অপেক্ষা শেষ_পর্ব

0
2937

অপেক্ষা শেষ_পর্ব
#গল্প

নিরু বরাবরই কটকট করে কথা বলে। বড় ভাইকে যে ভয় পায় না, তা নয়। ভয় পায়। বাবাকেও তাই। তারপরও নিরু বোনের পক্ষ নিয়ে সাহসের সাথে দুটো কথা নতুন বউকে শুনিয়ে দিলো।
-শোনেন ভাবী, আপনার কপাল ভালো তাই যেমন বর চেয়েছেন, তেমনই পেয়েছেন। আচ্ছা কল্পনা করেন তো, আপনাকে বিয়ের রাতে আপনার বর বলছে তার রিলেশন আছে একটি মেয়ের সাথে। কী পারছেন কল্পনা করতে ? জানি পারবেন-ই না। আর আমার আপার জীবনে এটাই ঘটেছে। হুম বাস্তব ঘটনা এটাই। বলতে পারেন, আমার আপার দোষ কোথায় ? ভাইয়া আর বাবা ওই বেয়াদব লোকটার চাকরী দেখলো শুধু ! আসলে আমাদের বাপ ভাই-ই দোষী। ওদের জন্যই আজ আপার এই দশা !
লিজা চোখ মুখ পাকিয়ে ছোট ননদকে দেখছে।
-তুমি ছোট মানুষ হয়ে এত কথা বলছো আমাকে ? তোমার সাহস তো কম নয়। দাঁড়াও তোমার ভাইয়াকে বলছি।
নিরুও কম যায় না।
-শোনেন ভাবী, নতুন বউ আপনি এই বাড়ির। আপনি বা কোন দুঃখে আপার পেছনে আজই লাগলেন ! আপনি জানেন, ও আজ চলে যাবে রাজশাহী। তবুও ওকে কষ্ট দিয়ে কথা বললেন। আমিতো বাড়িতে আম্মার কাছে থাকি।ও বেচারা তো একা, ওই শহরে থাকে।

ওদের এসব কথাবার্তায় নিপার মায়ের বড্ড অস্বস্তি লাগছে। নতুন বউ এর সাথে মেয়েরা এমন করে কথাই বা বলছে কেন, আর নতুন বউই বা বিয়ের দু’দিনের মাথায় ননদদের সাথে বিবাদ করছে কেন! নিরুকে এক ধমক দিলো ওর মা।
-বড় ভাবীর মুখে মুখে তর্ক করছিস তুই ? এমন শিক্ষা তো আমি দিইনি তোদেরকে।এই নিপা তোর বোনকে থামা। মুখে মুখে কথা বলে, বেয়াদব মেয়ে একটা !
নিরু ওর মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
-আপনার দেওয়া ভালো শিক্ষা পেয়েছি বলেই এখনও ভদ্রভাবে কথা বলি আম্মা। অসভ্য আর হতে পারলাম কই আমরা দু’বোন !
নিপা বোনের হাত ধরে টেনে বিছানায়
বসালো।
-ছিঃ নিরু এত কথা বলতে হয় ? আর একটা কথাও বলবি না। শোন আমি আজ চলে যাবো। আম্মাকে দেখে রাখিস। অনেকদিন হয়তো আসতে পারবো নারে বাড়িতে। বিভিন্ন জায়গায় চাকরীর জন্য পরীক্ষা দিয়েছি। দোয়া করিস রে’ যেন ছোট মোটো হলেও একটা চাকরী মিলে যায় আমার।
নিরু বোনের কথায় চমকে ওঠে।
-সেকি আপনি তো এমএ পাশই করেননি আপা। অনার্স পাশ দিয়ে হয় চাকরী ?
-হয় হয় ! যাক শোন, তুই মন দিয়ে পড়ালেখা কর নিরু।তুই এসএসসি পাশ করলে, আমি শহরে নিয়ে কলেজে ভর্তি করে দেবো তোকে। আমাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নইলে সুযোগ বুঝে মানুষ আমাদেরকে ঠকাতেই থাকবে। আর ঠকতে চাই না জীবনে।
নিপার চোখ বেয়ে তপ্ত নোনা জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

নিপা বিদায় নেবার সময় ওর বাবা সামনে এসে দাঁড়ালো। এই লোক গঞ্জের মোড়ে রাতদিন চালের আড়তেই পড়ে থাকে। শুধু টাকা আর টাকা চেনে।নিপা কৃতজ্ঞ ওর বাবার কাছে। যত যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে তো দিয়েছিলো। নিপা আস্তে করে ওর বাবার হাতটা ধরলো।
-আব্বা আমার জন্য দোয়া করবেন। এবার অনেকদিন হয়তো আসতে পারবো না। আপনি এসেন রাজশাহী। তাহলে দেখাটা হবে।
নিপার বাবার তড়িৎ উত্তর,
-আমার যাবার সময় আছে নাকি? আর শোন এত পড়ে কী হবি রে’ তুই ? সেই তো হাঁড়ি ঠেলবি ! আমি তোর আবার বিয়ে দিবো। জানিস একটা ভালো ছেলের খবর পেয়েছি।

নিপার আর ইচ্ছে করছে না এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়াতে। তবুও মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থেকে বাবার কথাগুলো শুনছে। এরই মধ্যে নজরুল আর লিজা এসে হাজির। নজরুল কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে নিপার দিকে।
-এই নিপা তুই কী বলেছিস লিজাকে ? এই তাকা আমার দিকে, তুই কী কোনদিন ভালো হবি না ? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার !
কষ্টে নিপার কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে। এত অপমান আর অসম্মান কেন করে ভাইয়া ! এক মা-বাবারই তো তিন সন্তান তারা। তাই বলে আচরণও তিন রকম ! নাহ্ নিপা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াতে চায় না। ওড়নার কোণা দিয়ে কোনরকমে চোখের জল মুছে মাকে জড়িয়ে ধরলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, “দোয়া করবেন আম্মা আমার জন্য”।

আকাশে মেঘ জমলেও একটা সময় তা সরে যায়। তেমনই মানুষের খারাপ সময়ও জীবনভর থাকে না।আজ সকালেই নিপা জানতে পারলো ‘আরডিএ’ তে’ অফিস সহকারী পদে চাকরীটা পেয়েছে সে। সব মিলিয়ে বেতন প্রায় বিশ হাজার টাকা। শেষ কবে নিপা এতটা খুশি হয়েছিলো, নিজেই মনে করতে পারছে না। চোখে আনন্দের অশ্রু নিয়ে বড়ভাইকে ফোন করলো।
-ভাইয়া, আমি ‘আরডিএ’ তে’ জব পেয়েছি। আম্মাকে দেন তো ভাইয়া। আম্মা শুনলে সবচেয়ে খুশি হবে।
নজরুল ফোনের ওপাশ থেকে বললো,
-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় গ্রেডের জব করবি ?
ভাইয়ের কথা শুনে, নিপা হাসতে শুরু করলো।
-আপনি দেখি কোন কিছুতেই সন্তোষ্ট হতে পারেন না ভাইয়া। আচ্ছা আচ্ছা শোনেন, এমএ পাশ করি। তারপর উঠে পড়ে লাগবো ভালো জবের জন্য। এখন আপাতত আব্বার খরচ কমানোর জন্য, আর নিজের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই জব করা দরকার। তাই আর কি !
নজরুল আমতা আমতা করে বললো,
-শোন, আম্মার শরীরটা একটু খারাপ। ঘুমাচ্ছে এখনো। আম্মা উঠলেই তোকে ফোন করবে। রাখছি এখন।
মুহূর্তেই নিপার মুখটা কালো হয়ে গেলো।
-তাহলে নিরুকে দেন, ওর সাথে কথা বলি।
নিরু ফোন হাতে নিয়েই কাঁদতে শুরু করলো।
-আপা ভালো আছেন ? শোনেন আম্মার প্রেশারটা হাই। হবে না হাই প্রেশার, হবেই তো !
নজরুল ফোনটা কেড়ে নিলো নিরুর হাত থেকে।
-আরে তেমন কিছু না। হটাৎ প্রেশার বেড়েছে। রাতদিন তোর চিন্তায় থাকে যে !
এদিকে নিরু সমানে চিৎকার করছে, যেন কথাগুলো নিপা শুনতে পায়।
-ভাইয়া সত্যি কথা বলেন আপাকে। আর কত অন্যায় করবেন আমাদের সাথে ? মিথ্যা বলছেন কেন ? আসলে তো ভাবীর কথার যন্ত্রণায় আম্মার এই অবস্থা।

কোথায় চাকরীর খবর নিপা ওর মাকে শোনাবে, মা কত খুশি হবে! সেখানে শুনতে হলো মায়ের শরীর নাকি নিপার জন্যই খারাপ। কথাটা বললো ওর আপন ভাই। এদিকে নিপা, দুপুর আড়াইটার বাসে উঠলো, বাড়ি যাবার জন্য। মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পৌঁছে গেলো সে বাড়িতে।নজরুল আর লিজা, নিপাকে দেখে যেন বোবা হয়ে গেলো। নিপা ওদের সাথে কোনো কথা না বলেই মায়ের ঘরে গেলো।ওর মা তখনো বিছানায় শুয়ে আছে।নিপা মায়ের পাশে বসে মাথায় হাত রাখলো।
-আম্মা কী হয়েছে আপনার ? ও আম্মা !
নিপার কন্ঠ পেয়ে ওর মা বিছানায় উঠে বসলো।
-আমি ঠিক আছি। তুই আসলি খুব ভালো হলো। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো রে’।
নিপা মাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
-জানেন আম্মা আমার চাকরী হয়েছে। আপনার দোয়াতে আর আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে।
খুশিতে নিপার মা, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কাঁদতে শুরু করলো। নিরুও চোখ ডলতে ডলতে মা আর বোনকে জড়িয়ে ধরলো।নিপা জানালো, সে দুটো দিন বাড়িতে থাকবে। তারপর রাজশাহী ফিরেই কাজে জয়েন করবে।

রাতে দেখা পাওয়া গেলো নিপার বাবার। একসাথে ওরা খেতে বসেছে। তবে খাবার টেবিলে লিজা আসেনি। নিরু ডাকতে গেলো ভাবীকে।
-ভাবী আসেন, সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।
লিজা তেড়ে ফুঁড়ে উঠলো নিরুকে।
-কী বোনকে ডেকেছো, আমাকে শায়েস্তা করবার জন্য? চলো দেখি কী করতে পারো তোমরা !
ভাবীর এমনতর কথায়, নিরু অবাক !
-আপনি কী সব সময় ঝগড়া বিবাদ করার জন্য রেডি থাকেন? ভালো তো! যেমন ভাইয়া, তেমনই আপনি!
নিরু চলে আসলো ডাইনিংয়ে। ওর আসার কিছুক্ষণ পর এলো লিজা।
লিজা আসার পর নিপাই আগে কথা বললো।
-ভাবী বসেন। কেমন আছেন ?
চোখ মুখ খামটি পাকিয়ে বসে আছে লিজা।
-কেমন আর থাকবো ? আমার ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে এই বাসায়। ভাবছি সদরে বাসা ভাড়া নিবো। ওখান থেকে আমার আর তোমার ভাইয়ার কলেজ যাতায়াতে সুবিধা হবে।
নিপা হাসলো।
-তো সমস্যা কোথায় ? চলে যান আপনারা। এই বাড়িতে আরো দুটো লোক কমলে আম্মার জন্য ভালো হবে।আম্মারও বয়স হয়েছে। আর কত করবে ? ভালো তো, আমি নেই। আপনারা থাকবেন না। আব্বা তো থেকেও নেই। আমিও অপেক্ষা করছি নিরুর পরীক্ষার জন্য। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই ওকে আর আম্মাকে নিয়ে চলে যাবো আমি রাজশাহী।
বোনের কথা শুনে নজরুল হটাৎ খ্যাক খ্যাক করে উঠলো।
-তুই নিয়ে যাবি মানে ? এই শোন কী মনে করিস তুই নিজেকে ?
নিপা হেসে জবাব দিলো,
-না না আমি নিজেকে কিছু মনে করি না। তো আপনি নিয়ে যান আপনার সাথে আম্মাকে। হ্যাঁ সদরে বাসা নেবেন বললেন, সেখানে আম্মাকে সাথে নিয়ে যান।ভালো ডাক্তার দেখান। আর ছেলেরা হলো বাবা মায়ের নির্ভরতার জায়গা। তো আপনার কাছে থাকলেই আম্মা ভালো থাকবে।

লিজা ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে নিপার দিকে।এদিকে নিপার বাবা রেগে গিয়ে কী যেন একটা বলতে চেয়ে গলায় ভাত আটকে গেলো। এমনই অবস্থা হলো যে, লোকটা শেষ পর্যন্ত আর কথাই বলতে পারলো না। চোখ নাক মুখ দিয়ে জল ঝরে বিশ্রী একটা অবস্থা।নিপা আর নিরু দুবোন মিলে বাবাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেলো।নিপা বললো,
-আব্বা খাবার মুখে দিয়ে চিৎকার করা ঠিক না। আপনার বয়স হয়েছে। এখন বুঝে শুনে চলবেন। নইলে যে কোন সময় বড় বিপদ হবে।

লিজা খাবার খেয়ে নিজের ঘরের দিকে হনহন করে হাঁটা দিলো। ভীষণ রেগে আছে সে নিপার উপর। ঘরে ঢুকেই মুখ গোমড়া করে বিছানায় বসে পড়লো। নজরুল বউয়ের পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো।
-লিজু তুমি মন খারাপ করো না। জানোই তো নিপা একটা পাক্কা শয়তান ! সেই জন্যই তো ওর সংসার হয়নি। প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। আমরা কালই সদরে যাবো আর সুন্দর ছিমছাম বাসা দেখবো। শুধু দুজন থাকবো আমরা। বলো কত মজা হবে, তাই না? এই লিজু হাসো একটু!
স্বামীর বুকে মাথা রেখে লিজা যেন স্বস্তি পেলো।

নিপা অফিসে জয়েন করেছে। অনেক দিন পর ওকে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার সাধ্যমত চেষ্টা করছে সে। কলিগদের সহযোগিতাও ওকে মুগ্ধ করছে।দিনে অফিস আর রাতে মাস্টার্সের পড়া, সব মিলিয়ে খুব ভালো সময় যাচ্ছে ওর। মাস দু’য়েক পরই নিপার এমএ পরীক্ষা।কদিন আগে কুরিয়ারে মায়ের জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনে পাঠিয়েছে নিপা। এদিকে নিরুটার আবার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। সেও মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। মনে মনে পণ করেছে নিরু, আপার মতই হবে সে।

নজরুল আর লিজা বাসা ভাড়া নিয়ে দিব্যি সংসার করছে। দুই রুমের ছোট্ট বাসা। লিজা দু’মাস হলো কনসিভ করেছে। আহ্লাদে আটখান যেন নজরুল। স্বামী স্ত্রী মিলে কলেজে একসাথে যায় ওরা, আবার আসেও একসাথে।

এরই মধ্যে একদিন শুক্রবারে হটাৎ নজরুলের বাবা এলো প্রিয় ছেলের বাসায় বেড়াতে। বউমার জন্য নজরুলের মা নানান পদের খাবার রান্না করে পাঠিয়েছে।এত এত খাবার দেখেও লিজা একটি বারের জন্যও শাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো না। বরং শ্বশুরকে দেখে বেশ খুশি হলো। তারপর নিজ হাতে শ্বশুরের জন্য রান্নাবান্নায় মন দিলো। দুপুরে খেতে বসে আজব এক প্রস্তাব দিলো লিজা ওর শ্বশুরকে।
-বাবা আপনাকে কিন্তু বেশ বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে।
শ্বশুর কিছুটা চমকে গেলো।বউমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-কী মা, কী দায়িত্ব, বলতো শুনি।
লিজা গদগদ হয়ে বললো,
-বাবা আপনি তো আপনার ছেলেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তাই না ?
-হ্যাঁ তা ঠিক। নজরুল আমার ব্যাটা গো মা।ওর কোনো আবদার আজ পর্যন্ত আমি অপূর্ণ রাখিনি।
লিজা হেসে বললো,
-আপনার নাতি নাতনি হলে বাবা, আপনাকে কিন্তু আমাদের সাথে এই বাসায় থাকতে হবে। নইলে আপনার নাতি নাতনিকে দেখবে কে ? আমি, আপনার ছেলে কলেজে যাবো।কিন্তু কাজের লোকের কাছে তো বাচ্চা রেখে যেতে পারবো না বাবা। দেখলেন না, কিছুদিন আগে টেলিভিশনে দেখালো, একটা কাজের মেয়ে ছোট্ট বাচ্চাকে কিভাবে মারছে, আছাড় দিচ্ছে ! ওই যে ওই বাচ্চার বাবা অফিসে বসে সব দেখছিলো। মনে নেই ?
নজরুলের বাবা কখনো টেলিভিশনই দেখে না। তবুও ব্যাটার বউয়ের কথাই মাথা নাড়লো।
লিজা আবারো বললো,
-বাবা আপনার চালের আড়তের
যাবতীয় আপনি বরং আপনার ছেলেকে বুঝিয়ে দেন।বেসরকারী কলেজে পড়াই আমরা। আমি বরং কলেজের চাকরীটা করবো আর আপনার ছেলে আপনার ব্যবসা দেখবে। ভালো হবে না বাবা ? আর আপনি আমাদের সাথে থাকবেন। কত ভালো হবে !
নজরুলও, লিজার সাথে তালে তাল মিলিয়ে বললো,
-হ্যাঁ আব্বা আপনি বরং আস্তে আস্তে আপনার সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে দেন।বর্তমানে আমার টাকা কড়ির দরকার খুব। ক’টাকাই বা বেতন পাই ! এখন খরচও বেড়েছে। এই বাসার ভাড়াও দিতে হচ্ছে। আবার কাজের মেয়ের বেতন দিই। সামনে বাচ্চার খরচাপাতি আছে।

নজরুলের বাবার বুঝতে বাকি রইলো না ছেলে আর ছেলের বউয়ের সহজ করে বলা সবচেয়ে জটিল কথাগুলো। এই মেয়ের পেটে পেটে এত কুবুদ্ধি ! আর নজরুল ! সেতো তার নিজের সন্তান। সেও এখন ওর বউয়ের মত করেই কথা বলছে। এখনই বাবার সহায় সম্পদের দিকে নজর দিচ্ছে। বাবার জীবিত অবস্থায়। অথচ বোনদুটোর কথা মুখেও আনছে না। কোনরকমে দুপুরের খাওয়া শেষ করে নজরুলের বাবা বললো,
-নজরুল, আমি কিছুক্ষণ পরই বাড়িতে চলে যাবো। আর শোনো লিজা, তুমি আজ অনেক কথাই বললে। মারে, তুমি কী আমাকে একেবারেই বোকা মনে করেছো ? তোমার কথাবার্তা আমার একদমই ভালো লাগলো না। শোনো, তোমাদের যদি টাকার সমস্যা হয়, এই বাড়ির ভাড়া দিতে, কাজের লোকের বেতন দিতে যদি সমস্যা হয়, তবে তোমরা আমার বাড়িতে চলো। সেখানে তো সব ফ্রি। বাড়ির বউ বাড়িতে থেকে কাজে যাবে, এখানে কোন সমস্যা নেই। আর তোমাদের কলেজ থেকে মোটর সাইকেলে মাত্র আধা ঘন্টার রাস্তা আমার বাড়ি। বিয়ের আগে নজরুল সেভাবেই যেতো কলেজে।
লিজা কী যেন একটা কথা বলতে যাবে, অমনি ওর শ্বশুর ওকে হাতের ইশারায় থামালো।
-আমাকে কথা শেষ করতে দাও মা। শোনো, বাচ্চার বিষয়ে এখনই যত চিন্তা করছো তুমি, এটা কী সত্যি এত ভাববার বিষয় ? বাচ্চা হবার পর তুমি দিব্যি তোমার শাশুড়ির কাছে বাচ্চা রেখে কলেজে যেতে পারবে। এরচেয়ে বড় হেল্প আর কী হবে, বলো ? দাদী যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে নাতি নাতনিদের দেখবে, কেউ ওভাবে দেখবে না মা। হ্যাঁ আর একজন দেখে। নিজের মা দেখে। কিন্তু তোমার মাতো নেই মা। তুমি চলো আমাদের বাড়িতে।
লিজা ফট করে বললো,
-না না আম্মার কাছে কী রাখা যাবে, নাকি ? আম্মার কাছে থাকলে বাচ্চা মানুষ হবে না।
-নজরুলের মত অমানুষ হবে, তুমি ঠিকই বলেছো মা। ঠিকই বলেছো।

নজরুলের বাবা আর এক মুহূর্ত না বসে উঠে দাঁড়ালো। তার মাথার মধ্যে এখন অনেক কিছু চলছে। তাকে এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। স্ত্রী আর দুই মেয়ের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে হবে যে ! এই জীবনে তিনি স্ত্রীকে কখনো কোন বিষয়ে দুটো ভালো মন্দ কথা বলার সুযোগ দেননি। আসলে তিনি কখনো স্ত্রীকে মানুষই মনে করেননি। সব সময় মনে করেছেন ‘মেয়ে মানুষ’! আর বড় মেয়ের যে ক্ষতি হয়েছে তাতো অপূরণীয়। নাহ এখনই বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। ক্ষমা চাইতে হবে ওদের কাছে।

রাত প্রায় ন’টা বাজে। নিপার ফোনটা সুর করে বেজে চলেছে। মায়ের ফোন। ভাত খেতে খেতে এঁটো হাতেই ফোনটা রিসিভ করলো মেয়েটা।
-আম্মা আসসালামু আলাইকুম… আমি তো ফোন করতাম একটু পরে। শরীর কেমন আপনার? আব্বা ভাইয়া নিরু কেমন আছে ?
ফোনের অপর প্রান্তে কান্নার আওয়াজ। কার কন্ঠ !
-আব্বা ! আব্বা কী হয়েছে ? কী হয়েছে ?
নিপার আব্বা হাউমাউ করে কাঁদছে।
-মারে আমাকে ক্ষমা করে দিস। বড় অন্যায় করেছি তোর সাথে। ক্ষমা করে দিস আমাকে। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ও মা, একবার বাড়ি আসবি মা? তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
এমন দিনও নিপার জীবনে আসবে ! আজ মনে হচ্ছে এতদিন ধরে এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই ছিলো সে! বাবা একদিন ঠিক বুঝতে পারবে নিজের মেয়েকে। বুঝতে পারবে মেয়ের অন্তরের কষ্টকে। কষ্টগুলো তখন তাকেও যে ছুঁয়ে যাবে !

নিরু সকাল থেকে বাড়ি ঘর গোছাচ্ছে। মাকে কাজে সাহায্য করছে। আজ যে তার আপা, অফিস শেষ করেই বাড়ি আসবে। আর ওদিকে মেয়ের জন্য বারবার নিপার বাবা একবার বাড়ি, একবার বড় সড়কের পাশে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে।থেকে থেকেই মেয়েকে ফোন করে জানছে গাড়ি কতদুর।

বিকেল পাঁচটায় গেটলক বাসটা, বড় সড়কে এসে দাঁড়ালো। রাজশাহীতে পড়তে যাবার পর এই প্রথম নিপার বাবা মেয়েকে নিতে এসেছে। নিপা বাস থেকেই বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। নিপার চোখে জল। আনন্দাশ্রু বলে যাকে। এদিকে পাশের সীটের যাত্রী মেয়েটি ঘন ঘন নিপার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর কৌতুহল চাপতে না পেরে মেয়েটি বললো,
-আপনি কাঁদছেন কেন ? কোন সমস্যা হয়েছে কী ? আপনার কী কোন অসুখ করেছে ?
নিপা এবার হেসে দিলো।হেসে উত্তর দিলো,
-হুম অসুখ হয়েছিলো আপু। তবে তা সেরে গিয়েছে। আমার এখন কেবলই সুখ আর সুখ ! আমি আমার বাবাকে পেয়েছি। যে মেয়েদের পাশে বটবৃক্ষের মত ছাঁয়া দিয়ে বাবা মা থাকেন, তারা অসুস্থ হতেই পারে না। কখনো না !

জুবাইদা পারভীন লিপি
১১-৩-২০২১

#১ম পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/groups/pencilglobal/permalink/2945766625712002/?comment_id=2946076139014384&notif_t=group_comment&notif_id=1614840647670821&ref=m_notif

#২য় পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/groups/pencilglobal/permalink/2946076622347669/?comment_id=2946083539013644&notif_t=group_comment&notif_id=1614871935490019&ref=m_notif

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here