অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-২৭,২৮
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব-২৭
“তুমি এখন থেকে এখানে থাকবে?”
“জ্বি।”
“একেবারে?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মা বাবা আসতে দিলো?”
“আমার মা মারা গেছেন।”
“ওহ ভুলে গেছিলাম। বাবা কিছু বলল না?”
“না।”
“শুনলাম কলেজের টিচার হয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কী আর বলব তোমায়! বোকা মেয়ে! সম্মানের চাকরি পেয়েছ। দেখেশুনে অন্য কোথাও বিয়ে করে নিলে সুখী হতে পারতে!”
“তা ঠিক বলেছেন।”
“তবুও ফিরে এলে কেন?”
“তাকে কথা দিয়েছিলাম ফিরব।”
“সে তোমার সাথে থাকতে চায়?”
“হ্যাঁ।”
“ও তো কিছুদিন পরই পুরানো জিনিস ভালো লাগে না। তোমাকে এখনো এত পছন্দ করে কী করে সেটা বিরাট রহস্য!” শ্বাশুড়ি মা মুখ হাঁড়ি করে পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় বসে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যত্ন করে ফরসা মুখে কালি মেখে দিয়েছে। চিন্তার ঘোরে আমায় কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আমার হাসি পাচ্ছে।
আমি বসে আছি আমার শ্বশুরবাড়ির ড্রইংরুমে। সে বিনা নোটিশে হুট করে আমায় একেবারে তুলে নিয়ে এসেছে। এসেই কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে। আমায় রেখে গেছে এই মূর্তিমান বিভীষিকার কাছে। যদিও তাকে আগের মতো ভয় পাই না। ভক্তিও করি না। উল্টে করুণা হচ্ছে। মহিলা সারাজীবন তার ছেলেটিকে নিজের মতো চালাতে চেয়েও পারেনি৷ সে ছেলে জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে। মাকে কষ্ট দিয়েছে। আবার নিজের দেয়া ক্ষত নিজেই সারিয়ে তুলেছে। সমানে বসা মহিলাটির অবস্থাও একপ্রকার আমার মতোই। তবে আমি উনার কষ্টটা বুঝতে পারলেও উনি আমারটা বুঝতে পারেন না, এটাই সমস্যা।
শ্বাশুড়ি মা পা নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, “থাকতে চাইলে থাকো, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। আমার তো বুঝে কাজ হলো না। তুমি না বুঝেই বসে থাকো।”
সে ঘরে ঢুকলো তখন। আমার পাশে বসে হাসিমুখে বলল, “মা ওকে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে আর একা থাকলাম না।”
শ্বাশুড়ি মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, “ভালো করেছ৷”
সে এবার মায়ের কাছে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে বলল, “দেখো মা, সব ঠিক চলবে এখন থেকে। তোমার ওকে আগে পছন্দ ছিল না, এখন হয়েছে তো? ও কলেজে চাকরি করে। স্মার্টলি কথা বলতে পারে। তুমি যেমন চাইতে ঠিক তেমন।”
শ্বাশুড়ি মা থমথমে গলায় বললেন, “হ্যাঁ দেখেছি।”
“গুড। মিলেমিশে থেকো তোমরা। আর আমি এই সপ্তাহে অফিসে জয়েন করছি। সো তোমার থেকে দূরে যাওয়ার চান্স নেই। ফর দ্যাট, য়্যু শুড থ্যাংক সমাপ্তি।”
মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “সমাপ্তিটা কে?”
“এইযে তোমার বউমা। এই নামেই তো লেখালেখি করে!”
শ্বাশুড়ি মা আমার দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত আমার লেখা পড়েছেন। কিন্তু জানতেন না আমি লিখেছি। আর ও সারপ্রাইজ দেয়ার আনন্দে ঝলমল করছে। মা বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। আমার কাছে এসে মাথায় হত রেখে বললেন, “অনেক ভালো লেখো তুমি মা, আমি পড়েছি। সবসময় এভাবে লিখতে থেকো। দেখবে একদিন সবাই তোমাকে এক নামে চিনবে।”
আমি তার মুহূর্তেই পরিবর্তিত রুপ দেখে বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। শেষ হলো শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসার ঘটনার সমাপ্তি। যতটা নাটক হবে ভেবেছিলাম ততটা হলো না দেখে একটু কষ্ট পেলাম। প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম যে!
.
প্রথম তিনটা সপ্তাহ ঝুম ঝুম বৃষ্টির মতো ভালোবাসা ঝরে পড়ল চারদিকে। চতুর্থ সপ্তাহে ঈশান কোণে কালো মেঘের ছায়া দেখতে পেলাম। সেদিন ভোরে উঠে দেখি সে রেডি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “এত সকালে যাচ্ছো কোথায়?”
সে টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল, “একটা জরুরি কাজ আছে।”
“তাই বলে এত সকালে?”
“এক ক্লায়েন্টের বাড়িতে যাব। খুব করে ধরেছে। পদ্মার পাড়ে তার বিরাট বাড়ি। বাউন্ডারির ভেতর মাছ ধরার পুকুর, খেলার মাঠ, গরু, ছাগল, মুরগির খামার, সুইমিং পুল পর্যন্ত আছে। সেখান থেকে এসে দুটোয় মিটিং ধরতে হবে। তাই একেবারে বেরিয়ে যাচ্ছি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “সেটা আগে বললে না কেন?”
“মনে ছিল না বলতে।”
“আজই কেন যাবে? অন্যদিন যেও, সারাদিন থেকে এসো।”
এবার সে রাগত স্বরে বলল, “আমারটা আমাকে বুঝতে দাও। নিজের মতামত চাপিয়ে দেবে না। আমার পছন্দ নয়।”
এই অতি সামান্য কথাটুকুর জন্য বের হওয়ার আগে আর আমার সাথে একটা কথাও বলল না। সোজা চলে গেল। এমন আগেও হয়েছে। তখন আমি নিজে তাকে সরি বললে তারপর কথা বলেছে। আর না বললে তার রাগ কমার জন্য বহু সময় কথাবার্তা বন্ধ রেখে তারপর স্বাভাবিক হয়েছে।
আমি ভেবেছিলাম হয়তো এবার ঠিক হবে, হলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়লাম। তবে ভেঙে পড়লাম না এবার। কিছু করার দরকার। মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকলেই মানসিক ডাক্তারের ঠিকানাটা চোখে পড়ে। একবার যাওয়া খুবই দরকার। আজ বুধবার। তার বসার কথা।
.
ডাক্তারের চেম্বারটা দেখে বেশ মজা লাগলো। পুরোটা গোলাপী৷ জানালার পর্দা, দেয়ালের রঙ, সোফার কুশন সব হালকা গোলাপী রঙের। গোলাপীর মাঝে জানালা গলে আসা দিনের আলোতে মনে হচ্ছে ঘরের বাতাস পর্যন্ত এই রঙ ধারন করেছে। ডাক্তারের বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। হাসিখুশি অত্যন্ত সুদর্শন চেহারা। কণ্ঠ পর্যন্ত চমৎকার। আমাকে প্রথমেই বলে নিলেন, “ছোট মেয়ে, তোমাকে তুমি বললে অসুবিধা নেই তো?”
আমার ঘটনা উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চাচ্ছো তোমার স্বামীর রোগ সেরে যাক?”
“হ্যাঁ।”
“শোনো” উনি এমনভাবে বলতে শুরু করলেন, যেন বাচ্চা মেয়েকে বোঝাচ্ছেন, “যে মানসিক রোগ কোনো ট্রমা বা অন্য কোনো কারনে হয়, সুস্থ মানুষ হঠাৎ রোগী হয়ে যায় সেটা ঠিক করার চেষ্টা করাই যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলতাও ধরা দেয়। কিন্তু জন্মগত আর বিশেষ করে আচরনগত সমস্যার প্রতিকার মুশকিল! তোমার মতে সে কখনো কখনো খুবই ভালো, আবার কখনো খারাপ। তার মানে সে পরিষ্কার চিন্তা করতে পারে। তবে তার চিন্তাগুলো অন্য সবার থেকে আলাদা। আর তার ভুলগুলো সে নিজের মতো সুন্দর ব্যাখ্যা করতে পারে। তাই না?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
উনি বললেন, “তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার জগতটা অন্যরকম। একটু একটু করে সে সেখানে বেড়ে উঠেছে। তুমি চাইলেই তাকে সেখান থেকে টেনে অন্য একটা জগতে নিয়ে আসতে পারবে না। ব্যাপারটা অসম্ভবের কাছাকাছি। আমার ধারনা সে ভালো মানুষ। সে যা করে, নিজের চিন্তা অনুযায়ী সেটাই সঠিক। তাই তাকে ভুল ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টাতে সে রেগে যায়। আর সে তার মাকে যেমন ভালোবাসে, ততটাই তোমাকেও বাসে। তাই তোমাকে সে ছাড়তে পারছে না। সে তোমার সাথে যা করেছে তার হিসেবে উপায় না পেয়েই করেছে।”
আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার অফিসের ঘটনাটা। সেদিন সে ফ্লোরে বসে পড়ে বলেছিল, “সীতাকে যখন বনবাসে পাঠিয়ে দিল তখন রামের কিছু করার ছিল না।”
আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন আমি কী করতে পারি?”
“তার সাথেই যদি থাকতে চাও, মানিয়ে নিতে হবে এভাবেই। তাকে স্পেস দিতে হবে। তর্ক করা যাবে না। সে যা বলবে, সেটা যদি অন্যায়ও হয়, মেনে নিতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
আমি চুপ করে রইলাম দেখে একটু পর উনি বললেন, “এটা পৃথিবীর কোনো স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব না।” বলেই হো হো করে হেসে ফেললেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “সরি ডিয়ার, তোমার কষ্টে হাসা উচিত হয়নি। আমি অবশ্য তোমার ব্যাপারে না, নিজের কথা মনে করে হেসেছি। আমি আমার স্ত্রীকে বেশি সময় দেই না, নিজের মতো থাকি, এই অপরাধে সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”
ডাক্তারকে খানিকটা মুষরে পড়তে দেখে কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা আপনার ঘরের সব গোলাপী কেন?”
উনি হেসে একটা ছবির ফ্রেম আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দুই ঝুটি করে ভীষণ সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে। হাসিতে উজ্জ্বল মুখ। সামনের দুটো দাঁত নেই। পরনে গোলাপী জামা।
ডাক্তার বললেন, “আমার মেয়ে যখন আমার সাথে থাকতো, তখন জেদ ধরে পুরো বাড়ি গেলাপী রঙ করিয়েছিল। তার প্রিয় রঙ। সে চলে যাওয়ার পর আমি অন্য রঙটা বদলাতে পারিনি। তার চয়েস যদিও এখন বদলে গেছ, অনেক বড় হয়ে গেছে মেয়েটা।”
ডাক্তারকে আমার খুব ভালো মনের মানুষ মনে হলো। তবে মানুষটা একাকী, বিষন্ন। আচ্ছা, ওকে ছেড়ে চলে গেলে ও ও কি এমন হয়ে যাবে? খুব কষ্ট পাবে? আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি ওকে ছেড়ে যাব না কোথাও। যেমন আছি, তেমনি থাকব।”
.
ভাবা আর করা দুটো এক নয়। একটা মাস আমি ভালোই রইলাম। তার সাথে মানিয়ে চললাম। সেও ভালো। হঠাৎ একদিন ছোট্ট বিষয় নিয়ে আবার ঝগড়া। আমিও রাগ সামলাতে পারলাম না। তার অনেকগুলো কথার কাটা কাটা জবাব দিয়ে দিলাম। সে এক পর্যায়ে আমায় সজোরে থাপ্পড় মারলো। আমি এতটা আশা করিনি। সেও সাথে সাথে ভু্ল বুঝতে পেরে মুখটা করুণ করে ফেলল। আমার হাত ধরে বলল, “আমি ইচ্ছে করে করিনি….সরি…রাগ করো না প্লিজ…”
সে রাতে আমি তার সাথে কথা বললাম না। সে অনুতপ্ত হয়ে রইল। কথা দিল আর করব না। এক সময় ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু আমি ভাবিনি গায়ে হাত তোলাটা তার নেশায় পরিণত হয়ে যাবে। এটা শুধু তার ক্ষেত্রে না, বহু পুরুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে একবার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মজাটা বুঝে যায়, সে সহজে সেটা ছাড়তে পারে না।
এরপর কথায় কথায় চড়- থাপ্পড় দিতে শুরু করল। একদিন এত জোরে ধাক্কা দিল যে আমি খাটের কোথায় মাথায় বাড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেলাম। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে গেল জায়গাটা।
সে দ্রুত ছুটে এল। আদর করে আমায় তুলে খাটে বসালো। মুখে সরি বলেই যাচ্ছে। আমার আর সহ্য হলো না৷ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। চিৎকার করে বললাম, “আর কোনেদিন আমার কাছে আসবে না! তুমি জানোয়ার হয়ে গেছ। আমি আর থাকতে পারব না তোমার সাথে। এই বাড়িতে আর কোনোদিন ফিরে আসব না। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছ তুমি!”
(চলবে)
অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব- ২৮
বৃষ্টিতে ভেজা পথঘাট। ঝিকমিক করা রোদের মাঝে হীরকচূর্ণের মতো বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ছে। সেই সাথে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে খুশবু হাততালি দিতে দিতে ছড়া কাটছে,
“রোদ হয়, বৃষ্টি হয়,
খ্যাঁকশিয়ালীর বিয়ে হয়…”
ছড়াটা তাকে শিখিয়েছে ইভা। খুশবু মনের আনন্দে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি জমা করছে হাতের তালুতে। পানিটুকু ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার মুখে। ছোট্ট মেয়েটা চাইছে আমি তাকে বকা দেই বা হাসি বা কিছু একটা বলি। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রয়েছি সেটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।
মেয়েটা আজ বড় খুশি৷ আমি যখন চলে গিয়েছিলাম তখন তার সে কী কান্না! দু’দিন কেঁদেই কাটিয়েছে। অনেক কষ্টে তাকে সামলেছিল ইভা। আজ আমাকে পেয়ে সে খুশিতে পারলে ডিগবাজি দেয়। কিন্তু আমার এই চুপচাপ থাকাটা তার হজম হচ্ছে না। মাথার ব্যান্ডেজটাও বার কয়েক হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। প্রতিবার বলেছে, “অনেক ব্যথা ফুপি মা?”
আমি উত্তর দেইনি।
আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মনটা বিষাক্ত হয়ে আছে। আমায় এভাবে দেখে ইভা এসে কিছুক্ষণ পর খুশবুকে নিয়ে গেল।
ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলাম অন্ধের মতো। একটা সিএনজি সামনে পেয়ে উঠে পড়েছিলাম। সাথে না ছিল মোবাইল, না টাকার ব্যাগ। কোনোরকম বাড়ির ঠিকানা বলে মরার মতো পড়ে ছিলাম সিটে। সেই সিনএনজিওয়ালা লোকটা আমাকে মাঝরাস্তায় একটা ডিসপেনসারিতে নিয়ে যায়। প্রায় জোর করেই ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়। আমি তাকে বলি, “টাকা নেই।” লোকটা হাসে। ডাক্তারকে নিজের পকেট থেকে টাকা দেয়।
তারপর নিরাপদে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। বাবা তাকে টাকা দিতে জোর করলেও নেয়নি। লোকটার বেশ বয়স। যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে গেছে, “আমার মাইয়াডাও আফনের মতোইনই। মেল্লা দিন দেখবার পারি না। হুনছি জামাই বাইত গিয়া বালা নাই। আফনে বালা থাইক্কেন মা।”
লোকটা কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিল আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাচ্ছি। আমি লক্ষ্য করেছি, আমার আশোপশের মানুষগুলো হয় খুব ভালো, নয়তো খুব খারাপ হয়। মাঝামাঝি পর্যায়ের স্বাভাবিক জীবন আর পেলাম না!
বাবা ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে গেলাম তার ঘরে। বাবা একটু অসুস্থ। হাঁটুর ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়েছেন একেবারে। এখন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন পা দুটো কুসুম গরম পানিতে চুবিয়ে। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললেন, “শুধু আজকেই মারল নাকি আগেও মার খেয়েছ?”
আমার চোখে পানি চলে এল। বাবা প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, “তোমাকে এখন আমার মারতে ইচ্ছে করছে। পড়াশুনা শিখেছ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখোনি? সে মারল আর তুমি মার খেলে? জানতাম সে ছেলে ভালো হবে না কোনোদিন। তবুও এত যেতে চাইলে, এখন শখ মিটেছে নাকি ঘা শুকালে আবার ছুটবে?”
আমি এবার কেঁদেই ফেললাম। বাবা একটু নরম সুরে বললেন, “আর তোমাকে যেতে দেব না। এবার আমি দেখব কেমন করে ডিভোর্স না দেয়। এখন যাও, কিছু খাচ্ছ না নাকি? খেয়ে রেস্ট নাও। পরে কথা বলব।”
ধীরে ধীরে আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ইভা খাবার নিয়ে এসেছে। সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে চিরতা পাতা বেটে নিয়ে এসেছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ও জোর করে নিজের হাতে খাবার আমার মুখে গুঁজে দিল।
এখন আর রোদ-বৃষ্টির খেলা নেই। আকাশ কালো হয়ে এসেছে। শো শো বাতাস বইছে। অনেক বৃষ্টি হবে হয়তো। হোক, প্রাণ জুড়োক একটু।
বিকেলের দিকে ঝিনু হঠাৎ দৌড়ে এলো আমার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ফোনটা দিয়ে বলল, “অর্না আপু ফোর করেছে।”
আমি ফোন সরিয়ে বললাম, “কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
ও জোর করে মোবাইল কানে ধরে বলল, ” কথা বল!”
কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলেও ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছু শুনতে পেলাম না। আমি ভয় পেয়ে কল কেটে আমি আবার কল দিলাম। ও কেটে দিল। একটু পর মেসেজ পাঠিয়ে দিল, “মা ভাইয়া দুজনেই মারা গেছে।”
মেসেজটা দেখে হঠাৎ মনে হলো হাজার হাজার তীর বিঁধে গেছে বুকে। এটা কী লিখেছে ও? ঠিক লিখেছে নাকি ভুল করে অন্য কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে? আমি বোবার মতো ঝিনুর দিকে তাকালাম। ঝিনু কাঁদছে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে। আমি স্ট্যাচু হয়ে বসে রইলাম। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। তারপর মনে হলো, মিথ্যে বলছে না তো আমাকে নেয়ার জন্য? তাই যেন হয়, আমি গিয়েই দেখি।
কীভাবে কীভাবে পৌঁছেছি জানি না, দেখি বাড়ি লোকজনে ভর্তি। বহুকষ্টে ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। এতক্ষণ বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো হয়তো এটা তাদের কোনো নাটক! যদি হতো!
নাহ, সত্যি দুটো লাশ শুয়ে আছে। তার শরীরটা রক্তে ভেজা। ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে। ঠোঁটদুটো কালো হয়ে শক্ত হয়ে আছে। সে সত্যি মরে গেছে! আর আমার শ্বাশুড়ি! এত জাদরেল মহিলা চুপচাপ শুয়ে আছেন। গায়ে গয়না নেই, মুখটা সাদা হয়ে আছে।
সবাই বলাবলি করছে, ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছে, আর মা খবর পেয়ে স্ট্রোক করেছে! আর কিছু কানে গেল না। বাইরে জোরালো শব্দে বাজ পড়ছে। লোডশেডিং হয়ে ঘরবাড়ি অন্ধকার হয়ে গেছে। শুধু বাতাসে পর্দাগুলো দুলে উঠছে আর বিদ্যুতের চমকে ঘর ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হয়ে উঠছে।
আমি আরেকবার তার দিকে তাকালাম। তখনই জেনারেটরের আলো জ্বলে উঠল ঘরময়। বাতাসে তার শরীরের ওপরের চাদরটা সরে গেছে। আর চুলগুলো রক্ত জমে শক্ত হয়ে আছে। আর কোনোদিন রেশমী চুলগলা কপালে ছড়িয়ে থাকবে না, আর কখনো গাল টেনে আদর করে দিতে পারব না। কক্ষনো আর সে আমার দিকে তাকাবে না। সে বহুদূরের অজানায় হারিয়ে গেছে একটা মৃত শরীর রেখে…
আমার নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে গেছে। চারদিকে আর্তনাদের শব্দে দমবন্ধ হয়ে আসছে। মৃত্যুপুরীর বাতাসটা আমার গায়েও লাগলো। আমি ঢলে পড়লাম। কে যেন ধরল। জ্ঞান হারানোর আগে আমি শেষবারের মতো তার গায়ের ঘ্রাণটা পেলাম। রজনীগন্ধার মতো, তবে আজকের ঘ্রাণটা রক্তের গন্ধের সাথে মিশে আছে!
.
তিনটে মাস। খুব বেশি, নাকি কম? আমার স্বাভাবিক হতে তিন মাস লেগেছে। এতদিন কী করেছি, কোথায় ছিলাম কিচ্ছু মনে নেই। যখন থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছি, আমি তখন হাসপাতালের ছোট্ট একটা কেবিনে। মাথাটা সারাদিন ঘোরে। আর ভুলভাল বকতে থাকি। আমার বিছানার সামনে জানালা। জানালার ওপাশে গাছপালা দেখা যায়। গাছের ডালে একটা হলদে পাখি ছানাপোনা নিয়ে বাস করে। পাখিটা মাঝে মাঝে জানালার গ্রীলে এসে বসে। মনে হয় কিছু বলতে চায়, তারপর না বলেই চলে যায়।
মাথা ভালো হওয়ার পর একটু একটু করে জেনেছি, সেদিন সে একসিডেন্ট করেছিলো। জোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল মালবাহী ট্রাকের সাথে। গাড়িটা একেবারে থেঁতলে গেছিল। সে ছিটকে পড়েছিল অপর পাশে রাস্তায়। তবে ট্রাক ড্রাইভারের মতে একসিডেন্টটা স্বাভাবিক নয়, সে বলেছে গাড়িটা ইচ্ছে করেই তার ট্রাকের দিকে ছুটে এসেছিল। যদিও একথা কেউ বিশ্বাস করেনি। নেশা করে ট্রাক চালানোর অপরাধে সে এখন জেলে। তবুও আমার মাথায় চিন্তারা দানা বাঁধে, সত্যি কি সে আত্মহননের চেষ্টা করছিলো? কিন্তু কেন?
একদিন আমাকে দেখতে আমার শ্বশুর এলেন। আগেও নাকি এসেছিলেন, আমার জ্ঞান ছিল না তখন। উনার বয়স ষাটের বেশি না, এখন আশি দেখায়৷ উনার সাথে কখনো কথা হয়নি তেমন, তাই স্বাভাবিক হয়ে কিছু বলতে পারলাম না। উনি শুধু করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
একসময় বললেন, “আমার বড় ছেলেটা এমনিতে একটু পাগলাটে হলেও কাজেকর্মে বড় ভালো ছিল। ও অফিসে থাকলে আমার আর ভাবতে হতো না কিছু। কিন্তু ওর পার্সোনাল লাইফ নিয়ে আমি কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। ছেলেটার কী থেকে কী হয়ে গেল তাই বুঝতেও পারিনি।”
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি এমন হলে কি চলবে মা? তোমার সারাজীবন তো পড়েই আছে। এই শোক কাটিয়ে উঠে একটা বিয়ে করে সুন্দর সংসার করো। তোমাকে এভাবে দেখলে আমার ছেলেটাও ওপাড়ে শান্তি পাবে না।”
উনি যাওয়ার আগে আমার সেই ফেলে আসা মোবাইলটা দিয়ে গেলেন। চার্জহীন বন্ধ মোবইল। চার্জ দিয়ে অন করার পর দেখা গেল অনেক কল আর মেসেজে ভর্তি। মোবাইল লক করা ছিল বলে কেউ দেখেওনি। মেসেজের ভিড়ে হঠাৎ চোখে পড়ল তার একটা মেসেজ! তার মোবাইল থেকে পাঠানো শেষ মেসেজ! কাঁপা হাতে মেসেজটা ওপেন করলাম৷ সেখানে লেখা-
“I can feel your pain. But believe me, I can’t control myself! Promise, I will never hurt you again. I love you…I love you more than my life…”
জানালা দিয়ে দমকা বাতাস ছুঁয়ে দিল আমাকে। মেসেজটা মৃত্যুর আগে আগেই পাঠিয়েছে। সে কি মারা যাওয়ার আগে বুঝতে পেরেছিল নাকি মৃত্যুটা তার ইচ্ছেমৃত্যু ছিল?
মানুষটাকে আমি মরার পরও বুঝলাম না, হায়! আজ মনে হলো, আমি অনেক বোকা। অনেক অনেক বোকা। অতল জলরাশির মাঝে পা রাখার ঠাঁই খুঁজছিলাম!
(চলবে)