অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব–পঞ্চাশ (শেষ পর্ব শেষাংশ।)
নাফিসা নীলয়া!
মিলা আর রেহানের বিয়ে উপলক্ষে সবাই শিহাবদের গ্রামের বাড়িতে এলো। মূলত রেজা সাহেবের ইচ্ছের জন্যই আসা। তিনি চেয়েছেন মিলা আর রেহানের বিয়েটা গ্রামে হোক। আর রিসেপশন শহরে গিয়ে ধুমধাম করে হবে। বিয়ে উপলক্ষে গ্রামে পরিবারের সবাই মিলে খুব আনন্দও করা হবে। সেজন্যই নীরার পরিবারের সবাই আর শিহাবের পরিবারের সবারই গ্রামে আসা। শিহাবদের পুরনো জমিদার বাড়ি। অনেক বড় জায়গা নিয়ে বাড়িটা। বাড়ির পেছনে বড় দিঘী। এর আগে নীরারা এখানে আসলেও এবারই সবাই মিলে আসা।
রেহান আর মিলা দুজনেই এখন প্রতিষ্ঠিত। রেহান একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ইংলিশ লিটারেচারের প্রফেসর। রেজা সাহেব চেয়েছিলেন রেহানও শিহাবের সাথে ব্যবসায় নজর দিক। কিন্তু রেহানের প্যাশনই আলাদা ছিলো। সে সবসময়েই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হতে চাইতো। ইংলিশ লিটারেচার তার ভালোলাগা। সেটাকে সে জায়গামতো ইউজ করতে চাইতো। শিহাবও রেহানকে সাপোর্ট করেছে। রেজা সাহেবের সাথে নিজে কথা বলেছে। রেহানকে নিজের স্বপ্ন নিয়েই থাকতে দেওয়ার কথা বলেছে। তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তার ভাইয়ের স্বপ্নও যদি পূরণ না হতো তাহলে শিহাব সেটা কখনোই মানতে পারতো না। প্রত্যেককেই নিজের প্যাশন নিয়ে এগিয়ে য়াওয়া উচিত। রেজা সাহেব ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং সানন্দে শিহাবের কথায় রাজি হয়েছেন। শিহাবের সাথে তার সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। নীরার সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে নীরা নিজ উদ্যোগেই শিহাব আর রেজা সাহেবের বাকি দুরত্ব ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। তিন বাবা ছেলে এখন একসাথে আড্ডাও দেয়।
মিলা বর্তমানের একজন প্রফেশনাল বিউটিশিয়ান। বর্তমানের ছেলে-মেয়েরা সব তাকেই ফলো করে। প্রফেশনাল এক্টর এক্ট্রেসদের কাজও মিলার টিম করে। সে তার ক্যারিয়ারে অনেকটা এগিয়ে গেছে। যার জন্য সবাই তাকে বাহবা দেয়। একদিন সবাই বলতো সামান্য আর্টিস্ট হয়ে কি আর করবে! কিন্তু মিলা সবার ধারনাকে পাল্টে দিয়ে বর্তমানের সেরা বিউটিশিয়ান হয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
ওরা প্রতিষ্ঠিত হবার পর সবাই মিলে ওদের বিয়ে ঠিক করেছে। আর সেই বিয়ে উপলক্ষেই গ্রামে আসা।
তিতলি এখন ইন্টার্ন করছে। তিতলি এখন ইন্টার্ন ডাক্তার। সে তার ভাইদের স্বপ্ন ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছে। এখন শুধু একজনের অপেক্ষা।
তিশা আর আসাদের বিয়েটাও কয়েকবছর আগে ধুমধাম করে হয়েছে।
বিয়ের সব অনুষ্ঠানে মিলার কর্মচারীরা সবাইকে সাজিয়ে দিয়েছে। বিয়ের দিন মিলাকে সাজ নিয়ে কনফিউজড দেখে রুমা আর তিশা মিলে পিঞ্চ মেরে বললো।
-বিউটিশিয়ানের নিজের বিয়ে হলে যা হয় আরকি!
মিলা তখন হতাশ হয়ে তাকালো ওদের দিকে। তিশা বললো।
-আমার বিয়েতে তো খুব বলেছিলি নিজের বিয়েতে সবচেয়ে সুন্দর করে সাজবি। এখন কি হলো। নিজে সাজবি না অন্যের হাতে সাজবি এটা নিয়ে কনফিউজড?
মিলা তখন দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
-আপাকে ডাকো নইলে আমি এখনই কাঁদবো।
সেই মুহূর্তে তিতলি রুমার মেয়ে রাহাকে কোলে নিয়ে ঢুকলো। রাহা মিলাকে বসে থাকতে দেখে বললো।
-খালাম্মা হোয়াট হ্যাপেন্ড?
মিলা তখন চেঁচিয়ে রুমাকে বললো।
-রুমা আপা থামাও এটাকে। এ আমাকে কোন দুঃখে খালাম্মা বলে? আই মিন কিসের জন্য?
মিলার কান্ড দেখে সবাই হাসতে হাসতে খুন। রুমা আর সাইফের মেয়ে মিলাকে কোনো এক অজানা কারনে খালাম্মা বলে ডাকে। নীরা এতো চিৎকার শুনে এসে দেখলো মিলা হতাশ হয়ে বসে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে সবাইকে জিজ্ঞেস করলো। রাহা তিতলির কোল থেকেই বললো।
-উই ডোন্ট নো বড় মা। খালাম্মা কেন এভাবে বসে আছে আমরা জানি না।
রাহার কথা শুনে সবাই আরেক দফা হাসলো। এতো কাহিনীর পর মালিহা এসে তাড়া দিলে। মিলা বায়না ধরলো সে নীরার কাছে সাজবে। অগত্যা বাধ্য হয়ে নীরাই মিলাকে সাজিয়ে দিলো। বধুবেশে মিলাকে দেখে নীরার চোখ জুড়িয়ে গেল। খয়েরী শাড়িতে আর বধূর সাজে কি মিষ্টি লাগছে মিলাকে। তার বোনটা কতো বড় হয়ে গেল। মিলা নীরাকে বললো।
-তোমার দ্বারাই সম্ভব এতো সুন্দর করে সাজানো। আপা আমার মনে হয় তোমারও বিউটিশিয়ান হওয়ার দরকার ছিলো।
মিলার কথা শুনে নীরা কেবল মুচকি হাসলো।
সবশেষে মিলা আর রেহানের বিয়ে পড়ানো হলো।
নীরা শাড়ি ধরে ধরে সব কাজ করছে। তার পরনে শিহাবের দেওয়া বেগুনি রঙের শাড়ি। নিজের অপরূপা সুন্দর স্ত্রী কে দুচোখ ভরে শুধু দেখেই যাচ্ছে শিহাব। সে চোখ ফেরাতেই পারছে না। নীরা সেটা লক্ষ করে এসে সাবধান করে গেছে শিহাবকে। তবুও শিহাব যেই কে সেই আছে।
বিয়ে পড়ানো শেষে তিতলি সবাইকে নিয়ে মজা করতে করতে সামনে এগিয়ে হঠাত থেমে গেল। চোখের সামনে কি সে ভুল দেখছে! নাকি ঠিক দেখছে। তার সামনে নির্বান দাড়িয়ে। সে কি নির্বানকে নিয়ে সারাদিন ইম্যাজিনেশন করতে করতে এখন এখানেও নির্বানকে দেখছে। ও মাই গড! সাংঘাতিক কান্ড হয়ে গেল তো তবে। তিতলি নিজের হাতেই নিজে চিমটি কাটলো। হঠাত পাশ থেকে নীরা এসে বললো।
-ঠিকই দেখছো। নির্বানই এসেছে। যাও কথা বলো।
তিতলি অবাক হয়ে নীরার দিকে তাকালো। নীরা হেসে সায় দিলো। নির্বান এগিয়ে আসলো। তারপর নীরাকে বললো।
-আপনার ননদ আমাকে এক্সপেক্ট করেনি ম্যাম।
নীরা তখন মুচকি হেসে চলে গেল ওদের সামনে থেকে। নির্বান আবারও বললো।
-কি ডাক্তার সাহেবা এক্সপেক্ট করেননি তো?
তিতলি বুঝলো এটা স্বপ্ন না বা তার ইম্যাজিনেশনও না। সে নিজেও এবার হেসে ফেললো। বললো।
-ভালো আছেন? অনেক বদলে গেছেন।
নির্বান হেসে বললো।
-আপনিও অনেক বদলে গেছেন।
তিতলি সরলভাবে বললো।
-ভেতরকার আমিটা কিন্তু বদলাইনি।
-জানি৷ আপনি কথা রেখেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। যা আমার জন্য খুব আনন্দের। আপনাকে যদি আমি না পেতাম তাহলে সত্যিই আমার ভেতরকার আমিটা মরে যেতো।
তিতলি বললো।
-আমার জন্য আপনার অনুভূতিটা বদলায়নি তো?
নির্বান ভ্রু কুঁচকে বললো।
-এতোটা বছর আপনাকে চিঠি লিখে গেছি। বাবা-মাকে আপনার ভাইদের সাথে কথা বলিয়েছি। আপনাকে আমার এই বুকে রেখেছি। আপনাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারি না তা কি আপনি এতো বছরেও বোঝেননি?
নির্বানের প্রশ্ন শুনে তিতলি হাসলো। বললো।
-আমি বোধ হয় আপনাকে ভালোবাসি।
নির্বান দ্রুত প্রশ্ন করলো।
-বোধ হয়?
তিতলি খিলখিল করে হেসে বললো।
-সত্যিই ভালোবাসি।
নির্বান বুকের বাম পাশে হাত রেখে বললো।
-আর আমি যে আপনাকে সেই প্রথম দেখার পর থেকেই ভালোবাসি। যেটা কখনো বদলাবে না।
তিতলি শুধু হাসলো। আর নির্বান তাকে দু চোখ ভরে দেখলো। বহু বছর সামনাসামনি না দেখে ছিলো যে!
আসাদ তিশাকে ধরে ধরে নিয়ে মিলার পাশে বসালো। তিশা পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট সেজন্যই আসাদ তিশার এতো যত্ন করে। তিশা বিরক্ত হয়ে গেছে আসাদের ব্যবহারে তবুও কিছু বলে না। কারন এটা তো ভালোবাসারই যত্ন। তিশা ছবি তুললো মিলা আর রেহানের সাথে।
আসাদ এবার তিশাকে জিজ্ঞেস করলো।
-এই বেশি খিদে পেয়েছে? খিদে পেলে বলো কিন্তু।
তিশা তখন দাঁত কিড়মিড় করছে। ওদের কান্ড দেখে সবাই তখন হাসছে। রুমা সাইফের দিকে তাকিয়ে বললো।
-শেখ কিছু।
সাইফও পাল্টা জবাব দিলো।
-আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নেই তারপর শেখা যাবে।
সাইফের কথা শুনে আবার হাসির রোল পরলো চারদিকে। জহুরা রেহানকে কানে কানে বললেন জায়মা সবাইকে একসাথে ভিডিওকলে দেখতে চান। রেহান তখন নীরার দিকে তাকিয়ে ডাকলো। নীরা কাছে গেলে রেহান বললো।
-মা আমাদের সবাইকে দেখবেন। ভাইকে একটু মানিয়ে নিও ভাবিমনি।
নীরা তখন আশ্বাস দিয়ে বললো।
-কিছু হবে না। শিহাব কিছু বলবে না।
রেহান নীরার কথায় নিশ্চিন্ত হলো। জহুরাকে বললো ফোন নিয়ে আসতে জহুরা ফোন নিয়ে আসলেই জায়মাকে কল করলো নীরা। জায়মা এখন তার স্বামী আর রিশাদের সাথে কানাডায় থাকেন। তার আর শিহাবের মাঝের সম্পর্ক আজও সেরকম। কিছু জিনিস কখনো বদলায় না। আর না কখনো বদলানো যায়। জায়মা নিজেও নিজের পাপের কথা ভেবে দূরে সরে গেছেন। তবে নীরা নিয়মিত তার খোঁজ নেয়। সবাই একসাথে হলো। শিহাব গম্ভীর মুখেই দাড়িয়ে রইলো।
জায়মা নীরার কল পেয়ে উচ্ছাসিত হলেন। তার পাশে থাকা রিশাদও মাকে খুশি হতে দেখে খুশি হলো। সে জানে তার মায়ের অন্তরটা সবসময় বাংলাদেশেই পরে থাকে। তবে কিছু করার নেই। শুধু সে তার মায়ের খেয়াল রাখছে নিজের মতো।
জায়মা কল রিসিভ করে সবাইকে মন ভরে দেখলেন। মিলার সাথে রেহানের সাথে কথা বললেন অনেক দুয়া করে দিলেন।
কথা বলা শেষে সবাই একসাথে ছবি তুললো। নির্বান দূরে দাড়িয়ে ছিলো বলে শিহাব নিজেই নির্বানকে ডাকলো।
-নির্বান এদিকে এসো। এখনো আমাদের এতো ভয় পেলে চলবে? বড় হয়ে গেছো না?
শিহাবের কথা শুনে সবাই হাসলো। নির্বান নিজেও হেসে সবার সাথে গিয়ে দাড়ালো। রেহান নির্বানকে দেখে শিহাবকে বললো।
-ভয় পাওয়াই ভালো। আমাদের কলিজার টুকরাকে দিচ্ছি তাকে একটু ধমক দেওয়ার আগেও যেনো আমাদের কথা মনে করে।
কথাটা রেহান মজা করে বললেও নির্বান সত্যিই ভয় পেলো।
রেজা সাহেব রেজাউলের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। হাসতে হাসতে হাসতে বলছেন।
-আপনার দুই মেয়েই এখন আমার দুই মেয়ে।
রেজাউলও হাসতে হাসতে বললেন।
-আপনার দুই ছেলে এখন আমার দুই ছেলে।
নূরজাহান বেগম পান খেতে খেতে মালিহাকে বললেন।
-আল্লাহ্ আমার সব মনের আশা পূরণ করেছেন। দুই নাতনিই কতো খুশি।
মালিহাও নীরা আর মিলার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকালেন। তার অন্তরটা ভরে গেল। দুই বোনকে একসাথে হাসতে দেখার দৃশ্য মালিহার কাছে পৃথিবীর সেরা দৃশ্য মনে হয়। আসমা আর জহুরাও গল্প করছেন নিজেদের মতো।
মিলা নীরাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-ফাইনালি আমি সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে থাকতে পারবো আপা। আমি যে কি খুশি তা বলে বোঝাতে পারবো না।
নীরা হেসে বোনের মাথায় হাত বুলালো। মিলাকে সে ছোট থেকে নিজ হাতে বড় করেছে। সবসময় ভয়ে থাকতো তার ছোট্ট বোনটার কোথায় বিয়ে হবে না হবে! সে কি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে তার বোনকে দূরে রেখে। কিন্তু এখন! এখন তার বোন আজীবনের জন্য তার চোখের সামনে থাকবে। এটাই কি কম আনন্দের!
রেহান দুই বোনকে মুগ্ধ হয়ে দেখলো। সে জানে মিলা তাকে যতোটা না ভালোবাসার কারনে বিয়ে করেছে এর চেয়ে বেশি নিজের আপার কাছে সারাজীবন থাকার জন্যও বিয়েটা করেছে। বোনদের ভালোবাসা এমনও হয়! নীরা আর মিলাকে না দেখলে সেটা রেহান বিশ্বাস করতো না।
এরইমধ্যে মিলা কেঁদে ফেললো। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে! নীরাও জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। মিলা তখন কাঁদতে কাঁদতেই বললো।
-এতো আনন্দ আমি কই রাখি। আপার কাছে থাকতে পারবো আগের মতো। অতিরিক্ত খুশিতে কাঁদছি।
সবাই মিলার কথা শুনে দফায় দফায় হাসলো।
আসাদ তিশার আগেপিছে ঘুরঘুর করতেই থাকে। এখনো সেটাই করছে! আসাদ তিশাকে এটা ওটা খাওয়ার জিনিস এনে দিচ্ছে তিশা খাচ্ছে।
সাইফ আর রুমা রাহাকে নিয়ে সবসময় ঝগড়া করে। এখনো তাই করছে। আর তাদের মেয়ে রাহা তাদের ঝগড়া মিটাতে ব্যস্ত হয়ে পরছে।
তিতলি আর নির্বান নিজেদের মতো গল্প করছে। এতো বছরের সব কথার ঝাঁপি একসাথে খুলে বসেছে দুজন। দুজন দুজনের সমস্ত অনুভূতির কথা জানান দিচ্ছে। তিতলি হঠাত নির্বানকে বলে উঠলো।
-এখন আমরা প্রেম করবো। তারপর বিয়ে। ক্যারিয়ারের চক্করে প্রেমই করা হলো না।
তিতলির কথা শুনে নির্বান আঁতকে উঠে বললো।
-আপনার ভাইয়েরা?
তিতলি নির্বানকে ধমকে বললো।
-এই আপনি এখনো ভীতুই রয়ে গেলেন? তারমানে আমি ভুল বুঝেছিলাম। আপনি একটুও বদলাননি।
তিতলির কথা শুনে নির্বান আমতাআমতা করলো। তিতলি নির্বানকে এমন করতে দেখে বললো।
-এই এমন করবেন না তো। সাহসী হন।
নির্বান এই কথার প্রতিউত্তরে বললো।
-আপনি বললে তো আমি আকাশের চাঁদটাও এনে দিতে রাজি।
তিতলি ফট করে বললো।
-কই এনে দিন চাঁদ।
তিতলির কথায় তিতলি আর নির্বান একসাথে হেসে ফেললো।
রেহান আর মিলাকে ঘরে দিয়ে এলে সব নিয়ম কানুন সেরে রেহান খাটে বসে মিলার হাত ধরে বললো।
-আমাকে তো একটুও ভালোবাসো না। খালি ঝগড়াই করো। আজ দেখাবো মজা।
মিলা তখন হাসতে হাসতে রেহানের হাতে জোরে চিমটি কেটে বললো।
-এই নাও ভালোবাসা। আরো লাগবে?
রেহান হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে বললো।
-একটা ডাইনিকে বিয়ে করলাম।
মিলা চোখ রাঙিয়ে বললো।
-কি বললে?
রেহান হেসে বললো।
-কিছু না।
মিলা রেহানকে ফিসফিস করে বললো।
-তোমার একটা মেয়ে স্টুডেন্ট তোমার ছবিতে হ্যান্ডসাম স্যার বলে কমেন্ট করেছিলো চিমটি টা সেজন্যে। এমন আর একটা কমেন্ট যদি পাই তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন!
রেহান অসহায় ফেস করে বললো।
-স্যরি আমি কমেন্টবক্স অফ করে রাখবো এরপর থেকে।
মিলার মন এক মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। সে ঝট করে রেহানের গালে চুমু দিয়ে দিলো। রেহান হতভম্ব হয়ে তাকালো। মিলা হাসতে হাসতে বললো।
-আমি কখনোই ভাবিনি যার সাথে আমার মারমার কাটকাট সম্পর্ক তার সাথেই আজীবন কাটাতে হবে।
রেহানও বললো।
-আমিও ভাবিনি জানো এই জোয়ালামুখী রাগী টিলাকে আমি একদিন এতো ভালোবেসে ফেলবো। যাক আজীবন জ্বালাতে তো পারবো।
মিলাও বললো।
-যাক আজীবন তোমাকে ধমকাতে তো পারবো। যার সাথে আমি এতো এতো ঝগড়া করতাম তাকে যে এতো ভালোবাসবো এটা আমিও ভাবিনি।
রেহান মিলার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিলার হাত ধরে বললো।
-আমি তোমাকে অনেকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
মিলাও হাসলো। বললো।
-আমিও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।
মিলা আর রেহানকে ঘরে রেখে এসে অনেক রাত হওয়ায় যে যার মতো ঘরে গেল। নীরা বাইরে দিঘীর পাড়ে এসে দাড়ালো। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। দিঘীর পানিতে স্পষ্ট সেই চাঁদের প্রতিবিম্ব। গ্রাম এলাকা হওয়ায় অধিকাংশ মানুষই ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। শিহাব কি যেনো একটা কাজে গিয়েছিলো সেজন্য নীরা একাই দাড়িয়ে আছে। শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নীরাকে। নীরা চোখ বুজে সেই বাতাস অনুভব করছে।
শিহাব দূর থেকে আবারও নীরার সৌন্দর্য অবলোকন করলো। দিঘীর পাড়ে দাড়িয়ে আছে তার সহধর্মিনী যাকে পেয়ে তার জীবনের সমস্ত দুঃখ বেদনা ঘুচে গেছে। এক অপরূপা ভুবনমোহিনী হুট করে তার জীবনে এসে জাদুর কাঠি দিয়ে তার সকল দুঃখ ঘুঁচিয়ে দিবে সেটা সে জানতো না। নিজেকে তার খুব ভাগ্যবান মনে হয়।
শিহাব নীরার কাছে এগিয়ে গেল। নীরা শিহাবের ঘ্রান পেয়ে চোখ খুললো। তারপর পেছনে ফিরলো। শ্যামবর্ণের সুন্দর হাসির এই মানুষটি একান্তই তার। একদম তার নিজের ভাবতেই আনন্দ হয় নীরার। শিহাবের হাতে একগুচ্ছ শিউলি ফুল আর পত্ম ফুল সে সেগুলো নীরার সামনে ধরলো। নীরা অবাক হয়ে তাকালো। তারপর হুট করে কেঁদে ফেললো। শিহাব হকচকিয়ে গেল। দ্রুত ফুলগুলো পাশের সিড়িতে রেখে নীরাকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিলো। নীরা কাঁদতে কাঁদতেই বললো।
-কেন আমাকে এতো ভালোবাসো? মাঝেমাঝে আমার মনে হয় আমাকে এতো ভালো না বাসলেও তো পারো। এই যে আমার এতো এতো কমপ্লিকেশন যার জন্য আমি কনসিভও করতে পারিনি। তবুও তোমার মনে হয় না আমাকে একটু কম ভালোবাসা উচিত?
শিহাব নীরার কথা শুনে নীরার কান্নামাখা ভেঁজামুখটা নিজের হাতের আঁজলে নিলো। এবং নীরার কান্নামাখা শুখ দেখে সে আরো একবার প্রেমে পরলো। তার কাছে মনে হয় সে যতোবার নীরার মুখ দেখে ততোবার নীরার প্রেমে পড়ে। শত সহস্র বার সে প্রেমে পড়েছে। আজীবন পড়বে। ভালোবাসবে! শিহাব নীরার চোখে চোখ রেখে বললো।
-আমার জীবনে তুমি ছাড়া বাকি কোনো কিচ্ছু ইম্পর্টেন্ট না। আমার তুমি আছো। আমার শুধুমাত্র তুমি হলেই চলবে। বাকি কোনোকিছু লাগবে না। আমি যেদিন প্রথম তোমাকে দেখলাম রাতের বেলাতে পথশিশুদের পড়াচ্ছিলে তখনই তোমার প্রেমে পড়লাম। দ্বিতীয়বার রেহানের ইউনিভার্সিটি তে দেখে তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেললাম। আমার অন্ধকার জীবনের আলো তুমি। তোমার মনে পড়ে? তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি কি না করেছি! সবার কাছে হয়তো সিনেমাটিক লাগবে। কিন্তু তুমি ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। নিজের অস্তিত্বকে আমি খুঁজে পাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার সবকিছুকে ভালোবাসি। তোমার গায়ের গন্ধ তোমার কথা,তোমার হাসিকে ভালোবাসি। তোমার সাথে জড়িত সবকিছুই আমার পছন্দের আমার ভালোবাসার। যার কখনো কোনো পরিবর্তন হবে না। আর সন্তান আল্লাহর ইচ্ছেতে আসে। আমাদের ইচ্ছেতে না। তোমার এমনও কোনো জটিল কমপ্লিকেশন নেই। আর আল্লাহ্ না করুন। যদি কখনো এমন হয়ও তবুও আমি বলবো যা হওয়ার তা ভালোর জন্যই হবে। আল্লাহ্ আমাদের ভালোর জন্যই করবেন। আমাদের সন্তানের অভাব আছে বলো? তুমিই তো বলো তোমার দায়িত্বে থাকা সবাই নিজের সন্তানের মতো তবে? তবে এটা কোনো সমস্যাই না।
এটুকু বলে শিহাব থামলো। নীরা মুগ্ধ হয়ে শিহাবের কথা শুনছিলো। তার কাছে মনে হচ্ছে তার স্বামী ম্যাজিক জানে। শিহাব সাথে থাকলে শিহাবের কথা শুনলে কোনো মন খারাপই বেশিক্ষন ছুঁয়ে থাকতে পারে না নীরাকে।
শিহাব নীরাকে স্বাভাবিক দেখে বললো।
-আল্লাহ্ হয়তো আমাদের ভালোর জন্যই করছেন সব।
শিহাব তারপর একটু হেসে বললো।
-আই কান্ট শেয়ার ইউ উইথ এনিওয়ান! মিলা তোমার সাথে সাথে থাকে বলেই তো আমার কষ্ট হয় হিংসে হয়!
নীরা শিহাবের কথা শুনে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে শিহাবের হাতে চাপড় মারলো। শিহাবও হাসলো। নীরা শিহাবকে বললো।
-তুমি জানো তুমি আমার সাথে থাকলে আমাকে কোনো মন খারাপ ভাব বেশিক্ষন ছুঁয়ে থাকতে পারে না।
নীরার মুখের ওপর বাতাসে কিছু চুল উড়ে আসলো। শিহাব সেই চুলগুলো সরাতে সরাতে বললো।
-তুমি জানো তুমি যে আমার কম্ফোর্টজোন। আমার হৃদয় শীতলকারীনি। তুমি আমার সাথে থাকলে আমার হাত ধরে রাখলে আমি সবকিছু করতে পারবো।
নীরা শিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শিহাব নীরাকে ছেড়ে দাড়িয়ে ফুলগুলো হাতে নিলো। ইশারায় বললো কোনটা। নীরা শিউলি ফুলের দিকেই ইশারা করলো। শিহাব শিউলি ফুল একত্র করে কয়েক মিনিটেই মালা বানিয়ে ফেললো। নীরা বসে বসে দেখলো। শিহাব নীরাকে হাতে মালাটা বেঁধে দিয়ে বললো।
-তুমি জানো আমি তোমার হাতে প্রত্যেকবার মালা কেন বাঁধি?
নীরা মাথা নেড়ে বললো।
-জানি না।
শিহাব নীরার হাতে চুমু খেয়ে বললো।
-আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখার জন্য।
নীরা সুন্দর করে হেসে বললো।
-আমাকে বেঁধে রাখতে হবে না। আমি তোমার থেকে কখনোই দূরে যাবো না। কারণ তোমার ভালোবাসার শক্তিই এমন যা আমাকে দূরে যেতে দেয় না। শিহাব তোমার হাসিতে কি এমন জাদু আছে বলো তো? যাতে আমি আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে থেকেই আটকে আছি?
নীরার এমন কথা শুনে শিহাব নিজের সেই সুন্দর হাসিটাই হাসলো। যেই হাসি নীরার পছন্দের। নীরা আবারও সেই হাসি অবলোকন করলো মনপ্রান দিয়ে। শিহাব নীরাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-এতোকিছু বলো অথচ এটাই বলো না যে আমাকে তুমি অনেক বেশি ভালোবাসো।
নীরাও শিহাবকে জড়িয়ে ধরলো। বললো।
-সবকিছু কি প্রকাশ করতে হবে? বুঝে নিতে পারো না?
শিহাব নীরাকে সোজা করে নীরার মুখ নিজের হাতের আঁজলে নিয়ে বললো। পুনরায় মুগ্ধ দৃষ্টি ছুড়ে দিলো। এক আকাশ সমান মুগ্ধতা চোখে নিয়ে বললো।
-আবার বলছি আমার আধার জীবনের আলো তুমি। তোমার সংস্পর্শে এসেই আমার সব দূঃখ ঘুচে গেছে। সবাই সবার নিজের মতো চলবে চলছে! কিন্তু আমার তুমি ছাড়া কোনোভাবেই দিন কাটানো সম্ভব হবে না। আমার শুধু তোমাকে দরকার। শুধুই তোমাকে। আর কিচ্ছু লাগবে না। কিচ্ছু না আমার নিজের অংশও আমার লাগবে না। শুধু তুমি আছো বলেই আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। আমি তোমাকে এতোটা ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা কোনো কিছুর সাথে পরিমাপ করা যাবে না। দিনদিন শুধু বাড়বে। বয়স হয়ে যাবে। চামড়া ঝুলে যাবে। দিন বদলে যাবে। সময়ও নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা শুধু বাড়বে। কখনো কমবে না।
নীরার চোখে পানি মুখে হাসি শিহাবের চোখে তাকে অপরূপ লাগছে। শিহাব আর নীরা হাসতে হাসতে দুজন দুজনের হাত ধরে একসাথে বললো।
“হ্যা আমি জানি তুমিই আমার জীবনের অপূর্ব প্রাপ্তি।”
সমাপ্ত।