অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব-আটাশ
নাফিসা নীলয়া!
কলেজের ব্রেক টাইমে তিতলি আর তিতলির বান্ধবি মিলে বাইরে বের হয়েছে। নির্বান তিতলির জন্যই দাড়িয়ে ছিলো। সেদিন রেহানের হুমকি শুনে আর কলেজ ছুটির পর দাড়ানোর সাহস পায়নি। তাই সে ভেবেছে এবার থেকে ব্রেক টাইমে কলেজের সামনে দাড়াবে। এর আগে তিতলি ব্রেক টাইমে এতোটা বের হতো না। তবে আজ বেড়িয়েছে নির্বান এর নিজেকে লাকি মনে হচ্ছে। তিতলি ওর বান্ধবির সাথে বাইরে আচার কিনছিলো। নির্বান ভাবলো তিতলির সামনে গিয়ে সে আজ মনের কথা বলবে। যে করেই হোক তাকে কথা বলতেই হবে। নির্বানের পাশেই তার বন্ধু শিমুল দাড়িয়ে দাড়িয়ে নির্বানের কান্ড দেখছে। সে ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছে নির্বানের ভয় দেখে। সে নির্বানকে বললো।
-এখনো দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবতে থাকলে তিতলি কলেজের ভেতরে চলে যাবে। তুই যাবি নাকি আমিই যাবো?
শিমুলের কথা শুনে নির্বান ভড়কে গেল। তাড়াহুড়ো করে সে শিমুলকে না বললো।
-একদম না আমিই যাচ্ছি। আজকে আমি জয়ী হয়েই ফিরবো। তুই দেখে নিস।
শিমুল বিরক্ত চোখেই নির্বানের দিকে তাকিয়ে রইলো। নির্বান শার্টের কলার ঠিক করে হাতা ফোল্ড করে ঠিকঠাক করে এগিয়ে গেল তিতলির দিকে। তিতলি আচার নিয়ে দাড়িয়ে আছে সাথে ওর বান্ধবিও আছে। নির্বান গিয়ে বহু কষ্টে কথা বললো।
-এক্সকিউজ মি! এই যে।
তিতলি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো। নির্বানের কথা শুনে তাকালো। দেখলো সেইদিনের ছেলেটা। এইটাকে না তার ছোট ভাই ধমকি দিয়ে গেছে তাও আবার এখানে এসেছে ভাবলো তিতলি। তিতলির বান্ধবিও নির্বানের দিকে তাকালো। তিতলি বলে উঠলো।
-আমাদের বলছেন?
নির্বান তিতলির প্রশ্ন শুনে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল। সে আমতা আমতা করতে থাকলো। তিতলি বিরক্ত হয়ে তাকালো। তারপর বললো।
-সেদিন আমার ভাই আপনার সাথে কথা বলেছে না? মনে আছে তো?
নির্বানের সেদিনের কথা মনে পরে গেলে সে আরো নার্ভাস হয়ে পরলো। কোনোরকমে বললো।
-জ্বি মনে আছে।
-তাহলে এখানে কি আপনার?
-ইয়ে মানে একটা কথা বলার ছিলো আপনাকে। বলি?
-বলুন।
নির্বান কোনোরকমে চোখমুখ খিঁচে বললো।
-মানে হচ্ছে আমি আপনাকে পছন্দ করি।
বলেই নির্বান উল্টো দৌড়ে শিমুলের কাছে চলে গেল। শিমুল বিরক্ত হয়ে তাকালে নির্বান হাপাতে হাপাতে বললো।
-এই শালা তাড়াতাড়ি বাইক স্টার্ট কর। নইলে তিতলি এক্ষুনি ওর দুই ভাইকে নিয়ে আমাকে ধরতে আসবে। জলদি কর। নইলে আজ এখান থেকেই আমাদের জানাজা উঠবে।
শিমুল দ্রুত বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো।
-ইন্নালিল্লাহ নির্বান। কিচ্ছু আটকায় না তোর মুখে তাই না? শালা ভীতু একটা। এতোই যখন ভয় পাস তো তিতলিকে পছন্দ করতে গেলি কেন?
-তুই দ্রুত যা নইলে তিতলি এখনই এসে পরবে।
শিমুল নির্বানের কাহিনী হজম করে দ্রুত বাইক চালানোতে মন দিলো।
এদিকে তিতলি তব্দা খেয়ে হাতে আচার নিয়ে দাড়িয়ে রইলো। কি থেকে কি হলো তার মাথায় এখনো কিছুই ঢুকছে না। তার বান্ধবি নদীর ধাক্কা খেয়ে তিতলির হুস ফিরলো।
-তিতলি বলিসনি তো ছেলেটার কথা?
তিতলি এতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো।
-আমি কি করে বলবো এইটাকে তো আমিই চিনি না ঠিক করে। পাগল ছাগল।
তিতলির বান্ধবি নদী হাসতে হাসতে বললো।
-যাই ই বলিস ভীতু টাইপের হলেও দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। ট্রাই করে দেখতে পারিস।
তিতলি রেগে তাকিয়ে বললো।
-এসব ছেলেদের আমি একদম পছন্দ করি না। কি ছ্যাচড়া রে বাবা। সেদিন ছোট ভাই এটাকে ধমকি টমকি দিয়ে গেছে। তাও আজ এখানে আমাকে পছন্দের কথা বলতে এসেছে। আর বলার স্টাইল দেখেছিস গাঁধা আর ভীতুর ডিম কোথাকার।
-যাই ই বল আমার তো খুব ভালো লেগেছে।
-হ্যা হ্যা ঝুলে পর না যা ছ্যাচড়াটার গলায় নিজেই গিয়ে ঝুলে পর।
তিতলির কথা শুনে নদী হাসতেই থাকলো। তিতলি বিরক্ত হয়ে তার বান্ধবি নদীর হাত ধরে টানতে টানতে কলেজের ভেতরে চলে গেল।
নীরা আজকে সকাল সকালই সাইফের ক্যাফেতে এসে পরেছে কাউকে কিছু না বলে। রুমাকেও বলেনি। সাইফ সকাল সকাল নীরাকে তার ক্যাফেতে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হলো। আর নীরার চোখমুখও কেমন যেনো গম্ভীর। সে ঠিক বুঝতে পারলো না। এর আগে নীরা রুমাকে নিয়েই সকাল সকাল আসতো। আর একা এলেও এমন গম্ভীর মুখে থাকতো না। সে এসব ভাবতে ভাবতে দুই মগ কফি নিয়ে নীরার সামনে বসলো। নীরা অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিলো। এরমধ্যে সাইফ নীরাকে দুইবার ডেকেও ফেললো। শেষমেষ নীরাকে ধাক্কা দিলো। নীরা সাইফের দিকে তাকালো। বললো।
-কিছু বলছিলি?
-বলবি তো তুই দুই তিনবার ডাক দিলাম শুনলি না কি এতো ভাবছিলি বল তো। আর সকাল সকাল তোর মুড অফ কেন?
-তোর সাথে কথা আছে। সময় হবে তো?
-গাঁধি এটা কোনো কথা বললি। সময় হবে না কেন! অবশ্যই হবে। তুই বল তো এমন ডিস্টার্ব কেন তুই?
-সাইফ আমি তোকে আমার ভাই মানি এজন্যই তোর কাছে কথাগুলো বলতে এসেছি। রুমাটা বেশি ইমোশনাল ফুল এজন্য ওর কাছেও বলিনি।
সাইফ বিরক্ত হয়ে কফির মগে চুমুক দিলো। এতো ফর্মালিটি তার কোনোকালেই পছন্দ না। নীরার সাথে তো সে কখনোই ফর্মাল ছিলো না।
-আমাকে যা বলবি স্ট্রেটকার্ট বলবি। আমার সাথে এতো ফর্মালিটির কি আছে আজব!
নীরা সাইফের কথায় হেসে ফেললো।
-ওকে ওকে রেগে যাস না। আর ফর্মালিটি করবো না।
-হু এবার বল।
নীরা মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলো। তারপর বললো।
-সাইফ আমার কি শিহাবকে বিয়ে করা ঠিক হবে?
নীরার কথা শুনে সাইফ বিষম খেলো। মুখ থেকে কফি ছিটকে গেল। নীরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে টিস্যু দিয়ে সাইফের মুখসহ শার্ট মুছে দিলো। সাইফ নিজেকে ধাতস্ত করলো। তারপর বললো।
-এসব কি কথা নীরা? শিহাব ভাইয়ের মতো মানুষকে বিয়ে না করার কথা কি করে বলতে পারলি তুই? আর ইউ ম্যাড?
-নো আই এম এবসুলিউটলি ফাইন।
-তোর মাথা ঠিক নেই এজন্যই তুই এসব বলছিস।
-আমার মাথা একদম ঠিক আছে সাইফ।
-তাহলে এমন কি হলো যে তুই এগুলো বলছিস?
-সাইফ গতকাল শিহাবের মায়ের সাথে আর তিশার সাথে আমি দেখা করেছি।
-হ্যা তো। এখানে ওনারা এলেন কোত্থেকে?
নীরা একটু বিরক্ত হলো সাইফের ওপর।
-তুই একটু চুপ কর। তারপর আমার কথাগুলো শোন মনোযোগ দিয়ে শুনবি।
নীরার কথা শুনে সাইফ মাথা নাড়লো।
-সাইফ আমাদের বিয়ের পর যদি শিহাবের আমাকে নিয়ে আফসোস হয়। তারপর যদি ওর মনে হয় ও একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়েকে ডিজার্ভ করে। তখন!
নীরার কথা শুনে সাইফ ভাবনাতে পরে গেল। নীরার মতো মেয়ে এসব ভাবছে।
-নীরা নিজেকে কি ভাবিস তুই? তোর মতো ওয়েল এডুকেটেড যোগ্য একজনকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। শিহাব ভাই লাকি হবে তোকে পেলে। স্বয়ংসম্পূর্ণ মানে? এক মিনিট নীরা তুই তোর দূর্বলতাটা নিয়ে আবার হীনমন্যতায় ভুগছিস?
নীরা কিছু বললো না। চুপচাপ রইলো। সাইফের যা বোঝার সে বুঝে গেল। সে নীরার হাত ধরে বললো।
-তুই এটা কি করে ভাবতে পারলি নীরা? কি করে? তুই যা করছিস সেটা কয়জন করতে পারে। তুই জানিস সবাই তোকে কতোটা সম্মানের চোখে দেখে। তোর এই সমস্যা টা কোনো সমস্যাই না। আর কতোবার বললে তুই এই কথাটা বুঝবি? অন্তরের সৌন্দর্যটাই সব এটা তোরই কথা। তারপরও তুই নিজেকে প্রমান করেছিস। তোর যথেষ্ট এবিলিটি আছে। আর শিহাব ভাই? সে তোকে কতোটা ভালোবাসে তুই কি এখনো বুঝছিস না? শিহাব ভাই প্রথম থেকে কখনো তোর এই সমস্যাটার কথা ভাবেইনি। সে কখনো তোকে ফিল করতে দিয়েছে যে তুই এবনরমাল?
সাইফের কথায় নীরা মাথা নেড়ে না জানালো।
-এক্স্যাক্টলি কখনো শিহাব ভাই এমন কোনো আচরনই করেনি। তার জন্য তুই কতোটা স্পেশাল সেটা আমরা সবাই জানি। তবুও তুই এগুলো ভাবছিস কি করে। নীরা তুই দূর্বল না। আমাদের নীরা কখনো দূর্বল হতে পারে না রাইট? এসব নিয়ে ভাববি না। একা এতদূর এসেছিস কখনো কারো সহানুভূতির প্রয়োজন তোর পরেনি। আর সামনেও পরবে না ইনশাআল্লাহ। কথাটা সবসময় মাথায় রাখবি। বুঝেছিস?
সাইফের কথা শুনে নীরার এখন একটু ভালো লাগছে। তবুও মনের ভেতর খুঁতখুঁত রয়েই গেল। আর তিশার কথাটাও সে সাইফকে বলেনি। নীরা ভেবেছে যতোদিন না শিহাব এখানে আসে। আর যতোদিন না শিহাবই তিশার ব্যপারটা ক্লিয়ার করে ততোদিন সে এসব কাউকে বলবে না। সাইফের কাছে এই কথাগুলো বলার একটাই কারন আর তা হলো একটু শান্তি। সারারাত এসব ভেবে সে ঘুমায়নি। জায়মার কথাগুলো তাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। নীরা এসবই ভাবছিলো তখন সাইফের কথায় নীরার হুস ফিরলো।
-আর যেনো কি বলছিলি তুই? শিহাব ভাইয়ের মায়ের সাথে দেখা হয়েছে তোর?
-হ্যা ওই এমনিই দেখতে চাইছিলেন আমাকে। তুই এখন এসব বাদ দে আমার মুড ঠিক হয়ে গেছে। কিছু খাওয়া সকালে খেয়ে আসিনি তাড়াহুড়োয়। জলদি কিছু নিয়ে আয়। দুজন মিলে খাবো ওকে?
সাইফ নীরার হাত ধরেই বললো।
-তুই এখন ঠিক আছিস তো? আর তো কোনো ইস্যু নেই?
নীরা হাসতে হাসতে বললো।
-একদম না ইয়ার। তোর কথা শুনে আমার আর কবে মন খারাপ ভাব থেকে গেছে! এখন জলদি খাবার নিয়ে আয়। খিদেতে মরে যাচ্ছি আমি।
সাইফ হাসতে হাসতে খাবার আনতে চলে গেল। নীরা বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকলো সে যদি সত্যিই শিহাবের ইনফ্যাচুয়েশন হয়। আর তিশার কথাটা তাকে কেন বলা হলো না!
মিলা রেহানের জন্য করিডোরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। রেহান বলেছে দশটা নাগাদ তার ক্লাস শেষ হবে। তারপর মিলাকে নিয়ে সে শপিংমলে যাবে। কারন তিতলি অনলাইনে একটা ড্রেস দেখিয়ে বলেছে সেটা তার লাগবেই। অনলাইনে ড্রেসটা আর পাওয়া যায়নি। তিতলির এটা নিয়ে খুব মন খারাপ হয়েছিলো। সেজন্য রেহান ভেবেছে সে ড্রেসটা যেখান থেকেই পারুক তিতলিকে কিনে দিয়ে সারপ্রাইজ দিবে। বিষয়টা যখন সে মিলার সাথে শেয়ার করেছে। তখন মিলা নিজ থেকেই তাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। মিলা অপেক্ষা করতে করতেই রেহান মিলার সামনে হাজির হয়ে গেল। মিলা রেগে বললো।
-দশটা বাজে ক্লাস শেষ হবে বলেছিলে। এখন কয়টা বাজে দেখেছো?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রেহান জ্বিভ কাটলো।
-ইয়ে মানে স্যরি একটা ইম্পর্টেন্ট শীট কালেক্ট করতে গিয়ে লেট হয়ে গেল।
-এখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমার মুখ না দেখে চলো। নইলে একটু পরে দুপুর হয়ে যাবে!
রেহান বিড়বিড় করে মিলাকে বকতে বকতে হাটতে লাগলো। মিলা রেহানকে ধমকে বললো।
-রেহান তুমি যে বিড়বিড় করে আমাকেই বকছো আমি কিন্তু সব শুনেছি। আমি তোমার সাথে যাবো না যাও।
-স্যরি টিলা চলো।
মিলা আর রেহান একটা মলে গিয়ে ঘুরে ঘুরে তিতলির পছন্দ অনুযায়ী ড্রেস কিনলো। মিলা না থাকলে রেহান কখনোই এতো খুঁজে খুঁজে আউটফিট কিনতে পারতো না। সেজন্য রেহান ভাবলো মিলাকে একটা গিফ্ট করা যাক। কিন্তু মিলা যদি না নেয়। যেই মেজাজ মিলার। আর মিলার কি পছন্দ রেহান তো জানেও না। সেজন্য সে ভয়ে ভয়ে মিলাকে জিজ্ঞেস করলো।
-তোমার কি পছন্দ মিলা?
মিলা এই কথা শুনে রেহানের দিকে সরু চোখে তাকালো। রেহান একটা ঢোক গিললো।
-না মানে আমি যদি তোমাকে একটা গিফ্ট করি তাহলে কি তুমি খুব রাগ করবে?
রেহানের এমন কথা শুনে মিলা খিলখিল করে হেসে ফেললো।
-রেহান তুমি কবে থেকে আমাকে এতো ভয় পাওয়া শুরু করলে।
রেহান তখন বিড়বিড় করে বললো।
-তোমার মতো ডাইনিকে কে না ভয় পাবে।
-কিছু বললে?
-নাহ্ একদম না টিলা। ভাবছি ভাবিকে আর তোমাকে কিছু গিফ্ট করা উচিত। আচ্ছা এবার বলো ভাবির কি পছন্দ?
মিলা দুদন্ড ভাবলো। তারপর বললো।
-আপার তো বুকস খুব পছন্দ। তুমি আপাকে বই গিফ্ট করতে পারো।
-আর তোমার?
-আমার কিছু লাগবে না।
রেহান এবার একটু বিরক্ত হলো।
-আরে বন্ধু ভেবেও তো নিতে পারো নাকি!
মিলা বুঝলো রেহান বকবক করতেই থাকবে। তাই সে বললো।
-আমারও বই পছন্দ। তাড়াতাড়ি করো দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।
রেহান আর কথা না বলে মিলার পছন্দমতো নীরা আর মিলা দুজনের জন্যই বই কিনে দিলো।
নীরা বাড়িতে এসে প্রতিদিনের মতোই সবকিছু করলো। রাতে নীরার ফোনে তিশার কল আসলো। নীরা ফোন রিসিভ করলো। নীরা স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো।
-কেমন আছো তিশা?
-খুব ভালো তুমি কেমন আছো?
-আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
-নীরা আই এম স্যরি। আমি আসলে বুঝিনি তোমাকে ওই কথাগুলো শুনতে হবে। কিন্তু আমার পরে মনে হয়েছে তোমার সব জানা আসলেই দরকার ছিলো।
নীরা তিশার কথা শুনলো।
-নীরা একটা সময় আমি আর শিহাব কাজিন্স কম বন্ধু বেশি ছিলাম। সত্যি বলতে আমাদের আন্ডার্সট্যান্ডিং খুব ভালো ছিলো। এজন্যই অনেক আগে থেকেই আমাদের বিয়ের কথা চলছিলো। আমিও খুশিই ছিলাম। শিহাব তখন কোনো আপওি জানায়নি। আমি জানি না হুট করে ওর কি হয়ে গেছে। তবে আমি সত্যিই তোমাকে এসব জানাতে চাইনি। খালামনি যে ওসব কেন বলতে গেল।
-ইট্স ওকে তিশা। তোমার এতো গিল্ট হতে হবে না।
-নীরা আমিও তো একজন মেয়ে দেখো আমি তোমার ভালোই চাইবো বলো। ইন ফ্যাক্ট তুমি আমার খুব পছন্দের একজন। এজন্যই আমি বলছি তুমি সবার মুখের কথাই বিশ্বাস করো না। মানুষের তো কোনো ভরসা নেই। কখন কে কি করে তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে বলো? তুমি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না।
-আমি এখন রাখছি তিশা। মিলা আমাকে ডাকছে পরে কথা হবে।
নীরা ফোন রেখে দিলে তিশা মুচকি হাসলো। নিজের প্রতি নিজেই ইমপ্রেস সে।
তিশার এসব কথা নীরার একদম ভালো লাগেনি। অশান্ত মন আরো অশান্ত হয়ে গেছে। কোনোকিছুই সে মিলাতে পারছে না।
সাত আট দিন নীরার এভাবেই কাটলো। এই আটদিনে নীরা শিহাবকে অনেক ইগনোর করেছে। শিহাবও এর কোনো কারন বুঝতে পারেনি। তার কাজ শেষ হতে হতে আটদিন সময় লেগে গেছে। নীরার ব্যবহারে সে খুব কষ্ট পেয়েছে। অনেকবার চেষ্টা করেছে তাড়াতাড়ি ফেরার তবে তা সম্ভব হয়নি। লাস্ট চারদিন তো নীরা ঠিক করে ফোনকলই রিসিভ করতো না। এতোটা ইগনোরেন্স সত্যিই মানা যায় না। মিলার কাছে বারবার খবর নিতেও শিহাবের ভালো লাগেনি সেজন্য সে মিলাকেও লাস্ট চারদিন ফোন করেনি।
আটদিন পর শিহাব ফিরেছে। তিতলি আর রেহান এতোদিন পর শিহাবকে পেয়ে মনে হচ্ছে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে। এতো কষ্টের ভেতরেও ভাই-বোনের এমন খুশি দেখে শিহাবের ভালো লেগেছে। তিতলি শিহাবের হাত ধরে বললো।
-আমার ভাইটা কতো শুকিয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া তো মনে হয় একদম করিসনি তাই না?
শিহাব তিতলির কথা শুনে হাসলো। রেহান বলে উঠলো।
-ভাইকে ফ্রেশ তো হতে দে। কতো দূর থেকে এসেছে।
রেহানের কথা শুনে তিতলি শিহাবকে জলদি ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। শিহাব সবার সাথে কথা বলে নিজের ঘরে চলে গেল। তিশা দাড়িয়ে দেখলো। সবার সাথে কথা বললেও তিশার সাথে কথা বললো না শিহাব।
শিহাব নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেও নীরাকে ফোন দিলো। এবারও ফোন রিসিভ হলো না। শিহাব নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে এখন ব্যক্তিত্বহীন মনে হচ্ছে। তবুও তার মন মানলো না সে আবারও নীরাকে কল করলো। এবার নীরার নাম্বার বন্ধ পেলো সে। এবার শিহাব প্রচন্ড রেগে গেল। এতোটা রাগ বোধ হয় কখনোই হয়নি। সে হনহন করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে তিশা আর আসমা বসে ছিলো। রেহান নিজের ঘরে ছিলো। জহুরা আর তিতলি ছিলো রান্নাঘরে। শিহাব রেগে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় তিশা সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো।
-কোথায় যাচ্ছো?
শিহাব রেগে ছিলো তিশাকে দেখে আরো রেগে গেল।চিৎকার করে ধমকে বললো।
-সামনে থেকে সর।
শিহাবের ধমক শুনে তিশার রুহ কেঁপে উঠলো। সে না চাইতেও সরে গেল। শিহাব হনহন করে বেড়িয়ে গেল। চিৎকার শুনে রেহান আর তিতলি বেড়িয়ে আসলো। ততোক্ষনে শিহাব বেড়িয়ে গেছে। তিতলি তিশাকে জিজ্ঞেস করলো।
-কি হয়েছে ভাই এভাবে চিৎকার করলো কেন?
-আমি কি জানি তোর ভাই কার ওপর রেগে বেড়িয়ে গেল! আমি জিজ্ঞেস করাতে আমাকে শুধু শুধু ধমকালো।
আসমা বললেন।
-খুব রেগে ছিলো। এতোটা রেগে যেতে কখনো দেখিনি। যেভাবে বেড়িয়ে গেল না জানি কি হয়েছে।
আসমার কথা শুনে রেহান আর তিতলি চিন্তিত হয়ে পরলো। তিতলি ইতিমধ্যে শিহাবকে ফোনও করা শুরু করে দিয়েছে। তবে ফোন রিসিভ হলো না।
নীরা স্কুল ছুটির পর মাএই বাড়িতে এসেছে। সে যখন রাস্তায় ছিলো তখন শিহাব বারবার কল করছিলো। সে প্রথমে রিসিভ করেনি। পরে রিসিভ করতে গেলে তার ফোনই বন্ধ হয়ে গেল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার কারনে। বাড়িতে এসে দেখলো দরজায় তালা দেওয়া। নীরা বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে এক্সট্রা কি বের করে তালা খুলে ভেতরে গেল। ড্রয়িংরুমে ব্যাগ রেখেই আগে ফোন চার্জে বসালো। ফোন চার্জে দিয়েই সে ওয়ামরুমে গেল। ওয়ামরুম থেকে বেড়িয়ে চার্জার থেকে ফোন বের করে মিলার নাম্বারে ডায়াল করলো৷ মিলা ফোন ধরে বললো সে আর মালিহা নূরজাহান বেগমকে তাদের কাকার বাড়ি থেকে আনতে গেছে। রেজাউল ব্যস্ত তাই তারা দুজনেই গেছে। তাড়াতাড়িই পৌছে যাবে। নীরা মিলার সাথে কথা বলার সময়েই দুই -তিন বার বেল বেঁজে উঠলো। সে ফোন কেটে দিয়ে টেবিলের ওপরে রেখে দেখতে গেল।
আর দরজা খুলতেই নীরা অবাক হয়ে গেল। শিহাব বাইরে দাড়িয়ে আছে। একহাত দেয়ালে ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে। নীরা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে বলে উঠলো।
-তুমি এখানে? কবে ফিরেছো?
শিহাব চোখ তুলে তাকালে নীরা ভড়কে গেল। শিহাবের চোখ মুখ থমথমে হয়ে আছে। তবুও সে স্বাভাবিকভাবে বললো।
-আসলে বাড়িতে কেউ নেই। আমরা পরে দেখা করবো। তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছো?
শিহাব নীরাকে অগ্রাহ্য করেই ভেতরে ঢুকে গেল। নীরা এক সাইড হয়ে দাড়িয়ে ছিলো এজন্য ঢুকতে সুবিধাই হলো। নীরা বুঝে গেল শিহাব আসলে রেগে আছে। সেজন্য সে আর ঘাটালো না। সেও শিহাবের পেছনে গেল। শিহাব কোনো কথা না বলেই সোফায় চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে পরলো। নীরা এখন কি করবে বুঝতে পারছে না সে দাড়িয়েই রইলো। কিছুসময় পর বললো।
-শিহাব বাড়িতে যাও। তোমার অবস্থা ভালো ঠেকছে না। আমরা পরে কথা বলবো।
নীরার কথা শুনে শিহাব এবার সোজা হয়ে বসলো। অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বললো।
-তোমার ফোনটা দাও। আনলক করে তারপর দিবে।
নীরা এবার বিরক্ত হলো।
-তুমি আমার ফোন দেখার জন্য এসেছো?
-তোমার কললিস্ট চেক করার জন্য এসেছি।
বলতে বলতেই শিহাবের নজর গেল টেবিলের ওপর রাখা নীরার ফোনের দিকে। সে নিজেই নীরার ফোন হাতে নিলো। নীরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
-আনলক করো।
নীরা সরু চোখে তাকিয়ে নিজের ফোন নিয়ে আনলক করে শিহাবের হাতে দিলো। শিহাব ফোন হাতে নিলো। নীরা দেখতে থাকলো শিহাব তার ফোন নিয়ে কি করে।
শিহাব কললিস্টে নিজের নাম্বার বের করে নীরার সামনে তুলে ধরলো। বললো।
-গত চারদিনে আমি তোমাকে কতোবার ফোন করেছি দেখো তো।
নীরা কিছু না বলে চুপচাপ রইলো।
-শুধু গত চারদিন বললে ভুল হবে। গত সাতদিন তুমি ঠিক করে আমার ফোনকল্স রিসিভ করোনি। কারন?
-আমি ব্যস্ত ছিলাম। তুমিও কাজে ব্যস্ত ছিলে এটাই কারন।
-আমি শত ব্যস্ততার মাঝেও তোমাকে ফোন দিয়েছি তার কোনো মূল্য নেই?
-শিহাব বাড়িতে যাও আমি বললাম তো আমরা পরে কথা বলবো।
এবার শিহাব হাসলো। হাসিটাও নীরার কাছে অদ্ভুত লাগলো।
-তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছো নীরা?
-একদম না। তোমার বোঝার ভুল।
-তুমি ডিস্টার্ব ছিলে আমি বুঝেছি। কারন ও জানতে চেয়েছি। বলেছি সব আমার কাছে বলতে। তুমি বলোনি আমি সেটাও মেনে নিয়েছি৷ কিন্তু এবার আর কোনো কারন জানতে চাইবো না।
-শিহাব আমি এখন এসব কথা একদম শুনতে চাইছি না। তুমি বাড়িতে যাও। এখনই যাবে রাইট নাও।
শিহাব অদ্ভুতভাবে হেসে তার হাতে থাকা নীরার ফোন একটা আঁছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললো। এবার নীরা নিজেই অনেক রেগে গেল। সে এতোক্ষন বসা ছিলো। এবার দাড়িয়ে গেল। শক্তভাবে বললো।
-তুমি এক্ষুনি বেড়িয়ে যাবে শিহাব। এক্ষুনি। আমাদের বাড়িতে এসে এরকম করতে পারো না তুমি। বেড়োও এখনই বেড়োও।
শিহাব বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছিলো। এবার সে ও দ্বিগুন রেগে গেল। নীরার হাত ধরে বললো।
-আমি বেড়িয়ে যাবো। আমার সাথে তুমিও যাবে। অনেক সহ্য করেছি তোমার ড্রামা। আর না। আমাদের আজই বিয়ে হবে। চলো।
বলেই নীরার হাত ধরে টানলো। নীরা হতভম্ব হয়ে গেল। সে চিৎকারও করতে পারছে না। তবুও দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
-হাত ছাড়ো নইলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
-আর কি খারাপ করবে। আমার ইমোশনসের কোনো দাম নেই তোমার কাছে তাই না? চলো আজ তোমার কোনো কথারও দাম নেই আমার কাছে।
বলতে বলতেই নীরাকে টেনে দরজার কাছে আনলো শিহাব। নীরা অবস্থা বেগতিক দেখে এবার রিকুয়েষ্ট করলো।
-শিহাব প্লিজ। হাত ছাড়ো। দেখো তুমি কিন্তু আমাকে অসম্মান করছো।
-সম্মান করে তো দেখেছি কোনো লাভ হয়নি। এবার একটু অসম্মান করেই দেখি।
শিহাবের কথা শুনে নীরা নিজের ভাষা হারিয়ে ফেললো। শিহাব নীরাকে এবার জোরে টেনে দরজার বাইরে নিয়ে গেল। এতে নীরা পায়ে একটু ব্যথা পেয়ে আওয়াজ করে উঠলো। তখনই শিহাবের হুস ফিরলো যে সে কি করতে যাচ্ছিলো। শিহাব দ্রুত নীরার হাত ছেড়ে দিলো। আর নীরার পায়ের কাছে বসে গেল। পায়ে হাত দিতে গেলেই নীরা দূরে সরে গেল। শিহাব জোর করে নীরার পা দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে বললো।
-আই এম স্যরি। স্যরি প্লিজ ক্ষমা করে দাও। খুব ব্যথা পেয়েছো তাই না? আই এম স্যরি।
নীরা শিহাবের হাত সরিয়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। তারপর বললো।
-দয়া করে যাও এখান থেকে। প্লিজ৷
শিহাব উঠে দাড়ালো। তারপর আবার নীরার হাত ধরলো। নীরা ভেবেছিলো শিহাব বোধ হয় চলে যাবে। কিন্তু সে গেলো তো না ই উল্টো আবার হাত ধরলো। হাত ধরে আস্তে আস্তে নীরাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো। তারপর বললো।
-আমরা আজই বিয়ে করবো।
-কিন্তু তোমার এই ব্যবহারের পরে আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। আমাকে কোনোকিছু বলোনি তুমি। কিচ্ছু না। আমাকে বিয়ে করার জন্য এতো মরিয়া কি করে হলে তুমি? যেখানে কয়দিন আগেও অন্য একজনের সাথে তোমার বিয়ের কথা চলছিলো।
– আচ্ছা আর এসব কি করে জানলে তুমি? ও আই সি বুঝেছি আমি। আগে তোমার ব্যবস্থা করে নেই তারপর বাকিটা দেখছি। আমি তোমাকেই বিয়ে করবো। আজ এই মুহূ্র্তে বিয়ে করবো। আর কিচ্ছু বলবে না তুমি।
শিহাবের কথা শুনে নীরা মাথা ধরে বসে রইলো।
শিহাব ফোন বের করতে করতে নীরাকে দেখলো।
–চলবে!