পর্ব তেত্রিশ লেখাটা বড় হওয়ার জন্য অনেকেই ফেসবুক লাইট দিয়ে পড়তে পারছে না। সেজন্য লেখাটা দুই ভাগে ভাগ করলাম।
অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-তেত্রিশ (২য় ভাগ)
নাফিসা নীলয়া!
ভোরের দিকে নীরাদের বাড়ির সবাই উঠে গেল। সবাই সকাল সকালই কাজে লেগে পরলো। মালিহা নীরাকে ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষন ঘুমাতে বললেন। নীরা তাই করলো।
শুক্রবারে বিয়েটা পরেছে। তাই ঠিক হয়েছে বাদ জুম্মা বিয়ে পড়ানো হবে। শিহাবেরা সবাই জুম্মার নামাজের পরে রওনা দিবে।
রেজা সাহেব,শিহাব,রেহান নামাজ পড়ে আসলে তিতলি শিহাবকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তিতলি এক্সাইটেড হয়ে বললো।
-আমার ভাইয়ের বিয়ে ইয়েএ। আমার ভাই এখন বর সাজবে।
রেহান ওদের পিছে পিছে এসে বললো।
-দুলহারাজা আমাদের ভাই, তাড়াতাড়ি করুন এবার।
শিহাব হাসলো ভাই-বোনের কান্ড দেখে।
শিহাব শুভ্র স্নিগ্ধ সাদা রঙের শেরওয়ানি পরলো। তিতলি এগিয়ে এসে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-কতো স্নিগ্ধ লাগছে আমার ভাইকে। রাজপুএ একদম।
রেহান মুখ লটকে বললো।
-আর আমি?
তিতলি হাসতে হাসতে বললো।
-সবসময় ভাইকে কপি করা না? তুইও হোয়াইট? কিন্তু তোকেও খুব সুন্দর লাগছে। আমার দুইটা রাজপুএের মতো ভাই।
রেহান দাঁত কেলিয়ে বললো।
-একটু ডিফারেন্স আছে আমি অফ হোয়াইট। আর তুই যেহেতু আজ আমার প্রশংসা করলি তাই আমিও আজ ভাইয়ের সাথে সাথে তোরও প্রশংসা করবো। আমার পরীর মতো বোন। আর রাজপুএের মতো ভাই।
তিতলি একটা সুন্দর গোলাপি রঙের শাড়ি পরেছে। তিতলিকে দেখতে রূপকথার অপরূপা রাজকন্যার মতো লাগছে। শিহাবের চোখ জুড়িয়ে গেল তিতলিকে দেখে। সে হেসে তিতলির থুতনি ধরে বললো।
-আমার বোনকে অপ্সরী লাগছে।
তিতলি হেসে বললো।
-লাগবেই তো। আমি তো এতোটাই সুন্দর দেখতে।
তিতলির কথা শুনে শিহাব হেসে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো।
-আর তোকে লাগছে মোস্ট হ্যান্ডসাম হাঙ্ক! সবাই আজ হা করে তাকাবে। স্পেশালি মেয়েরা।
কথা শেষ হলে তিন ভাই-বোন একএে হাসলো।
এরমধ্যে রেজা সাহেব আর জহুরা এসে তাড়া দিলেন ওদের। রেজা সাহেব শিহাবের কাছে এসে বললেন।
-তোমার মা ফোন করেছিলেন। শুভকামনা জানিয়েছেন। তুমি কি চাও ও তোমার বিয়েতে থাকুক? চাইলে বলতে পারো।
শিহাব শক্ত কন্ঠে বললো।
-চাই না। সেদিনই বলেছি।
রেজা সাহেব আর কিছু বললেন না। তিতলি দেখলো পরিস্থিতি গুমোট হয়ে যাচ্ছে তাই সে আবার বললো।
-বাবা ইউ লুকিং সো হ্যান্ডসাম। আজকে তো কয়েকটা মেয়ে কুপোকাত হবেই হবে।
রেজা সাহেব তিতলির কথা শুনে হোহো করে হাসলেন। এরমধ্যে জহুরা আর রেহান তাড়া দিলো। আর কথা না বাড়িয়ে সবাই রওনা দিলো।
বিয়েটা সাদাসিধা ভাবে হলেও দেখা গেল কয়েকজনকে বলতেই হলো আত্নীয়দের মাঝে। তাই বাড়িটা ভরপুরই আছে। রেজাউল আর সাইফসহ সবাই জুম্মার নামাজ পড়ে এসে সব দেখভাল করতে লাগলো।
মিলা আর রুমা মিলে নামাজের পরে নীরাকে সাজাতে বসলো। নীরা এখনো নিজের বিয়ের শাড়ি দেখেনি। শিহাব বলেছে তাকে বিয়েতে শাড়িই পড়তে হবে। আর তা শিহাবই পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। শিহাব শাড়ি কিনে রুমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। নীরার আর দেখাই হয়নি। বহুবছর পর আজ বিয়ের দিন নীরা শাড়ি পরবে ভেবেই অদ্ভুত লাগছে।
মালিহা ঘরে আসলেন। নীরাকে দেখে বললেন।
-বহুবছর পর শাড়ি পরবে আমার মেয়ে। আমার চোখ তড়পাচ্ছে দেখার জন্য।
রুমা হাসতে হাসতে বললো।
-শিহাব ভাই না বললে তোমার মেয়ে আজও পরতো না।
রুমার কথা শুনে মিলাও ফিঁক করে হেসে ফেললো। নীরা চোখ গরম করে তাকালো ওদের দিকে। মিলা বললো।
-ওকে চুপ করলাম এবার আমার আপাকে বউ সাজানোর পালা।
নীরা হুট করে বললো।
-আমাকে আম্মা শাড়ি পড়িয়ে দিবে।
মালিহার চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি এগিয়ে আসলেন। মিলা হাসলো সে জানতো নীরা এটাই বলবে। রুমার কাছে শাড়িটা ছিলো। সে নিয়ে এলো।
খয়েরী রঙের চিকন সোনালী জোড়ি দিয়ে পারের সুন্দর জামদানী শাড়ি। দেখতেও ইউনিক। শাড়ি দেখে সবাই খুব প্রশংসা করলো। রুমা বললো।
-ও মাই গড শিহাব ভাইয়ের কি সুন্দর চয়েস। আচ্ছা এক মিনিট নীরা তোর তো খয়েরী রঙই পছন্দ। তারমানে তোর পছন্দ অনুযায়ী কেনা হয়েছে? হাউ রোমান্টিক ইয়ার!
নীরার নিজেরও খুব পছন্দ হয়েছে শাড়িটা। সে হাসলো রুমার কথা শুনে।
রুমা আর মিলাসহ সবাই শাড়ি পড়েছে। রুমা পড়েছে মেরুন রঙের শাড়ি। আর মিলা পড়েছে নীলচে বেগুনি রঙের শাড়ি। দুজনকেই খুব সুন্দর লাগছে। আর মিলা তো নিজেই কোনো বিউটিশিয়ানের থেকে কম না। নিজেই খুব সুন্দর সাজতে ও সাজাতে জানে। তাই ওরা নিজেরা নিজেরাই সেজেছে।
মালিহা নীরাকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। ফুল স্লিভ ব্লাউজের সাথে খয়েরী শাড়িতে নীরাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। রূপ বেড়ে গেছে তিন গুন।
মালিহা দু চোখ ভরে দেখলেন নীরাকে। মিলা খুশি হয়ে রেজাউল আর নূরজাহান বেগমকে ডেকে আনলো। রেজাউল ও চোখ ফেরাতে পারলেন না। কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নূরজাহান বেগম কাজল দিয়ে দিলেন যেনো নজর না লাগে।সবার এমন কান্ড দেখে নীরা হতভম্ব হয়ে গেল। বললো।
-শাড়িই তো পরেছি। অন্যকিছু তো না। এমন রিয়্যাক্সন দিচ্ছো কেন সবাই?
রুমা খুশিয়াল গলায় বললো।
-আল্লাহ্। নীরা এতো সুন্দর লাগছে মাশাআল্লাহ। আমার কল্পনার চেয়েও দ্বিগুন সুন্দর।
মিলা নীরাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-আমার ভুবনমোহিনী রূপসী আপা।
সবাই হাসলো কথা শুনে। মিলা বললো।
-এবার যাও সবাই। আপাকে আরেকটু সাজাবো। তখন দেখে নিও।
সবাই হেসে চলে গেল। রুমা বসে রইলো। মিলা নিজের হাতে নীরার চুল সুন্দর করে খোপা করে দিলো। মাথায় বেলি ফুলের মালা গুঁজতে গেলে নীরা আটকে দিলো। রুমা অবাক হয়ে বললো।
-মিলাকে থামালি কেন?
নীরা ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে শিউলি ফুলের মালাটা নিলো। শিহাব রাতে মালাটা দিলেও মালাটা নষ্ট হয়নি। নীরাও একটু পরপর পানি ছিটিয়ে দিয়েছিলো। মিলা আর রুমা অবাক হয়ে গেল শিউলির মালা দেখে। নীরা বললো।
-এটা খোপায় পড়িয়ে দে।
মিলা হতভম্ব হয়ে তাই করলো। রুমা জিজ্ঞেস করলো।
-এটা কোত্থেকে এলো?
নীরা হাসতে হাসতে বললো।
-তোর না মাথায় খুব বুদ্ধি গিঁজগিঁজ করে। বের কর কোত্থেকে এলো।
রুমা ভাবতে লাগলো। তারপর ঝট করে বললো।
-শিহাব ভাই দিয়েছে না? কিন্তু কখন?
মিলা মিটি মিটি হাসছে কারন সে রাতে টের পেয়েছিলো নীরা বের হওয়ার সময়। সে বুঝে ফেলেছে।
মিলা নীরাকে হালকা করে সাজিয়ে দিলো। খুবই হালকা গয়না পরিয়ে দিলো। হাতে কয়েক গাছি চুড়ির সাথে বেলি ফুলের মালাও পেঁচিয়ে দিলো। কপালে টিপ পরাতে চাইলে নীরা পরলো না। কারন সে জানে মুসলিম মেয়েদের কপালে টিপ দেওয়া ঠিক নয়। তাই মিলা আর জোর করলো না। মিলা সুন্দর করে নীরার মাথা ঢেকে ওড়না পড়িয়ে সেট করে দিলো। খয়েরী শাড়ি,খোপা,হালকা গহনা,হালকা সাজ সবমিলিয়ে নীরাকে আরো স্নিগ্ধ দেখালো।
মিলা সুন্দর করে সাজাতে জানে সেটা রুমার জানা ছিলো। কিন্তু নিজের বোনকে এতোটা সুন্দর করে সাজাবে সেটা রুমা জানতো না। সে চেঁচিয়ে বললো।
-ও আল্লাহ্। এবার তো আরো সুন্দর লাগছে। ও খোদা!
রুমা এমনভাবে চিৎকার করে উঠলো যে সবাই নীরার ঘরে এসে পরলো ভয় পেয়ে।
সবাই এসে আরেক দফা চমকালো। এরপর কয়েকদফা প্রশংসা চললো। নীরা সবার প্রশংসা শুনতে শুনতে প্রায় হয়রান হয়ে গেল।
সাইফ নীরার কাছে এসে বললো।
-মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ! অপ্সরী।
নীরা সাইফের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
-তুইও?
সাইফ হাসতে হাসতে বললো।
-আমিও।
এসব চলতে চলতেই শিহাবেরা সবাই চলে আসলো। সাইফ,রুমা আর মিলা তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে পরলো। নীরা একা বসে রইলো।
আগে সবার আপ্যায়ন চললো। এরমধ্যে একটা কান্ড ঘটলো। নির্বান এসেছিলো তার ম্যামের বিয়ে খেতে। নীরার স্টুডেন্ট লাইফের প্রথম টিউশনের ছাএ ছিলো নির্বান। নীরা তাকে খুব ভালোবাসে সেজন্য দাওয়াতও করেছে। সে ও সাচ্ছন্দ্যে এসেছে। তার ম্যামের সাথে কথা বলেছে। তারপর নীরার বাবার সাথে সব তদারকি ও করছিলো , নির্বান। হঠাত বরপক্ষ আসার সংবাদ শুনে সে ও গেল। কিন্তু গিয়ে যা দেখলো তাতে তার হার্ট বিট বেড়ে গেল। তারমানে তার ম্যামের বিয়ে তিতলির ভাইয়ের সাথে? ও মাই গড! তাকে আবার তিতলি দেখে ফেলেনি তো। যদি ভুল বুঝে। সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সটকে পরলো। কিন্তু বিধি বাম রেজাউল সাইফের সাথে নির্বানকেও তিতলিদের আপ্যায়ন করতে পাঠালেন। তিতলি নির্বানকে দেখে সরু চোখে তাকালো। নির্বান ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো। তবে রেহান তখনো নির্বানকে দেখেনি। সে আছে মিলাকে জ্বালানোর ধান্ধাতে।
আপ্যায়ন শেষে এবার বিয়ে পড়ানোর পালা আসলো। নীরা ঘরে বসে বসে ভাবছিলো আজ থেকে তার জীবনের সাথে নতুন মানুষেরাও জুড়ে গেল। দায়িত্ব বেড়ে গেল। সে কি পারবে সব দায়িত্ব পালন করতে।এসব ভাবতে ভাবতেই নূরজাহান বেগম, মালিহা,মিলা, তিতলি আর রুমা তার ঘরে আসলো। সাইফ আর নির্বান এসে পর্দা টানিয়ে গেল। একটু পরেই মাওলানা সাহেব এই ঘরে আসবেন সেজন্য।
শিহাব আসার পর থেকেই ছটফট করছিলো, নীরাকে দেখার জন্য কিন্তু দেখতে পেলো না। সে এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছিলো। শিহাবের পাশেই কয়েকজন বসা ছিলো শিহাবের কান্ড দেখে সবাই হাসলো। কয়েকজন টিটকারিও মারলো। রেহানও কিছু বলতে চাইছিলো তবে ভয়ে বলতে পারলো না। রেজা সাহেব হাসলেন ছেলের কান্ড দেখে একসময় তিনি নিজেও এমন কান্ড করেছিলেন।
বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। মাওলানা সাহেব শিহাব আর নীরার বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। বিয়ের খুৎবা পড়ার পর কালেমা পড়লেন। কালেমা পড়া হলে আনুষ্ঠানিক মোহরসংক্রান্ত সব বলা হলো। এরপর মাওলানা সাহেব নীরার ঘরে গেলেন সম্মতি নেওয়ার জন্য। নীরার পাশে রেজাউলও এসে বসেছেন। সম্মতি চাওয়া হলে নীরা মালিহা আর রেজাউলের দিকে একবার তাকিয়ে তিনবার বললো।
-আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
সাক্ষর করতে বলা হলে নীরা সাক্ষর করে দিলো।
এরপর বাইরে গিয়ে শিহাবের কাছে মাওলানা সাহেব সম্মতি চাইলেন। শিহাব দেরি না করে সম্মতি দিলো। তিনবার বললো।
-শুকুর আলহামদুলিল্লাহ কবুল, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ কবুল,শুকুর আলহামদুলিল্লাহ কবুল!
এরপরে শিহাবকে সাক্ষর করতে বলা হলে সে তাড়াতাড়ি সাক্ষর করে দিলো।
মাওলানা সাহেব বললেন।
-আলহামদুলিল্লাহ্ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
সবাই একএে মোনাজাত ধরলো।
-চলবে!