অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব_৩,৪
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব-৩
প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করে রইলাম, সে বুঝি ফোন করবে। তারপর মেনে নিলাম, নিজেকে বুঝিয়ে নিলাম এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল, যেটা কেটে গেছে। এখন আর এসব নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।
ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। সারা বছর কিছু পড়িনি। এখন প্রয়োজন দিনরাত এক করে পড়াশুনা করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বই নিয়ে বসলেই আর পড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় জীবন থেকে পড়াশুনা নামক বিষয়টা টেনেহিঁচড়ে বের করে দেই। শরীরে অসম্ভব আলস্য জায়গা করে নিয়েছে।
পরীক্ষা হচ্ছে। টেনেটুনে পাশ করার মতো পরীক্ষা দিচ্ছি। প্রশ্নপত্র পেয়ে পাশ নাম্বার ওঠার মতো লিখে আর পারলেও লিখতে ইচ্ছে করে না। হাত গুটিয়ে বসে অন্যদের লেখা দেখি। শেষ পরীক্ষাটা ভয়ানক খারাপ হলো। পাশ নিয়ে সন্দেহ। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় মনে হলো, ভুল হয়ে গেছে। একটা ভুলকে পাত্তা দিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলাটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কাজের মধ্যে পড়ে না।
পরীক্ষা শেষে কাজ নেই। বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটে। সেসব কাহিনী ভুলে গেছি মোটামুটি। অন্তত নিজেকে তাই বলে সান্ত্বনা দেই। শুধু মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কপালে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পাই। সাথে রজনীগন্ধার সুবাস!
বছরটা ঘুরে গেলো। পরের বছর শীতকাল চলে এলো। শীতকালটা আমার ভারি পছন্দ। খেয়ে-পরে-ঘুমিয়ে শান্তি। সবাই যখন মোটা জামাকাপড় গায়ে দিয়ে শীতে কাঁপে আমি পাতলা জামা পরে বাতাসের মধ্যে দৌড়ে বেড়াই। গায়ে কাটার মতো শীত বেঁধে। আমার ভেতরটা জুড়িয়ে যায়।
সকালে সবাই যখন লেপ মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমোয়, আমি তখন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। চাদর গায়ে দিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘুরি। একটু সোনালী রোদের আলো দেখা দিলে গায়ের মেখে নেই।
এক সকালে একটা বিশাল গাড়ি এসে বাড়ির বাইরে দাঁড়ালো। আমি তখন গোলাপ গাছের আগা ছেটে দিচ্ছি। কৌতুহল নিয়ে তাকালাম।এত সকালে গাড়ি করে কে এল! আমাকে অবাক করে দিয়ে গেট খুলে এক মহিলা ঢুকলেন। সুন্দর ফরসা চেহারা, গায়ে সিল্কের শাড়ি জড়ানো, গলায়-হাতে-কানে স্বর্ণের অলঙ্কার। পুরো শরীরজুড়ে আভিজাত্য উপচে পড়ছে। সকালবেলা এমন মূর্তি দেখে হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুখটা চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারলান না। আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার বাবা বাড়ি আছেন?”
উনাকে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলাম আমি। বাবা বসার ঘরেই ছিলেন। মায়ের কিছুদিন ধরে জ্বর। দুই ভাবীই এদিকে বাপের বাড়িতে গেছে। আমাকে রান্নাবান্না সব করতে হচ্ছে। আমি তার জন্য কিছু চা-নাস্তা নিয়ে গেলাম। দেখলাম বাবার সাথে কী বিষয়ে খুবই গম্ভীরভাবে আলোচনা করছেন। আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেলেন দুজনে। আমি নাস্তার ট্রে রেখে ভিতরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম কাজে। এর মাঝে ভুলেও গেছি উনার কথা। অনেকক্ষণ পর তিনি বের হলেন বাড়ি থেকে। আমি তখন ছাদে আচার শুকোতে দিতে এসেছি। ঝিনু দৌড়ে এসে বলল, “আপি জানিস কে এসেছিলো?”
“কে?”
“মনে আছে গত বছর তোকে দেখতে এসেছিলো তাদের কথা? ওইযে অনেক মিষ্টি এনেছিলো যে..সেই ছেলের মা।”
আমাকে যেন কেউ জোরে ধাক্কা দিল। কোনোমতে বললাম, “কেন এসেছে?”
“তোর সাথে সেই ছেলেটার বিয়ের কথা বলতে।”
আমি এবার সোজা আকাশ থেকে পড়লাম। হা হয়ে যাওয়া মুখটা দেখো ঝিনু বলল, “তারা অনেক তাড়াতাড়ি বিয়ে করাবে বলেছে। তুই কি করবি নাকি পালিয়ে যাবি?”
আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, “পালাবো কেন?”
“এই মহিলা শ্বাশুড়ি হলে তোকে জ্বালিয়েই মেরে ফেলবে। কি কাটা কাটা কথা!”
“ধুর! যা তো!”
“ভালো বুদ্ধি দিলাম…”
“বাবা কী বলেছে শুনেছিস?”
ঝিনু ঠোঁট উল্টে বলল, “জানি না, বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”
আমার মাথায় তখন একশো একটা লাল নীল বাতি জ্বলছে, নিভছে। একদৌড়ে আমি ঘরে চলে এলাম। তক্ষুনি ফোন বাজলো। সেই নম্বরটা। হাজারখানেক বার পড়ে পড়ে মুখস্থ নম্বর!
“হ্যালো!”
“ভালো আছেন?”
বহুদিন পর আমার শ্রবণযন্ত্রের শুষ্ক মরুভূমিতে দু’ফোঁটা বৃষ্টিপাত হলো। ভয়ানক তৃষ্ণার্তের মতো ফোঁটাদুটো গিলে নিলাম। চোখ বুঝে অতিকষ্টে কান্না চেপে বললাম, “এতদিন পর কী মনে করে?”
“আমার মা যায়নি আপনাদের বাড়িতে?”
“এসেছিলেন।”
“তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন!”
হঠাৎ খুব রাগ হলো। এটা কেমন কথা? বললাম, “আমি কী বুঝব? আপনাদের কাজকর্ম কোনোটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না। আমি আপনাকে বিয়ে করব না৷ অনেক ফাজলামো করেছেন। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলেই ভালো হবে।”
“আপনি শুনুন তো আগে!”
“কী শুনব?”
“সমস্যা এটাই তো যে আমি নাম্বার বন্ধ রেখেছিলাম? এর ব্যাখ্যা আছে..”
“কী ব্যাখ্যা?”
“অস্থিরতা বাড়াতে চাইনি তাই।”
“কিসের অস্থিরতা?
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সে। আমিও এদিকে চুপ। কিছু না বলেও সব বুঝিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চলল। অভিমানের পাহাড় ঠেলে মনের যোজন যোজন দূরত্ব পেরিয়ে সেই না বলা কথাগুলো যখন বোঝা গেল না তখন সে বলল, “সেদিন নাম্বারটা ইচ্ছে করে বন্ধ করিনি, হাত থেকে পড়ে মোবাইল ভেঙে গিয়েছিল। আমার একটাই মোবাইল। তাই সেটা ঠিক করা পর্যন্ত কথা বলতে পারছিলাম না। পরদিন সকালবেলা মোবাইল ঠিক করে আনার মাঝখানের সময়টুকু পাগলের মতো কেটেছে। রাতে একফোটা ঘুম হয়নি। সকালে সিমটা চালু করার সময় মনে হলো আপনার সাথে কথা বলাটা উচিত হবে না। আগে সবকিছু ঠিক করব, তারপর বাকি কাজ।”
তার কথার কিছুই আমি বুঝলাম না। বললাম, “যা বলার ভালো করে বলুন।”
“বুঝিলে বলতে গেলে সময় করে বলতে হবে৷ শুধু এতটুকু জানুন, সেদিন রাতে কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিলাম আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। তাই চাচ্ছিলাম আপনাকে পুরোপুরি পেতে, অন্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে আবার কষ্ট না পেতে। আর সেটার ব্যবস্থা করতেই এতদিন লেগে গেল।”
“মানে আপনার মা’কে রাজি করাতে?”
“হ্যাঁ, যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।”
আমি কিছু বললাম না। সে বলল, “আমি মায়ের অবাধ্য হতে পারি না। সে যত কাটাছেঁড়াই করুক না কেন আমার জীবনের সাথে। একটা ঘটনা বলি, আমি যখন মায়ের গর্ভে এসেছিলাম, তখন আমার মায়ের বিয়ের বয়স মাত্র চার মাস। মায়ের বয়সও কম। আঠারো বছর। কেউই চায়নি বাচ্চাটা রাখতে। মায়ের বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি প্রত্যেকেই বাচ্চা নেয়ার বিরুদ্ধে ছিল। মা তাদের বিপক্ষে গিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমার জন্মের পর মায়ের শরীরে রক্তশূন্যতা, শরীর ব্যথাসহ আরও নানা রকমের রোগ স্থায়ী বাসা বানিয়ে নিয়েছে। এই বয়সেই বুড়ো মানুষের চেয়ে বেশি ব্যাধি নিয়ে বাস করেন তিনি৷ তবুও বাকি দুই ভাইবোনের চেয়ে আমাকে বেশি ভালেবাসেন। তার জীবনের সমস্ত ত্যাগ-তিতিক্ষার সিংহভাগই করেছেন এই আমার জন্য। আমার থেকে আশাও করেন অনেক বেশি। তার জীবনের সবচেয়ে দামী সময়টা আমার জন্য উৎসর্গ করা। তাই বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা!”
আমি মৃদু স্বরে বললাম, “বুঝেছি। আপনার মা এখন রাজি হয়েছে?”
“হ্যাঁ। আমি তাকে বোঝাতে পেরেছি।”
“আপনি কেমন আছেন?”
সে হেসে বলল, “এইতো ভালোই। আপনি এত শুকিয়ে গেছেন কেন? মনে হয় দিন দিন ছোট হচ্ছেন।”
“আপনি আমাকে দেখলেন কোথায়?”
“কথা বন্ধ করেছি বলে দেখাও বন্ধ করব এমন কোনো কথা আছে নাকি?”
আমি ঢোক গিললাম। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী কাঁপছে। পায়ের তলায় সুড়সুড়ির মতো অনুভূতি! সেও বোধহয় কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না আর। শুধু চুপচাপ মোবাইল কানে দিয়ে বসে থাকা। কতক্ষণ কেটেছে জানা নেই, আমার ডাক পড়লো। ফোন কেটে দিলাম।
ডেকেছেন বাবা। বসার ঘরে পত্রিকা হতে বেশ গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আমি যেতেই বললেন, “বসো। তোমার সাথে জরুরি আলাপ আছে।”
“বলো বাবা।”
“তুমি নিশ্চয়ই জেনেছ সকালে ভদ্রমহিলা কেন এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“সম্বন্ধটা এনেছিলেন তোমার আফজাল চাচা৷ জানোই তো তার মাঝে লুকোছাপা কিছু নেই। সোজাসুজি সব বলে দেয়। তারা যখন তোমাকে দেখে গিয়েছিল, আমার স্পষ্ট মনে আছে তার দু’দিন পর সন্ধ্যায় আফজাল আমাকে ফোন করে বলেছিল, তারা বলেছে তোমার মেয়ে দেখতে ভালো নয়, পড়াশুনায় ভালো নয়, সাজগোজের বালাই নেই তাই তাদের পছন্দ নয়। মেয়ে তাদের ছেলের যোগ্য নয়।
আমি সেদিন কতটা কষ্ট পেয়েছি তুমি হয়তো জানো না। আমার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে তুমি আমার সবচেয়ে লক্ষী মেয়ে। তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না। শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে কাউকে রিজেক্ট করে দিয়ে আবার তার সাথে সম্বন্ধ করতে যাওয়ার কারনটা আমাকে ভদ্রমহিলা সোজাসুজি বলেননি। তুমি নিশ্চয়ই আশা করো না আমি তাদের সাথে সম্পর্ক করব।”
বাবার কথা শুনে শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। কী বলছে এসব!
বাবা বলে গেলেন, “আমি উনাকে সোজা না করে দিয়েছি। অনেকভাবে বুঝিয়েছেন, আমি মানিনি। প্রয়োজন নেই সম্পর্কের৷”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। চোখে পানি চলে এসেছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বাবাকে কী করে মুখ ফুটে বলব, আমি এখানেই বিয়ে করতে চাই। তাই কি বলা যায়? বললে তো সবটা বলতে হবে!
বাবা উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, তোমার অনেক ভালো বিয়ে হবে। এই সম্বন্ধটা নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। যে কেউ শুনলে বলবে এমন জিনিস না করে জীবনের বিরাট ভুল করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, আল্লাহ যার সাথে যার জুটি ঠিক করেছেন, বিয়ে তার সাথেই হবে। তুমি এই ছেলের চেয়ে লক্ষগুণ ভালো ছেলে পাবে। বলে দিলাম আমি।”
বাবা চলে গেলেন। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সব তো চুকেবুকে গিয়েছিল। তবে নতুন করে পুরানো ক্ষত খুঁচিয়ে ঘা করা কেন? আচ্ছা সে তো এতক্ষণে জেনে গেছে কী হয়েছে। তবে সে কী ভাববে? কষ্ট পাবে খুব? আমাকে ভুল বুঝবে না তো? কত কত চিন্তারা মাথায় শুঁয়োপোকার মতো কিলবিল করতে শুরু করলো। বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। শীতের মধ্যদুপুরে কড়া রোদের নিচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। জ্ঞান হারালাম আমি।
জ্ঞান ফিরলো বিকেলে। তাকিয়েই প্রথম যে মুখটা দেখলাম তাতে চমকে উঠে বসতে গেলাম। কিন্তু শরীরে বল পেলাম না। শুধু চমৎকার সুন্দর গোলাপ পাপড়ির মতো দুটো চোখকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। সে হয়তো জোরেই কথা বলছে। কিন্তু আমার কানে আসছে খুব ধীরে…মনে হচ্ছে যেন বহুদূর থেকে কেউ টেনে টেনে কথা বলছে। শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে কানে প্রবেশ করছে…
“এই…মেয়ে…এত… অল্পতে… জ্ঞান… হারালে… চলে…?”
(চলবে)
অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব-৪
আমি শুধু অপলক তাকিয়ে আছি তার দিকে। সে হাসছে। হাসিটা ঘোর লাগা। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে, জোর করে চোখ মেলে তাকে দেখতে হচ্ছে।
আশেপাশে কোনো খবর নেই আমার। হঠাৎ ঝিনুর কণ্ঠ শুনতে পেলাম, “আপিরে, একটু অন্যদিকেও তাকা!”
আমি চমকে তাকালাম ঝিনুর দিকে। ভাগ্যিস ঘরে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না! ঝিনু তাকে বলল, “ভাইয়া, বাবা বসার ঘরে যেতে বলেছে।”
সে বলল, “যাচ্ছি।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জ্ঞান ফেরার পর বিড়বিড় করে নাকি আমার নাম করছিলেন? তাই আমাকে ইমারজেন্সি খবর দিয়ে আনা হলো। আহ এত প্রেম কোথায় রেখেছিলেন বলুন তো?”
আমি ভারি লজ্জা পেয়ে গেলাম। কখন করলাম এই কাজ! কিছুই তো মনে নেই!
সে উঠে চলে গেল৷ যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত রাখল। আমি চোখ বুজে ফেললাম। মনে হলো আর কোনোদিন কিচ্ছু ভাবতে হবে না। দুশ্চিন্তা, কষ্ট, ক্লেশ সব এক ঝটকায় সে নিয়ে নিল। ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেল পাশে। এখন আমি শুধু তাকে জড়িয়ে বাকি জীবনটা ভালোবেসে কাটিয়ে দিতে পারব। সে ফিসফিস করে বলল, “এত স্ট্রেস নেবেন না। সবকিছু ঠিক আছে।”
মা এলেন এরপর। স্যালাইন, সেদ্ধ ডিম খাইয়ে দিলেন। ভালো লাগলো একটু। হাতমুখ ধুয়ে এলে মা ধরে নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। সে আর বাবা বসে আছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কেমন আছ?”
“ভালো।”
“এত দুর্বল হয়েছ কেন মা? একটুতে অজ্ঞান হয়ে যাবে জানলে ওসব বলতাম না। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তোমার প্রতিক্রিয়া কী হয় কথাগুলো শুনে। ছেলেটাকে সত্যি পছন্দ করো কি না। কিন্তু তুমি যা দেখালে!”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে?”
বাবা বললেন, “ওর মা আমাকে সব বলেছে। তোমরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করো তাও বলেছে৷ তোমার মুখ থেকে সেটা শোনার জন্য আমি ওভাবে বলেছিলাম। আমি চাইছিলাম তুমি নিজে কিছু বলো।”
আমি হতাশ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম। এ কেমন অত্যাচার? আমার ভেতর দিয়ে কী যাচ্ছে সেটা বোঝা কি উচিত ছিল না বাবার? বাবাটা বরাবরই এমন!
এদিকে সে মুচকি মুচকি হাসছে৷ তার ওপরেও অভিমান হলো এবার। ইশ্ কি আনন্দ হচ্ছে আমায় বোকা হয়ে যেতে দেখে!
.
পরের সপ্তাহে একগাদা লোকজন এসে আমায় আংটি পরিয়ে দিয়ে গেল। আমার হাতে অনামিকা আঙুলে ঝকঝকে হীরের আংটিটা কেন যেন বেমানান মনে হলো। তবে আংটিটা পরার পর থেকে অচেনা আনন্দের অনুভূতি হতে লাগলো, মনে হলো যেন তার সাথে আমার নাম একটা মালায় গাঁথা হয়েছে। এখন শুধু লেখাপড়া করে তার হয়ে যাওয়া বাকি।
বিয়ে আরও একমাস পর। বাড়ি থেকে মানা করে দেয়া হলো তার সাথে এর মাঝে দেখা করার জন্য। ফোনে কথা হয় নিয়মিত। সে এখন আপনি থেকে তুমি হয়েছে। ইদানিং প্রতিদিন বলে একবার দেখা করি চলো। আমার লজ্জা লাগে। ভিডিও কলও করতে পারি না। কেমন আজব মনে হয়।
এক রাতে সে ফোন করে বলল, “ছাদে আসো তো, আমি তোমাদের বাসার ছাদে।”
আমি মুড়ি খাচ্ছিলাম। আচমকা তার কথাটা শুনে কাশতে কাশতে অবস্থা বেসামাল। একটু স্থির হয়ে ছাদের দিকে গেলাম। সত্যি এসেছে না মিথ্যা বলল? এলেও জ্বালা, না এলেও।
গিয়ে দেখি কেউ নেই। চিকন চাঁদ উঠেছে। সেটার রঙ কিছুটা লালাভ। আকাশে শুধু একটাই তারা। পশ্চিমাকাশ জুড়ে জ্বলজ্বলে সন্ধ্যাতারাটার নিচে কে যেন চাঁদটা ঝুলিয়ে দিয়েছে। সে ফোন করল তখন। বলল, “চাঁদটা দেখেছ?”
“হ্যাঁ।”
“একদম তোমার মতো দেখতে।”
আমি হেসে বললাম, “এলে না কেন?”
“কে বলেছে আসিনি?”
“কোথায় তবে?”
“তোমার পেছনে।”
পেছনে তাকিয়ে দেখি সত্যি সে। কেমন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে আজ। দাড়িগোঁফ গজিয়েছে মুখভর্তি। শার্টটাও পরিপাটি করে পরেনি৷ বড় বড় চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে আছে৷ সে সামনে এসে বলল, “একটা গল্প শুনবে?”
“কীসের গল্প?”
“বিকেলবেলা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম তোমার সাথে আমার ঘরের বারান্দায় বসে আছি। আমার বারান্দাটা কেমন জানো, কোমর পর্যন্ত রেলিং, ওপরে খোলা। এখনকার বাড়িগুলোর মতো কবুতরের খাঁচা না। আমরা চা খাচ্ছি আর কথা বলছি। হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হলো, পুরো বিল্ডিং নড়তে শুরু করল। এত জোরে দুলতে লাগলো যে তুমি ছিটকে পড়ে যেতে নিলে বাইরে। আমি তোমার হাতটা ধরে ফেললাম। কিন্তু কিছুতেই বাঁচাতে পারছি না। যতই তুলতে চাইছি, আমার হাত থেকে তোমার হাত তত ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্পের দুলুনি আরো জোরে হলো, আর আমার ঘুমটাও ভেঙে গেল!”
তার স্বপ্নের বর্ণনা শুনতে শুনতে আমারও ভয় ধরে গেছে মনে। তবু হাসি টেনে বললাম, “ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল। দুপুরে এমন কিছু খেয়েছিলে যেটা হজম হয়নি।”
সে একটু কাছে এসে বলল, “হাত ধরি?”
এর আগে কখনো সে আমার হাত ধরেনি। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। সে বামহাত ধরে উঁচু করল। তারপর কী হলো, বিয়ের আংটিটা টেনে খুলে ফেলল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সে বলল, “এটা পরার দরকার নেই।”
“কিন্তু কেন?”
গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার কপালে ঘাম জমে গেছে ততক্ষণে। সে কিছুক্ষণ পর হো হো করে হেসে কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল, “ভয় পেয়েছিলে? ভাগ্যিস ফিট হয়ে যাওনি!”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে ফিরলাম অভিমানে। এমন করার কী আছে আমার সাথেই?
সে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবারো হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য একটা আংটি পরিয়ে দিল। রূপার আংটি। ভারি সুন্দর কারুকাজ করা। জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কেন?”
“এটা দাদীর। এনগেজমেন্টেরটা ডানহাতে পরবে, এটা যেভাবে পরিয়েছি, সেভাবে যেন থাকে। কেন দিলাম সেটা পরে একসময় বলব। আর হ্যাঁ, এটার কথা আমার বাড়ির কেউও জানে না, তাই কাউকে বলার প্রয়োজন নেই যে এটা আমি তোমাকে দিয়েছি। কেমন?”
“আচ্ছা।”
“লক্ষী মেয়ে।”
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। আমি তাকে ভেতরে যেতে বললাম, সে গেলো না। বলল, “দেখেছো কেমনভাবে এসেছি? স্বপ্নটা দেখে অস্থির লাগছিলো তোমাকে দেখার জন্য। ভালোমতো এলে একবার শ্বশুরমশাইকে দর্শন দিয়ে যেতাম। এখন তবে যাই।”
এতক্ষণে মনে হলো সে কাউকে না জানিয়ে কী করে ছাদে চলে এলো? জিজ্ঞেস করাতে বলল, “তোমার ছোট্ট বোনটি খুব কাজের। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পাহারা দিয়ে ছাদে উঠিয়ে দিয়েছে। এখন যাওয়ার ব্যবস্থা তুমি করে দাও।”
ভেঙচি কেটে বললাম, “পারব না।”
সে হেসে বলল, “তাহলে পাইপ বেয়ে নেমে যাই? পরে চোর মনে করে লোকে গনপিটুনি দিলে দোষ তোমার।”
আমি হেসে তাকে নিয়ে লুকিয়ে বের হয়ে এলাম। বাগানের পেছন দিয়ে বের হয়ে অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ সে আমাকে জাপটে ধরে কপালে গভীর একটা চুমু খেল। আমার নিঃশ্বাস আটকে গেল। সে আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না। দেয়াল টপকে চলে গেল ওপাশে। আমি আরো বহুক্ষণ সেখানেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ বেয়ে অকারণেই দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। ভেতর থেকে কার অস্পষ্ট ডাক শুনে সম্বিত ফিরল। নিজেকে সামলে চলে গেলাম ভেতরে।
বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে এলো, আমার অস্থিরতা বাড়তে শুরু করলো। মনে হলো বুকের ভেতর আরো একটা হৃৎপিণ্ড গজিয়েছে। দুটিতে মিলে পাল্লা দিয়ে লাফাতে থাকে। নতুন পরিবেশে, একগাদা অচেনা লোকের ভিড়ে একা আমি ঘরকুনো মেয়েটা কী করে মানিয়ে নেব সেই চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন! সে থাকবে তো সবসময় পাশে?
একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমার পাশে সবসময় থাকবে?”
সে একটু সময় নিয়ে বলল, “সারাজীবন তোমার পাশে থাকব। তোমার সব কাজে, সব সিদ্ধান্তে আমি তোমার সাথে আছি। স্বশরীরে না থাকলেও মন থেকে জানবে, আমি আছি।”
.
অবশেষে বিয়ের দিন এলো। বহু কাঙ্খিত দিনটা! জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাস্তব মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সত্যি একটা ঘটনাবহুল ভয়ানক দিন গেল আমার জন্য! কখনো ভাবিনি আমার বিয়ের দিনটা এমন হবে। জীবনে যে বিষয়ে যা আশঙ্কা করা হয়, সেটা তেমন হয় না। হয় পুরোপুরি অন্যরকম। যেমনটা মানুষ ভুলেও ভাবে না।
আমি জীবনে অনেকবার ক্ষুদ্র ঘটনার ধাক্কা সইতে না পেরে সংজ্ঞা হারিয়েছি। সেসব দিনে যদি আজকের বিয়ের দিনটার কথা জানা থাকতো, আমি তখনকার জ্ঞান হারানোর ক্ষমতা বাঁচিয়ে রাখতাম। কারন এতবড় ধাক্কার পরও আমি একবারও ফিট হয়ে যাইনি। চুপচাপ দেখে গেছি সব। একবার মনে হচ্ছিলো জ্ঞান হারিয়ে কিছুক্ষণ সব ভুলে থাকতে পারতাম যদি! তবে হইনি। বোধহয় জীবন প্রথমবার বুঝিয়ে দিলো, তার আসল রূপ কেমন হতে পারে!
(চলবে)