অপেক্ষা
পার্ট_০৩
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
জীর্নতা যখন গ্রাস করে অস্তিত্ব তখন বিলীন হয়ে যায়।যে রেওয়াজ এর নাম ক্যাম্পাসের প্রতিটা মানুষের অন্তরে গেথে ছিল সে রেওয়াজের কথা ভাবতেও আজকে সবাই দ্বিধাবোধ করে।
ঠিক মাগরিবের আযানের সময়ে একটা পুরোনো বিল্ডিং এ গিয়ে পৌছালাম।পুরো বিল্ডিং জীন শীর্ন। যেকোন মুহুর্তেই যেন ধ্বসে পরবে।অন্য সময়ে হলে হয়তো এই জায়গায় আসতে আমি ১০০ বার ভাবতাম।কিন্তু রেওয়াজকে খুজে পাওয়ার ইচ্ছা আমার মধ্যে এমনভাবে গ্রাস করে বসেছে যে আমি জাহান্নামের দরজায়ও বিনা দ্বিধায় যেতে পারি।ছোট খাটো একটা রুমের সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমরা।দরজা আধ খাওয়া ভাঙা।কালোমত ছেলেটা তিনবার নক করল দরজায়।ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। ছেলে টা আবার একই সময় ব্যবধানে দরজায় টোকা দিল। এবার যেন ভেতরে কেউ নড়ে উঠল।খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে।ছেলেটা আবার আগের মত তিনটা টোকা দিল। আচ্ছা এইটা কি কোন কোড ওয়ার্ড?
এখনো দরজা খুলছে না কেন?ভেতরে কে আছে?১৫ সেকেন্ড রুদ্ধ শ্বাসে কাটল।ঠিক তার পরেই আসল সেই মুহুর্ত।খুট করে শব্দ হয়ে দরজা খুলে গেল।
.
.
কথায় বলে চোখে দেখা সব কিছু সবসময় বাস্তব হয় না।আমিও খুব করে চাচ্ছি যেন আমার সামনের দৃশ্যটা যেন বাস্তব না হয়ে কল্পনা হয়।আমার সামনে রেওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে,চোখের নিচে জমেছে অগনিত নির্ঘুম রাতের আধার।ঠোট দুটো সিগারেটের আগুনে জ্বলে কালো হয়ে গেছে। গাল দুটো যত্নের অভাবে মলিন।চুল উষ্কখুষ্ক। পরনে সেই প্রথম দিন দেখা সাদা পাঞ্জাবিটা।সিগারেটের উটকো গন্ধ নাকে আসতেই দেখি বাম হাতে একটা আধখাওয়া সিগারেট জ্বলছে।রেওয়াজ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে ওর হাত পুড়াচ্ছে।আমি টেনে নিয়ে ওর হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিলাম।রেওয়াজ কোন কথা না বলেই ভেতরে চলে গেল।আমি ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম।
ভিতরে গিয়ে রেওয়াজ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল
– কি চাই?
-তুমি আমাকে চিনতে পারো নি?
রেওয়াজ কথার জবাব দিল না কোন৷শুধু চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে রইল।আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-আমি ভার্সিটি ঘুরতে এসে গুন্ডাদের হাতে পরেছিলাম।তুমি আমাকে বাচিয়েছিলে। পুরো ভার্সিটি ঘুরিয়েছিলে।যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু একে বলেছিলে -“অপেক্ষা করব,অপেক্ষায় থেকো”।
রেওয়াজ আমি ৪ মাস ধরে প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহুর্ত তোমার অপেক্ষা করেছি।
রেওয়াজ অন্যদিকে সরে গিয়ে বলল
-কায়া তুমি ছোট বাচ্চা না। যথেষ্ট বড় হয়েছ৷ সিম্পল একটা প্রাঙ্ককে এত সিরিয়াস নেওয়ার মত বয়স নেই এখনো তোমার।বেটার হবে তুমি এখান থেকে চলে যাও।
-প্রাংক?!রেওয়াজ তোমার চোখের মায়া প্রাংক ছিল?আমার কপালে তোমার ঠোটের আলতো স্পর্শ প্রাংক ছিল?আমাকে ভালবাসার স্বপ্ন প্রাংক ছিল?রেওয়াজ তুমি তো আমাকেই প্রাংক বানিয়ে দিলে।
কথাগুলো বলেই কাদতে লাগলাম আমি।বুক ফেটে যাচ্ছে আমার।এতদিন থেকে যার স্বপ্নকে যত্ন করে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছি সে এক নিমিষেই সবকিছুকে মিথ্যা বানিয়ে দিল।
-কায়া অযথা সীন ক্রিয়েট করে কোন লাভ হবে না।আজকে তোমার ভার্সিটিতে প্রথম দিন৷ তোমার সামনে একটা সুন্দর ফিউচার পরে আছে।মরীচীকার পেছনে না ছুটে নিজের ভবিষ্যত সুন্দর কর।
-এটাই কি তোমার শেষ কথা?
রেওয়াজ একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল
-হ্যা৷
-তাহলে চোখ নিচু কেন তোমার? যদি এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত হয় তাহলে আমার চোখে চোখ রেখে বল। বল যে তুমি আমায় ভালোবাসো না।বল যে আমার জন্যে তুমি অপেক্ষা করনি।বল রেওয়াজ। নাহলে আমি এখান থেকে যাব না।
রেওয়াজ রেগে গিয়ে আমার দুবাহু চেপে ধরে বলল
-একবার কথা বললে কানে ঢোকে না? সিনেমার মত নাটক করে দেখাইতে হবে?আরেকবার যদি তোমাকে এইখানে দেখি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। যাও এখান থেকে।
বলেই রেওয়াজ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।টাল সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়লাম পাশের টেবিলের উপর। টেবিলের কোনা লেগে মাথা ফেটে গেছে।প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে পুরো মাথা।
রেওয়াজ আরেক দফা চেচিয়ে উঠল
-আই রফিক ওকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস?নিয়ে যা ওকে এখান থেকে৷ আর কখনো যাতে ওকে আমি না দেখি এইখানে।
ছেলেটা মাথা নিচু করে কাচুমাচু করে উত্তর দিল
-জ্বি বস।
আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল
-আপা চলেন এইখান থাইক্কা।ওস্তাদের মন মেজাজ ভালো নাই। চলেন।
আমি ছলছল চোখে রেওয়াজের দিকে এক পলক তাকিয়ে বের হয়ে আসলাম।
.
.
সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল এক নিমিষেই।সব যেন ঝরের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।কি এমনটা হল যে রেওয়াজ এতটা বদলে গেছে?!ভার্সিটিতেও যায় না একা একা একটা রুমে চোরের মত লুকিয়ে আছে। ভার্সিটির কেউ রেওয়াজের নামটাও শুনতে নারাজ। কি এমন হল যে পুরো দুনিয়াই পাল্টে গেল!আমাকে যে করেই হোক জানতেই হবে।
রফিক আমাকে মেইন রোড পর্যন্ত পৌছে দিয়েছে।অটোতে উঠতে যাবে তখনি মাথা ঘুরিয়ে বললাম
-রফিক ভাইয়া রেওয়াজ…..
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই রফিক বলে উঠল
-আমি জানি আপা আপনি কি জিগাবার চান।কিন্তু আপা আমি কিছু কইতে পারুম না।ওস্তাদের নিষেধ আছে।আপনি সাবধানে বাড়ি যাইয়েন। আল্লাহ হাফেজ।
আমি কিছু বলার আগেই রফিক দ্রুত পায়ে হেটে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
সব কিছুতেই একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।সবাই কিছুনা কিছু লুকাচ্ছে।রেওয়াজের সাথে এমন খারাপ কিছু হয়েছে যার ছায়া আমার উপর সে ফেলতে চাইছে না।কিন্তু সে জানে না আমি তাকে নিজের করে নিয়েছি এতে সে চাক বা নাই চাক।
.
.
বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে।ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে গেছে পুরো দমে।ক্লাস এসাইনমেন্ট সব মিলিয়ে দম ফেলারও টাইম নেই। কিন্তু এর মাঝে আমি আমার খোজ বন্ধ রাখিনি৷আমি যতই খোজ করিনা কেন এমন কোন মানুষ নেই যে মুখ খুলতে রাজী হয়েছে।সবাই নাম শোনা মাত্রই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। এখনো কোন খোজ পাইনি।এর মাঝে একবার রেওয়াজকে ক্যাম্পাসে দেখেছিলাম।চোখ মুখ বেধে এসেছিল।লোকের ভীড়ে ওকে কেউ চিনতে না পেলেও আমি ঠিকি চিনে নিয়েছিলাম।ওর দিকে এগিয়ে যাব তখনি ও ভীড়ে মিলিয়ে গেল।লাইব্রেরিতে বসে নোট করছি আর কথাগুলো ভাবছি।হঠাত করে একজন এসে আমার সামনের চেয়ারে বসল।আমি মাথা তুলে দেখি লাইব্রেরিয়ান আমার সামনে বসে আছেন।এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।
উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে বেশ অস্বস্তি লাগছে আমার। নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম
-কিছু বলবেন স্যার?
-তুমি কায়া না?
-জ্বি বলুন।
-শুনলাম তুমি নাকি কয়েকদিন থেকে রেওয়াজকে খুজছ।কোমড় বেধে লেগে পরেছ ওর কাছে পৌছানোর জন্যে।
আমি হালকা হেসে বললাম
-আমি ওর কাছে পৌছে গিয়েছি স্যার। আমি জানি রেওয়াজ কোথায় আছে কেমন আছে।
কথাটুকু বলেই আমি আবার বইএ মুখ গুজলাম।তখনি উনি আবার বলে ঊঠলেন
-তাতে কি আদৌ কোন লাভ হয়েছে?সে তোমাকে কখনোই মেনে নিবে না। শুধু তোমাকে কেন কাউকেই সে মানতে পারবেনা।যেকোন মেয়ের দিকে তাকানোই তার জন্য মৃত্যুর সমান।
-মানে?
আমার কথার জবাবে উনি শুধু মুচকি হাসলেন।কোন কিছুই না বলে উঠে চলে গেলেন বই ইস্যু করতে।
.
.
লাইব্রেরির তিনতলার গেটে দাঁড়িয়ে আছি আমি।লাইব্রেরিয়ান কাগজ পত্র গোছাচ্ছেন।পুরো লাইব্রেরী ফাকা।কেউ নেই আশেপাশে।এটাই মোক্ষম সুযোগ।উনার সাথে কথা বলার৷ উনি রেওয়াজের সম্পর্কে কিছু জানেন।আমাকে তা জানতে হবে।হয়তো ভিড়ের কারনে তখন তিনি কিছু বলেন না হয়তো বা ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন রেখেছেন।কারন যাই হোক না কেন আমাকে তা জানতেই হবে।ছোট একটা দম ফেলে লাইব্রেরীর ভিতরে পা বাড়ালাম।…..
চলবে