অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব-ছয়

0
1209

অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব-ছয়
নাফিসা নীলয়া।

-আপা নীরা তো প্রতিবন্ধীই তুমি যতোই মানতে না চাও এটাই তো সত্যি। আর কতোদিন তুমি তোমার মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখবে বলো? এবার তো বিয়ে দিতে হবে ওকে। তাছাড়া প্রতিবন্ধী একটা মেয়ে তারওপর ওই তো রূপের ছিড়ি। না আছে রূপ আর না অন্য কিছু।দুলাভাইয়ের কথা শুনে এসএসসির পরই নীরাকে বিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। আমি বলি কি আমার ননদের ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়ে দেই নীরাকে। রিশাদের তো তেমন দোষ নেই। ওই একটু মেয়েদের ওপর ঝোঁক ছিলো সেটা বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।

নিজের বোনের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মালিহা। আপন খালা হয়ে কিভাবে এসব বলতে পারে। নীরার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে ঠিক আছে। তাই বলে ওমন একটা নেশাখোর চরিএহীন ছেলের সাথে বিয়ে দিতে বলবে! নীরার একটা অক্ষমতাই কি ওর সব গুন কে চক্ষুগোচর করতে যথেষ্ট, জানা নেই মালিহার। রিশাদের ব্যপারে খুব ভালো করে জানেন মালিহা। যেই ছেলে এতোবছরেও শুধরায়নি দুইবার জেল পর্যন্ত খেটেছে মেয়ে কেলেঙ্কারিতে। সে আর বিয়ের পর কতোটুকু শুধরাবে।
এতক্ষন মিলা পাশে বসেই খালার কথাগুলো শুনছিলো। এই মুহূর্তে রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সামনের মহিলাটি তার খালা বলে ছেড়ে দিবে না সে।

-খালামনি, আমার আপাকে নিয়ে এতো চিন্তা কেন তোমার? নিজের মেয়েকে নিয়েই তো ভাবতে পারো তুমি। একমিনিট রিশাদের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দিলেই তো পারো । দুজনের জুটি একেবারে মিলে যাবে। আরে কিছুদিন আগে না তোমার মেয়ে হোটেলে ধরা খেয়েছে। রিশাদও তো এমন। দুজনকে তো পার্ফেক্ট মানাবে। এক কাজ করো তুমি তোমার মেয়ের সাথেই রিশাদের বিয়েটা দিয়ে দাও। ও ও তুমি কেন তোমার মেয়ের বিয়ে রিশাদের সাথে দিতে চাচ্ছো না এবার বুঝেছি। তোমার মেয়ের তো একজনকে দিয়ে হয় না। কয়দিন পরপর চেঞ্জ করার স্বভাব তার।

মিলার এমন ঠোঁটকাটা কথায় ধপ করে রেগে গেলেন সুফিয়া। নিজের মেয়ের বিষয়ে এই কথাগুলো শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন উনি।

-তোর এতবড় সাহস মিলা। তুই আমার মেয়েকে নিয়ে এতো বাজে কথা বললি। তা তোর বোন কোথাকার রাজকন্যা শুনি? ওই তো ল্যাংড়া পা প্রতিবন্ধী একটা। প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে এতো গর্ব তোর? হাজার চেষ্টা করলেও তোর বোন আমার মেয়ের মতো হতে পারবে না। আমার মেয়ের মতো সুন্দরী লাখে একটা হয়।

মিলা রেগে তার খালাকে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই তাদের বাবা রেজাউল এসে হাজির হলেন।

-আমার মেয়েকে নিয়ে তোমার এতো অসুবিধা কেন সুফিয়া? বারবার প্রতিবন্ধী শব্দটা উচ্চারন করে তুমি কি বুঝাতে চাইছো? আমার মেয়ের ওই একটা অক্ষমতা নিয়ে তুমি কি বুঝাতে চাও? আমার মেয়ে যেমনই হোক সে নিজেকে নিজে বানায়নি। আল্লাহ ওকে এমনভাবে তৈরি করেছেন। আর তোমার ভাষায় আমার মেয়ে প্রতিবন্ধী। হ্যা নীরা প্রতিবন্ধী তবে ও প্রতিবন্ধী হয়েও যেভাবে নিজের পায়ে দাড়িয়েছে তা কজন পারে বলতে পারো? আমার মেয়ের যেই যোগ্যতা আছে তার কানাকড়িও কি তোমার মেয়ের আছে? রূপ ছাড়া আর কি আছে তোমার মেয়ের? তাও তো কয়দিন পর নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে। তাহলে কিসের এতো দম্ভ তোমার? আমি কাউকে ছোট করতে চাইনি। তবে তুমিই আমাকে বাধ্য করলে এসব বলতে। দয়া করে আর কখনো আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে তুমি কথা বলবে না। ওর জন্য এখনো ওর বাবা আছে মা আছে। যে নিজের বোনের মেয়েকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলতে পারে। এমন বাজে ছেলের হাতে নিজের বোনের মেয়েকে তুলে দেওয়ার কথা বলতে পারে। আমার মেয়ের ব্যপারে কোনো প্রকার কথা বলার অধিকার তার নেই।

রেজাউলের বাক্যবাণে হতভম্ব হয়ে গেল সবাই। মালিহা আর মিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রেজাউলের কাছে তারা এই কথাগুলো যে কোনোদিন শুনতে পাবে সেই আশাই করেনি।

-দুলাভাই আপনি আমাকে এতো অপমান করলেন? তা মেয়ের প্রতি হঠাত এতো দরদ এলো কোত্থেকে? নিজেই তো একসময় ওকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন। আমিও দেখবো আপনার মেয়েকে কোন রাজপুএ বিয়ে করে। আপা আর আসবো না তোমার বাড়িতে। তোমার স্বামী আর মেয়ে মিলে আমাকে যেভাবে অপমান করলো। এরপরও তুমি একটা কথা বললে না।

কথা শেষ করেই ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন সুফিয়া। মালিহা কিছু বললেন না। যা বলার তার স্বামী আর মেয়েই বলে দিয়েছে। সে এখনো নিজের হতভম্ব ভাব কাটাতে পারছে না। রেজাউল তো নীরাকে দেখতেই পারতেন না। ছোটবেলা থেকে কতো অবহেলা করেছেন। এটা ঠিক নীরার বড় হওয়ার পর নিজের পায়ে দাড়ানোর পর অতীতের ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়েছেন তিনি। তবে মালিহা কখনো আশাই করেননি রেজাউল এভাবে নীরার হয়ে কথা বলবে। মিলাও চুপচাপ বসে আছে। হঠাত তার চোখ গেল নীরার ঘরের দরজায়।
দরজা ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে সে। আজ তার মাথা ব্যথা করছিলো আর উপরন্ত শুক্রবার ছিলো এজন্য সে তার ঘরে শুয়ে ছিলো। চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে সে দেখতে এসেছে বসার ঘরে কি হয়েছে। এসেই সে তার বাবার কথাগুলো শুনলো। সে ও কখনো আশা করেনি তার বাবা কখনো তার হয়ে কথা বলবে তার হয়ে স্ট্যান্ড নিবে। আজ নিজের চোখে দেখে তার কষ্ট সুখের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোনো এক বাঁধায় সে এগিয়ে যেতে পারছে না।

রেজাউল এতক্ষনে নিজেকে ধাতস্ত করতে পারলেন। তার মেয়েটাকে সে অনেক অনাদর করেছে। এতো কষ্ট পাওয়ার যোগ্য নীরা না। তার ভুলের ক্ষমা হয় না। সে অপরাধবোধে এখনো নিজের মেয়ের সামনে দাড়াতে পারে না। বুকের ভেতর অসহনীয় কষ্ট হয়। খুব ইচ্ছে করে নীরাকে মা বলে জড়িয়ে ধরতে তবে পারেন না। এখনো পারলেন না। চোখের কোলে পানি জমেছে তিনি এই পানি কাউকে দেখাবেন না। তাই তাড়াতাড়ি ঘরে চলে গেলেন তিনি।

মিলা দেখলো পরিস্থিতি কেমন থম মারা হয়ে আছে। তাই সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইলো।

-আম্মা আজ উইকেন্ড কি রান্না করবে তুমি? তুমি তো জানোই আমি ডায়েট করছি। তবে আজ আমি ডায়েটের নাম ভুলে গেলাম। আজকে এমন কিছু রান্না করো যেনো আমি চেটেপুটে সব একাই শেষ করে দিতে পারি। আর আপাকে একটুও দিবো না।

কথাগুলো বলে ফিক করে হেসে দেয় মিলা। মালিহা ও হেসে ফেলেন।

-হ্যা রে নীরা ওভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন? মাথা কি এখনো ব্যথা করছে? টিপে দিবো আমি?

নীরা এতক্ষন থম মেরে থাকলেও এবার হাসলো।

-না আম্মা এখন আর মাথা ব্যথা নেই। আজকে তুমি এমন কিছু রান্না করো যেনো আমিই সব খেয়ে ফেলি। মিলাকে আজ কিচ্ছু দিবো না।

নীরার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মিলা। মনে মনে ভাবলো যাক আপা একটু স্বাভাবিক হয়েছে।

-আপা নট ফেয়ার আমাকে দিবে না তুমি? এটা বলতে পারলে?

মিলার মুখ ফুলানো দেখে ধীরে ধীরে মিলার কাছে গেল নীরা। গাল টেনে আদর করে দিলো বোনকে। এলোমেলো চুল ঠিক করে দিতে লাগলো।

-আমার রাজকুমারী বোনকে না দিয়ে আমি কিভাবে খাবো মিলা? তুই তো আমার প্রাণ।

-রাজকুমারীর বোন তো রাজকুমারীই হবে তাই না আপা?

প্রশ্নটা করে নীরাকে জড়িয়ে ধরলো মিলা। নীরাও আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।

দুই বোনের ভালোবাসা দেখে অভিভূত হলেন মালিহা। তার মেয়ে দুটো একে অপরকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। বিয়ে হলে যে কি করবে আল্লাহ জানেন। ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে চলে গেলেন তিনি। রান্না করতে হবে আজ তিনি দুই মেয়ের প্রিয় খাবার রান্না করবেন।

-তিতলি আমার মনে হচ্ছে ভাই কিছুটা চেঞ্জ হয়েছে আগের থেকে। তোর কি মনে হয়? ইদানিং কেমন যেনো ওর অভ্যাসের বাইরের কাজগুলো করছে। কিছু একটা তো হয়েছেই ভাইয়ের।

রেহানের কথা শুনে তিতলিও দুশ্চিন্তায় পরে গেল। সে ও তার ভাইয়ের আচরনে কিছুটা চেঞ্জ দেখেছে। তার ভাই কি তবে প্রেমে পরলো! তার বান্ধবির কাছ থেকে সে শুনেছে একমাএ প্রেমে পরলেই মানুষের গতিবিধি তে বদল আসে।

-ছোট ভাই আমার কি মনে হচ্ছে বলতো! আমার মনে হচ্ছে ভাই প্রেমে পরেছে। ও মাই গড আমার ভাই প্রেমে পরেছে অথচ আমাকে বলছে না। এটা কি করে হতে পারে। আমি ভাইয়ের সাথে কথাই বলবো না তাহলে।

একটানা কথাগুলো বলে ফেললো তিতলি। রেহান বোনের ওপর বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা সবসময় দুই লাইন বেশি বোঝে। এখনো শিওর ই হওয়া গেল না ভাই প্রেমে পরেছে কিনা। তার আগেই কতো কি বলে ফেললো। আর সে শিওর তার ভাই প্রেমে পরেনি।

-তিতলি সারাদিন মাথায় শুধু প্রেম ঘোরে না তোর? এসব করতেই কলেজে যাস তুই? ভাইয়ের দ্বারা প্রেমে পরা পসিবল না। তারচেয়ে ভালো আমরাই ভাইয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিবো। ভাইয়ের প্রেমের আশায় থাকলে এ জনমে আর ভাবি পাবো না।

রেহানের কথায় রেগে গেল তিতলি।

-আমি কি তোর মতো অকর্মা? যে সারাদিন প্রেম ভালোবাসা নিয়ে থাকি। তুই আমাকে এসব বললি না? দাড়া আমি ভাইকে বিচার দিবো। এবার তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

-আচ্ছা, তো ভাইকে কি বলবি? আমরা তোর প্রেমে পরা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমি বলছিলাম তুই প্রেমে পরেছিস। ছোট ভাই আমাকে এজন্য উল্টাপাল্টা বলেছে। এটা বলবি? গাঁধি।

নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো শেষ করে তিতলির মাথায় হালকা বারি মারলো রেহান।

তিতলি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবছে কি বলবে। কিভাবে ভাইয়ের কাছ থেকে কথা বের করবে। কি হয়েছে তার ভাইয়ের সেটা তো জানতে হবে।

-তোমরা দুইজন কি গল্পই করতেই থাকবে? খাবে না আর? শিহাব নিচে এসে কখন থেকে বসে আছে তোমাদের জন্য।

জহুরা খালার কথায় ধ্যান ভাঙ্গে দুই ভাই-বোনের। জহুরা তাদের বাড়িতে বহুবছর যাবত আছেন। রান্নাবান্না সহ বাড়ির দেখাশোনা উনিসহ আরো একজন করেন।

-চল বকবকানির রানী।

তিতলি রেহানের কথায় ভেঙ্চি কাটে।

-এতোক্ষন কি করছিলি তোরা? খাওয়াদাওয়া লাগবে না নাকি দুজনের?

শিহাবের কথায় দুজনেই চুপ করে বসে পরলো। খাওয়া শুরু করলো তিনজনে।

-বাবার ট্যুর কবে শেষ হবে রেহান?

খেতে খেতেই প্রশ্নটা করলো শিহাব।

-আর দুই দিন পরে শেষ হবে। জানোই তো বাবা ট্রাভেল করতে কতোটা ভালোবাসে।

রেহানের কথায় ছোট করে হাসলো শিহাব।

-ভাই, এই কথাটা ছোট ভাইকে না বলে তুই তো বাবাকেই বলতে পারতি। বাবার সাথে এতো কম কথা বলিস কেন তুই? একটু চেষ্টা কর দেখবি আর জড়তা কাজ করবে না।

তিতলির হঠাত কথায় কয়েক পলের জন্য থমকে গেল শিহাব। তারপর পুনরায় খাওয়া শুরু করলো।

-আচ্ছা ভাই আমি কি ভাবছি বলো তো। এইবার তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো আমরা। আর কতোদিন ভাবিহীনা থাকবো। এবার কোনো কথা শুনবো না। বাবা এলেই তোমার বিয়ের কথা তুলবো।

রেহানের কথা শুনে বিষম উঠে গেল শিহাবের। তিতলি উঠে গিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুঝাচ্ছে। তিতলি বুঝতে পারছে না। তার ভাইয়ের কি এটা নতুন রোগ হয়ে গেল কথায় কথায় বিষম খাওয়া। হায় হায় তাহলে তো তার ভাইকে ইমিডিয়েট ডাক্তার দেখাতে হয়।

-ভাই আমার মনে হচ্ছে তোর বিষম খাওয়া রোগ হয়ে গেছে জলদিই ডাক্তার দেখাতে হবে। পরে যদি এই রোগ বিরাট আকার ধারন করে।

তিতলির কথায় রেহান আর জহুরা জোরে হেসে ফেললো। জহুরা দেখতে এসেছিলেন কারো কিছু লাগে কিনা।

-আল্লাহ তিতলি এগুলা কি বলো তুমি? বিষম খাওয়া রোগ আছে নাকি আবার? এমনিই বিষম খেয়েছে শিহাব।

হাসতে হাসতে বললেন জহুরা।

-গাঁধা একটা। খালা বোঝাও গাঁধিকে বিষম খাওয়া কোনো রোগ হয় না।

রেহানের কথায় রেগে গেল তিতলি।

-ভাই তুই কিছু বলবি না ছোট ভাইকে? ও আমাকে গাঁধা বলছে। ও নিজেই তো একটা গাঁধা।

-রেহান তিতলিকে গাঁধা বললি কেন? চুপচাপ খা কোনো কথা বলবি না।

-এখন তুই ঠিক আছিস ভাই?চল আজ বিকালেই ডক্টরের এপোয়েনমেন্ট নিয়ে রাখি। আমি অনেকদিন ধরে লক্ষ করছি তুই নিজের দিকে একদম নজর দিস না। আমি আর তোর না শুনছি না।

-আরে কিছুই হয়নি আমার। শুধু শুধু ডক্টরের কাছে কেন যাবো তিতলি। তুই চুপ করে বস তো এবার। খাওয়া রেখে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছিস তুই। আজব!

ভাইয়ের কথায় এবার তিতলি কিছুটা শান্ত হলো। তিনজন একসাথে নানা কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করলো। তিন-ভাই বোনের একজনের প্রতি আরেকজনের এমন টান দেখে মুগ্ধ হন জহুরা। ওদের ছোটবেলা থেকেই তিনি এখানে আছেন। যখন থেকে ওদের মা নেই তখন থেকে। ওদের দেখাশোনা উনিই করতেন। তিন ভাই বোন একে অন্যের প্রবলেম বুঝতো। মা না থাকায় নিজেরাই নিজেদের দেখে শুনে রাখতো। শিহাব, রেহান তখন একটু বড়ই ছিলো। তিতলিটা তো একেবারে দুধের বাচ্চা ছিলো। দুই ভাই কি সুন্দর না বলতেই তিতলির খেয়াল রাখতো। তিতলি বড় হওয়ার পর ও নিজেও দুই ভাইয়ের খেয়াল রাখা শুরু করলো। তিন ভাই বোন ওনাকেও কোনো অংশে কম আপন মনে করে না। কিছু হলেই জহুরা খালা করে করে পাগল করে দেয়। এতো ভালো ছেলে-মেয়েদের ছেড়ে অন্য লোকের সাথে ঘর বাঁধতে কি একবারো বুক কাপেনি ওদের মায়ের! প্রশ্নটা মনে আসলেই ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয় জহুরার। মনে মনে প্রার্থনা করেন তিন ভাই -বোন যেনো আজীবন এমনই থাকে।

-দাদী তোমার শরীর কেমন এখন?

নীরা প্রশ্ন করলো তার দাদীকে। আজ শুক্রবার হওয়ায় সবাই একসাথে খেতে বসেছে। নীরার দাদীও আজ সবার সাথে আছেন।

-আল্লাহ যেমন রেখেছে। তুই কই থাকিস সারাদিন? এত ছোটাছুটি করলে কি হয়? বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। দুই দুইজন বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে ঘরে। একজনের ও বিয়ে হলো না। বলি মরার আগে কি কারো বিয়ে দেখতে পারবো না? বউমা এখন তো নীরার আর কোনো বাঁধা নেই। এখনো নীরাকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছো না কেন?

নীরার দাদী নিজের পূর্বের আচরণের জন্য অনুতপ্ত হলেও শিকার করেন না। তার মতে মেয়ে মানুষের তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়াই ভালো। এতো লেখাপড়া চাকরিবাকরি করা লাগে না। আগেকার দিনের ধ্যান ধারনা এখনো মনে পুষে রেখেছেন তিনি।

-আম্মা নীরার মতামত থাকলে আমরা এগোবো এই ব্যপারে। তার আগে না। আর বিয়ে ছাড়াও মেয়েদের করার মতো আরো অনেক কাজ আছে। তবুও আল্লাহ রিজিকে রাখলে বিয়ে অবশ্যই হবে। আর তোমার কিছু হবে না। আল্লাহ কপালে রাখলে তুমি নিশ্চয়ই নীরার বিয়ে দেখতে পারবে। তোমার বাদবাকি নাতি নাতনিদের বিয়ে তো দেখতে পারছো। ওদেরও পারবে।

একটানা কথাগুলো বলে থামলেন রেজাউল। মালিহা,নীরা,মিলা তিনজনই আজ অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে।

-যা ভালো বুঝিস কর। বুড়ো হয়ে গেছি এখন আর আমার কথা শুনবিই বা কেন। বউমা আমাকে একটু ঘরে দিয়ে আসো। বিশ্রাম নিবো।

শাশুড়ির কথায় হকচকিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে আসলেন মালিহা শাশুড়িকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে লাগলেন।

-আব্বা চিংড়ি মাছের ডিসটা নাও। আমি রান্না করেছি এটা।

খুশি মনে বললো নীরা। রেজাউল নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। যার মানে তিনি নিবেন। নীরা খুশি মনে বাবার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে।

-জানো আব্বা আম্মা তো আপাকে আজ রান্না করতেই দিবে না। তবুও আপা জোর করে এটা রান্না করেছে। তুমি পছন্দ করো বলে।

হাসতে হাসতে বললো মিলা। রেজাউল চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। তার মেয়ের হাতের রান্না খুব মজা। এর আগেও নীরা রান্না করতো তার জন্য কিন্তু কখনো বলতো না যে সে নিজে রান্না করেছে। তবে রেজাউল বুঝে যেতেন যে এটা তার মেয়ের হাতের রান্না। আজ নীরা নিজ থেকেই বললো সে রান্না করেছে। আনন্দ হচ্ছে তার কিন্তু প্রকাশ করছেন না। তবে তিনি বোধ হয় জানেন না তার তৃপ্তিকর চেহারা দেখে দুই বোন যা বোঝার বুঝে গেছে।

-আম্মা তাড়াতাড়ি আসো। তোমার তো খাওয়াই হয়নি।

জোরে হাঁক ছেড়ে মাকে ডাকলো নীরা।

-এইতো আসছি।

মালিহা এসে পুনরায় টেবিলে বসলেন। বাবা মায়ের সাথে দুই বোন খাওয়া শেষ করলো।

-আম্মা বিকেলে শপিং করতে গেলে কেমন হয়?

খাওয়ার পর তিন মা বোন গল্প করছিলো। তখন মিলা প্রসঙ্গ তুললো।

-হ্যা মিলা মেক-আপ আইটেম এর লিস্ট শাড়ির লিস্ট ও নিশ্চয়ই করা শেষ তোর? তোকে নিয়ে আর পারলাম না। সেদিন ও না শপিং করলি। এতো অপচয় করা ঠিক না মিলা।

মায়ের কথায় নিঁভে গেল মিলা। তার সাজগোজের ঝোঁক বেশি হওয়ায় শুধু শপিং করতে ইচ্ছে করে।

-সত্যিই মিলা এতো অপচয় করা কিন্তু ঠিক না। তুই তো সব পাচ্ছিস আল্লাহর রহমতে। কিন্তু তাদের কথা ভাব যারা দুইবেলা খেতে পর্যন্ত পায় না। পরার পোশাক পর্যন্ত পায় না। আমাদের যাদের সামর্থ আছে তাদের আয়ের পাঁচ শতাংশ হলেও এমন মানুষদের দেওয়া উচিত যারা খেতে পায় না। যাদের আয় কম। বুঝেছিস? এটাই উচিত। আল্লাহ এটাই বলেছেন। অতিরিক্ত অপচয় করা আল্লাহ ও পছন্দ করেন না। আমার বোন তো অবুঝ না। সে তো সব বুঝে তাই না?

নীরার কথায় নিজের ভুল বুঝতে পারলো মিলা। সে মনে মনে অনুতপ্ত হলো। আসলেই তো সে তো আল্লাহর রহমতে সব পাচ্ছে। কিন্তু যারা খেতেও পায় না রাস্তায় থাকে তারা! সেদিকে তাকালে তো শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

-আমি সত্যিই স্যরি আপা। আমারই বোঝা উচিত ছিলো। আমার সব জিনিস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আর শপিং করবো না।

মিলার কথায় মালিহা প্রশান্তির হাসি দেন। তিনি জানেন একমাএ নীরার কথাই মিলা বুঝবে। তিনি মা হলেও মিলার সবকিছু নীরা দেখতো। মিলা ও কিছু হলেই আগে তার আপার কাছে যাবে৷ এজন্যই বুঝি বলে বড় বোন মায়ের সমান। মায়ের প্রতিচ্ছবি।

-মিস ও বোধ হয় লিখতে পারছে না। দেখো তো ওর কি হয়েছে।

আজ মর্নিং শিফটের ক্লাস করাচ্ছে নীরা৷ তখনই একটা বাচ্চা মেয়ে তার বন্ধুর সমস্যার কথা বললো। নীরা সামনে এগিয়ে দেখলো বাচ্চা মেয়েটা আসলে লিখতে চাইছে না। মেয়েটার জন্মগতভাবে একটা হাত অকেজো। সে তার বাম হাত দিয়ে লিখে। নীরা বাম হাত দিয়েই লেখানো শিখিয়েছে। স্পেশাল চাইল্ডদের সামলানোর চমৎকার গুন রয়েছে নীরার। হয়তো সে নিজেও তাই বলেই। স্পেশাল চাইল্ডদের প্রতি অন্যরকম টান কাজ করে তার।

-মিশমি হোয়াট হ্যাপেন্ড? কি হয়েছে তোমার লিখতে চাইছো না কেন তুমি? আমাকে বলতে পারো মিশমি। আমি সমস্যা সমাধান করে দিবো।

-আব্বু আম্মু আমাকে কম ভালোবাসে মিস। আমার ছোট বোনকেই সব এটেনশন দেয়। আমাকে দেয় না। আমার একটা হাত নেই বলেই এমন করে তাই না?

মিশমির কথায় একটু থমকালো নীরা। পরক্ষনেই কিছু একটা ভাবলো।

-তোমার বোনের বয়স কতো মিশমি? সে কি খুব বড়?

-নো মিস ও তো একটা পুতুল। এইটুকু পুতুল। ওকে তো সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখতে হয়।

পরক্ষনেই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল নীরার কাছে। বাচ্চা মেয়েটা তাহলে এই বিষয় নিয়ে মন খারাপ করছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারে নতুন বাচ্চা এলে তাকে সবাই একটু বেশি এটেনশন দেয়। নতুন সদস্য এজন্যই। এটাই অনেক বাচ্চাদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। অনেক নরমাল বাচ্চাই মনে করে এখন নতুন বোন বা ভাই এসেছে আমাকে সবাই কম ভালোবাসবে। সেখানে তো মিশমি স্পেশাল চাইল্ড। তবে প্যারেন্টসদেরও উচিত ওদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলা। আর খেয়াল রাখা। বিশেষ করে স্পেশাল চাইল্ডের প্যারেন্টসদের।

-দেখো মিশমি তোমার বোন তো খুব ছোট ওকে তো সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখতে হয়। তুমিই তো বলেছো তাই না?এতটুকু বেবিকে তো সবসময় দেখেই রাখতে হয়। ও তো খুব ছোট নিজের ওপর নির্ভর করতে পারে না। তুমি তো বড় তাই না মা? তোমার তো এখন কাউকে লাগে না তুমি নিজের কাজ নিজে করো। এজন্যই তোমাকে কম এটেনশন দেওয়া হয়। বোন তো ছোট ও তো পারে না তাই বেশি এটেনশন দেওয়া হয়।

নীরার কথায় মাথা দোলালো মিশমি।

-আমরা তোমাদের কি শিখিয়েছি বলো তো?

-কষ্ট হলেও নিজের কাজ নিজে করতে শিখিয়েছো মিস। আর যেটা দেখবো একেবারেই পারছি না বা আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে তখনই সাহায্য নিতে বলেছো। কেউ কোনো কাজ না পারলে তাকেও সাহায্য করতে বলেছো।

-এক্স্যাক্টলি তো তুমি তো বড় নিজের কাজ নিজে করো। কিন্তু তোমার বোন তো ছোট। সে হাটতে পারে না বসতে পারে না। এইটুকু একটা ডল। তাকে তো সবারই বেশি এটেনশন দেওয়া উচিত তাই না? নইলে সে বড় হবে কি করে? তাকে যত্ন না করলে সে তো দ্রুত বড় হতে পারবে না। ছোটবেলায় তোমাকেও এমন যত্ন করা হতো। এখানে মন খারাপ করার কোনো বিষয় নেই মা। আমি কি বুঝাতে পেরেছি।

-ইয়েস মিস। আমি বুঝেছি।

-তাহলে হাসো এখন আর তুমিও বাড়িতে গিয়ে বোনের খেয়াল রাখবে ওকে মা?

-ওকে মিস। থ্যাংক ইউ আমাকে বোঝানোর জন্য। আমিও বাড়ি গেলে বোনের খেয়াল রাখবো।

মিষ্টি হেসে বললো মিশমি। পুনরায় খাতায় লিখতে লাগলো সে। নীরা হেসে বাকি বাচ্চাদের দিকে গেল। সবাইকে পর্যবেক্ষন করলো। সমস্যা সমাধান করতে লাগলো।

-নীরা ম্যাম আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।

ব্রেক টাইম হওয়ায় টিচারস রুমে এসেছিলো নীরা। তখনই জিনিয়া এসে তাকে খবর দিলো। নীরা ভাবলো মিলা হয়তো।

-মিলা নাকি জিনিয়া? বসতে বলো ওকে আমি ড্রয়ারটা লক করেই আসছি।

-না,মিলা না ম্যাম একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তিনি ওয়েট করছেন আপনাকে যেতে বললেন।

জিনিয়ার কথা শুনে একটু অবাক হলো নীরা।

-আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।

আজকে রুমা ও আসেনি স্কুলে। নীরা ধীরে ধীরে হেটে যেতে লাগলো গেস্ট রুমে।

শিহাব হুট করেই নীরার সাথে দেখা করতে চলে এলো। সে নীরার সোশ্যাল একাউন্ট স্টক করে ডিটেইলসে স্কুলের নামটা দেখে নিয়েছে। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে নীরার সাথে তার দেখা হয়নি৷

-আপনি এখানে? আমার কাছে এসেছেন?

শিহাবকে দেখে অবাক গলায় প্রশ্ন করলো নীরা। সে বুঝতে পারছে না তার সাথে শিহাবের কি কাজ! শিহাব নীরাকে দেখে দাড়িয়ে গেল। সে এসে তো পরেছে। এবার কি বলবে। কেন এসেছে সে। পরক্ষনেই চট করে একটা আইডিয়া মাথায় এসে গেল শিহাবের।।

-কেমন আছেন নীরা?

-কেমন আছি এটা জিজ্ঞেস করতে এসেছেন?

নীরা হেসে বললো শিহাবকে। শিহাবও একটু হাসলো।

-না স্কুলে ডোনেশন দিতেও এসেছি।

-তাই? কিন্তু জানলেন কি করে আমি এখানে পড়াই?আর ডোনেশনের ব্যপারে তো আমি কাজ করি না। অফিসকক্ষে গিয়ে ডিসকাস করতে হয়।

নীরার একের পর এক কথায় হকচকিয়ে গেল শিহাব। আসলেই তো এটা তো তার মাথায় আসে নি এবার কি বলবে সে। এখন মনে হচ্ছে হুট করে আসাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কি করবে সে হঠাত নীরাকে দেখতে মন চাইলো যে। খানিকখন এদিকওদিক তাকালো সে। কিছু একটা ভাবলো।

-রেহান, আমার ভাই ও বলেছে। আরকি ও আপনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলো করে তো সেখান থেকেই জেনেছে। আরকি।

কোনোমতে বলে ফেললো শিহাব। এখন নীরাকে বলা যাবে না সে ও নীরাকে ফলো করে। তাহলে সব ওলটপালট হয়ে যাবে। রেহানের ব্যপারটাও আন্দাজে বলেছে সে। তার উপস্থিত বুদ্ধি চমৎকার। তবে নীরার সামনেই সব ওলটপালট হয়ে যায়। এখন সে নিশ্চিত এই বুদ্ধিটা কাজে দিবে।

-ও আচছা।

হেসে বললো নীরা। নীরার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিহাব।

-তো অফিস-রুমে যোগাযোগ করবেন ঠিক আছে?

-আপনি যদি হেল্প করতেন।
একটু আমতা আমতা করে বললো শিহাব।

-আচ্ছা আমার সাথে আসুন।

নীরা বের হওয়ার জন্য ফিরলো। শিহাব ও নীরার পিছে পিছে গেল।

-পেছনে কেন পাশে হাটুন।

সহজ হয়ে বললো নীরা। এতে শিহাবের মনে হলো সে একটা মধুর বাক্য শুনেছে। তার এতো কষ্ট স্বার্থক। এতো ছলছাতুরি সব স্বার্থক। তার গোটা জীবনটাই স্বার্থক। সে তাড়াতাড়ি নীরার পাশে হাটতে লাগলো।

–চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here