শেরওয়ানি, খয়েরী পাগড়ি, পায়ে খাগড়া। নিজেকে ভালোভাবে দেখে নেয় অনুভব। এলিনা মিনমিন করে বলে ওঠে….
–“মাধুর্য আপনাকে অনেক ভালোবাসে। কোনো কি উপায় নেই?”
–“আমি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না এলিনা। ড্যাড কে গিয়ে বলো আমি তৈরি।”
এলিনা বাধ্যমতো চলে যায়।
আশেপাশে বর এসেছে বলে আনন্দের চিৎকার লেগে গিয়েছে। ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ বলে ধুম পড়ে গেছে। বিয়েটা যেহেতু অনুষ্ঠান করে নয় সেহেতু বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। অনুভবদের বসতে দেওয়া হয়। দরদর করে ঘামছে অনুভব। বার বার শেরওয়ানির গলা ধরে টানছে ও। তার দুচোখ খুঁজছে তার প্রেয়সীকে। কবিতা কি তার কথা মানবে? নাকি বিয়েতেই রাজি হবে? প্রলয় রুমাল এগিয়ে দেন ছেলের দিকে। ফিসফিস করে বলেন….
–“মুখে রুমাল গুঁজে নে। এটা নিয়ম।”
–“দেখো ড্যাড, আমার ভালো লাগছে না। আমি মেয়ে নই যে লজ্জা পেয়ে রুমাল মুখের সামনে ধরে থাকতে হবে। প্লিজ স্টপ!”
প্রলয় সিনহা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অন্যদিকে তাকান। কাজি বলেন বিয়ের জন্য মেয়েকে নিচে নিয়ে আসতে। অনুভবের টেনশন বেড়ে যায়। এতো অস্থিরতা কি ভালো লাগে?
কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে আসে বিয়ের বউ। গায়ে বিয়ের সাজ। অনুভবের দুচোখ ব্যস্ত হয়ে পড়ে মাধুর্যকে খুঁজতে। মনে হচ্ছে মেয়েটা ভিড়ের মাঝেই কোথাও আছে। কিন্তু অনুভব খুঁজে পাচ্ছে না কেন? বিরবির করে বলে ওঠে….
–“মাধুর্য কোথায় তুমি? আই উইশ একটা মিরাকেল ঘটে যাক।”
অনুভবের ইচ্ছে যেন পূরণ হবার নয়। বিয়ের কনে কে নিয়ে এসে বসানো হয় অনুভবের পাশেই। কনের মুখ মাথার কাপড় দিয়ে ঢাকা। তবে অনুভব তেমন কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না পাশের জনের প্রতি। একসময় অনুভব বিরবির করে বলে….
–“কবিতা শেষমেশ তুমি বিয়েতে রাজি হলে? কেন?”
কবিতা নড়েচড়ে ওঠে। কবিতার হাতের স্পর্শ লাগে অনুভবের হাতের সাথে। অজানা অনুভূতি জাগে অনুভবের মনে। অবাক চোখে তাকায় ও। হুট করে জোরেই প্রশ্ন করে বসে….
–“কে তুমি?”
কবিতার মা এগিয়ে আসেন।
–“কেন অনুভব বাবা? ও কবিতা!”
–“না ও কবিতা হতেই পারে না।”
সঙ্গে সঙ্গে মুখের ওপর থেকে কাপড় তোলে বিয়ের সাজে থাকা মেয়েটি। সবাই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। এ কি বাস্তব নাকি কল্পনা??
চলবে…..??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।