অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-১৭,১৮
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব- ১৭
আমাদের বাগানজুড়ে অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। নীল রঙ ছেয়ে আছে চারদিকে। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই। গোধুলীবেলার লাল আলোয় চারদিক মায়াময় হয়ে আছে। এমন দিনে ইচ্ছে করে কোন ছোট্টবেলায় পড়া রূপকথার দেশে হারিয়ে যাই। সুয়োরানী-দুয়োরানীর দেশে, বীর রাজপুত্রের দেশে চলে যাই, বনের মাঝে থমকে গিয়ে শুনি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা!
আমি খুশবুকে কোলে নিয়ে বাগানে হাঁটছি। মেয়েটা ঘুমিয়েছিলো দুপুরে। মাত্র উঠলো। এখন না হাঁটলে যে কান্না শুরু করবে, তা থামতে থামতে রাত। আমি ছাড়া আর কারো কাছে যাবে না জেদ ধরেছে। বয়স তিনে পড়ল। তাও আহ্লাদ কমেনি।
এদিকে আমার পড়াশুনা আছে। আগামীকাল ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। হঠাৎ কে যেন গেটের কাছে ডাকাডাকি শুরু করল। গিয়ে দেখি চিঠি এসেছে। আমার নামেই। সেটা হাতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ঢুকতে নিলে আমার গেটে ধাক্কা। গিয়ে দেখি বড় আপা এসেছে। আমি চমকে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
সে বাড়িতে ঢুকেই খুশবুকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ও আপাকে তেমন চেনে না। নতুন মানুষ দেখে তাই কাঁদো কাঁদো হয়েও বেশি আদরের চোটে কাঁদতে পারলো না। আয়াশও দুষ্টুমি শুরু করল। ছেলেটা বড় হয়েছে কতো! আমি তাদের ধরে ঘরে নিয়ে গেলাম।
“শুধু দু’জনেই এসেছ? ভাইয়া আসেনি?”
আপা ঠোঁট উল্টে বলল, “নাহ। তার কাজের যা চাপ!”
“তুমি না বলে এলে কেন?”
“সারপ্রাইজ দিতে!”
আপাকে নিয়ে কাটলো অনেকটা সময়। প্রায় নয়টার দিকে পড়তে বসলাম। মনে হচ্ছে হিমালয় পর্বতের মতো পড়া ঘাড়ে চেপে আছে। প্রস্তুতি এবার তুলনামূলক অনেক ভালো, আগে তো এর অর্ধেক পড়া হলেও মনে হতো যথেষ্ট। এখন সব কেমন বদলে গেছে। আমার চিন্তা ভাবনার দিকগুলোও অনেক পরিণত হয়েছে। নিজেকে গোছানো মনে হয় খুব। আগের মতো এলোমেলো, উদাসীন, একটা হলেই চলে ভাবটা আর নেই।
বসতে না বসতে অর্নার ফোন এলো। এই মেয়েটা এখনো নিয়মিত ফোন করে। সবসময় বলে, দেখো ভাইয়ার সাথে ঠিক ঠিক তোমার মিল হয়ে যাবে। আমি কথাটা হেসে উড়িয়ে দেই। তবু কি মনের কোথাও কি চিকন সলতেতে আবছা হয়ে একটা প্রদীপ অল্প সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে?
তার সাথে আর দেখা হয়নি সেদিনের পর। রাস্তাঘাটে কতো পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে হয় না কেন? সে কি ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে চলে? আমার তাতে ভালোই হয়েছে। একটা বিয়ের সম্পর্কের চিকন সুতো দু’জনকে এখনো জুড়ে রেখেছে। তবুও আমরা যোজন যোজন দূর। সে আর বিয়েও করেনি। নোরা ইংল্যান্ড চলে গেছে। ওবাড়িতে খুব একটা শান্তি আছে বলে মনে হয় না।
“বলো অর্না।”
“প্রিপারেশন কেমন?”
“মোটামুটি।”
“মানে কী! তুমি তো কবে থেকে পড়ছিলে!”
“তবুও মনে হয় কিছু পারব না।”
“খুব পারবে। রিলাক্স থাকো।”
“পারছি না তো।”
“কেন বলো তো, কিছু হয়েছে?”
“নাহ, এই পরীক্ষার জন্যই।”
“কোনো প্রবলেম হলে শেয়ার করতে পারো কিন্তু..”
“সত্যি কোনো সমস্যা নাই।”
“ওহ! বেস্ট অফ লাক। আর ডিসটার্ব করব না, রাখি।”
“ভালো থেকো অর্না।”
“তুমিও।”
ফোনটা রেখেই আমার মনে পড়ল আজ একটা চিঠি এসেছিলো। চিঠিটা নিয়ে দেখি তাতে প্রেরকের ঠিকানা সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম। ওখান থেকে কে চিঠি দিলো?
ভেতরে সাদা কাগজে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি। সাথে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ। চিঠিতে লেখা মাত্র কয়েক লাইন-
“কেমন আছ? কাল থেকে ফাইনাল শুরু তাই না? জানি না চিঠি সময়মতো দিনে পৌঁছাবে কি না৷ প্রস্তুতি ভালো তো এবার? জানি তোমার খুব একা একা লাগে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমার সাথে আছি। প্রতিটি মুহূর্ত তোমার মঙ্গল কামনা করছি। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তুমি সফলতার সিঁড়ি বেয়ে বিনা বাধায় উঠে যাও এই দোয়া করি। শুভকামনা ও অজস্র ভালোবাসা রইল।”
– তোমার অপূর্ব
চিঠি পড়ে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। অপূর্ব! কোন অপূর্ব? তাও আবার আমার! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কে? কী করে জানলো আমার আগামীকাল পরীক্ষা? আমার পরিবারের বাইরে কোনো ছেলের সাথে যোগাযোগ নেই। মহিলা কলেজে পড়ার সুবাদে ছেলেবন্ধুও নেই। তবে কি এটা….
বড় আপা এসে আমায় অস্থির দেখে বলল, “কী হলো তোর?”
আমি কাঁপা হাতে তাকে চিঠি দেখালাম। আপা চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে বলল, “এইটার জন্য ভয় পাচ্ছিস কেন?”
“জানি না। কে পাঠালো বলো তো? আমার পরীক্ষার কথা কে জানলো? চট্টগ্রামের কাউকে আমি চিনি না।”
“সব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা একসাথে হয়। এটা জানা কোনো ব্যাপার? মনে করে দেখ হয়তো ফেসবুকের কোনো বন্ধু।”
“আমার ফেসবুকে অচেনা কেউ নেই।”
“না থাকুক। পরীক্ষার আগে এসব উড়েচিঠি কেউ পাত্তা দেয় নাকি? কোন পাগল পাঠিয়েছে কে জানে! তবে অপূর্ব নামটা চেনা চেনা লাগছে।”
আমি ঢোক গিলে বললাম, “হয়তো উড়োচিঠিই। ঠিক বলেছ। এসব দেখার আগেই ফেলে দেয়া উচিত।”
আপা চিঠিটা নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে চলে গেল। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বলল, “মনোযোগ দিয়ে পড় তুই। কেউ আসবে না আর।”
আমি উঠে চিঠিটা নিয়ে এলাম। মনে মনে কয়েকবার আউড়ে নিলাম- ‘অপূর্ব! অপূর্ব!’ চিঠিটাতে কী যেন আছে। মনে হচ্ছে ভরসার একটা হাত। স্বপ্নে দেখা হাতের মতো। একেবারে জাদুর মতো কেমন করে যেন আমার দুশ্চিন্তাগুলো টেনে নিল নিজের মাঝে।
বই খুলে দেখি পড়তে শুরু করলাম। একটু আগের ভয়টা আর নেই। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। মনে হচ্ছে এবার পরীক্ষা ভালোই হবে। বেশ ভালো!
.
পরীক্ষার দিনগুলো বিভীষিকার মতো লাগে আমার। আবার একদিক দিয়ে ভালোও। একেকটা পরীক্ষা চ্যালেঞ্জের মতো। নিজের কাছে নিজের চ্যালেঞ্জ। প্রায় প্রতিটাতেই জিতে যাচ্ছি। তারপর নিজেকে ছোট ছোট গিফট দেই। আবার না পারলে শাস্তিও দেই ঠিক ঠিক। জীবনটা আমার কাছে যেন একটা খেলার অংশ হয়ে গেছে। উপরে ওঠার নেশা পেয়ে বসেছে। তবে জীবন উপভোগ করার ইচ্ছেটা মরে গেছে।
আমার কাছে এক টুকরো অক্সিজেন হলো খুশবু। ও ছাড়া আর কোনো পিছুটান নেই। হ্যাঁ, আমার কিছু হলে মা বাবার কষ্ট হবে, কিন্তু এই স্বামী ছেড়ে আসা কন্যার দায় থেকে মুক্তিও পাবেন। আমিতো হিসেবে তাদের বোঝা হয়ে রয়েছি!
তাই এখন মনে হয়, হয় জীবনে কিছু করব নয়তো মরব। তবুও ধুঁকে ধুঁকে বাঁচবো না। সুইসাইড করার ইচ্ছে কিন্তু নেই। এই মৃত্যু শরীরী মৃত্যু নয়। চলে যাব যেদিকে দু’চোখ যাবে। হয়তো কোনো আশ্রমে সন্যাসিনী হয়ে!
.
শেষ পরীক্ষার দিন আবার সেই স্বপ্নময় বুক স্টোরে গেলাম। সেই বৃদ্ধটিকে পেলাম না। তার কথা জিজ্ঞেস করলে দোকানী মনে করতে পারলো না কার কথা বলছি। বলল তার দোকানে নাকি সে ছাড়া অন্য কেউ বসে না। আমি জোর দিয়ে বললাম, সে বিশ্বাসই করল না। প্রায় দুই বছর আগের কথা কেই বা মনে রেখেছে! এতদিন খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করিনি আমি। এদিকটা মাড়াইনি আর। তবে এখন কিসের যেন হিসেব মনে খচকচ করছে। সেটা মেলাতে গিয়েছিলাম। তা আর হলো কই।
সেদিন আবার একটা চিঠি এলো। চট্টগ্রাম থেকেই।
“ভালো আছ? মনে হয় নেই। তুমি খুব দুঃস্বপ্ন দেখো তাই না? রাতের বেলা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে মনের কষ্টগুলো আকাশে ছড়িয়ে দিও। আমি ঠিক ঠিক সেগুলা খুঁজে নিয়ে নিজের কাছে জমিয়ে রাখব।”
– তোমার অপূর্ব
আমার এবার আগের মতো অবাক লাগলো না। মনে হলো এটা যেন পাওয়ারই ছিল। মানুষটা কে জানার প্রয়োজন নেই। সে থাকুক পাশে।
কয়েকদিন পর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার লেখা আত্মিক উন্নতি সম্পর্কিত “প্রভা” নামের একটা ছোট প্রবন্ধ পত্রিকায় ছাপা হলো। কাজটা মৃন্ময় স্যার করেছেন। আমি স্যারকে ফোন করলাম। স্যার বললেন,
“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?”
“ভয়ানক! কিন্তু আপনি এটা কেন করলেন?”
“অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম পাঠাবো। তোমার লেখা আগের তুলনায় বেশ পরিপক্ক হয়েছে। এটাই তো সময়। আরো বেশি করে লেখো। সবাই চিনুক তোমাকে।”
“কিন্তু স্যার কেমন যেন লাগে। আমি তো এমনি লিখি…”
“যা লেখ, সেসব দেশের মানুষের পড়ার অধিকার আছে। প্রতিভা শুধু নিজের মধ্যে কেন রাখবে? ছড়িয়ে দাও সবার মাঝে। তাছাড়া তুমি তো বলেছিলে পৃথিবীর জন্য কিছু করতে চাও।”
“জি স্যার।”
“তাহলে এটাই তো সুযোগ। কলমের কত শক্তি তা নিশ্চয়ই জানো।”
“আমি কি পারব?”
“অবশ্যই পারবে মেয়ে। তুমিই পারবে।”
লেখা ছাপা হওয়ার ঠিক দু’দিন পর আবার চিঠি-
“লেখাটা পড়লাম। তুমি এত ভালো লিখতে কবে শিখলে? কথাই তো গুছিয়ে বলতে পারো না। অপেক্ষায় রইলাম পরের লেখার। ভালোবাসা নিও।”
– তোমার অপূর্ব
আমি অবসময় সময়গুলোতে আরও কয়েকটা লেখা লিখলাম। স্যারের কাছে সবগুলো পাঠিয়ে দেই। স্যার তার পছন্দমতো লেখা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন পর আবার পত্রিকায় ছাপা হলো আমার নতুন লেখা। এবারেরটা মনস্তাত্বিক ছোটগল্প৷ নাম ‘কাকের কুঁড়ে’। এটা বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেল। তার কিছুদিন পর আরেকটা- নাম ‘সুগন্ধী’।
এই দুটো গল্প ছাপা হওয়ার কিছুদিন পর একটা খুব প্রচলিত ম্যাগাজিনের সম্পাদক স্যারের সাথে যোগাযোগ করলেন৷ তাদের মাসিক পত্রিকার জন্য নিয়মিত লিখতে। আমি লোভীর মতো প্রস্তাবটা নিয়ে নিলাম। লেখালেখিটা এবার খুব জোর দিয়ে শুরু করলাম।
(চলবে)
অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব- ১৮
আমার রেজাল্ট দেয়ার দিনটা সকাল থেকেই গুমট গরম। অস্থির ফাঁপর লাগছে যেন ভেতরটা। আকাশ জুড়ে গনগনে সূর্যটা শাসিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। বড় ভাইয়ার ভালো লাগছে না বলে অফিসে যায়নি আজ। ভাইয়া বাড়িতে থাকলে খুশবু তার সাথেই থাকে। আমি তাই একাকী চুপচাপ ঘরে বসে আছি। সময় যেন কাটছেই না। কলেজে যাব কি যাব না সেই নিয়েও দোটানায় আছি।
বেলা বারোটায় গোসল করে এসে এত ক্লান্ত লাগতে লাগলো যে শুয়ে পড়লাম। আর শুয়েই ঘুম৷ ঘুম ভাঙলো বিকেলে। প্রথমেই মনে পড়ল আজ রেজাল্ট! কী হলো? মোবাইলে অনেকগুলো মিসড কল। কয়েকজন ক্লাসমেট আর মৃন্ময় স্যারের। মেসেঞ্জারে এক বান্ধবী ছবি তুলে রেজাল্ট শীট পাঠিয়েছে। ভয়ে ভয়ে ছবিটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে।
সিজিপিএ ৩.৫৮। ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট জঘন্য খারাপ না হলে ৪ এর কাছাকাছি থাকতে পারতাম। তবে সেটা নিয়ে আফসোস নেই। যা হয়েছে তাই ঢের। যে পরিস্থিতিতে শুরু করেছিলাম তাতে এরচেয়ে বেশি সম্ভব ছিল না। স্যারকে ফোন করতে যাব, তখনই একটা মেসেজ এলো। পরিচিত সেই ফেসবুক আইডি। পরিচিত নাম। বহুদিন কোনো মেসেজ যাওয়া আসা না থাকায় কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল!
সে লিখেছে- “অভিনন্দন।”
আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। কতদিন পর? প্রায় তিন বছর! আহা! এতদিনে আজ মনে পড়ল? জানলো কী করে রেজাল্টের কথা? আমার খুব ইচ্ছে হলো তাকে কিছু লিখতে। বহুবার এলেমেলো শব্দ কীবোর্ডে টাইপ হয়ে মুছে গেল। তবু লেখা আসছে না। ধন্যবাদ দেব? না থাক। প্রয়োজন কী? আবার মনে হলো সে বুঝি অপেক্ষা করে আছে আমি কিছু বলব বলে।
এতদিন পর এই এক শব্দের মেসেজ আবার আমায় কতটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল বলতে পারব না। একদম গোছানো জীবনের মাঝে কালবৈশাখীর মতো এসে ক্ষণেই সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল।
রেজাল্টের কথা কাউকে জানালাম না বাড়ির। প্রথমে যে চিৎকার করে নিজের অর্জনটুকু সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছিলো সেটা মরে গেছে কেমন করে। সব অনর্থক মনে হচ্ছে। এই পড়াশুনা দিয়ে কী হবে যদি মনে শান্তিই না থাকে?
অর্না ফোন করল এর মাঝে।
“ভাবী কংগ্র্যাচুলেশনস। অনেক ভালো করেছ।”
“থ্যাংস। আমার রেজাল্ট তুমি জানলে কী করে?”
“তোমাদের ভার্সিটির ওয়েবসাইটে দেখলাম।”
“ওহ।”
“জানো ভাইয়া তো খুব খুশি হয়েছে।”
তার মানে অর্নার কাছে সে শুনেছে। আমি আবার ভাবছিলাম সে বুঝি খোঁজ নেয়। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আশা দিয়ে সে কেন নিরাশ করে আমায়? অর্না কী কী যেন বলছিল। আমি ফোন কেটে দিলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এলে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলাম। গরমের মধ্যে ফ্যানটাও ছাড়তে ভুলে গেছি। বড় আপা হুট করে কোথা থেকে এসে আমার পেছন থেকে জাপটে ধরে কী একটা বলতে নিয়ে আবার সরে গেল। কপাল কুঁচকে বলল, “এই, তোর গা ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। এই গরমে বসে আছিস কেন?”
“এমনি।”
“এমনি মানে? ভাবখানা দেখো! তুই কি ফেল করেছিস? তোর স্যার ফোন করেছিল বাবাকে। বেশ তো ভালো হয়েছে রেজাল্ট। তাহলে? এদিকে মশায় টেকা যাচ্ছে না। এতক্ষনে সব তোর রক্ত খেয়ে হাতিঘোড়া হয়ে গেছে।”
“ভালো লাগছে না আপা। যাও তো!”
“কেন যাব? আগে বলবি কী হয়েছে।”
আপা ফ্যান লাইট জ্বালিয়ে আমার মুখোমুখি এসে বসল। আচমকা চোখে আলো পড়ায় ভয়ানক বিরক্তি হলো। আমি উঠে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।
আপা চেঁচিয়ে বলল, “গোসল করিস না। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। জ্বরে পড়বি কিন্তু।”
আমি বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। গরমের মধ্যেও ঠান্ডা পানি। বোধহয় মাত্র তোলা হয়েছে। গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। গোসল করলে মনের ভার হালকা হয়। শরীরের ময়লার সাথে মনের কালো কালো কষ্টগুলোও ধুয়ে নিয়ে যায় পানি। চোখ বুজে বসে রইলাম। ভাবার চেষ্টা করলাম, ঝর্নার ধারে বসে আছি। চারপাশে শান্ত বনানী। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে আর পাখিগুলো মিষ্টি সুরে ডাকছে ক্ষণে ক্ষণে। মনটা ভালো লাগলো।
এদিকে বাইরে থেকে মা আর আপার ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। পাত্তা দিলাম না। ঘন্টাখানেক পর বের হলাম। মা আপা বকছে একনাগাড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি চোখমুখ ফুলে আছে। মা হঠাৎ আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের উচ্চতা আমার চেয়ে কম অনেকখানি। আমার বুকের ওপর তার মাথাটা রেখে কাঁদতে কাঁদতে একেবারে ভেঙে পড়লেন।
তাকে ধরে বসিয়ে দিতেই চোখনাক মুছে বললেন, “তুই এমন হয়ে গেছিস কেন? আগের মতো নেই তুই। কেমন যেন শক্ত পাথর পাথর লাগে তোকে। তোর শরীর, তোর বুকের ভেতরটাও পাথর হয়ে আছে। এক স্বামীর সাথে থাকতে না পারলে কি জীবন চলে না কারো? তুই আরেকটা বিয়ে কর। ওকে বল, আরেক বিয়ের কথা শুনলে ও ঠিকই ডিভোর্স দেবে। তাও এমন হয়ে যাস না। আমার ফুটফুটে মেয়ে চোখের সামনে এমন হয়ে গেলে আমি সময়ের আগেই মরে যাব।”
আমার হাসি পেয়ে গেল। বললাম, “সময়ের আগে কেউ মরে না মা।”
মা রাগ হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখেছিস, ওর মধ্যে মায়াদয়া সব মরে গেছে। ও শক্ত ইট হয়ে গেছে। আমার মরার কথা শুনেও হসে।”
আমি বললাম, “একটু আগেই বললা পাথর হয়েছি, এখন বলো ইট। তুমি আগে শিওর হও আমি কী হয়েছি।”
মা বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। হেসে বললাম, “গরম লাগছিলো বলে গোসল করেছি। তাই জন্য এত কান্নাকাটির কী আছে বুঝি না তো।”
“কথা ঘোরাবি না।” তারপর মা আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিয়ের কথা বললেই অমন কথা ঘুরিয়ে ফেলে। আমি কি ওর সাথে পারি বল? তুই দেখিস তো ভালো ছেলে পাস কি না। প্রথমবার তো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। এবার আমি বিয়ে দেব। দেখবি তখন সুখী হয় কি না।”
আপা বলল, “দেখব দেখব। আজ এসব কথা ছাড়ো। ও কত ভালো রেজাল্ট করেছে। ভালোমন্দ কিছু রাঁধো না আজ রাতে।”
মা আমার দিকে তাকালেন। আমি হেসে বললাম, “যাই রাঁধো, ক্ষীরের পায়ের যেন থাকে।”
ঝিনু কোথা থেকে উদয় হয়ে এসে বলল, “আমি চিংড়ির মালাইকারি খাব।”
আপা ঝিনুর কান টেনে বলল, “নিজে তো টেনেটুনে পাশ করিস। আবার আসছে এটা খাব, ওটা খাব।”
মা মুচকি হেসে চোখের কোণের পানি মুছে বলল, “সব রাঁধবো। তোরা মন ভরে খাস।”
.
দু’দিন পর অপূর্বর চিঠি এলো। এবারের চিঠি লম্বা চওড়া।
“শোনো মেয়ে, ভালো থাকো না কেন বলো তো? আমি কাছে থাকি না বলে? আমার কাছে থাকলে তোমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে অনেক যত্ন করে রাখতাম। রেজাল্ট তো দেখলাম। তুমি জানো, আমি সেদিন কত খুশি হয়েছি? অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছি। আমার কোয়ার্টার থেকে কিছুদূর গেলে চাকমাদের বিরাট বস্তি। সব মেয়েগুলোকে শাড়ি কিনে দিয়েছি। ওদের কী একটা অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। নাচগান হয়েছে প্রচুর। তোমার কথা তাদের প্রায়ই বলি। তারা তোমায় নিয়ে একটা গান বেঁধেছে। বলেছে তুমি যখন আসবে এখানে, তখন শোনাবে।
সকালের সূর্যটা পাহাড়ের মাথা থেকে যখন ওঠে, পূর্বাকাশ লাল হয়ে সিঁদুররঙা দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, প্রতিদিন সে দৃশ্য দেখে আমি দিন গুনি কবে তোমাকে আমার কাছে এনে রাখতে পারব, একসাথে সূর্যোদয় দেখব। পাহাড়ি নদীটার পাড়ে সুযোগ পেলে গিয়ে বসে থাকি। তোমার জন্য পাশে জায়গা থাকে। জায়গাটা প্রতিবার আমায় জিজ্ঞেস করে, এনেছ তাকে? আমি নিরাশ হয়ে বলি, না, সে আসেনি। জানো, পুরো প্রকৃতিটা তখন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে, তাকে নিয়ে এসো। সে ছাড়া সবকিছু অসম্পূর্ণ!
তোমার জন্য তিনটা শাড়ি কিনেছি। একটা বেগুনী পাড়ের, জমিন আকাশের মতো হালকা নীল। আমার কোয়ার্টারের বাইরে বুনোফুলের ঘন ঝোপে গাঢ় বেগুনী ফুল হয়। শাড়িটা পরে সেই ফুল খোঁপায় গুঁজে কোনো এক শরতের বিকেলে তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাব। যাবে তো?
ঝকমকে শহুরে মেয়ে আমার কোনো কালেই পছন্দ নয়। আমার তো তোমার মতো শ্যামবর্ন গভীর চোখের স্বচ্ছ মনের মেয়ে পছন্দ। যাকে হুট করে পাহাড়ি পথের বাঁকে দেখতে পেলে মন ভরে যাবে। ঘন অরন্যের মাঝে যে মিশে যাবে অপরূপা প্রকৃতির সাথে!
প্রতীক্ষার প্রহর গুনে গুনে হাত ক্ষয়ে যাওয়ার আগে চলে এসো তুমি।
অনেক কিছু লিখে ফেললাম। আজকের মতো ঢের। শুধু আমার জন্য হলেও ভালো থেকো। ভালোবাসা রইল।”
– তোমার অপূর্ব
চিঠি পড়ে দুই ঘন্টা আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। এই লোক কে? এমনিতেই বাঁচি না, তার মধ্যে আরেকটা ক্যাচাল! ইচ্ছেমতো কতক্ষণ গালাগালি করলাম এই চিঠিদাতাকে। কঠিন গালি দিয়ে মনটা কেমন হালকা হয়ে গেল। হালকা মনে বসন্তের নতুন পাতার মতো কিছু একটা গজিয়ে উঠলো। কোথা থেকে একঝলক হাওয়া দোলা দিয়ে গেল মনে।
.
মাস্টার্সে ভর্তির পর লেখালেখি কমে গেল। শুধু পড়তে ইচ্ছে করে। পড়িও দিনরাত। ইদানিং একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছি। বাড়ির পাশেই কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ছোট ছোট বাচ্চারা আসে, বেশ লাগে তাদের পড়াতে। আমাকে সবাই ভালোবাসে, কথা শোনে। চুপ করে আমার ক্লাস করে। কেমন করে যেন প্রতিটা বাচ্চা আপন হয়ে গেছে। কাছে গেলে মনে হয় জড়িয়ে ধরে রাখি সবাইকে।
.
আপা এসেছে অনেকদিন হলো। আসার কয়েকদিন পর আবিষ্কার করেছি সে ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করে এসেছে। ভাইয়া তাদের সময় দেয় না। ভাইয়া প্রতিদিন ফোন করছে, কিন্তু আপা প্রতিবার ফোন ধরে ঝগড়া করছে। মিটমাটের লক্ষণ নেই। জানা কথা ভাইয়া আসলেই আপা চলে যাবে। কিন্তু উনি আসার সময় পাচ্ছেন না। আর তাতেই আপা রেগে আরো আগুন হয়ে আছে।
রোজ রোজ তাদের মিঠে খুনসুটি শুনে ঘুম ভাঙে। রাতে ঘুমানোর আগেও সেই ফোনে ঝগড়া। ঝাড়ি দিয়ে বলা কথার মধ্যেও ভালোবাসা লুকানো। ভাবি, এরা এতদিন আলাদা আছে কী করে? এতই যখন প্রেম তখন কষ্ট করে দূরে থাকার কী মানে?
একদিন সময় করে ভাইয়া এলো। তাও ঝড় তুফানের সন্ধ্যায়। বিদ্যুৎ নেই। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। ভাইয়া আসার সাথে সাথে আপা ঝগড়া করতে শুরু করল। এই দুর্যোগের মধ্যে আসার জন্য চিৎকার করে আশেপাশের সবার মাথা খারাপ করে ফেলল। সেই সাথে নিজেই ভাইয়ার মাথা মুছে দিল। ভেজা শার্ট খুলে শুকনো জামা পরিয়ে দিল। তারপর খুব মন দিয়ে সরিষার তেল দিয়ে মুড়িমাখা আর মসলা দেয়া রং চা বানিয়ে ভাইয়াকে খাওয়ালো।
আমরা শুধু দেখি আর হাসি। আপা আমাদের হাসি দেখলে রেগে চেঁচামেচি করে। চোখমুখ গরম করে ভাইয়ার পাশ ঘেঁষে বসে থাকে।
তাদের দেখলে আমার আরো বেশি করে তার কথা মনে পড়ে। আজ একসাথে থাকলে কি এমন খুনসুটি আমাদের মধ্যেও হতো? একেকবার ভীষণ রাগ হয়। মা ঠিক তো বলে। নতুন জীবন শুরু করতে। কতদিন এমন একলা পড়ে থাকব? কিন্তু কাউকে বিশ্বাস হয় না যে! তারপর অপূর্বর কথা মনে পড়ে। ছেলেটা তার শেষ চিঠিতে ফোন নাম্বার দিয়েছে। বলেছে চট্টগ্রাম যেতে। তার সাথে দেখা করতে। অনেক কথা নাকি বলার আছে। আমারও তাকে অনেক প্রশ্ন করার আছে। সে কি ভালো মানুষ? সে কি আমায় সত্যি ভালোবাসে? আমিও কি তাকে ভালোবাসতে পারব? অনেক প্রশ্নেরা ঘুরপাক খায় মাথায়। একঘেয়ে জীবনটা অসহ্য লাগে এখন। একবার কি যাব সেখানে? দেখা করব অপূর্ব নামক অদ্ভূত চরিত্রটির সাথে?
পরদিন ঝকঝকে সকাল হলো। মেঘ কেটে সোনালী সূর্য উঠলো। আপা ভাইয়ারা বাড়ির পথে রওনা হবে। আপাকে গোছগাছ করে দিতে দিতে বললাম, “আপা, আমি তোমাদের সাথে যাব।”
আপা খুশি হয়ে বলল, “সত্যি যাবি?”
“ইচ্ছে করছে।”
আপা নেচে উঠে আরেকটা ব্যাগ নিয়ে এল তক্ষুনি। বলল, “গুছিয়ে ফেল কাপড়চোপড়।”
স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। হাতে আর কাজ নেই। কলেজও বন্ধ। সুযোগে ঘুরে আসা যায়। মজার ব্যাপার হলো আপার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। গেলে অপূর্বর সাথে দেখা করার সুযোগ পাব। সে যেই হোক, তাকে বলব পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যেতে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার তীব্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছে আমায়।
(চলবে)