অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-৯,১০
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব- ৯
দুই মাস হয়ে গেল আমরা এসেছি৷ একেবারে যেন তুলোর মতো উড়ে উড়ে সময়গুলো চলে গেলো! আমার কাছে এই নতুন অচেনা জায়গায় নিজের মতো করে সংসার করার অনুভূতিটা প্রতি মুহূর্তে আনন্দ দেয়। একটা মেয়ের এমন স্বপ্নই তো থাকে! এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে কল্পনার মতো চমৎকার একটা মানুষের সাথে জীবন কাটানোর। না আছে কোনো লোকের কথা, না আছে সমাজের ভয়, আত্মীয়স্বজনের ভিড়ভাট্টা…কিচ্ছু না।
সে সকালে উঠে খেয়ে অফিসে চলে যায়, ফেরে সন্ধ্যায়। আমার দিন কাটে ঘরের কাজ করে, রান্না করে, বই পড়ে আর টিভি দেখে। মায়ের সাথে, আপার সাথে, ঝিনুর সাথে ফোনে কথা হয়। কখনো বা বিকেলে সে আগে আগে ফিরে আমাকে নিয়ে সে হাঁটতে বের হয়। চা বাগান দেখাতে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর চা খেতে খেতে সারাদিনের গল্প বলে, ক্লান্ত থাকলে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। আমি অপলক তার অপূর্ব মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি অনেক…অনেকক্ষণ…এইতো..আর কী চাই জীবনে?
তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেও সে জবাব দেয় না। এড়িয়ে যায় সযত্নে। আমিও তাই আগ্রহ দেখাই না। তারটা সে বুঝুক। আরেকটা আশ্চর্যের বিষয় হলো সে আমাকে পড়াশুনার কথা বলে না। এ পর্যন্ত একটিবারও বলেনি। আমি অবশ্য বেঁচে গেছি পড়া থেকে মুক্তি পেয়ে৷ তবে অবাকও হয়েছি।
এদিকটায় প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। কাছেপিঠে বাড়িঘর না থাকায় রাতের বেলা পুরো বাড়ি গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়। এক রাতে এই আঁধারের মাঝে সে আমাকে ছাদে নিয়ে গেল। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠেছে। চারপাশ ভিজে যাচ্ছে রূপালী আলোয়। দূরের নদীর পানি চিকচিক করছে। আর খোলা জায়গায় ঝাঁকড়া গাছের বিশালাকার ছায়া ভুতুড়ে এক আবহ সৃষ্টি করেছে। তবে সে হাত ধরে থাকায় ভয় হচ্ছে না একটুও।
সে আমাকে ছাদের কোণায় নিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো প্রশান্তিগুলো হৃদয় ভেদ করে গেল, অনুভব করলাম তার শরীরের উষ্ণতা। অনেক সময় পার হলো। সে হঠাৎ বলল, “মনে করো আমি অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেলাম, কাজকর্ম করতে পারি না, ঠিকভাবে চলাফেরাও করতে পারি না। তোমার ওপর ভরসা করে চলতে হয়। তখন তুমি আমাকে এখনকার মতো করে ভালোবাসবে?”
আমি হেসে ফেলে বললাম, “সময় বলে দেবে। তাছাড়া উল্টোটাও তো হবে। তখন?”
“উমম…সেটাও নাহয় সময় বলে দেবে। আচ্ছা, তুমি আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো?”
“তোমায় কেন ভুল বুঝব?”
“বলো না তুমি! যদি পরিস্থিতি তেমন হয়, ভুল বুঝবে না তো?”
“নাহ।”
“কক্ষনো না?”
“কক্ষনো না!”
“তোমার শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে দেখা করতে, তাদের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে?”
আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি বলতে ইচ্ছে করে না। শ্বাশুড়ি মায়ের কথাগুলো কানে বাজে। “তুমি কারো সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না!”
আমার নিরবতার সে কী মানে বের করল জানি না। সেও চুপ হয়ে গেল। আকাশ থেকে হঠাৎ তারা খসে পড়লো। সে আরেকটু শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “তারা খসার সময় কিছু চাইলে নাকি পূরণ হয়?”
“কার কাছে চাইবে?”
“জানি না।”
“আল্লাহর কাছে চাও, তিনি যেন আমাদের জীবনে এমন ধ্বস না আনেন।”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “চাইলাম!”
.
পরদিন সকালে আমাদের জাফলং যাওয়ার কথা। খুব ভোরে উঠে দেখি সে পাশে নেই। পুরো বাড়ির কোথাও নেই। ফোনটা ফেলে গেছে। এত সকালে অফিসে যাওয়ার কথা না। অনেকটা সময় হয়ে গেল, তবুও সে এলো না। অফিসে ফোন করে দেখি সেখানেও নেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, তার কোনো খবর নেই। এর মাঝে হুট করে আবির্ভাব হলেন তারানা জামান, আমার একমাত্র শ্বাশুড়ি।
আমি আমার ঘরে বসছিলাম। নিচে কথার শব্দ শুনে ভাবলাম সে এসেছে৷ ছুটে নিচে নেমে দেখি শ্বাশুড়ি মা। হঠাৎ অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। আমি মাথায় কাপড় দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “কেমন আছ মা?”
আমি থতমত ভাব কাটিয়ে বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার শরীর কেমন?”
“এইতো আছি।” তারপর মা খালাদের মতো করে বললেন, “এতদিন হয়ে গেল, তুমি একটা ফোনও করলা না আমাকে, শরীরটা খারাপ খবরও নিলে না।”
আমি সত্যি লজ্জা পেলাম। খবর নেয়া উচিত ছিল। তার মধ্যে আবার এই অসুস্থ অবস্থায় তার ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে আসাটাও আটকানো দরকার ছিল। শুনেছি সে নাকি ছেলের হাত ছাড়া খেতোই না! সব মিলিয়ে আমার ভারি অনুশোচনা হতে লাগলো। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি বললেন, “কেমন চলছে তোমার সংসার?”
“ভালো।”
“ঝগড়া টগড়া হয় নাকি?”
“না।”
“তবে তো ভালোই। সিলেট মিশন সফল হলো। ও তোমার সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে।”
সিলেট মিশন মাথায় ঢুকলো না। এদিকে জহিরুল এসে বলল, “ম্যাডাম আপনার ঘরের সব ঠিকঠাক করে দিছি।”
“কোন ঘর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
জহিরুল বলল, “ম্যাডামের ঘর।”
সেই নিচতলার তালা মারা ঘরটা! মায়ের সাথে সে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই বিষ্ময়ে হা হয়ে রয়ে গেলাম। ঘরটা অন্যসব ঘরের চেয়ে আলাদা। প্রচুর আসবাপত্র। সবচেয়ে বড় কথা, ঘরের দেয়ালে বড় একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি টানানো। ছবিটা ওর সাথে ওর বাবা, মা, ভাই, বোন। কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে তোলা ছবি। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
আমাকে অবাক হতে দেখে মা বললেন, “এটা দু’বছর আগের তোলা। আমার ইচ্ছে ছিল বড় করে বাঁধিয়ে রাখবো ছবিটা। কিন্তু তোমার শ্বশুর আবার নামাজ পড়ে তো, তাই ওবাড়ির কোনো দেয়ালে ছবি টানাতে দেয় না। এখানে থাকা হয় না তেমন, তাই এখানে টানিয়ে রেখেছি।”
তার মানে কী? এই বাড়িটা ওদের? তবে যে বলেছিলো তানজিম ভাইয়ের?
মা সাথে ব্যাগ আনেননি। আলমারির চাবি দেখলাম তার কাছেই। পার্স থেকে চাবি বের করে আলমারি খুললেন। প্রচুর শাড়ি, কসমেটিকসে ভরা আলমারি। উনি বললেন, “আমার যেসব জিনিস না হলেই চলে না, সেসব এখানে সবসময় থাকে। যখন তখন চলে আসি তো, এ বাড়িটাতে শান্তি লাগে আমার। এই ঘরটাতেও। কেউ ঢুকে যাতে নোংরা না করতে পারে, তাই অন্য সময় তালা দেয়া থাকে। জহিরুল অবশ্য মাঝে মাঝে ঢুকে পরিষ্কার করে।”
আমার মাথা দপদপ করতে শুরু করলো। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ঘরে কী আছে। ও বলেছিল এখানে নাকি তানজিম ভাইয়ের জিনিসপত্র আছে। তাই তালা দেয়া। ও আমাকে এসব মিথ্যে কথা কেন বলল? এবাড়িটা তাদের সেটা বললে কি আমি থাকতাম না?
মা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। শাড়ি পাল্টে একটা সুতির শাড়ি পরেছেন। এই বয়সেও উনার ফিগার সুন্দর। বয়স কম লাগে, যদিও বড় অসুখ থেকে উঠেছেন বলে চেহারায় একটা অসুখের ছাপ পড়ে গেছে। উনি বললেন, “এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন, বসো।”
আমি চাবি দেয়া পুতুলের মতো খাটে গিয়ে বসলাম৷ উনি বললেন, “আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমার ন্যাওটা। আমার পরামর্শ ছাড়া কিচ্ছু করতে পারে না। আমি তাকে যখন বললাম ডিভোর্স দিতে তোমাকে, তখন সে রাজি হলো না। উল্টে আমাকেই বলল কোনো উপায় বের করতে। সে তোমার সাথে থাকতে চায়। তাই আমি বললাম কিছুদিন দূরে গিয়ে থাকতে। যাতে তোমাদের মধ্যে বোঝাপড়া হতে পারে। যদি তোমরা মানিয়ে নিতে পারো, তো ভালো। নয়তো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক। অবশ্য ছেলে বলল, তুমি নাকি খুব লক্ষী। মানিয়ে গেছ তার সাথে।”
ও আচ্ছা এই ছিল সিলেট মিশন! বাহ! আমি কিছুতেই বুঝলাম না এত নাটকের কী প্রয়োজন ছিল? সব বলে দিলে কি আমি আসতাম না?
মা বলে চলেছেন, “ছেলে ছাড়া আমি কি আর থাকতে পারি? তাই চলে এলাম৷ কয়েকটা দিন এখানে থেকে তারপর তোমাদের নিয়ে একসাথে ফিরব ঢাকায়।”
এসময় বাইরে তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। সে সোজা এঘরে এসে ঢুকলো। মা’কে দেখে প্রায় ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সময় চলল তাদের মা ছেলের মিলন দৃশ্য। সে মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।”
মা তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “তুই যা করেছিস, ঠিক করেছিস।”
“আচ্ছা, তুমি কী করে এলে? আমি সেই ভোরবেলা থেকে এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে আছি। ফোনটা ভুলে নিয়ে যাইনি। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায় অবস্থা হয়েছিল।”
“প্লেনে আসতে ইচ্ছে করেনি। গাড়িতেই চলে এলাম। আর তোর মোবাইলে আমি টেক্সট করেছিলাম। দেখিসনি?”
“নাহ।”
“সমস্যা নাই। মায়ের জন্য একটু কষ্ট করেছ, এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।”
সে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে আমাকে বলল, “তুমি আজকে ইলিশ মাছ আর খাসির মাংস রান্না করবে। মায়ের পছন্দ এগুলো। আর হ্যাঁ, সাথে টমেটো ছাড়া সালাদ। একেবারে কুচি কুচি করে। ঠিক আছে?”
তারপর জহিরুলকে কিছু জিনিস আনতে বলে আবার মায়ের ঘরে ঢুকে গেল। আমি তখনো সেখানেই স্থির হয়ে আছি। সে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, “দাঁড়িয়ে থেকো না, হারি আপ! মা জার্নি করে এসেছেন।”
আমি তবুও দাঁড়িয়ে। সব হজম করতে পারছি না। জহিরুলের ডাকে সম্বিত ফিরল। “ভাবী, রান্না বসাইবেন না?”
আমার জীবনটার মতোই রৌদ্রজ্জ্বল দিনটা হঠাৎ আঁধার হয়ে এলো। মেঘ ডাকতে শুরু করলো ক্ষণে ক্ষণে আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।
(চলবে)
অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব -১০
মানুষ তখন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে যখন তার চারপাশে একটা বলয় তৈরি হয়? তার পরিচিত গন্ডিটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে? আর সে তার অত্যন্ত কাছের মানুষদের কাছেও দিন দিন অপরিচিতের মতো ব্যবহার পেতে থাকে?
আমার জীবনটাও তেমনি হয়ে উঠছে। দিন দিন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া। প্রতিটা নিঃশ্বাস নিতে এখন আমার কষ্ট হয়। সিলেটের মিষ্টি দিনগুলোর পর এই দুঃসহ দিন অপেক্ষা করছিলো তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
খুলে বলা যাক। সেদিন সিলেটে ওর মায়ের আসার পর আবহাওয়ার রঙ বদলে গেল। প্রথম দিনটা সে মা’কে নিয়েই রইল। তাকে আমি একটুও পেলাম না কিছু বলার জন্য। রাতে যখন শুতে এলো, তখন সে ভীষণ টায়ার্ড। কাল রাতে নাকি ঘুম হয়নি, এক্ষুনি ঘুমাবে। আমি বললাম, “কিছু কথা শুধু জিজ্ঞেস করব।”
সে হাই তুলে বলল, “পরে।”
“পরে কখন?”
“সকালে বলো প্লিজ। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। এখন কথা বলতে পারব না।”
সে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি চাইলে তখন চিৎকার করে সিনক্রিয়েট করতে পারতাম। পারতাম ঝগড়া বাঁধাতে। কিন্তু কেন যেন পারিনি। আমার বিবেক বাঁধা দিয়েছিলো। যে মানুষটা এতকিছু করেও এত স্বাভাবিক থাকতে পারে তাকে কী বা বলব! আমাকে সে যদি দুই পয়সার দামও দিতো তবে অন্তত কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করতো পুরো ঘটনার। তার মানে এটাই ছিল, এতদিনের ভালোবাসাটা শুধুই নাটক। সে শুধু আমাকে ব্যবহার করে গেছে। কিন্তু সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সবই কি নাটক? কী করে হতে পারে? আর নাটকে আমার ভূমিকা কী? আমি কেন জড়িয়ে গেলাম? সেই প্রতিবার আমার কাছে এসেছিলো। আমি তো যাইনি তার কাছে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার আজও অজানা। আমি তাকে এখনো কিছু বলিনি। দেখা যাক জল কতদূর গড়ায়। ঢাকায় চলে এলাম সেই সপ্তাহেই।
তাদের বাড়িটায় প্রথমবার প্রবেশ করে আমার মনে হলো একটা দুর্গ৷ বিশাল পাচিলে ঘেরা বড় জায়গা নিয়ে করা একটা বাড়ি। বাড়ির সবকিছুতে আভিজাত্য উপচে পড়ছে, যেন এটি একটি সিনেমার সেট। সব সাজানো হয়েছে, এখন শ্যুটিং শুরু হবে।
বাড়িতে তার মা বাবা আর দুই ভাই বোন থাকে। প্রত্যেকেই বিশাল বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যার যার মতো করে থাকে। শুধু সবাই খাওয়ার সময় একসাথে হয় আর কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের অনুমতি নিয়ে যায়। আমার এই স্বাধীন রাজ্যে সত্যি মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়ে গেলো। সারাদিনে কোনো কাজকর্ম নেই, শুধু পায়ের ওপর পা তুলে রানী হয়ে থাকা। কথা বলারও কোনো মানুষ নেই। সবাই ব্যস্ত। সিলেটেও অবশ্য ছিল না, তবুও সেটা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। কাজ দিয়ে মা বাবার মন জয় করার ব্যাপারটাও এখানে সম্ভব না।
আমার শ্বশুড়কে প্রথমবার দেখলে অতি সাধারণ মানুষ মনে হয়েছিলো, তবে খেয়াল করলাম স্ত্রীর ওপর তার বেশ প্রভাব। এরকম ভয়ানক মহিলাও স্বামীকে ভয় পায় এবং বেশ সমীহ করে চলে। আমারও তখন বাবার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। আমাকে অবশ্য বাবা পছন্দ করলেন কি না সেটা জানা যায়নি। সামনে থাকলে হাসিমুখে কথা বলেন। কখনো ছোটখাটো গল্প করেন। তবে তার চোখ দেখে ভালো খারাপ বোঝার উপায় নেই।
বাকি সদস্যদের কথা বলার মতো নয়। তারা তাদের মতো। পৃথিবীতে নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই। ভাই বোনের মধ্যে যেমন সম্পর্ক থাকে, তাদের মধ্যে সেটা নেই বললেই চলে। একে অপরের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলে না।
তার সাথেও আমার কথা হয় কম। এখানে আসার পর এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে সময়ই পায় না। সেই সকালে যায়, রাত দশটা বাজে ফিরতে। এসেই ক্লান্তির ঘুম! দুটো কথা বলার সময় নেই। প্রথমবার দিনে কয়েকবার ফোন করলেও এখন সেই সময় হয় না। আমি ফোন করলে একটু কথা বলে, নয়তো না। ছুটির দিনেও অর্ধেক দিন ঘুমিয়ে কাটায়। বাকি অর্ধেকের বেশিরভাগটা শ্বাশুড়ির দখলে থাকে।
এর মাঝে তাদের বাড়িতে ননদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হলো। দুনিয়ার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব এলো। শ্বাশুড়ি মা আমাকে একগাদা গয়নাগাটি দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে গেলেন। আমাদের বিয়ের খবরটা চাপা ছিল এতদিন। যেটা প্রকাশ হয়ে গেল।
কাহিনী যে হবে সেটা জানা ছিল, তবে যা হলো তা অত্যন্ত বিশ্রী। হাই প্রোফাইলের স্টাইলিশ মাঝবয়সী মহিলাদের নোংরা মনের আবর্জনাগুলো তারা নিজেরাই প্রচার করতে শুরু করলো! আমার সাথে তাদের নিজেদের মেয়ে বা ছেলের বউয়ের তুলনা! রুপে গুণে তারা কতো অতুলনীয়া আর আমি কতটা সাধারণ সেটা বুঝিয়ে দেয়া হলো। অনেকে আমার শ্বাশুড়িকে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে একটা কথা বুঝিয়ে দিলেন, তার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে তিনি ঠকে গেছেন। আমার দিকে তাদের দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছিলো, অমন রাজপুত্রের মতো ছেলের কপালে শেষ পর্যন্ত এই জুটলো!
অবাক করা বিষয় হলো এসব নিয়ে মা আমাকে কিছুই বললেন না। তার ব্যবহার সিলেট থেকেই অবিশ্বাস্য রকমের পাল্টে গেছে।
সেসব নারীমহলের কথা তার কানে অবশ্য গেল না। সে বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত৷ তার বন্ধুরা আমার কথা জানতো। তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করলো। তাদের প্রিয় বন্ধুর বউ হিসেবে যতটুকু প্রাপ্য ছিল, পুরোটুকুই দিল।
সেদিন প্রথমবার আমার নোরার সাথে দেখা হলো। মেয়েটা সত্যি অনেক সুন্দর। সেই সাথে আমার স্বীকার করতে হলো, মেয়েটা খুব ভালো মনের মানুষ। খোলা মনে অনায়েসে অপরজনের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমার সাথে এমন করে কথা বলল যেন আমি তার বহুদিনের পরিচিত।
সেদিন শেষে সবাই চলে গেলে ও ঘরে ঢুকে বলল, “তোমাকে এত সাজতে কে বলেছিল?”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল, “এত মেকাপ কেউ করে? ভূতের মতো লাগছিলো। তুমি নরমালি সুন্দর। এরকম করে সাজবে না আর কখনো।”
“মা সাজিয়ে দিয়েছে। আমি কি তাকে বলব আমি সাজবো না?”
“কেন বলবে না? তোমার মুখ নাই? নিজেরটা নিজে ডিসাইড করবে এখন থেকে। ইচ্ছে না হলে বলবে আমি করব না। কথা শেষ।”
এটা বলে সে গোসল করতে ঢুকে গেল। আমিও তার কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিলাম। সত্যি তো উনার সব চাপিয়ে দেয়া বিষয় আমি মেনে নেব কেন? কিন্তু পার্টিতে ভূতের মতো লাগার কথা বলাতে এত লজ্জা লাগছিলো যে তার সাথে সেরাতে আর কথাও বলতে পারলাম না।
এই ঘটনার কিছুদিন পর একদিন সকাল সকাল মা এসে বললেন, “রেডি হয়ে নাও, একটা দাওয়াতে যাব।”
তখন বাড়িতে ও, বাবা কেউ নেই। আমি মা’কে বললাম, “শুধু আমরা দু’জন যাব? কিসের দাওয়াত?”
“আমার বান্ধবীর ছেলের বউয়ের বাচ্চা হবে, সাত মাসের সময় ঘরোয়া প্রোগ্রাম হবে। শুধু মহিলাদের দাওয়াত দিয়েছে।”
আমার একটুও ইচ্ছে হলো না যেতে। আবার সেই মহিলাদের আড্ডা! আমি মা’কে সোজা বলে দিলাম, “আমি যাব না।”
উনি খানিক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “সত্যি যাবা না?”
“না।”
“কেন?”
“শরীর ভালো না।”
উনি আর কিছু বললেন না। একাই গেলেন দাওয়াতে। রাতে ও বাড়ি ফেরার পর মায়ের ঘরে ডাক পড়লো। আমার নামে বিশাল নালিশের তালিকা দেয়া হলো। এই পর্যন্ত বাড়িতে আসার পর আমি কী কী ভুল করেছি সেসব তো জানানো হলোই, আর সবচেয়ে বড় অপরাধ, আমি অযুহাত দেখিয়ে তার সাথে যাইনি, তার কথা অমান্য করেছি।
সে ঘরে আমার সাথে ইচ্ছেমতো চেঁচামেচি শুরু করলো। আমি কৈফিয়ত দিলাম, “সেদিন তুমি বলেছিলে আমার কিছু ইচ্ছে না হলে মা’কে যেন সরাসরি বলি।”
কথাটা শুনে সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমার মনে হলো মাটির সাথে মিশে যাই। বলল, “তোমার কমনসেন্সের অভাব? তোমার নিজের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা তোমাকে নিতে বলেছিলাম। আর এটা ফ্যামিলির সম্মানের বিষয়। দাওয়াত রক্ষা করার ব্যাপারে তোমার জানা নেই কিছু? উনারা মা’কে কত প্রশ্ন করেছে, কত কথা শুনিয়েছে কোনো ধারনা আছে?”
ঝগড়াটা অনেকদূর গড়ালো। একটা সময় আমি ক্ষান্তি দিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, আমার ভুল হয়েছে। আর হবে না।”
সে তাচ্ছিল্য করে বলল, “দেখা যাবে। পারলে নিজেকে একটু আপডেট করার চেষ্টা করো।”
দিনে দিনে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে ঝগড়া চলতে থাকলো। যেগুলো সময়ের অভাবে ঠিকভাবে মিটমাট করাও হলো না। দূরত্ব বাড়তে লাগলো আমাদের। প্রতিদিন যেন একটু একটু করে দূরে সরে গেলাম একে অপরের থেকে। সে আমাকে অপছন্দ করতে শুরু করলো, আর আমার তার প্রতি বিশ্বাস, সম্মান কমে যেতে থাকলো।
প্রথমদিকের মিষ্টি ভালোবাসাটা কোথায় হারিয়ে গেল! যেন সেটা মুঠোয় বন্দি গ্যাসবেলুন ছিল। মুঠি আলগা হতেই উড়ে পালিয়ে গেছে দূরে কোথাও!
এখনকার একসাথে থাকাটা ভালো থাকার জন্য নয়, থাকতে হবে বলে থাকা। সেও হয়তো বোঝে কথাটা। মাঝে মাঝে বলে, “দূরে কোথাও ঘুরে আসবো।”
তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে যায় কাজে। সময়ই হয় না তার।
সাথে শ্বাশুড়ি মায়ের আছে কড়াকড়ি নজর। মনে হয় আমার ওপর সর্বক্ষন তার দুটি চোখ লাগিয়ে রেখেছেন। কে যে আমার বলা প্রতিটা কথা তার কান পর্যন্ত নিয়ে যায় আল্লাহ মালুম। আমি বাপের বাড়ির কারো সাথেও শান্তিমতো ফোনে কথা বলতে পারি না। বাড়ির সব ভৃত্যই তার কেনা। তাই আমি এখানে একটা পুতুল ছাড়া কিছুই না৷ অধিকারবোধের কোনো বালাই নেই। তাকে তার মায়ের ব্যাপারে বললে সে শুধু বলে একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও।
দেখতে দেখতে ছয়টি মাস চলে গেল। আমার পড়াশুনা এখনো বন্ধই আছে। সে অবশ্য এখন বলে কলেজে যেতে, পড়তে। আমার ভালো লাগে না। যদিও বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পাবো কলেজ শুরু হলে, তবু কেন যেন মন টানে না সেদিকে৷ কী হবে পড়ে? এইতো এমনই থাকবে জীবনটা। বাড়তি ঝামেলা করে কী লাভ? তার ওপর আমার শ্বাশুড়ি উচ্চশিক্ষিতা বউমা প্রথমদিকে খুঁজলেও এখন আমাকে পড়ানোর ব্যাপারে একটি কথাও বলেন না। কথা উঠলে এমন ভাব করেন যেন সেটা তার কর্নকুহরের আশেপাশেও যায়নি!
একদিন দারুণ খুশির একটা ঘটনা ঘটলো। তপ্ত মরুভূমিতে ঘুরতে ঘুরতে আমি হঠাৎই সবুজ মরুদ্যানের দেখা পেয়ে গেলাম! একেবারে প্রাণ জুড়িয়ে গেল তৃপ্তিতে!
কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিলো, তাই লুকিয়ে এক কাজের মেয়েকে দিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট আনালাম। পরীক্ষা করে দেখা গেল পজিটিভ! আমি অনেকক্ষণ অবিশ্বাস নিয়ে বসে রইলাম। ঘটনাটা সত্যি আমার জীবনে ঘটছে এটা আমার যেন ভেতরে যাচ্ছিলো না। সারাটা দিন অতি আনন্দে পাথর হয়ে বসে রইলাম আমি।
সে সেদিন অফিস থেকে ফিরলো আগেই। আমাকে অস্বাভাবিক আচরন করতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে?”
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকবার কথাটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বলতে পারলাম না। সে কয়েকবার আমার হাত ধরে ঝাকি দিয়ে বলল, “ওই…কী হলো তোমার?”
আমি পরে প্রেগনেন্সি কিটটা এনে তাকে দেখালাম। সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল, “আমি বাবা হব? সত্যি?”
আমি চুপ করে রইলাম। তার চোখের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছি না। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে আমরা কেঁদে গেলাম। মনে হলো আমার হারানো সব আবার ফিরে পেয়েছি। পৃথিবী ভর্তি রঙ ছেয়ে গেছে। স্বপ্নের বর্ণিল রঙ!
(চলবে)