অপেক্ষা পর্ব-১৬

0
190

অপেক্ষা
পর্ব-১৬
__হুমায়ূন আহমেদ।

গভীর রাতে সুরাইয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোন কারণ ছাড়াই তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তাঁর কাছে মনে হল বাড়িঘর একটু যেন দুলছে। ঘরের পর্দা কাঁপছে। ভূমিকম্প না-কি? ইমনকে ডাকতে যাবেন-তখন তাঁর শরীর জমে গেল। বিছানায় সুপ্ৰভা শুয়ে আছে। কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ছোটবেলার মত করে ঘুমুচ্ছে—বুড়ো আঙ্গুল মুখের ভেতর। আঙ্গুল চুষতে চুষতে ঘুম। বড় হয়েও এই অভ্যাস যায় নি। কত মার খেল এই জন্যে। সুরাইয়া ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন, ইমন ইমন। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তিনি ফুসফুসের সমস্ত শক্তি একত্র করে ডাকলেন, ইমন ইমন। তিনি সুপ্রভার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরাতে পারছেন না। মেয়েটা ঘুমুচ্ছেও না। এইত চোখ মেলে আবার চোখ বন্ধ করল। সুপ্ৰভা কোথেকে এল?
দরজায় ধাক্কা পড়ছে। ইমনের গলা শোনা যাচ্ছে—মা কি হয়েছে? দরজা খোল। দরজা খোল মা।
সুরাইয়া খাট থেকে নামলেন। মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, দেয়াল ধরে টাল সামলালেন। কোন রকমে দরজার কাছে গেলেন। আবারো তাকালেন খাটের দিকে—ঐতো সুপ্রভা। পা গুটিয়ে শুয়েছিল, এখন পা সোজা করেছে।
মা দরজা খোল।
সুরাইয়া দরজা খুললেন। ইমন বলল, কি হয়েছে? সুরাইয়া তাকালেন খাটের দিকে। খািট শূন্য। কেউ সেখানে শুয়ে নেই। ইমন বলল, কি হয়েছে?
সুরাইয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, ভয় পেয়েছি।
ভয় পেয়েছ। কেন?
মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে।
মা শুয়ে থাক, ভূমিকম্প হচ্ছে না।
তুই আমার সঙ্গে ঘুমো।
ইমন বিরক্ত গলায় বলল, পাগলের মত কথা বলো নাতো মা।
পাগলের মত কথা কি বললাম? ছেলে মার সঙ্গে ঘুমুতে পারে না।
একটা জোয়ান ছেলে মার সঙ্গে শুয়ে থাকবে এটা কেমন কথা?
মার কাছে ছেলে সব সময়ই ছেলে।
তোমার সঙ্গে ডিবেট করতে ভাল লাগছে না। মা! তুমি ঘুমাও আমি যাচ্ছি।
এ রকম বিরক্ত গলায় কথা বলছিস কেন? তোর বাবাতো জীবনে কখনো আমার সঙ্গে এমন বিরক্ত গলায় কথা বলে নি।
বাবা যদি এখন থাকতো তাহলে আমার চেয়ে অনেক বেশী বিরক্ত হত। তুমি আগে যেমন ছিলে এখন তেমন নেই। তুমি বদলে গেছ।
আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন?
ধমকাচ্ছি না। তোমাকে ধমকাব এত সাহস আমার নেই।
ইমন চলে গেল। সুরাইয়া আবারো ভয়ে ভয়ে খাটের দিকে তাকালেন। না, খাটে কেউ নেই। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। পানির পিপাসা হয়েছে পানি খাবেন। মাথা দীপ দাপ করছে। নারিকেল তেলের সঙ্গে পানি মিশিয়ে মাথায় দিতে হবে। ঘরে কি নারিকেল তেল আছে? মনে করতে পারছেন না।
সুরাইয়া পানি খেলেন। মাথায় পানি দিয়ে চুলা ধরালেন। বাকি রাতটা তিনি জেগেই কাটাবেন। একা একা বিছানায় ঘুমুতে যাবার মত সাহস তাঁর নেই। চা নিয়ে বসার ঘরে চলে যাবেন। মোটাসোটা দেখে একটা গল্পের বই নিয়ে বসতে পারলে হত। গল্পের বই কি আছে? ইমনের কাছে থাকতে পারে। সুরাইয়া ইমনের জন্যেও এক কাপ চা বানালেন। মনে হয় খাবে না। না খেলে তিনি নিজেই পরে গরম করে খেয়ে নেবেন।
ইমনের ঘরের দরজার কড়া নাড়তেই ইমন দরজা খুলল। সুরাইয়া বললেন, চা খাবি?
ইমন কোন কথা না বলে চায়ের জন্যে হত বাড়াল। সুরাইয়া বললেন, তোর কাছে কোন গল্পের বই আছে?
এত রাতে গল্পের বই দিয়ে কি হবে?
রাতে আর ঘুমুতে যাব না। এই জন্যে।
ভূমিকম্পের ভয়ে জেগে থাকবে?
ভূমিকম্প না। অন্য ব্যাপার।
অন্য ব্যাপারটা কি?
সুরাইয়া ছেলের ঘরের বিছানার উপর চায়ের কাপ নিয়ে বসতে বসতে বললেন— হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি কি বিছানায় সুপ্ৰভা ঘুমুচ্ছে।
এটাতো নতুন কিছু না মা। এক সময় তুমি দেখতে বাবা তোমার পাশে ঘুমুচ্ছে।
তোর বাবাকে দেখে কখনো ভয় পেতাম না। সুপ্ৰভাকে দেখে ভয় পেয়েছি।
সুপ্ৰভাকে কি আজই প্রথম দেখলে না। আগেও দেখেছ?
সুরাইয়া জবাব দিলেন না। তিনি অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছেন। ব্যাপারটা ছেলেকে এই মুহুর্তে বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। সুরাইয়া হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তিনি ছেলেকে কিছুটা হলেও ভয় পান। আশ্চর্য নিজের পেটের ছেলেকে তিনি ভয় পাচ্ছেন। ঐতো সেদিন এতটুকু ছিল। সিঁড়ি দিয়ে একা নামতে পারত না। কেমন পা লেছড়ে লেছড়ে নামত।
ইমন!
বল।
মুন্নী মেয়েটাকে তুই দেখেছিস না? মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে রাতে এসে থাকে।
হুঁ।
মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
ভাল।
শুধু ভাল না, মেয়েটা আসলে খুবই ভাল। তুইতো তার সঙ্গে কথা বলিসনি কাজেই তুই জানিস না। আমার সঙ্গে অনেক কথা হয় আমি জানি। মেয়েটা তোকে খুব পছন্দ করে।
পছন্দ করলে তো ভালই।
ভাল হত।
ভাল হত কেন?
ভাল একটা মেয়ে-এই জন্যেই ভাল হত।
মেয়েটাকে তোমার যত ভাল মনে হচ্ছে সে তত ভাল না। কাছুয়া টাইপ মেয়ে।
কাছুয়া টাইপ মেয়ে মানে?
মানে তুমি বুঝবে না মা। বাদ দাও।
আমি বুঝব না, আর তুই সব বুঝে বসে আছিস? এত তাড়াতাড়ি এত লায়েক কি ভাবে হয়ে গেলি? তোর বাবাওতো এত লায়েক ছিল না।
কথায় কথায় বাবার প্রসঙ্গ টানবে নাতো মা। বাবার সঙ্গে আমার তুলনা করবে না। বাবা ছিল বাবার মত আমি আমার মত।
তোর বাবার কথা উঠলেই তুই রেগে যাস কি জন্যে? আমি ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। তুইতো তাকে সহাই করতে পারিস না।
আমি তাকে সহ্য করতে পারি বা না পারি তাতে তো তাঁর কিছু যাচ্ছে আসছে না। তুমি কেন রাগ করছ?
এখন তোর বাবার কিছু যাচ্ছে। আসছে না। কিন্তু সে যখন ফিরে আসবে, আমাদের সঙ্গে থাকবে তখনতো যাবে আসবে।
বাবা আমাদের সঙ্গে থাকবে?
সে যাবে কোথায়?
ইমন চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, তোমার এখনো ধারণা বাবা ফিরে আসবে?
অবশ্যই আসবে। আমি আলাদা বাসা নিয়েছি কি জন্যে? তোর বাবার জন্যে।
ও।
আমি চেষ্টা করছি তোর বাবা চলে যাবার সময় যে বাড়িতে ছিল সেই বাড়ি ভাড়া নিতে। বাড়িওয়ালাকে বলে রেখেছি— ঘর খালি হলেই তিনি আমাকে খবর দেবেন।
ঠিক আছে মা। তোমার যা ইচ্ছা কর।
মুন্নী মেয়েটার ব্যাপারে তুই ভেবে দেখা।
মা আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমুব।
অবশ্যই ফিরবে। তাকে ফিরতেই হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তোর বাবা ফিরে আসবে শুনে তুই মনে হয় বিরক্ত হচ্ছিস?
মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। মা। আমার আনন্দ হচ্ছে।
তোকেতো চিনতেই পারবে না। এতটুকু ছেলে রেখে গিয়েছিল ফিরে এসে দেখবে এত বড় জোয়ান ছেলে।
সুরাইয়া হাসছেন। ইমন তাঁর মার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
ইমনের ঘুম আসছে না। মার সঙ্গে কথা বলে মাথা কেমন জানি করছে। চোখ জ্বালা করছে। একবার ঘুম আসবে না জানা হয়ে গেলে বিছানায় শুয়ে থাকা খুব কষ্টকর হয়। ইমন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। বাকি রাতটা জেগেই কাটাতে হবে। চিঠি লিখলে কেমন হয়? ছোট চাচাকে একটা চিঠি লেখা যায়। তবে তিনি আবারো ঠিকানা বদলেছেন। চিঠি লিখলেও পাঠানো যাবে না। অবশ্যি চিঠি যে পাঠাতেই হবে এমনতো কথা নেই। চিঠি লেখাটাই প্রধান। পাঠানোটা প্রধান না। আচ্ছা সুপ্ৰভাকে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়? সুপ্ৰভা কোনদিন পড়তে পারবে না, আবার পড়তেওতো পারে। জগৎ রহস্যময়, সেই রহস্যময় জগতে কত কিছুই ঘটতে পারে। সে চিঠি লেখার সময় অশরীরি সুপ্ৰভা হয়ত উঁকি দিয়ে দিয়ে পড়বে। নিজের মনে পড়বে। আচ্ছা তারও কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
ইমন কাগজ কলম নিয়ে বসল। সম্বোধন কি হবে।— প্রিয় সুপ্ৰভা? না, প্রিয় লেখার দরকার নেই। যে প্ৰিয় তাকে প্ৰিয় সম্বোধন করার প্রয়োজনটা কি? আমরা যখন অপ্ৰিয় কাউকে চিঠি লিখি তখন কি লিখি অপ্ৰিয় করিম বা অপ্রিয় রহিম? ইমন কাগজের উপর ঝুকে পড়ল। চিঠিটা এমন করে লিখতে হবে যেন সুপ্ৰভা পড়ে মজা পায়। আচ্ছা এসব সে কি ভাবছে? সুপ্ৰভা পড়বে কি ভাবে যে মজা পাবে?
সুপ্ৰভা,
তুই কেমন আছিস? মনের আনন্দে খুব ঘুরে বেড়াচ্ছিস? চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, স্কুলের ঝামেলা নেই।
তোর কথা খুব মনে হয়। আমি যখনই একা থাকি তখনি দুজন মানুষের কথা মনে হয়–একজন ছোট চাচা, আরেকজন তুই।
আর যখন অসুখ বিসুখ হয় তখন ছোট চাচা না, তখন শুধু তোর কথা মনে হয়। তোর যে অভ্যাস ছিল অসুখ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেই গল্পের বই পড়ে শুনানো। অসুখের সময় কিছু ভাল লাগে না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। তখন কি আর গল্প শুনতে ভাল লাগার কথা? আমার কখনো ভাল লাগত না। তুই এত আগ্রহ করে গল্প পড়ে শুনাতি বলে চুপ করে থাকতাম।
কয়েকদিন আগে জ্বরে পড়েছিলাম। গায়ে হামের মত গোটা গোটা কি যেন বের হয়েছিল। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। তখন তোর কথা খুব মনে পড়ছিল।
এখন আমাদের খবর বলি। শোভন ভাইয়াকে পুলিশ ধরে থানা হাজতে আটকে রেখেছে। আমি প্রায়ই তাকে দেখতে যাই—সিগারেট দিয়ে আসি। শোভন ভাইয়া সেদিন হঠাৎ বললেন, তোকে না-কি স্বপ্নে দেখেছেন। স্বপ্নটাও অদ্ভুত। তিনি হাজতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্যে নাক মুখ সব কম্বলে ঢাকা। হঠাৎ কে যেন টান দিয়ে কম্বল সরাল।
তিনি জেগে উঠে দেখেন— তুই। তিনি বললেন, সুপ্ৰভা তুই এখানে কেন? হাজতে এসেছিস কি মনে করে? তুই হাসতে হাসতে বললি, তোমাকে দেখতে এসেছি। শোভন ভাইয়া দারুণ রেগে গিয়ে বললেন, তুই তোর বিশ্ৰী অভ্যাসটা বদলা। যেখানে সেখানে উপস্থিত হবি। তুই একটা বাচ্চা মেয়ে, হাজতে তুই আসবি কেন?
তুই বললি, তোমাকে নিতে এসেছি ভাইয়া। এসো আমার সঙ্গে।
তিনি বললেন, এরা আমাকে যেতে দেবে না।
তুই বললি, অবশ্যই যেতে দেবে। আমার হাত ধর।
তিনি তোর হাত ধরতেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
স্বপ্নটা সুন্দর, কিন্তু তার কাছে মনে হল তিনি একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছেন। এটা নাকি মৃত্যু স্বপ্ন। কোন মৃত মানুষ যদি স্বপ্নে দেখা দিয়ে হাত ধরতে বলে এবং সেই হাত যদি ধরা হয় তাহলে ধরেই নিতে হবে অবধারিত মৃত্যু।
সুপ্ৰভা, তুই কি জানিস শোভন ভাইয়া এবং টোকন ভাইয়া তোকে অসম্ভব ভালবাসে। তোর কথা উঠলেই তাদের চোখে পানি আসে। আশ্চর্য কাণ্ড, তোর দেখি তলে তলে সবার সঙ্গেই খাতির ছিল। সবাই তোকে এত পছন্দ করে কেন? রহস্যটা কি?
আমাকে কিন্তু কেউ তেমন পছন্দ করে না। এটা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। ছোটবেলায় কেউ আমাকে খেলতে নিত না। তুই শুনে খুব অবাক হবি স্কুলের সব ছেলেরা একবার কোন কারণ ছাড়াই আমাকে মাটিতে ফেলে মেরে প্রায় ভর্তা বানিয়ে ফেলেছিল। আমাদের জিওগ্রাফি স্যার শেষে ছুটে এসে আমাকে উদ্ধার করেন।
এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি—এখানেও একই সমস্যা। ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার সময় ভাইবা পরীক্ষা হয়। ভাইবায় আমাকে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার প্রতিটির উত্তর আমি দিয়েছি। তারপরেও নম্বর পেয়েছি মাত্ৰ ৫০, অথচ অন্যরা ৭০, ৭৫ পেয়েছে। ও তোকেতো বলা হয় নি ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠার পরীক্ষায় আমি খুব ভাল করেছি। থিওরী পরীক্ষার প্রতিটায় খুব ভাল করেছি। স্যাররা এখন মনে হয় ভাইবায় আমাকে কম নাম্বার দেয়ায় নিজেরাই লজ্জিত।
স্যারদের ধারণা আমি রেকর্ড নাম্বার নিয়ে পাশ করব। আমার সে রকম ধারণা না। আমার মনে হচ্ছে। আমি শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেব না। আমার কিছুই ভাল লাগে না। প্রায়ই ইচ্ছা করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে বাবার মত কোথাও চলে যাই।
এমন কোথাও যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। কেউ আমাকে চিনবে না, আমিও কাউকে চিনতে পারব না। আমার কথাবার্তা কি তোর কাছে এলোমেলো লাগছে?
আমার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়েছে ঠিকই। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্নগুলির মধ্যেও কোন ভেরিয়েশন নেই–একই দুঃস্বপ্ন—খালি গায়ে শুয়ে আছি, হঠাৎ গায়ের উপর দিয়ে কুৎসিত একটা মাকড়সা হেঁটে যেতে শুরু করল। আমি বিকট চিৎকার দিয়ে মাকড়সাটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করেও ফেলতে পারলাম না। সে আঙ্গুল কামড়ে ঝুলে রইল। আমার কি ধারণা জানিস? আমার ধারণা আমি যদি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাই তাহলে আমার ভুবন হবে মাকড়সাময়। আমার চারদিকে কিলবিল করবে। অসংখ্য মাকড়সা। আমাকে যে খাবার দেয়া হবে সে খাবার খেতে গিয়ে দেখব—মাকড়সার ঝোল আলু এবং সীম দিয়ে রান্না করা হয়েছে। এসব কি লিখছি? আমার গা ঘিনঘিন করছে।
মার কথাতো তোকে বলা হয় নি-মা ভাল আছে। খুব ভাল না, মোটামুটি ভাল। মা এখন আমাকে কিছুটা ভয় পায়। এটা বিরাট একটা ঘটনা না? তার এখনো ধারণা যেদিন আমার বিয়ে হবে সেদিন বাবা ফিরে আসবেন। তার অপেক্ষার শেষ হবে।
তিনি আমার জন্যে মনে মনে একটা পাত্রীও ঠিক করে ফেলেছেন। মেয়েটার নাম মুন্নী। মার ধারণা এই পৃথিবীতে মুন্নীর মত ভাল মেয়ের জন্ম হয় নি। আমার ধারণা অবশ্যি সে রকম না। নানা রকম দুঃখ কষ্ট, বঞ্চনার ভেতর দিয়ে সে বড় হয়েছে বলে তার ভেতর বেশ কিছু ধাপ্লাবাজী ঢুকে গেছে। এই জাতীয় মেয়েদের প্রধান ঝোক থাকে মানুষকে পটানো। মাকে সে ইতিমধ্যে পটিয়ে ফেলেছে। খুব শিগগীরই সে আমাকে পটানোর একটা চেষ্টা চালাবে বলে আমার ধারণা।
আচ্ছা সুপ্ৰভা, তুই কি নবনীর কথা জানিস? মিতু কি তোকে নবনী সম্পর্কে কিছু বলেছে? মনে হয় বলেনি। মিতু আবার কাউকেই কিছু বলে না। সব কথা পেটে রেখে দেয়। নবনীকে আমি অংক শেখাই। আমাদের এক স্যার এই প্রাইভেট টিউশ্যানিটা আমাকে জোগাড় করে দিয়েছেন। হুলুস্থুল টাইপের বড়লোকের মেয়ে। চেহারা জাপানী পুতুলের মত, ভাবভঙ্গিও পুতুলের মত। একমাত্র মেয়ে হলে যা হয়। আহ্লাদ না করে কোন কথা বলতে পারে না। আমি যদি তাকে জিজ্ঞেস করি।-অংকটা বুঝতে পেরেছ? সে কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে হাসবে তারপর টেনে টেনে বলবে-জানি না। আমি যদি বলি-আবার বুঝিয়ে দেব? সে আগের মত টেনে টেনে বলবে, ইচ্ছে হলে বুঝাতে পারেন, ইচ্ছা না হলে নাই। ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত বিরক্তিকর।
নবনী টাইপ মেয়েরা করে কি জানিস? তারা পরিচিত অর্ধপরিচিত সব ছেলের সঙ্গেই প্ৰেম প্ৰেম ভাব নিয়ে কথা বলে। এ রকম করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। তখন এই কান্ডটা সবার সঙ্গেই করে। বর্তমানে আমার সঙ্গে করছে। জন্মদিনে উপহার কিনে দিচ্ছে। আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। মেয়েটা সম্ভবত তার বাবা-মাকেও আমার বিষয়ে কিছু বলেছে। কারণ কয়েকদিন আগে মেয়েটির বাবা আমার সঙ্গে অনেক কথা টথা বললেন। দেশের বাড়ি কোথায়? ক ভাইবোন? এইসব। শেষটায় বললেন, তারা সিলেট হয়ে শিলং বেড়াতে যাচ্ছেন। আমি যদি শিলং না দেখে থাকি তাহলে যেন তাদের সঙ্গে যাই। আমার অবস্থাটা কি বুঝতে পারছিস? আমি নবনীদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তবে খুব ভয়ে ভয়ে আছি কবে না জানি সে খুঁজে খুঁজে বাসায় উপস্থিত হয়!
আমার পড়াশোনার কথা তোকে চিঠির শুরুতে একভাবে লিখেছিলাম। এখন অন্যভাবে বলি, তোর মৃত্যুর পর থেকে আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। কেন জানি বই পড়তে ভাল লাগে না। ঘরে থাকতেও ভাল লাগে না। তিনটা ক্লাস এসাইনমেন্ট জমা দেই নি। নিয়মিত যে ক্লাসে যাচ্ছি তাও না। ঘরে যখন থাকি বিছানায় শুয়ে থাকি। বাইরে যখন থাকি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি। এর নাম হন্টন-সিনড্রোম।
রাস্তায় যখন হাঁটি তখন আমার গায়ে থাকে চাদর। এখন শীতকাল কাজেই চাদর থাকতেই পারে। চাদরের নিচে, প্যান্টের পকেটে ভয়াবহ একটা বস্তু থাকে। এই ভয়াবহ বস্তুটা আমাকে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছেন শোভন ভাইয়া। আমি লুকিয়েই রাখি। হঠাৎ হঠাৎ পকেটে নিয়ে বের হই। তখন খুব অন্যরকম লাগে। পৃথিবীটাকে নিজের পায়ের নিচে মনে হয়। এমিতেই পৃথিবী আমাদের পায়ের নিচে, যদিও তা কখনো মনে হয় না। ঐ বস্তুটা পকেটে থাকলেই শুধু মনে হয়। এবং কি ইচ্ছা করে জানিস? ইচ্ছা করে আশে পাশের সব দুষ্টলোক মেরে ফেলি। এখন তুই কি বুঝতে পারছিস বস্তুটা কি? যা ভাবছিস তাই-পিস্তল। পিস্তলের নাম ধামতো জানি না—তবে পিস্তলের গায়ে রাশিয়ান ভাষায় কি সব লেখা দেখে মনে হচ্ছে রাশিয়ায় তৈরি। জিনিসটা ছোট্ট এবং সুন্দর। হাতের মুঠোর মধ্যে আটে। ধরার বাটটা রূপালী। মনে হয় রূপার তৈরি। বাটে সুন্দর সুন্দর ছবি, গাছ-লতা-পাতা-ফুল এইসব।
সেদিন কি হল শোন। কাকরাইলের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি তিনটা ছেলে (আমার মত বয়েসী) আধাবুড়ো এক রিকশাওয়ালাকে কিল চড় ঘুসি মারছে। রিকশাওয়ালা নাকি তাদের সঙ্গে কি বেয়াদবী করেছে। রিকশাওয়ালার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। অনেক লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে মারের দৃশ্য দেখছে। কেউ কিছু বলছে না।
এক পর্যায়ে রিকশাওয়ালার লুঙ্গি খুলে পড়ে গেল। লুঙ্গি টেনে শরীরে জড়ানোর মত শক্তিও তার নেই। নগ্ন একজন মানুষ মার খাচ্ছে-কুৎসিত দৃশ্য। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার প্যান্টের পকেটে লতা-ফুল-পাতা আঁকা পিস্তল। অথচ আমিও কিছু বলছি না। আমি কি খুব সহজেই বলতে পারতাম না—যথেষ্ট হয়েছে। এখন সব বন্ধ। তোমরা তিনজন কানে ধরে দশবার ওঠবোস কর এবং বুড়ো মানুষটার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমি কিছুই করলাম না। মাথা নিচু করে চলে এসেছি।
সুপ্ৰভা শোন, মা যেমন রাতে ঘুমায় না, আমিও ঘুমাই না। মা জেগে থাকে তার ঘরে। আমি জেগে থাকি আমার ঘরে। মার জেগে থাকার তাও একটা অর্থ আছে। তিনি অপেক্ষা করেন। মার অপেক্ষা বাবার জন্যে। আমিতো কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করি না।
রাত জেগে আমি অনেক কিছু ভাবি। সেই অনেক ভাবনার একটা হল—মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে অপেক্ষা নামের ব্যাপারটির খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক। মার শরীরের যে অবস্থা তাতে তার বেঁচে থাকার কথা না, তারপরেও আমার ধারণা তিনি দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকবেন কারণ তিনি অপেক্ষা করছেন। বড় মামা বেশী দিন বাঁচবেন না, কারণ তিনি এখন আর কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছেন না।
ইমন লেখা বন্ধ করল। ফজরের আজান হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক ফর্স হতে শুরু হবে। দিনের আলোয় এই চিঠি লেখা যাবে না। ইমনের হাই উঠছে, ঘুম পাচ্ছে। কিছুদিন হল ঠিক ফজরের আজানের পর পর তার ঘুম আসে। ইমন লেখা কাগজগুলি হাতে নিয়ে এখন কুচি কুচি করে ছিড়ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এখন তার চেষ্টা কত ছোট কাগজের কুচি করা যায় তা দেখা। কাগজের কুচিগুলিকে এখন দেখাচ্ছে জুই ফুলের মত। সারা ঘরময় ছড়িয়ে তার উপর দিয়ে হাঁটতে হবে—কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here