#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#২৪,২৫
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪
বিয়ের সাজে বসে আছে মাধুর্য। মুখে নেই তেমন কোনো কৃত্রিম সাজগোজ। যেন একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই সেজেছে সে বউয়ের সাজে। শুধুমাত্র লাল রঙের বেনারসি, মাথায় গোল্ডেন রঙের কাপড় আর গায়ে গয়না। এতটুকুই তার সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। তার চোখের পাতা ভিজে। অনুভবের অস্থির মনটা মাধুর্যকে নতুন রুপে দেখেই স্থির হয়ে পড়ল। মেয়েটা আর কত ভাবে তাকে বিমোহিত করবে তা জানা নেই অনুভবের। এক মূহুর্তের জন্য কবিতাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো সে। ওর ধারণা, কবিতা নিজে বিয়ে থেকে সরে গিয়ে মাধুর্যকে কনে সাজিয়েছে। আশেপাশের মানুষেরা কানাকানি শুরু করে দিয়েছে। অনেকে চিৎকার করে বলছে,
–“বিয়ের কনে অদল বদল হয়েছে।”
কবিতা মা হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন….
–“এটা কি হচ্ছে টা কি মাধুর্য? তুমি কেন তাও বিয়ের সাজে? আমার মেয়ে কোথায়?”
মাধুর্য হুট করেই কেঁদে ফেলে। সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার কান্নার কারণ কেউ বুঝতেই পারছে না। প্রলয় সিনহা বিরক্ত হন। যেই মেয়ের থেকে দূরে রাখার জন্য ছেলের বিয়ে দিচ্ছে সেই মেয়েটাই কি না এখন বিয়ের কনে সেজে বসে আছে। ভাবা যায়? উনি কড়া গলায় বলেন….
–“কান্নাকাটি বাদ রেখে বলো, বিয়ের কনে কোথায়?”
কবিতার মা নিজের চিন্তার অন্ত ঘটাতে না পেরে নিজেই ছুট লাগালেন সিঁড়ির দিকে। মাধুর্য নিজের মনকে শক্ত করে অতি শান্ত সুরে বলে….
–“কবিতা আর নেই আন্টি। ওকে খুন করা হয়েছে।”
সবাই অতি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিয়ের কনে বিয়ের দিনে খুন বিষয়টা বেজায় সাংঘাতিক। কবিতার মা কিছুক্ষণের জন্য থমকে পড়েন। কাঁপতে শুরু করেন উনি। চেঁচিয়ে বলে ওঠে….
–“কি বলছো তুমি? আমার মে…মেয়ে! না। আমার মেয়ের কিছু হতে পারে না।”
শোক সামলাতে না পেরে সিঁড়ি ঘেঁষে বসে কাঁদতে শুরু করেন কবিতার মা। অনুভবও বেশ ধাক্কা খেয়েছে বিষয়টাতে। কবিতার মতো একজন সাধারণ মেয়ের খুন কে আর কেনই বা করতে যাবে তা ওর মাথাতেই আসছে না।
–“কি উল্টোপাশে কথা বলছো তুমি? তোমার কথা কেনই বা বিশ্বাস করব আমরা?”
গর্জে বলে ওঠেন প্রলয় সিনহা। অনুভব সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে বলে ওঠে….
–“ড্যাড, মিথ্যে বলে কি লাভ ওর? যেখানে কবিতা মাধুর্যের সব থেকে কাছের বন্ধু।”
মাধুর্য উঠে দাঁড়ায়। যান্ত্রিক ভাবে বলে….
–“আপনাদের বিশ্বাস না হলে আপনারা ওপরের ঘরে গিয়ে দেখতে পারেন। আসুন আপনারা।”
যেহেতু বিয়েতে বেশি তোড়জোড় নেই সেহেতু লোকজনের ভীড়ও কম। যে কয়জন লোকজন রয়েছে সবাই কাছের লোক। রেনুকাও উপস্থিত আছেন সেখানে। মাধুর্যের এমন কর্মকান্ড দেখে হতবাক তিনি। পাশে থাকা বিভোরকে হিসহিসিয়ে বলে ওঠেন….
–“দেখেছিস মেয়ের কান্ড? যাই হয়ে যাক, ওকে বিয়ের কনে সেজে বসতে হবে?”
–“আহ মা! তুমি যা জানো না তা নিয়ে কথা বলবে না। চুপ করো।” (বিরক্তির সুরে)
রেনুকা মুখ ভেংচি দিয়ে ওপরে ওঠেন সবার সাথে।
দরজা খুলে ভেতরে আসে মাধুর্য। পেছন পেছন আসে অনুভব সহ অনেকেই। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই রক্তের গন্ধে অনুভবের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় সে। মাধুর্য গিয়ে বেডের ওপাশে বসে পড়ে। সবাই তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে বেডের ওপাশে কবিতার রক্তাক্ত শরীর দেখে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ে। কেউ কেউ নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাধুর্য মূর্তির মতো কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন, কবিতা গভীর ঘুমে ঘুমিয়েছে আর মাধুর্য তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। কবিতা মা এসে বসে পড়েন কবিতার মৃত দেহের সামনে। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করেন উনি। নিজের মেয়ে ছাড়া কেউ নেই উনার। সেই মেয়ে আজ উনাকে একা ছেড়ে চলে গেল। এর থেকে বেশি কষ্টের আর কি কিছু হতে পারে? সামিহাও গুটি গুটি পায়ে এসে বসে পড়ে মাধুর্যের পাশে। মাধুর্যের কাঁধে হাত রাখতেই মাধুর্য মলিন হেসে বলে…..
–“দেখো, কবিতা কি ভাবে ঘুমোচ্ছে। ও আর উঠবে না সামিহা আপু!”
সবাই ভেঙে পড়ে। অনুভব বুকে হাত রেখে কবিতাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। ভ্রু কুঁচকে কবিতার গালে, হাতে, গলায় লাগা আঘাতগুলো পর্যবেক্ষণ করে সে। এ আঘাত কোনো মানুষের হতেই পারে না। প্রণয় এই পরিস্থিতিতে বলে ওঠেন….
–“কে কবিতাকে এভাবে মারল? এটা আমাদের আগে জানা জরুরি।”
–“হ্যাঁ। ঠিক বলছিস। মাধুর্য, তুমি তো কবিতার সাথেই ছিলে। কি করে ওর সাথে এসব ঘটল? সব সন্দেহ কিন্তু তোমার যাচ্ছে।”
মাধুর্যকে উদ্দেশ্য করে সন্দেহি কন্ঠে বলে ওঠেন প্রলয়। সঙ্গে সঙ্গে মাধুর্য তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে। অনুভবের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে মাধুর্যের হাসিটা। ও ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। মাধুর্যের চোখ ও পড়তে পারছে। ওর চোখের মাঝে ফুটে উঠেছে হাজারো যন্ত্রণা! সেই যন্ত্রণা গ্রাস করে ফেলছে সবকিছু। তবে কিছু বলছে না অনুভব। ও কবিতাকে দেখছে। কবিতার মৃত্যু একদমই চায়নি সে। কবিতা নিঃসন্দেহে ভালো মনের মেয়ে ছিল। যাকে বলে একদমই সরল। সে ধীর পায়ে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে মাধুর্যের সামনে বসে। সবার সামনেই ওর গালে হাত রেখে শান্তনা দিয়ে বলে….
–“কি হয়েছিল তখন? আমাদের খুলে বলো।”
কিছুক্ষণ আগে…..
সামিহার সঙ্গে দ্রুত কবিতার বাড়িতে প্রবেশ করে। ইতিমধ্যে কবিতা কয়েকবার ফোন করেছে। বার বার বলছে…
–“মাধু, আমার বিয়ের সময় এসেছে। আজ অন্তত লেট করিস না। তাড়াতাড়ি আয়। বউ সাজাবি কিন্তু শুধু তুই।”
আধঘন্টা আগে লাস্ট কল করেছিল কবিতা। নিজের মনকে শক্ত করে অবশেষে কবিতাকে বউ সাজানোর উদ্দেশ্যে পা রাখে মাধুর্য। প্রথমেই কবিতার মা তাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসেন। নরম সুরে বলেন….
–“কবিতা সেই থেকে একা বসে আছে। বিয়ের কনে কে একা ছাড়তে নেই। তুমি যখন এসেছো একটু যাও না ওপরে।”
মাধুর্য বিনিময়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে সামিহার সঙ্গে ওপরে উঠে আসে। রুমে ঢুকেই তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে…..
–“কবিতা, আমি এসেছি। আয় তোকে তৈরি করিয়ে দিই। সময় নেই হাতে।”
প্রতিত্তোরে কবিতার কোনোরকম আওয়াজ পায় না মাধুর্য। তাকে দেখে কবিতা কোনো সাড়া দেবে না বিষয়টা অবিশ্বাস্য। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায় সে।
কবিতাকে না পেয়ে ওয়াশরুম ও বেলকনি চেক করা হয়। কবিতা নেই। সামিহা কপালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে বলে….
–“এই মেয়েটা কোথায় গেল?”
–“জানি না সামিহা আপু! আন্টি তো বলল ও ওপরেই আছে।”
কথা বলতে বলতে একটা শব্দে কান খাঁড়া করে মাধুর্য। কোনো জন্তুর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। চোখ ছোট ছোট করে বেলকনির দিকে তাকায় মাধুর্য। সামিহা কিছু বলতে নিলে ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে। ফিসফিস করে বলে ওঠে….
–“কিছু শুনতে পাচ্ছো সামিহা আপু?”
সামিহা মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে না জানায়। রেলিং ধরে নিচে কান পেতে থাকে মাধুর্য। আওয়াজ নিচ থেকে আসছে। আর একটা মেয়েলী আওয়াজও আসছে। দেরি না করে রেলিংয়ের ওপরে উঠে এক লাফ দেয় মাধুর্য। সামিহা মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে….
–“সাবধানে। কি করছিস? পেছনে জঙ্গল।”
–“সেকারণেই তো ওখানে যাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না। আমার কিছু হবে না।”
সামিহার কোনো রকম কথা না শুনেই বিদ্যুৎতের গতিতে উধাও হয়ে যায় মাধুর্য।
মাধুর্য যত এগুতে থাকে ততই প্রখর হতে থাকে মেয়েলী গোঙানি। অন্ধকারেও তার কাছে সবই স্পষ্ট। তাই চলতে সমস্যা হচ্ছে না ওর। আরো কয়েক ধাপ এগুতেই ওর চোখে পড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে। আকাশ থেকে পড়ে মাধুর্য। তার দুটো পা কাঁপতে শুরু করে। পড়ে থাকা মেয়েটা মৃদু নড়ছে আর সাহায্য চেয়ে চলেছে। তৎক্ষনাৎ কারো ধুপধাপ পায়ের শব্দে মাথা উঠিয়ে সামনে তাকায় মাধুর্য। দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়েও যখন কাউকে দেখতে পায় না তখন ফিরে আসে রক্তাক্ত জখম হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার কাছে। মেয়েটাকে সোজা করতেই চোখে ভরে ওঠে পানি। আধো আধো করে তাকানোর চেষ্টা করছে কবিতা। তার চোখ বারংবার বন্ধ হয়ে আসছে। অতি কষ্ট করে মাধুর্যকে দেখতে পেয়ে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে কবিতার। তার আশা, তার মাধু তাকে ঠিক বাঁচিয়ে নিতে পারবে। আটকা আটকা গলায় বলার চেষ্টা করে….
–“মা..মাধু…! আমাকে বা…বাঁচা।”
মাধুর্য কবিতার রক্তে মাখামাখি হাতটা নিজের গালের সঙ্গে চেপে ধরে। সবটা একটা দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। হু হু শব্দ করে কেঁদে ওঠে মাধুর্য।
–“ওরা কারা ছিল? কেন তোর এ অবস্থা করল?”
–“ওরা ভ..ভয়ানক প্রাণি। কি যেন বলছিল। আমি ভা..ভাবনা নাকি যেন একটা। আমি বাঁচতে চাই মাধু।”
কবিতার হাত ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় মাধুর্য। কবিতাকে উঠানোর অনেক চেষ্টা করেও সফল হয় না সে। কবিতার নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারি হয়ে যাচ্ছে। চোখ বড় বড় করে শ্বাস তুলছে সে। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে মাধুর্যের ভয়। নিজের ছোট বেলার বন্ধুকে হারানোর ভয় তাকে ঝেঁকে ধরেছে। এখন যদি কবিতাকে বাঁচাতে সে সক্ষম না হয় তবে নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে হবে তার। মাধুর্যের চোখ থেকে পড়ছে অজস্র ফোঁটা ফোঁটা পানি। অবশেষে হার মেনে চোখ বন্ধ করে নিজের আসল রুপ ধারণ করতে বাধ্য হয় মাধুর্য। হালকা অবয়ব দেখে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে কবিতা। কথা বলার মতো শক্তি বেঁচে নেই তার মাঝে।
–“মাধু, তু…তুই…”
–“আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই কবিতা। এসব বলার সময় নেই আমার হাতে। তোকে ঠিক করতে হবে।”
কবিতাকে দুই হাতে তুলে নেয় মাধুর্য। দ্রুত পায়োোধ এড়িয়ে চলে আসে বাড়ির পেছনে। সামিহা সেখানেই অপেক্ষা করছিল বেশ চিন্তিত হয়ে। বাড়ির অন্যকাউকে জানাতেও পারছিল না ব্যাপারটা। তাহলে অনেকে তিল কে তাল বানাতে দুই বারও ভাবত না। মাধুর্যের সঙ্গে কবিতাকে সেই অবস্থায় দেখে মাথা ঘুরতে শুরু করে সামিহার। একে তো কবিতার রক্তাক্ত অবস্থা তার ওপর মাধুর্যের এমন ভয়ানক রুপ। সামিহা এতো শক সহ্য করতে পারে না। হা করে চেয়ে দেখে। মাধুর্য কষ্ট করে বলে….
–“সামিহা আপু, সাহায্য করো। কবিতাকে কারা যেন মেরেছে।”
হতভম্বতা কাটিয়ে মাধুর্যকে সাহায্য করে সামিহা। বেডের নিচে শুইয়ে দেওয়া হয় কবিতাকে। মাধুর্য দ্রুত উঠে পড়ে।
–“আমি নিচে যাচ্ছি। আন্টিকে সব বলছি। ডক্টর ডাকছি। তুই ঠিক হয়ে যাবি কবিতা। কিচ্ছু হবে না তোর।”
আর একধাপও যেতে পারে না মাধুর্য। কেননা, পেছন থেকে কবিতা তার হাত ধরে রেখেছে। অস্থিরতা নিয়ে তাকায় মাধুর্য।
–“আমার কাছে বস। আমি তোকে কিছু কথা বলব।”
–“কবিতা, দেখ এখন কথা বলার সময় নয়। তোকে ঠিক হতে হবে। তারপর যা বলার বলিস?”
কবিতা কষ্ট করে মাথায় নাড়ায়। মনে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে বলে….
–“এখন কথাগুলো না বললে আর কখনোই হয়ত বলতে পারব না। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। শেষ সময় আমাকে দে। প…প্লিজ!”
মাধুর্য আরো অস্থির হয়ে ওঠে। কবিতা কি বলছে তাকে? তাহলে কি সেও অন্যদের মতোই তাকে ছেড়ে চলে যাবে তার থেকে দূরে? কবিতা মাধুর্যকে বসায়। রক্তমাখা হাত মাধুর্যের গালে রেখে বলে….
–“অনুভব তোকে ভালোবাসে না রে?”
চমকিত হয়ে তাকায় মাধুর্য। উত্তেজিত হয়ে বলে….
–“এসব কথা এই সময় না বললেই নয়?”
–“আমার শেষ ইচ্ছে রাখবি মাধু?”
অতি দ্রুততার সাথে কবিতার মুখে হাত রাখে মাধুর্য। মাথা নিচু করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাঁদতে কাঁদতে বলে….
–“শেষ ইচ্ছে বলিস না। আমাকে ছেড়ে যাস না প্লিজ। কাকে আমি আমার মনের সব কথা শেয়ার করব তুই গেলে? কার মুখে সবসময় কথার পপকর্ণ ফুটবে? কে আমাকে অতিষ্ঠ করবে? যাস না প্লিজ!”
কবিতা প্রতিত্তোরে শুধু তার টেবিলের দিকে ইশারা করে। আর শেষবারের মতো বলে….
–“অনুভবের সঙ্গে বিয়ে করে সুখি থাকবি। ওপর থেকে দ…দেখব। আর হা…হাসব।”
শেষ নিশ্বাস ফেলে এবং শেষ হাসি হেসে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যায় কবিতা। সামিহা আর মাধুর্য দুজনেই চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলে…
–“ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিয়ুন।”
ফ্লোরে মাথা ঠেকিয়ে অনরবত কাঁদতে থাকে মাধুর্য। সামিহার সবটা গড়মিলে লাগছে। কবিতার এমন ভয়ানক মৃত্যু অবিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে। মাধুর্যের কাঁধে হাত রাখতেই চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায় মাধুর্য। টেবিলের কাছ গিয়ে গ্লাসের নিচে চেপে রাখা একটা চিঠি আবিষ্কার করে সে। ধীরে ভাঁজ খুলে কবিতার লিখা সুন্দর হয়ে ভেসে ওঠে। কবিতার দিকে ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে মনে মনে চিঠি পড়তে শুরু করে মাধুর্য।
–“মাধু!! বুঝতে হয়ত দেরি হয়েছে। কিন্তু বুঝে ফেলেছিলাম তুই অনুভবকে ভালোবাসিস। তাও প্রচন্ড ভালোবাসিস। আমি যেদিন তোকে আমার আর অনুভবের বিয়ের কথা বলেছিলাম। সেদিনই আমার সন্দেহ হয়। পুরোপুরি নিশ্চিত হয় তখন, যখন অনুভব নিজে আমাকে ফোন করে সবটা বলেছিল। সেদিন ওর কন্ঠে আমি তোর জন্য ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম। অনুভবের কন্ঠে ছিল তোকে না পাওয়ার এক অসামান্য যন্ত্রণা। যা যেকোনো মানুষকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কষ্ট হয়েছিল বটে কিন্তু মনে হলো আমি অনুভবকে আমিও ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তোদের দুজনের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে অবস্থান করতে চাই না আমি। আমি তাই তোদের বিয়ে দেওয়ার মতো বড়সড় সিদ্ধান্ত নিলাম।”
বর্তমানে…..
–“আমি ঠিক সেকারণেই কনে সেজেছি। এটা কবিতার শেষ ইচ্ছে ছিল। যদি বিশ্বাস না হয় সামিহা আপুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
কবিতার নিস্তেজ মুখের দিকে একমনে তাকিয়ে বলে মাধুর্য। সবাই স্তব্ধ হয়ে পড়ে। আশেপাশে বিরাজ করে পিনপিনে নিরবতা। প্রলয় সিনহা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে আছেন কবিতার পানে। তাহলে কি উনি না জেনেই ভাবনার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন নিজের ছেলের?
এরই মাঝে সবাইকে চমকে দিয়ে অনুভব মাধুর্যের হাতে হাত রেখে দাঁড় করায়। সবাই আরো একবার চমক খায়। মাধুর্য যেন রোবট হয়ে পড়েছে নিজের প্রিয় বান্ধবীকে হারানোর শোকে। অনুভব মাধুর্যকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় প্রলয়ের সামনে। চোয়াল শক্ত করে বলে….
–“ড্যাড, তোমার কথা অনেক শুনেছি। মায়ের দোহাই দিয়ে বিয়ে চেয়েছিলে। তুমি বলেছিলে এই বিয়ে আমাকে করতেই হবে। অ্যান্ড আমি এই বিয়ে করব। মাধুর্যকে বিয়ে করতে চাই আমি।”
প্রলয় কি বলবেন ভেবে পায় না। মাধুর্য তার ভালোবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক চোখে। অনুভবও মাধুর্যের দিকে এক পলক চেয়ে বলে….
–“বিয়ে করতে চাও না তুমি? অন্তত কবিতার শেষ ইচ্ছে রাখার জন্য।”
চোখে চোখ রেখে মৌনতা অবলম্বন করে মাধুর্য। তার মৌনতা অনুভবকে বুঝিয়ে দেয় মাধুর্যের মতামত। কবিতার মা দুর্বল গলায় বলেন….
–“আমিও চাই আমার মেয়ের শেষ ইচ্ছে রাখতে। অনুভব পাত্রপক্ষ। আপনারা ফিরে যাবেন না। মাধুর্য ভালো মেয়ে। কোনো কিছুতে কমতি নেই তার। এটা অদ্ভুত কিন্তু আমার মেয়ের শেষ ইচ্ছে। তাই আমিও চাই বিয়েটা হক।”
প্রণয় প্রলয়ের কানে কানে বলেন….
–“প্রলয় ভাই, বিয়েটা মেনে নেওয়ায় ভালো। আমার মনে হয় ভাবনা কবিতাই ছিল। মাধুর্য সাধারণ মানুষ।”
প্রলয় হাফ ছেড়ে বলেন….
–“ঠিক আছে। আমি বিয়েতে রাজি। মাধুর্যকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে চাই।”
চলবে….??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫
আশেপাশে খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। অন্ধকার মহল মেতে উঠেছে পৈশাচিক আনন্দে। এই আনন্দের মূল কৃতিত্ব মূলত অরুণই পাচ্ছে। তার মতে আজ সে তাদের সবথেকে বড় শত্রুকে ধ্বংস করে এসেছে। তাই সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ওয়ারওল্ফ রাজ্যে। আশেপাশে জ্বলছে আগুনের শিখা। কালো রঙের ফুলের সুভাস আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ ভয়ানক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে তাদের মহলের কোণা কোণা। অরুণ দাঁত বের করে হেসে অদ্ভুত গ্লাসে নিজের পানীয় পান করছে। তার বাবা সেই মূহুর্তে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠেন….
–“অরুণ! তোর কি মনে হয় না? মেয়ের মৃত্যুর খবর তাদের মা-বাবাকে দেওয়া উচিত?”
অরুণ গ্লাস রেখে নিজের হাসি প্রসারিত করে। আবারও গ্লাস নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলে….
–“কথাটা ভুল বলো নি। এতো বড় একটা সুখবর তাদের না জানালে হয়? চলো যাওয়া যাক।”
কিং অলক নিজের রাজকীয় চেয়ার থেকে উঠে পড়ে।
দরজা খোলাতে অধিক আলোয় চোখ মেলার চেষ্টা করে মধুরিমা ও মুহিত। যারা মাধুর্যের মা-বাবা। হ্যাঁ আজও বেঁচে আছে বন্দি অবস্থায়। ২২ বছর আগে তাদেরকে এখানে এনে বন্দি করা হয়। তারপর থেকে আজও ওরা এখানে। সবাই জানে মধুরিমা ও মুহিত নিজেরা নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মাধুর্যকে রেখে। কিন্তু কথাটা আদোও ঠিক নয়। সেদিন মাধুর্য বেবি অবজারভেশনে ছিল তাই ওকে মেরে ফেলতে এসেও খোঁজ পায়নি কিং অলক। না পেয়ে তার মা-বাবা কেই ধরে এনেছিল তারা। শত চেষ্টার পরেও বলেনি তাদের সন্তানের নাম বা তাদের ঠিকানা। তারপর থেকে তারা বন্দি অবস্থাতে নিজেদের মেয়ে জন্য অপেক্ষা করছে। এতোদিনে এই শয়তান ওয়ারওল্ফের কার্যক্রম সম্পর্কে ওরা অবগত হয়ে গিয়েছে।
মুহিত আর মধুরিমা বুঝে গিয়েছে অরুণ আর তার বাবা নিশ্চয় কোনো দরকারেই এসেছে। নয়ত বছরেও তাদের দেখা পাওয়া যায় না। অরুণ এসে তাদের মুখে থাকা কাপড় আলগা করে নিচে নামিয়ে দেয়। তাদের কাঠের মতো শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে। মধুরিমা বেশ ধীরে বলে…
–“কি চাই?”
অরুণ এবং তার বাবা উল্লাসের হাসি হাসে। অরুণ হাত দিয়ে কিছু একটা করে হাসিমাখা মুখে বলে ওঠে….
–“আজকে কিচ্ছু চাই না। আজ তো আমরা তোমাদের কিছু দেখাতে চাই। যা দেখলে তোমাদের পিলে চমকে যাবে।”
কথাটুকু শেষ করেই অরুণ হাত দিয়ে ঝটকা মেরে ওপরে ইশারা করতেই একটা দৃশ্য উপস্থিত হয় তাদের সামনে। দৃশ্যগুলোতে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে অরুণ তার আসল রুপে কবিতাকে আঘাত করছে। তাও খুবই জঘন্যভাবে। শেষমেশ কবিতার গলায় অরুণ তীক্ষ্ণ ধারালো তিনটে নখ দিয়ে গভীর আঘাত করে। কারো পায়ের শব্দ পেয়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। সেই গলায় লাগা আঘাত থেকে ঘটে কবিতার মৃত্যু। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মুহিত আর মধুরিমা হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়। তারা ঠিক তখনো বুঝে উঠতে পারেনি অরুণ ঠিক কি বোঝাতে চাইছে। অরুণ একটু ঝুঁকে দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
–“মেরে ফেলেছি। তোমাদের একমাত্র মেয়েকে এই দুনিয়া থেকেই সরিয়ে ফেলেছি।”
মুহিত ও মধুরিমার বুক কেঁপে ওঠে। ছটফট করতে থাকে মুহিত। তবে কিছু একটা ভেবে শান্ত থাকে মধুরিমা। তারপর হুট করে পাগলের মতো হেসে ওঠায় সবাই চুপ হয়ে যায়।
–“বাবা, ইনি বোধহয় মেয়ে হারানোর শোকে অবশেষে পাগল হয়ে গেলেন। এদের বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ? মেরে ফেললেই তো হয়।”
মধুরিমাকে লক্ষ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ওঠে অরুণ। অরুণের কথা শুনে গর্জে ওঠে মধুরিমা।
–“ভুল করেছো তোমরা। অনেক বড় ভুল করেছো। জানি না কোন মায়ের কোল খালি করেছো। তবে আমার কোল এখনো খালি হয়নি। আমার মেয়েকে আমি অনুভব করতে পারছি। ও যেখানে সুস্থ আছে।”
মধুরিমার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় কিং অলক। অরুণ মধুরিমাকে আঘাত করতে গেলে থামিয়ে দেয় সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে মধুরিমাকে। কি বলতে চায় মধুরিমা?
–“কি অবাক হলে? যেই মেয়েকে তোমরা মেরেছো সে আমার মেয়ে নয়। ও আমার নাড়ি ছেঁড়া সন্তান। ওকে চিনতে একটুও ভুল হবে না আমার। দৃশ্যতে যা দেখলাম তাতে আমি নিশ্চিত আমাদের মেয়ে নয়। আমাদের মেয়ে তো ছিল রূপনগরীর রাজকন্যার মতো দেখতে। তাকে যে একবার দেখবে সে বিমোহিত হতে বাধ্য। ওর হাসি সবাইকে সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখত। যেই মেয়েটিকে হত্যা করেছো সেই মেয়ের মাঝে আমার মেয়ের কোনো গুন পাইনি।”
মুহিত ভাবুক হয়ে পড়ে। সত্যিই তো! মাধুর্যকে যতটা মাধুকরী সৌন্দর্য দিয়ে তৈরি করা ততটা ছিল না ওই দৃশ্যে থাকা মেয়েটার মধ্যে। না চাইতেও আঁতকে ওঠে কিং অলক। তবে কি ওরাই ভুল করে ফেলল? নিজের ছেলেকে ইশারায় ডেকে ফিসফিসিয়ে বলে……
–“ওরা কি বলছে? তুই কি ভুল কাউকে মেরে এসেছিস?”
অরুণ বিদ্রুপের সঙ্গে বলে….
–“হতেই পারে না বাবা। আমি প্রমাণ পেয়েছি ওই কবিতাই ভাবনা। আর আমি ১০০ ভাগ সিউর হয়েছি যখন খবর পেয়েছি ওর সঙ্গে অনুভবের বিয়ে হচ্ছে। অনুভব আর যাই হোক অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না। তাই তো ভাবলাম যে বিয়ের দিনেই মৃত্যু দেব ভাবনার। তাই তো করলাম।”
কিং অলক কোনটা বিশ্বাস করবেন বুঝতে পারছে না। ভাবনার ভীড়ে হারিয়ে যায় সে। অরুণ ধীর গলায় বলে ওঠে…..
–“বাবা, এদের বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। মেরে ফেলি?”
–“না! আমিও দেখতে চাই ওদের ভাবনা কতটুকু সত্যি হয়।”
–“বাবা তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো?”
চোখ গরম করতেই মাথা নিচু করে চুপ হয়ে যায় অরুণ। মুহিত তাদের দেখে বিদ্রুপের হাসি হাসে।
–“তোমাদের সাথে এতো বছর থেকে আমরা জেনে গেছি, ৪৯ বছর আগে অধিক শক্তিশালী ভাবনাকে প্রিন্স অনুভব মারেনি। মেরেছিলে তোমরা। যার কারণে ভাবনার জন্ম হয় আবার তবে একটা মানুষের গর্ভে। আমাদের মেয়ে হয়ত অনুভবকে ভুল বুঝেছে। কিন্তু সেই ভুল বোঝাবুঝি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে দেব না আমরা।”
কিং অলক ধমকে ওঠেন।
–“চুপ। একদম চুপ। তোমাদের যখন ইচ্ছে তখন মারতে পারি আমরা। কিন্তু আমাদের স্বার্থের কারণে মারতে পারছি না।”
–“পারবেও না।”
রাগে কটমট করে অলক অরুণকে ইশারা করে তাদের মুখ বেঁধে দিতে। অরুণও তাদের মুখ বন্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে। বেঁধে দেয় তাদের মুখ। তবে কিং অলকের চিন্তার রেশ কাটে না। কাকে বলতে কাকে মারল অরুণ???
রেজিষ্ট্রেশন আগেই হয়ে গিয়েছে। আইনত অনুভব আর মাধুর্য স্বামী-স্ত্রী বলে অ্যাখ্যা পেয়েছে। ব্যাপারটা মাধুর্যের কাছে আনন্দে হলেও তার মুখে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। তার মনে একটাই কথা ঘুরছে। সে প্রচন্ড অলক্ষ্মী। তার কাছে যে আসবে তার শুধু ক্ষতিই হবে। প্রথমে তার মা-বাবার কিছু একটা হয়েছে আর এখন তার বেস্টফ্রেন্ড কবিতার। এখন তার অনুভবকে নিয়েও ভয় লাগতে শুরু করেছে। চোখ থেকে আর পানিও পড়ছে না। হয়ত পানি শুকিয়ে গেছে। কত আর পড়বে? কাজি তাকে কবুল বলতে বললে কিছুক্ষণ বসে থাকে মাধুর্য। এক মূহুর্তে কিঞ্চিৎ ভাবনা জাগে মনে। সে ভ্যাম্পায়ার। অনুভবকে বিয়ে করা কি ঠিক হচ্ছে? সামিহা তার হাত নাড়া দিতেই এক দমে তিন বার কবুল বলে ফেলে মাধুর্য। অনুভব প্রথমেই কবুল বলে ফেলেছে। সকলে মিলে বলে ওঠে…
–“আলহামদুলিল্লাহ।”
বিয়ের সম্পূর্ণ হওয়ার পর চলতে থাকল খাওয়া দাওয়ার কার্যক্রম। যদিও খাওয়ার অবস্থাকে কেউই এখন নেই। কবিতার এমন নৃশংস মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। কেউ যেন মানতেই পারছে না। কবিতার মা এক কোণায় গিয়ে কেঁদে চলেছেন। উনার আর এই পৃথিবীতে কেউ রইল না।
কিছুক্ষণ অনুভবের পাশে বসে থেকে উঠতে নেয়। অনুভব ওর হাতটা কোমল ভাবে ধরে। কিছুটা চমকে পেছনে তাকায় মাধুর্য।
–“কিছু বলবেন?”
–“কোথায় যাচ্ছো? মনে রেখো, কিছু করবার আগে আমাকে অবশ্যই জানাবে। এখন শুধু তুমি নেই। তোমার সঙ্গে জুড়েছে আমার নামটাও।”
মাধুর্য স্মিত হাসে। তারপর হাসিটা মিলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে অনুভব তার হাত দিয়ে মাধুর্যের মুখে হাসি টেনে দেয়।
–“আজ থেকে তোমাকে হাসিখুশি রাখার দায়িত্ব আমার মিস. মাধুর্য চৌধুরী… উপপস…সরি! মিসেস. মাধুর্য সিনহা?”
মাধুর্য বুঝতে পারে, তাকে হাসাতে চাইছে অনুভব। মানুষটি বড়ই মন কাড়া স্বভাবের। অনুভবকে খুশি করতে একটু খানি হাসে মাধুর্য। নরম সুরে বলে….
–“আন্টির কাছে যাচ্ছি। উনি খুব ভেঙে পড়েছেন।”
মাধুর্যকে থামিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয় সামিহা। তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে….
–“তোকে যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি। তুই বরণ কিছু খেয়ে নে। দুপুরের পর থেকে কিছু পেটে পড়েনি তোর।”
–“আমি কিছু খাব না। কি করে খাবো? খাওয়ার মতো অবস্থা আমার নেই আপু।”
সামিহা কিছু বলতে চাইতেই হাত দিয়ে ইশারা করে তাকে থামিয়ে দেয় অনুভব। সামিহাকে যেতে বলে সে। ব্যাপারটা সে সামলে নিতে পারবে। সামিহা দ্রুত নেমে যায় সেখান থেকে। মাথার পাগড়ি খোলে অনুভব। মাথা যেন ঘেমে যাচ্ছিল তার। আর বড় বড় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কপালে এক সামনের চুলগুলো। কপালের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে যায় তার। পাগড়ি খুলে পাশে রাখতেই খাবার নিয়ে আসে এলিনা। অনুভবের হাতে খাবার তুলে দিয়ে চলে যায়। খাবার বলতে সেখানে রয়েছে ফলমূল। মাধুর্য এই অবস্থায় বেশি কিছু খেতে পারবে না। কাটা চামুচ দিয়ে একটা আপেলের টুকরো নিয়ে অনুভব হালকা কেশে ডেকে ওঠে….
–“মাধুর্য!”
পাশে তাকায় মাধুর্য। খাবারের প্লেট দেখে চোখমুখ জড়িয়ে ফেলে সে। বিব্রতবোধ করে বলে….
–“আমি খাব না। কেন শুধু শুধু জোর করছেন?”
–“কেন খাবে না? না খেলেই কি কবিতা ফিরে আসবে তোমার কাছে? বরণ ওর জন্য তুমি যদি কষ্ট পাও তাহলে ওরই খারাপ লাগবে। গট ইট?”
বিষন্ন মুখে সামনে তাকায় মাধুর্য। সামনে বেশ লোকজনের আনাগোনা। এর মাঝেও খাওয়া সম্ভব? আর গলার নিচে খাবার নামবেই বা কি করে?
অনুভব ধমকে বলে…..
–“খাবার মুখে নাও মাধুর্য।”
শুকনো ঢোক গিলে মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে মাধুর্য। ঢোক গিলে ছোট করে খাবার মুখে নিতেই লাইট পড়ে তাদের ওপর। সামনে হাত রেখে তাকায় অনুভব। তার বন্ধু সুযোগ বুঝে জোহান ছবি তুলছে। অনুভবের দৃষ্টি দেখে দাঁত কেলিয়ে তাকায় জোহান। মাথা চুলকে বলে….
–“ছবি। মানে ছবি তুলছিলাম। তোদের বিয়ে আর ছবি না তুললে হয়?”
–“সবসময় ফাইজলামি করবি না। কানের নিচে থাপ্পড় মারব আমি উঠলে।”
ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে অনুভব। জোহান জ্বিহ্বা কেটে এক চোখ বন্ধ করে বলে….
–“ওকে ওকে। সরি।”
সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে ক্যামেরা হাতে নিয়ে জোহান।
বাঁকা চোখে তাকিয়ে আস্তে আস্তে খেতে থাকে। ইতস্তত বোধ করে বলে…..
–“আপনি খেয়েছেন?”
–“না এখনো খাইনি।”
–“আপনিও খান। নয়ত আমার একা খেতে কেমন জানি লাগছে।”
মুখ ফসকে বলে ফেলে মাধুর্য। সঙ্গে সঙ্গে নিজেই থম মেরে যায়। অনুভব মুচকি হাসে।
–“বিয়ে হতে না হতেই স্বামীভক্ত হয়ে পড়েছো। নট ব্যাড।”
মাধুর্য প্রতিত্তোরে কিছু বলে না। একমনে তাকিয়ে থাকে। তার মনের একপাশে বইছে শান্তির হাওয়া। অন্যপাশে বইছে নিজের এক প্রিয়জনকে হারাবার কষ্ট।
কবিতার মাকে সামলে হিমশিম খেয়ে মাধুর্যের খাওয়া হয়েছে কি না দেখার জন্য ছুটছে সামিহা। কিছুক্ষণে মাঝেই হবে বিদায়। তাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। তখনই ঘটে আরেক বিপত্তি। একটা ছেলের সঙ্গে কাঁধে ধাক্কা লেগে পড়তে পড়তে সামলে নেয় নিজে সামিহা। সব মিলিয়ে একপ্রকার রেগেমেগে তাকায় সামিহা। সামনে কালো ফ্রেমের চশমা আর সাদা শেরওয়ানি পড়া এক ছেলে। তার হাত থেকে ক্যামেরা পড়ে যা তা অবস্থা। সে ঝুঁকে ক্যামেরা তুলছে। অতশত খেয়াল না করে সামিহা তেতিয়ে বলে ওঠে….
–“মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে মন চায় না? কোনো ম্যানার্স নাই? ভীড়ের মাঝে ঠিকঠাক চলাফেরা করতে পারেন না?”
ক্যামেরা হাতে নিয়ে রেগেমেগে তাকায় জোহান। সামিহার থেকে দ্বিগুন জোরে বলে ওঠে…..
–“ও হ্যালো মিস…! আমার কোনো শখ নেই যে আপনার মতো একজন শুটকি মাছকে ধাক্কা দিতে। কোথায় পড়ে টরে যাবেন। অতঃপর নিজের হাত-পা ভেঙে বসে থাকবেন। নিজে তো চোখ মাথায় রেখে হাঁটেন। ধাক্কা দেওয়ার আসল মজা তো সুন্দরী মেয়েরদের।”
মুখটা হা হয়ে যায় সামিহার। কত বড় অসভ্য ছেলের পাল্লায় পড়েছে সে।
–“দেখি সরুন আমার পথ ছাড়ুন।”
–“এইযে মিস! এভাবে পথ ছাড়ব মানে? আমার এতো দামি ক্যামেরা ভেঙে দিয়ে এখন বলছেন পথ ছাড়ুন? এতোই সোজা নাকি? ক্যামেরার টাকা দিন পথ ছাড়ছি।”
সামিহা রাগে কটমট করে বলে….
–“মেয়েদের থেকে টাকা চান লজ্জা করে না?”
–“আমি কি আপনাকে বউ বানাতে চেয়েছি যে লজ্জা করবে? কোন বইয়ে লিখা আছে মেয়েদের থেকে টাকা চাইতে নেই?”
সামিহা পড়েছে মহা বিপদে। এই মানুষটার থেকে পিছু ছাড়াতেই হবে। সে একটু হেসে বলে….
–“হ্যাঁ মা আসছি।” (পেছন দিকে তাকিয়ে)
জোহানও সাথে সাথে পেছনে তাকায়। সেই সুযোগে ঝটপট হেঁটে চলে আসে সামিহা। জোহান সামনে ফিরে তাকে দেখতে না পেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
–“কি মেয়ের বাবা! ভালো বলে ছেড়ে দিলাম। নয়ত দাঁত বের করে রক্তশূন্য করে ছেড়ে দিতাম।”
চলবে……??