অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব_৫,৬
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব-৫
বিয়ের দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সত্যি বলতে রাতে ঘুমটাই হয়েছিল বড্ড হালকা। বাড়িভর্তি মেহমান। বিছানা, ফ্লোরে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। মুরুব্বি গোছের কয়েকজন শুধু উঠে নামাজ পড়ছে। আমার গায়ে হলুদের শাড়ি তখনো। রাতে ক্লান্তিতে বদলানো হয়নি। আমি উঠে চুপিসারে ছাদে চলে গেলাম। ভোরের নতুন সূর্যের আলো গায়ে মাখব বলে।
কিন্তু সেদিন কী হলো, সূর্য্যিমামা রাগ হয়ে রইলেন আমার ওপর। পণ করেছেন যেন দেখা দেবেন না একেবারে। ঘন কালো কালো মেঘ ছেয়ে রইল পুরো আকাশজুড়ে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
আস্তে আস্তে সবাই উঠে পড়লে শুরু হলো সারা গায়ে হলুদ ডলে গোসল করানোর পর্ব৷ বাড়ি গমগম করছে লোকে। আমি তাকে ফোন করার সুযোগ একটুও পেলাম না৷ সবাই আমাকে ঘিরেই বসে আছে৷ এর মাঝে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে নিস্তার পেলাম সবার থেকে। তার সাথে কথা বললে বোধহয় একটু ভালো লাগবে৷ কিন্তু সে ফোন ধরল না৷ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও তার সাথে কথা হলো না।
অনুষ্ঠান দুপুরে। সকাল সকাল পার্লারে রওনা দিতে হলো। মোবাইলটা ভুলে ফেলে গেলাম বাড়িতে। সাজানোর সময়টা এত অস্থিরতায় কাটলো বলার মতো না। বার বার চোখে পানি এসে সাজ নষ্ট হতে লাগলো। পার্লারের মহিলারা বিরক্ত হয়ে সাজাতে লাগলেন। এদিকে আমার বুকের কাঁপুনি বেড়ে চলেছে। ছুটে তার কাছে চলে যেতে মন চাইছে। আবার লজ্জাও লাগছে। আজ তো একেবারের মতো তার কাছে যাবই। তবে এত অস্থিরতা কিসের?
সাজগোজ শেষে পার্লার থেকে বের হয়ে দেখি বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব। পানি জমে গেছে রাস্তায়। এত বৃষ্টি যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না চারপাশে। একটা ট্যাক্সি পেয়ে বাড়ি পৌঁছুলাম কোনোমতে। তাও বৃষ্টির ছিটেফোঁটা লেগে শাড়ির নিচটা কাদা কাদা হয়ে গেছে। বিচ্ছিরি অবস্থা।
বাড়ি পৌঁছে দেখি সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে। আয়োজন সব করা হয়েছিল বাড়ির বাইরে উঠানে। আমার দাদার আমলের বিশাল জায়গা জুড়ে আমাদের বাড়ি। তাদের পক্ষের মেহমানও এত বেশি নয়। তাই এখানেই সব আয়োজন করা হয়েছিলো। কিন্তু প্যান্ডেল ভিজে জায়গাটা কাদা হয়ে আর কিছু করার জো নেই। কিন্তু চিন্তা সেটা নয়, চিন্তার বিষয় হলো, সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বরযত্রীর দেখা নেই। তার ওপর সকাল থেকে ওবাড়ির কেউ ফোন ধরছে না।
আমি ভয়ে কাটা হয়ে তাকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। কারো কোনো খবর নেই। এই এত লোকের মাঝেও যে সব নিস্তব্ধ হতে পারে, প্রথমবার দেখলাম৷ সবাই চুপ। কথা হারিয়ে গেছে যেন। আমি ঠাঁয় বসে আছি, নড়তেও ভয় হচ্ছে! থেকে থেকে ঝড়ে সুপারি গাছের মাথাগুলো একটার সাথে অন্যটা বাড়ি খাওয়ার শব্দ, আর মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনে শব্দ নেই। বাচ্চাগুলোও বোধহয় বুঝেছে সব স্বাভাবিকভাবে চলছে না।
সন্ধ্যার দিকে ওবাড়ি থেকে খবর এলো। তার মা সকালবেলা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। খুব খারাপ অবস্থা। এখনো প্রাণসংশয় আছে৷ হাসপাতালে ভর্তি তিনি৷ বিয়ের অনুষ্ঠান এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
আমার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে এলো। মন বিষাক্ত হয়ে গেল। এমনটাই ছিল ভবিতব্য? কেন খোদা! কোন পাপের ফল এটা? এত অপমান, লজ্জা! সাধ, আকাঙ্খা সব ধুলোয় লুটিয়ে গেল কেন? তার ওপর ওই মানুষটারও কত ভোগান্তি! না জানি মা কেমন আছেন!
এতক্ষণ অনেকেই অপেক্ষা করে ছিল, ভাবছিলো হয়তো ঝড়ের কারনে বরপক্ষ আসতে পারছে না, সে আশা শেষ হলো। সবার মুখে কথা ফুটলো হঠাৎ। নিস্তব্ধতা ভেঙে তীব্র কোলাহলে ছেয়ে গেল পৃথিবী। আমি নিঃশব্দে উঠে গেলাম।
থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ বিদীর্ণ করে আলোর ঝলকানিতে রাতের শহর দৃশ্যমান হচ্ছে। কালসাপের মতো ফনা তুলে ঝড়টা ছোবল মারছে সারা পৃথিবীতে। আমার জীবনেও তেমন ঝড় হয়ে গেল। বৃষ্টির পানিতে সাজ গলে পড়েছে অনেক আগেই। বিয়ের শাড়িটা ভিজে আধমনী ভারী হয়ে গেছে। ছাদের কর্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে অনন্তকাল পেরিয়ে গেছে সব ঘটনার। প্রতিটা মুহূর্ত অনেক বেশি ভারী৷
আমার খোঁজ পড়ল রাত সাড়ে দশটার দিকে। কে যে ধরে ঘরে নিয়ে গেল আমি বলতে পারব না। বড় আপা কাপড় বদলে দিলেন। শীতে তখন কাঁপছি। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে শরীর গরম হয়ে গেছে, চোখ জ্বালা করছে। আপা বললেন, “তুই চিন্তা করিস না। আজ একটা বিপদ হয়েছে বলে বিয়েটা হলো না। ওদেরও তো দোষ নেই বল? দেখিস সময়মতো বিয়ে হবে। তুই এমন করলে চলবে?”
আমি আপার দিকে তাকিয়ে বললাম, “বিয়েটা আর হবে না আপা।”
“কেন হবে না পাগলি। অবশ্যই হবে।”
“আমার কেন যেন মনে হয় হবে না।”
ছোটবেলা থেকে আমার হঠাৎ মনে হওয়া কথাগুলো সত্যি হয়ে যায়। সে ভরসায় বলছিলাম বিয়ে হবে না। ভয়টা মনে শেকড় গেড়ে বসে গেছে। কিন্তু তখনো জানি না আমার আশঙ্কা এবার ভুল।
রাত সাড়ে এগারোটায় দরজার কড়া নড়লো। মেহমানরা অনেকে শুয়ে পড়েছিল৷ আজ সবাই ক্লান্ত, বিষন্ন। কে যেন দরজা খুলল। তারপর চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করল। বাতাসের আগে আমার কানে খবর পৌঁছে গেল, বর এসেছে, বর এসেছে!
আমি শুয়েছিলাম। ঝট করে উঠে বসলাম। মাথা দপদপ করে উঠল ব্যথায়। স্বপ্ন দেখছি না তো? বার কয়েক শরীরে চিমটি কাটার পরও যখন বর এসেছে রব কানে আসতে থাকলো তখন বিশ্বাস হলো সত্যি সে এসেছে। ভাবীরা আমাকে নিয়ে গেল নিচে। সে সত্যি এসেছে। মনে হলো অনন্তকাল পর তাকে দেখছি! তার চেহারা দেখে বোঝা যায় সত্যিকার ঝড় তার ওপর দিয়েই গেছে। একদিনে চেহারা শুকনো পাতার মতো হয়ে গেছে। আমাকে দেখে একটু হাসলো। আমার কান্না পেয়ে গেল। সে এখন কেন এসেছে?
বাবা বললেন, “এতরাতে শুধু শুধু আসতে গেলে কেন বাবা? আমরা বুঝতে পারছি তোমাদের অবস্থা। না এলেও হতো।”
সে বলল, “আমি শুধু দেখা করতে আসিনি। বিয়ে করতে এসেছি।”
ঘরের মাঝে একটা বজ্রপাত হলো যেন। সবাই চুপ হয়ে গেল আবার। সে তৈরি হয়েই এসেছে। সাথে কাজি নিয়ে এসেছে। বাবা, মা, বাড়ির লোক কেউই ঠিক রাজি হতে পারল না এভাবে বিয়ের জন্য। তাকে বোঝাতে লাগলো। কিন্তু তার এক কথা, “আমি কথা দিয়েছি, আজ বিয়ে করব, আজই বিয়ে হবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। তাছাড়া মা এখন মোটামুটি ভালো। আমার বাড়িতে এসময় বিয়ের কথা না জানালেও চলবে। সব স্বাভাবিক হলে তখন বলব। একটা মেয়েকে বিয়ের কথা বলে এভাবে ফেলে রাখতে আমি পারব না।”
বাড়ির সবাই যখন দ্বিধায় ভুগছে, আমি তখন দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলাম, “আমি এখনই বিয়ে করব।”
মিয়া বিবি রাজি হলে বাকিদের আর অমত চলল না। বিয়ে পরানো হয়ে গেল৷ ঝড় বাদলার ভেতর প্রায় মধ্যরাতে আমি লেখাপড়া করে তার হয়ে গেলাম।
বিয়ের শেষে মিষ্টিমুখ হলো। আমার মনে হচ্ছে এসব নেশার ঘোরে হচ্ছে। কেউ হয়তে কড়া ডোজের ড্রাগ দিয়েছে, আমার হ্যলুসিনেশন হচ্ছে!
বিয়ের কাজ শেষ হবার পর সে চলে যাওয়ার আগে আমার সাথে পাঁচ মিনিট আলাদা কথা বলতে চাইলো। একটা ঘরে কথা বলতে দেয়া হলো আমাদের। আমি দরজা বন্ধ করে এসে তার পাশে বসলাম। দু’জনের কারো মুখে কথা নেই। কী বলব? আমি লজ্জায় মাথা তুলতে পারছি না, এদিকে ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হলো তার হাত থরথর করে কাঁপছে। মুখটা স্বাভাবিক, তবে শরীর ঠিক থেকেও ঠিক নেই। আমি তার হাত ধরলাম। সে আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। আদ্র গলায় বলে উঠল, “জানো, আজ অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
তার কথায় কেঁদে ফেললাম আমি। সে আমার জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। দু’জনের শরীর কাঁপছে। সেও আমার সাথে কাঁদছে নিঃশব্দে। হয়তো ভরসা চাচ্ছে। আমি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম, “কিচ্ছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সে পাঁচ মিনিটই আমার সাথে রইল। তারপর চলে গেল। যাওয়ার আগে একবার পেছনে ফিরে আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “ভালো থেকো তুমি। আমাদের ভবিষ্যত কী হবে জানি না, তবে জেনে রাখো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
তার মুখে প্রথমবার ভালোবাসার কথা শুনে আমি সারারাত কাঁদলাম। ভোর হলো একসময়। আজকের ভোরটা গতদিনের মতো মন খারাপ করানো না, ঝকঝকে রৌদ্রজ্বল একটি দিন শুরু হলো।
(চলবে)
অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব- ৬
“মেঘের পালক, চাঁদের নোলক
কাগজের খেয়া ভাসছে…
বুক ধুকপুক চাঁদপনা মুখ চিলেকোঠা থেকে হাসছে…
মেঘের বাড়িতে ভেজা ভেজা পায় তা-থৈ তা-থৈ বরষা…
কাকভেজা মন জল থৈ থৈ রাত্তির হলো ফরসা…
আমি তুমি আজ একাকার হয়ে মিশেছি আলোর বৃত্তে…
মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে..কে যে নাচে….”
গান ভেসে আসছে বড় ভাবীর ঘর থেকে। কেমন ফুরফুরে লাগছে মনটা! ভাবীটা ভারি শৌখিন। গান শোনে আবার গাইতেও পারে, হাতের কাজ খুব ভালো পারে, দারুণ সুন্দর করে ছবি আঁকে। প্রায়দিন সকালের কাজ সেরে বিশ্রাম নেয়ার আধঘন্টা মৃদু শব্দে গান শোনে। আমাদের ঘর পাশাপাশি বলে আমি শুনতে পাই। আজ খুব ইচ্ছে হলো ভাবীর সাথে গল্প করতে।
ভাবী খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে হেসে বলল, “ননদিনী, কী দরকার গো? ইদানিং তো কারো কথা মনেই পড়ে না তোমার!”
“ভাবী গল্প করতে আসলাম।”
“করো করো, তোমার তো দিন। রসিয়ে রসিয়ে বরের গল্প বলবা!”
“ধুর! করার মতো গল্প আছে আমার কোনো?”
ভাবী আমার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসালো। “বরের সাথে কথা হয় না?”
“তা হয়। জানো, ওর মায়ের ভালো হওয়ার নাম নেই। ও অনেক মন খারাপ করে থাকে। আমার কেন জানি মনে হয় ওর বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে।”
ভাবী আমার থুতনিতে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। বর দেখলে কী বলবে, যত্ন নেই না আমরা একটুও। তুমি আগেই এত ভাবলে চলবে? দেখো না কী হয়।”
“কেমন করে বিয়েটা হলো, আমার ভয়ই করে।”
ভাবী হেসে বলল, “প্রেম তো কোনোদিন করোনি। এইযে বিয়ের প্রথম প্রথম মিষ্টি প্রেম, দূরে দূরে থাকার সুখের বেদনা এসব উপভোগ করো। টেনশন সারাজীবন থাকবে, কিন্তু একবার সংসারে ঢুকে গেলে এই সময়টা ফিরে পাবে না।”
“আচ্ছা ভাবী ওর মা মেনে না নিলে?”
“আবার! যা হবে পরে দেখা যাবে। সবাই আছি তো আমরা। আর তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ না মেনে পারে?”
“ঠিক বলছ?”
“হ্যাঁ রে বাবা। এখন শক্তি সঞ্চয় করো পরবর্তীতে যা হবে সেটা সামাল দেয়ার জন্য। অকারন আশঙ্কা খুব খারাপ জিনিস, বিশেষ করে এমন ব্যাপারে যেটা হয়ে গেছে, শুধু ফলাফল দেখার বাকি। তোমার সাথে তো তোমার বর আছেই, তবে চিন্তা কী এত!”
“আচ্ছা।”
“তেঁতুল খাবে? কাল তোমার ভাই কাঁচা তেঁতুল এনেছে। চলো ভর্তা করি।”
ভাবী কাঁচা তেঁতুলের ভর্তা বানিয়ে এনে বারান্দায় বসে খেতে খেতে গল্প শুরু করলো! তার বেশিরভাগ গল্প বড় ভাইয়াকে নিয়ে। আজ কিছুদিন ভাবীকে একটু বেশি খুশি লাগছে। আজ যেভাবে টক খাচ্ছে! আমার মনে পড়ল গতকাল খাবার সময় ডালের চামচ পড়ে গিয়েছিল। ভাইয়া ভাবীকে নিচু হয়ে তুলতে দিল না কিছুতেই। তবে কী…
এ পর্যন্ত এমন অনেক দেখেছি, তবুও হঠাৎই ব্যাপারটা ভেবে আমার চোখে পানি চলে আসলো। বুকের কোথাও সুক্ষ্ম ব্যথা উঠলো। আচ্ছা এমন একটা দিন আমারও আসবে? একটা ছোট্ট নতুন মানুষ নিজের মধ্যে…! ভাবীর মতো সুখের সংসার আমার কপালেও আছে? আশা মানুষ অনেক কিছুই করে, তবে ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? বিধাতা কত রকমের রঙতুলি নিয়ে বসে আছেন। একেকজনের জীবন একেকভাবে রাঙিয়ে দেবেন বলে। শুধু একটাই প্রার্থনা, সেই রঙটা যেন ফ্যাকাসে না হয়!
.
বিয়ের দুই সপ্তাহ পর তার সাথে দেখা হলো। কলেজে গিয়েছিলাম, বের হয়ে দেখি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে একেবারে। গলার হাড় বের হয়ে গেছে। আমি কাছে যেতে হেসে বলল, “আহারে, লোকে বিয়ের পর প্রতিদিন বউ এর মুখ দেখে ঘুম থেকে ওঠে। আমার কি কপাল! কতদিন পর দেখলাম!”
“বাদ দাও ওসব। তোমার এই চেহারা হয়েছে কেন?”
“ভালো নেই গো! মা অসুস্থ বলে বাবাও কাজে ঢিল দিয়েছে, অফিসে চাপ এত, তার ওপর মা’কেও সময় দিতে হয়। আমি না থাকলে খেতেও চায় না ঠিকমতো। তোমার সাথে দেখা করার সময়টা বের করতে পারি না বোঝো তবে!”
“আমি বুঝি। তুমি দায়িত্ব পালন করো ঠিক করে।”
সে আমার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো। হাঁটতে থাকলাম ফুটপাথ ধরে। সে বলল, “তুমি এত ভালো কেন?”
“আমি ভালো নই। তোমার মনটা ভালো।”
সে অকারনে হো হো করে হাসলো। আমার জন্য কোথা থেকে একটা শুকনো বকুল ফুলের মালা এনেছিলো। সেটা পরিয়ে দিল গলায়। খুব বেশি সময় দিতে পারলো না। আমায় অনেক অনেক বার বুঝিয়ে, ক্ষমা চেয়ে সেদিন বিদায় নিয়েছিল সে। ইচ্ছে করছিলো ওখানেই বসে কাঁদি। কিন্তু পারিনি। বোধহয় শক্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
বাবা মা আমাকে কিছুই বলেন না। ওর সাথে তাদের কথা হয়। কী বলে সেই জানে। আমি এমনভাবে থাকি যেন বিয়ে থা হয়নি। আগের মতোই আছে সব।
.
আগামীকাল আমাদের বিয়ের একমাস পূর্ণ হবে। রাতে সে ফোন করে বলল, “আমাদের বিয়ের কথাটা সবাই জেনে গেছে।”
আমি ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে বললাম, “তারপর কী হলো?”
“শুরু থেকেই কানাঘুষা চলছিলো। সবাই ভেতরে ভেতরে জানতো, তবে আজ একেবারে সামনাসামনি কথা হয়েছে। আমিও স্বীকার করেছি।”
“তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?”
“নাহ।”
“তোমার মা?”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মায়ের ব্যাপারটা জানি না। আমাকে কিছুই বলল না। সুন্দরভাবে রাতে খেয়ে নিল আমার সাথে। অন্য কথাও বলল, তবে বিয়ের কথা তুলল না। যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এটা। তবে এত সহজভাবে মেনে নেবেন না জানি। কী যে করবেন বুঝতে পারছি না।”
আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেল। খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে বলব আগামীকাল দেখা করার কথা। কিন্তু বলতে পারলাম না শেষ পর্যন্ত। সে ফোন রাখার আগে বলল, “ভয় পেও না। আমি সামলে নেব সব।”
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। আজ আবার বৃষ্টি। ভারি বর্ষন হচ্ছে। ভাবীর কথামতো আমি চেষ্টা করছি চিন্তা না করতে। ভাবী সত্যি প্রেগনেন্ট। অসুস্থও খানিকটা। শুয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। তার ঘর থেকে গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে–
“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন..
কবে যাব কাছে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ…”
গান শুনতে শুনতে আনমনা আমার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে তার কাছে চলে যাই..বিয়ের একমাস পূর্তিতে ভাবছিলাম কিছু করি। কী করব? বৃষ্টিতে ভিজে সব উত্তেজনা ছড়িয়ে দেব প্রকৃতিতে?
তাকে ফোন করব কি না ভাবতে ভাবতে সেই ফোন করে বলল, “শোনো বৃষ্টিতে ভিজো না আজকে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তোমাকে কে বলল ভিজব?”
সে গলায় কৃত্রিম বিষ্ময় ফুটিয়ে বলল, “এইমাত্র কানে কানে বলে গেলে ভুলে গেছ?”
আমি হেসে ফেললাম। মাঝে মাঝেই সে বলে আমি নাকি তার সাথে বাতাসে ভেসে গিয়ে কথা বলে আসি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি যেসব কথা মনে মনে ভাবি সেসব কথাই সে পরে আমাকে শোনায়। আমি অবাক হলেও কখনো তাকে এই কথাটা বলে দেই না। তার সাথে আমার এত বেশি গভীর পরিচয়ও নেই মনের কথা বোঝার মতো। দুজনের ছোট ছোট স্বভাবগুলো পর্যন্ত দুজন ঠিকভাবে জানি না। অথচ সে আমাকে অন্তর থেকে বুঝতে পারে ভাবলেই অজানা শিহরন হয়। গর্ব হয় ভীষণ। সাথে ভয়ও!
দুপুরের পর ঘুমিয়েছিলাম। মায়ের অস্থির ডাকাডাকি শুনে উঠে গেলাম। “কী হয়েছে?”
“বেয়াইন সাহেবা এসেছেন।”
“মানে? কে এসেছে?”
“তোর শ্বাশুড়ি!”
আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। মা আলমারি থেকে শাড়ি বের করে বললেন, “তাড়াতাড়ি পরে নে। একটু সুন্দর হয়ে তার সামনে আয়।”
আমি বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি শ্বাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে। মা হা হা করে উঠলেন, “আরে অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার আপনি এলেন কেন? ও ই তো যাচ্ছিলো।”
শ্বাশুড়ি মা বললেন, “আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি শুধু কিছু কথা বলে চলে যাব। আপনি একটু বাইরে যাবেন? আমি ওর সাথে একা কথা বলতে চাই।”
মা চলে গেলে শ্বাশুড়ি মা আমার পাশে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন, “জানো, আজ সকালেও উঠে মনে হয়েছিল বাঁচবো না। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। শরীর এত দুর্বল যে মনে হয় ঘুরে পড়ে যাব যে কোনো মুহূর্তে। তার ওপর বুকে ব্যথা শুরু হয় যখন তখন। বেডরেস্টে থাকার কথা আমার। তবুও ছুটে এসেছে। কেন বলতে পারো?”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। উনি বলে গেলেন, “তুমি কী করে আমার ছেলেকে এত পাগল করেছ তা তুমিই জানো। এমন অবস্থা যে সে আমাকে না জানিয়ে বিয়ের মতে একটা কাজ করে ফেলল। প্রথম থেকে কখনোই তোমাকে আমার পছন্দ নয়। কিছু মনে করো না, একটা সত্যি কথা বলি, আমার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার নেই। তবুও সে তোমাকে এত ভালোবাসে কেন জানো? সে অনেক ভালো মনের মানুষ।
তোমার ইনিয়ে বিনিয়ে বলা দুঃখের কথাগুলো তার মন দুর্বল করে দিয়েছে। ছেলের এত রিকোয়েস্টে আমি তোমার সাথে তার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার এত অসুস্থতার মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের দিন যে আমার ছেলেকে ফুসলিয়ে বিয়ে করাতে পারে সেরকম ছলনাময়ী মেয়ে আমি আমার ছেলের পাশে সারাজীবন কিছুতেই দেখতে পারব না।”
আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। চোখের পানিগুলো কখন বাঁধ ভেঙে বইতে শুরু করেছে! আচ্ছা, মানুষ সহজভাবে কেন ভাবে না?
উনি আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কান্না জমিয়ে রাখো। আসল কথা এখনো বলিনি।”
(চলবে)