অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব-তেরো
নাফিসা নীলয়া!
আজকে রুমা আর সাইফের বিয়ে। সকাল সকাল সবাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে হওয়ায় সব একেবারে জমজমাট অবস্থা। বিয়ে পড়ানোর পর কনে বিদায় হবে। আর রিসেপশন আগামীকাল সাইফের বাড়িতে হবে। মিলা আর তিতলি সকাল থেকে রুমাকে নিয়ে পরেছে দুজন পারছে না যে সকাল সকালই রুমাকে বউ সাজিয়ে বসিয়ে রাখতে। রুমা এখন বিরক্ত হচ্ছে। কেন যে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। বিয়ে না করলে তো এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না। নীরা তিতলি আর মিলার কান্ড দেখে হাসছে। রুমার বিরক্তমাখা মুখ দেখে তার আরো হাসি পাচ্ছে।
-নীরা এদিকে শোন তো?
নীরার মা মালিহা সকাল সকালই এসে পরেছেন। রুমা রেগেমেগে তাকে ফোন করে সকাল সকালই আসতে বলেছে। এ ও বলেছে তার মালিহা আন্টি না আসলে সে বিয়ে করবে না। এজন্য মালিহা এসে পরেছেন। নীরার দাদীকে দেখে রাখার জন্য বুয়াকে বলে এসেছেন। নীরার বাবাকেও অনেকবার আসতে বলেছেন। কিন্তু তিনি আসেননি।
-হ্যা আম্মা বলো।
নীরা তার মায়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো।
-বলছি এখনো তো খাওয়া হয়নি কারো। রুমাটা তো এতো ঝামেলায় পরে আর খেতেই পারবে না। ওকে নিয়ে চল।ও বলছিলো আজ সকালে সবার সাথেই খাবে।
-আচ্ছা। আম্মা তুমি যাও আমি ওদের নিয়ে আসছি।
মালিহা চলে গেলেন। নীরা ঘুরে দেখলো মিলা আর তিতলি রুমাকে এখনো জ্বালাচ্ছে। নীরা ওদের ধমক লাগালো। তারপর সবাইকে নিয়ে একসাথে নিচে খেতে নামলো।
শিহাব রা সবাই বসেই ছিলো আগে থেকে। নীরারা ও এসে পরলো। মালিহা রুমার মায়ের সাথে সব তদারকি করছেন। শিহাব উঠে গেল তার খেতে ভালো লাগছে না। সাধারণত এতো সকালে সে খায় না। সে একটু দূরে দাড়িয়ে ফোন ঘাটতে লাগলো।
মালিহা দেখলেন সবাই বসে গেছে। শিহাবই বসেনি। উনি শিহাবকে ডাকলেন।
-সবাই তো ওখানে। তুমি একা এখানে কি করছো? খেয়ে নাও বাবা পরে আবার সেই দুপুরে খেতে হবে। তারচেয়ে ভালো এখনই খেয়ে নাও।
শিহাব চোখ তুলে তাকালো। বহুদিন তাকে কেউ এমন স্নেহভরা কন্ঠে খেতে ডাকেনি। এতো মমতা মাখা কন্ঠ বহুদিন পর সে শুনলো। তার ভেতরটা ভরে গেল। সে এখনো জানে না মালিহা নীরার মা। তবে সে মালিহার কথা ফেলতে পারলো না। সবার সাথে গিয়ে টেবিলে বসলো।
-আম্মা তুমি কই ছিলে এতক্ষন? দেখো রুমা আপা নাকি এবার তোমার হাতেও খাবে। আশ্চর্য দুই আন্টির হাতে খেয়ে এখন আবার আমার আম্মার হাতেও খেতে হবে ?
মিলার এমন কথায় সবাই হাসতে থাকলো। শিহাব চমকে তাকালো। মিলা মালিহাকে আম্মা বলছে তারমানে উনি নীরার মা। তাই তো এতো সুন্দর মমতাময়ী। এবার বুঝলো শিহাব।
-আমার ছেলের বউকে নিয়ে এরকম বলা তোমার একদম ঠিক হয়নি মিলা। এরপর তো ও বাড়ির বউ হয়ে যাবে। বাড়ির মেয়ে হিসেবে খেয়ে নিক না।
হাসতে হাসতে বললেন সাইফের মা।
-হ্যা আন্টি তাই বলে হবু শাশুড়ীর হাতেও খাবে আবার আমার আম্মার হাতেও খাবে। বাহ্!
মিলার কথায় রুমা কিছু বলতে পারছে না। সে বিয়ের কনে তাই চুপ করে আছে। নইলে মিলাকে এখনই একটা চড় দিতো।
সাইফ চুপ করে আছে। সবাই মিলে রুমাকে প্যাম্পার করছে। তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেসই করছে না।
-সাইফ ভাই,দেখলে সবাই রুমা আপুকে কতো আহ্লাদ করছে। তোমাকে কেউ দেখছেই না। এজন্যই বিয়ের আয়োজন একসাথে করা উচিত হয়নি তোমার। আলাদা করে হলে এখন এসব দেখতে হতো না।
সাইফের গোমড়া মুখ দেখে হাসতে হাসতে পিঞ্চ মেরে বললো রেহান। তবে সাইফের গোমড়া মুখ বেশিক্ষন রইলো না। কারন ইতিমধ্যে রুমার মা আর নীরা তাকে আদর আপ্যায়ন করা শুরু করে দিয়েছে।
সাইফ এবার রেহানের কানে কানে বললো
-দেখলি বিয়ের আগেই কেমন জামাই আদর পাচ্ছি। বাহ্। কি খাতিরদারি।
সাইফের কথা শুনে হাসতে থাকলো রেহান। রুমা নীরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। নীরা তো তার বেস্ট ফ্রেন্ড অথচ দেখো সব এটেনশন সাইফকেই দিচ্ছে। সে বিয়ের কনে বলে কিছু বলতেও পারছে না। নীরা আর সাইফ রুমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আরো আহ্লাদ করা শুরু করলো।
-থাক আপু আর রাগ করে থেকো না। আমিই তোমাকে আপ্যায়ন করছি।
রুমার রাগী ভাব দেখে হাসতে হাসতে বললো তিতলি। এবার রুমাও হেসে ফেললো।হাসি ঠাট্টা করেই সবাই খাওয়া শেষ করলো।
রুমাকে বউ সাজানোর দায়িত্ব আজও মিলার। তিতলিও সাহায্য করছে। রুমার পছন্দ অনুযায়ী লাল বেনারসি ই পরেছে সে। নীরা ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো রুমাকে এখনো সাজানো চলছে। সে আবার সাইফের কাছে গেল।
সাইফের কাজিনরা সাইফকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে রেহান। আর শিহাব গম্ভীর মুখে ফোন চাপছে। যেনো এই দুনিয়ার কোনোকিছুতে তার খেয়াল নেই। সব খেয়াল ওই ফোনেই আছে। নীরা কাশি দিয়ে ঘরে ঢুকলো। সাইফ সবাইকে চুপ করতে বললো।
-কিরে জামাই রাজা এখনো তৈরি হসনি?
-হচ্ছি তো নীরা। তুই কিন্তু আমার প্রশংসাই বেশি করবি বলে দিলাম।
-তুই কিন্তু খুব হিংসুটে হচ্ছিস সাইফ।
হাসতে হাসতে বললো নীরা। সাইফের কাজিনরা আর ওদের বন্ধুরাও হাসলো। শিহাব এমন একটা ভাব করলো যেনো সে এই দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ। নীরা শিহাবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো আজব মানুষ। আমার সামনে আসলে এক। আর সবার সামনে আরেক!
সাইফ গোল্ডেন রঙের শেরওয়ানি পরেছে সাইফকে খুব সুন্দর লাগছে। নীরার খুব ভালো লাগছে। তার এই দুই বন্ধু তার আত্মার এক অংশ। তাদের পরিণয়ে নীরার মন প্রান খুশিতে উপচে পরছে।
সবাই তৈরি হয়ে গেছে। মিলা আজ শাড়ি পরবে না বলে ঠিক করলো। নীরা শাড়ি পরবে না তাই আজ সে ও শাড়ি পরবে না। নীরা তাকে বারবার বলেছে কিন্তু মিলা তো মিলাই সে কারো কথাই শুনেনি। দুই বোন খয়েরি রঙের থ্রি-পিস পরেছে। দুজনকে একদম টুইন সিস্টারের মতো লাগছে। নীরা আর মিলার চেহারায় অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। তিতলি সুন্দর করে শাড়ি পরেছে। তাকে এখন প্রাপ্তবয়স্ক লাগছে।
রুমা তৈরি হয়ে বসে আছে। তার পরনে সুন্দর লাল বেনারসি। মাথায় ওড়না খোপায় ফুল। হালকা স্নিগ্ধ বাঙালি বউয়ের সাজ। এতেই চারদিক ঝলসে যাচ্ছে। নীরা মুগ্ধ হয়ে তাকালো। তার কেন জানি কান্না পাচ্ছে। তার সবসময়ের সাথী। তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবি। বান্ধবির চেয়ে দুজনকে বোনই বলা যায় বেশি। তার আজকে বিয়ে। নীরা ভাবতে পারছে না। খুশিতে তার চোখ ছলছল করছে। রুমা লক্ষ করেছে নীরার চোখে পানি। তার ও খুব কষ্ট হচ্ছে সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে তাই। নীরা রুমার কাছে এগিয়ে গেল। রুমাকে জড়িয়ে ধরে বললো
-এই দিনটার জন্য আমি কতো অপেক্ষা করেছি জানিস? আজ আমার মতো খুশি বোধ হয় কেউ নেই। এতোদিন পর তোরা দুজন এক হচ্ছিস।
-হু তুই তো আমাকে দেখিসই না। সবসময় সাইফ সাইফ করিস। এখন আহ্লাদ করতে আসছিস।
অভিমানী কন্ঠে অভিযোগ করলো রুমা। নীরা হেসে ফেললো। দুই বান্ধবির এতো মিল দেখে মালিহারও খুব ভালো লাগলো। তিনি ওদের ডাকতে এসেছিলেন। এসেই এই দৃশ্যের সাক্ষী হলেন।
-নীরা এবার রুমাকে নিয়ে চল। বিয়ে পড়ানোর সময় হয়ে গেছে। ওদিকে ওরা সবাই অপেক্ষা করছে।
মালিহার কথায় ধ্যান ভাঙলো দুজনের। রুমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পুরোটা সময় রুমা নীরার হাত ধরে ছিলো। মালিহা রুমার কান্ড দেখে হেসে ফেললেন।
সাইফ রুমাকে দেখে স্থির হয়ে গেল। তার এতোদিনের সাধনা পূরণ হচ্ছে। ভালোবাসাকে জয় করার সুখে ভরে যাচ্ছে মন। এতো বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটছে। রেহান সাইফকে টিপ্পনী কাটলো। তবুও সাইফের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। শিহাব এদের কান্ড দেখে হেসে ফেললো। ভালোবসলে কি সবাই এমন বেহায়া হয়ে যায় ভাবলো শিহাব।
তিতলি জোরে সাইফের হাতে চিমটি কাটলো। তখন সাইফের হুস ফিরলো।
-সাইফ ভাই দেখার আরো অনেক সময় পাবে।আগে বিয়ে তো পড়াতে দাও।
তিতলির কথায় সাইফ খুব লজ্জা পেলো। রুমাকে নিয়ে আসা হলো। মিলা আর নীরা রুমার পাশে ছিলো। রুমা তখনো নীরার হাত শক্ত করে ধরে আছে। বিয়ে পড়ানো শুরু হলো কালেমা পড়ানো হলো। কবুল বলার সময় সাইফ নীরার দিকে তাকালো। নীরা হেসে ইশারা করলো। সাইফ হেসে একদমে কবুল বলে ফেললো। রুমা কবুল বলার সময় নীরার হাত ধরে কাঁদতেই থাকলো। শেষে নীরার ধমক শুনে কবুল বলে ফেললো।
তখন মিলা হাসতে হাসতে বললো।
-তোমার কোনো কাজই আপাকে ছাড়া হয়না।
বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। রুমা নীরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। নীরারও কান্না পাচ্ছিলো তবে সে কাঁদলো না। রুমা আর সাইফকে একএে বসানোর পর ফটোসেশন হলো মজা হলো সবই হলো।
সাইফ নীরার হাত ধরলো।
-তোকে আমি থ্যাংক ইউ বলবো না। শুধু বলবো সারাজীবন এভাবেই আমাদের পাশে থাকিস আগলে রাখিস।
নীরা তখন হেসে ফেললো। সবাই মুগ্ধ হলো ওদের এতো সুন্দর বন্ডিং দেখে।
রেহান এদিকওদিক ফ্ল্যার্ট করছে মেয়েদের সাথে।
-ইউ লুকিং সো বিউটিফুল। তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করা যাবে?
একটা মেয়েকে হাসতে হাসতে বললো রেহান। মেয়েটা লজ্জা পেলো অনেক। তখনই তিতলি আসলো রেহানের কাছে।
-আরে ছোট ভাই তুই এখানে? ওদিকে তোর বউ তোকে ডাকছে। তোর বাচ্চাটা কখন থেকে কাঁদছে।
রেহান হতভম্ব হয়ে গেল। মেয়েটাও বিস্ময় নিয়ে তাকালো রেহানের দিকে।
-আপনি ম্যারিড? আবার বাচ্চাও আছে?
রেহান অনেকবার না করলো কিন্তু মেয়েটা বিশ্বাস করলো না। চলে গেল। এবার রেহান তিতলির দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকালো। তিতলি এক ছুট দিতে চাইলো রেহান হাত ধরে ফেললো।তারপর তিতলির কান মলে দিলো। মিলা তখন তিতলিকে ডাকতে আসছিলো। তিতলি মিলাকে দেখতে পেয়ে ডাকলো। মিলা এগিয়ে গেল ওদের দিকে।
-আপু ছোট ভাই বলেছে তোমাকে নাকি আজকে পেত্নীর মতো লাগছে।
তিতলির এমন কথা শুনে রেহান আর মিলা দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেল। তিতলি দুজনের মধ্যে প্যাচ লাগিয়ে দিয়ে দৌড় লাগালো। এদিকে মিলা আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকালো রেহানের দিকে। রেহান অসহায় হয়ে তাকালো।
-বিশ্বাস করো টিলা আজ তোমাকে সুন্দর লাগছে। আমি পেত্নী বলিনি। আমি তো তোমাকে মালিকা হামিরার মতো লাগছে বলতে চেয়েছি।
মিলাকে আরো রাগিয়ে দিলো রেহান। সে ভেবেছিলো মালিকা হামিরা যে আলিফ লায়লার ডাইনির নাম সেটা বোধ হয় মিলা জানে না। কিন্তু মিলা তো জানে। এবার মিলা রাগে রেহানের হাতে জোরে চিমটি কাটলো।
-অসভ্য বেয়াদব ছেলে জীবনে তুমি শুধরাবে না তাই না? আস্ত বেয়াদব একটা।
বলে যাওয়ার সময় হিল দিয়ে রেহানের পায়ে ইচ্ছে করে জোরে পারা দিলো মিলা। রেহান ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। তারপর আবারও হেসে ফেললো।
বিদায়ের সময় হয়ে গেছে। নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। রুমা একে একে সবাইকে ধরে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে বেহাল অবস্থা হয়ে গেছে তার। সাইফেরও কান্না পাচ্ছে। রুমার কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। শেষে রুমা নীরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা শুরু করলো। নীরাকে সে ছাড়তেই চাচ্ছে না। নীরা বহু কষ্টে কান্না থামিয়ে রেখেছে। রুমার কান্না দেখে তিতলি ও কেঁদে দিয়েছে শিহাব তিতলিকে কান্না করতে না করছে। তবুও সে কেঁদেই যাচ্ছে। রেহানের হাসি পাচ্ছে সবার কান্না দেখে।
-তিতলি বিয়ে হয়েছে রুমা আপুর। আর কাঁদছিস তুই। তোর বিদায় নাকি? আশ্চর্য।
রেহানের কথা শুনে তিতলি শিহাবকে বিচার দিলো।
-ভাই কিছু বল ছোট ভাইকে। ভাল্লাগে না কিন্তু।
মিলার কান্না থামাতে থামাতে শিহাব ইশারায় রেহানকে চুপ থাকতে বললো।
মিলা নীরার থেকে রুমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
-রুমা আপা সাইফ ভাইরা দাড়িয়ে আছে তো। আর কেঁদো না। আপার সাথে তো তোমার প্রতিদিন দেখা হবে।
রুমা তাও কান্না থামাতে পারছে না। নীরা বহু কষ্টে রুমাকে ছাড়ালো। রুমার বাবা রুমাকে সাইফের হাতে তুলে দিলেন। মেয়েকে দেখে রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে বললেন। সাইফ সবসময় রুমার খেয়াল রাখবে কথা দিলো।
-রুমাকে দেখে রাখবি। একদম ঝগড়া করবি না দুজন। রুমা তুইও ঝগড়া করিস না। কিছু শুনলে কিন্তু দুজনেই আমার হাতের মার খাবি।
নীরার কথা শুনে রুমা আরো জোরে কেঁদে দিলো।
-তোর সব কথা শোনা হবে নীরা। সবসময় দেখে রাখবো রুমাকে।
এরপর রুমার বিদায় হয়ে গেল। প্রিয় জন পরিবার ছেড়ে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নীরা এতক্ষন না কাঁদলেও তার চোখ ছলছল করছিলো। রুমাকে বিদায় দিয়ে ওর পরিবারের সবাই ভেতরে চলে গেল। মালিহা রুমার মাকে শান্তনা দিতে ভেতরে গেছেন। তিতলি বিমর্ষ হয়ে পরলে মিলা ওকে নিয়ে গেল। রেহানও ওদের সাথে গেল। নীরা এখন একা একা দাড়িয়ে চোখের পানি মুচছে। শিহাব ভেতরে চলে গিয়েছিলো। নীরাকে না দেখতে পেয়ে আবার বাইরে আসলো। দেখলো নীরা একমনে চোখ মুছে যাচ্ছে। নীরার চোখের কাজল ঘেটে গেছে,যে কেউ দেখলে বলবে কাজল ধুয়ে নিতে। কিন্তু এতেও শিহাবের চোখে নীরাকে সুন্দর লাগছে। সে নীরার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো। নীরা শিহাবকে না দেখেই টিস্যু নিয়ে চোখ মোছা শুরু করলো। কারো সামনে কাঁদতে তার ভালো লাগে না। এজন্য তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো। ভেবেছিলো মিলা এসেছে। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো।
-এখানে কি করছিস মিলা?
-মিলা না শিহাব।
শিহাবের কন্ঠ শুনে পাশ ফিরে তাকালো নীরা। সে বুঝে না সে একা থাকলেই শিহাব কি করে হাজির হয়ে যায়। এখন আবার শিহাবের ঢঙ দেখতে হবে। সবার সামনে এক আর ওর সামনে আরেক।
-ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
বিড়বিড় করে বললো নীরা। শিহাব নীরার কথা শুনে ফেললো। তবে হাসলো না। অন্যরকম গলায় বললো
-তোমাকে তো কাঁদলেও সুন্দর লাগে নীরা।
নীরা হতভম্ব হয়ে শিহাবের দিকে তাকালো। বিয়ে শেষ কাল রিসেপশনের পরে শিহাবের সাথে আলাদা করে কথা বলতে হবে। এখন আর শিহাবকে কিছু বলে লাভ হবে না। ভেবেই ভেতরের দিকে যেতে চাচ্ছিলো নীরা। কিন্তু শিহাব নীরার হাত ধরে আটকে দিলো। একমনে নীরার হাত দেখতে থাকলো। নীরা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। শিহাব নীরার হাত ধরে রেখে দেখছে। হাতের নখ আঙুল সব পর্যবেক্ষন করছে।
-আমি বলেছিলাম শিহাব আমার হাত না ধরতে। আপনার মতো এমন অভদ্র অসভ্য তো আমি কখনো দেখিনি।
-তাই? কিন্তু আমি তো এখনো কোনো অসভ্যতামি করিনি।
শিহাবের এমন ঘারত্যাড়া জবাবে হতবাক হয়ে গেল নীরা। কেউ যদি দেখে যে শিহাব ওর হাত ধরে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে তাহলে কি হবে। ভাবতেই মাথায় আরো রাগ চেপে গেল নীরার। সে হাত মোচড়াচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। শান্ত মাথায় এই পাগলকে হ্যান্ডেল করতে হবে এভাবে হবে না। ভাবলো নীরা।
-আপনি আমাকে সম্মান করেন?
নীরার কথা শুনে ওর দিকে চোখ তুলে তাকালো শিহাব। সে নীরাকে খুব সম্মান করে৷ যা মুখে বলে বোঝানো সম্ভব না। সে মাথা দোলালো।
-অবশ্যই কোনো সন্দেহ আছে?
– হ্যা আছে। আমার তো মনে হয় আপনি আমাকে রেস্পেক্টই করেন না। রেস্পেক্ট করলে আমার পারমিশন ছাড়া যখন তখন হাত ধরতেন না। এখনো হাত ধরেই আছেন আপনি। আশ্চর্য!
নীরার কথা শুনে হাসলো শিহাব। কি সুন্দর চালাকি করছে নীরা। যেনো শিহাব আর ওর হাত ধরতে না পারে। কিন্তু সে নীরাকে সফল হতে দিবে না।
-আমি সব মেয়েকে সম্মান করি। তোমাকেও সম্মান করি। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আমি তো তার দিকে চোখ তুলেই তাকাতাম না। হাত ধরা তো দূরেই থাক। কিন্তু কেন যেনো তুমি সামনে আসলে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। তোমার হাত ধরতে ইচ্ছে করে। ছাড়তেই ইচ্ছে করে না। তখন পারমিশনের কথাও মাথায় থাকে না। আর একদিন না একদিন আমাদের মাঝে এমন সম্পর্ক তৈরি হবেই। যেদিন তোমার হাত ধরতে আমার কোনো পারমিশন লাগবে না। তাই আগে থেকেই প্র্যাক্টিস করছি।
শিহাব তখনো নীরার হাত ছাড়েনি। পুরো কথা হাত ধরে রেখেই বললো সে। নীরা শান্ত গলায় বললো।
-এটাকে সম্মান করা বলে না। আর আমাদের মাঝে কখনোই এমন সম্পর্ক তৈরি হবে না,যেদিন বিনা পারমিশনে আপনি আমার হাত ধরতে পারবেন। কখনোই না। আমি তা হতে দিবো না।
শিহাব নীরার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনলো। তারপর নীরার হাত শক্ত করে ধরে হেচকা টান দিলো। এতে নীরা শিহাবের একেবারে কাছে চলে আসলো। শিহাব নীরার চোখের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললো।
-দরকার পরলে তোমাকে বাধ্য করা হবে।
শিহাবের এমন কথা শুনেও নীরা ঘাবড়ালো না। শিহাব এতো শক্ত করে নীরার হাত ধরেছে যে নীরা হাতে ব্যথা পাচ্ছে। তবুও চোখ মুখ স্বাভাবিক করে রেখেছে। সে ও স্থির চোখে শিহাবের দিকে তাকালো।
-আপনি পারবেন না। আমি না চাইলে আপনি কখনোই পারবেন না।
এই পর্যায়ে শিহাব হাসলো। নীরার হাত ছেড়ে দিলো।
-ভেতরে যাও। আর হাতে মলম লাগিয়ে নিয়ো।
বলেই উল্টো ঘুরে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো শিহাব।
নীরা আর এক মুহূর্ত ও দাড়ালো না। আস্তে আস্তে হেটে ভেতরে চলে আসলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো শিহাবের হাতের ছাপ বসে গেছে। ব্যথাও করছে হাতটা। তবে শিহাবের এমন কাহিনী সে শেষ করবেই। নিজের কাছে নিজেই কথা দিলো নীরা।
–চলবে।